ভূতের বিচার

ভূতের বিচার

প্রথম পরিচ্ছেদ 

আজ জেলায় জজসাহেবের আদালতে লোকের জায়গা হইতেছে না, এজলাস-ঘরটি এরূপ লোকারণ্য হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার মধ্যে প্রবেশ করা কাহার সাধ্য। প্রহরীগণ কিছুতেই লোকনিবারণ করিতে পারিতেছে না। 

আজ আদালত-গৃহ এরূপ লোকে লোকারণ্য কেন? সেই জেলার প্রসিদ্ধ দস্যু সর্দ্দার হানিফ খাঁর আজ বিচারের শেষ দিন। জজসাহেব তাহার মোকদ্দমার প্রমাণ প্রয়োগ পূর্ব্বে শুনিয়াছিলেন, আজ সেই মোকদ্দমার শেষ হুকুম প্রদান করিবেন। 

হানিফ খাঁ সেই প্রদেশীয় একজন অতি প্রসিদ্ধ ডাকাইত সর্দ্দার। পুলিস-কর্মচারীগণ তাহার দলস্থিত অনেক দস্যুকে অনেকবার ধরিয়াছেন, অনেক দস্যুকে অনেকবার জেলে দিয়াছেন, কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও হানিফ খাঁকে কয়েক বৎসর পর্য্যন্ত ধরিতে পারেন নাই। তাহার দলস্থিত লোক ধরা পড়িয়াছে ও জেলে গিয়াছে সত্য, কিন্তু এক দিবসের জন্য তাহার দল ভগ্ন হয় নাই, অপর লোক সংগৃহীত হইয়া সেই দল পরিপুষ্ট হইয়াছে। গত চারি পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত ওই প্রদেশে যত ডাকাইতি হইয়াছে, ডাকাইতির সঙ্গে সঙ্গে যতগুলি খুন হইয়াছে, তাহার প্রায় সমস্তই হানিফ খাঁর দলের দস্যুদিগের দ্বারা হইয়াছে, কিন্তু হানিফ খাঁ ধৃত হয় নাই। হানিফ খাঁর বিরুদ্ধে ডাকাইতি ও খুনি মোকদ্দমার প্রমাণও অনেক সময় সংগৃহীত হইয়াছে সত্য, কিন্তু বিশেষ চেষ্টা করিয়াও কেহ তাহাকে ধরিতে পারে না। 

পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ তাহাকে ধরিবার জন্য যে সকল যত্ন ও উদ্যম করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই ব্যর্থ হইয়াছে। 

ইহাকে ধরিবার জন্য গবর্ণমেন্টের অনেক অর্থ ব্যয়িত হইয়াছিল ও অনেক পুরস্কার ঘোষিত করা হইয়াছিল, কিন্তু সে সময়ে হানিফ খাঁ কোনরূপে ধৃত হয় নাই। সম্প্রতি তাহারই দলের একটি লোক কোন কারণ বশতঃ তাহার উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হয় ও জনৈক পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে সংবাদ দিয়া নিদ্রা যাইবার কালীন হানিফকে ধরাইয়া দেয়। নিম্ন আদালতে প্রথম তাহার মোকদ্দমার শুনানি হয়, পরিশেষে তাহার চূড়ান্ত বিচার হয়। পাঁচজন জুরির সাহায্যে জজসাহেব এই মোকদ্দমার বিচার করেন। বিচারক জজ সেই সময় একজন এদেশীয় ছিলেন। 

জজসাহেব সেই দিবস বিচারাসন গ্রহণ করিয়া অপরাপর দুই একটি সামান্য কার্য্য সম্পন্ন করিলেন, পরে হানিফ খাঁর মোকদ্দমা ডাকিলেন। জেলের একজন প্রধান কর্ম্মচারী কয়েকজন পুলিস-প্রহরীর সাহায্যে আসামীকে আনিয়া কাঠগড়ার ভিতর প্রবেশ করাইয়া দিলেন। বিচারালয় একেবারে নিস্তব্ধ হইল। জজসাহেব আসামীর দিকে লক্ষ্য করিয়া সজল নেত্রে ও ভগ্নকণ্ঠে কহিলেন “হানিফ খাঁ! জুরিগণ নিরপেক্ষ ভাবে তোমার মোকদ্দমার বিচার করিয়া ঠিক ন্যায়সঙ্গত ও যথাযথ অভিমত প্রকাশ করিয়া তোমাকে ডাকাইতি ও খুনি মোকদ্দমার দোষী সাব্যস্ত করিয়াছেন। আমিও তাঁহাদিগের মতের সম্পূর্ণ পোষকতা করিয়া আমার কর্তব্য-কর্ম্মের অনুরোধে বাধ্য হইয়া তোমাকে আইনের চরম দণ্ডে দণ্ডিত করিতেছি। তোমার উপর যতগুলি ডাকাইতি ও নরহত্যার প্রমাণ হইয়াছে, একব্যক্তি দ্বারা যে এতগুলি গুরুতর অপরাধ ঘটিতে পারে, তাহা আমি ইতিপূর্ব্বে কখন বিশ্বাস করি নাই। তোমার উপর বিচারালয়ের এই আদেশ হইতেছে যে, “যে পৰ্যন্ত তোমার প্রাণবায়ু বহির্গত না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত তোমার গলায় রজ্জু বেষ্টিত করিয়া তোমাকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলাইয়া রাখা হইবে।” 

হানিফ খাঁ জজসাহেবের আদেশ ধীর ভাবে শ্রবণ করিয়া, একটু হাসিল ও জজ সাহেবকে লক্ষ্য করিয়া কহিল “আপনি হিন্দু-বিচারক, আপনার ক্ষমতায় যতদূর কুলায়, তাহার শেষ পর্য্যন্ত আপনি দেখাইলেন, কিন্তু শুনিয়াছি, আপনাদিগের শাস্ত্রে ইহা কহে যে, মানুষ মরে না, তাহার আত্মা পুরাতন দেহ পরিত্যাগ করে মাত্র, ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে জজ সাহেব, আপনি জানিবেন, একদিবস আপনার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে, আজ আপনার ক্ষমতা আপনি দেখাইলেন, আর সেদিন আমার ক্ষমতা আপনি দেখিবেন।” 

হানিফ খাঁর কথা শেষ হইতে না হইতে জেলের সেই কর্ম্মচারী সাহেব তাহাকে আর সেই স্থানে থাকিতে দিলেন না, পুলিস-প্রহরীর সাহায্যে তাহাকে কাঠগড়া হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেলেন। 

হানিফ খাঁকে বিচার-গৃহ হইতে বাহির করিয়া লইয়া যাইবার পর, যে সকল দর্শক ওই ঘর পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহারাও একে একে ওই ঘর হইতে বহির্গত হইয়া গেল, কিন্তু উহাদিগের মধ্যে কাহাকেও কোনরূপে অসন্তোষ প্রকাশ করিতে দেখা গেল না; অধিকন্তু অনেকেই কহিল, হানিফ খাঁ যেরূপ কার্য্য এ পর্যন্ত করিয়া আসিতেছিল, আজ তাহার উপযুক্ত ফল সে পাইল। আজ হইতে আমাদিগের দেশ ঠাণ্ডা হইবে, ডাকাইতি একেবারেই বন্ধ হইয়া যাইবে। 

কেহ কহিল “পাপ করিয়া কতদিন বাঁচা যায়, উপরে একজন আছেন, তাঁহার নিকট হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ নহে।” 

এইরূপে নানা লোক নানা কথা বলিতে বলিতে আপনাপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল। দেখিতে দেখিতে যেস্থান লোকে লোকারণ্য ছিল, সেই স্থান একেবারে প্রায় জনশূন্য হইয়া পড়িল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

ক্রমে হানিফ খাঁর সময় পূর্ণ হইয়া আসিল, আজ তাহার ফাঁসীর দিন, অতি প্রত্যূষে সে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলিবে। তাহার ফাঁসী দেখিবার নিমিত্ত নানা লোকের সমাগম হইল। বিচারের শেষ দিবসে যেমন লোকের জনতা হইয়াছিল, আজও ক্রমে সেইরূপ লোকের সমাগম হইল! 

লোকের সমাগম হইল সত্য, কিন্তু জেলের বন্দোবস্তের গুণে ফাঁসীতে ঝুলিয়া মরিবার সময় কেহই তাহাকে দেখিতে পাইল না। 

ফাঁসী কাষ্ঠ কি? কিরূপে ফাঁসী দেওয়া হয়? তাহা পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই জানেন না। ফাঁসী কাষ্ঠকে ফাঁসী কাষ্ঠ না বলিয়া ইহাকে ফাঁসীমঞ্চ নামে অভিহিত করিলেই বোধ হয় ভাল হইত। কারণ উহা কাষ্ঠের একটা উচ্চ মঞ্চ বিশেষ, তাহার উপর হইতে রজ্জু ঝুলাইয়া দিবার বন্দোবস্ত আছে। ওই মঞ্চের উপর উঠিয়া যে তক্তার উপর দাঁড়াইতে হয়, তাহা এরূপ ভাবে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে যে, ইচ্ছা করিলেই উহার খিল ভিতর হইতে খুলিয়া দেওয়া যায়। যাহাকে ফাঁসী দেওয়া হইবে, তাহার আপাদমস্তক বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া ওই মঞ্চের উপর তোলা হয়। সে তাহার উপর দণ্ডায়মান হইলে ফাঁসী রজ্জু তাহার গলায় পরাইয়া দেওয়া হয় ও পূর্ব্বকথিত তক্তা, যাহার উপর সে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার খিল নিম্ন হইতে যেমন জল্লাদ খুলিয়া দেয়, অমনি সে ওই মঞ্চের ভিতর ঝুলিয়া পড়ে। ওই মঞ্চ এরূপ উচ্চ করিয়া নির্ম্মিত যে, ওই ব্যক্তি ঝুলিয়া পড়িলেই মৃত্তিকা হইতে তাহার পা অনেক দূর উচ্চে থাকে। ঝুলিয়া পড়িবামাত্র ওই রজ্জুর ফাঁস উহার গলায় এরূপ ভাবে আঁটিয়া যায় যে, তাহতেই তাহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া যায়। এইরূপে যাহাকে ফাঁসী দেওয়া হয়, সে ঝুলিয়া পড়িলে বাহির হইতে আর কেহই তাহাকে দেখিতে পায় না। যে রজ্জু তাহার গলদেশে আবদ্ধ থাকে, কেবল সেই রজ্জুর উপরিভাগ বাহির হইতে দুই চারিবার নড়িতে দেখা যায়। এইরূপে কোন ব্যক্তিকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলান হইলে তাহাকে শীঘ্র নামাইয়া ফেলা হয় না, সে বহুক্ষণ পর্যন্ত ওই রজ্জুতে লম্ববান থাকে, পরিশেষে তাহাকে নামাইয়া তাহার সৎকার করা হয়। 

হানিফ খাঁকেও ওইরূপে ফাঁসী দেওয়া হইল, তাহার আপাদমস্তক বস্ত্রে আবৃত করিয়া সেই মঞ্চের উপর উঠান হইল, তাহার গলায় রজ্জু পরাইয়া দেওয়া হইল, যে তক্তার উপর সে দাঁড়াইয়াছিল, তাহা ভিতর হইতে হঠাৎ খুলিয়া গেল। হানিফ খাঁ সজোরে তাহার মধ্যে ঝুলিয়া পড়িল, উপরের রজ্জুর দুই একবার নড়িল। ইহা দেখিয়াই একে একে সকলে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। সকলেই বুঝিল যে, হানিফ খাঁ এতদিন পরে ইহ জগৎ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। 

কেহ বা এই অবস্থা দেখিয়া দুঃখ প্রকাশ করিল, কেহ বা আনন্দিত হইল, কেহ বা তাহার উদ্দেশে সহস্ৰ গালি দিতে দিতে সেই স্থান পরিত্যাগ করিল। 

সকলেই জানিতে পারিল যে, হানিফ খাঁর মৃতদেহ সেই মঞ্চের মধ্যে রজ্জুতে লম্ববান রহিল। 

এইরূপ সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, সন্ধ্যার সময় জেলাময় প্রকাশ হইয়া পড়িল যে, হানিফ খাঁ ভূত হইয়াছে; যে রজ্জুতে তাহাকে ফাঁসী দেওয়া হইয়াছিল, ভূত হইয়া সেই রজ্জু হইতে আপন দেহ মুক্ত করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। সেই কথা প্রকাশ হইবার সঙ্গে সঙ্গে নানাস্থান হইতে নানা কথা উঠিতে লাগিল। কেহ কহিল, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া, জল্লাদকে মারিয়া ফেলিয়াছে; কেহ কহিল, যে জজসাহেব তাহার ফাঁসীর হুকুম দিয়াছিলেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া তাঁহার ঘাড় মটকাইয়া দিয়া আসিয়াছে। কেহ কহিল, যে পুলিস-কর্ম্মচারী তাহাকে ধরিয়াছিল, ভূত হানিফ খাঁ তাঁহাকে গাছের উপর হইতে ফেলিয়া দিয়াছে। কোন স্থানে কেহ কহিল, জেলের ভিতর একটি লোকও নাই, ভূতে একটি ঝড় তুলিয়া সকলকেই কোথায় উড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। এইরূপে যাহার মুখে যাহা আসিল, সে তাহাই কহিতে লাগিল ও প্রমাণ করিতে প্রবৃত্ত হইল যে, তাহার কথা মিথ্যা নহে। পাড়ায় পাড়ায়, পথে ঘাটে মাঠে, গাড়িতে কেবল ওইকথা; উহা ছাড়া আর কোন কথাই নাই। যাহারা হানিফ খাঁর ফাঁসী দেখিতে গিয়াছিল, তাহারা কেহই সন্ধ্যার পর আর ঘর হইতে বাহির হইল না। যাহারা তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, তাহারা আপনাপন স্ত্রী-পুত্রাদি লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল। বাতাসের শব্দে তাহারা ভয় পাইতে লাগিল। বৃক্ষ হইতে পত্রাদি পতনের সামান্য শব্দে তাহারা মনে করিতে লাগিল যে, বুঝি হানিফ খাঁর ভূত আসিতেছে। এইরূপে নিতান্ত অশান্তির সহিত সেই রাত্রি অতিবাহিত হইল। 

এই সকল জনরবের যে একেবারে কোন ভিত্তি ছিল না, তাহা নহে, প্রকৃতই একটি ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা হইতেই এই সকল জনরবের উৎপত্তি। 

যে দিবস প্রাতে হানিফ খাঁকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলান হয়, সেইদিবস বৈকালে তাহার মৃতদেহ ফাঁসী-রজ্জু হইতে নামাইবার জন্য যখন জেলের একজন প্রধান কর্ম্মচারী সেই স্থান গমন করিয়া, ওই ফাঁসী মঞ্চের ভিতর প্রবেশ করেন, সেই সময় দেখিতে পান যে, উহার মধ্যে কেবলমাত্র ফাঁসী-রজ্জু ঝুলিতেছে, হানিফ খাঁর মৃতদেহ আদৌ নাই। ইহা দেখিয়া প্রথমতঃ তিনি অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হন, কিন্তু পরক্ষণেই মনে করেন, হয় ত অপর কোন কর্মচারী ওই মৃতদেহ নামাইয়া লইয়া, সৎকারের নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছেন। যদি অপর কোন কর্মচারীর দ্বারা ওই কাৰ্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলেও উহা নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য হইয়াছে; কারণ তাঁহার আদেশ ব্যতীত ওই মৃতদেহ ফাঁসী-রজ্জু হইতে অবতরণ করান কাহারও ক্ষমতা নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ওই ফাঁসী মঞ্চের উপর যে প্রহরীর সেই সময় পাহারা ছিল, তাহাকে ডাকাইলেন ও জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন যে, তাহার পাহারাকালীন কোন ব্যক্তি উহার ভিতর প্রবেশ করে নাই, বা মৃতদেহ কেহই বাহির করিয়া লইয়া যায় নাই। 

তাহার নিকট এই অবস্থা অবগত হইয়া তিনি, ওই প্রহরীর পূর্ব্বে যাহার পাহারা ছিল, তাহাকে ডাকাইলেন। সেও ওইরূপ কহিল। তাহার পূর্ব্ববর্ত্তী প্রহরীও সেইরূপ বলিল। ক্রমে জেলের সকল কর্ম্মচারী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জেলের মধ্যে মহা হুলস্থুল পড়িয়া গেল, সকলেই ওই মৃতদেহের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, কিন্তু কেহই ওই মৃতদেহ বা তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। 

এই অবস্থা হইতেই ক্রমে এই কথা রাষ্ট্র হইয়া পড়িল যে, হানিফ খাঁর মৃত্যুর পর সে ভূতযোনী প্রাপ্ত হইয়াছে ও আপন শরীর লইয়া সেই স্থান হইতে কোথায় প্রস্থান করিয়াছে। 

অশিক্ষিত লোকগণ ক্রমে এই কথা বিশ্বাস করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, আর যাহারা শিক্ষিত বা যাহারা ভূত মানেন না, সেই সকল কৰ্ম্মচারিগণ, হানিফ খাঁর মৃতদেহের বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। 

জেলের প্রধান কর্ম্মচারী এই সংবাদ স্থানীয় পুলিসের প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিলেন। তিনিও সদলে .সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া হানিফ খাঁর মৃতদেহ বাহির করিবার নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। এইরূপ ক্রমে দিনের পর দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

এই ঘটনার প্রায় পনর দিবস পরে, সদর হইতে প্রায় দশ ক্রোশ ব্যবধানে একখানি ক্ষুদ্র পল্লিগ্রামে একটি ডাকাইতি হয়। যাহার বাড়ীতে ডাকাত পড়িয়াছিল, তাহার বাড়ীতে ইতিপূর্ব্বে আর একবার ডাকাইতি হইয়াছিল। হানিফ খাঁ তাহার দল-বলের সহিত ওই ডাকাইতি করিয়াছিল। যে সময় হানিফ খাঁ ধৃত হইয়া বিচারার্থ প্রেরিত হয়, সেই সময় তিনি হানিফ খাঁকে সনাক্ত করিয়াছিলেন ও বিচারকালে উভয় আদালতে তিনি তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্যও প্রদান করিয়াছিলেন। 

বর্তমান ডাকাইতির অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যখন পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ আগমন করেন, সেই সময় গৃহস্বামী যেরূপ এজাহার দিয়াছিলেন, অনুসন্ধানকারী পুলিস-কৰ্ম্মচারী তাহা তাঁহার ডাইরিভুক্ত করিয়া লন। তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন যে, রাত্রি প্রায় তিন প্রহরের সময় যখন তাঁহারা সকলে নিদ্রিত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ তাঁহার বাড়ীতে ডাকাইত পড়ে, ডাকাইতের সংখ্যা প্রায় ৫০ জনের কম নহে। তাহাদিগের মধ্যে তিনি হানিফ খাঁকে দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হন, ভাবেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়াও ডাকাইতি পরিত্যাগ করে নাই। যখন ভূতে ডাকাইতি করিতে আসিয়াছে, তখন তাহাদিগকে বাধা দেওয়া কৰ্ত্তব্য নহে; এই ভাবিয়া তিনি খিড়কী দরজা খুলিয়া সপরিবারে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া বাড়ীর সংলগ্ন একটি জঙ্গলের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেন। ডাকাইতগণ নির্বিবাদে ডাকাইতি করিয়া তাঁহার যথাসৰ্ব্বস্ব লইয়া প্রস্থান করে। 

অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী বাদীর এজাহারের এই অংশটুকু যদিও তাঁহার ডাইরিভুক্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু ভূতের দ্বারা যে ডাকাইতি হইয়াছে, এ কথা তিনি আদৌ বিশ্বাস করেন নাই; তিনি এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন যে, যাঁহার বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছে, তাঁহার বাড়ীতে হানিফ খাঁ ইতিপূর্ব্বে আর একবার ডাকাইতি করিয়াছিল, হানিফ খাঁর মোকদ্দমার তিনি সাক্ষ্য প্রদান করেন। এখন হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে, এই কথাও তিনি শুনিয়াছিলেন, ও ওই বিষয় মনে মনে আন্দোলন করিতে থাকেন। সুতরাং অন্ধকার রাত্রে ডাকাইতি করিবার সময় তিনি তাহাদিগকে দেখিয়া হতজ্ঞান হইয়া পড়েন ও বিবেচনা করেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া এই ডাকাইতি করিতেছে। যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে, তাহার দ্বারা এই কার্য্য কিরূপে সম্ভবপর হইতে পারে? 

পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ এই মোকদ্দমার অনেক অনুসন্ধান করিলেন, সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া অনেককে ধরিলেন, কিন্তু প্রকৃত আসামীর একজনও ধরা পড়িল না বা এই মোকদ্দমার কোনরূপ কিনারাও হইল না। 

এই ঘটনার পর ওই গ্রামে এক এক করিয়া আরও তিন চারিটি ডাকাইতি হইয়া গেল; কিন্তু ওই সকল মোকদ্দমায় হানিফ খাঁর নাম উল্লেখ হইল না বা হানিফ খাঁর ভূতকে যে আর কেহ দেখিয়াছে, এ কথাও কেহ বলিল না। 

 পুলিস নিয়মিতরূপে এই সকল ঘটনার অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু ইহার একটিরও কিনারা করিতে সমর্থ হইলেন না।

এইরূপে আরও কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। ওই গ্রামের লোকজন ক্রমে ক্রমে হানিফ খাঁকে বা তাহার ভূতকে ভুলিয়া যাইতে লাগিল। 

হানিফ খাঁর মৃতদেহ পুনঃ প্রাপ্ত হইবার আশায় জেলের ও পুলিসের কর্ম্মচারিগণ অনেক অনুসন্ধান করিয়াছিলেন এবং বিশেষ পারিতোষিক প্রদত্ত হইবে এরূপও ঘোষিত হইয়াছিল, কিন্তু কোনরূপেই ওই মৃতদেহের কোনরূপ সন্ধান হয় নাই। 

এইরূপে আরও কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর, সেই জেলার প্রধান পুলিস-কৰ্ম্মচারী একখানি পত্র পাইলেন। যে জজসাহেব হানিফ খাঁর মোকদ্দমার চূড়ান্ত বিচার করিয়া তাহাকে প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, ওই পত্রখানি তাঁহারই লিখিত। ইহার সার মর্ম্ম এই।– 

“গত রাত্রে আমার বাড়ীতে একটি ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছে। রাত্রিকালে আমি আমার ঘরে একাকী শয়ন করিয়াছিলাম, নিকটেই একটি আলো অল্প অল্প জ্বলিতেছিল, সেই সময় হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়, আমি চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখি, দুই জন লোক আমার ঘরে প্রবেশ করিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে যে অগ্রে ছিল, তাহাকে দেখিবা মাত্রই আমি চিনিতে পারি, সে হানিফ খাঁ। তাহার হস্তে একখানি তরবারি ছিল, সে আমাকে হত্যা করিবার মানসেই যে আমার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এই অবস্থা দেখিয়াই আমার মনে অতিশয় ভয় হইল, আমি নিমেষ মধ্যে আলোটা নিভাইয়া দিয়া একেবারে ঘরটি অন্ধকার করিয়া ফেলিলাম ও আমার পালঙ্কের অপর পার্শ্ব দিয়া অবতরণ পূর্ব্বক পালঙ্কের নিম্ন দিয়া ক্রমে গোছলখানায় উপস্থিত হইলাম ও উহার মধ্য দিয়া অন্ধকারে আপন দেহ লুকাইয়া বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ক্রমে উহার এক প্রান্তে গমন করিয়া কতকগুলি লতা-পাতার মধ্যে লুকাইয়া রহিলাম। আমি ঘর হইতে বহির্গত হইবার পরই আর এক ব্যক্তি মশাল হস্তে ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল ও উহারা আমার অনুসন্ধানও করিয়াছিল, কিন্তু আমাকে না পাইয়া উহারা ও উহাদিগের অনুচর যাহারা বাহিরে ছিল, তাহারা আমার গৃহস্থিত দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে। সেই সময় আমার পরিবারবর্গ ঘরে না থাকায় অলঙ্কার-পত্র ও বহুমূল্য দ্রব্যাদি বিশেষ কিছুই ঘরে ছিল না, কাজেই তৈজস-পত্র বা বস্ত্রাদি যাহা কিছু সম্মুখে পাইল, তাহাই লইয়া প্রস্থান করিল। মূল্যবান দ্রব্যের মধ্যে একটি সোণার ঘড়ী, চেন, চেনে সংলগ্ন একখানি মোহর, একটি আংটী ও কয়েকখানি রূপার বাসন অপহৃত হইয়াছে। উহারা যখন মশালের আলো জ্বালিয়া বাহির হইয়া যায়, তখন আমি উহাদিগের অনেককে উত্তমরূপে দেখিয়াছি, বোধ হয় চিনিলেও চিনিতে পারি। উহাদিগের মধ্যে আমি হানিফ খাঁর মূৰ্ত্তি স্পষ্ট দেখিয়াছি। সেই ওই দলের দলপতির কার্যে নিযুক্ত ছিল, কিন্তু আমি কিছুই বুঝিয়া উঠতে পারিতেছি না যে, যে ব্যক্তিকে ফাঁসী দেওয়া হইয়াছে, সেই ব্যক্তি পুনরায় কিরূপে আগমন করিল? ভূতপ্রেতের কথা আমি কখনও বিশ্বাস করি নাই, কিন্তু হানিফ খাঁকে দেখিয়া আমি কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার বাড়ীতে যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহাই আপনাকে লিখিলাম, এ সম্বন্ধে যদি কোনরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক বিবেচনা করেন, করিবেন। আমি যাহাকে দেখিয়া হানিফ খাঁ বলিয়া চিনিতে পারিয়াছি, সে প্রকৃত হানিফ খাঁই হউক বা তাহার ভূতই হউক, অথবা ‘ হানিফ খাঁর বেশধারী অপর কোন ছদ্মবেশী পুরুষই হউক, সে যে আমাকে হত্যা করিতে আসিয়াছিল, সে বিষেয় আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।” 

প্রধান পুলিস কর্মচারী সাহেব এই পত্র পাইয়া আর ক্ষণমাত্র স্থির থাকিতে পারিলেন না, তখনই তাঁহার অধীনস্থ উপযুক্ত পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণকে সঙ্গে লইয়া এই ঘটনার অনুসন্ধানে গমন করিলেন। 

ঘটনাস্থলে গমন করিয়া জজ সাহেবের বাড়ীর অবস্থা স্বচক্ষে দেখিলেন। দেখিলেন, যে, সেই বাড়ীতে প্রকৃতই ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে। সেই বাড়ীর নিকটে অপর কোন লোকের আবাসস্থান ছিল না। জেলায় সাহেবপাড়ায় যেরূপ বাঙলোয় সাহেবগণ বাস করিয়া থাকেন, ইহাও সেই প্রকারের বাঙলো, ময়দানের মধ্যে স্থাপিত। সুতরাং ডাকাইতি হইবার সময় পাড়ার লোকের কোনরূপ সাহায্য পাইবার উপায় নাই। ভরসার মধ্যে কেবল ভৃত্যগণ, তাহার মধ্যেও অনেকেই রাত্রিকালে সেই স্থানে থাকে না, পাড়ার ভিতর প্রায় সকলেরই থাকিবার স্থান আছে, রাত্রিকালে তাহারা সেই স্থানে গমন করিয়া থাকে ও পরদিবস প্রত্যূষে অপনাপন কাৰ্যে উপস্থিত হয়। 

সুতরাং নিকটবর্ত্তী কোন লোকজনের নিকট হইতে বিশেষ কোনরূপ অবস্থা তাঁহারা অবগত হইতে পারিলেন না। কেবলমাত্র একজন চৌকিদার কহিল, সে যখন চৌকি দিতে বাহির হয়, সেই সময় জজসাহেবের বাড়ীর দিকে মশালের আলো দেখিয়া ও লোকের কলরব শুনিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারে, জজসাহেবের বাড়ীতে ডাকাইত পড়িয়াছে। যদি সে কোনরূপে সাহায্য করিতে পারে, এই ভাবিয়া, সে সেইদিকে আসিতে থাকে, পথে দেখিতে পায়, ডাকাইতগণ ডাকাতি করিয়া সেইদিকেই ফিরিয়া আসিতেছে। সে একাকী, সুতরাং কোনরূপ উহাদিগের প্রতিবন্ধক না হইয়া লুক্কায়িত ভাবে রাস্তার একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হয়। দস্যুগণ তাহাকে অতিক্রম করিয়া গমন করিবার পর সেও দূর হইতে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করে, কিন্তু কিছুদূর গমন করিবার পরই উহারা তাহার দৃষ্টিপথের অতীত হইয়া চলিয়া যায়। 

ওই চৌকিদার আরও বলিয়াছিল যে, সে হানিফ খাঁকে উত্তমরূপে চিনে। সে তাহাকে ওই দলের সঙ্গে দেখিয়াছিল। ডাকাইতের দল দেখিয়া তাহার যত ভয় না হয়, ভূত দেখিয়া তাহার অতিশয় ভয় হয়, কারণ সে শুনিয়াছিল, হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে। ভূত দেখিয়া ও ভূতের ভয়ে অতিশয় ভীত হইয়াছিল বলিয়াই, সে সেই দলের সম্পূর্ণরূপ অনুসরণ করিতে পারে নাই। সে আরও বলিয়াছিল, ওই ভূতের দল একটি বাঁশবাগানের নিকট গমন করিবার পর কোথায় ডুবিয়া গেল, আর সে তাহাদিগকে দেখিতে পায় নাই। তাহার বিশ্বাস, ওই দলের সকলেই ভূত, উহারা বাঁশ-বাগানের ভিতর গিয়াই অন্তর্দ্ধান হয়। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

জজ সাহেবের বাড়ীতে ডাকাতির অনুসন্ধানের নিমিত্ত পুলিসের সর্বপ্রধান কর্মচারী হইতে সৰ্ব্বনিম্ন কৰ্ম্মচারী পৰ্য্যন্ত সকলেই বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে সকলেই হানিফ খাঁর দ্বারা যে ডাকাতি হইয়াছে, এ কথা বিশ্বাস করুন বা না করুন, কিম্বা ভূতের কথা বিশ্বাস করুন বা না করুন, জজসাহেবের বাড়ীতে যে ডাকাতি হইয়াছে ও তাঁহার বাড়ী হইতে যে অনেক দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, ইহা কিন্তু সকলকেই বিশ্বাস করিতে হইল। আরও বিশ্বাস করিতে হইল যে, ওই কাৰ্য্য ডাকাতের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। সেই সকল ডাকাত যাহারই হউক না কেন, তাহারা কিন্তু ভূত নহে, কারণ উহারা যদি ভূত হইত, তাহা হইলে কেবলমাত্র উৎপাত করিয়াই চলিয়া যাইত। চেন, ঘড়ী, আংটী, রূপার বাসন, কাপড় চোপড় প্রভৃতি দ্রব্যাদি ভূতে অপহরণ করিবে কেন? ওই সকল দ্রব্যে ভূতের প্রয়োজন কি? 

এই ডাকাতির কিনারা করিবার নিমিত্ত পুলিস কর্ম্মচারীগণ বিধিমতে চেষ্টা করিতে লগিলেন। দুইজন প্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী তাঁহাদিগের সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া এই ডাকাতির অনুসন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কিন্তু সহজে কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না, বা শীঘ্র যে তাহার একটা কিনারা হইবে, তাহারও কোন উপায় দেখিতে পাওয়া গেল না। 

এইরূপে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। একদিবস বেলা আন্দাজ দশটার সময় ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীদ্বয়, থানায় দারোগার নিকট বসিয়া এই ডাকাতি সম্বন্ধে কথাবার্তায় নিযুক্ত আছেন, এরূপ সময় একজন চৌকিদার একটি স্ত্রীলোককে লইয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগাবাবু সেই চৌকিদারকে কহিলেন “এই স্ত্রীলোকটির কি হইয়াছে?” 

চৌকিদার। এই স্ত্রীলোকটি কোন বিষয় আপনাকে জানাইতে ইচ্ছা করেন, তাই আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। দারোগা। কি বিষয় জানাইতে ইচ্ছা করে? 

চৌ। উহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই সমস্ত বিষয় জানিতে পারিবেন। 

দা। কি গো বাছা, কি হইয়াছে? 

স্ত্রী। আমরা আর ঘরে সুস্থ হইয়া বাস করিতে পারি না। 

দা। কেন? 

স্ত্রী। ভূতের অত্যাচারে। 

দা। ভূতের অত্যাচার আমরা কিরূপে নিবারণ করিব? আমরা তো ভূতের ওঝা নহি। কি হইয়াছে বল দেখি শুনি? 

স্ত্রী। গত রাত্রে আমি আমার ঘরে শুইয়াছিলাম, বাহির হইতে কে আমার দরজায় ধাক্কা দিল; আমি প্রদীপ হস্তে দরজা খুলিয়া দেখি, আমার ঘরের সম্মুখে সেই ভূত দাঁড়াইয়া। ওই ভূত দেখিয়াই আমি একেবারে অজ্ঞান হইয়া সেই স্থানে পড়িয়া গেলাম, আমার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। আমি কতক্ষণ ওইরূপ হতজ্ঞান অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয়াছিলাম, তাহা আমি জানি না। যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, আমার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহা নাই। ঘরের ভিতর আমার যে সকল বাক্স পেটরা ছিল, তাহা সমস্তই ভাঙা অবস্থায় পতিত রহিয়াছে, ও তাহার মধ্যে আমার যাহা কিছু ছিল তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। আমার বিশ্বাস, ওই ভূত ভিন্ন অপর কেহ আমার ওই সকল দ্রব্য অপহরণ করে নাই। আমার সমস্ত দ্ৰব্য যখন ভূতে লইয়া গিয়াছে, তখন আমার ঘাড়টি যে সে মটকাইয়া রাখিয়া যায় নাই, ইহাই আশ্চৰ্য্য! 

দা। তুমি বলিতেছ “সেই ভূত”! কোন্ ভূত? 

স্ত্রী। তাহা তো আপনারা সকলেই জানেন। যে ভূত কোটাল বৌর ঘাড় মটকাইয়া রাখিয়া গিয়াছিল; যে ভূত রাস্তার উপর বাঁশ ফেলিয়া সকলের যাতায়াত সময় সময় বন্ধ করিয়া দেয়; যে ভূত গাছের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া থাকিয়া সকলকে ভয় দেখাইয়া থাকে, ও সেই ভূত, সকলেই উহাকে চিনে। 

দা। উহার নাম কি? 

স্ত্রী। হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে, তাহা তো আপনারা সকলেই জানেন। ও সেই ভূত। 

দা। সে ভূত থাকে কোথায়? 

স্ত্রী। ভূত যে কোথায় থাকে তাহা কে জানে, কিন্তু প্রায়ই তো তাহাকে কেহ না কেহ দেখিতে পায়। 

দা। কোথায় ভূতকে দেখিতে পাওয়া যায়? 

স্ত্রী। আমাদের গ্রামে ও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সমূহে — মাঠের ভিতর, জঙ্গলের ভিতর, বাগানের ভিতর, পুকুরের ধারে প্রভৃতি যে সকল স্থানে লোকের যাতায়াত কম, প্রায় সেই সকল স্থানে কেহ না কেহ ওই ভূতকে দেখিতে পায়, ইহা তো প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায়। 

দা। তুমি ওই ভূতকে আমাদিগকে দেখাইতে পার? 

স্ত্রী। আমি স্ত্রীলোক, আমি কিরূপে ওই ভূত আপনাদিগকে দেখাইব; আপনারা চেষ্টা করিলেই, ওই সকল স্থানে কোন দিন না কোন দিন ভূতকে দেখিতে পাইবেন। কিন্তু সে যদি আপনাদিগের ঘাড় মটকাইয়া দেয়? 

ওই স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া পুলিস কৰ্ম্মচারীত্রয় ভূতের ব্যাপার বিশেষ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না, তবে এই মাত্র বুঝিলেন যে, যে চোর তাহার বাড়ীতে চুরি করিতে আসিয়াছিল, তাহাকে দেখিয়া ওই স্ত্রীলোকটী অতিশয় ভয় পাইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়ে। এই সুযোগে ওই চোর ইহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। 

স্ত্রীলোকটির কথা শুনিয়া দারোগাবাবু সেই চৌকিদারকে কহিলেন, এই স্ত্রীলোকটি যেরূপ ভূতের কথা বলিতেছে, তাহা তুমি শুনিয়াছ কি? 

চৌ। হ্যাঁ হুজুর, শুনিয়াছি। 

দা। এ কি সত্য কথা কহিতেছে? 

চৌ। হাঁ হুজুর, এ সব সত্য কথা কহিতেছে। আমার মহলে হানিফ খাঁ ভূত হইয়া আজ-কাল বড়ই অত্যাচার করিতেছে। 

দা। তুমি কি সেই ভূত কোন দিন দেখিয়াছ? 

চৌ। না, আমি নিজে একদিনও দেখি নাই। কিন্তু যাহারা যাহারা দেখিয়াছে, তাহাদেরই মুখে শুনিয়াছি। অনেকেই ভয় পাইয়াছে, এ কথা আপনি সেই স্থানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন। 

চৌকিদারের কথা শুনিয়া ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীদ্বয়ের মধ্যে একজন কহিলেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া যখন ওই সকল স্থানে নানারূপ অত্যাচার করিতেছে, এ কথা যখন ওই স্থানের স্থানীয় লোকদিগের বিশ্বাস, তখন একবার ওই স্থানে গিয়া একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখা মন্দ নহে। 

ইঁহার কথায় সকলেই অনুমোদন করিলেন। দারোগাবাবু ওই স্ত্রীলোকটির এজাহার লিখিয়া লইয়া তাহাকে কহিলেন “তুমি এখন ঘরে যাও, আমি একটি ভূতের ওঝার যোগাড় করিয়া তোমাদিগের বাড়ীতে যত শীঘ্র পারি গিয়া উপস্থিত হইব ও দেখিব, তোমার যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে, তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি কি না এবং যে ভূত তোমাদিগের গ্রামের লোকের উপর অত্যাচার করিতেছে, সেই ভূতকে ওই গ্রাম হইতে তাড়াইতে পারি কি না? 

দারোগা বাবুর কথা শুনিয়া চৌকিদার ওই স্ত্রীলোকটিকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

উহারা প্রস্থান করিবার পর দারোগাবাবু আহারাদি সমাপন করিয়া সেই স্থানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। বলা বাহুল্য, ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীদ্বয় ও তাঁহার সহিত সেই স্থানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া আসিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

ডিটেকটিভ কর্মচারীদ্বয়ের সহিত দারোগা বাবু সময় মত সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ওই স্ত্রীলোকটির বাড়ীতে গিয়া দেখিলেন, তাহার ঘর হইতে প্রকৃতই সিন্দুক, বাক্স ভাঙ্গিয়া দ্রব্যাদি কে চুরি করিয়াছে। আরও জানিতে পারিলেন, যে সকল গহনা ওই স্ত্রীলোকটির অঙ্গ হইতে অপহৃত হইয়াছে বলিয়া সে এজাহার দিয়াছে, সেই সকল অলঙ্কার সদা সর্বদাই সে পরিধান করিত, এখন তাহার গাত্রে সেই সকল অলঙ্কার নাই। 

এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া ভূতের প্রকৃত ব্যাপারটা কি তাহা জানিবার নিমিত্ত তিনি সেই গ্রামের ও নিকটবর্তী স্থানের অনেক লোককে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে অনেকেই ভূতের অত্যাচারের কথা বলিল। কেহ বলিল, সে একদিন বাঁশ-বাগানের ভিতর একঝাড় বাঁশের গোড়ায় ভূতকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছে। কেহ বলিল, একদিন সন্ধ্যার পর রাস্তা দিয়া গমন করিবার কালীন দেখিতে পায় যে, ভূতটি একটি গাছের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া আছে। তাহাকে দেখিয়া যেমন ওই ভূত সেই গাছ হইতে লাফ দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িবে, অমনি সে দৌড়াইয়া সেই স্থান হইতে পলায়ন করে। এইরূপ অনেকে ওই ভূত সম্বন্ধে অনেক কথা কহিল। কেহ বা কহিল, সে ভাল করিয়া দেখিয়াছে যে, উহার আকৃতি হানিফ খাঁর মত, কিন্তু লম্বা লম্বা হস্ত, লম্বা লম্বা অঙ্গুলি, লম্বা লম্বা পা বাড়াইয়া চলে। 

উহাদিগের নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, ওই মোকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে দারোগাবাবু সেই ডিটেকটিভ কর্মচারীদ্বয়ের সহিত সেই স্থানে প্রায় দশ পনর দিবস অবস্থিতি করিলেন। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ভূতের আর কোনরূপ অত্যাচারের কথা তাঁহার কর্ণ গোচর হইল না, বা নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহের কোন লোক ওই ভূতকে দেখিতে পাইল না, বা তাহার কথাও শুনিতে পাইল না। 

দারোগাবাবু ওই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিলেন সত্য, কিন্তু তাহার কোনরূপ কিনারা করিতে না পারিয়া, সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্বক আপন থানায় গমন করিলেন। বলা বাহুল্য যে, ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীদ্বয়ও তাঁহার সহিত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

তাঁহাদিগের সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর পুনরায় সেই গ্রামে সেই ভূতের উৎপাত আরম্ভ হইল। অনেকেই আবার সেই ভূতকে মাঝে মাঝে দেখিতে পাইল; অনেকেই আবার তাহার অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইল; অনেক স্থলেই পুনরায় সেই ভূতের দল ডাকাতি করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু ওই ভূতের দলের একটি ভূতও ধরা পড়িল না, বা জানিতে পারা গেল না যে, উহারা কাহারা? এইরূপে ওই গ্রামে পুনরায় অশান্তির আবির্ভাব হইল। 

এই সকল বিষয়ে ক্রমে জেলার প্রধান প্রধান কর্তৃপক্ষগণের দৃষ্টি আকর্ষিত হইল। যাহাতে ওই সকল অত্যাচারের প্রতিকার হয়, সকলেই তাহার বিশেষরূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। গ্রামের প্রধান প্রধান লোকদিগকে ডাকাইয়া, যাহাতে তাঁহারা পুলিসকে উপযুক্তরূপে সাহায্য প্রদান করেন, তাহার নিমিত্ত অনুরোধ করিলেন, ও পুলিস-কৰ্ম্মচারীদিগের মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া কয়েকজন কর্মচারীকে ওই কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। তাঁহাদিগের কার্য্যই হইল–ওই ভূতের দলের অনুসন্ধান করা ও ইহার নিগূঢ় তত্ত্ব আবিষ্কার করা। 

কর্ম্মচারিগণ আপনাপন কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়া ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। নানা স্থানে নানা লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, যাহাতে কোনরূপে ভূতের সন্ধান করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যে প্রকারের লোক নিযুক্ত করিলে তাহাদিগের দ্বারা এই সকল বিষয়ের সন্ধান হইতে পারে, প্রচুর পরিমাণে সরকারী অর্থ ব্যয় করিয়া সেই সকল লোককে নিযুক্ত করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু কেহই কোনরূপে কোন বিষয়ের বিশেষরূপ সন্ধান আনিয়া দিতে পারিল না। 

এই সকল কৰ্ম্মচারিগণের মধ্যে একজন কর্মচারী তাঁহার কার্য্যে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া মনে মনে বিশেষরূপ লজ্জিত হইলেন, কিরূপ উপায়ে তাঁহার অভিলষিত কাৰ্য্য সমাপন করিতে পারেন, একাগ্রমনে কেবল তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কোনরূপ উপায় স্থির করিতে না পারিয়া, একবার যে ব্যক্তি হানিফ খাঁকে ধরাইয়া দিয়াছিল, তাহার সাহায্য গ্রহণ করিতে মনস্থ করিলেন। তাহার ঠিকানা তিনি জানিতেন না, পুরাতন মোকদ্দমার কাগজপত্র হইতে তিনি তাহার ঠিকানা বাহির করিলেন। তিনি যে ওই ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, এ কথা অপর কোন কর্ম্মচারীকে বা থানার দারোগাবাবুকে পৰ্য্যন্ত বলিলেন না। তিনি নিজেই নিজের অভিলষিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। 

বহু চেষ্টায় আবেদ আলির সন্ধান পাইলেন। যে ব্যক্তি হানিফ খাঁ সম্বন্ধে সংবাদ দিয়া একবার তাহাকে ধরাইয়া দিয়াছিল, তাহারই নাম আবেদ আলি। আবেদ আলি পূৰ্ব্বে হানিফ খাঁর ডাকাইত দলের একজন ডাকাত ছিল। 

হানিফ খাঁ মরিয়া গিয়াছে, মরিয়া সে ভূতই হউক, বা অপর কিছু হউক, তাহার সম্বন্ধে এখনকার সংবাদ যে আবেদের নিকট পাওয়া যাইবে না, তাহা সেই কৰ্ম্মচারী বেশ জানিতেন। কারণ হানিফ খাঁকে ধরাইয়া দিবার পর, আবেদ আলি আর ওই দলের মধ্যে প্রবেশ করিতে সাহস করে নাই। কিন্তু কর্মচারী ইহা জানিতেন যে, আবেদ আলি যে সময়ে ডাকাইত দলভুক্ত ছিল, সেই সময়ে সেই দলে অপর যে সকল ডাকাইত ছিল, তাহাদিগকে নিশ্চয়ই সে চিনিত, ও যে যে স্থানে তাহারা বাস করিত, তাহাও সে জানিত। সুতরাং তাহার নিকট হইতে যদি ওই সকল লোকের নাম ও ধাম অবগত হইতে পারা যায়, এবং যদি তাহাদিগকে কোন না কোন উপায়ে ধরিতে পারা যায়, তাহা হইলে সম্প্রতি যে সকল ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার দুই একটির কিনারা হইলেও হইতে পারে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তিনি আবেদ আলিকে হস্তগত করিবার নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যতদিন পর্যন্ত আবেদ আলি তাহার নিজ গৃহকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে না পারে, ততদিন পর্যন্ত তিনি তাহার ও তাহার পরিবারবর্গের ভার সরকারী অর্থ হইতে চালাইবেন এবং তদ্ব্যতীত সময় সময় আরও দশ কুড়ি টাকা দিয়া, তাহাকে সম্পূর্ণরূপে হস্তগত করিয়া লইবেন। আবেদ আলিও সাধ্যমত সেই কর্ম্মচারীকে সাহায্য প্রদান করিতে সম্মত হইয়া, কখন একা, কখন বা তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল এবং সময় সময় পুরাতন দলের ডাকাইতদিগের মধ্যে কাহার কোথায় বাসস্থান তাহা সেই কর্ম্মচারীকে গোপনে দেখাইয়া দিতে লাগিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

এইরূপে আবেদ আলি কিয়দ্দিবস পর্যন্ত সেই কর্ম্মচারীর নিকট বিশেষরূপ সাহায্য পাইতে লাগিল। তাঁহাকে বিবিধরূপে পরীক্ষা করিয়া আবেদ বেশ বুঝিতে পারিল যে, ওই কর্মচারীর দ্বারা তাহার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই; অধিকন্তু সরকারী কার্য্যে সাহায্য করিতে গিয়া যদি সে কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হয়, তাহা হইলেও ওই কর্ম্মচারী তাহাকে বিপদ হইতে আশু উদ্ধার করিবেন। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সে একদিবস সেই কৰ্ম্মচারীকে কহিল “আমি আপনার নিকট হইতে অনেক অর্থ গ্রহণ করিয়াছি, কিন্তু এ পর্যন্ত আমি আপনার বিশেষ কোন কার্য্য করিয়া উঠিতে পারি নাই; ইহার নিমিত্ত আমি মনে মনে অত্যন্ত লজ্জিত আছি। এখন আমি স্থির করিয়াছি যে, অভাব পক্ষে পনর দিবসের মধ্যে একবার একাকী বহির্গত হইব। ইহার মধ্যে আপনি আমার কোনরূপ সংবাদ লইবার চেষ্টা করিবেন না। 

কৰ্ম্ম। তুমি কোথায় যাইবে? 

আবেদ। তাহা আমি এখন আপনাকে বলিব না, আর বলিবই বা কি? আমি যে কোথায় যাইব, তাহা আমি এখন নিজেই জানি না, ইচ্ছা করিয়াছি, আমি কোনরূপে আর একবার ডাকাইত দলের সহিত মিশিব, যদি কৃতকাৰ্য্য হইতে পারি, তাহা হইলে দলপতির সহিত সকলকেই ধরাইয়া দিয়া আপনার ঋণ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিব। 

কৰ্ম্ম। কতদিন পরে আবার দেখা হইবে? 

আবে। তাহা আমি এখন বলিতে পারি না। কিন্তু যতদিনই হউক না কেন, পনর দিনের মধ্যে আমি একবার আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব ও কতদূর কৃতকার্য্য হইতে পারিয়াছি, তাহার আমি আপনাকে বলিয়া যাইব। কিন্তু- 

কৰ্ম্ম। কিন্তু কি?– 

আবে। আমার পরিবারবর্গ? 

কৰ্ম্ম। তোমার পরিবারবর্গের নিমিত্ত তোমাকে ভাবিতে হইবে না, সে ভার আমার উপর রহিল, তাহাদিগের সংবাদ আমি সৰ্ব্বদা গ্রহণ করিব ও তাহাদিগের নিমিত্ত যাহা কিছু খরচ হইবে, তাহা এখন আমি যেরূপ ভাবে দিতেছি, সেইরূপ ভাবেই দিয়া আসিব; সে সম্বন্ধে তোমাকে আদৌ কোনরূপ ভাবিতে হইবে না। 

এই বলিয়া আবেদ আলি কর্ম্মচারীর নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। সে যে কোথায় গেল, কেহ জানিল না, বা কেহই বলিতে পারিল না। আট দশ দিবস কেহ তাহাকে আর সেই স্থানে দেখিতে পাইল না, বা তাহার কোনরূপ সংবাদও পাওয়া গেল না। দ্বাদশ দিবসে সে হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া সেই কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিল, ও কহিল, যে দলের দ্বারা আজ-কাল ডাকাইতি হইতেছে, আমি তাহার সন্ধান করিয়া আসিয়াছি, যদি অনুমতি হয়, আমি তাহার ভিতর গিয়া প্রবিষ্ট হই। 

কৰ্ম্ম। কিরূপে তুমি উহার ভিতর প্রবিষ্ট হইবে? 

আবে। উহাদিগের দলভুক্ত হইয়া উহাদিগের সহিত ডাকাইতি করিতে হইবে। 

কৰ্ম্ম। ডাকাইতি না করিলে তুমি কি উহাদিগকে ধরাইতে পারিবে না? 

আবে। না। 

কৰ্ম্ম। কেন? 

আবে। দলভুক্ত না হইলে উহারা আমার কথায় বিশ্বাস করিবে কেন? 

কৰ্ম্ম। আচ্ছা, তাহাই হইবে; কিন্তু এক কাজ করিতে হইবে। আমার কথা মত ডাকাইতি করিতে গিয়া যদি কোন গতিকে ধৃত হও, তাহা হইলে যাহাতে আমি তোমাকে বাঁচাইতে পারি, অগ্রে তাহার বিশেষ বন্দোবস্ত করিতে হইবে, পরে ডাকাইতি করিতে তোমাকে অনুমতি দিব। এখন বল দেখি, তুমি যে দলের কথা কহিতেছ, সেই দল এই স্থান হইতে কতদূরে অবস্থিতি করে? 

আবে। তাহারা নানা স্থানে বাস করে, কিন্তু কার্য্য করিবার সময় যেস্থানে সমবেত হয়, সেই স্থান এখান হইতে প্রায় চল্লিশ ক্রোশ দূরে। 

কৰ্ম্ম। তুমি ততদূর গিয়াছিলে? 

আবে। না যাইলে কার্য্য উদ্ধার করিব কিরূপে? 

কৰ্ম্ম। ওই দলের দলপতি কে? 

আবে। দলপতির কথা বলিবেন না, সে বড় ভয়ানক কথা। আমি যে হানিফ খাঁকে ধরাইয়া দিয়াছিলাম, সে মরিয়া ভূত হইয়াছে। ভূত হইয়াও সে আপন কার্য্য পরিত্যাগ করে নাই। সে এখনও ডাকাইত দলের দলপতি। সে দলপতির কার্য্য করে বটে, কিন্তু নিজে কিছুই গ্রহণ করে না। তাহার অংশে যাহা হয়, সে তাহা উড়াইয়া লইয়া গিয়া এক এক গ্রামের এক এক স্থানে ফেলিয়া দেয়, যে পায় সেই লয়, উহাতেই তাহার আমোদ। 

কৰ্ম্ম। তুমি তাহাকে দেখিয়াছ? 

আবে। দেখিয়াছি। 

কৰ্ম্ম। সে তোমাকে চিনিতে পারিয়াছিল? 

আবে। খুব পারিয়াছিল। 

কৰ্ম্ম। তুমি যে তাহাকে ধরাইয়া দিয়াছিলে, তাহার নিমিত্ত সে তোমাকে কিছু বলে নাই? 

আবে। না। আমি যে তাহাকে ধরাইয়া দিয়াছিলাম, তাহা সে জানিতে পারে নাই বা বুঝিতে পারে নাই। 

কৰ্ম্ম। তাহার চেহারা এখন কিরূপ? 

আবে। পূর্ব্বে যেরূপ ছিল, এখনও ঠিক সেইরূপ আছে, তবে পূর্ব্বের অপেক্ষা সে এখন কিছু কাহিল হইয়াছে। প্রভেদের মধ্যে, তাহার কথা একেবারে খোনা হইয়া গিয়াছে; এমন কি, তাহার কথা সহজে বুঝিয়া উঠিতে পারা যায় না। 

কৰ্ম্ম। তাহাকে দেখিয়া তোমার ভয় হইয়াছিল? 

আবে। দলের একজন লোক আমাকে সঙ্গে করিয়া তাহার নিকট লইয়া যায়, ভূতের কথা শুনিয়া প্রথমেই আমি অতিশয় ভয় পাইয়াছিলাম, পরে তাহাকে দেখিয়া আমি এরূপ ভীত হইয়া পড়ি যে, কিছুক্ষণ পর্যন্ত আমার সংজ্ঞা থাকে না। পরে যখন আমার সংজ্ঞা হয়, তখন তিনি আমাকে কহেন “তোমার কোন ভয় নাই, দলের কোন লোকের আমা হইতে কিছুমাত্র ভয় নাই, আমার দ্বারা তাহাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হওয়া দূরে থাকুক, অপর কেহ তাহাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট করিতে পারিবে না। যে কোনরূপে অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিবে, আমি জানিতে পারিলেই, তাহার ঘাড়টি মটকাইয়া রাখিয়া আসিব। তুমি আমার দলে বহুদিন ছিলে, যাও, পুনরায় দলভুক্ত হও। এই কথা বলিয়াই তিনি সেই স্থান হইতে অন্তৰ্দ্ধান হইলেন, আর তাঁহাকে সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না। 

কৰ্ম্ম। কোন্ স্থানে তোমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল? 

আবে। একটি প্রকাণ্ড মাঠের মধ্যস্থলে বৃহৎ ও বহু পুরাতন একটি অশ্বত্থবৃক্ষ আছে, তাহার নিকট একটি বৃহৎ পুষ্করিণী, ওই পুষ্করিণীর চতুষ্পার্শ্বে ভয়ানক জঙ্গলে আবৃত, দিনমানে ওই স্থান বাঘ ভালুকের আবাস-স্থল, কোন লোক ভুলক্রমেও সেই স্থানে যায় না, সকলেই জানে, ওই স্থানে ওই অশ্বত্থ গাছের উপর যত ভূতের আবাস-স্থল। 

কৰ্ম্ম। ওই স্থান তুমি আমাদিগকে দেখাইতে পারিবে?” 

আবে। তাহা পারিব না কেন? 

কৰ্ম্ম। তোমার কি অনুমান হয় যে, ওই ভূত ওই স্থানেই বাস করিয়া থাকে? 

আবে। তাহা আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। ভূতের বাসস্থানের ঠিক কি? 

কৰ্ম্ম। এ বিষয়ে তোমাকে উত্তমরূপে সন্ধান করিতে হইবে। 

আবে। আমি তো তাহারই চেষ্টায় আছি, কিন্তু উহাদিগের সহিত ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত না হইলে উহারা আমাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিবে কেন? 

কৰ্ম্ম। আমি তোমাকে সে বন্দোবস্ত করিয়া দিতেছি, তাহার জন্য তোমার কোন চিন্তা নাই। এখন তুমি তোমার বাড়ীতে যাও, কল্য আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও। 

আমার কথা শুনিয়া আবেদ আলি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, আমি আমার উর্দ্ধতন কর্মচারী ও সেই জেলার সর্বপ্রধান বিচারককে সমস্ত কথা বলিলাম; তাঁহারা অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিলেন, ওই উপায়ে যদি ডাকাইতের দল ধরা পড়ে, তাহা হইলে ক্ষতি নাই। কিন্তু পূর্ব্ব হইতেই এরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে যে, ডাকাইতি করিবার সময় সকলকে ধৃত করিতে হইবে। 

পরদিবস প্রত্যূষে আবেদ আলি আসিয়াই সেই কৰ্ম্মচারীকে কহিল “কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে সমর্থ হইয়াছেন কি?”

কৰ্ম্ম। হাঁ, তুমি অবলীলাক্রমে ডাকাইতের দলে মিশিতে পার। 

আবে। আর ডাকাইতি? 

কৰ্ম্ম। তাহাও করিতে পারিবে, কিন্তু একটি কথা আছে। 

আবে। কি? 

কৰ্ম্ম। এরূপ কোন উপায় করিতে হইবে যে, ডাকাইতি করিবার সময় যাহাতে আমরা উহাদিগকে ধরিতে পারি।

আবে। যদি আপনারা তাহা করিতে চাহেন, তাহা হইলে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইলেও আমি তাহার বন্দোবস্ত করিব। কিন্তু ওইরূপে কার্য্য করিতে আমি নিষেধ করি। 

কৰ্ম্ম। কেন নিষেধ কর? 

আবে। তাহাতে উভয় পক্ষে অনেক খুন জখম হইবার সম্ভাবনা। 

কৰ্ম্ম। তাহা জানি, কিন্তু এই স্থানের সর্বপ্রধান বিচারপতির ওইরূপ ইচ্ছা। 

আবে। যদি তাঁহার ওইরূপ ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে সেইরূপই বন্দোবস্ত করিব। 

কৰ্ম্ম। আমরা অগ্রে কিরূপে জানিতে পারিব যে, কবে ও কোন্ সময় এই কাৰ্য্য হইবে? 

আবে। তাহা হইলে এক কার্য্য করিতে হইবে। আমার সহিত একটি বিশ্বাসী লোক দিতে হইবে, আর একজন দ্রুত অশ্বারোহীরও যোগাড় করিতে হইবে। যে গ্রামে বসিয়া যে সময় ডাকাইতি করিবার সমস্ত ঠিক হইবে, আমি সেই বিশ্বাসী লোককে সেই গ্রামের কোন স্থানে রাখিয়া দিব। যেমন ডাকাইতির স্থান ও সময় স্থির হইবে, অমনি আমি তাহাকে সেই সংবাদ প্রদান করিব। অশ্বারোহীকে কোন দূরবর্তী গ্রামে থাকিতে হইবে। লোক ওই সংবাদ অশ্বারোহীকে প্রদান করিলে, সে দ্রুত অশ্বচালনা করিয়া আপনার নিকট আগমন পূর্ব্বক ওই সংবাদ প্রদান করিবে, তখন আপনারা সদলবলে ডাকাইতির স্থানে উপস্থিত হইয়া ডাকাইতি করিবার সময় আমাদিগকে ধরিবেন। যদি এইরূপ বন্দোবস্ত করিতে পারেন, তাহা হইলে কার্য্যসিদ্ধ হইতে পারিবে, কিন্তু বিশেষ বিশ্বাসী লোক না হইলে সকল কাৰ্য্য নষ্ট হইয়া যাইবে ও আমাদিগের সমস্ত মন্তব্য প্রকাশ হইয়া পড়িবে, তাহা হইলে পরিশেষে আর কোন কাৰ্য্যই সহজে সম্পন্ন হইবে না। 

আবেদ আলির কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী বুঝিতে পারিলেন যে, সে যাহা বলিতেছে, তাহা যুক্তিসঙ্গত। এখন ওইরূপ বিশ্বাসী লোক ও অশ্বারোহী কোথায় পাওয়া যাইবে? 

এ সম্বন্ধে ওই কৰ্ম্মচারী তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর সহিত পরামর্শ করিলেন ও পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, ওই কৰ্ম্মচারীই আবেদ আলির সহিত গমন করিবেন ও জেলার অশ্বারোহী পুলিসের যিনি নেতাও তিনি অশ্বারোহণে গমন করিয়া নিকটবর্ত্তী কোন গ্রামে অপেক্ষা করিবেন। 

ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া যাহা সাব্যস্ত হইল, তিনি তাহা আবেদ আলিকে কহিলেন। আবেদ আলি ওই প্রস্তাবে সম্মত হইয়া পুনরায় তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। এবার সেই কর্ম্মচারীও তাহার সহিত গমন করিলেন। তিনি দূরে দূরে থাকিয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলেন। যে গ্রামে যেরূপ ভাবে অবস্থিতি করিলে তাঁহার উপর অপর কাহারও কোনরূপ আদৌ সন্দেহ হইতে না পারে, সেইরূপ ভাবে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। কর্ম্মচারী ভদ্রলোক সুতরাং ভদ্রবেশেই তাঁহাকে নানা গ্রামে গমন করিতে হইল; সকল স্থানেই তিনি স্কুল ও পাঠশালা-পরিদর্শক বলিয়া আত্ম-পরিচয় প্রদান পূৰ্ব্বক স্কুল বা পাঠশালা পরিদর্শন করিতে গমন করিতে লাগিলেন, যে সকল গ্রামে দুই চারি দিবস অবস্থিতি করিতে হইল, তিনি পীড়িত হইয়াছেন বলিয়া সেই সেই স্থানে অবস্থিতি পূৰ্ব্বক সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। 

অশ্বারোহী ওই প্রদেশে ঘোড়া ও গরু খরিদ করিতে আসিয়াছেন, এই পরিচয়ে নানা স্থানে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। কোন কোন স্থানে গরু বা ঘোড়া খরিদ করিবার জন্য বায়নার স্বরূপ তাহাদিগকে কিছু কিছু অর্থও প্রদান করিতে লাগিলেন। 

এই প্রকার আবেদ আলি ও তাহার সমভিব্যাহারী কর্মচারীগণ আপনাপন কার্য্য উদ্ধার মানসে দিন যামিনী অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

আবেদ আলি ও কর্ম্মচারীদ্বয় জেলা হইতে বাহির হইয়া যাইবার পর জেলার সর্বপ্রধান পুলিস-কৰ্ম্মচারী ও সর্ব্বপ্রধান বিচারক সাহেব সমস্তই প্রস্তুত করিয়া রাখিলেন; সংবাদ পাইবামাত্র তাঁহার স্বদলবলে গমন করিতে পারিবেন, কালমাত্র বিলম্ব হইবে না, এরূপ সমস্তই ঠিক রহিল ও উহাও স্থির রহিল যে, তাঁহারা নিজেই ওই কার্য্যে গমন করিবেন। 

জেলার সমস্ত কর্ম্মচারীই বুঝিতে পারিল যে, কি একটি ঘটিবে, বোধ হয়, কোন স্থানে দাঙ্গা হইবার সম্ভাবনা আছে, তাই সিপাহি শাস্ত্রী সৰ্ব্বদা প্রস্তুত থাকে। কিন্তু কেন যে প্রস্তুত থাকে, তাহা সঠিক কেহই অবগত নহে; যাহারা প্রস্তুত থাকে, তাহারাও বলিতে পারে না কি কার্য্যে কোথায় গমন করিতে হইবে? 

এইরূপে প্রায় ১০ দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এদিকে সৰ্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীগণ আপনার দলবলের সহিত সশস্ত্র প্রস্তুত হইয়া রহিলেন। অপর দিকে আবেদ আলি সমভিব্যাহারী কৰ্ম্মচারী ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরিতে লাগিল। 

একাদশ দিবসের দিন আবেদ আলি আসিয়া সেই কর্ম্মচারীকে সংবাদ প্রদান করিল যে, আগামী কল্য স্থির হইবে যে, কোন্ গ্রামে ও কাহার বাড়ীতে ডাকাইতে হইবে। পর দিবস রাত্রি নয়টার সময় আসিয়া পুনরায় সংবাদ প্রদান করিল যে, সেই রাত্রেই বারটার পর উহারা ডাকাইতি করিবে। যে গ্রামে ডাকাইতি হইবে, সেই গ্রামের নামও বলিয়া দিল, কিন্তু কাহার বাড়ীতে যে ডাকাইতি হইবে, তাহা বলিতে পারিল না। কারণ যাহার বাড়ীতে ডাকাইতি হইবে, সংবাদদাতা তাহার নাম বলে নাই, সে সঙ্গে গিয়া ওই বাড়ী দেখাইয়া দিবে। 

এই সংবাদ প্রদান করিয়াই আবেদ আলি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

যে স্থানে ডাকাইতি হইবে, সেই স্থান ওই স্থান হইতে প্রায় পাঁচ ক্রোশ ও সেই স্থান হইতে জেলাও প্রায় পাঁচক্রোশ দূরে। সংবাদপ্রাপ্তির স্থান হইতে জেলাও ৭ ক্রোশের কম নহে। এখন ৭ ক্রোশ পথ গমন করিলে, জেলায় সংবাদ পৌঁছিবে। সেই স্থান হইতে পাঁচ ক্রোশ পথ গমন করিলে, যে গ্রামে ডাকাইতি হইবে, সেই গ্রামে উপস্থিত হইতে পারা যাইবে। এদিকে সময় ৩ ঘণ্টা মাত্র। এত অল্প সময়ের মধ্যে কর্ম্মচারিগণ সেই স্থানে উপস্থিত হইতে পারিবেন কি না, বলা যায় না। যাহা হউক, ওই কর্ম্মচারী সেই অশ্বারোহীকে তখনই সংবাদ প্রদান করিলেন, তিনি দ্রুতবেগে অশ্ব চালনা করিয়া কোন গতিকে রাত্রি ১২টার সময় জেলায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিলেন। এদিকে কৰ্ম্মচারীও যে গ্রামে ডাকাইতি হইবার কথা, সেই গ্রামাভিমুখে গমন করিলেন। 

জেলায় কৰ্ম্মচারিগণও প্রস্তুত ছিলেন, তাঁহারাও সংবাদপ্রাপ্তিমাত্র অশ্বারোহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। অপর যে কয়েকজন অশ্বারোহী পুলিস ছিল, তাঁহারাও তাঁহাদিগের সহিত গমন করিতে লাগিলেন। ওই দলের নেতা, যিনি সংবাদ লইয়া আসিয়াছিলেন, তিনিও তাঁহার অশ্ব পরিত্যাগ করিয়া অপর আর একটি অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক তাহাদিগের সহিত গমন করিলেন। এইরূপে অশ্বারোহীর সংখ্যা দশ জনের অধিক হইল না। অপরাপর কর্মচারিগণ প্রায় একশত অস্ত্রধারী পুলিস প্রহরী সমভিব্যাহারে পদব্রজে তাঁহাদিগের অনুসরণ করিলেন। কিন্তু অশ্বারোহীগণের সহিত একত্রে গমন করিতে পারিলেন না, তাহাদিগের অনেক পশ্চাতে পড়িলেন। 

সৰ্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারীদ্বয় অস্ত্রধারী অশ্বারোহীর সহিত যখন সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন ডাকাইতি, প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে, অথচ তাঁহাদিগের অনুচরগণ তখনও পর্যন্ত উপস্থিত হইতে পারেন নাই। জেলার দুইজন প্রধান ইংরাজ কৰ্ম্মচারী যখন ডাকাইতির সময় সেই স্থানে গিয়া, উপস্থিত হইলেন, তখন তাঁহাদিগের সাহায্যকারী নিতান্ত অল্প হইলেও তাঁহারা স্থির থাকিবার লোক নহেন। এইরূপ অবস্থায় যদি কেবল একজন ইংরাজ কর্মচারীও বিনা সাহায্যে আসিয়া উপস্থিত হইতেন, তিনিও চক্ষের উপর উহা দেখিতে পারিতেন না। ইংরাজের স্বভাব সেরূপ নহে। এ ক্ষেত্রে দুইজন প্রধান ইংরাজ কৰ্ম্মচারী দশজন সশস্ত্র অনুচরের সহিত উপস্থিত। ডাকাইতের সংখ্যা যতই হউক না কেন, আপন প্রাণের উপর মায়া করিয়া তাঁহারা কখনই স্থির থাকিতে পারেন না। 

ইংরাজ কর্মচারীদ্বয় ওই দশজন অনুচর লইয়াই উহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। অন্য আক্রমণ নহে, উহাদিগকে একেবারে গুলি করিতে আদেশ দিলেন। একেবারে দ্বাদশ বন্দুকের আওয়াজ হইল। ডাকাইত দলের মধ্য হইতেও বন্দুকের শব্দ হইতে লাগিল। বন্দুকের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ডাকাইতগণ তাহাদিগের মশাল প্রভৃতি যে সকল আলো ছিল, তাহা একেবারে হঠাৎ নির্ব্বাপিত করিয়া দিল। সুতরাং সেই স্থান একবারে অন্ধকারময় হইয়া পড়িল; গুলি সকল শন্-শন্ শব্দে ছুটিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, সেই স্থান একেবারে জনশূন্য, অন্ধকারের আশ্রয় লইয়া ডাকাইতগণ পলায়ন করিয়াছে। 

পরে জানিতে পারা গিয়াছিল, আবেদ আলিও ওই ডাকাইতদিগের সঙ্গে আগমন করিয়াছিল। সে জানিত যে, ডাকাইতি করিবার সময় গোলযোগ হইবে, সুতরাং সে বাড়ীর ভিতরে না গিয়া বাহিরে ঘাঁটি আগলাইতে লাগিল। অশ্বারোহীকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া সাঙ্কেতিক শব্দে উহাদিগকে সংবাদ দিয়া আবেদ নিজের কার্য্য শেষ করে ও তথা হইতে প্রস্থান করে। 

ডাকাইতগণ প্রস্থান করিবার পর আলো জ্বালাইয়া ঘটনাস্থল উত্তমরূপে পরীক্ষা করিবার সময় পূৰ্ব্ব-কথিত সংবাদ সংগ্রহকারী কর্ম্মচারীও সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘটনাস্থলে অনুসন্ধান করিয়া দুইটি মৃতদেহ পাওয়া গেল। বন্দুকের গুলি উহাদিগের বক্ষঃস্থল ভেদ করায় তাহাদিগের মৃত্যু হইয়াছে। যাহাদিগের মৃতদেহ পাওয়া গেল, তাহারা ওই গ্রামের লোক নহে, বা ওই গ্রামের কোন লোকও তাহাদিগকে চিনিতে পারিল না। সুতরাং ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, ওই দুই ব্যক্তি ডাকাইতের দলের লোক; পুলিসের গুলিতে মরিয়া গিয়াছে। 

ডাকাইত দলের মধ্যে হইতে যে সকল গুলি ছুড়িয়াছিল, তাহাতে পুলিসের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নাই, কেবলমাত্র একটি অশ্ব সামান্যরূপ আহত হয়। পদাতিক কর্ম্মচারিগণ যখন আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন সমস্তই শেষ হইয়া গিয়াছিল। 

ডাকাইতগণ অন্ধকারের আশ্রয়ে সেই স্থান হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং কোন্ দিকে ও কিরূপ অবস্থায় তাহারা প্রস্থান করিয়াছিল তাহা জানিতে না পারায় অশ্বারোহীগণ তাহাদিগের অনুসরণ পর্য্যন্ত করিতে সমর্থ হয় নাই। 

এইরূপে বিফল মনোরথ হইয়া ইংরাজ প্রধান কর্মচারীদ্বয় নিতান্ত ক্ষুব্ধ মনে আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলেন। সময় মত আবেদ আলি আসিয়া সেই কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিল ও যেরূপে তাহারা ওই ডাকাইতি করিয়া পলায়ন করিয়াছিল, তাহার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট বিবৃত করিল। আরও কহিল যে, সেই ভূত, এবারও দলপতি হইয়া ওই ডাকাইতি করিতে গমন করিয়াছিল। কিন্তু আক্রান্ত হইয়া সকলে যখন পলায়ন করিয়াছিল, সেই সময় হইতে ওই দলপতিকে আর কেহই দেখিতে পায় নাই। ডাকাইতি করিয়া যে সকল দ্রব্যাদি আনা হইয়াছিল, তাহা ডাকাইতির চারি দিবস পরে সকলের মধ্যে বিভাগিত হয়। সেই সময়েও দলপতি সেই স্থানে উপস্থিত হয় নাই। অপরাপর ডাকাইতগণ তাহাদিগের আপনাপন অংশ গ্রহণ করিয়া চলিয়া যায়; দলপতির অংশ একজনের নিকট গচ্ছিত থাকে। 

আবেদ আলি এই সকল বিষয় কৰ্ম্মচারীকে বলিয়া তাহার অংশে যে সকল দ্রব্যাদি পাইয়াছিল, তাহা আনিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিল। আর ওই ডাকাইত দলের যে সকল ব্যক্তির নাম ও বা স্থান এ পর্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছিল, তাহারও একটি তালিকা তাঁহাকে প্রদান করিল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

এই সমস্ত সংবাদ কৰ্ম্মচারীকে প্রদান করিয়া আবেদ আলি, তাঁহার পরামর্শমত পুনরায় সেই স্থান পরিত্যাগ করিল। এবার তিনি তাহাকে বলিয়া দিলেন “যেরূপে হয়, ওই ভূতের বাসস্থান স্থির করিয়া আসিবে।” 

এক সপ্তাহ পর, সে পুনরায় প্রত্যাগমন করিল ও কহিল “এবার সেই দলপতি ভূতের বাসস্থানের সন্ধান পাইয়াছি, যে জঙ্গলের ভিতর তাহার সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেই জঙ্গলের মধ্যেই তাহার বাস। তবে তাহার বাসস্থান নিজ চক্ষে না দেখিলেও বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইয়াছি।” 

আবেদ আলির কথা শুনিয়া তিনি সমস্ত অবস্থা তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীকে বলিলেন। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, যত লোক আবশ্যক, তত লোক সংগ্রহ করিয়া অধিক রাত্রে ওই জঙ্গল বেষ্টন করা হইবে। অতি প্রত্যূষেই সকলে চতুৰ্দ্দিক হইতে জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হইতে থাকিবে। যে সকল লোক ওই কার্য্যে নিযুক্ত হইবে, সকলেই পুলিসের পোষাক পরিয়া ওই কার্য্যে নিযুক্ত হইবে; কারণ পুলিসের লোক ব্যতীত যে কোন ব্যক্তিকে উহার ভিতর পাওয়া যাইবে, তাহাকেই ধৃত ও অবরুদ্ধ করা হইবে। 

এইরূপ পরামর্শ স্থির হইলে, নানা স্থান হইতে নানা পুলিস-কৰ্ম্মচারী ও পুলিস-প্রহরী আনীত হইল। জেলার মধ্যস্থিত যে কোন গ্রামে ও থানায় যে কোন পুলিস-কর্মচারী ও কনেষ্টবল ছিল, সকলেই নির্দিষ্ট দিনে সদরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তদ্ব্যতীত নিকটবর্ত্তী জেলা সকল হইতেও অনেক পুলিসের আগমন হইল। যেস্থান হইতে যতগুলি ইংরাজ কর্মচারীর সেই স্থানে উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা, তাঁহারাও আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। আবেদ আলি পূৰ্ব্বেই সেই স্থান গোপনে দেখাইয়া দিয়াছিল, ওই কয়েকজন কর্মচারী গুপ্তবেশে সেই স্থানে গমন করিয়া ওই জঙ্গল ও পুষ্কারিণীর অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া লইলেন। 

নির্দ্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পরই সমস্ত পুলিস-কৰ্ম্মচারী সদর হইতে বাহির হইয়া আপন গন্তব্য স্থানে গমন করিতে লাগিলেন। যখন তাঁহারা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন রাত্রি প্রায় ৩টা বাজিয়া গিয়াছিল। সেই সময় হইতেই তাহারা ওই জঙ্গল ও পুষ্করিণীর চতুর্দিক বেষ্টন করিতে আরম্ভ করিলেন। সকলের আপনাপন স্থান অধিকার করিতে প্রায় চারিটা বাজিয়া গেল। পাঁচটা বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে চতুৰ্দ্দিক হইতে সকলে ক্রমে ক্রমে সেই জঙ্গলের ভিতর অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তিন চারি হস্ত অন্তর এক এক জন লোক স্থাপিত করা হইয়াছিল, উহারা যাহাতে আপন আপন কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করে, তাহা দেখিবার জন্য, প্রত্যেক দশজন কনেষ্টবলের উপর একজন করিয়া দেশীয় কৰ্ম্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিল। তাঁহাদিগের উপর এক একজন ইংরাজ কর্মচারী। তৎকার্য্যে যতগুলি লোক নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সকলেই সশস্ত্র। যিনি যে অস্ত্র উত্তমরূপে ব্যবহার করিতে পারিতেন, তাঁহাকে তাহাই প্রদান করা হইয়াছিল। কনেষ্টবলগণ লাঠী লইয়াছিল, কৰ্ম্মচারিদিগকে তরবারি, পিস্তল ও বন্দুক প্রদান করা হইয়াছিল। 

এইরূপে সকলে সেই জঙ্গল ভেদ করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। ক্রমে ব্যাঘ্রশার্দূলাদি ভীষণ বন্যজন্তুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। উহাদের মধ্যে কেহ বা তাহাদের হস্তে নিধন প্রাপ্ত হইল, কেহ বা পলায়ন করিল। 

ওই জঙ্গলের প্রায় মধ্যস্থলে উপনীত হইলে একটি বহু পুরাতন পুষ্করিণীর ধারে একখানি ক্ষুদ্র কুটীর দেখা গেল। চারিজন ইংরাজ কর্মচারী বন্দুক হস্তে ওই কুটীরের নিকট গমন করিলেন। দেখিলেন, ওই কুটীরখানি দুই অংশে বিভক্ত। এক অংশে তিনজন লোক, অপর অংশ একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক। উহাদিগের নিকট অস্ত্রশস্ত্র থাকিলেও উহারা কিন্তু কোনরূপ প্রতিবন্ধকতাচরণ করিল না; বোধ হয়, অস্ত্রধারী অনেক লোককে দেখিয়া ও সহজে তাঁহাদের হস্ত হইতে পলায়ন করিবার আশা নাই ভাবিয়া, উহারা সহজেই আত্মসমর্পণ করিল। 

যে তিনজন লোককে ওই কুটীরের এক অংশে পাওয়া গিয়াছিল, তাহাদিগকে দলস্থ কেহই চিনিতে পারিল না, কিন্তু স্ত্রীলোকটির সহিত যাহাকে তথায় পাওয়া গিয়াছিল, একজন কর্মচারী তাহাকে চিনিতে পারিলেন। তিন কহিলেন “আমার যদি ভ্রম না হইয়া থাকে, যদি হানিফ খাঁ এখন জীবিত থাকে, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি, যে হানিফ খাঁর ফাঁসী হইয়াছিল, এ সেই হানিফ খাঁ ভিন্ন আর কেহই নহে; তবে সে যদি মরিয়া ভূত হইয়া থাকে, তাহা হইলেও ইহার আকৃতির সহিত হানিফ খাঁর আকৃতির কিছুমাত্র প্রভেদ নাই।” 

সেই সময় ওই সকল লোককে কৰ্ম্মচারিগণ দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন কিন্তু কেহই তাঁহাদিগের কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না, মাত্র একজন কহিল “আমাদিগকে এখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না, যেখানে লইয়া যাইতে চাহেন, সেই স্থানে লইয়া চলুন, তথায় আপনাদের সকল কথার উত্তর পাইবেন।” 

পরে ওই জঙ্গলটি কর্মচারিগণ উত্তমরূপে দেখিলেন, ওই কয়জন ব্যতীত অপর কোন লোককে আর পাওয়া গেল না। যে যে স্থানে সন্দেহ হইল, সেই সেই স্থান খোদিত হইল। পুষ্করিণীর ভিতর যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান করা হইল, কেল কতকগুলি পিতল কাঁসার বাসন ব্যতীত আর কিছুই পাওয়া গেল না। ওই কুটীর ও উহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকল উত্তমরূপে খোদিত করিয়াও কয়েকখানি সোণা রূপার অলঙ্কার ও সামান্য কয়েকটি মুদ্রা ব্যতীত বহুমূল্য দ্রব্য কিছুই পাওয়া গেল না, তবে বন্দুক, তরবারি, লাঠি, সড়কি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র ওই কুটীরের একপ্রান্তে অনেক পাওয়া গিয়াছিল। ওই সমস্ত দ্রব্যের সহিত যে পাঁচজন ধৃত হইয়াছিল, তাহারা জেলার সদর থানায় আনীত হইল। 

অলঙ্কার প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছিল সে সমস্তই যে ডাকাতি করিয়া প্রাপ্ত, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না, ক্রমে ক্রমে ওই সকল দ্রব্যের ফরিয়াদীও বাহির হইয়া পড়িল। 

যে সকল ডাকাইতের নাম ও ঠিকানা আবেদ আলি পূৰ্ব্বে বলিয়া দিয়াছিল, তাহারাও ক্রমে ক্রমে আপনাপণ বাসস্থানে ধৃত হইতে লাগিল ও তাহাদিগের নিকট হইতে কিছু কিছু ডাকাতির দ্রব্যও পাওয়া গেল। 

যে সকল ব্যক্তি হানিফ খাঁকে উত্তমরূপে চিনিত, তাঁহাদের একে একে সকলকেই আনা হইল, সকলেই হানিফ খাঁকে চিনিতে পারিলেন কিন্তু কেহই সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না যে, ওই ব্যক্তিই প্রকৃত হানিফ খাঁ। তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই কহিলেন, যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে, সে আবার বাঁচিয়া আসিবে কিরূপে? এ প্রকৃত হানিফ খাঁ নহে, সে মরিয়া ভূত হইয়াছে, এ সেই ভূত। 

নবম পরিচ্ছেদ 

ভূত ধরা পড়িয়াছে, এই কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। ভূত দেখিবার মানসে নানা স্থান হইতে নানা লোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে লাগিল। কেহ বা সাহসে ভর করিয়া উহার নিকটে গিয়া উহাকে দর্শন করিল, কেহ বা দূর হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল। কাহারও সে সাহসও হইল না, অপরে যাহা দেখিয়াছে, তাহাই শুনিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

হানিফ খাঁর সহিত অপর যে তিন ব্যক্তি ধরা পড়িয়াছিল, তাহারা পরিশেষে আত্মপরিচয় প্রদান করিল। তাহারা কে, কোথায় তাহাদিগের বাড়ী, তাহাও বলিল। ডাকাইতি করিয়াই যে তাহারা জীবনধারণ করে, তাহাও তাহারা স্বীকার করিল, এবং যে যে স্থানে তাহারা ডাকাইতি করিয়াছে, তাহাও বলিয়া দিল। আরও কহিল, তাহারা তিনজনেই সর্দ্দার হানিফ খাঁর প্রিয় শিষ, সেই জন্য তাহারা প্রায়ই হানিফ খাঁর নিকট অবস্থান করিয়া থাকে। 

ওই স্ত্রীলোকটি যে কে, সে কথাও প্রকাশ হইয়া পড়িল। সে বহুদিবস হইতে হানিফ খাঁর আশ্রিত। হানিফ খাঁও তাহাকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, যেখানে যায়, সেই স্থানেই তাহাকে সঙ্গে লইয়া যায়। সেইজন্যই এই নিৰ্জ্জন বাসেও সে হানিফ খাঁর সহচরী। 

হানিফ খাঁ প্রথম প্রথম তাহার নিজের পরিচয় গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু পরিশেষে যখন সে দেখিল যে, তাহার সমস্ত কথা ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িতেছে, তখন সমস্তই স্বীকার করিল। স্বীকার করিল, তাহারই নাম হানিফ খাঁ, সেই পূর্ব্বে ধৃত হইয়া ফাঁসীর হুকুম প্রাপ্ত হয়। 

সৰ্ব্ব সমক্ষেই তাহাকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলান হইয়াছিল, কিন্তু যে জল্লাদ তাহার গলায় দড়ি পরাইয়া দেয়, সে তাহার দলভুক্ত একজন ডাকাইত ছিল, সে ওই দড়ীতে এরূপ ভাবে একটি গাঁট দিয়া রাখিয়াছিল যে, গলায় দড়ী দিয়া সজোরে উচ্চ হইতে পতিত হইলেও ওই দড়ীর ফাস গলায় আঁটিয়া যায় নাই। যে সময় সে ফাঁসী মঞ্চের উপর হইতে ঝুলিয়া পড়ে, সেই সময় জল্লাদ ওই মঞ্চের ভিতরেই দাঁড়াইয়াছিল, পড়িবার সময় সে নিচে হইতে উহাকে ধরে, তাই গলায় দড়ী আঁটিয়া যায় নাই বা বিশেষরূপ সে আঘাতপ্রাপ্ত হয় নাই; কেবল কিছুক্ষণ ঝুলিয়া থাকে মাত্র। অল্পক্ষণ পরে সুযোগ মত ওই জল্লাদ তাহাকে ওই রজ্জুর ফাঁস হইতে নামাইয়া, নিজের ঘরে লুকাইয়া রাখে, রাত্রিকালে কোন গতিকে জেলের ভিতর হইতে বাহির করিয়া দেয়। এইরূপে সে যাত্রা সেই জল্লাদ তাহার জীবন রক্ষা করে। সে মরে নাই বা ভূতও হয় নাই, তবে লোকদিগকে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত সে ভূত সাজিয়া বেড়াইত, এই জন্যই লোকে জানিত যে, হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে; সুতরাং কেহই তাহার নিকটে আসিতে সাহস করিত না। 

এই সমস্ত বিষয় অবগত হইবার পর হানিফ খাঁর পুনরায় বিচার হইল। তথায় ভূতের বিষয় দেখিবার নিমিত্ত অনেক লোকের আগমন হইল। যে জজসাহেব পূর্ব্বে হানিফ খাঁর বিচার করিয়াছিলেন, এবারও তিনি সেই ভূতের বিচার আরম্ভ করিলেন। বিচারকালে কেবল এইরূপ সাক্ষ্য গৃহীত হইল যে, এই ব্যক্তিই হানিফ খাঁ, ইহারই প্রতি পূর্ব্বে চরমদণ্ডের আদেশ হয়। এই সমস্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়া জজসাহেব এই আদেশ প্রদান করেন যে, পূর্ব্ব মোকদ্দমার বিচারে উহার প্রতি যে দণ্ডের হুকুম হইয়াছিল, সেই দণ্ডই বলবর্তী থাকিবে, ফাঁসী কাষ্টে ঝুলাইয়া উহাকে এ জগৎ হইতে পরজগতে প্রেরণ করা হইবে। 

কাঠরার ভিতর হইতে বাহির করিয়া লইবার সময় জজসাহেব হানিফ খাঁকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন “আমি তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।” 

উত্তরে হানিফ খাঁ কহিল “আমি কেন আপনার বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়াছিলাম, তাহাই জানিতে চাহেন কি? “ জজসাহেব কহিলেন “হাঁ।” 

হানিফ খাঁ কহিল “আপনি বিচারকালে আপনার পূর্ণ ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তাই আমিও আমার পূর্ণ ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করিতে আপনার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে কৃতকার্য হইতে না পারিয়া পাথেয় স্বরূপ যাহা কিছু পাইয়াছিলাম, তাহাই লইয়া প্রত্যাগমন করি।” 

জজসাহেব শুনিয়া হাসিলেন। 

তাহার দলের অপরাপর যে সকল ডাকাইত ধৃত হইয়াছিল, বিচারে তাহারা যথোপযুক্ত দণ্ডপ্রাপ্ত হয়। হানিফ খাঁর ফাঁসী হইবে, এবার দেশীয় জল্লাদকে বিশ্বাস না করিয়া ইংরাজ জল্লাদের দ্বারা জেলার সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর সম্মুখে ওই কার্য্য সম্পন্ন করা হয়। 

সেই সময় হইতে ওই প্রদেশে কিছুদিন আর ডাকাইতির কথা শুনিতে পাওয়া যায় নাই। 

সম্পূর্ণ 

[ আশ্বিন, ১৩১৭ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *