ভূতের মুখে রাম নাম

ভূতের মুখে রাম নাম

যে কোনও ভদ্রসন্তান স্তম্ভিত হবে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঝাড়া দশটি মিনিট গা-গা রব ছাড়বে। অপেক্ষাকৃত রোগাপটকা ভিরমি যাবে। খবরটা এমনই অবিশ্বাস্য।

মানুষের তৈরি বেঙ্গল ফ্যামিনের সময় এক অজানা কবি রচেন–

দেখো না আজব হ্যায়,
এ যেন ভূতের পায়
স্বস্তিবাচন
 করা নিবেদন।
এ যেন প্রেতের গায়
উদা উদা আতর মাখানো ভুরভুরে খুশবায়।
এ যেন দুখিনী মায়
 Amery-র কাছে শিশুটির তরে
ভিক্ষার চাল চায়।

খবরটা এর চেয়েও বিস্কুটে।

ফ্রানসের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ফ্লোবেরের(১) বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস মাদাম ভারি ফ্রাসে এখন থেকে ছাপা যাবে, বেচা যাবে বটে কিন্তু বিজ্ঞাপন দেওয়া তথা বইয়ের দোকানে পেটি রেখে খদ্দের আকৃষ্ট করা বেআইনি!

কেন?

বইখানা অ্যামরাল, ইমরাল (immoral) অর্থাৎ দুর্নীতিপূর্ণ, এক কথায় অশ্লীল। বইখানা লিখতে ফ্রোবেরের লেগেছিল পূর্ণ চারটি বছর কিঞ্চিৎ অধিক–১৮৫২ থেকে ১৮৫৬। প্লটটি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন তার পূর্বে তিনটি বছর। এই ছোট বইখানা লিখতে ফ্লোবেরের এতখানি সময় লাগল কেন? তার প্রথম কারণ, তিনি ছিলেন মাত্রাধিক পিটপিটে পারফেনিস্ট। বাস্তব জগতের পরিবেশ যেমন তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, (অন্য উপন্যাসে একটি রোমান ভোজের নিখুঁত বর্ণনা দেবার জন্য তিনি নাকি প্রাচীন ক্ল্যাসিক্স ঘটেন– কেউ বলে ছ মাস, কেউ বলে দু বছর)(২) ঠিক তেমনি তার স্বপ্নলোক কাগজকলমে মৃণয় করার সময় তিনি চাইতেন সেটা যেন বাস্তবের চেয়েও বাস্তব হয়, এবং সর্বশেষে প্রত্যেকটি বাক্য, প্রত্যেকটি সেনটেনস যতক্ষণ না তার নিখুঁত ভারসাম্য পায়, তার প্রত্যেকটি শব্দ অন্য শব্দগুলোর সঙ্গে মিলে গিয়ে যতক্ষণ না উন্নয়নাতীত হয়, নিটোল সুডৌল না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরের সেটেসে যেতেন না, কিংবা বলব, যেতে পারতেন না, যেন আগের সেটেনস্ তাকে জোর করে আঁকড়ে ধরে বলছে, আমাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়ে দিয়ে তবে তুমি এগোও।

এমন দিন বহুবার গেছে, যেদিন ফ্লোবের মাত্র একটি ছত্রের বেশি লিখতে পারেননি! এটা কিংবদন্তি নয়। নইলে চারশো পাতার বই লিখতে চারটি বছর লাগবার কথা নয়। এবং স্মরণ রাখা উচিত, ফ্লোবের যখন কোনও বই লিখতে আরম্ভ করতেন, তখন সেইটে নিয়েই অষ্টপ্রহর মেতে থাকতেন। পেটের ধান্দা তার ছিল না, তার দেখভাল করার জন্য লোকের অভাব ছিল না, তিনি চিরকুমার, প্রতিদিন নিয়মিতভাবে লেখার টেবিলে বসতেন, বাড়ি ছেড়ে পারতপক্ষে রাস্তায় পর্যন্ত নামতেন না, অথচ চল্লিশ বছর সাধনার ফলস্বরূপ তিনি লিখেছেন মাত্র খান-আষ্টেক বই।

মোটামুটি ভালো বই হলেই আমরা সেটাকে বলি রসোত্তীর্ণ, খেয়াল না করেই বলি পিস অব আর্ট, কিন্তু সত্য সত্য যদি কোনও একখানি বইকে শব্দার্থে পিস অব আর্ট বলতে হয় তবে সে বই মাদাম ভারি। এর সর্বোৎকৃষ্ট পরিচিতি লিখেছেন ফ্লোবেরের পুত্রপ্রতিম প্রিয়শিষ্য মোপাসাঁ। তাঁর ভুবনবিখ্যাত নেকলেস গল্পে পাঠক ফ্লোবেরের প্রভাব দেখতে পাবেন। বস্তৃত বভারি বেরুবার পর সে-যুগের ফরাসি কৃতী লেখকদের বড় কেউই এর প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পাননি। একমাত্র এরকম বইকেই পিস অব আর্ট বলা চলে। সিপাহি বিদ্রোহের বছরে এই কাব্য প্রকাশিত হয়– আজও নবীন লেখক নবীন পাঠক এ পুস্তকের শরণ নেন।

মোপাসাঁ তার গুরু সম্বন্ধে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। আজও যারা ফ্লোবের নিয়ে আলোচনা করেন তারা এ দুটি প্রবন্ধের বরাত না দিয়ে পারেন না।(৩) এছাড়াও তিনি কাগজে-কলমে ফ্লোবেরের মৃত্যুর পর তার হয়ে একাধিক লড়াই দিয়েছেন। এসব উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আইস, পাঠক, প্যারিস যাই।

কিন্তু প্যারিসের বর্ণনা দেবার মতো কোথায় আমার বীর্যবল, কীই-বা অধিকার! তাই আমার যেটুকু দরকার সেটুকু নিবেদন করি।

সেই ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে প্যারিস যত না কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি চেঁচিয়ে দুনিয়া ফাটিয়েছে, লিবেরতে (liberty), লিবেরতে, তুজুর (চিরন্তন) লা লিবেরতে। সে চিল্কারে মোহাচ্ছন্ন হয়েছেন গ্যেটে থেকে শুরু করে মিশর-ইন্ডিয়া পেরিয়ে চীন দেশের সুন ইয়াট সেন পর্যন্ত। ক্রমে ক্রমে তার বিকৃত রূপ দেখা দিল তার সামাজিক জীবনে তার আমোদ-আহ্লাদে। পুরীর নুলিয়ারা যে বড়ম্বর পরিপূর্ণ বস্তাভরণ পরিধান করে সমুদ্রে নামে, কিংবা আমাদের জেলেরা মাছ ধরার সময়, সেই পরে মেয়েরা প্যারিসে নৃত্যাদি আরম্ভ করলেন। এবং শুধু যে আপন-ভোলা নটরাজের জটার বাঁধন খুলে যায় তাই নয়, দিব্য সচেতন অবস্থায়– যাক গে, পূর্বেই বলেছি, যতখানি জ্ঞাতাস্বাদো বিপুলজঘনাং হলে পর প্যারিস বর্ণনের শাস্রাধিকার জন্মে, আমার ততখানি নেই।

এই বাতাবরণের মাঝখানে ফ্লোবের এতই সংযত সমাহিত যে, আজকের দিনের মডার্নরা তাঁকে রীতিমতো চেঁচিয়ে গালাগাল দেবেন, কাপ্রুs তোমার sহs নেই (কাপুরুষ! তোমার সাহস নেই– পাঠক সামবাজারের সসীবাবুর মত স-গুলো উচ্চারণ করবেন!)।

বইখানা পত্রিকায় কিস্তিতে কিস্তিতে বেরিয়ে পুস্তকাকারে ছাপা হবে এমন সময় ঘটল বিপর্যয়।

আল্লায় মালুম কোন শুকদেব ঠাকুরের সুপরামর্শে তখনও তো দ্য গল জন্মাননি– ফরাসি সরকার লাগিয়ে দিলেন ফ্লোবেরের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা। ফরাসি সরকারের শিক্ষা বিভাগ- মিনিস্ট্রি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন, ওই সময় থেকেই বোধহয় প্যারিসের যদো মেধা ওর নাম দেয়, মিনিস্ট্রি অব পাবলিক ডিস্ট্রাকশন।

ফ্লোবেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি বভারি পুস্তকের মাধ্যমে দেশের দশের নীতিধর্মের সর্বনাশ করছেন! সোজা বাংলায় তাঁর বইখানা অশ্লীল, কদর্য!!

অশ্লীল শব্দটা একথা শুনে হেসে উঠল না তো?

সেই যে-রকম ঢাকাতে সোয়ারি কম ভাড়া হাঁকলে রসিক কুট্টি কোচমান ফিসফিস করে বলে, আস্তে কন, কত্তা, ঘোড়ায় হাসব!

এবং কার মুখে এই অভিযোগ?

 প্যারিসের মুখে! তাজ্জব, তাজ্জব! গজব, গজব!!

প্যারিসিনির পরনে তখন কী? A la নুলিয়া নয় তো?

তাই বলছিলুম,

এ যেন প্রেতের গায়
 শানেল আর উ (h) বিগ মাখানো
 ভুরভুরে খুশবায়।

কিংবা রাষ্ট্রভাষায় :

আরে তেরা লড়কেকা
আজব তরে কা খেল
 চুচ্ছুন্দর কা সিরপর
চামেলি কা তেল!

(তোর ছেলেটার আজব কীর্তি! ছুঁচোর গায়ে মাখিয়েছে চামেলির তেল। কীরকম চামেলি? বাদল শেষে করুণ হেসে, যেন চামেলি কলিয়া!)।

পাঠক ভাবছেন, আমি রগড় দেখে, the uter absurdity of it ভূতের মুখে রামনাম শুনে বে-এক্তেয়ার হয়ে উচ্ছ্বসিত গঞ্জিকা বিলাস করছি?

আদৌ না। আর করলেও আমি আছি সত্যঙ্গে, ইন গুড কামপনি!

মোপাসাঁ মোকদ্দমার সাতাশ বছর পরে মসকরা করে বলেন, সরকারি পক্ষের উকিল যেভাবে ফ্লোবেরকে আক্রমণ করে বজ্রনির্ঘোষ বক্তিমে ঝাড়েন, একমাত্র সেই কারণেই তাঁর নাম মার্কামারা (marque) হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন, উকিল মসিয়োটি মোকদ্দমা আরম্ভের প্রাক্কালে তার নাম Pinard-টি– বদলালেন না কেন।(৪)

পিনার একরকম মদ। মোপাসাঁর বক্তব্য : বক্তিমে ঝাড়বি ঝাড়। হামলা করবি, কর। কিন্তু দোহাই ধর্মের, সাদা চোখে কর। পিনার–হুঃ ড়ি এলেন শ্লীলতা বাঁচাতে। এ যে দুঃশাসন এল নুলিয়াকে জোব্ব পরাতে।

এর পরও মোপাসাঁ আরেকখানা সরসে মাল ছেড়েছেন। কিন্তু হায়, সেটা তুলে দিলে লালবাজার চোখ লাল করেই ক্লান্ত হবে না!! দে উইল বি আফটার মাই রেড় ব্লাড!!!

———–

১. উচ্চারণ ফ্লো, তার পর ব্যার। ফ্লোব্যার লিখতে সাধারণ বাঙালি ফ্লোববার পড়ে বসতে পারে; সেটা হবে ভুল। ওইটে বাঁচাবার জন্য পূর্বসূরিগণ লিখতেন ফ্রোবেয়ার বা ফ্লোবের।

২. এদেশের উপন্যাসে প্রায়ই পড়ি, বিলিতি বড়সাহেব বা বিলেতফের্তা ন-সিকে এটিকেট-দুরস্ত সাহেব জুতো মস্ মস্ করে চলে গেলেন। জুতোজোড়া মস্ মস্ করলে এদেশের ট্যাশসায়েবও সেটা ভেজাছালার উপর রাতভর পেতে রাখে। সামান্যতম মস্ করলেও বন্ধুজন মস্করা করে বলে, দাম দাওনি বুঝি! বেচারি যে চিৎকার করে করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

৩. প্রবন্ধ দুটি বেরোয় মোপাসার চিঠি-চাপাটির (করেদাস) সঙ্গে সঙ্গে পুস্তকাকারে। এ পুস্তকে পাঠক পাবেন মোপাসাঁর অন্যান্য রচনা-সংগ্রহ। গল্পলেখক মোপাসাঁর খ্যাতি ব্যাল ল্যারিসৃৎ (রম্যরচনা তথা প্রবন্ধ-লেখক) মোপাসাকে এমনই ম্লান করে দিয়েছে যে, ফ্রান্‌সের বাইরে কেউ মোপাসার এসব লেখার সন্ধান বড় একটা করে না। এ পুস্তকে পাঠক পাবেন, বালজাক, জোলা, তুর্গেনিফ (একাধিক), সুইনবার্ন এবং অন্যান্য সম্বন্ধে প্রামাণিক প্রবন্ধ। এবং সবচেয়ে কৌতূহল উদ্দীপক পাঠক এতে পাবেন, মোপাস কোন আকস্মিক যোগাযোগের ফলে কথাসাহিত্যে প্রবেশ করেন। জোলার গ্রামের বাড়িতে একদিন গল্প বলার আর্ট, এবং সে আর্টের রাজা তুর্গেনিফ ও মেরিমে (চারু বাঁড়ুয্যে এর বই কলব আগুনের ফুলকি নাম দিয়ে প্রায় ৪৫ বছর হল অনুবাদ করেন) সম্বন্ধে কথা উঠলে জোলা প্রস্তাব করেন, সে মজলিশের সবাইকে একটি একটি করে গল্প বলতে হবে। গল্প বলেন জোলা, হোসমাস সেআর, এনিক এবং সবচেয়ে বড় কথা মোপাস স্বয়ং। সেই তাঁর প্রথম গল্প। সেটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় অন্যান্য গল্প-লেখকদের রচনাবলি সংগ্রহের সঙ্গে। যেহেতু জোলার বাড়ি ঘেঁদাতে গল্পগুলো বলা হয়, চয়নিকার নাম হয় মোর সোয়ারে। সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি মোপাস ফ্রাসে বিখ্যাত হয়ে যান। ফ্লোবের তখনও বেঁচে। আন্তরিক অভিনন্দন ও অকুণ্ঠ প্রশংসা জানালেন তরুণ লেখককে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, জোলার চাপে না পড়লে কী হত! কারণ এর পূর্বে মোপাসা নিজেই জানতেন না, কথাসাহিত্যে তিনি কী অভূতপূর্ব সৃজনীশক্তি নিয়ে জনুগ্রহণ করেছিলেন। মোপাসার চিঠি-চাপাটি ও প্রবন্ধাবলির পরিচয় আমি অন্যত্র অতি সংক্ষেপে দিয়েছি। এ বাবদে দুটি সংকলন আছে এবং যেহেতু এ দুটির ইংরেজি অনুবাদ আমার চোখে পড়েনি, তাই পুনরুল্লেখ প্রয়োজন বোধ করি :

1. Rene Dumesnil, chroniques, Etudes, Correspondance de Guy de Maupassant, publiees pour la premiere fois avec de nombreux documents inedits, Gruend, Paris 1938.

 2. Artine Artinian & Edouard Maynial, Correspondance inedite de Guy de Maupassant Wapler, Paris, 1951.

৪. ফ্লোবেরের মৃত্যুর পর জর্জ সাড় (George Sand)-কে লিখিত তার পত্রাবলির ভূমিকারূপে মোপাসাঁ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন, উদ্ধৃতিটি সেই প্রবন্ধ থেকে। সাড়, সড, সঁদ– এ তিনটেই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু দিল্লিবাসীর সদম্ভ প্রদত্ত ফতোয়া যে ইটি স্যান্ড়– কোথাও নেই। সাদামাটা a হরফটির উচ্চারণ একমাত্র ইংরেজি ছাড়া কোনও ভাষাতেই অ্যা হয় না। অবশ্য ai, au, ae বা a-র উপর দুটি ফুটকি থাকলে (উমলাউট) ভিন্ন কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *