ভূতের বাসায় কলাবতী (১৯৯৮)

ভূতের বাসায় কলাবতী – মতি নন্দী / প্রথম সংস্করণ: আগস্ট ১৯৯৮/ আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা ৯ / পৃ. ১৪৪। মূল্য ৫০.০০ / প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: শংকর বসাক / উৎসর্গ: পুট্টু বোরা-কে

”কালু, এ হল আমার পিসতুতো বোন ইচ্ছাময়ী, তোর দিদা হয় আর ইচ্ছে, এ হল আমার নাতনি দিব্যর মেয়ে কালু, কলাবতী। এইবার উচ্চচ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল, এখন ছুটি চলছে।” রাজশেখর কথা শেষ করেই চোখের ইঙ্গিতে প্রণাম করতে বললেন। কলাবতী ইচ্ছাদিদাকে তারপর ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসা দাদুকে প্রণাম করল।

ইচ্ছাময়ী প্রসন্ন চোখে কলাবতীর চিবুক ছুঁয়ে আঙুল ছোঁয়ালেন ঠোঁটে। ”শিখলে কোথায় গুরুজনদের প্রণাম করার এই শিক্ষাটা? এসব তো আজকালকার মেয়েরা জানেই না।” জিনস আর টপ পরা কলাবতীর থেকে চোখ সরিয়ে তিনি রাজশেখরের দিকে তাকালেন।

”সিংহি বংশের মেয়েদের কি এসব শেখাতে হয়, এ—বাড়িতে যে জন্মেছে, এ—বাড়ির বাতাসে যে শ্বাস নিয়েছে, সে আপনা থেকেই শিখে যায়।” রাজশেখরের গলার স্বরে ফুটে উঠল ক্ষীণ অহঙ্কার, চাপা গর্ব।

কলাবতী এই প্রথম দেখল ইচ্ছাদিদাকে। দাদুর যে একজন পিসতুতো বোন আছে সে জানত না। চেহারায় দাদুর সঙ্গে অনেক মিল আছে। তেমনই লম্বা নাক, বড় বড় টানা চোখ, ভারী গলা। সওয়া ছ’ফুট দাদুর পাশে দাঁড়ালে ইচ্ছাদিদার মাথা কান পর্যন্ত তো পৌঁছবেই আর ওজনেও দাদুর নব্বই কেজি’—র থেকে সামান্যই কম হবে। ওদের অমিলটা শুধু চুলে। রুপোর মতো ঝকঝকে থাক থাক বাবরি রাজশেখরের ঘাড় ঢেকে রেখেছে, বিধবা ইচ্ছাময়ীর মাথায় কাঁচাপাকা কদমফুল।

”রাজুদা তুমি যাবে তো?”

”এই পা নিয়ে! অসম্ভব।” রাজশেখর ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা ডান পায়ের গোড়ালিটা আঙুল দিয়ে দেখালেন। চারদিন আগে ভোরে নিত্যদিনের মতো দু’মাইল প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে রাস্তার গর্তে পা পড়ে মচকে যায়। লাঠিতে ভর দিয়ে এখন ঘর থেকে বারান্দায় ইজিচেয়ার পর্যন্ত আসতে পারছেন।

”দিব্যকে কত ছোট দেখেছিলুম। লখনউয়ে থাকতেই শুনেছিলুম ওর বউ মারা গেছে। তারপর সন্নেসি হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে একটা মেয়ে রেখে।” ইচ্ছাময়ী স্নেহাতুর চোখে কলাবতীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ”তোমার আর নাতি—নাতনি নেই?”

”নাহ।” রাজশেখর গম্ভীর হলেন। ”সতু বিয়ে করেনি, মনে হয় করবেও না, পঁয়তাল্লিশ পার করে ফেলেছে। যা ওর মনে হয় তাই করুক, আমি তো তিনবার বলেছি, আমার কথা এড়িয়ে গেছে।…যাকগে কালুই আমার নাতনি আবার নাতিও। নিজের ইচ্ছেমতো ও বড় হয়েছে, আমি কোনও হস্তক্ষেপ করিনি। ওর স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হল হরির মেয়ে মলু, সেই হল কালুর গার্জেন, মায়ের মতো। হরিকে তোর মনে আছে?”

”বকদিঘির মুখুজ্যে হরিশঙ্কর? ওরে বাবা মনে থাকবে না!” ইচ্ছাময়ী ভুরু কপালে তুললেন। ”কালোয়াতি গান শিখবে বলে একবার আগ্রা না পাটিয়ালা কোথায় যেন গেছল। তারপর ওস্তাদজির ঘাড়ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।”

”তুই তা হলে জানিস।” তৃপ্তস্বরে রাজশেখর বললেন, ”ওস্তাদজি হরিকে বলেছিলেন, আমার বকরিটাও তোর থেকে শুদ্ধভাবে পুরিয়া কল্যাণের সরগম করতে পারে। তাই শুনেই আগ্রা থেকে তানপুরাটা বগলে নিয়ে হরি চলে আসে। ওস্তাদজি ভদ্রলোক, ওকে ঘাড়ধাক্কা আর দেননি।”

”রাজুদা, তুমি আমার নাতনির বিয়েতে না আসতে পারো, কিন্তু সতু আর কালু অবশ্য—অবশ্যই যেন আসে। এই কার্ডে ঠিকানা লেখা আছে, তোমার বাড়ির কাছেই বাড়ি ভাড়া করে বিয়ে হবে।”

ইচ্ছাময়ী আধহাত লম্বা একবিঘত চওড়া একটা ঘাম এগিয়ে দিলেন। খাম থেকে রাজশেখর কার্ডটা বার করলেন—একটা কাগজের পালকি। কার্ডের ভাঁজ খুলে ভ্রূ কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করে তাকালেন কলাবতীর দিকে। বুঝতে পেরে সে রাজশেখরের ঘরে গিয়ে চশমাটা নিয়ে এল।

”হ্যাঁ রে ইচ্ছে, ছেলের বাবার নামটা যেন চেনা—চেনা ঠেকছে—জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ প্রাক্তন ডি আই জি। আই সি এস প্রেমেন ঘোষের ভাই না?”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি চেনো নাকি?”

”সার বলেন ঘোষের ছেলে ওরা। প্রেমেন তাদের সঙ্গে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ত। তখন ওদের ওল্ড বালিগঞ্জের বাড়িতে কয়েকবার গেছি। ভাল ঘরেই কুটুম্বিতে করছিস। পা—টা এই সময়ই বিগড়োল নইলে অবশ্য যেতুম, কত বছর প্রেমেনকে যে দেখিনি। নাতনির বিয়ে দিতে সেই লখনউ থেকে এসে উঠেছিস কোথায়?”

”গড়পাড়ে আমার ভাসুরের বাড়িতে। ছেলের বাড়ি থেকে বলল লখনউ গিয়ে বিয়ে দিতে পারব না, আপনারাই মেয়ে নিয়ে কলকাতায় আসুন। কলকাতার কিছুই তো জানি না, যা কিছু করাকম্মো সব ভাসুরপোরাই করে দিচ্ছে। এ বিয়েবাড়ি ভাড়া করা যে কী ঝকমারি তা কি আগে জানতুম! ছ’মাস আগে বুক না করলে নাকি পাওয়া যায় না। ভাসুরপো—র চেনা ছিল তাই ধরাধরি করে একটা বাড়ি পাওয়া গেছে। এই তোমাদের কাঁকুড়গাছির কাছেই। আজ তা হলে আমি উঠি, গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি, এখনও দশ—বারো জায়গায় যেতে হবে নেমন্তন্ন করতে।”

ইচ্ছাময়ী চলে যাওয়ার পর কলাবতী কার্ডটা পড়ল।

”দাদু, ১৬ নম্বর সি আই টি রোড, মনে হচ্ছে বাড়িটা চিনি, আমাদের স্কুলের কাছেই। খুব পুরনো, মোটা—মোটা থাম আছে, ফটক আছে অনেকটা আমাদের বাড়ির মতোই। এখন বিয়ের জন্য ভাড়া দেয়।”

”কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোর এখন বেশিরভাগেরই এই দশা। পূর্বপুরুষেরা তো আর জানত না কলসির জল গড়িয়ে—গড়িয়ে খেয়ে একশো দেড়শো বছর পরে বংশধরদের কী হাল হবে। তারা তো বড়লোকি দেখাতে মোটা—মোটা থামের বাড়ি করে গেছে। এখন ওই থামে সিমেন্ট—বালি লাগিয়ে কলি করাবার টাকা নেই তার ওপর অংশীদারের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। সেদিক থেকে আমি বরং বেঁচে গেছি। আমার সম্পত্তির মালিক হবে একজনই।” রাজশেখর মিটমিট হাসলেন কলাবতীর দিকে তাকিয়ে।

”এতবড় বাড়ি, লোক মাত্র তিনজন, কী হবে এটা দিয়ে? তার থেকে বরং বিক্রি করে ফ্ল্যাট কেনো।” কলাবতী দাদুকে চটাবার জন্য বলল। রাজশেখর হাতের লাঠিটা তুলতেই দুটো লাফ দিয়ে কলাবতী সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাতের খাওয়ার টেবিলে ওরা তিনজন। রাজশেখর, ছোট ছেলে সত্যশেখর ওরফে সতু আর কলাবতী। রুটি ছিঁড়ে আলু—পটল—কুমড়োর ডালনার বাটিতে ডুবিয়ে সতু বলল, ”শীতকালেই খাওয়ার আরাম, তাই না রে কালু? কতরকমের তরিতরকারি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কড়াইশুঁটি—”

কাকাকে থামিয়ে দিয়ে কলাবতী বলে উঠল, ”তার ওপর অঘ্রান, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন মাসে বিয়ের সিজন, কত নেমন্তন্ন খাওয়া।”

”কালু পৌষ মাসে বিয়ে হয় না।” রাজশেখর ভুল ধরিয়ে দিলেন।

রুটি চিবোতে—চিবোতে সতু বলল, ”ওহ, কতদিন নেমন্তন্ন বাড়ির বেগুনভাজা আর ছোলার ডাল যে খাইনি। ফুলকো—ফুলকো গরম লুচি…পৃথিবীর কোনও খাবারের সঙ্গে তুলনা হয়?”

রাজশেখর বিরক্ত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আমাদের বাড়ির লুচি কি ফুলকো হয় না। ছোলার ডাল বেগুনভাজা কি অপুর মা খারাপ রাঁধে?”

কলাবতী প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল, ”তোমার লুচি বেগুনভাজার একটা ব্যবস্থা আজ হয়েছে।”

সতু সটান হয়ে গেল। ”নেমন্তন্ন! কোথায়, কার, কবে?”

”আর তিনদিন পরে, ইচ্ছেদিদার নাতনির, ষোলো নম্বর সি আই টি রোড।”

সতু এবার বাবার মুখের দিকে তাকাল। রাজশেখর বললেন, ”ইচ্ছে হল আমার পিসতুতো বোন। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ তো রাখো না, জানবে কী করে। আমাদের কত আত্মীয় সারা ভারতে ছড়িয়ে রয়েছে। ইচ্ছের মা খাঁদুপিসির বিয়ে হয় গাজিয়াবাদে, ইচ্ছের বিয়ে হয় লখনউয়ে। ওর নাতনির বিয়ে হচ্ছে কলকাতায় সার বলেনের নাতির সঙ্গে। আজ ইচ্ছে এসেছিল নেমন্তন্ন করতে। তোমরা তো ওদের কাউকেই চোখে দ্যাখোনি। অবশ্য আমিও কাউকে দেখিনি শুধু ইচ্ছেকে ছাড়া। যাই হোক, তোমরা দু’জন এ—বাড়ির তরফে নেমন্তন্নটা রেখে এসো।”

”নিশ্চয় নিশ্চয়।” সতু দাঁত দিয়ে রুটি ছিঁড়ে পটলের টুকরো মুখে ঢোকাল। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গেলে বিয়ের নেমন্তন্নে যাওয়ার থেকে ভাল আর কী হতে পারে, তাই না রে কালু? কত লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, আলাপ পরিচয় হয়, কত খবর জানা যায়। তা হলে বাবা আমি আর কালু যাচ্ছি। কার নাতনি রে কালু?”

”বললুম তো ইচ্ছেদিদার।”

”ওহ ইয়েস, ইচ্ছে মানে উইশ, ডিজায়ার, অ্যাসপিরেশন। মনে থাকবে। কতদিন ফুলকো লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল যে—।”

”দাদু, কী উপহার দোব?”

কলাবতীর প্রশ্নে রাজশেখর গভীর চিন্তায় পড়ে ক্ষীরের বাটিতে চামচ নাড়তে লাগলেন।

”সোনার একটা কিছু না দিলে তো মান থাকে না। ইচ্ছের নাতনি মানে আমারও নাতনি।”

”একটা আংটি?” কলাবতী প্রস্তাব দিল।

রাজশেখর ভ্রূ তুলে তাকিয়ে রইলেন। কথাটা যথেষ্ট মনঃপূত হল না।

”তা হলে কানের কিংবা গলার? আধ ভরির?” সতু প্রস্তাবটার সংশোধন করল।

”যা ভাল বুঝিস। পাঁচজন লোক দেখবে তো সিংহিবাড়ি কী দিল।”

”তা হলে এক ভরির, কী বলো কাকা?”

”নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমি কালই হাইকোর্ট থেকে ফেরার পথে বউবাজার ঘুরে কিনে নিয়ে ফিরব। গলার একটা, পাথরটাথর বসানো—হ্যাঁ রে কালু, পুঁইশাকের সঙ্গে মাছের তেল আর কাঁটা দিয়ে ছ্যাঁচড়া বোধ হয় বিয়েবাড়িতে আজকাল আর করে না। লোকজনের খাওয়ার টেস্ট যে কত খারাপ হয়ে গেছে।” সতু আক্ষেপ জানিয়ে কাঁচাপাকা চুলেভরা মাথাটা নাড়তে লাগল, ”কত কাল যে খাইনি।”

”কাকা, অপুর মা চারদিন আগে পুঁইশাক আর ইলিশের মুড়ো দিয়ে ছ্যাঁচড়া করেছিল।”

”কালু, তোর কাকার জিভ আর স্মৃতিশক্তি দুটোই খারাপ হয়ে গেছে।” রাজশেখর চেয়ার ছেড়ে উঠলেন বিরক্ত মুখে।

ফিসফিস করে কলাবতী কাকার দিকে ঝুঁকে বলল, ”দাদুর কথাটার মানে বুঝলে? আবার ডায়েট চার্ট ক’রে তোমাকে থানকুনি, কালমেঘ, উচ্ছে, কাঁচাহলুদ খাওয়ানো শুরু করবে।”

”না, না, ছ্যাঁচড়া ফ্যাঁচড়া কি একটা খাওয়ার মতো জিনিস? পেঁপেসেদ্দ কত টেস্টফুল বল?”

সতু একটু জোরেই বলল, যাতে ঘর থেকে প্রস্থানরত রাজশেখরের কানে কথাটা পৌঁছয়।

.

গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যা ঘণ্টাখানেক উতরেছে। রাত প্রায় সাড়ে আটটা। কাকা আর ভাইঝি সি আই টি রোড ধরে হাঁটছে। সত্যশেখরের পরনে ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে শুঁড়তোলা চটি। কলাবতী পরেছে শাড়ি। টিকোল নাকে একটা হিরেমাত্র। যখনই মুখটি ঘোরাচ্ছে রাস্তার দোকানের আলোয় ঠিকরে উঠছে দ্যুতি। পথচারীরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। নাকের এই নাকছাবিটা রাজশেখর দিয়েছিলেন কলাবতীর মাকে, সেইসঙ্গে আরও লাখদেড়েক টাকার সোনার ও জড়োয়ার গহনা। তার অঙ্গে আর একটিও গহনা নেই, অবশ্য হাতঘড়িটাকে যদি গহনা ধরা না হয়। জামদানি শাড়ি পরে সে যখন দাদুকে দেখাতে আসে বিয়েবাড়ি যাওয়ার আগে, তখন মুগ্ধ চোখে রাজশেখর বলেন, ”এত সুন্দর করে সাজতে শিখলি কার কাছে?”

”বড়দির কাছে।” একটু আড়ষ্ট হয়েই কলাবতী বলেছিল। সে জানে মুখুজ্যেবাড়ির প্রশংসা শুনলেই দাদু তেলেবেগুনে হয়ে যায়।

”মলুর, মলয়ার কাছে? ও—বাড়ির মেয়েরা আবার সাজগোজের বোঝেটা কী? হরির মেয়ের রংটাই শুধু ফরসা। তোর এই রঙের পাশে কি মেমসাহেবদের রং দাঁড়াতে পারে? লোকে কেন যে ফরসা ফরসা করে হেদিয়ে মরে। কালো হচ্ছে জগতের আলো।”

উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা কলাবতী। নাকটা কুঁচকে বলল, ”তা হলে এবার যাই বিয়েবাড়ি আলো করে দিয়ে আসি।”

”কাকার দিকে নজর রাখিস, লুচি—ছ্যাঁচড়ায় যা লোভ।”

হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে বিয়েবাড়ির সামনে হাজির হল। নানান রঙের নানান চেহারার মোটরগাড়ি এসে ফটকের সামনে দাঁড়াচ্ছে, সাজগোজ করা মেয়ে পুরুষ ও বাচ্চচারা গাড়ি থেকে নামছে। ফুল দিয়ে বাংলায় ‘স্বাগতম’ আর ইংরেজিতে ‘ওয়েলকাম’ লেখা ফটকের মাথায়। সামনে দাঁড়ানো কিছু বয়স্ক ও আধা—বয়স্ক ধুতি—পাঞ্জাবি পরা লোক এগিয়ে হাতজোড় করে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। তারপর হাত দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ভেতরে ঢুকে ডান দিকের না বাঁ দিকের কোন পথ ধরে যেতে হবে।

ফটকটা পার হয়েই বাঁদিক ও ডান দিকে পথ চলে গিয়েছে অর্ধচক্রাকারে একটুকরো ঘাসের জমিকে ঘিরে এবং আবার এসে মিলেছে বাড়িতে ওঠার টানা লম্বা সিঁড়িতে। সিঁড়িতে প্রায় দশটা ধাপ। উঠে গেলে চওড়া দালান। তার দু’ দিকে দুটো ঘর, সামনে তিনটে দরজা। দরজা পার হলে উঠোন। উঠোন ঘিরে চওড়া দালানের মতো রক। রকের দু’ধারে দোতলায় যাওয়ার দুটো সিঁড়ি। সিঁড়ির শ্বেত পাথরগুলো ভাঙা এবং ফাটা, থামগুলোয় দায়সারা কলি করা। ফটকে ঢুকেই দু’ধারে আগাছা। মার্কারি ভেপারের আলো ফটকের মাথায়। বাড়ির ছাদ থেকে ঝুলছে তিন—চার রঙের টুনি বালব, দু’দিকের পথের ধারে রাখা চেয়ারে আমন্ত্রিতরা বসে।

ওরা দু’জন হাঁটতে—হাঁটতে এসে ফটকের সামনে দাঁড়াল। কলাবতীর হাতে সোনালি জরির ফিতেয় বাঁধা রঙিন কাগজে মোড়া গহনার বাক্স। হাবিলদারি সাদা গোঁফ, টাকমাথা, গরদের পাঞ্জাবি গায়ে, ছড়ি হাতে এক বৃদ্ধ হাসি—হাসি মুখে এগিয়ে এলেন সত্যশেখরের দিকে।

”আপনারা কি বরপক্ষের?”

”না, না, কনেপক্ষের, কাছেই তো বাড়ি, তাই হেঁটেই চলে এলুম।” সত্যশেখর বিনীত স্বরে বলল।

”কিছু মনে করবেন না, আমি তো সবাইকে চিনি না। মানুর বিয়েতে এসেছেন তো?”

”অবশ্যই।” সত্যশেখর সপ্রতিভ দ্রুত উত্তর দিল।

”তা হলে এই ডান দিকে চলে যান। বর এখনও আসেনি, লগ্ন তো দশটায়। একটু পরেই এসে যাবে, কলকাতায় ট্র্যাফিকের যা অবস্থা।” বলতে বলতে বৃদ্ধ সদ্য আগত এক দম্পতির দিকে এগিয়ে গেলেন।

”আয় রে কালু।” সত্যশেখর ডান দিকের পথ ধরল।

কলাবতী তখন কথা বলছে সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতিপরা এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে।

”ইচ্ছেদিদার নাতনি!” প্রৌঢ়কে থতমত দেখাল। ”আমি বাচ্চচুর জ্যাঠামশাইয়ের শালা, ধানবাদে থাকি। তুমি বরং বাঁ দিকের ওই চেয়ারের একটায় বোসো। মুশকিল হয়েছে কী, আমি এদের বাড়ির দু—তিনজন ছাড়া কাউকেই চিনি না।” কিন্তু—কিন্তু করে তিনি বললেন।

”ওই একই সমস্যা আমারও। ইচ্ছাদিদার নাতনির নাম যে বাচ্চচু, সেটাই এই প্রথম শুনলাম।” বলেই কলাবতী বাঁ দিকের পথে এগোল। বিব্রত হয়ে ভাবল, বিয়ের কার্ডে অমিতা না সুমিতা কী যেন একটা নাম দেখেছিল। নামটা এখন আর মনে পড়ছে না। ওটা সঙ্গে করে আনলে ভাল হত। চেয়ারগুলো ভর্তি হয়ে রয়েছে। খালি চেয়ারের খোঁজে সে তাকাচ্ছে তখন দেখতে পেল হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছেন হরিদাদু। অবাক হয়ে সে এগিয়ে গেল হরিশঙ্কর মুখুজ্যের দিকে। সিংহিবাড়ির এক নাতনির বিয়েতে কিনা বকদিঘির মুখুজ্যেবাড়ির লোক নিয়ন্ত্রিত! তাজ্জব ব্যাপার!

”হরিদাদু আপনি?”

”কেন আমি কি নেমন্তন্ন খেতে যাই না? আমার বহুদিনের বন্ধুর নাতনির বিয়ে, এই অ্যাত্তটুকু বয়স থেকে বাচ্চচুকে দেখে আসছি। তারপর এধার—ওধার তাকিয়ে হরিশঙ্কর বললেন, ”খালি চেয়ার তো একটাও দেখছি না। তুমি বরং ভেতরে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বোসো।”

বয়স্ক মহিলামহল কলাবতীর একেবারেই ভাল লাগে না। সে বলল, ”এই তো বেশ দাঁড়িয়ে আছি, অসুবিধে হচ্ছে না। বড়দি আসেনি হরিদাদু?”

”না। সন্ধে থেকে মাথা ধরেছে, শুয়ে আছে। বাচ্চচুর বিয়েতে আটঘরার লোকের নেমন্তন্ন ভাবতেই পারছি না। সিংহিবাড়ির সঙ্গে ভবতোষদের সম্পর্ক আছে তা তো জানতুম না।”

”আমিও কি জানতুম ইচ্ছাদিদার নাতনির বিয়েতে আপনাকে দেখতে পাব!” কলাবতী হাসল। দেখল দূরে একটা চেয়ারে বসে কাকা হাত তুলে তাতে ডাকছে।

”ইচ্ছেদিদা কে?” হরিশঙ্কর উদগ্রীব হলেন।

”লখনউয়ে থাকেন। দাদুর পিসতুতো বোন। আচ্ছা আমি এখন কাকার কাছে যাব, ডাকছে।”

অবাক হয়ে থাকা হরিশঙ্করকে রেখে কলাবতী তার কাকার কাছে এল।

”হরিকাকা এখানে কেন রে?”

”ওঁর বন্ধুর নাতনি বাচ্চচুর বিয়ে।”

”বাচ্চচু কী? মানুর বিয়ে।”

”হরিদাদু তো বাচ্চচুই বললেন।”

”আমাদের এই এক মুশকিল। আদর করে এক—একজন এক—একটা নাম রাখে। কেউ ডাকছে বাচ্চচু, কেউ বলবে মানু।…হ্যাঁ রে ভেতরটা একবার ঘুরে আসবি? উপহারটা তো মেয়ের হাতে দিতে হবে। চট করে দিয়ে আয় আর সেইসঙ্গে পারলে দেখে নিবি এই ব্যাচটার পাতে এখন কী চলছে, চাটনি পর্যন্ত এসেছে কি না।”

”কাকা তোমার এখনই খিদে পেয়ে গেল? কোর্ট থেকে ফিরেই তো চারটে আম দিয়ে দই আর চিড়ে খেল!”

”খিদে পাবে না? চুপচাপ একা বসে, এত লোক যাচ্ছে আসছে কাউকেই চিনি না শুধু ওই হরিকাকা ছাড়া। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলা আর ইনভাইট করে চিমটি খাওয়া একই কথা, কালু তুই একটু ভেতরে গিয়ে দ্যাখ। বরযাত্রীরা এসে পড়লে তখন তো ওরাই প্রায়রিটি পাবে খেতে বসায়। তার মানে আমাদের বসতে বসতে থার্ড কি ফোর্থ ব্যাচ, তার মানে তো বেগুনভাজার টেস্ট একদমই নষ্ট হয়ে যাবে।” সত্যশেখরকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাল।

ভেতর থেকে এক মহিলা এই সময় বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনারত এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে জর্দার কৌটো চেয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। সত্যশেখর তাকে ডেকে বলল, ”এই মেয়েটিকে একটু কনের কাছে নিয়ে যাবেন।”

”নিশ্চয়, নিশ্চয়, এসো ভাই।” তিনি কলাবতীর হাত ধরলেন। ”আসলে কী জানেন আমাদের লোকজন খুব কম, ঠিকমতো খাতিরযত্ন করতে পারছি না। তা ছাড়া চিনিও না কাউকে। এসো ভাই।” কলাবতীকে হাত ধরে তিনি বাড়ির ভেতর নিয়ে বাঁ দিকের সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠলেন।

”এই যে সতু, তুমি একা যে, বাবা আসেনি?”

সত্যশেখর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল। হরিশঙ্কর তাকে বসার জন্য ইশারা করে বললেন, ”বসে পড়ো, নয়তো কেউ টেনে নেবে।”

ধপ করে বসে পড়ল সত্যশেখর। ”বাবার পা মচকে গেছে।”

”মচকাবেই তো। দিন দিন যা মোটা হচ্ছে। তা ভবতোষ চাটুজ্যের নাতনির বিয়েতে তোমরা নেমন্তন্ন পেলে কোন সুবাদে?”

”কেন, মানুর ঠাকুমা তো বাবার পিসতুতো বোন ইচ্ছেপিসি! মানু তো সম্পর্কে বাবার নাতনি, ওরা চাটুজ্যে বামুন হতে যাবে কেন?”

”মানু আবার কে?”

”কেন, আজ যার বিয়ে হচ্ছে!”

”বিয়ে তো হচ্ছে বাচ্চচুর। শিলিগুড়ির ছেলের সঙ্গে। ভুল করে খেতে ঢুকে পড়োনি তো।” হরিশঙ্কর মুচকি হাসলেন। ”তুমি আবার যা পেটুক। সিংহিরা অবশ্য খেতে ভালবাসে। খেয়ে খেয়ে মোটা হয় আর পা মচকায়।”

রাগে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল সত্যশেখরের মাথা। কোনওক্রমে নিজেকে সামলে বলল, ”ভুল আপনি করেননি তো। বাচ্চচু নয় মানুরই বিয়ে হচ্ছে। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন।”

”আচ্ছা দেখছি।” খোঁজ নেওয়ার জন্য হরিশঙ্কর এধার ওধার তাকিয়ে সদ্য খেয়ে উঠে বেরিয়ে আসা একটি বেঁটেখাটো যুবককে ধরলেন। ”ভাই, বলতে পারেন যার বিয়ে হচ্ছে তার নাম বাচ্চচু কিনা?”

যুবকটি পান চিবনো বন্ধ করে ভ্রূ কোঁচকাল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, ”বাচ্চচু?…হতে পারে। আমার বউ বলতে পারবে, ওর মামাতো বউদির ননদ হয় কনে। আচ্ছা, দাঁড়ান আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।”

দাঁড়াতে আর হল না। বাড়ি থেকে কোমরে গামছা বাঁধা একটি লোক বেরিয়ে এসে চেঁচাল, ”পাত পড়েছে। এই ব্যাচে যারা খাবেন তারা চলে আসুন।”

”শুনলে তো সতু। চলো চলো আর দেরি কোরো না।” হরিশঙ্কর কনুই ধরে টান দিলেন। সত্যশেখর চলতে শুরু করল।

সেই মহিলাটি কলাবতীর হাত ধরে বাঁ দিকের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন। একতলায় উঠোনের দু’ধারে যে টানা লম্বা রক তার ডাইনে ও বাঁয়ে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বাঁ দিকের টেবিলে তখন ধুতিপরা কোমরে গামছা বাঁধা দুটি লোক শালপাতার থালা পাতছে, এইমাত্র একটা ব্যাচ খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে। কৌতূহলবশতই কলাবতী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ডান দিকের রকে যারা খাচ্ছে তাদের দিকে তাকাল। তার মনে হল পাতে বেগুনভাজা রয়েছে, ছোলার ডাল পরিবেশন করছে কালো ট্রাউজার্স, সাদা শার্ট পরা তিন—চারজন লোক, তাদের হাতে শাদা গ্লাভস। তার অদ্ভুত লাগল আর একটা জিনিস দেখে বাঁ দিকের মতো ডান দিকের টেবিলে শালপাতায় নয়, নিমন্ত্রিতরা খাচ্ছে কলাপাতায়। দু’দিকে দু’রকম একই বিয়ের ভোজে, কী করে হয়!

যাই হোক, এই নিয়ে ভাবার জন্য কলাবতী সময় আর পেল না, কেননা ততক্ষণে সেই মহিলা তাকে একটা বড় ঘরের মধ্যে এনে ফেলেছেন। সারা ঘর জুড়ে বসে রয়েছেন সাজগোজ—করা মহিলারা। একদিকে সিংহাসনের মতো চেয়ারে বসে কনে। কলাবতী এধার—ওধার তাকিয়ে ইচ্ছেদিদাকে খুঁজে তাঁকে দেখতে পেল না। সসঙ্কোচে কনের দিকে সে এগিয়ে গেল। গহনার বাক্সটা কনের হাতে তুলে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ”দাদুর আশীর্বাদ।”

মাথায় ফুলের মুকুট, কপালে চন্দন, গলায় বেলফুলের মালা এবং হাতে ও গলায় সোনার গহনা এবং গোলাপি বেনারসিপরা মেয়েটি স্মিত হেসে দু’হাত জড়ো করে নমস্কার করল এবং পাশে দাঁড়ানো এক বিবাহিত মহিলার হাতে বাক্সটি তুলে দিল। কাগজের মোড়কটা ছিঁড়ে বাক্সের ডালাটা খুলেই তার চোখদুটি বিস্ফারিত হয়ে গেল উত্তেজনায়। মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বেরোল।

”ওমমা, কী দারুণ পেন্ডেন্ট, মুক্তো বাসানো!”

”কই, দেখি, দেখি।” সামনে—বসা একজন বললেন।

গহনার বাক্সটা তুলে ধরে সবাইকে দেখানো হল। খাতা কলম নিয়ে একজন বিধবা উপহারের তালিকা রাখছেন। তিনি জানতে চাইলেন, ”কে দিয়েছে রে রাধু, নামটা বল।”

বাক্সটার ভেতর থেকে ছোট্ট একটা কাগজ বার করে রাধু নামের মহিলা চেঁচিয়ে পড়লেন, ”ইচ্ছার নাতনিকে তার শুভ বিবাহে আটঘরার সিংহবাড়ির শুভেচ্ছা। আশীর্বাদক, রাজশেখর।”

লেখাটা কলাবতীরই। ইচ্ছার সঙ্গে শুভেচ্ছা মিল দেওয়ার লোভ সে সামলাতে পারেনি। সারা ঘরে একটা গুঞ্জন। গহনাটার দাম কত হতে পারে তাই নিয়ে ফিসফাস। একজন বলল, শুধু মুক্তোগুলোর দামই তো আড়াই হাজার, ওটা হাজার পাঁচেকের কম নয়। এখন সোনার দর কত করে জানো? কে একজন বলল, খুব বড়লোকের বাড়ি থেকে দিয়েছে। এইসব কথাবার্তা কলাবতী কান লাল করে শুনল।

”আরে, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোসো।”

একজন হাত ধরে কলাবতীকে বসিয়ে দিল। সে বসতে যাচ্ছে তখন কোমরে গামছা জড়ানো একজন দরজার কাছ থেকে বলল, ”যাঁরা এই ব্যাচে বসতে চান তাঁরা নীচে আসুন। দেরি করবেন না।”

শোনামাত্র কলাবতী উঠে দাঁড়াল এবং দ্রুত দরজার দিকে এগোল, তার খিদে পায়নি কিন্তু কাকার পাশে তাকে বসতেই হবে, দাদুর কড়া হুকুম। সিঁড়ি দিয়ে সে নামছে আর তারই বয়সী একটি মেয়ে, খোঁপায় জড়ানো বেলফুলের গোড়ে, হাতে একটা শাঁখ, ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। দু’জনের ধাক্কা লাগে প্রায়। দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে তাকাল।

”কালু তুই!”

”তুই সুশি!”

.

সুস্মিতা আর কলাবতী পরস্পরের দিকে সদ্য—ভাজা ছানাবড়া চোখে তাকিয়ে রইল। ওরা দু’জনে কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে একই ক্লাসের ছাত্রী। দু’জনেই এবার উচ্চচ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে।

”আমার বউদির খুড়তুতো বোনের বিয়ে, শিলিগুড়ি থেকে বর আসবে এখনই। তুই এখানে?”

”বলছি।” কলাবতী এখন নিশ্চিত হয়ে বুঝে গেল, বড় রকমের একটা ভুল সে করে ফেলেছে। ভুলটা যেভাবেই হোক ম্যানেজ করতে হবে।

”এ—বাড়িতে কি আর একটা বিয়ে হচ্ছে?” কলাবতীর গলায় সন্দেহের সুর।

”দ্যাখ না কী যে মুশকিল হচ্ছে। আমাদের লোক ওদিকে চলে যাচ্ছে ওদের লোক আমাদের দিকে চলে আসছে। সেইজন্য তো সদরগেটে লোক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।” সুশি মেশিনগানের মতো তড়বড় করে বলল। ”একটা বাড়িতে দুটো বিয়ে, পার্টিশান করে আলাদা করারও ব্যবস্থা নেই। বিয়েবাড়ির যে এত ডিমান্ড কে জানত? বাড়িওলা বলল দেরি করে ফেলেছেন, আরও দু’মাস আগে এলে গোটা বাড়িটাই পেতেন, এখন আপনাদের শেয়ার করে নিতে হবে, রাজি থাকেন তো এখনই অ্যাডভান্স করুন। যত বিয়েবাড়ি এদিকে রয়েছে সব তো ভাড়া হয়ে গেছে, কী আর করা যায় অগত্যা ভাগাভাগি করেই নিতে হল।” এর পর গলা নামিয়ে সুশি বলল, ”হ্যাঁ রে কালু, তুই ভুল করে এদিকে চলে আসিসনি তো?”

ওদের পাশ দিয়ে হুড়মুড় করে মেয়েরা নীচে নেমে যাচ্ছে নতুন ব্যাচে বসার জন্য। সিঁড়ির একধারে সরে গিয়ে কলাবতী বলল, ”বোধ হয়।” তারপর উৎফুল্ল হওয়ার ভান করে কলাবতী বলল, ”তোর বউদি তো আমারও বউদি। বউদির বোন তো আমারও দিদি। দিদির বিয়েতে এসেছি মনে করলেই আর গণ্ডগোল নেই। তবে ওদিককার লোকেরা না জানলেই ভাল। দাদুর পিসতুতো বোনের নাতনি, কাউকে জীবনে চোখেও দেখিনি শুধু ইচ্ছেদিদাকে ছাড়া। চল, তোদের বিয়ের খাওয়াটাই খাব।”

কথাগুলো বলার সময় কলাবতীর মনের মধ্যে খচখচ করছিল একটাই কথা : দাদু শুনলে কী বলবে? অত দামি একটা গহনা কিনা ভুল জায়গায় দিয়ে এলুম!

”তুই একা এসেছিস?”

”সঙ্গে কাকাও আছে। ভুল নেমন্তন্নে এসেছি জানলে লজ্জায় পড়ে যাবে। এতক্ষণে হয়তো খেতে বসে গেছে।”

”সে আমি ম্যানেজ করে দোব। চল, তাড়াতাড়ি, বসার জায়গা পাস কিনা দ্যাখ।”

কলাবতীর হাত ধরে সুশি টেনে নিয়ে চলল। লম্বা টানা টেবিলগুলো তখন ভরে গেছে। কলাবতী গলা তুলে দেখার চেষ্টা করল কাকাকে এবং দেখতেও পেল। সত্যশেখর তখন সামনে দাঁড়ানো এক মহিলাকে হাত নেড়ে প্রাণপণে কী যেন বোঝাচ্ছে আর এদিক—ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ কলাবতীকে দেখতে পেয়ে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করল, ”কালু, কালু, এই যে, এই যে, এখানে তোর জায়গা রেখেছি, চলে আয়।”

”সুশি, ওই যে কাকা!”

ভিড়ের মধ্য দিয়ে কলাবতী এগিয়ে গেল, পেছনে সুশি।

”এই দেখুন, মিথ্যে কথা বলিনি, শুধু শুধু চেয়ার আটকে রাখিনি।” সত্যশেখর উদ্ভাসিত মুখে মহিলার দিকে তাকাল। ব্যাজার মুখে সরে যাওয়ার সময় মহিলা বললেন, ”এ কী, অনাচ্ছিস্টির নিয়ম, যে আগে আসবে সেই তো আগে বসবে।”

”কাকা ভাল আছেন? আপনি যে আসবেন ভাবতেই পারিনি।” সুশি কয়েকবার কলাবতীদের বাড়িতে এসেছে, সত্যশেখরকে সে চেনে। সত্যশেখরের পাশের চেয়ারটা খালি, তার পাশের চেয়ারে হরিশঙ্কর। তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। মুখটা আড়চোখে দেখে নিয়ে সত্যশেখর বলল, ”আসব না মানে! ইচ্ছেদিদার নাতনির বিয়েতে আসব না?”

মুহূর্তের জন্য সুশির মুখ হতভম্ব হয়ে স্বাভাবিক হল কনুইয়ে কলাবতীর চিমটি খেয়ে।

”তা তো জানিই।” সুশির মুখ হাসিতে ভরে গেল। ”ইচ্ছেদিদা তো সন্ধে থেকে আপনার কথাই বলছিলেন।”

এই সময় একটা হইচই, ব্যস্ততা বিয়েবাড়িতে পড়ে গেল। শোনা গেল ”বর এসেছে, বর এসেছে।” সুশি চঞ্চল হয়ে উঠল। ”কাকা, আমি যাই, বরণের সময় শাঁখ বাজাতে হবে, লজ্জা করে খাবেন না কিন্তু।”

”না, না, লজ্জা কেন করব।” সত্যশেখর আশ্বস্ত করল সুশিকে। ”ওদিককার মতো কেটারিং সার্ভিস তো এদিকে নয় যে, চেয়ে চেয়ে খেতে হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”

হরিশঙ্কর চোখ বুজে গলা চুলকোচ্ছিলেন। সুশি চলে যাওয়ার পর বললেন, ”মেয়েটি কে কালু?”

কলাবতী টেবিলের তলা দিয়ে প্রায় হামা দেওয়ার মতো অবস্থায় শরীর গলিয়ে এধারে উঠে এসে চেয়ারে বসল। ‘সুশি তো ইচ্ছেদিদার ভাশুরের নাতনি। আমার বন্ধুও।”

বেগুনভাজা সহযোগে খানছয়েক লুচি শেষ করে সত্যশেখর ছোলার ডাল পবিশেনকারীকে ”আরও দু’হাতা দিন,” বলেই কলাবতীর কাছে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল, ”ইচ্ছেদিদার সঙ্গে দেখা হল?”

কলাবতী অস্ফুটে বলল, ”হুঁ।”

”আমি এসেছি কি না জানতে চাইল?”

”হুঁ।”

”যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাওয়া উচিত, কী বলিস?”

কলাবতীর মুখ দিয়ে এবার কোনও শব্দ বেরোল না। আড়চোখে দেখল কাকার পাতে কুমড়োর ছোঁকার একটা ঢিপি বসিয়ে দিয়ে লোকটি বলল, ”আপনাকে পরিবেশন করে সুখ আছে, খাইয়ে লোক তো আর দেখাই যায় না।”

”ফ্রাই হয়েছে?”

”হয়েছে।”

সত্যশেখর উত্তেজিত হয়ে চেয়ার থেকে চার ইঞ্চি উঠে আবার বসে পড়ল। ”আপনি পরিবেশন করবেন তো?”

”করব।”

হরিশঙ্কর মন্তব্য করলেন, ”এত ভাল ভাল জিনিস থাকতে সতুর নজর যত্তসব অখাদ্যের দিকে।”

আটটা ফ্রাই খেয়ে সত্যশেখর জানিয়ে দিল, ”কালু, আর কিছু খাব না শুধু কয়েক টুকরো মাছ, ব্যস, আজকের মতো শেষ।”

”দাদু বলে দিয়েছে তোমার ওপর নজর রাখতে।”

”নিশ্চয় রাখবি। খাইয়ে লোক তো আর দেখাই যায় না, দেখে নে। খুব ভাল করে নজর করে দ্যাখ। ভাল রান্নার মতো ভাল করে খাওয়াও একটি শিল্প, একটা আর্ট।”

আর্টের প্রদর্শনীতে সত্যশেখর জুড়ে দিল গোটাকয়েক পানতুয়া এবং সোজা বর্ধমান থেকে আনা হয়েছে শুনে, প্রায় চারশো গ্রাম সীতাভোগ।

অবশেষে একসময় হরিশঙ্করকে বলতে হল, ”সতু, আমরা যে উঠতে পারছি না, এবার ক্ষান্ত হও।”

হাত ধুয়ে সবাই বসে আছে। খুবই লজ্জা পেয়ে সত্যশেখর দইয়ের মালসা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবেশকের দিকে মাথা নেড়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। গ্লাসের জলে হাত ডুবিয়ে রুমালে আঙুল মুছতে—মুছতে সে বলল, ”কালু, এবার তো ইচ্ছেপিসির সঙ্গে একবার দেখা করা উচিত।”

কলাবতীর এখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। বিনা উপহারে তারা যাবে কী করে কনে দেখতে? দাদুর মানসম্মান তা হলে ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে। তার থেকে বরং কেটে পড়াই উচিত। কাকা তো জানেই না কার জন্য আনা উপহার সে কাকে দিয়ে ফেলেছে।

”কাকা, বড্ড গরম, একটু বাইরে বসি গিয়ে।”

”তাই চল, জিরিয়ে নিয়ে ইচ্ছেপিসির সঙ্গে দেখা করব।”

ওরা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে তখন দোতলার ডান দিকের বারান্দা থেকে জলদমন্দ্র কণ্ঠে হাঁক শোনা গলে, ”কালু না?”

এ—গলা ইচ্ছেদিদা ছাড়া আর কারও হতে পারে না। কলাবতীর বুকের মধ্যে কাঁপন লাগল। সে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, যা ভয় করেছিল সেটাই ইচ্ছেদিদার চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে।

”এত দেরি করলে কেন…ওপরে এসো। তোমার কাকা আসেনি?”

কলাবতী মাথাটা কাত করে আঙুল দিয়ে কাকাকে দেখাল।

”ওপরে এসো।”

”কাকা, ওপরে যেতে বলছে।”

”চল। এই একপেট খেয়ে আবার সিঁড়ি ভাঙা। হ্যাঁ রে ‘এত দেরি করলে কেন’ বললেন কেন? তুই তো অনেক আগে ওপরে গিয়ে উপহারটা দিয়ে এসেছিস, ইচ্ছেপিসির সঙ্গে দেখাও হয়েছে বললি।” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সত্যশেখর বলল।

”কাকা, একটা বিশাল ভুল হয়ে গেছে। দোষটা অবশ্য আমারই, আমি যে একটা গাধা আজ তা টের পেলুম। উফফ, দাদু শুনলে কী যে বলবে!”

”হয়েছে কী?” সত্যশেখর সিঁড়ি ভাঙা বন্ধ করে উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাল।

”ডান দিকের সিঁড়িতে না উঠে বাঁ দিকে উঠে পড়েছিলুম আর সেখানেই কনের হাতে উপহারটা দিয়ে দিয়েছি।”

”করেছিস কী! অত দামি গহনা দিয়ে দিলি? এখন কী হবে?”

”ফিরিয়ে আনব?”

”পাগল হয়েছিস। ওপরে চল। আর নয়তো এখান থেকেই সটকে পড়ি।”

”না, না, সেটা বিশ্রী দেখাবে। দিদা তো আমাদের দেখে ফেলেছে। চলো, ওপরেই যাই।”

কাকা আর ভাইঝি একগাল হাসি নিয়ে বারান্দায় ইচ্ছাময়ীর সামনে দাঁড়াল। চওড়া বারান্দা তখন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবে গিজগিজ করছে। সত্যশেখর কোনওক্রমে শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে প্রণাম করল, কলাবতীও।

”কত্ত ছোট্ট তোমাকে দেখেছিলুম আর আজ দেখছি। চলো, আমার নাতনিকে দেখবে, এই পাশের ঘরেই।” ইচ্ছাময়ীর কথা শেষ হতে—না—হতেই ঘর থেকে হুড়মুড়িয়ে মেয়েরা বেরোতে শুরু করল, ”বর এসেছে, বর এসেছে,” বলে।

ধাক্কা সামলাতে—সামলাতে সত্যশেখর বলল, ”কালু, বর আসা কখনও দেখেছিস, দেখার মতো একটা জিনিস।”

”না কাকা, কখনও তো দেখিনি। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।” কলাবতীর আদুরে গলায় বলল।

”তা হলে দেখবি চল। পিসিমা কালুকে একটু দেখিয়ে আনি।” সত্যশেখর কথা শেষ করেই ভাইঝির হাত ধরে টানল।

”দেরি কোরো না, তাড়াতাড়ি এসে কনে দেখে যেয়ো।”

”নিশ্চয় দেখব।” যেতে যেতে সত্যশেখর বলল, ”যা খিদে পেয়েছে তাড়াতাড়ি তো ফিরতেই হবে।”

দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বরের মোটরগাড়ি ঘিরে থাকা ভিড়টার পাশ কাটিয়ে, ফটক দিয়ে বেরিয়ে এসে দু’জনে প্রায় দৌড়ে একশো মিটার অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁফাতে—হাঁফাতে সত্যশেখর বলল, ”আর পারছি না রে একটু জিরোই। যাক, প্রণামটা তো করা হয়েছে, এতেই মনে করে রেখে দেবেন আমরা গেছলুম।”

”কাকা, দাদুকে কী বলব?”

”বলবি পেটভরে খেলুম, রান্না খুব ভাল হয়েছে—”

”আর উপহারের গহনাটা যে ভুল কনেকে দিয়ে এলুম! আমি কিন্তু দাদুকে মিথ্যে কথা বলতে পারব না।”

”বলবি না। বাবাকে তোর থেকে বেশি আমি চিনি। সত্যি কথা বললে সাতখুন মাফ করে দেবে।”

কলাবতীর কাছ থেকে সব শুনে রাজশেখর ঘরের কড়ি—বরগা কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলেন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুরদুর বুকে অপেক্ষা করছিল সত্যশেখর এইবার ঘরে ঢুকল।

”জানো বাবা, হরিকাকা আর একটু হলেই ধরে ফেলেছিল। কিন্তু কালুর বন্ধু সুশি এমন ম্যানেজ করে দিল যে, আমি পর্যন্ত টের পাইনি কালু ডাইনে—বাঁয়ে গুলিয়ে ফেলেছে।”

”ঠিক বলছিস হরি ধরতে পারেনি? ওকে বিশ্বাস নেই, তলে তলে ঠিক খোঁজ নেবে। ধরতে পারলে চারদিকে বলে বেড়াবে রাজুর ছেলেটা হাঁদা, নাতনিটা বোকা। সিংহিদের চিমটি কাটার সুযোগ পেলে তো ছাড়বে না, কালু, এ নিয়ে তুই চিন্তা করিসনি। উপহারটা যেই পাক একটা কনে তো পেয়েছে, ব্যস! ইচ্ছের নাতনিকে আমি একটা কিছু পরে দোব। তোর বন্ধু সুশিকে একদিন নেমন্তন্ন কর, ওর সঙ্গে ভাল করে আলাপ করব। মেয়েটি আমাদের মান রক্ষা করে দিয়েছে।”

.

নেমন্তন্ন করার আগেই দু’দিন পর বিকেলে সুশি এসে হাজির হল কলাবতীদের বাড়িতে। সঙ্গে ওর দাদা সমীর আর বউদি চঞ্চলা। ওরা দেখা করতে চায় রাজশেখরের সঙ্গে। সমীরের হাতে একটা অ্যাটাচি কেস।

”কী ব্যাপার রে?” ভয়ে ভয়ে কলাবতী জিজ্ঞেস করল সুশিকে।

”ব্যাপার গুরুতর, তুই যে উপহারটা বাচ্চচুদিকে দিয়ে এসেছিস সেটা ফিরিয়ে দিতে দাদা এসেছে। বাচ্চচুদি তো কিছুতেই নেবে না, আমরাও ওই উপহার গ্রহণ করতে পারব না। ভুল করে দেওয়া অন্যের জন্য অত দামি জিনিস কি নেওয়া যায়, তুই বল?”

”কিন্তু একবার দিয়ে ফেলা উপহার দাদুই বা ফিরিয়ে নেবেন কী করে? তাতে তো ওঁর মর্যাদা থাকবে না।”

বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে বিপন্ন মুখে দু’জন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। তখন বৈঠকখানায় রাজশেখর আলাপ করছিলেন সমীর আর চঞ্চলার সঙ্গে। পায়ের ব্যান্ডেজ খুললেও লাঠি হাতে রাজশেখর সাবধানে চলাফেরা করছেন। সমীর পূর্ব রেলের অফিসার, থাকে আসানসোলে।

”আরে, বোলতা আমি চিনব না। হুগলি জেলার প্রায় সব গ্রামেরই নাম আমি জানি। আমাদের আটঘরা থেকে দশ—বারো মাইল বড়জোর। খুব বর্ধিষ্ণু জায়গা বোলতা। স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়েছে, অনেক সরকারি দপ্তর হয়েছে, টেলিফোন আছে, প্রচুর টিভি সেট, একটা ব্যাঙ্কও আছে, কলেজও নাকি হবে শুনেছি।” রাজশেখর তাঁর নিজের জেলার প্রসঙ্গ পেলে একটু সোজা হয়ে বসেন। উত্তেজিত হয়ে ওঠার এটা প্রাথমিক লক্ষণ।

”ঠিকই শুনেছেন। আমরা একটা জমি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু যারা কলেজ করার জন্য উদ্যোগী হয়ে কমিটি করেছে তারা জমিটা নিতে চায়নি।” সমীরের স্বরে খেদ ফুটে উঠল।

”কেন? খুব বেশি দাম চেয়েছিলে?”

”আজ্ঞে না, নিঃশর্ত দান করব বলেছিলুম। প্রায় পাঁচ বিঘে জমি বাস—রাস্তার ওপর। কাছেই পোস্ট অফিস, থানা, জায়গাটা নির্জন। একটা বিশাল দিঘি আছে আমাদেরই বাড়ির পেছনদিকে। কলেজ করার আইডিয়াল জায়গা।”

”তা হলে?”

”জমিতে ভূত আছে। ওখানকার লোকদের বিশ্বাস। প্রায় দেড়শো—দুশো বছরের বিশ্বাস। তাই ওই জমিতে কেউ পা পর্যন্ত রাখে না, গোরু—ছাগল পর্যন্ত চরতে দেয় না। জমিটায় পা রাখলে নাকি তার মৃত্যু অবধারিত। শুনেছি অনেকে নাকি মারাও গেছে তবে আমরা শুধু শুনেই এসেছি ছোটবেলা থেকে, চোখে দেখিনি। জমিটা এখন জঙ্গল হয়ে আছে। পেয়ারাগাছে পেয়ারা হয়, বেলগাছে বেল, কুলগাছে কুল। কেউ পাড়তে যায় না। ফল হয় আর গাছেই থাকে, তারপর জমিতে পড়ে পচে যায়। আমাদের বাড়ির লাগোয়াই পুরনো ভাঙা বাড়ি আর পোড়ো একটা শিবমন্দির আর তার গায়েই জমিটা।”

”আশ্চর্য তো!” রাজশেখর টানটান হয়ে বসলেন। ”খুব ইন্টারেস্টিং। একবিংশ শতাব্দীতে আমরা পা দিতে চলেছি আর আমার জেলার লোক কিনা এখনও ভূতপ্রেতকে ভয় পায়।” রাজশেখরকে যত না অবাক তার থেকেও বেশি লজ্জিত দেখাল।

এই সময় কলাবতী ও সুশি বৈঠকখানা ঘরে ঢুকল। এতক্ষণ ওরা বাইরের বারান্দায় শলাপরামর্শে ব্যস্ত ছিল, আর ঘরের কথাবার্তা শুনছিল।

”দাদু”। কলাবতী রাজশেখরের গা ঘেঁষে বসল। দাদুর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। ”দাদু, তোমার জেলার লোকদের পক্ষে এটা নিশ্চয় খুব লজ্জার, তাই না?”

”নিশ্চয়। ভূতে বিশ্বাস করে কারা? ভিতু, কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা।”

”তা হলে এই ভূতের ভয়টা তো ভেঙে দেওয়া উচিত। কী বলো?”

”ভাঙবেটা কে? আমার পা—টায় এখনও তেমন জোর ফেরেনি নইলে আমিই গিয়ে—একবার ভাব তো, কলেজ করার জন্য অতবড় একটা জমি কিনা ভূতের মাঠ হয়ে পড়ে আছে, কলেজ হবে না!”

”তুমি নাই বা গেলে, সিংহিবাড়িতে কি আর লোক নেই? সুশি দেশের বাড়িতে যাচ্ছে সামনের শনিবার, আমিও ওর সঙ্গে বোলতায় যাব। দেখব ভূত আমার ঘাড় মটকাতে পারে কি না।” কলাবতী বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের ঘুসি বসাল।

রাজশেখর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ”অবশ্যই যাবি। সিংহিরা ভূতপ্রেত দৈত্যদানোকে কোনওদিন ভয় করেনি, শুধু একবার মাত্র আমার বাবা সোমেন্দ্রশেখর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে পঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ক্রিকেট ম্যাচে ভয় পেয়েছিলেন মহম্মদ নিসারকে ফেস করতে গিয়ে। বলেছিলেন, বল হাতে যখন ছুটে আসছিল তখন ওকে দেখে হাঁটু দুটো একটু কেঁপে উঠেছিল। ব্যস, সারা সিংহি বংশের হিস্ট্রিতে ওই একটাই ভয় পাওয়ার কেস পাওয়া গেছে। ভূতেরা কি নিসার, লারউডের থেকেও ভয়ঙ্কর?…নিশ্চয়ই যাবি।”

”কিন্তু দাদু,” গলাখাঁকারি দিয়ে সুশি এবার বলল, ”এটা কিন্তু খুব ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপার হয়ে যাবে। বোলতার লোকেরা দেড়শো—আড়াইশো বছর ধরে, মানে বর্গির আমল থেকে বিশ্বাস করে আসছে ওই মাঠে অপদেবতা বাস করে। শুধু শুধু কি আর বিশ্বাস করে, নিশ্চয় ভূতটুত তারা দেখেছে। না দাদু, কালুর ওখানে গিয়ে কাজ নেই, কিছু একটা হয়েটয়ে গেলে—”

”ওহ, তুমিও দেখছি এইট্টিনথ সেঞ্চুরিতে পড়ে রয়েছ।” হতাশ স্বরে কথাটা বলে সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে রাজশেখর চোখ বুঝলেন। সমীর ও চঞ্চলা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। সমীর টেবিলে রাখা অ্যাটাচি কেসটা খুলল।

”যেজন্য আমরা এসেছি জ্যাঠামশাই।” সমীর কুণ্ঠিত স্বরে বলল।

”কী জন্য?” রাজশেখর চোখ খুললেন। সমীরের হাতে গহনার বাক্সটা দেখেই তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল, অথবা বলা যায় সিংহের কেশর ফুলে উঠল।

”এটা কী?” গর্জনই বলা যায়, রাজশেখরের প্রশ্নটিকে।

সমীর কিন্তু ঘাবড়াল না। শান্ত দৃঢ়স্বরে সে বলল, ”এটা আমাদের বাচ্চচুর জন্য আপনি পাঠাননি। ইচ্ছার নাতনিকে দিচ্ছেন বলে এই কাগজটায় লেখা রয়েছে। এ—জিনিস বাচ্চচু নেবে না। ফেরত দেওয়ার জন্য আশা করব তার অপরাধ আপনি ক্ষমা করবেন।”

সারা ঘরে শব্দ নেই। সব চোখ রাজশেখরের মুখের দিকে। কঠিন মুখটি ধীরে—ধীরে কোমল হয়ে এল। দুই চোখে ফুটে উঠল কৌতুক মেশানো স্নেহ। ধীর স্বরে তিনি বললেন, ”দুটো শর্তে নিতে পারি। ইচ্ছার নাতনিকে কিছু একটা দোব বলে মন স্থির করেছি, সেটা দোব বাচ্চচুকে নিজের হাতে। ওকে একদিন আমার কাছে নিয়ে আসবে। দ্বিতীয় শর্ত, কালু বোলতায় যাবে। ‘কিছু একটা হয়েটয়ে গেলে’ এই ভয়ে সিংহিবাড়ির মেয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকবে আমি বেঁচে থাকতে? তাই কখনও হয়।”

”দুটো শর্তই আমরা মানব।” এতক্ষণে কথা বলল চঞ্চলা।

কলাবতী দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠল, তাকে জড়িয়ে ধরল সুশি।

”কালু, এবার এদের মিষ্টি—মুখ করানোর ব্যবস্থা কর, এই প্রথম এরা আমাদের বাড়িতে এসেছে।”

কলাবতী ভেতরে গিয়ে দাদুর নির্দেশ জানিয়ে এল মুরারিকে। কলাবতী কবে, কার সঙ্গে, কীভাবে বোলতায় যাবে রাজশেখর সেইসব বিষয় জেনে নিচ্ছিলেন আর দেশের বাড়ির খবরও।

”দেশের বাড়িতে থাকেন আমার কাকা। বিয়ে করেননি, একা মানুষ, বয়সে আপনার থেকে একটু ছোটই হবেন। আমরা ওঁকে ডাকনামেই ব্যাংকাকা বলে ডাকি।” সমীর জানাতে লাগল রাজশেখরকে তাদের দেশের বাড়ির কথা। ”জমিজমা, চাষবাস, ফলের বাগান, মাছচাষ সবকিছুই দেখাশোনা, বিক্রিটিক্রি করা ব্যাংকাকাই করেন। দোতলা বাড়ি, সাত—আটখানা ঘর সবই ফাঁকা পড়ে আছে, বছরে এক—আধবার আমরা যাই। আমি তো দেড় বছর যাইনি, সুশি তো তবু গত বছর গেছল। ব্যাংকাকার খেলাধুলোয় খুব উৎসাহ। বোলতা স্পোর্টিং ক্লাব, বি এস সি—র আজীবন প্রেসিডেন্ট, টাকা দিয়ে ক্লাবটাকে উনিই চালান। আমরা কেউ গেলে উনি খুব খুশি হন।”

”ওই যে বললে একটা পোড়ো শিবমন্দির আছে, ওটা কবেকার?” রাজশেখর কৌতূহলভরে জানতে চাইলেন।

”লোকমুখে শুনেছি ওটা নাকি বর্গিদের প্রতিষ্ঠা করা।”

”তার মানে পলাশির যুদ্ধের পনেরো বছর আগে, নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলে। নাগপুর থেকে মারাঠি বর্গিরা ঘোড়ায় চেপে আসত লুটপাট করতে, নিষ্ঠুরভাবে খুন করে আগুন লাগিয়ে ছারখার করে দিয়েছিল বাংলাকে।” রাজশেখর বললেন, ”ওদের রণহুঙ্কার ছিল, ‘হর হর মহাদেও’। শিবের ভক্ত ছিল ওরা।”

”ওদের আসার খবর পেলেই গ্রাম ছেড়ে মানুষ পালাত।” চঞ্চলা বলল, ”তখনই তো বাচ্চচাদের ভয় দেখাতে ঘুমপাড়ানি ছড়াটা তৈরি হল, ‘ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োল বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।’ এখন অবশ্য এই ছড়ায় বাচ্চচারা আর ভয় পায় না।”

”কিন্তু ভূতের ভয় পায়। তবে শুদু আমাদের কেন সারা পৃথিবীর বাচ্চচারা ভয় পায় আর সেইজন্যই তো ভূতের গল্প শুনতে চায়।” সমীর বলল।

”কিন্তু বর্গিরা শিবমন্দিরটা তৈরি করেছিল, এটা কি বিশ্বাস করা যায়?” রাজশেখর তাঁর সন্দেহটা জানালেন।

”আমি তো করি না।” সমীর বলল। ”বর্গিরা তো লুটপাট করে চলে যেত। তাদের অত সময় কোথায় মিস্ত্রি খাটিয়ে ছ’—সাত মাস ধরে মন্দির তৈরি করার? তবু বোলতার লোকের ধারণা মন্দির নাকি বর্গিরা তৈরি করেছে। আর ভূত তৈরির গল্পটা শুনবেন?”

ট্রে—হাতে, আম, লিচু, তালশাঁস, সন্দেশ আর ঘোলের শরবত নিয়ে মুরাবি ঘরে ঢুকল। রাজশেখর বললেন, ”প্লেটগুলো খালি করতে করতে বলো তোমার ভূত তৈরির গল্প।”

সমীর কাঁটা দিয়ে এক টুকরো আম মুখে ভরে শুরু করল। ”আমাদের এখনকার বাড়ি থেকে ষাট—সত্তর গজ দূরে পুরনো বাড়িটা। পূর্বপুরুষরা একটা গড় তৈরি করেছিলেন। তাই লোকে বাড়িটাকে বলত গড়বাড়ি। জায়গাটার নামও হয়ে যায় গড়বাড়ি। এখন গড়বাড়ি একটা ধ্বংসস্তূপ। এই গড়ের পাশেই একটা প্রকাণ্ড দিঘি খোঁড়া হয়। এখন সেটা বুজে বুজে আর আগের মতো নেই। দিঘিটাকে বলা হয় গড়ের দিঘি। জংলা আগাছায় ভরা এই দিঘির সংস্কার হয়নি, মাছ আছে কিন্তু প্রচুর। বছরে একবার মাছ বিক্রি করেন ব্যাংকাকা। এই দিঘির কিনারেই শিবমন্দির। মন্দিরটাকে জড়িয়ে আছে একটা অশ্বত্থ গাছ। দূর থেকে মনে হয় জটাজূট ভরা একটা বিশাল মাথা। মন্দিরের গা বেয়ে নেমেছে মোটা—মোটা ঝুরি আর ডালপালা। কত যুগ যে পুজো হয় না তা বলতে পারব না, দেড়শো—দুশো বছর তো হবেই। শিবমন্দিরে যেতে হলে ওই ভূতের জমির ওপর দিয়ে যেতে হবে নয়তো দিঘির দিক দিয়ে নৌকোয় করে যেতে হবে। অতএব কেউ আর শিবমন্দিরের ধারেকাছে মাড়াত না, ফলে পুজোটুজো বন্ধ হয়ে যায় আপনা থেকেই।

”তখনকার দিনে ডাকাতের খুব ভয় ছিল। ডাকাতির হাত থেকে বাঁচার জন্য গড়বাড়ির নীচে একটা পাতালঘর তৈরি করা হয়েছিল। সেটা লম্বায় কতটা চওড়ায় কতটা তা আমরা জানি না, কেননা কেউই কোনওদিন সেই পাতালঘরটা চোখে দেখিনি। মাটির নীচে ঘর, সেখানে যাওয়ার রাস্তা বা সিঁড়িটা কোথায় তাও আমরা জানি না। কেউ জানার চেষ্টাও কখনও করেনি। শুনেছিলাম আজ থেকে একশো পঁচিশ বছর আগে এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট পাতালঘরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গড়ের মাঠের খানিকটা খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলেন। কিন্তু কাজটা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বদলি হয়ে যান, কাজ আর এগোয়নি। খোঁড়াখুঁড়িতে দু—চারখানা ছোট—ছোট পাতলা ইট বেরিয়ে ছিল, তাতে দেবনাগরি অক্ষরে কারও নামের আদ্যক্ষর লেখা ছিল। আমি কেন আমার ঠাকুর্দার বাবাও সে ইট চোখে দেখেনি।”

রাজশেখর সকলের খাওয়া দেখা আর সমীরের গল্প শোনা, দুটো কাজ একসঙ্গেই সারছিলেন। খালি প্লেটগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ”আর দুটো আম দিক।”

”না, না, আর না।” সমীর মাথা নাড়ল।

”সন্দেশ?”

সমীরের মাথা স্থির রইল এবার।

”মুরারি।” রাজশেখর হাঁক দিলেন। ”বলো, তারপর।”

সমীর শুরু করল, ”তারপর বর্গিদের কথা। ধনী লোকেদের বাড়িতে তখন খুব ডাকাত পড়ত। ডাকাত আসছে শুনলেই টাকাকড়ি, গহনা, দামি জিনিসপত্তর নিয়ে একটা সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ওই লুকনো পাতালঘরে বাড়ির সবাই আশ্রয় নিত। ডাকাতরা চলে গেলে বেরিয়ে আসত। সুড়ঙ্গপথটা যাতে ডাকাতরা আবিষ্কার করতে না পারে সেজন্য সেটা বাইরে থেকে বন্ধ করে তালাচাবি দিয়ে চাবিটা খুব বিশ্বাসজনক কাউকে দিত। চাবি নিয়ে সেই লোকটি বাড়ির কাছাকাছি একটা ঝাঁকড়া গাছে উঠে লুকিয়ে বসে থাকত। ডাকাতদের আসা আর চলে যাওয়া দেখার পর লোকটা গাছ থেকে নেমে এসে চাবি দিয়ে তালা খুলে দিত।

”বোলতার দিকে বর্গিরা আসছে খবর পেয়েই আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁদের সঞ্চিত ধনসম্পত্তি নিয়ে গড়বাড়ি থেকে সুড়ঙ্গপথে পাতালঘরে পালিয়ে আশ্রয় নেন। তাঁদের একজন বিশ্বস্ত কাজের লোক সুড়ঙ্গের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে তালাচাবি দিয়ে দিঘির পাড়ে একটা পুরনো তেঁতুলগাছে উঠে লুকিয়ে বসে থাকে। এদিকে বর্গিরা ঘোড়ায় চড়ে এসে হাজির। গ্রামের লোকজন যার যা কিছু সম্বল ছিল তাই নিয়ে আগেই পালিয়েছে। বর্গিরা গড়বাড়িতে ঢুকে দেখল চারদিকে ভোঁ ভাঁ। গোয়ালে গোরু পর্যন্ত নেই, বড় বড় সিন্দুকের ডালা খোলা, ভেতরে সোনার একটা দানাও নেই, অগত্যা তারা হতাশ হয়ে বোলতা ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু দু’—চারজন বর্গি নাকি তখনও গড়বাড়ির আশেপাশে জঙ্গলে ঘুরছিল।

”যে বিশ্বস্ত কাজের লোক তেঁতুলগাছের মগডালে চড়ে বসেছিল, সে যখন দেখল বর্গিরা চলে গেছে তখন সে গাছ থেকে নেমে গড়বাড়ির দিকে এগোল তালা খুলে দেওয়ার জন্য। যে বর্গিগুলো জঙ্গলে ঘুরছিল তাদের একজনের চোখে পড়ে যায় ওই চাকরটা। ব্যস, সঙ্গে—সঙ্গে পাকড়াও আর খবর বার করার জন্য অকথ্য মার। কিন্তু শত অত্যাচারেও বর্গিরা তার মুখ দিয়ে একটা কথাও বার করতে পারল না। তখন প্রচণ্ড রাগে তারা তরোয়াল দিয়ে কাজের লোকটার মুণ্ডচ্ছেদ করে।”

সমীর জল খাওয়ার জন্য কথা বন্ধ করল। মুরারির নতুন করে আনা সন্দেশের প্লেট তখনও খালি হয়নি। একটা সন্দেশ তুলে নিয়ে সমীর আবার শুরু করল। ”এখানে দু’রকম গল্প বোলতায় চালু আছে। একটা হল, বর্গিরা কাজের লোকটাকে মেরে ফেলার পর তার শরীর তল্লাশ করে সুড়ঙ্গের চাবি পেয়ে যায়। এর পর খোঁজাখুঁজি করে সুড়ঙ্গের দরজাও বার করে ফেলে, তারপর অন্য বর্গিদের ডেকে এনে পাতালঘরে যারা লুকিয়ে ছিল তাদের কচুকাটা করে তাদের সর্বস্ব লুট করে চলে যায়। সেই মৃতরাই নাকি পরে ভূত হয়। আর একটা গল্প হল, সেই কাজের লোকটাকে খুন করে লাশটা ফেলে রেগে বর্গিরা নাকি চলে যায়। ওদিকে পাতালঘরে আশ্রয় নেওয়া লোকেরা তো আটকা পড়ে থাকে। চাবিটা তো লাশের পোশাকের মধ্যে। অবশেষে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে সেই লোকগুলো দরজা—বন্ধ পাতাল ঘরের মধ্যে একে একে মারা যায়। এরাই পরে ভূত হয়েছে।” সমীর হাসল। তার গল্প আর সন্দেশ দুটোই শেষ।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ। প্রথম কথা বলল কলাবতী, ”আচ্ছা দাদু, ভূতেরা কতদিন বাঁচে?”

”যতদিন মানুষের মনে ভয় থাকে ততদিন বাঁচে। তবে এই গড়বাড়ির পাতালঘরের ভূতেদের আড়াইশো বছর বেঁচে থাকার কোনও যুক্তি নেই। আছে কী?” রাজশেখর তাকালেন সমীরের দিকে।

”আছে, কেননা বোলতায় ভয়টাও বেঁচে আছে। ওখানকার লোকের ধারণা ওই গড়বাড়ির জমিতে বাড়ি তৈরি করে বাস করলে তার সর্বনাশ হবে। ওখানে অপদেবতারা বাস করে। আমার ঠাকুর্দার আমলে একজন প্রচলিত প্রবাদ অগ্রাহ্য করে বাড়ি করেছিল। গৃহপ্রবেশের দিন পরিবারের কর্তা কলেরায় মারা যায়, তারা বাড়ি বিক্রি করে দেয়। যিনি কেনেন তাঁর একমাত্র ছেলে বাড়িতে বাস করার তিনদিনের মধ্যে গড়ের দিঘিতে ডুবে মারা যায়। তাঁরাও বাড়ি বিক্রি করে দেন। যারা কিনল তাদের কেউ মরেনি তবে তিনদিনের মাথায়ই বাড়িতে আগুন লেগে তারা সর্বস্বান্ত হয়। ব্যস, বোলতায় আরও পাকাপোক্ত হয়ে গেল ভূতের ভয়। একজন পাঁচ কাঠা জমি কিনেছিল, এর পর আর বাড়ি করেনি।”

”যে বাড়িটা হয়েছিল, সেটা এখনও আছে?” কলাবতী জানতে চাইল।

”নেই। পুড়ে একদম ছাই হয়ে গেছে।” সমীর উঠে দাঁড়াল। ”এবার আমরা আসি জ্যাঠামশাই। পরশু শনিবার সুশি বোলতা যাবে। ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। হাওড়া স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে এক ঘণ্টা, তারপর ১৫ মিনিট বাসে, তারপর সাইকেল রিকশা একাই চলে যাবে। গত বছর তো তাই গেছল। এবার তো সঙ্গে কলাবতী থাকবে। ব্যাংকাকা খুব খুশি হবেন।”

”সুশি তা হলে শনিবার আমাদের বাড়ি চলে আয়, খেয়েদেয়ে দু’জনে একসঙ্গে স্টেশনে যাব।” কলাবতী ঘরের দরজার দিকে এগোল ওদের সঙ্গে। ”উফফ, কতদিন যে ইলেকট্রিক ট্রেনে চড়িনি।”

সেইদিন রাতে কলকাতায় হঠাৎই দমকা ঝড় উঠল মিনিটদশেকের জন্য। ঘন ঘন মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। আধঘণ্টা পর সব শান্ত। তারপর ফোন এল স্কুলের বড়দি মলয়া মুখার্জির কাছ থেকে। মলয়া প্রায়ই রাতে কলাবতীকে ফোন করে ওর খবর নেয়। ওদের মধ্যে এই ভাবে কথা হল :

”কালু, বৃষ্টিতে ভেজোনি তো?”

”না বড়দি, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুধু চাঁপাগাছটা দুলে দুলে কীভাবে ভিজছে তাই দেখছিলুম।”

”ঠাণ্ডা পড়েছে, পাখা আজ বন্ধ রাখবে।”

”রাখব।”

”দাদুর পা কেমন? এখন তিনি কোথায়?”

”ভাল আছে। দাদু লাইব্রেরিতে ভূতেদের নিয়ে এক সাহেবের লেখা বই পড়ছে।”

”হঠাৎ ভূতেদের নিয়ে লেখা বই পড়ছেন?”

”আমি সুশির সঙ্গে মানে আমাদের ক্লাসের সুস্মিতার সঙ্গে ওদের গ্রামের বাড়ি বোলতায় যাব ভূত দেখতে, সামনের শনিবার। তাই দাদু জানতে চাইছে ভূত কোথায় থাকে বেলগাছে না শ্যওড়া গাছে না হানাবাড়িতে না মানুষের মনে।”

”সাহেবের বইয়ে বেলগাছ শ্যাওড়াগাছ থাকবে কী করে? ওরা কি এসব গাছ চোখে দেখেছে? বোলতাটা কোথায়?”

”আমাদের আটঘরা মানে আপনাদের বকদিঘিরও কাছাকাছি বোলতা জায়গাটা। হরিদাদু নিশ্চয়ই জানেন। বোলতার লোকেরা ভীষণ ভয় পায় সুশিদের পোড়ো গড়বাড়ি আর গড়ের মাঠটাকে। বর্গিরা সুশিদের পূর্বপুরুষের অনেককে খুন করেছিল, তারাই নাকি ভূত হয়ে রয়েছে।”

”বর্গিরা খুবই অত্যাচার করেছিল, বিশেষ করে আমাদের হুগলি জেলায়। তুমি তো জানো না, রঘুজি ভোঁসলের ছেলে জানাজির সর্দারিতে শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেন পর্যন্ত এসে পড়েছিল। গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা অ্যাটাক করতে পারে এই ভয়ে সতেরোশো বিয়াল্লিশে ইংরেজরা বাগবাজার থেকে আদি কলকাতার পূর্ব দিক ঘিরে গর্ত খোঁড়ে গোবিন্দপুর পর্যন্ত। তাকে বলা হত মারহাট্টা ডিচ। এখন অবশ্য এই ডিচটা নেই। বছর চল্লিশ পরেই এটা বুজিয়ে ফেলে একটা রাস্তা তৈরি করা হয়। ওই রাস্তাটার নাম কী বলো তো?”

”সার্কুলার রোড। এখন তার দুটো নাম, দুই আচার্য—প্রফুল্লচন্দ্র আর জগদীশচন্দ্রের নামে। দাদু বলেছে বহু লোক ভুল করে বাগবাজার থেকে উল্টোডাঙা মানিকতলা বেলেঘাটা যে খালটা তাকে মারহাট্টা ডিচ বলে।”

”বোলতায় কিন্তু বেলগাছ কি শ্যাওড়াগাছের দিকে একদম যাবে না, শুধু দূর থেকে দেখবে। আমার একটা বায়নাকুলার আছে সেটা নিয়ে যেতে পারো ভূত দেখতে সুবিধে হবে।”

”বড়দি, আপনি তিন বছর বিলেতে থেকে ডক্টরেট করে এলেন আর কি না ভূতে বিশ্বাস করেন?”

”কে বললে করি? ভূতটুত ওসব মনগড়া ব্যাপার। তবে কি না হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে তাকে চট করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ভাল কথা আমার বায়নাকুলারটা বোধ হয় তোমাদের বাড়ির কারও কাছে আছে।”

”হ্যাঁ, কাকার কাছে। ভাবছি কাকার ক্যামেরাটাও নিয়ে যাব, ভূতের ছবি তুলে রাখব। আর আমার টেপ রেকর্ডারটাও নেব ভূতের গলার স্বর যদি—”

”আহা—হা, আবার ক্যামেরা—টেপ রেকর্ডার কেন? কাছে যাওয়ার মতো কোনও ব্যাপারেই থাকবে না। ভূতেরা আধুনিক যন্তরপাতি একদমই পছন্দ করে না। তুমি খুব স্মার্ট পোশাক সঙ্গে নেবে মানে শাড়িটাড়ি নয়, দৌড়ে যাতে পালাতে সুবিধে হয় এমন কিছু সবসময় পড়ে থাকবে—বারমুডা, জিনস, সালোয়ার কামিজ, তুমি তো এসব পরোই, তবে গ্রামের লোক পছন্দ নাও করতে পারে। ভূতেদের পা খুব লম্বা মনে রেখো, তাড়া করলে পালাতে পারবে তো?”

”মনে হয় পারব। স্কুলের স্পোর্টসে একশো, দু’শো, চারশো মিটার দৌড়ে তো ফার্স্ট হয়েছি বরাবর।”

”আর শোনো, সুশির উপস্থিত—বুদ্ধিটা খুব ভাল, ওকে সবসময় কাছে কাছে রাখবে। মনে আছে তো স্কুলের স্পোর্টসে ও তোমাকে কীভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিল!”

”মনে আছে। এই সেদিন বিয়েবাড়িতে ওর উপস্থিত—বুদ্ধির আর একটা প্রমাণ পেলুম। ও না বাঁচালে আমি আর কাকা খুব লজ্জায় পড়ে যেতুম। পরে সব বলব কী ঘটেছিল। এখন ফোন রাখছি, খাওয়ার ডাক পড়েছে।”

”পাখা বন্ধ রাখবে।”

”রাখব।”

”বেলগাছ দূর থেকে দেখবে। মনে রেখো ভূতেদের পা খুব লম্বা হয়।”

সুশি সম্পর্কে মলয়া যে উপস্থিত বুদ্ধির কথা বলল, সেটা অনেকেই জানে। তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি। স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টসে ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতায় কলাবতী সেজেছিল গুণ্ডা। সে এমন মেকআপ নিয়েছিল যে, উপস্থিত সব শিক্ষিকা, অভিভাবক আর ছাত্রীরা, প্রায় দু’শো লোক, কেউ বুঝতেই পারেনি হলদে কাপড়ের টুপি মাথায়, কালো কাচের চশমা চোখে, ফুলহাতা লাল জামা আর জিনস পরা ছিপছিপে চেহারার, থুতনিতে হালকা দাড়ি, হাতে একই ছ’ইঞ্চি ফলার ছুরি নিয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে যে গুণ্ডাটা আসলে সে কলাবতী। হেডমিস্ট্রেস অর্থাৎ বড়দি মলয়া মুখার্জি যখন নিরুপায় হয়ে মাইক্রোফোনে চিৎকার করলেন ‘হেল্প হেল্প, পুলিশ, পুলিশ, বাঁচান আমাদের বাঁচান।’ তখন উপস্থিত কিছু পুরুষ গুণ্ডাটাকে ধরার জন্য এগোতে থাকে। কলাবতী বিপদ বুঝে পালাবার জন্য এধার—ওধার যখন তাকাচ্ছে তখনই সুশি ‘আঁ আঁ আঁ’ শব্দ করে চোখ উলটে মূর্ছা যায়। সবার নজর কলাবতীর থেকে ঘুরে গেল সুশির দিকে আর সেই ফাঁকে কলাবতী ছুটে মাঠ থেকে পালায়। গো অ্যাজ ইউ লাইকের প্রথম পুরস্কারটা অবশ্য সে—ই পেয়েছিল।

.

কাঁকুড়গাছির মোড় থেকে বাসে উঠেই সুশি বলল, ”এই মুহূর্ত থেকে বোলতা হয়ে কাঁকুড়গাছির বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত সব খরচ আমার। তুই আমার অতিথি, একদম পকেটে হাত ঢোকাবি না।”

কলাবতী বলল, ”কিন্তু ট্রেনে ঝালমুড়ি, বাদাম, শশা—”

”সব আমার।”

দু’জনেরই কাঁধ থেকে ঝুলছে মোটা কাপড়ের অ্যাডিডাসের ক্যারিব্যাগ। বড়দি যেসব পোশাক নিতে বলেছে কলাবতী সেগুলো নিয়েছে। মাত্র ক’টা দিন তো থাকবে তাও গ্রামের মতো জায়গায়, বিয়েবাড়িতে তো আর যাচ্ছে না। পুজোটুজোও এখন নেই। ক্রিকেট খেলার জন্য ভারতের কয়েকটা শহর সে ঘুরে এসেছে। তার ধারণা আছে কোথায় কী পোশাক নিয়ে যেতে হবে। তার ব্যাগে আছে টেপ রেকর্ডার আর গানের ক্যাসেট। বায়নাকুলার বা ক্যামেরা নেয়নি। ঘুরে বেড়াবার জন্য কাপড়ের পাম্পশুটা নেব নেব করেও তার বদলে হাওয়াই চপ্পল নিল।

এগারোটা তেত্রিশের ট্রেনে উঠে বারো—তেরোটা স্টেশন ছুঁয়ে পৌনে একটায় তারা ট্রেন থেকে নামল, মাত্র পনেরো মিনিট লেট করেছে তারকেশ্বর লোকাল। ভিড় ছিল না, বসেই এসেছে সারা পথ এবং দু’জন ঝালমুড়িওয়ালাকে সমৃদ্ধ করেছে আট টাকায়, শসাওলাকে দু’টাকায়, বাদামওলাকেও দু’টাকায়, কলাবতী এক সফট ড্রিঙ্কসওলাকে ডাকতে যাচ্ছিল সুশি বাধা দেয়, ”খবরদার খাবি না, ট্রেনে সব নকল জিনিস, খেলেই কিন্তু জন্ডিস।”

ওরা যে যাচ্ছে ব্যাংকাকাকে সেটা অবশ্য গতকাল জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুশিদের দেশের বাড়ির কাজের লোক জনার্দন যাকে ওরা জনাদা বলে, তার হাত দিয়ে ব্যাংকাকা গোটা কুড়ি ল্যাংড়া আম আর শ’খানেক লিচুর সঙ্গে একটা থলিতে বেঁধে এক বিঘত লম্বা দশটা কইমাছ আর প্রায় এক কেজি বাড়িতে তৈরি গাওয়া ঘি পাঠিয়ে দেন। কালই জনাদা ফিরে গেছে বোলতায়, সঙ্গে চিঠি নিয়ে। মুখেও অবশ্য তাকে বলে দেওয়া যেত কিন্তু জনাদার শ্রবণশক্তি কিছুটা গোলমেলে। তাকে বলা হয়েছিল দু’কেজি মতো কই পেলে ব্যাংকাকা যেন পাঠিয়ে দেয়। তিনদিন পর ব্যাংকাকা দু’কেজি খই পাঠিয়ে দেন, সঙ্গে একটা চিঠি—’হঠাৎ খইয়ের দরকার হল কেন, কলকাতাতে কি খইয়ের আকাল পড়েছে?’ অতঃপর চিঠি দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিতে দশটা কইমাছের সঙ্গে আম, লিচু আর ঘি তিনি পাঠিয়ে দেন।

ট্রেনের পর বাসে দশ মিনিট গিয়ে নামল ইকড়ি নামে একটা জায়গায়। সুশি বলল, ”এখানে সুবল সামন্তর দোকানের মাখা সন্দেশ খুব ফেমাস, খাবি?”

কলাবতী সঙ্গে—সঙ্গে রাজি। বাসস্টপের কাছেই দোকানটা। ওরা দুশো গ্রাম করে সন্দেশ দোকানের বেঞ্চে বসে খেল। খেতে খেতে কলাবতী বলল, ”এখানে ঘড়ির দোকান আছে? আমার ব্যান্ডটা ছিঁড়ব ছিঁড়ব হয়েছে, বদলাতে হবে।”

”আমাদের বোলতায় ঘড়ি, ট্রানজিস্টার, টিভি সবকিছু সারানোর দোকান আছে, ওখানেই পেয়ে যাবি।”

এর পর ওরা সাইকেল—রিকশায় রওনা দিল বোলতার উদ্দেশে। যেতে যেতে যা কিছু চোখে পড়ছে অবাক হয়ে যাচ্ছে কলাবতী। বিশাল একটা বাঁশবন দেখে সে বলল, ”সুশি, এখানে বাঘ থাকে?”

”বাঘেদের তো মাথা খারাপ হয়নি। এখানকার লোক পিটিয়ে কিমা করে দেবে।”

”ওটা কী গাছ রে?”

”ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখ, কী ঝুলছে গাছে?”

”ওমমা, তাই তো কত্ত কালোজাম!”

”আমাদের বাগানেও আছে, কত খেতে পারিস দেখব।”

রাস্তাটা দু’পাশের জমি থেকে উঁচু। একটা নিচু পাঁচিল দেওয়া পুরনো বাড়ির সিমেন্ট বাঁধানো লম্বা দাওয়ায়, রৌদ্রের মধ্যে ছাতা মাথায় এক বৃদ্ধা বসে কৌতূহলে তাকিয়ে দেখছিলেন কারা সাইকেল—রিকশায় চড়ে যাচ্ছে।

”সুশি, সুশি, দেখেছিস!” বৃদ্ধার দিকে আঙুল তুলল কলাবতী।

সুশি তাকাল। তার চোখ পড়ল বৃদ্ধা ছাড়াও আরও কিছুতে।

”এই রিকশাওলা, থামাও, থামাও।” সুশি চেঁচিয়ে উঠতেই রিকশাওলা ব্রেক কষল। লাফ দিয়ে নামতে নামতে সুশি বলল, ”একটু দাঁড়াও, আসছি।”

বাড়ির সদর দরজাটা খোলা। কলাবতী দেখল সুশি দৌড়ে ঢুকল। বৃদ্ধার কাছে গিয়ে প্রণাম করে কী যেন বলল। বৃদ্ধার মুখ ভরে গেল হাসিতে। দু’জনে কী যেন কথা হল। আঙুল দিয়ে বৃদ্ধা পাঁচিলের ধারের কলাগাছটা দেখালেন, সুশি ছুটে গিয়ে কলাপাতা ছিঁড়ে আনল। বৃদ্ধার সামনে ঢাকনা খোলা চারটে আচারের বোয়েম। তিনি তাই থেকে আচার তুলে তুলে কলাপাতায় রাখলেন। সুশি আঙুল দিয়ে রিকশায় বসা কলাবতীকে দেখাল। বৃদ্ধা আর একটু আচার দিলেন। সুশি তারপর গদগদ মুখে কী যেন বলতে বৃদ্ধার মুখ স্নেহের, সুখের হাসিতে ভরে গেল।

”নে, ধর।” রিকশায় ওঠার আগে সুশি কলাপাতাটা কলাবতীর হাতে ধরিয়ে দিল। ”চলো গো এবার।”

”টক, মিষ্টি, ঝাল সবরকমের; আমের, তেঁতুলের আর করমচার। একটু—একটু করে বুড়ি দিল। লেবুরও ছিল, আমি আর চাইনি।” সুশি তেলচুপচুপে মশলামাখা আমের টুকরো মুখে দিয়ে বলল।

”তোর চেনা?”

”দুর, চেনা হতে যাবে কেন? স্রেফ গিয়ে বললুম, ঠাকমা কলকাতা থেকে আসছি তোমার হাতের আচার খাব বলে, দাও। না দিলে এখানে বসে কাঁদতে শুরু করব। বুড়ির সে কী হাসি! জিজ্ঞেস করল, কাদের বাড়ির মেয়ে তুই? বললুম। বলল, ব্যাংয়ের ভাইঝি? বাবার নাম কী? বললুম। বলল, ট্যাংরার মেয়ে তুই? তারপর কলাপাতা ছিঁড়ে আনতে বলল। আসার সময় বলল, ক’দিন আগে এলি না কেন, কামরাঙার আচারটা খাওয়াতে পারতুম। খেতে কেমন লাগছে রে কালু?”

”জবাব নেই। তোদের বাড়িতে ব্যাং আর ট্যাংরা ছাড়া আর কী আছে?”

”জ্যাঠামশাইয়ের ওজন ছিল তিনমন, নাম ফড়িং।”

”এইসব বুড়িরা এখনও আছে বলেই নাতনিরা চিরকাল নাতনিই থেকে যায়।”

গল্প করতে করতে ওরা বোলতার ফুটবল মাঠের ধার দিয়ে, বি এস সি—র ক্লাবঘরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছে তখন একটা শিকড়সমেত উপড়ে পড়া নিমগাছ দেখে কলাবতী বলল, ”এখানেও খুব ঝড় হয়ে গেছে দেখছি।”

কথাটা শুনে রিকশাওলা প্যাডেল করতে করতেই বলল, ”শুধু ঝড় নয় দিদিমণি, চার—পাঁচটা বাজও পড়েছে। আপনারা যে বাড়িতে যাচ্ছেন সেখানকার ভাঙা শিবমন্দিরে দু—দুটো বাজ পড়েছে। ইকড়ির বাসস্টপের কাছে দুটো লোক গাছতলায় বাজে মরেছে। সে যে কী অবস্থা, সারা জেলাটা তছনছ করে দিল বৃষ্টি আর বাজ।”

সুশি ভয়ে ভয়ে বলল, ”আর বাজ পড়বে না তো?”

কলাবতী বলল, ”আচ্ছা, ভূতেরা কি বাজকে ভয় করে?”

ব্যাংকাকা দোতলার বারান্দা থেকে ওদের আসতে দেখে নীচে নেমে এসে বাইরের উঁচু দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। শীর্ণকায়, কাঁচাপাকা চুল কদমছাঁটে, গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবি, পায়ে কাপড়ের পাম্প শু, ধুতি মালকোঁচা করা, চাহনিতে কৌতূহল। ওরা প্রণাম করতেই তিনি বললেন, ”ভাত খাবি তো? রান্না করাই আছে। আমি একটু বেরোচ্ছি। ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে, ঝড়ে গোলপোস্ট পড়ে গেছে, পরশু আবার সেমিফাইনাল খেলা। শেতলের মা রইল, যা দরকার ওকে বলবি। কালু কোনওরকম লজ্জা করবে না, নিজের বাড়ি মনে করবে।” এই বলে ব্যাংকাকা ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন।

দোতলায় দক্ষিণ—পশ্চিমের ঘরটায় ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বিরাট একটা সেকেলে পালঙ্ক, তাতে অন্তত চারজন বয়স্ক লোক পাশাপাশি শুতে পারে। মোটা মোটা দুটো পাশ বালিশ আর বালিশ। এক বিঘত চওড়া গদিতে ধবধবে সাদা চাদর পাতা। লাল সিমেন্টের মেঝেটা দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত মোছা হয়। সিলিংয়ে পাখা ঝুলছে। চারটে জানলাই বেশ বড়, খড়খড়ির পাল্লা দেওয়া। এইরকম ঘর কলাবতীদের আটঘরার বাড়িতেও আছে।

ঘরের বাইরেই রেলিং দেওয়া টানা বারান্দায় এসে সে দাঁড়াল। সেখানে থেকে পশ্চিমে গড়ের দিঘির অনেকটাই দেখা যায়। দিঘির পাড়ের কাছে নলবন আর জলাঘাসে ভরা। মাঝখানটায় কিন্তু পরিষ্কার টলটলে জল। দিঘির অপর পাড়ে কয়েকটা মাটির বাড়ি। তার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ট্রেকার চলছে। রাস্তাটা দিঘিকে বেড় দিয়ে বোলতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে তারকেশ্বরের দিকে। লোকে এর নাম দিয়েছে ‘বাবার সড়ক’।

বাড়ি থেকে একটা সরু পথ গেছে ভাঙাচোরা বাঁধানো ঘাটে। সেখানে একটা ছোট্ট নৌকো বাঁধা, তার আকৃতিটা ত্রিভুজের মতো। দুটো দাঁড় নৌকোর দু’ধারে লোহার কড়ায় আঁটা। দু’জন লোক পাশাপাশি বসে দাঁড় বাইতে পারে এমন একটা পাটাতন নৌকোয় পাতা।

কলাবতী সুশিকে ডেকে বলল, ”নৌকোটা কাদের রে, তোদের?”

”হ্যাঁ, দাদার জন্য ব্যাংকাকা ওটা তৈরি করে দেন। দাদা ছুটিছাটায় এসে দিঘিতে ঘুরে বেড়াত। এখন আর চড়ার লোক নেই, পড়েই থাকে।”

”চল, আমরা নৌকোয় চড়ে ঘুরব।”

”আজ নয়, কাল সকালে। চান করবি তো নীচে চল, যা ভ্যাপসা গরম, টিউবওয়েল থেকে জল তুলে রেখেছে শেতলের মা। দেখবি কী ঠাণ্ডা জল।”

”তোদের শিবমন্দিরটা কোনদিকে?”

”বারান্দার পুবে গেলে দেখতে পাবি। তুই দ্যাখ, আমি চান করতে যাচ্ছি।”

কলাবতী বারান্দার পূর্ব দিকে গেল। ব্যাংকাকা থাকেন এইদিকের ঘরটায়। ঘরের দরজায় শিকল তোলা। গড়বাড়িটা একটু দূরে। দোতলা বলে কিছু নেই। একতলায় খাড়া রয়েছে মোটা—মোটা কয়েকটা ভাঙা দেওয়াল। দরজা—জানলার জায়গাগুলো ফাঁকা। বাড়িটা আগাছায় ভরা, ভাঙা ইট ছড়িয়ে রয়েছে। দেওয়ালগুলোর পেছনেই শিবমন্দির। সেটিও ভাঙা, তবে বোঝা যাচ্ছে না যেহেতু অশ্বত্থ গাছে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো বলে। রিকশাওলা বলেছিল দুটো বাজ এর ওপর পড়েছে। কলাবতী দূর থেকে খুঁজল কিন্তু বাজ পড়ার কোনও চিহ্ন দেখতে পেল না। তার মনে হল মন্দিরের পেছন দিকে সম্ভবত বাজ পড়েছে, তাই সে পোড়া বা ভাঙা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কাল সকালে দেখতে হবে।

ওদের খিদে ছিল না। শেতলের মা কয়েকটা আম কেটে দিল।

”চল সুশি, একটু ঘুরে দেখি তোদের বোলতা, সেইসঙ্গে ঘড়ির দোকানটাও।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকে জংলা পোড়া মাঠটাকে দেখিয়ে সুশি বলল, ”এই হল সেই গড়ের মাঠ আর ওই তোর শিবমন্দির। ভূতেদের ছেলেমেয়েরা ওখানে কানামাছি খেলে।”

”পাতালঘরটা কোথায় বল তো?”

”লোকে তো বলে শিবমন্দিরের তলায়।”

”চল না শিবমন্দিরটা একটু দেখে আসি।”

সুশি শিউরে উঠে বলল, ”আজ শনিবার, ভূতেদের ডিস্টার্ব করতে নেই। আজ ওদের শনিপুজোর দিন।” খিলখিল করে সে হেসে উঠল। ”আজ ভূতটুত থাক, কাল সকালে দেখা যাবে!”

দু’জনে হাঁটতে—হাঁটতে বোলতা বাজার এলাকায় এল। সেখানে শনিমন্দির, পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, অডিও ক্যাসেটের দোকানের সামনে ঘড়ি—সারাইয়ের দোকান। দোকানটা বন্ধ। দোকানের পাশে একটা বটগাছের গায়ে টিনের সাইনবোর্ডে লেখা, ‘যে—কোনও মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম অ্যারেঞ্জ করিয়া থাকি।’ তার নীচের আর একটা টিনে, ‘টিউকলের অভিজ্ঞ মিস্ত্রি পাওয়া যায়।’ ওরা ফেরার পথে উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টা ঘুরে ফুটবল—মাঠের দিকে গেল। মাঠে ব্যাংকাকা দাঁড়িয়ে দু’জন লোক দিয়ে গোলপোস্ট খাড়া করার কাজে ব্যস্ত। চার—পাঁচজন ছেলে আর এক প্রৌঢ় তার পাশে।

”কাকা, এখানে কী টুর্নামেন্ট হচ্ছে?” সুশি জানতে চাইল।

”বংশীবদন চ্যালেঞ্জ শিল্ড আর প্রিয়বালা চ্যালেঞ্জ কাপ, জেলার একটা টপ টুর্নামেন্ট, চল্লিশ বছর ধরে চলছে। কত ফুটবলার এখান থেকে বেরিয়েছে জানিস। ভোঁদা মিত্তির ইন্ডিয়ার গোলকিপার খেলেছে সে তো রসবেড়িয়ার ছেলে, এই মাঠ থেকে উঠে ইস্টবেঙ্গলে খেলেছে। কালো দত্ত, শৈলেন মান্নার পর অমন একটা ব্যাক আর মোহনবাগানে খেলেনি, সে তো পাশের ইকড়ি গ্রামের রাসু দত্তর নাতি।”

”শৈলেন মান্নার পর কালো দত্ত ছাড়া আর কেউ খেলেনি বলছেন কেন?” কলাবতী নিচু স্বরে প্রতিবাদ জানাল, ”জার্নেল সিং? সুব্রত ভটচায?”

প্রৌঢ়টির চোখদুটিতে অবাক চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি ব্যাংকাকাকে বললেন, ”মেয়েটি দেখেছি খেলার খবর ভালই রাখে।”

”রাখবে না? আটঘরার রাজশেখর সিংহির নাতনি যে!”

”অ অ, তাই বলো। তা এখানে এয়েচে কী জন্যে, বেড়াতে?”

জবাব দিল সুশি। ”বেড়াতে আর ভূত দেখতে। গড়ের মাঠের ভূত।”

প্রৌঢ়র চোখে আবার বিস্ময়। ”বলে কী। খবরদার ওই কাজটি কত্তে যেয়ো না। কলকাতায় থাকো তো, তাই ভূত জিনিস জানো না। ওই শিবমন্দিরের পাশে বেলগাছে শাদা কাপড় পরে ওঁরা বসে থাকেন। খড়ম খটখটিয়ে হেঁটে বেড়ান গড়ের মাঠে।”

কলাবতী বলল, ”আপনি দেখেছেন?”

”পাগল নাকি! আমি কেন দেখতে যাব। ওঁদের দেখলে কি আর আজ এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতুম। কবে ওখানে চলে যেতুম।” আঙুলটা তুলে তিনি আকাশের দিকে খোঁচালেন। ”দুলেপাড়ার খ্যাঁদা দেখেছিল, ওঁরা মড়ার খুলি দিয়ে অমাবস্যার রাতে ফুটবল খেলছেন। তেরাত্তির পোয়াল না, বেচারার লাশ ভাসতে দেখা গেল পুকুরে। ওদের দেখতে নেই বুঝলে খুকিরা, ব্যাং, বারণ করো ওদের। বেড়াতে এসে কি বেঘোরে প্রাণটা দেবে?”

”নিশ্চয় বারণ করব ভূদেবদা। এই ছেলেমেয়েদের কথা কি শুনলে চলে?” বলেই ব্যাংকাকা ”হয়নি, হয়নি” বলে ছুটে গেলেন গোলপোস্টের দিকে। একদিকের পোস্ট ইঞ্চিচারেক নেমে গেছে পোঁতার দোষে।

ভূদেব একটি ছেলেকে ডাকলেন, ”হ্যাঁ রে রতন, বিদ্যুৎপুরের টিমে কলকাতার ক’টা ছেলে খেলেছিল?”

”তিনটে। সবাই সুপার ডিভিশনের।”

”হুমম। সেমিফাইনালের গাঁটটা দেখছি বি.এস. সি—র আর পেরনো হল না। ব্যাংয়ের এই এক গোঁ, হায়ার করে প্লেয়ার আনব না। আরে বাপু, সব টিমই কলকাতার প্লেয়ার আনে, ড্যাংডেঙিয়ে তারা শিল্ড নিয়ে গেছে আর আমরা ওই সেমিফাইনাল পর্যন্ত। বি. এস. সি. লাস্ট কবে শিল্ড জিতেছে?”

”কী জানি জ্যাঠামশাই, আমরা তো কখনও জিততে দেখিনি। বলুন না ব্যাংজ্যাঠাকে হাতটা একটু উপুড় করতে। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল, দুটো ম্যাচে খেলে দেবে; জনাতিনেক হলেই হবে, গোলকিপার, স্টপার আর একটা স্ট্রাইকার। হাজার দশেকের মধ্যেই হয়ে যাবে।”

আর একটি ছেলে বলল, ”অত নীতিবাগীশ হলে কি টুর্নামেন্ট জেতা যায়? ঘরের ছেলে ছাড়া খেলাব না বললে কি চলে? মোহনবাগান কী করল? সেই তো ফরেন প্লেয়ার খেলাতে হল!”

”আমি বললে ব্যাং শুনবে না। ভূতের জমিতে কলেজ করা চলবে না বলার পর থেকে আমার ওপর চটে আছে। যদি বলি পঞ্চায়েত সমিতির আপত্তি নেই ভূতের জমিতে কলেজ করতে দিতে, তা হলে দশ কেন, বিশ হাজার বার করে দেবে। ওর কি টাকার অভাব!” ভূদেবের মুখ ব্যাজার, কণ্ঠে ক্ষোভ।

ভূত না থাকলে, ভূদেব মনে মনে ভেবে দেখলেন, জমিটা নিয়ে কোনও আপত্তিই উঠত না, তা হলে কলেজ করার যে স্বপ্ন বোলতাকে কেন্দ্র করে চারপাশের গ্রামের হাজার—হাজার মানুষ দেখতে শুরু করেছিল সেই স্বপ্ন এতদিনে পূরণ হয়ে যেত। না হওয়ায় ভূতে অবিশ্বাসীরা তার বিরুদ্ধে চলে গেছে। তার এখন চিন্তা সামনের পঞ্চায়েত ভোটে তিনি প্রধানের পদটি রক্ষা করতে পারবেন কি না। অবশ্য ভূতে বিশ্বাসী ভোটারও কম নেই। তা হলেও—ভূতেরা না থাকলে জমিটা নিতে কারও কোনও আপত্তিই হত না, এতদিনে কলেজের শিলান্যাস হয়ে যেত, তাতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নামের নীচে মান্যবর ভূদেব খেটো নামটাও খোদাই করা থাকত, ভোটে তো জিততেনই, এমনকী ব্যাংয়ের হাতটাও উপুড় করিয়ে কলকাতা থেকে প্লেয়ার আনিয়ে বংশীবদনকে বোলতায় রেখে দেওয়ার সাফল্যের ভাগিদার হতে পারতেন। এত কিছু হারাচ্ছেন শুধুই ভূতেদের জন্য। ভূদেব মনে মনে ভীষণ চটে উঠলেন ভূতেদের ওপর। হতভাগারা বিদায় হলে বাঁচা যায়।

ভূদেব যখন এইসব ভাবছেন তখন মাঠের পাশের রাস্তায় দুটো মোটরসাইকেল এসে থামল, দুটিতেই চালকের পেছনে একজন বসে। তাদের একজন বাইক থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে এল। বেঁটে, গাঁট্টাগোট্টা বছর কুড়ি—বাইশ বয়স। পরনে গোলগলা কালো স্পোর্টস শার্ট, জিনস, পায়ে স্নিকার, বগলে যেন ফোড়া হয়েছে এমনভাবে হাত দুটো ফাঁক করে দুলে—দুলে হেঁটে এসে ভূদেবকেই জিজ্ঞেস করল, ”দাদু, স্বরাজ দাসের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?”

ছ’—সাতটি শব্দ মারফত কর্কশ উচ্চচারণে ও বলার ভঙ্গিতে যুবকটি বুঝিয়ে দিল, সে অমার্জিত ও অশিক্ষিত। ভূদেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ”কে স্বরাজ দাস?”

”যে গত বছর ইউনিয়নে খেলেছে, ইন্ডিয়া জুনিয়ার টিমে খেলেছে। সরার তো আপনাদের এখানেই বাড়ি।”

তখন একটি ছেলে বলল, ”তাকে আপনার কী দরকার?”

”দরকার আছে।” হিন্দি ফিল্মের খলনায়কদের মতো চোখ ও গলার স্বর হয়ে গেল যুবকটির। ”জানো যদি বলো ওর বাড়িটা কোথায়।”

ছেলেটি বলল, ”সরা—ফরা চিনি না। আপনি খুঁজে নিন।”

কালো শার্ট কয়েক সেকেন্ড মুখ কুঁচকে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”সরার বাড়ি কোথায় ঠিকই জানো তবে বলবে না। কেন?”

”জানি না, তাই বলতে পারব না।”

”বদু চলে আয়। বাড়ি খুঁজে নোব।” মোটরবাইকে বসা একজন চেঁচিয়ে বলল।

”জানো না, না?” নীচের ঠোঁট কামড়াল। একটা চোখ সরু হল। ”ফেমাস হয়ে গেছে যে ফুটবলার তার বাড়ি কোথায় জানো না? ঠিক আছে। বাড়ি বার করে নিচ্ছি।” হাত ফাঁক করে দুলতে দুলতে ফিরে গিয়ে সে মোটরবাইকের পেছনে উঠল। বাইক দুটো গর্জন করে বাজারের দিকে চলে গেল।

”কী ব্যাপার বল তো ঘণ্টু? সরার বাড়ি তো তুই চিনিস, ওকে বললি না কেন?” একজন বলল।

ভূদেব বললেন, ”সরার ভাল নাম যে স্বরাজ, সেটাই আমি জানতুম না। ও তো দাসপাড়ার বিরাজ দাসের ছেলে। শুনেছি বটে উঠতি প্লেয়ারদের মধ্যে খুব নাম করেছে।” তারপর চেঁচিয়ে বললেন, ”হ্যাঁগা ব্যাং, সরা কি বোলতার মাঠ থেকে উঠেছে?”

”তা না হলে কোত্থেকে উঠবে!” অবাক স্বরে উত্তর এল।

কলাবতী আর সুশি সারাক্ষণ চুপ করে কথাবার্তা শুনছিল। কলাবতী এবার ঘণ্টু নামের ছেলেটিকে বলল, ”আপনি স্বরাজ দাসের বাড়ি জানেন বলে মনে হল। কিন্তু সে—কথা লোকটাকে বললেন না কেন?”

”কারণ আছে।” বলেই ঘণ্টু ব্যস্তভাবে হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল।

আর—একজন বলল, ”ঘণ্টু হল সরার খুব বন্ধু। হয়তো কোনও ব্যাপার আছে তাই লোকটাকে বাড়ির হদিস দিল না। তবে সরাকে এখানকার প্রায় কেউই চেনে না, ও তো গত আট বছর ধরে হাওড়ায় মামার বাড়িতে রয়েছে, মাঝে—মাঝে এখানে আসে দু—চারদিনের জন্য। খুবই গরিব ওরা। ঘণ্টু ছাড়া কারুর সঙ্গে মেশে না।”

ভূদেব বললেন, ”লোকটার হাবভাব যেন কেমন কেমন ঠেকল। খারাপ মতলবে আসেনি তো?”

”হতে পারে। কাগজে সেদিন দেখেছিলুম ট্রান্সফারের ব্যাপারে সরা নাকি ব্রাদার্স ইউনিয়ন আর শ্যামপুকুর দুটো ক্লাবের কাছ থেকেই অ্যাডভান্স নিয়েছে। হয়তো তাই নিয়ে গোলমাল পাকিয়েছে।” ছেলেটি আর দাঁড়াল না, তার সঙ্গে অন্য তিনজনও চলে গেল।

”আমিও যাই।” ভূদেব ব্যস্ত স্বরে বললেন, ”দীক্ষা নিয়েছি হার্ট অ্যাটাকের পর, এখন সন্ধ্যাহ্নিকে বসতে হবে।”

সুশি বলল, ”সন্ধে হতে তো এখনও অনেক দেরি।”

”কোথায় আর দেরি। দেখছ কেমন কালো হয়ে রয়েছে আকাশ। দুমদাম বাজ পড়তে পারে সেদিনকার মতো। খোলা মাঠে এখন থাকাটা ঠিক নয়, বাড়ি যাও।”

কলাবতী বলল, ”ঠিক বলেছেন। শুধু বাজ কেন, গড়বাড়ির ভূতেরাও তো পাতালঘর থেকে উঠে আসতে পারে কি বেলগাছটা থেকে নেমে আসতে পারে!”

ভূদেব চোখ পিটপিটিয়ে কলাবতীর দিকে তাকালেন। ”ভূতেদের আমি একদমই পছন্দ করি না, ওদের আমি ভয়ও পাই না। যাই, সন্ধ্যাহ্নিকের সময় হয়ে গেল।”

তিনি আর দাঁড়ালেন না। ব্যাংকাকা এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। ”আর যদি ঝড়টড় না হয় গোলপোস্ট দুটো মনে হয় দাঁড়িয়েই থাকবে। ভূদেবদা এমন করে চলে গেল যে?”

সুশি বলল, ”উনি বললেন ভূতেদের ভয় করেন না।”

”করেন না? তা হলে গড়ের মাঠে কলেজ করায় বাধা দিচ্ছেন কেন? কী যে ছেলেমানুষি ভয় বুঝি না।”

কলাবতী বলল, ”কাকা, ওঁর ভয়টা ভেঙে দেওয়া যায় না?”

”গা ছমছম করা এইসব প্রবাদ না ভাঙলে এদের ভূতে বিশ্বাস দূর হবে না।” ব্যাংকাকা মাথা নাড়লেন হতাশভাবে। ”মোটরবাইকে কারা এসেছিল?”

সুশি বলল, ”স্বরাজ বলে এক ফুটবলারের বাড়ি কোথায় জানতে চাইল।”

”স্বরাজ মানে সরা? ও তো ছোটবেলায় বি.এস.সি—তেই খেলত। ওই বয়সেই দারুণ ড্রিবল করত, দু’পায়ে শট ছিল দেখার মতো। শুনছি এখন নাকি খুব নাম করেছে। কত আর বয়েস, কুড়িটুড়ি হবে। সুশি তোরা তো এখন বাড়ি যাবি। আমার ঘরে টিভি আছে দেখতে পারিস। আমি একটু পরে ফিরব। পরশুর খেলার টিম নিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে গেছি।”

বাড়ি ফেরার পথে মোটরবাইক দুটো ওদের পাশ দিয়ে ভটভট করে বেরিয়ে গেল। চারজন লোকের একজন বুড়ো আঙুল তুলে কলা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল ওরা যা খুঁজছিল পেয়ে গেছে। কলাবতী বলল, ”ওরা যাচ্ছে কোনদিকে বল তো? আমাদের বাড়ির দিকেই দেখছি গেল!”

সুশি বলল ”আমাদের বাড়ির কাছেই তো দাসপাড়া। বোধ হয় সরাদের বাড়ির খোঁজ কোথাও থেকে পেয়ে গেছে তাই যাচ্ছে।”

”যাওয়ার কারণটা একদমই বোঝা গেল না। লোকটাকে কীরকম যেন মস্তান—মস্তান বলে মনে হল। নিশ্চয় কোনও বদ মতলবে এসেছে।”

.

মেঘলা আকাশ। আলো পড়ে গেছে। বাড়িতে ঢোকার মুখে কলাবতী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। গড়বাড়ির দিকে তাকিয়ে ম্লান আলোয় তার মনে হল ভাঙা দেওয়ালগুলো যেন প্রাচীন কোনও রহস্য আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সত্যিই কি বর্গিরা পাতালপুরীতে লুকিয়ে—থাকা সুশির পূর্বপুরুষের হত্যা করেছিল? এত বছর পর তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। লোকের মুখে—মুখে গল্প তৈরি হয়েছে তারা নাকি ভূত হয়ে পাতালঘরে বাস করছে।

তার ইচ্ছা করল শিবমন্দিরের দিকটা দেখে আসতে। সুশিকে সে বলল, ”দূর থেকে শিবমন্দিরটা দেখব, তুই দাঁড়া এখানে।”

”দাঁড়াব কেন, আমি যাব।”

দু’জনে এগিয়ে গেল গড়ের মাঠের দিকে। মাঠের কিনার ঘেঁষে বাবার সড়ক। একটি লোক সাইকেল চড়ে যেতে যেতে ওদের দেখে চেঁচিয়ে বলল, ”হেই, মাঠে নেমো না, শনিবার আজ।”

”নামলে কী হয়েছে?” কলাবতীও চেঁচিয়ে জানতে চাইল।

”ওঁরা ভর করবেন, জানো না?”

লোকটি প্যাডেল করতে করতে চলে গেল। ওরা মাঠের আর—একটু ভেতরে এগোল। মন্দিরের একটা দিক দেখা যাচ্ছে। যেখানে একসময় দরজা ছিল সেই জায়গাটাকে কালো গুহার মতো দেখাচ্ছে। দেখলে গা—ছমছম করে ওঠে। তার চারদিক ঘিরে উঁচু চাতাল। মন্দিরের পেছনে সত্যিই একটা বেলগাছ। মন্দিরের ইটগুলো ক্ষয়া, জরাজীর্ণ। বাবার সড়ক থেকে গড়ের মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে, মন্দিরের চাতালে পৌঁছতে হলে দু—তিন ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হবে, সেই সিঁড়িও ভেঙে গিয়ে একটা টিপির মতো হয়ে রয়েছে। অশ্বত্থগাছ থেকে বিশ্রী কর্কশ স্বরে একটা পাখি ডেকে উঠল।

”এইরকম ভাঙা শিবমন্দির বাংলার অনেক গ্রামেই পাবি। এমনকী কলকাতাতেও আছে।” সুশি বলল।

”কিন্তু তাতে কি ভূতপ্রেত বাস করে?”

”বাস করাটা নির্ভর করছে সেখানকার লোকেরা বিজ্ঞান মানে কিনা তার ওপর।”

”ফেরা যাক, কাল নৌকোয় চাপব,” কলাবতী বলল।

”আমি মাছ ধরব। কাকার ছিপ আছে অনেকরকমের। আগেরবার এসে দিঘির ঘাটে বসে পুঁটি ধরেছি, একটা চারাপোনাও উঠেছিল।”

গল্প করতে—করতে ওরা বাড়ি ফিরে এল। সেদিন ভোররাতে এক পশলা বৃষ্টি হল। কলাবতী নৌকোর বদলে বেছে নিল ছিপ। সে আর সুশি ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে গেল দিঘির ঘাটে। জনাদা জোগাড় করে দিয়েছে টোপের জন্য লাল পিঁপড়ের ডিম, শেতলের মা দিয়েছে দুটি পিঁড়ি, ভিজে জমিতে পেতে রাখার জন্য। ব্যাংকাকা বলে দিয়েছিলেন কলাবতীকে কীভাবে ফাতনাটাকে লক্ষ করতে হবে। ভেসে থাকা ফাতনাটা খাড়া হয়ে উঠলে বুঝবে মাছ টোপ গিলেছে, তারপর সেটা ডুবে গেলেই টান মারবে। কলাবতী সব শুনে ঘাড় নেড়ে জানায়, বুঝেছে।

ঘাটের একধারে দু’জনে পাশাপাশি ছিল ফেলে বসল। সাত—আট হাত তফাতে। সঙ্গে দুটো খালুই, ধরা মাছ রাখার জন্য। সুশির অভিজ্ঞতা আছে মিনিটদশেক পরেই ছিপে টান দিয়ে সে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ”কালু, পেয়েছি। ফলুই।”

কলাবতী মুখ ঘুরিয়ে ইঞ্চিছয়েক লম্বা কালো রঙের মাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, ”ওটা তুই খাবি।” তারপর সে ফাতনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। মিনিট তিন পর সুশি আবার চিৎকার করল, ”কালু, বাটা।” কলাবতী মুখ ফিরিয়ে দেখল, কিন্তু কোনও মন্তব্য করল না। শুধু ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ফাতনাটা মনে হল একটু কাঁপল। সে উবু হয়ে বসল। ক্রিকেট ব্যাট ধরার মতো দু’হাতে ছিপটা ধরে রইল এমনভাবে, যেন বোলার এবার একটা লংহপ বল দেবেই আর সে সপাটে পুল করবে। ফাতনাটা টুকটুক করে কাঁপছে। কলাবতীর মনে হল লংহপ বলটা এসে গেল বলে, এবার পুল—সপাটে সে হ্যাঁচকা টান দিল।

সুতোর প্রান্তে বাঁধা বঁড়শিটার দিকে কলাবতী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। বঁড়শিতে গাঁথা পিঁপড়ের সাদা ডিমের টোপটা নেই। বদমাশ মাছ খেয়ে পালিয়ে গেছে।

”কালু, আবার একটা বাটা।”

”তোর পাশে বসলে আমি একটাও পাব না। চললুম ওদিকে।”

খলুই আর পিঁড়িটা তুলে কলাবতী ঝোপঝাড় পেরিয়ে পঞ্চাশ হাত দূরে একটা খেজুরগাছের পাশে গিয়ে বসার উদ্যোগ করল। মুখ ঘুরিয়ে সে পেছন দিকটা দেখে নিতে গিয়ে চোখে পড়ল শিবমন্দিরটাকে। একটা বড় বেলগাছ ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের দিকে। ডালে ঝুলন্ত দুটো বেল তার চোখে পড়ল। চিকচিক করে উঠল তার চোখ। পেকে হলুদ হয়ে আছে আর সাইজ কী! ছোটখাটো কুমড়োর মতো। অন্তত দশ গ্লাস বেলের পানা হয়ে যাবে। সুশি মাছ ধরছে ধরুক, সে চটপট ভেবে নিল। অমন দুটো বেল পেড়ে নিয়ে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। কলকাতার মেয়ে গাছেও চড়তে পারে এটা সে দেখিয়ে দেবে।

সুশি নিবিষ্ট চোখে ফাতনার দিকে তাকিয়ে। কলাবতী পা টিপে—টিপে কাদা মাড়িয়ে বেলগাছটার দিকে এগোল। গাছতলায় পৌঁছে চারদিক দেখল। তার ভাগ্য ভাল, গাছের একটা ডাল বেশ নিচুতেই পেয়ে গেল। চটিটা খুলে সে হাত তুলে দু’বার লাফিয়েই ডালটা ধরে ফেলল। একটু দোল খেয়ে মেয়ে জিমন্যাস্টরা যেভাবে আনইভন বার—এর ওপর চড়ে বসে সেইভাবে সে ডালটার ওপর উঠে গেল। তারপর এই ডাল সেই ডাল করে সে এগোতে লাগল বেল দুটোর দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে পিছল হয়ে রয়েছে ডালগুলো। সন্তর্পণে একটু—একটু করে সে এগোচ্ছে। একটা সরু ডালে বেলদুটো। হাত বাড়াল সে। একটা বেল আঙুলে ঠেকল। ওটাকে ভাল করে ধরে মোচড় দিয়ে—দিয়ে ছিঁড়তে হবে। ডালের ওপর উপুড় হয়ে সে আর একটু এগোতেই ডালটা বিপজ্জনকভাবে নুড়ে পড়ল। কলাবতী ভয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ডালটাকে, তাইতে সেটা আরও নুয়ে পড়ল।

কলাবতী বুঝতে পারছে সে এবার পড়ে যাবে। মট করে ডাল ভাঙার শব্দ হল, ডালটা ভেঙে ঝুলছে তাকে নিয়ে। সে টের পেল, ডালের ঘষা লেগে ব্যান্ডটা ছিঁড়ে ঘড়িটা হাত থেকে নীচে পড়ে গেল আর কয়েক সেকেন্ড পরেই সে নিজেও দুটো বেলসমেত ডালটা নিয়ে প্রায় কুড়ি ফুট নীচে পড়ল একটা নরম ঝোপের ওপর।

অন্তত তিন মিনিট সে চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে মারা যায়নি, তার হাড়গোড় ভাঙেনি, সে দিব্যি বেঁচে আছে। অতঃপর সে উঠে দাঁড়াল। ঘড়িটা কোথায় পড়ল? দু’বছর আগে জন্মদিনে কাকা ওটা দিয়েছিল। তার কাছে অমূল্য জিনিস। ওটাকে উদ্ধার করতেই হবে।

সে ঝোপঝাড় সরিয়ে খুঁজতে শুরু করল। খুঁজতে—খুঁজতে শিবমন্দিরের দিকে দশ—বারো হাত এগিয়েই তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। পা অসাড়, শরীর ঠাণ্ডা এবং মাথার মধ্যে নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করল।

তার চোখের সামনে মন্দিরের পেছন দিকের চাতাল। চাতালটা হাঁ হয়ে রয়েছে। গাছ থেকে পড়ার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আর একটা। চাতালে গজানো ঘাস আর ঝোপের মধ্যে একটা লোহার দরজা শোয়ানো। সেটা মরচেয় জরাজীর্ণ এবং ভেঙে চৌচির। দরজার পাল্লাটা কোনও কিছুর আঘাতে ভেঙে গিয়ে ভেতর দিকে ঝুলে পড়েছে। কলাবতীর মনে পড়ল রিকশাওলার কথাটা, ”দু—দুটো বাজ পড়েছে।”

এই তা হলে সেই পাতালঘরের দরজা।

সে ঝুঁকে পড়ল চার হাত লম্বা তিন হাত চওড়া গর্তটার দিকে। ভেতরটা অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা গন্ধ ভেতর থেকে উঠে আসছে। তাকিয়ে থাকতে—থাকতে হঠাৎ কলাবতী চমকে উঠল। তার মাথার খুলিতে হাজারদশেক পিঁপড়ে চলাফেরা শুরু করল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। ঘাড়ের কাছটা সুড়সুড় করছে। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।…ভূত! সে চোখ বুজল। এবার নির্ঘাত তার ঘাড় মটকাবে, নয়তো রক্ত চুষে খাবে।

”কে তুমি?” একটা খসখসে ভয়ার্ত স্বর সেই অন্ধকার গর্তের মধ্যে থেকে উঠে এল।

এবার চোখ খুলে তাকাল কলাবতী, অন্ধকারের মধ্যে আবছা একটা মুখের আদল আর চিকচিক করছে দুটো চোখ। ভূতের চোখ?—”তুমি কি ভূত?”

”আমি মানুষ। কাল সন্ধে থেকে আমি এখানে।”

এইবার কলাবতী নিশ্চিন্ত হল। আর যাই হোক চোখ দুটো ভূতের নয়। কিন্তু মানুষ এই পাতালঘরে কেন?

”তুমি ঠিক বলছ ভূত নও? তা হলে তুমি কে?”

”আমি সরা, স্বরাজ দাস, ফুটবল খেলি।”

অন্ধকারের সঙ্গে এর মধ্যেই চোখ দুটো সইয়ে নিয়েছে কলাবতী। তার ভয় এখন কেটে গেছে। এখন সে কৌতূহলী। সে দেখতে পাচ্ছে একটা মুখ গর্তের মধ্যে থেকে তার দিকে তাকিয়ে।

”ভয় পেয়ো না।” কলাবতী বলামাত্র দুটো মোটরবাইকের গর্জন বাবার সড়ক দিয়ে ভটভটিয়ে উড়ে গেল।

”চারটে লোক কাল থেকে মোটরবাইকে ঘুরছে, সে কি তোমার জন্যে?”

”হ্যাঁ। বলেছে আমার হাঁটু ভেঙে দেবে, যাতে জীবনে যেন আর খেলতে না পারি। হাঁটু ভেঙে দিতে ওরা এসেছে।”

কলাবতী আর একটু ঝুঁকে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ”তুমি উঠে আসতে পারবে না?”

”না। শিবমন্দিরে ঢোকার জন্য দৌড়ে আসছিলুম তখন এই গর্তে পড়ে গেছি। একটা সিঁড়িমতন ছিল। কিন্তু সেটা একদম ভেঙে গেছে। ভেতরটা খুব ঠাণ্ডা, শীত—শীত করছে। মেঝেটা ভিজে—ভিজে।”

”কত বড় ঘর?”

”বিরাট বড়। একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট হয়ে যাবে। তুমি একটা মোটা দড়ি জোগাড় করতে পারবে? তা হলে—” সরার কথা বন্ধ হয়ে গেল আবার মোটরবাইকের গর্জন ভেসে আসায়।

”আমার এখন বাইরে আসাটা ঠিক হবে না। ওরা দেখে ফেলতে পারে।”

কলাবতী বলল, ”ওদের এত ভয় পাচ্ছ কেন? কী করেছ?”

”পরে বলব। তবে ওরা আমার ফুটবল কেরিয়ার শেষ করে দিতে পারে। খুব খিদে পাচ্ছে, প্রায় তেরো—চোদ্দো ঘণ্টা এখানে রয়েছি।”

কলাবতী ভাঙা ডালে লেগে থাকা বেল দুটোর একটা মুচড়ে ছিঁড়ে আনল। গর্তটার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে বেলসমেত হাতটা ঝুলিয়ে দিল। ”ধরো। এটা খাও।”

”আমার হাত পৌঁছচ্ছে না। তুমি ফেলে দাও আমি লুফে নোব।”

”তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ?”

”পাচ্ছি। তুমি একটা মেয়ে। তোমার নাম কী?”

”কলাবতী সিংহ। এখানে এসেছি আমার বন্ধু সুশিদের বাড়িতে। এবার বেলটা ধরো।”

কলাবতী আলতো করে বেলটা ছেড়ে দিল। শব্দ না হওয়ায় বুঝল লুফে নিয়েছে।

”আপাতত যতটা পারো খাও। মনে হচ্ছে বেশ মিষ্টিই হবে। দেখি খাবার ব্যবস্থা কী করা যায়।”

”আমার কথা কাউকে কিন্তু একদম বোলো না।”

”পাগল নাকি! তুমি আমার কী যে উপকার করলে ভূত না হয়ে, ভাগ্যিস তুমি মানুষ!”

”তাতে কী উপকার হল?”

”হল না?” কলাবতীর স্বরে বিরক্তি ফুটে উঠল। ”যদি ভূত হতে তা হলে এতক্ষণে তো আমার ঘাড়টা মটকে দিতে। তার থেকেও বড় কথা বোলতার লোক আরও আড়াইশো বছর বিশ্বাস করবে গড়ের মাঠে ভূতে মড়ার খুলি দিয়ে অমাবস্যার রাতে ফুটবল খেলে।”

”কালুউ, কালুউ।” দূর থেকে ভেসে এল সুশির উদ্বিগ্ন চিৎকার। ”কালু তুই কোথায়?”

”এই যে এখানে। শিগগির আয় সুশি।” কলাবতীও চেঁচিয়ে সাড়া দিল।

কয়েক সেকেন্ড পর হাঁফাতে—হাঁফাতে ছুটে আসতে দেখা গেল সুশিকে। ”জলে ডুবিসনি তা হলে।”

”ডুবলে তো বেঁচে যেতুম। দেখে যা তোদের পাতালঘরের রহস্য। এবার একটা নতুন ভূত!”

সুশি পায়ে পায়ে গর্তটার কাছে এল। জমিতে শোয়ানো চূরমার লোহার দরজাটা দেখে সে আঁতকে উঠল।

”এটা কী রে!”

”এর ওপর বাজ পড়েছিল। এটাই পাতালঘরের নামার পথ।”

”এর ভেতর ভূত আছে?”

”আছে। দেখবি?” কলাবতী গর্তের দিকে ঝুঁকে বলল, ”ওহে সরাবাবু, বেলটা খেতে কেমন লাগছে?”

গর্তের ভেতর থেকে ভেসে এল, ”বেশ মিষ্টি। একটু জল খাব।”

সুশি বিস্ময়ে কাঠের মতো হয়ে গেল। থরথর কেঁপে উঠল তার দুই হাঁটু। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ”ক্কা…কালু, ভূত মানুষের মতো ক্ক—কথা বলে?”

”শুধু কথাই বলে না, জলও খায়!” কলাবতী গর্তের দিকে মুখ করে বলল, ”সরা, এই হচ্ছে সুশি। শিবমন্দিরটা ওদের, যে বেলটা খাচ্ছ সেটাও ওদের।”

”ধন্যবাদ সুশি। আমি কিন্তু ভূত নই। পালাতে গিয়ে এখানে পড়ে গেছি।”

কলাবতী বলল, ”ওখানে ভূত থাকার কথা, তুমি তাদের দেখতে পেয়েছ কি?”

”এখনও তো পাইনি। তবে আসল ভূতেরা এখন মোটরবাইকে চড়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটু আলোর ব্যবস্থা করতে পারো? একটা মোমবাতি। অন্ধকার আর সহ্য করতে পারছি না।”

”একটু ধৈর্য ধরো, আমি আর সুশি যতটা পারি ব্যবস্থা করছি। ভাল কথা…তুমি কি খুব বড় ফুটবলার? বলরামের মতো?”

”বলরামের নখের যুগ্যি নই তবে এ—বছর আমার দর পাঁচ লাখ টাকায় উঠেছে। এত টাকা কুড়ি বছর বয়সে উনি একসঙ্গে চোখে দেখেছেন কিনা জানি না।”

”থাক, থাক, টাকার কথা বোলো না। ভটভট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? আমাদের বাড়ির সামনে থামল।”

”ওরা আমাকে খোঁড়া করে দেবে বলেছে। কলাবতী, তুমি কি আমাকে বাঁচাবে? কাল ওরা আমাদের বাড়িতে গিয়ে পিস্তল দেখিয়ে শাসিয়েছে। বোকামি গাধামি, স্বীকার করছি লোভে পড়ে আমিই করেছি, দুটো ক্লাব থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়েছি। আমরা গরিব তো।”

”অত কথা শোনার এখন সময় নেই। তুমি যেমন আছ তেমনই থাকো। গুডবাই।” কলাবতী হাত নাড়ল।

সুশি এতক্ষণে অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে। সে ভাবল, ”কালু এখন কী হবে?” ”ব্যাংকাকাকে সব বলতে হবে। এখন চল, সরার খাওয়া—দাওয়ার, শোয়ার একটা ব্যবস্থা করি। বেচারার শীত করছে। আর একটা কথা, একদম জানাজানি যেন না হয়। ওই ভটভটিওলারা জানতে পারলে—।”

”সুশিদিদি, অ সুশিদিদি।” দিঘির ঘাট থেকে শেতলের মা’র পরিত্রাহি চিৎকার শোনা গেল। ওরা দু’জন দৌড়ল ঘাটের দিকে।

”কী হয়েছে শেতলের মা?” সুশি বলল।

”তিনটে লোক এসে কাকে যেন খুঁজছে। কী হম্বিতম্বি, যেন পুলিশ! কাকাবাবু বাড়ি নেই, তুমি এসে দ্যাকো।”

ওরা ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। সদরঘরের বাইরের রকে তিনটি লোক। তাদের মধ্যে একজনকে ওরা চিনল। গতকাল মাঠে এসে লোকটা সরার বাড়ি কোথায় জানতে চেয়েছিল। অন্য দু’জন বসে ছিল মোটরবাইকে। দেখতে শান্তশিষ্ট, ভদ্র। একজনের চোখে চশমা। অন্যজনের গলায় সোনার চেন।

চোখে চশমা বলল, ”কাল মাঠে তোমাদের দু’জনকে দেখেছি মনে হচ্ছে। তা হলে এটা তোমাদের বাড়ি?”

”হ্যাঁ।” সুশি বলল।

দু’হাত ফাঁক করে কালো শার্ট বলল, ”কাল সন্ধেবেলা সরা এ বাড়িতে ঢুকেচে আমাদের তাড়া খেয়ে। কোতায় সে, তাকে আসতে বলো।”

”কে সরা!” কলাবতী আকাশ থেকে পড়ল। তারপর যেন মনে পড়েছে এমনভাবে বলল, ”ওহহো, কাল যার কথা বলছিলেন? স্বরাজ দাস? সে কেন এ বাড়িতে থাকবে?”

”নিজের চোখে দেখেচি মাটের মদ্দে ছুটে গেল। মাট দিয়ে তো এ বাড়িতে ঢোকা যায়। ওকে বেরিয়ে আসতে বলো, নয়তো আমরাই বার করে আনব। তা হলে কিন্তু ফল ভাল হবে না।”

”ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” চোখে চশমা শান্ত স্বরে বলল, ”শ্যামপুকুর ক্লাবে খেলবে বলে সরার সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে। সাড়ে তিন লাখ টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছে কিন্তু তার আগেই ব্রাদার্সের অ্যাডভান্স নিয়েছে চার লাখ। ওদের সঙ্গেও চুক্তি পাঁচ লাখের। এবার তোমরাই বলো এটা স্রেফ চিটিং কি না? দুটো ক্লাব থেকেই টাকা খেয়ে বসে আছে।”

কলাবতী অবাক হয়ে বলল, ”কলকাতার ফুটবলে এরকম হয় নাকি? কী অদ্ভুত আশ্চর্যের কথা! একই সঙ্গে দুটো ক্লাবে কি খেলা যায়?”

”যায় না যে, সেটা তো সরা ভালই জানে,” গলায় চেন ঠোঁট বেঁকিয়ে কঠিন গলায় বলল, ”কোর্ট পেপারে সই করে অ্যাডভান্স নিয়েছে শ্যামপুকুর থেকে। অথচ ও থানায় ডায়েরি করল আমরা নাকি জোর করে ওকে সই করিয়েছি। টোকেন হারিয়ে গেছে বলেও শ্যামপুকুর নাকি ওকে দিয়ে জোর করে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে আই এফ এ—কে দেওয়ার জন্য। কী মিথ্যেবাদী ছেলে! সরা তো নাবালক নয় যে, জোরজবরদস্তি করে সই করানো যাবে। এ—কথা ও কাগজের রিপোর্টারকে বলেছে, কাগজে ছাপাও হয়েছে।”

কলাবতী বলল, ”তা হলে এখন আপনারা কী করবেন?”

চোখে চশমা বলল, ”টোকেন মোটেই হারায়নি। ওর কাছেই আছে, ওটা আমাদের চাই আর ব্রাদার্সের টাকা ফেরত দিয়ে শ্যামপুকুরে সই করুক। সই না করা পর্যন্ত ওকে আমাদের হেফাজতে থাকতে হবে।”

গলায় চেন বলল, ”টোকেন যে ক্লাবের হাতে থাকবে প্লেয়ারকেও সেই ক্লাবে থাকতে হবে। আমরা সরার টোকেনটা চাই। হারিয়ে যাওয়া টাওয়া একদম বাজে কথা। ওকে আমরা ছাড়ব না। এর আগে বিজন চৌধুরী আমাদের এইভাবেই চিট করতে গেছল, পারেনি অবশ্য। লালবাজারে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে অ্যাডভান্স ফেরত দেয়। নইলে অ্যারেস্ট হত।”

”এই প্লেয়ারদের, বুজলেন চিতুদা, এমন সিক্কা দেওয়া উচিত যে জীবনে ভুলবে না। স্রেফ হাঁটুতে গুলি করে দিন।”

”ওরে বাবা!” সুশি শিউরে উঠল। ”কিন্তু সরা তো আমাদের বাড়িতে নেই।”

”আমি খুঁজে দেখছি।”

কথাটা বলেই কালো শার্ট ওদের তোয়াক্কা না করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে একতলার ঘরগুলো আঁতিপাতি দেখল। তারপর রান্নাবাড়ি, গোয়ালঘর ইত্যাদি দেখে ফিরে এসে দোতলায় উঠল। সুশি আর কলাবতী এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারা বুঝে নিয়েছে আপত্তি জানিয়ে কোনও লাভ হবে না। তা ছাড়া সরার কীর্তির কথা শুনে তার পক্ষ নিয়ে দাঁড়াতেও আর তাদের ইচ্ছা করছে না। সারাবাড়ি ওরা দেখুক না। একটু পরেই কালো শার্ট নেমে এল।

”না চিতুদা, ছাদ পর্যন্ত দেখে এলুম। তবে একটা শিবমন্দির চোখে পড়ল, ওটা একবার দেখা দরকার।”

সুশি শিউরে উঠে চোখ বড় করে বলল, ”ওরে বাবা, ওধারে একদম মাড়াবেন না। দুশো বছর ওই মন্দিরে লোক যায় না। ভূতপ্রেত বাস করে। যে ওই মাঠে পা দিয়েছে তিনরাত্তিরও তার কাটে না, অবধারিত মরণ। আপনারা বোলতার যে—কোনও লোককে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”

তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, চোখে ফুটে উঠল সন্দেহ, ভয়। ইতস্তত করে চোখে চশমা বলল, ”ঠিক আছে, চল এবার। আশপাশটা আর একবার দেখা যাক।”

ওরা চলে যাওয়ার পর সুশি বলল, ”যত দোষই করে থাকুক সরা এখন আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে। আমরা যতটা পারি ওকে দেখব। কাকা কোথায় যে গেছে প্লেয়ার ধরতে, কাল তো সেমিফাইনাল ম্যাচ।” তারপরই জিভ কেটে সুশি দৌড়ল দিঘির ঘাটের দিকে—”অনেক মাছ রে কালু, কাক—চিলের পেটে গেছে কিনা কে জানে।”

কলাবতী চেঁচিয়ে বলল, ”তোর তো মাছ, আমার যে ঘড়িটা গেল।”

সরা জল চেয়েছে। ভিজে মেঝেয় বসতেও পারছে না। বৃষ্টির জল নিশ্চয় ভাঙা দরজার গর্তটা দিয়ে পাতালঘরে ঢুকেছে। কলাবতী মনে মনে বলল, ‘এসব শাস্তি তো ওর প্রাপ্যই। লোকগুলোর কথা যদি সত্যি হয় তা হলে কোনওরকম সহানুভূতিই দেখানো উচিত নয়। তবে সুশি যা বলল, আশ্রিতকে দেখা উচিত।’ এর পর সে ভেবে নিল দোতলায় শোওয়ার ঘরে জলভরা একটা কুঁজো আছে। লোডশেডিং হয় তাই তেলভরা একটা হারিকেন আর দেশলাই শোওয়ার ঘরে খাটের নীচে রাখা আছে। কিছু খাবারও দরকার। বেল খেয়ে তো আর সারাটা দিন কাটানো যায় না। একটা মাদুর কি চটের বস্তা চাই মেঝেয় পাতার জন্য। মেঝেটা কেমন কে জানে। দিঘির পাড়ে ফেলে আসা পিঁড়ি দুটো দিয়ে আসা যায়।

সুশি ফিরে এল। হাতে দুটো পিঁড়ি, দুটো ছিপ আর খালুইয়ে সাত—আটটা নামারকমের মাছ।

”এগুলো শেতলের মাকে দিয়ে আসি।”

”তার আগে সরার জন্য কী করা যায় সেটা ভেবে ঠিক কর। কুঁজোটা দিয়ে আসি, হারিকেনটাও। ধান রাখার বস্তা নিশ্চয় আছে। খাবার কী দেওয়া যায়? তার আগে শেতলের মাকে রান্নাঘরে ব্যস্ত রাখতে হবে, এদিকে যেন না আসে। সকালে যে লুচি বেগুনভাজা খেলুম তার কিছু পড়েটড়ে আছে কিনা দ্যাখ।”

সুশি রান্নাঘরের দিকে চলে যাওয়ার পর কলাবতী ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ছুটে দোতলা থেকে হারিকেন আর জলভরা কুঁজো নামিয়ে আনল। একতলায় একটা ঘরে সারি দিয়ে থাক থাক বস্তাভর্তি ধান। খুঁজেপেতে দুটো ছেঁড়া চটের বস্তা বার করল, সেইসঙ্গে একটুকরো ত্রিপল। আপাতত এটুকু উপকারই করা যাক।

জিনিসগুলো নিয়ে গর্তের কাছে গিয়ে কলাবতী সরাকে ডাকল।

”কুঁজো আর হারিকেনটা তো বেল নয় যে ফেলে দেওয়া যাবে। এই বস্তায় ভরে একে একে ঝুলিয়ে দিচ্ছি ধরে নাও। হাত তুলে পাবে তো? তোমার হাইট কত?”

”পাঁচ—দশ। পেয়ে যাব বস্তা।”

প্রথম কুঁজো নামল। সেটা পাওয়ামাত্র সরা অর্ধেক খালি করে দিয়ে বলল, ”বাঁচলুম।”

”মোটেই বাঁচোনি। ওরা আমাদের বাড়ি ঢুকে তন্নতন্ন সার্চ করে গেছে। এখন তোমার খোঁজে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলেছে, পেলে তোমার হাঁটুতে গুলি করবে।…বস্তাটা ছুড়ে দাও হারিকেন আর দেশলাই নামাব।”

”হাঁটুতে গুলি? তা হলে তো খোঁড়া হয়ে যাব!”

”যাও না, তাতে লোকসান তো হবে না। তুমি তো ফুটবলার হতে চাও না, টাকা কামাতে চাও। চার—পাঁচ লাখ টাকা তো হাতিয়ে নিয়েছই, তা হলে আর প্লেয়ার হওয়ার দরকার কী?” স্বাভাবিক স্বরে কলাবতী বলল।

”তুমি ঠাট্টা করছ। জানো এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার, হাঁটুতে গুলি খেলে কী হতে পারে সেটা তুমি বুঝছ না।”

”তুমি বোধ হয় এবার একটু একটু করে বুঝতে পারছ সেই প্রবাদটা ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। যাকগে, বস্তাটা ছোড়ো।”

বস্তাটা ছুড়ে দিয়ে সরা ঢোক গিলে বলল, ”আমার মৃত্যুর কথা শুনলে ভয় করে।”

কলাবতী জবাব দিল না। হারিকেনটা বস্তায় ভরে নামিয়ে দিয়ে বলল, ”দেশলাই রয়েছে ওটা এবার জ্বালো আর এই তেরপলটাও নাও।”

একটু পরেই দেশলাই আর হারিকেনের আলো জ্বলে উঠল। কলাবতী দেখল, কালো ট্রাউজার্স পরা খালি পায়ে একটি বছর কুড়ি—একুশের ছেলে। ভাল স্বাস্থ্য, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গায়ের রং শ্যামলা, চোখা নাক।

”খুঁজে দ্যাখো তো আমার হাতঘড়িটা পাও কি না।”

ঘড়িটা খুঁজে পেতে দেরি হল না। সরা ছুড়ে দিতেই কলাবতী লুফে নিল। ”এবার তুমি পারলে ঘুমিয়ে নাও। খাওয়ার জোগাড় কী ভাবে করব জানি না, চেষ্টা করব।”

”আমার এখন আর খিদে পাচ্ছে না। ওরা কি সারাদিন বোলতায় থাকবে? তুমি কি একটু খোঁজ নিয়ে বলবে ওদের অ্যাডভান্সের টাকাটা বাবা ফিরিয়ে দিয়েছে কিনা।” সরার গলা দিয়ে কাতর মিনতি ঝরে পড়ল।

”পারলে খোঁজ নোব।” কলাবতী চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এল। ”টোকেন হারিয়েছে বলে মিথ্যে ডায়েরি করেছ। ওটা তোমার কাছেই আছে।”

”হ্যাঁ। সবসময় ওটা পকেটে থাকে। এই দ্যাখো।” ট্রাউজার্সের হিপপকেট থেকে সরা টোকেন বার করে দেখাল।

হারিকেনের অল্প আলোয় কলাবতী একটা কালো চাকতি দেখে বলল, ”ওটা দেখতে পাচ্ছি না, ছুড়ে দাও তো।”

”না, না, এটা হাতছাড়া করব না।”

”আরে, তুমি তো ডায়েরি করেছ। আই এফ এ থেকে নতুন টোকেন তো পেয়ে যাবে।”

”কিন্তু আমি যে খবরের কাগজে বলে ফেলেছি জোর করে মিথ্যে ডায়েরি আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে।”

”তা হলে টোকনটা আমায় দেখতে দেবে না? বেশ, থাকো ওখানে। শ্যামপুকুরের লোকগুলো তো আবার আসবেই, আমি আর কথা বলব না, সুশিই বলবে। আর ও খুব মরালিস্ট, সবসময় সত্যি কথা বলে। হয়তো বলে ফেলবে স্বরাজ দাস কোথায় লুকিয়ে আছে।”

”না, না, না। এই নাও টোকেন।”

একটা কালো ধাতুর চাকতি গর্ত থেকে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। এক হাতে কলাবতী লুফে নিল। বেশ ভারী, একশো গ্রাম তো হবেই, একপিঠে টোকেন নম্বর। এমন ধ্যাবড়া ভাবে খোদাই করা যে, কলাবতী পড়তে পারল না। শুধু ‘ভ্যালিড ফ্রম ১৯৯৪’ টুকু পড়া গেল। মধ্যিখানে খোদাই করা একটা ফুটবলার বলে লাথি মারছে, তলায় ঠিকানা ১১১ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট। অপর পিঠে লেখা ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, মধ্যিখানে তারা মার্কা লোগো খোদাই করা, নীচে দুই সেক্রেটারির সই। পড়া গেল না নাম।

”আমার ক্যারামের স্ট্রাইকারটা হারিয়ে গেছে। এটা দিয়ে মনে হচ্ছে কাজ চালানো যাবে, একবার পরীক্ষা করে দেখব।”

”তার মানে তুমি ওটা নিয়ে নিচ্ছ?”

”আপাতত।” বলেই কলাবতী আর দাঁড়াল না। যেতে যেতে শুনতে পেল, ”তুমি কিন্তু কথা বলবে, সুশি নয়।”

.

সুশি পাউরুটি কিনতে গেছে বাজারে। সরাকে তা ছাড়া আর কীই—বা খেতে দেওয়া যেতে পারে! শেতলের মাকে লুকিয়ে ডাল—ভাত রান্নাঘর থেকে বার করা সোজা ব্যাপার নয়। কয়েকটা আম অবশ্য দেওয়া যেতে পারে। ফেরার পথে সে ফুটবল মাঠের ধার দিয়ে আসছিল, তখন ক্লাবঘরের জানলা দিয়ে দেখল ভেতরে কয়েকজন, তার মধ্যে ব্যাংকাকা, ভূদেব খেটো, ঘন্টুও রয়েছে।

সুশি ক্লাবঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

”কাল সেমিফাইনাল রি—প্লে আর আজ বিপ্লব বলছে কিনা খেলব না?” ভূদেব খেটো টেবিলে চাপড় মারলেন। ”ব্যাপার কী ব্যাং?”

”ভোরবেলাতেই কৃষ্ণপুরে গেছলুম, বিপ্লব তখন দাঁত মাজছে। বলল অ্যাঙ্কেলে চোট। ভাল করে পা ফেলতে পারছে না, হেঁটে দেখালও। একটু বেশি খোঁড়াল মনে হল।”

সুশি এবার ঘন্টুর গলা পেল, ”চোট না আর কিছু। ও একজনকে কাল বলেছে হাজার টাকা হাতে দিলে পায়ে বল ছোঁবে। খেলে তো কলকাতার সেকেন্ড ডিভিশনে।”

এবার ভূদেবের গলা, ”আমার এলাকার ছেলে আমাদেরই টুর্নামেন্টে খেলার জন্য কিনা টাকা চায়?”

ব্যাংকাকার গলা, ”শেতলের মা’র ছাগলটাকে কাল নামাব, তবু ওকে নয়।”

ঘন্টুর গলা, ”সরাটা থাকলে আর ভাবনা ছিল না, কিন্তু কাল সন্ধে থেকে কোথায় যে গেল!”

ভূদেবের গলা, ”স্থানীয় ছেলে, টাকাপয়সাও চাইত না। ব্যাংয়ের কোনও আপত্তিও হত না। সরা খেললে সেমিফাইনাল কেন, ফাইনালও জিতে নোব। ওহহ বেঁচে থাকতে থাকতে বংশীবদনকে ঘরে তোলা—!”

এই সময় সুশি দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, ”কাকা একবার বাইরে শুনে যাও।”

ব্যাংকাকা একটু অবাক হয়ে বেরিয়ে এলেন, ”কী বলবি, তাড়াতাড়ি বল। এখন জরুরি মিটিং হচ্ছে।”

”আমিও একটা জরুরি কথা বলব। যাকে চাইছ তাকে বন্দি করে রেখেছি আমরা।”

”কাকে?”

”শ্রীমান সরাকে?”

”অ্যাঁ! কোথায়”

”পাতালঘরে।”

ব্যাংকাকা মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন, দরজার পাশে রাখা সাইকেলটা ধরে সামলে নিয়ে বললেন, ”ওখানে তো ভূত আছে!”

”ঘোড়ার ডিম আছে। সরা ওখানে কাল সন্ধে থেকে ধরা দেখছে। ওর জন্যই তো এই পাউরুটি কিনে নিয়ে যাচ্ছি।”

সুশি এর পর সংক্ষেপে দ্রুত বলে গেল কলাবতী কী ভাবে সরাকে আবিষ্কার করল, মোটরবাইক চড়া তিনজন বাড়িতে ঢুকে কীভাবে সরাকে খুঁজে গেছে। ওদের ভয়েই যে পাতালঘর থেকে সে বেরোতে চাইছে না, তাও বলল। ”তোমরা তো ওকে বার করে এনে খেলাতে পারো, যদি ওর ভয় ভাঙাতে পারো।”

আর কথা না বলে ব্যাংকাকা ছুটে ক্লাবঘরে ঢুকলেন।

”পাওয়া গেছে, সরাকে পাওয়া গেছে। এখন সে পাতালঘরে বসে ধরা দেখছে।” ব্যাংকাকার উত্তেজিত গলা সুশি শুনতে পেল।

তারপর ভূদেবের গলা, ”বলো কী? ওখানে তো ভূতের বাসা!”

ব্যাংকাকা বললেন, ”সেটা দেখে এলেই তো সব বোঝা যাবে। চলো তো সবাই।”

সুশি আর দাঁড়াল না। পড়িমড়ি ছুটতে শুরু করল বাড়ির দিকে। কলাবতী তখন নৌকোয় দাঁড় বেয়ে দিঘির মাঝামাঝি। সেখানে নৌকোটা রেখে চারদিকের গাছপালা, বাড়ি দেখছিল আর টেপ রেকর্ডার চালিয়ে শুনছিল লতা মঙ্গেশকর। ঘাট থেকে হাতছানি দিয়েই সুশির ”কালু, কালু” চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি দাঁড় বাইতে শুরু করল। ঘাটে নৌকো লাগাতেই সুশি শ্বাসবন্ধ স্বরে বলল, ”সব বলে দিয়েছি। কাকা ক্লাবের লোকদের নিয়ে এখানে আসছেন। ওঁদের একজন প্লেয়ার দরকার। বোধ হয় সরাকে খেলায় নামাতে চায়।”

”বলে দিলি?”

”দিলুম। এভাবে গর্তে লুকিয়ে কতদিন থাকবে? তার থেকে বেরিয়ে পড়ুক। কাল খেলা দেখতে এই অঞ্চলের হাজার—হাজার লোক আসবে। তাদের সামনে ওই চারটে লোক কী করবে?”

”ঠিক, ঠিক বলেছিস। যদি ম্যাচটা জিততে পারে তা হলে বোলতার লোকেরাই ওকে প্রোটেকশন দেবে।”

কয়েকজন লোকের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যেতেই ওরা দু’জনে এগিয়ে গেল। সাইকেল হাতে ব্যাংকাকা, তাঁর পেছনে ভূদেব খেটো, ঘন্টু সহ আরও তিন—চারজন।

”সুশি, পাতালঘরটা কোথায়?” ব্যাংকাকা ব্যস্তভাবে জানতে চাইলেন। ভূদেবের উদ্বিগ্ন এবং ভীত চোখে একই প্রশ্ন।

কলাবতী বলল, ”শিবমন্দিরের ঠিক পেছনে। আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”

ভূদেব বললেন, ”তোমরা যাও, আমি এখানে থাকছি।”

ব্যাংকাকা বললেন, ”সে কী ভূদেবদা! আপনি যে বললেন নিজের চক্ষে দেখবেন পাতালঘরে মানুষ রয়েছে কি না! চলুন, চলুন।”

ব্যাংকাকা হাত ধরলেন ভূদেবের। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি পেছনে হটে গেলেন। ”তোমরা যাও না! আমার হার্টের ব্যামো আছে জানোই তো। আগে দ্যাখো, সরার ছদ্মবেশে কোনও ভূত কি না!”

ঘন্টু বলল, ”সেই ভাল, আপনি এখানে থাকুন, আমরা যাচ্ছি। তরুণ, খোকন আয় রে, চলুন ব্যাংজ্যাঠা।”

কলাবতী আর সুশির পিছু নিয়ে ওরা শিবমন্দিরের কাছাকাছি আসতেই ছেলেরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই ঘন্টু ইতস্তত করে বলল, ”ব্যাংজ্যাঠা দেখলেই হবে, আমরা বরং এখানেই থাকি।”

কলাবতী আর সুশি মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ব্যাংকাকা বিরক্ত স্বরে বললেন, ”তাই থাক। দুটো মেয়ে সঙ্গে যাচ্ছে, তবু তোদের ভূতের ভয় কাটল না। সুশি দেখা তো কোথায় পাতালঘরটা।”

চাতালের গর্তটার কাছাকাছি এসে কলাবতী বলল, ”ওই যে। আপনি দাঁড়ান।” এই বলে সে এগিয়ে গিয়ে দরজাভাঙা গর্তর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। হারিকেন জ্বলছে না।

”সরা, সরা।”

”হারিকেনে তেল আর নেই।” পাতালঘর থেকে কথাগুলো উঠে এল।

”এবার তুমি উঠে এসো। তোমায় দেখতে কয়েকজন এসেছে।”

”সব্বোনাশ! না, না, আমি বেরোব না।”

”ভয় নেই, ওরা শ্যামপুকুরের লোক নয়, এখানকারই লোক। তোমাকে ওদের কী যেন দরকার। সুশির ব্যাংকাকা তোমার সঙ্গে কথা বললেন। তোমার বন্ধু ঘন্টুও এসেছে।”

”ঘন্টুকে ডেকে আনো।”

”সে ভয়ে আসছে না, ওই দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তুমি চেঁচিয়ে ডাকো তো।”

”ঘোওওন…টুউউউ।” সরার চিৎকারটা গর্ত দিয়ে উঠে এল বিদঘুটে আওয়াজে অনেকটা স্টিমারের ভোঁওও—এর মতো। তাই শুনেই ঘন্টু আর তার সঙ্গীরা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। সরা আরও দু’বার ভোঁ দিল। কিন্তু কলাবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে আর সুশি ও ব্যাংজ্যাঠাকে এগিয়ে যেতে দেখে ওরা একটু সাহস পেল।

সুশির হাতে পাউরুটি। সে গর্তের দিকে তাকিয়ে বলল, ”তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। পাউরুটি এনেছি, খাবে?”

”খাব। জলতেষ্টা পেয়েছে।”

ব্যাংকাকা স্তম্ভিত। এ তো সত্যি—সত্যিই মানুষের গলা। গর্তে উঁকি দিয়ে কাঁপা গলায় তিনি বললেন, ”তুমি কি ব্রাদার্স ইউনিয়নের স্বরাজ দাস?”

”এখনও পর্যন্ত আমি ব্রাদার্সের স্বরাজ দাস।”

ব্যাংকাকার চোখে মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল। ভূতে তিনি কোনওকালেই বিশ্বাসী ছিলেন না, তবে জন্ম থেকেই সবার মধ্যে ভয় দেখতে দেখতে তাঁর মনের ওপর আবছা একটা ছায়া জমে উঠেছিল। এই মুহূর্তে সেটা কেটে গেল।

”স্বরাজ, তুমি যেমন বিপদে পড়েছ, বোলতা স্পোর্টিং ক্লাবও তেমনই বিপন্ন। কাল সেমিফাইনাল রি—প্লে বিদ্যুৎপুরের সঙ্গে। তুমি বাবা ম্যাচটা খেলে দাও।” ব্যাংকাকার স্বরে কাতরতা ফুটে উঠল।

”না, না, না, এখানে মাঠে নামব না। পাগল হয়েছেন? আমার হাঁটুর দাম কত জানেন?”

কলাবতী বিরক্ত স্বরে বলল, ”হাঁটু নিয়ে এই ভয়টা কোথায় ছিল যখন দুটো ক্লাব থেকে টাকা নিয়েছিলে? তোমাকে পনেরো মিনিট সময় দিচ্ছি ভাবার জন্য, ব্যাংকাকার অনুরোধ রাখবে কি রাখবে না সেটা ঠিক করো।”

পাতালঘর থেকে কোনও উত্তর এল না। ব্যাংকাকা হাতছানি দিয়ে ঘন্টুদের ডাকলেন। পায়ে পায়ে ওরা এগিয়ে এল।

”আরে, এত ভয় পাচ্ছিস কেন, সত্যি—সত্যিই স্বরাজ দাস রয়েছে পাতালঘরে। ভূতটুত কিসসু নেই।” ব্যাংকাকা দু’জনকে হাত ধরে টেনে আনলেন। ”ওই দ্যাখ, পাতালঘরে নামার গর্তটা। লোহার দরজাটা ঝরঝরে হয়ে গেছল, বাজ পড়ে ভেঙে গেছে। সিঁড়িটাও ভেঙে গেছে।”

ঘন্টু ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে বলল, ”সরা, এই সরা।”

”ঘন্টু? আমাকে বাঁচা ভাই। এখান থেকে বেরোবার একটা ব্যবস্থা কর। আর কিছুক্ষণ থাকলে মরে সত্যি—সত্যি ভূত হয়ে যাব।”

সরারই গলা বটে! ঘন্টু নিশ্চিন্ত হল। তরুণ খোকনও এবার এগিয়ে এল। তাদের চোখমুখে বিস্ময়। ফিসফিস করে খোকন বলল, ”হ্যাঁ রে ঘন্টু, ভূতটুত তা হলে নেই? সত্যিই সরার গলা!”

কলাবতী বলল, ”বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? শুনবে ওর কথা?” তারপর সে গর্তের কাছে মুখ দিয়ে বলল, ”সরা শুনতে পাচ্ছ ভটভটির আওয়াজ?”

”কই না তো! ওরা কি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে?”

ঘন্টু উত্তর দিল, ”সকাল থেকে ওদের দেখতে পাচ্ছি না। বোধ হয় চলে গেছে।”

”আমাদের বাড়ির খবর কী?”

”সবাই তোর জন্য খুব চিন্তায় আছে। ওরা চারবার তোদের বাড়ি ঘুরে এসেছে। তুই এখানে থেকে বেঁচে গেছিস, ওরা তোর বাবাকে বলেছে, ছেলেকে না পেলে দানা খাইয়ে দেবে। কথাটার মানে জানিস?”

”জানি, গুলি করবে। কিন্তু আমি তো টাকাটা শ্যামপুকুরকে ফেরতই দিতে চাই। তুই বাবাকে বল না ব্রাদার্সের পতিত ভটচাযের সঙ্গে দেখা করে ওকে দিয়ে শ্যামপুকুরের ব্রজদার সঙ্গে কথা বলে একটা মিটমাট করতে। তা নইলে এই অন্ধকার ঘরে না খেয়ে পচে মরতে হবে।”

”তুই নিজে গিয়ে কাকাবাবুকে বল। আমার কথা কানে তুলবেন না। দানা খাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন।”

কলাবতী এবার বলল, ”ঠিক আছে, আমি আর সুশি যাব তোমার বাবার কাছে। তুমি এই ম্যাচটা খেলে দাও।”

”ওরে বাবা! একটা দানা হাঁটুতে ছুড়ে দিলে তখন কী হবে?”

ব্যাংকাকা এইবার কথা বললেন, ”সরা, তোমার কোনও ভয় নেই। ভূদেবদা, তোমার সেফটির দায়িত্ব নিলে বোলতার মাটিতে কেউ তোমার কেশ স্পর্শ করতে পারবে না।”

”কেশ নয়, হাঁটু। ওদের ওটাই টার্গেট।”

”সারা বোলতায় মানুষ তোমাকে ঘিরে পাহারা দেবে দিনরাত।”

”আমাকে নয়, ওই ভটভটিওলাদের পাহারা দিক।”

”তাই দেবে, তুমি দয়া করে ম্যাচটা খেলে দাও।”

”হ্যাঁ রে ঘন্টু, এই ভূদেবদা কে?”

”এখানকার জনমত। এখানকার পঞ্চায়েত সমিতির হেড। এখানকার যাবতীয় উন্নয়ন—।”

”থাম তুই,” সরা চিৎকার করে ওকে থামিয়ে দিল, ”ডেকে আন ওঁকে।”

সবাই বাড়ির দিকে ছুটল, যেখানে ভূদেব অপেক্ষা করছেন। যাওয়ার আগে সুশি অবশ্য কাগজে—মোড়া পাউরুটিটা গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে বলল, ”জল দিয়ে যাচ্ছি।”

ভূদেব উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাঝে দু’বার একটু এগিয়ে গোড়ালি তুলে গলা লম্বা লম্বা করে ওদিকে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিছু দেখতে না পেয়ে বুকের বাঁ দিকে হাত চেপে ধুকপুকুনি ঠিক ছন্দে হচ্ছে কি না বোঝার চেষ্টা করেছেন। জনাদাকে দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে একগ্লাস জলও খেয়েছেন।

সবাই প্রায় দৌড়েই এল। ঘন্টুই প্রথম কথা বলল। ”জ্যাঠামশাই, পাতালঘরে সত্যি—সত্যিই সরা! আমি কথা বললুম!”

”আমিও বলেছি।” ব্যাংকাকা যোগ করলেন।

”বলেছ? ওর চেহারাটা দেখেছ?” ভূদেবের গলায় সন্দেহ।

”না। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না।” ঘন্টুর স্বর মিইয়ে পড়ল।

”এই তো! এই তো তোমাদের বুদ্ধি! ওরা তো শুধু ছদ্মবেশই ধরতে পারে না, গলার স্বরও নকল করতে পারে।” ভূদেব নিশ্চিত গলায় বুঝিয়ে দিলেন পাতালঘরের ভূতের সঙ্গেই ওরা কথা বলেছে।

কলাবতী বলল, ”জ্যাঠামশাই, ওকে তুলে এনে কাল যদি ম্যাচটায় খেলানো যায়, সেই ব্যবস্থা করুন না।”

”ভূত ফুটবল খেলবে, তাই কখনও হয়?”

”যদি হয়।” জোর দিয়ে কলাবতী বলল, ”শুধু দেখতে হবে ওই মোটরবাইকে চড়া লোকগুলো যেন ধরতে না পারে।”

”ধরতে অবশ্য পারবে না, তার আগে লোকগুলোকেই ধরে ফেলবে বোলতার জনগণ। কিন্তু তার আগে পাতালঘরের লোকটা সরা না ভূত সেটার ফয়সলা হওয়া দরকার।”

সুশি বলল, ”আমি এইমাত্র ওকে পাউরুটি দিয়ে এলুম। ভূতেরা কি পাউরুটি খায়? ভূতেরা তো রামনাম শুনলে পালিয়ে যায়, জ্যাঠামশাই আপনি শুনবেন চলুন নিজেই রামনাম করবে।”

অকাট্য যুক্তি সুশির। ভূদেবের থতমত অপ্রতিভ মুখ দেখে সবাই উৎসাহ ফিরে পেল। ”চলুন, চলুন” বলে ওরা প্রায় টানতে টানতে ভূদেব খেটোকে শিবমন্দিরের কাছে নিয়ে এল।

সুশি গর্তের কাছে বসে বলল, ”সরা, এখন তোমায় প্রমাণ করতে হবে তুমি ভূত নও। তা হলে তোমাকে তোলার ব্যবস্থা হবে। আর ওঠার পর কাল তোমাকে ম্যাচ খেলে বি এস সি—কে জেতাতেই হবে। নয়তো বোলতার জনগণ মানে ভূদেবজ্যাঠা তোমাকে রক্ষার চেষ্টা করবেন না শ্যামাপুকুরের হাত থেকে। বুঝেছ ব্যাপারটা?”

”বুঝেছি। কিন্তু কী করে প্রমাণ করব আমি ভূত নই!”

”খুব সোজা কাজ। তুমি খুব চেঁচিয়ে রামধুন গাও যাতে ভূদেবজ্যাঠার কানে পৌঁছয়। উনি এখানে কাছাকাছি রয়েছেন। ভাল কথা, তুমি রামধুন জানো তো?”

”রঘুপতি রাঘব রাজারাম তো? প্রথম লাইনটা শুধু জানি।”

”ফাইন, ওতেই দু’বার রাম শব্দটা আছে। ও কে। এবার গাও।”

গর্তের মধ্য থেকে ভেসে উঠল সরার তারস্বরে চিৎকার, ”রঘুপতি রাঘব রাজারাম, পতিত পাবন সীতারাম।”

সুশি দেখল, ভূদেবের মুখে ভয়, বিস্ময়, আনন্দ সবিকছু মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে উঠছে। তাই দেখে সুশি বলল, ”সরা থামলে কেন। রিপিট করে যাও। কাজ হয়েছে। এই রামনামই তোমাকে পাতালঘর থেকে উদ্ধার করবে।”

সরা এর পর না থেমে প্রথম লাইনটা বারবার গাইতে লাগল। ব্যাংকাকা বললেন ভূদেবকে, ”দাদা এবার কি বিশ্বাস হচ্ছে পাতালঘরে ভূত নেই। গড়ের মাঠেও ভূত নেই।”

”ব্যাং, তা হলে এতকাল যা বিশ্বাস করে এসেছে বাপ—ঠাকুর্দারা, বোলতার জনগণ—সব মিথ্যে!”

ঘন্টু বলল, ”ভাগ্যিস, সরা পালাতে গিয়ে গর্ত দিয়ে পাতালঘরে পড়ে গেছল!”

খোকন বলল, ”যদি না ওই ভটভটির লোকগুলো তাড়া করত তা হলে সরা কি শিবমন্দিরের দিকে ছুটত?”

তরুণ বলল, ”ছুটলই বা, যদি না বাজ পড়ে দরজাটা ভেঙে যেত তা হলে কি এই গর্তটা তৈরি হত?”

কলাবতী বলল, ”এত ঘটনা যে ঘটল, নিশ্চয় এর পেছনে শিবঠাকুরের কোনও ইচ্ছা আছে। ব্যাংকাকা এই শিবের নাম কী?”

ব্যাংকাকা আমতা—আমতা করে বললেন, ”অফিশিয়াল কোনও নাম আছে কিনা জানি না, তবে এখানকার লোকে বলে গড়ের শিব।”

”গড়ের শিবের ইচ্ছেটা আমার মনে হচ্ছে,” কলাবতী থেমে গিয়ে পাঁচ সেকেন্ড পরে বলল, ”উনি কলেজে পড়তে চান। ভূদেবজ্যাঠা আপনার কী মনে হয়?”

ভূদেব খেটোর মুখে তখন চাপ থেকে রেহাই পাওয়ার প্রশান্তি। তিনি ছেলেমানুষের মতো উৎসাহে ছটফট করে উঠে বললেন, ”কলেজ পরে হবে, আগে চাই বংশীবদন। সুশি, ছেলেটা যে এখনও রঘুপতি করে চলেছে, ওকে থামতে বল। এবার ওকে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে, ব্যাং, একটা মই জোগাড় করো।”

সুশি গর্তের দিকে মুখ করে বলল, ”এই, এই এবার থামো। কাজ হয়েছে, এবার তোমাকে তোলার জন্য মই আসছে। জল তখনই বরং খেয়ো। মনে রেখো, বংশীবদনকে ফাইনালে তুলে দিতে না পারলে জনগণ তোমাকে আবার পাতালঘরে নামিয়ে দেবে।”

”আমি এখন কন্ডিশনে নেই, খেলব কী করে?”

বিরক্ত হয়ে সুশি বলল, ”কন্ডিশন ফন্ডিশন বোলতায় চলবে না। ওসব বোলচাল কলকাতায় মেরো।”

ব্যাংকাকা মই আনতে ছুটলেন। একটু পরেই জনার্দন একটা বাঁশের মই ঘাড়ে করে আনল। মইটা গর্তে নামানো হল। উঠে এল স্বরাজ দাস। চারদিকে ভীত চোখে তাকিয়ে সে প্রথমেই বলল, ”ওরা ধারেকাছে নেই তো?”

ভূদেব মুঠি শক্ত করে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, ”আরে, ভূতটুত এ—তল্লাটে কোনওকালে ছিল না, এখনও নেই। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? এই তো আমরা এখানে রয়েছি।”

”আজ্ঞে ভূত নয়, শ্যামপুকুর ক্লাবের ওরা। এই দেখুন আমার হাঁটু কাঁপছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।” বলতে বলতে সরা উবু হয়ে বসে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ওরা তাড়াতাড়ি তাকে তুলে বসাল, তারপর চ্যাংদোলা করে বাড়িতে এনে একতলার বৈঠকখানা ঘরের চৌকিতে শোওয়াল। ব্যাংকাকা সবাইকে সাবধান করে বললেন, ”খবরদার, সরার কথা এখন বোলতার কাকপক্ষী কেন, মশামাছিরাও যেন জানতে না পারে। বিদ্যুৎপুরের কানে গেলেই ওরা কলকাতা থেকে এগারোটা প্লেয়ার এনে টিম করে ফেলবে।”

ঘন্টু তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”জ্যাঠামশাই, সরা কত লাখ টাকার প্লেয়ার, জানেন? কলকাতার এগারোটা কেন, বাইশটা প্লেয়ার এলেও ওকে আটকাতে পারবে না।”

কাতরস্বরে সরা বলল, ”কিন্তু ওই মোটরবাইক দুটো এলে আমি কী করব!”

জনার্দন একটা জাগে জল আনল। সরা প্রায় এক নিশ্বাসে জাগটা শেষ করে বলল, ”আমার বাবাকে ডেকে আনবেন?”

”না, না, না।” ভূদেব আঁতকে উঠলেন, ”বাবা—টাবা এখন নয়। শুনলে না, মশামাছির কানে পর্যন্ত তোমার কথা যেন না পৌঁছয়। তুমি এখন এই বাড়িতে থাকবে। কোনও ভয় নেই এখানে। ব্যাং সদর দরজা বন্ধ করে হুড়কোটা দিয়া দাও।”

”আচ্ছা জ্যাঠামশাই,” কলাবতীর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেছে। ”সরা যদি চেহারায় একটু ভোল পালটায় তা হলে তো ওকে চিনতে পারবে না শ্যামপুকুরের লোকগুলো।”

”তার মানে?” ধড়মড় করে চৌকিতে উঠে বসল সরা।

কলাবতী ওকে সাহস দেওয়ার জন্য বলল, ”ধরো খেলা শুরুর দশ সেকেন্ড আগে তোমাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হল ক্লাবঘর থেকে ঢেকেঢুকে আড়াল করে নিয়ে গিয়ে। মাঠে তুমি সবসময় মধ্যিখানে থেকে খেলার চেষ্টা করবে, মাঠের সাইডের দিকে একদম আসবে না। দূর থেকে তোমার হাঁটুকে দানাপানি খাওয়াতে গেলে ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান শু্যটার আনতে হবে। আমাদের দেশে তেমন চ্যাম্পিয়ান কেউ নেই। সুতরাং—”

সুশি এবার জুড়ে দিল, ”তা ছাড়া তোমার ভোলটাও একটু পালটে দিলে চট করে ওরা চিনতে পারবে না, এমনকী, বোলতার জনগণও নয়। তারা তো বলতে গেলে তোমাকে দেখেইনি শুধু নামটাই শুনেছে। আমরা রটিয়ে দোব কটক থেকে প্লেয়ার আনিয়েছি, দু—চারটে ওড়িয়া কথা বলতে পারবে তো?”

”দারুণ বুদ্ধি তো তোদের।” ভূদেব আপ্লুত মুখে বললেন, ”বাবা স্বরাজ, আর তুমি আপত্তি কোরো না।”

”করবে না জ্যাঠামশাই, ও খুব বাধ্য ছেলে, আপনার মতো বয়স্ক লোকের অনুরোধ ও ফেলবে না। তা ছাড়া আমি তো ওর বাড়িতে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করে বলব শ্যামাপুকুরের অ্যাডভান্সটা ফিরিয়ে দিতে। সেটা ফিরিয়ে দিলে সরার হাঁটু নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। অবশ্য শ্যামপুকুর নিতে রাজি হবে কি না জানি না। থানায় ডায়েরি করে বলেছে টোকেন হারিয়ে গেছে, আবার খবরের কাগজের লোককে বলেছে শ্যামপুকুর জোর করে ওকে দিয়ে মিথ্যে ডায়েরি করিয়েছে, এতে তো শ্যামপুকুরের লোকেরা খেপে রয়েছেই।”

”বাবা স্বরাজ, তোমার মতো এমন কীর্তিমান অকুতোভয় ছেলে সামান্য ওই চারটে লোকের ভয়ে মাঠে নামবে না তাই কি হয়?”

ভূদেব সরার পিঠে হাত বুলোলেন। সরা মাথা নামিয়ে বসে ছিল। তার মুখে অনুশোচনা। মুখ তুলে সে কলাবতীকে বলল, ”টোকেনটা ফেরত দেবে তো?”

”দোব।”

.

স্নান করে, পেটভরে ভাত আর সুশির ধরা মাছগুলোর ঝোল খেয়ে সরা চার ঘণ্টা টানা ঘুমোল। ওকে ব্যাংকাকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাত্রে আস্ত একটা মুরগির রোস্ট খাওয়াবেন। ঘুম থেকে সে যখন উঠল তখন ভয় অনেকটা কেটে গেছে। এখন সে এইটুকু অন্তত বুঝেছে যে—পরিস্থিতিতে সে পড়েছিল সেটা অতটা বিপজ্জনক অবস্থায় আর নেই। শ্যামপুকুরের লোকেরা আর বোধ হয় তাকে খুঁজতে আসবে না। তবু সাবধানে থাকতে হবে। এই বাড়ির লোকেরা, বিশেষত মেয়ে দুটি তার বন্ধুই, তার ভাল করতেই চায়, তবে বড্ড চিমটি কেটে কথা বলে। কী আর করা যাবে, যে—কাজ সে করে ফেলেছে তাতে সারা দেশে যদি ছ্যা ছ্যা পড়ে যায় তাতে মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আর কী সে করতে পারে! তবে ওই কালো লম্বা মেয়েটার একটা কথা তার মাথায় খটখট করে গাঁট্টা মেরে চলেছে—’তুমি তো ফুটবলার হতে চাও না, টাকা কামাতে চাও।’ একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনলে লজ্জা করে।

ইতিমধ্যে কলাবতী ঘন্টুর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে ফেলেছে সরার ভোল পালটানোর ব্যাপারে কী করা যায়। ঘন্টুই বুদ্ধিটা দিল। ”ওকে পরচুলা পরিয়ে গোঁফদাড়ি লাগিয়ে খেলতে নামালে কেমন হয়। আমাদের এখানে ‘বোলতার চাক’ নামে একটা নাটকের দল আছে। রাঙাদা আমার খুড়তুতো দাদা, সে ওই চাকের মেকআপ ম্যান। ওর কাছে মেকআপের জিনিস আছে। রাঙাদাকে বললেই করে দেবে।”

শুনেই তো কলাবতী প্রায় লাফিয়ে উঠল। ”ঠিক হ্যায়। লাগাও মেকআপ।” বলে সে সুশির পিঠে একটা কিল মেরে বসল। ঘন্টু ছুটল রাঙাদার কাছে। কলাবতী বৈঠকখানা ঘরে এসে সরাকে বলল, ”ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমাকে মেকআপ নিতে হবে।”

কথাটা সরার মাথায় ঢুকতে আধ মিনিট সময় নিল। ”মেক আপ! কেন, আমায় কি যাত্রা করতে হবে?”

”প্রায় তাই।” গম্ভীর মুখে সুশি বলল, ”তোমার হাঁটুর গঙ্গাযাত্রা বন্ধ করতে তোমাকে ফুটবল যাত্রা করতে হবে। খুব সামান্য ব্যাপার, দাড়ি—গোঁফ চুল পরতে হবে। কেউ তা হলে চিনতে পারবে না, তুমি সেফ থাকবে।”

গত চব্বিশঘণ্টায় সরার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা দিল। ”দাড়ি—গোঁফ লাগিয়ে একবার ছোটবেলায় স্কুলে থিয়েটার করেছিলুম। গোঁফটা ভীষণ সুড়সুড়ি দিচ্ছিল নাকে। এমন হেঁচে ছিলুম যে, খুলে পড়ে যায়। যদি সেরকম এবারও হয়?”

”হবে না, হবে না।” কলাবতী ওকে আশ্বস্ত করল। ”রাঙাদার একটা স্পেশ্যাল আঠা আছে। গোঁফ—দাড়ি এমন এঁটে থাকবে যে, কম করে তিনদিন তেলে চুবিয়ে রাখলে তবেই তোলা যাবে।”

”তিনদিন! আমার দাড়ি গোঁফ থাকবে? না আমি মেকআপ নোব না।”

তাড়াতাড়ি সুশি বলল, ”কালু ভুল বলেছে। তিনদিন নয় ঘণ্টাতিনেক জম্পেশ হয়ে এঁটে থাকবে। তুমি পারবে না তিনঘণ্টা চুল, দাড়ি—গোঁফ সহ্য করতে?”

সরা মাথা নেড়ে যেতে থাকল, ওরাও তাকে বুঝিয়ে যেতে লাগল যতক্ষণ না রাঙাদা হাতে একটা টিনের ছোট্ট বাক্স আর একটা পরচুল নিয়ে হাজির হল। খ্যাংরাকাঠির মতো দেহ, পুরু কাচের চশমা, ধুতির ওপর বুশশার্ট পরা রাঙাদার বয়স তিরিশ না পঁয়তাল্লিশ বোঝা যায় না।

”পরচুল নিয়ে কী ঝামেলা রে বাবা।” ঘন্টু হাঁফ ছাড়ল। ”সবই বুড়োদের সাদা পরচুল, একটা ছিল কটা রঙের সাহেবের পার্টের জন্য। শেষকালে পাওয়া গেল একটা কালো চুল। সরা পরে দ্যাখ তো।”

সরা পরার আগেই রাঙাদা বলল, ”আমার এটা তো ছোট্ট রাজপুত্তুরের মাথায় লাগাবার জন্য। কিন্তু এর মাথাটা যে দুর্বাসার মতো বড়, তার ওপর অত লম্বা চুল, এই পরচুল তো ওর মাথায় বসবেই না।” রাঙাদার প্রবল সন্দেহ মাথা নাড়ার মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

”তা হলে কী হবে?” কলাবতী হতাশ স্বরে বলল।

”কী আবার হবে। চুল কেটে মাথাটার সাইজ কমাতে হবে।” সুশি চটপট সমাধান করে দিল মাথা—সমস্যার।

”না, না, চুল আমি কাটব না।” সরা আঁতকে উঠে বসল।

”কেন কাটবে না! একমাসের মধ্যেই যেমন ছিল তেমনই হয়ে যাবে। রাঙাদা, আপনার কাছে কাঁচি আছে?”

”নিশ্চয় আছে। ছুরি, কাঁচি, ক্ষুর, ব্লেড ছাড়া বড় বড় মেকআপ ম্যানদের কি চলে? একবার কেদার রায় পালা হচ্ছে। কার্ভালো বলল পিস্তল না হলে স্টেজে নামবে না। কোথায় পিস্তল! মনে পড়ল পঞ্চাননের ছেলের হাতে যেন টয় পিস্তল দেখেছি। দৌড়ে গেলুম। একটা হজমোলার শিশি দিয়ে নিয়ে নিলুম। ওটা আর ফেরত দিইনি।” বলতে—বলতে রাঙাদা টিনের বাক্সটা খুলে একটা একবিঘত লম্বা কাঁচি আর চিরুনি বার করল। ”এবার তুমি এই চেয়ারটায় বোসো। জাস্ট টু মিনিট লাগবে।”

রাঙাদা চিরুনি দিয়ে চুল টেনে মুঠোয় ধরে কাস্তে দিয়ে ধানকাটার মতো কাঁচি চালাল। শব্দ হচ্ছে কচকচ, গোছা গোছা চুল সরার কাঁধে, বুকে ঝরে পড়তে লাগল। হাত দিয়ে ঘাড়ের কাছ থেকে একগোছা চুল তুলে চোখের সামনে ধরেই সরা চেঁচিয়ে উঠল, ”এ কি, আমার মাথা যে আপনি খালি করে দিলেন!” সে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলের পরিমাণ মেপে প্রায় কাঁদো—কাঁদো হয়ে বলল, ”একমাস কি, এ তো এক বছরের ধাক্কায় পড়ে গেলুম।”

সুশি ফিসফিস করে কলাবতীর কানে বলল, ”কালু সর্বনাশ করেছে রে। এ কী চুলকাটা! ধানকাটার পর মাঠ যেমন দেখায় সরার মাথা তো তাই হয়ে গেছে!”

”চুপ কর। দেখার জন্য আয়না চাইলে মুশকিলে পড়ে যাব।”

রাঙাদা পরচুলটা সরার মাথায় বসাল। মাথার মাপের থেকে সেটা এখনও ছোট। রাঙাদা ঠোঁট কামড়ে একমিনিট সরার মাথার দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁচিটা তুলে নিল। আঁতকে সরার চোখদুটো বড় হয়ে উঠল। রাঙাদা সরার ডাইনে বাঁয়ে পেছনে ঘুরে ঘুরে ওর মাথাটাকে জরিপ করতে করতে বলল ”মাথাটাকে যদি ঝুনো নারকোলের সাইজে আনা যায় তা হলে—” কথা শেষ না করেই কাঁচি দিয়ে কচকচ করে কিছু চুল উচ্ছেদ করে দিল।

সরা সটান দাঁড়িয়ে উঠল। দাঁত চেপে বলল, ”আপনার কাছে আয়না আছে?”

”অবশ্যই।” রাঙাদা গর্বিত স্বরে বলল, ”বড় বড় মেকআপ ম্যানদের কাছে আয়না থাকবে না, এ কী একটা জিজ্ঞেস করা মতো কথা হল?” বাক্স থেকে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতার মাপের আয়না বার করে সরার হাতে দিল। মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নায় দেখতে সরার চোখ জলে ভরে উঠল।

কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”সুশি, এবার কেটে পড়।”

কেটে পড়ার আগেই সরা দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গর্জন করল, ”এই, তোমরা দু’জন আমার এই সর্বনাশটা করালে। তোমাদের জন্যই আমার মাথাটা গেল।”

”আহহা, রাগছ কেন, মাথাটা তো তোমার অনেক আগেই গেছে। এখন ওটাকে বাঁচাবার চেষ্টা চলছে।” সুশি সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলল।

”কী এমন খারাপ দেখাচ্ছে! চমৎকার মাথা। আরও ভাল দেখাবে যদি ন্যাড়া হয়ে যাও, তা হলে পরচুলটাও ফিট করবে, তাই না রাঙাদা?”

কলাবতীর পরামর্শে ঝকঝক করে উঠল রাঙাদার চোখ। ”নিশ্চয় নিশ্চয়। ন্যাড়া হলে দারুণ খুলে যাবে মাথার রূপ। পরচুলটাও এঁটে যাবে।”

কলাবতী জানতে চাইল, ”আপনার কাছে ক্ষুর আছে?”

”কী যে বলো, বড় বড় মেকআপ ম্যানদের—”। রাঙাদা বাক্স থেকে একটা ক্ষুর বার করল। ”জল আনো, মাথাটা ভেজাতে হবে।”

সুশি ছুটল জল আনতে। সরা আয়নায় বারবার মাথাটা দেখে বুঝে গেল, চুলের এই অবস্থা দেখলে লোকে হাসবে, পাগল বলবে। তার থেকে ন্যাড়া হয়ে যাওয়াই ভাল। তবু এত যত্নে তৈরি করা চুলের শোভা এভাবে ধ্বংস হলে মন খারাপ না হয়ে যায় না। সরা যারপরনাই মনমরা হয়ে পড়ল।

সরার মুখের করুণ অবস্থা দেখে কলাবতী বলল, ”দুঃখ হচ্ছে? আরে পৃথিবীর সবথেকে দামি ব্রাজিলের রোনাল্ডোও তো ন্যাড়া, টিভিতে ওর খেলা দ্যাখোনি?”

”দেখেছি, কার সঙ্গে কার তুলনা করছ। আমি ন্যাড়া হলে কি রোনাল্ডো হয়ে যাব?”

”খানিকটা তো হয়ে যাবে। কলকাতার মাঠে সেটাই যথেষ্ট। ন্যাড়া রোনাল্ডো পঞ্চাশ কোটি পেলে, ন্যাড়া স্বরাজ পাঁচ লাখ তো পেতেই পারে।”

রাঙাদা ক্ষুরে শান দিচ্ছিল। সুশি জগভর্তি জল এনে সরার মাথায় ঢেলে দিল। সরা ভয়ে ভয়ে বলল, ”আপনি ক্ষুর চালাতে জানেন তো?”

”কী যে বলো। মেকআপ ম্যানদের ক্ষুর ব্লেড কাঁচি—” বলতে বলতে রাঙাদা কাজ শুরু করে দিল। মিনিটদশেকের মধ্যেই সরার মাথা সাফ হয়ে গেল। আয়নাটা মুখের সামনে ধরে বিড় বিড় করে সরা বলল, ”সত্যিই পাপ করেছিলুম তা নইলে কি আজ এই অবস্থা হয়!”

”আচ্ছা কালু, সরাকে পরচুল পরাবার আর দরকার কী? এই তো দিব্যি ওকে অচেনা লাগছে।” সুশি দু’পা পিছিয়ে চোখ দুটো সরু করে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল।

”কিন্তু আমি তো এখনও ওকে চিনতে পারছি। আমার কাকা একবার বলেছিল ভুরু কামিয়ে দিলে মানুষকে নাকি একদম চেনা যায় না। ক্রিমিনালরা লোকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তাই করে। এজন্যই ভুরু কামানো লোক দেখলেই পুলিশ সঙ্গে—সঙ্গে অ্যারেস্ট করে। অবশ্য সরাকে করবে না। এখন থেকে তো ও ইন্ডিয়ার রোনাল্ডো, কে ওকে অ্যারেস্ট করবে!”

সরা চোখ পিটপিট করে কলাবতীর কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ”তুমিই হচ্ছ পালের গোদা। যত বদবুদ্ধি বেরোয় তোমার মাথা থেকেই। চুল গেছে, এবার ভুরু দুটোকেও লোপাট করাতে চাও। এই বলে দিচ্ছি, আর একটা কথাও আর আমি শুনব না, তাতে যদি দানা খেতে হয় খাব।…এই যে দাদা, পরচুলটা মাথায় আঁটুন তো।”

রাঙাদা পরচুল সরার মাথায় টেনেটুনে বসাল। কিন্তু ঠিকমতো আঁটল না, সামান্য ছোট হয়েছে। সরা হাত দিয়ে চেপে বসাবার চেষ্টা করতে—করতে বলল, ”হেড করতে পারব তো?”

কলাবতী বলল, ”এখানে তো বল নেই, তা হলে ট্রায়াল দিয়ে দেখা যেত।”

সরা ডান দিক থেকে উঁচু হয়ে আসা একটা কাল্পনিক বল বাঁ দিকের গোলের দিকে হেড করার জন্য লাফিয়ে উঠে বাঁ দিকে সজোরে মাথাটা ঝটকা দিয়ে ঘোরাল। মাথা থেকে পরচুলটা ছিটকে উড়ে গেল। লুফে নিল কলাবতী।

মাথা নেড়ে সরা বলল, ”চলবে না। একদম অচল। শেষে মাঠের মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

কলাবতী বলল, ”তা হলে দাড়িটা—”

”একদম নয়। কেউ যদি দাড়ি টেনে দেয়?” সরা ভ্রূ তুলে বলল।

”তা হলে ভুরু দুটো—” রাঙাদা ক্ষুরটা বাগিয়ে এগোল।

পিছিয়ে গিয়ে সরা বলল, ”আমি তো বলেইছি ক্ষুর আর শরীরে ঠেকাতে দোব না। এই ন্যাড়া মাথা নিয়েই কটকের প্লেয়ার হয়ে নামব। যতদিন না ভালমতো চুল গজায় একটা টুপি পরতে হবে। হ্যাঁ রে ঘন্টু আছে কিছু? আর আমায় পরার মতো কিছু এনে দে, খালি গায়ে আর কতক্ষণ থাকব।”

ঘন্টু বলল, ”বাড়ি গিয়ে দেখছি, আমার মাপের প্যান্টশার্ট হয়ে যাবে বোধ হয়।”

”আর কলাবতী, কালই কিন্তু বাবার সঙ্গে দেখা করে টাকাটা শ্যামাপুকুরের ব্রজদাকে ফেরত দিয়ে কোর্ট পেপারটা ফিরিয়ে আনতে বোলো। এই হয়েছে এক যন্ত্রণা। টোকেনটা ঠিকমতো রেখে দিয়েছতো?

কলাবতী বলল, ”রেখেছি। ফাইনাল খেলার পর পাবে।”

”সে কী!” সরা প্রায় চিৎকার করে উঠল। ”কথা ছিল একটা মার্চ, শুধু সেমিফাইনালটা। এখন বলছ ফাইনালের পর?”

”বংশীবদন না পেলে কলেজ হওয়া আটকে যেতে পারে। এখানকার লোকজন এখন মেতে রয়েছে এই শিল্ড নিয়ে। বোলতার টুর্নামেন্ট কিন্তু বোলতা একবারও জেতেনি। তুমি যদি জিতিয়ে দাও এরা তা হলে এত খুশি হবে যে কেউ আর জমিটায় কলেজ করতে আপত্তি করবে না। তুমি জানো না, শিবমন্দিরের সামনের জমিটা সুশিরা দান করতে চেয়েছিল কলেজ করার জন্য। ভূত আছে বলে এখানকার বহু লোকের আপত্তিতে জমিটা নিতে সাহস করেননি কলেজ কমিটি। ভূতের বাসা যে ওখানে নেই তা তো কমিটির চেয়ারম্যান ভূদেবজ্যাঠা নিজেই দেখেছেন। পাতালঘরে রাত কাটিয়ে তুমি তা প্রমাণও করে দিয়েছ। এখানকার কেউ এখনও সেটা জানে না কিন্তু জানিয়ে দিতে হবে। তুমিই তা নিজের মুখে জানাবে।…প্লিজ সরা একটা ভাল কাজ করো। যে অন্যায় করেছ তার প্রায়শ্চিত্ত হবে।” মৃদু গম্ভীরস্বরে ধীরে—ধীরে কথাগুলো বলে কলাবতী হাতজোড় করে সরার দিকে তাকিয়ে রইল।

সরা মুখ নিচু করে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মুখ তুলে বলল, ”ঠিক আছে, আমি দুটো ম্যাচই খেলব, অবশ্য যদি সেমিফাইনালটা জিততে পারি। ঘন্টু একজোড়া বুট কারও কাছ থেকে চেয়ে এনে দে আর শর্টস।”

ঘন্টু বলল, ”কাল সকালেই পেয়ে যাবি।”

.

পরদিন সকালে ঘন্টু আর ব্যাংকাকার সঙ্গে সুশি গেল সরাদের বাড়ি দাসপাড়ায়। রাত্রে কলাবতী সুশির সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে, সে বাইরের মেয়ে, সুশি বোলতার। এই ব্যাপারে বাইরের কারুর নাক গলানোর থেকে স্থানীয় কেউ কথা বললে সেটা বেশি গুরুত্ব পাবে। সবার কাছে ওরা শুনেছে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা একটা বড় অ্যাটাটি কেসে ভরে শ্যামপুকুরের ব্রজদা এই বোলতায় এসে তার বাবা বিরাজ দাস আর মা সুখদা অর্থাৎ সুখি দাসের হাতে দিয়ে গেছে। তখন সরা ছিল ইন্ডিয়া ক্যাম্পে সল্টলেকের সাই হস্টেলে। ব্রজদা টোকেনটা চেয়েছিল, সরা বলেছিল টোকেন ব্রাদার্সের পতিত ভটচাযের কাছে রয়ে গেছে। আসলে মিথ্যে বলেছিল, মিথ্যে ডায়েরি করেছিল, ওটা তখন তার কাছেই ছিল, এখন সেটা কলাবতীর হেফাজতে।

কলাবতী ছিপ দিয়ে নৌকোয় বসে ছিল ঘাট থেকে কিছুটা দূরে, দিঘিতে। দু’বার ছিপে টান দিয়ে একটাও মাছ পায়নি। বিরক্ত হয়ে দাঁড় বেয়ে ঘাটের দিকে আসছে, তখন সুশির ডাক সে শুনতে পেল।

”কী হল, রাজি?” নৌকো থেকে নেমে ব্যগ্র কলাবতী জানতে চাইল।

”রাজি। কোনওমতে পালিয়ে বেঁচেছি।” সুশি হাঁফ ছাড়ার ভাব দেখিয়ে বলল, ”কী একখানা মহিলা রে বাবা! বলে, ‘টাকাফাকা ফেরত হবে না। আমাদের ভয় দেখিয়ে গেছে ছোট বন্দুক দেখিয়ে বলেছে দানা খাইবে দেবে। ঠিক আছে আমরাও ঘোলের পানা খাইয়ে ছাড়ব।’…টাকা ছাড়বে না কালু। সরার বাবা মনে হল নিমরাজি কিন্তু মা একদম নয়।”

কলাবতী বলল, ”তোরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলি?”

”ব্যাংকাকা যতটা সম্ভব বলার বলেছেন। লোকগুলো আমাদের বাড়িতে এসে সরাকে খুঁজে গেছে, ওদের সন্দেহ, সরা আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে আছে। আমরা এখন বিপদে পড়েছি, বলে গেছে টাকা ফেরত না পেলে সরার হাঁটুতে গুলি করে চিরতরে ওর খেলার জীবন শেষ করে দেবে। ব্যাংকাকা অনেক করে বোঝাল কিন্তু সরার মা কিছুতেই বুঝবে না। দুটো ক্লাব থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে, এত টাকা ওরা হাতে পেয়ে কী রকম যেন আধাপাগল হয়ে গেছে। ছেলের হাঁটু যাবে তো যাক তবু টাকা ছাড়বে না।” সুশি একনিশ্বাসে বলে গেল।

”ওদের বাড়িতে আর আছে কে?”

”দুটো দিদি, বিয়ে হয়নি।” ঘন্টু বলল।

সুশি যোগ করল, ”বাড়িটা টালির চালের। প্লাস্টার খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে, দু’খানা মাত্র ঘর আর একটা রক। তার মেঝেতে সিমেন্ট নেই। আমরা ভেতরে আর ঢুকিনি। সরার মা আরও কী বলল জানিস, পরের বছর ছেলে শ্যামাপুকুরে খেলবে এই টাকা তারই অ্যাডভান্স, এ বছর ছেলে খেলবে ব্রাদার্সে!”

কলাবতী বলল, ”যদি সরাকে সামনের বছর শ্যামাপুকুরের দরকার না হয় তা হলে সাড়ে তিন লাখ টাকা তো ফেরত দিতে হবে।”

সুশি বলল, ”ব্যাংকাকা তাও বলেছেন। সরা যদি বড় কোনও চোট পায়, ওর খেলা যদি পড়ে যায় তা হলে শ্যামপুকুর তো ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না। কিন্তু মহিলার এক কথা, যে টাকা ঘরে একবার ঢুকেছে আর তা বেরোবে না।”

ঘন্টু বলল, ”সুখিকাকিমা খুব কষ্ট করে সংসার চালান। বিরাজকাকা শ্যাওড়াফুলিতে একটা মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। বড় মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে, পাত্র প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়, চেয়েছে মোটরবাইক, কালার টিভি আর একটা ঘর তোলার টাকা।”

কলাবতী কিছুক্ষণ ঘন্টুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ”চলো, সরার সঙ্গে একবার কথা বলি। ওর বুট আর প্যান্ট জোগাড় হয়েছে?”

”হয়েছে।”

ব্যাংকাকা কথা বলছিলেন সরার সঙ্গে, আজকের খেলা প্রসঙ্গে। লোক লাগিয়ে জেনেছেন, কলকাতার প্লেয়াররা রি—প্লে খেলার জন্য যে টাকা চেয়েছে বিদ্যুৎপুর তা দিতে পারবে না তাই কলকাতা থেকে কেউ আসছে না। এটা রীতিমতো সুখবর। আরও বললেন তিনি রটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন কটক থেকে ওড়িশার সন্তাোষ ট্রফি প্লেয়ার সরানন্দ মহাপাত্র তারকেশ্বরে মানতের চুল দিতে এসেছিল, ওখানকার এক পাণ্ডাকে ধরে তিনি সরানন্দকে বোলতায় এনে ফেলেছেন। আজ সে বি এস সি—র স্ট্রাইকার খেলবে।

কলাবতীদের দেখে ব্যাংকাকা বললেন, ”সরার মা যা বলল তা আমি ওকে বলেছি। মোটরবাইক আর যখন আসেনি মনে হয় আর আসবে না। কিন্তু বিপদের সম্ভাবনাটা তো রয়েই গেল।”

”তা তো রইলই।” সরার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

চিন্তিত মুখে কলাবতী বলল, ”অত টাকা বাড়িতে রাখাটাও তো বিপজ্জনক। বাড়িও তো খুব শক্তপোক্ত নয়। যে—কোনওদিন ডাকাতি হয়ে যেতে পারে।”

সুশি বলল, ”ডাকাতরা এখন যা সাহসী হয়েছে, কলকাতায় দিনের বেলা ভিড় বাসেও ডাকাতি হচ্ছে, ভিড় ট্রেনে গুলি করে দিব্যি পালিয়ে যাচ্ছে।” বলতে বলতে সে শিউরে উঠল। ”দরজার যা অবস্থা দেখলুম একটা টোকা দিলেই ভেঙে পড়বে। তারপর বাক্স ভেঙে টাকা বার করে নিতে দু’মিনিট।” সে দুটো আঙুল তুলে দেখাল।

”টাকা পাওয়া অত সোজা নয়।” সরা তাচ্ছিল্যভরে বলল। ”ব্রাদার্সের টাকা পলিথিনের চারটে ব্যাগে মুড়ে মা পেছনের ডোবায় ইট বেঁধে ডুবিয়ে রেখেছে।”

”আর শ্যামপুকুরের টাকা?” কলাবতী উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।

”তারও ব্যবস্থা হয়েছে। রান্নাঘরের মাচায় চেলাকাঠের ভেতর থলেয় ভরে অ্যাটাচিটা রাখা আছে। ডাকাতের বাবাও খুঁজে পাবে না।” সরার দু’চোখে চাপা গর্ব। ”বুদ্ধিটা আমারই।”

”যাক, ডাকাতরা তা হলে খুঁজে পাবে না।” কলাবতী হাঁফ ছাড়ল। ”কিন্তু তুমি বাঁচবে কী করে? শ্যামপুকুর বলছে তুমি তাদের। ব্রাদার্সও ক্লেম করছে। এই টানাপোড়েনে তুমি তো কোনওদিকেই যেতে পারবে না।”

সরা মুষড়ে পড়ল। ”একটা ক্লাবের টাকা ফিরিয়ে না দিলে এ বছরটা আমার নষ্ট হবে। আই এফ এ আমার ট্রান্সফার দেবে না। মা যে কী সর্বনাশ আমার করতে বসেছে তা জানে না।” সরা মাথা নিচু করে দু’হাতে কপাল চেপে ধরল।

ঘরের সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল সরার মানসিক যন্ত্রণা দেখে। কলাবতী ফিসফিস করে সুশির কানে কয়েকটা কথা বলে সরাকে বলল, ”তুমি এই নিয়ে আর ভেবো না, আজকের ম্যাচটা খোলা মনে খেলে দাও। টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা আমি দেখছি। পতিত ভটচাযের ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা দাও। উনি করেন কী?”

”হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট।”

”তাই নাকি! আমার কাকাও তো হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। সরানন্দ মহাপাত্র, এবার ম্যাচের কথা ভাবো। সুশি, আয় তো একটু কথা আছে।” কলাবতীর সঙ্গে সুশি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দোতলায় শোওয়ার ঘরে এসে কলাবতী বলল, ”আবার সেই স্কুল স্পোর্টসের গো অ্যাজ ইউ লাইকের মতো ব্যাপারটা করলে কেমন হয় বল তো? সেদিন গুণ্ডা সেজেছিলুম, এবার ডাকাত। বিখ্যাত মেকআপ ম্যান রাঙাদাকে দরকার, আর ঘন্টুকেও।”

ভ্যাবাচাকা খেয়ে সুশি বলল, ”তার মানে!”

”বলছি।”

কলাবতী বুঝিয়ে বলতে শুরু করল।

.

* * *

যত ভিড় হওয়ার কথা তার দ্বিগুণ ভিড় হয়েছে বোলতায় ফুটবল মাঠে শুধু ওড়িশার সরানন্দকে দেখার জন্য। ব্যাংকাকার কেরামতি আছে, সকালে কয়েক ঘণ্টা সাইকেল রিকশায় মাইক আর চোঙা দিয়ে যে প্রচার তিনি ক্লাবের দুটি ছেলেকে দিয়ে চালিয়েছেন তাতেই দর্শকসংখ্যা হাজারতিনেক বেড়ে প্রায় ছ’হাজারে পৌঁছে গেছে। এটা বোলতার মাঠের রেকর্ড।

খেলা শুরুর দশ মিনিট আগে একটা বেডকভারে মাথা আর শরীর মুড়ে সরা পৌঁছল ক্লাবঘরে। ড্রেস করে বুট পায়ে দিতে গিয়ে ঝামেলা হল। বুটটা ছোট। বুড়ো আঙুল দুটো কুঁকড়ে গুটিয়ে না রাখলে জুতোর মধ্যে পায়ের পাতা ছড়ানো যাচ্ছে না। কী করা যায়। ভূদেব খেটো একজনকে ডেকে বললেন, ”দৌড়ে ফণী চাটুজ্যের বাড়িতে যা। বুটের বুড়ো আঙুলের জায়গা দুটো বঁটি দিয়ে এক্ষুনি কেটে নিয়ে আয়।” রেফারি তখন মাঠে টিম নামার জন্য হুইসল বাজাচ্ছেন।

যার বুট ধার করা হয়েছে সে বেঁকে বসল। বুট সে কাটতে দেবে না। ব্যাংকাকা আর ভূদেব একান্তে ছোট্ট একটা বৈঠক সেরে তাকে জানিয়ে দিলেন, নতুন বুট কিনে দেওয়া হবে। বিদ্যুৎপুর টিম মাঠে নেমে পড়েছে। রেফারি ঘন—ঘন হুইসল দিচ্ছেন বি এস সি—কে মাঠে নামার জন্য কিন্তু নামবে কী করে, সরানন্দের কাটা বুট তখনও যে ফিরে আসেনি।

ক্লাবঘরের সামনে দড়ি দিয়ে ঘেরা ভি আই পি এনক্লোজার। সেখানে চেয়ারে বসে কলাবতী, সুশি আর ঘন্টু। তাদের কিছুটা উত্তেজিত, উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে। বি এস সি দল মাঠে নামল সরানন্দকে ছাড়াই। বুট তখনও এসে পৌঁছয়নি। ব্যাংকাকা মাঠে গিয়ে রেফারিকে অনুরোধ করলেন পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে খেলা শুরু করতে। জেলার পাশকরা রেফারি অনুরোধ রক্ষা না করে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটেতে কিক—অফের হুইসল দিলেন। তিন মিনিটের মাথায় বি এস সি সেমসাইড গোল খেয়ে বসল। স্টপার একটু জোরেই আমচকা ব্যাক পাস করেছিল প্রথম পোস্টে। গোলকিপার ছিল দ্বিতীয় পোস্টে। এর পরই মাঠ ঘিরে তুমুল হাততালি উঠল ওড়িশার সরানন্দ মহাপাত্রকে মাঠে নামতে দেখে। ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে হাততালি থামার আগেই চুপিসারে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল।

সুশি বলল, ”কালু তাড়াতাড়ি কর, দৌড়ো।”

ঘন্টু বাধা দিয়ে বলল, ”একদম নয়, লোকের চোখে পড়ে যাবে, বরং একটু জোরে হাঁটো। রাঙাদা রেডি হয়ে থাকবে বলেছে।”

রাস্তায় জনমানুষ নেই যে ওরা চোখে পড়বে। মানুষজন তো এখন ফুটবল মাঠে। সুশিদের বাড়িতে পৌঁছতে মিনিট পাঁচেক লাগল। রাঙাদা সত্যিই রেডি হয়ে ছিল মেকআপের বাক্স খুলে। ”আসছি।” বলেই কলাবতী ছুটে দোতলায় শোয়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। একটু পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল অন্য এক কলাবতী। পরনে নীল জিনস, পায়ে স্নিকার, ঘন্টুর এনে দেওয়া ঢলঢলে কালো ফুলশার্ট, চোখে সানগ্লাস, চুল টেনে গোছা করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে প্রাচীন জাপানি যোদ্ধা সামুরাইদের মতো বাঁধা। মাথায় ক্রিকেটারদের ক্যাপ। বারান্দার দু’ধারে দেখে নিয়ে ছুটে নেমে এল পাতলা গড়নের শ্যামলারঙের ছিপছিপে একটা ছেলে।

নীচের ঘরে ঢুকতেই কলাবতীকে দেখে ঘন্টু আর রাঙাদার চক্ষু চড়কগাছ। সুশি বলল, ”হাই।”

”কেয়া হাই হাই করতা।” কর্কশ চোয়াড়ে স্বরে কলাবতী বলল। ”জানতা হাম কৌন হ্যায়? ভাগলপুরকা কালু প্রসাদ পাসোয়ান হ্যায়। হাই মাই করেগা তো এক ঝাপ্পড় লাগায়গা।” বলে সে সুশির দিকে এগিয়ে চড় মারার জন্য হাত তুলল।

”কালুজি মুঝে মাফ কিজিয়ে।” সুশি মুখে ভয় ফুটিয়ে হাত জোড় করল।

রাঙাদা বলল, ”তা হলে কার্ভালোর দাড়িটা লাগিয়ে দি।”

কলাবতী বলল, ”না, না, সাহেবের কটা দাড়ি নয়।”

”তা হলে শাজাহানের দাড়ি?”

”ফ্রেঞ্চকাট নেই?” সুশি বলল।

”কী যে বলো, বড় বড় মেকআপ ম্যানদের কাছে—”

থুতনিতে দাড়ি লাগাবার পর সবাই নানান দিক থেকে কলাবতীকে দেখল। ঘন্টু বলল, ”গাল দুটো বড্ড প্লেন, নরম নরম দেখাচ্ছে, একটা লম্বা ঝুলফি হলে ভাল হয় আর পাতলা একটা গোঁফ, চিনেদের মতো।”

তিন মিনিটের মধ্যে কলাবতীর গোঁফ ও ঝুলফি গজিয়ে গেল।

”পিস্তল?” সুশি বলল।

রাঙাদা একটা খেলনা পিস্তল বাক্স থেকে বার করল, একটা ফোল্ডিং ছোরাও। স্প্রিং টিপতেই বেরিয়ে পড়ল ঝকঝকে ছ’ ইঞ্চি ফলা। কলাবতী পিস্তলটা কোমরের কাছে প্যান্টে গুঁজে ছোরার ফলাটা মুড়ে হিপপকেটে রাখল।

”রেডি। সরার বাবা এখন শ্যাওড়াফুলিতে কাজে গেছে। বাড়িতে এখন মা আর দুই মেয়ে। ঠিক আছে। এবার অ্যাকশন।” স্বাভাবিক স্বরে কলাবতী বলল।

কিন্তু কিন্তু করে ঘন্টু বলল, ”এই ড্রেসে কলকাতায় হাঁটলে কেউ তাকাবে না কিন্তু বোলতায় লোকে তাকাবে। মিনিট চার—পাঁচ তো এখান থেকে দাসপাড়া হেঁটে যেতে লাগবে।”

সুশি সমস্যাটা মিটিয়ে দিল, ”এর ওপর একটা শাড়ি পরে নিলেই হবে। আমরা তো দাসপাড়া পর্যন্ত সঙ্গে যাচ্ছি। ঘন্টু দূর থেকে বাড়িটা দেখিয়ে দিলে কালু শাড়ি খুলে ওর হাতে দিয়ে এগিয়ে যাবে। ঘন্টু, তুমি ব্যাংকাকার সাইকেলটা নাও। কাজ হয়ে গেলেই কালুকে সাইকেলে পাঁইপাঁই পালাতে হবে। আমি শাড়ি আনছি।”

দোতলা থেকে সুশি তার ধনেখালি ডুরে শাড়ি নিয়ে এল। আটপৌরে ভাবে পরে কলাবতী ক্যাপ আর সানগ্লাস খুলে ঘোমটা দিয়ে সেটা টেনে রইল এমনভাবে যাতে দাড়ি ও জুলফি ঢাকা পড়ে। জুতোটা অবশ্য ঢাকা গেল না।

”হর হর মহাদেও।” সুশি স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গিতে চাপা গলায় বলল। ”এবার নয়া বর্গির হানা শুরু হবে।”

ওরা বাড়ি থেকে বেরনো মাত্র শুনল মাঠ থেকে ভেসে আসা ”হোওওও” শব্দে প্রচণ্ড উল্লাসধ্বনি। ঘন্টু আনন্দ চেপে বলল, ”বোলতা গোল দিল।”

বাবার সড়কে ওরা দেখা পেল শুকনো ডালপালা মাথায় নিয়ে চলা এক বুড়ির। একটি কুকুর, দুটি ছাগল আর যাত্রীভর্তি এক ট্রেকারের। দাসপাড়ায় ঢোকার মুখে আবার ”হোওওও” শব্দ বোলতার আকাশ ভরিয়ে দিল। সুশি বলল, ”বোধ হয় সরানন্দর অ্যাকশন শুরু হয়েছে।” ঘন্টু হাসি চেপে মাথা নাড়ল। কলাবতী গম্ভীর। সে এখন মনোনিবেশ করছে আসন্ন অ্যাকশনের জন্য।

”ওই যে নিমগাছের পেছনে, টালির চালের বাড়িটা।” ঘন্টু প্রায় সত্তর গজ দূর থেকে উত্তেজিত চাপা গলায় দ্রুত কথা বলে আঙুল তুলে দেখাল। ”শাড়িটা খুলে দাও। আমি আর সুশি সড়কে দাঁড়াচ্ছি।”

গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ম্যাক্সি পরা, গোলগাল মুখ মাঝারি আকৃতির সরার ছোড়দি ঘর থেকে সবে বাইরের রকে বেরিয়েছে, হাতে একটা বালতি। বেড়ার দরজা সরিয়ে বিদঘুটে সাজের একটা লোককে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল।

”কাকে চাই?”

”সব কোই কো।” কলাবতী একলাফে সিঁড়ির দুটো ধাপ পেরিয়ে রকে উঠল। ”ঘর মে কৌন কৌন হ্যায়?” ওর স্বরে যথাসম্ভব পুরুষালি রুক্ষতা আনার চেষ্টা।

”অ্যাঁ, কী বলছেন?” অবাক এবং ভীত গলা আর চোখ।

”ঘরে কৌন কৌন আছে?”

”মা আর আমি।”

”তুমারা বহেন কাঁহা?” ধমকে উঠল কলাবতী।

”বহেন? মানে দিদি?’ ঢোক গিলল। ”দিদি মাঠে খেলা দেখতে গেছে।”

”বহুত আচ্ছা। ঘরমে ঘুসো।” কলাবতী আঙুল দিয়ে ঘরের দরজা দেখাল। মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

”খাড়া হ্যায় কিঁউ। কেয়া কালা হো গিয়া। ঘুসসো।” কলাবতী কাঁধে একটা ধাক্কা দিল বেশ জোরেই। মেয়েটি টলে গিয়ে দরজা ধরে ফেলল। ঝট করে পকেট থেকে ছোরাটা বার করে সে স্প্রিং টিপল। ছিটকে বেরনো ফলাটার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে মেয়েটির মুখ দিয়ে ”আঁ আঁ” একটা আওয়াজ হল তারপর চিঁ চিঁ করে ”মা…মা” বলে উঠল।

”কী রে সুমি?” ভেতরে থেকে গলা শোনা গেল। ”কার সঙ্গে কথা বলছিস?”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে কৌতূহলী চোখে শোওয়ার ঘরে ঢুকেই লম্বা, রুগণ চেহারায় সুখি দাসের চোখ স্থির হয়ে গেল। ডাকাত!

”কী, কী চাই?”

”তোম ভালাই জানতা কী চাই। কাঁহা হ্যাঁয় ওয় এটাচি কেস? লে আও,…জলদি করো…” কলাবতী ছোরাটা ঠেকাল সুমির পেটে।

”কী বলছেন? কীসের এটাচি কেস?” সুখি দাসের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে এখন বোধশক্তি ফিরে এসেছে। গলার স্বরে জোর এসেছে।

”কীসের এটাচি কেস? দেখেগে?” কলাবতী ছোরার ডগাটা সুমির পেটে ঠেকিয়ে চাপ দিল।

”ওমা গো, পেটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে গো।” সুমি আর্তনাদ করে উঠল।

”আভি তক নেহি ঢুকায়া লেকিন অ্যাইসি মাফিক ঢুকায় গা।” কলাবতী সুমির পেটের সামনে বাতাসে ছোরাটা বিঁধিয়ে এপাশ ওপাশ ডাইনে—বাঁয়ে আড়াআড়ি চালিয়ে বুঝিয়ে দিল তার পরের কাজটা কী হবে। সুমি দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। ”মা আমার নাড়িভুঁড়ি বার করে দেবে গো।”

”জলদি করো, জলদি করো, বার করো এটাচি। বাহার মে হামকো দো দোস্ত সুশীল পরসাদ অউর ঘন্টালাল বম হাতে খাড়া হায়। হামকো দেরি দেখেগা তো ও লোক অধৈরজ হো যায়গা। …সমঝা হাম কেয়া বোলতা? ও দোনো লোক বম মারেগা, আগ লাগায়গা এই কোঠিমে। সমঝা?”

”এটাচি—ফেটাচি এ—বাড়িতে নেই।” সুখি দাস মরিয়া হয়ে বলল। তবে গলায় তেমন জোর নেই। কলাবতী ”হা হা হা” করে হিন্দি ফিল্মের খলনায়কদের মতো কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাসতে—হাসতে কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বাঁ হাত দিয়ে বার করে সুখি দাসের রগে ঠেকাল। তেরিয়া ভাবের বদলে এইবার ভয় ফুটে উঠল তার দু’চোখে।

কলাবতী সুখি দাসের কানের কাছে মুখ এনে খসখসে চাপা গলায় বলল, ”হামি সাতদিন ধরে সব খবর লিয়েছি। এটাচি কোথায় আছে হামি জানি। চলো রান্নাঘরমে চলো।” পিস্তলের নল দিয়ে সে সুখি দাসের মাথায় একটু জোরেই টোকা দিল। ”হামি ইয়ে ভি জানি পিছে কা ডোবামে, পলিথিনমে প্যাক করকে কেয়া রাখা হায়।”

”কে, কে বলেছে ডোবায় টাকা রেখেছি?” সুখি দাসের চোখেমুখে রাগ, গলায় তেজ।

গোঁফে আঙুল বুলিয়ে কলাবতী বলল, ”হাম শিউ মহারাজকা ভকত হায়। পাতালঘরকা ভূত হামকো পাতা দিয়া, হামকে বোলা এহি রান্নাঘরমে, পিছে কা ডোবামে তনখা হায়।” বলেই সে বিকট স্বরে গব্বর সিং মার্কা হাসি হাসতে শুরু করল।

এইবার সুখি দাসের ভেতরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। তার এত গোপন কাজ কিনা এই ডাকাতটা জেনে ফেলেছে! এ তো সোজা বদমাশ নয়। শিবভক্ত, পাতালঘরের ভূতেদের সঙ্গে ভাবও আছে।

উবু হয়ে বসা সুমির মাথায় ছোরার ফলাটা চাঁটির মতো মেরে কলাবতী বলল, ”অ্যাই ছুকরি উঠো, রান্নাঘর চলো।”

সুমি উঠে দাঁড়াল, সুখি দাসের গলায় পিস্তলের নল দিয়ে খোঁচা মেরে কলাবতী বলল, ”রান্নাঘর, রান্নাঘর।’

দু’জনকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে কলাবতী চট করে মাচার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল লম্বা লম্বা চেলা কাঠের স্তূপের ওপরে রয়েছে একটা চটের থলি। হাঁফ ছাড়ল সে। এত ঝুঁকি নিয়ে ডাকাত সাজা তা হলে বৃথা হয়নি। সময় আর হাতে বেশি নেই। ফুটবল ম্যাচটা শেষ হওয়ার আগেই তাকে পালাতে হবে।

”পিছু ফিরো, পিছু ফিরো।” কলাবতী কর্কশ গলায় ধমক দিল। সে ছোরার খোঁচা দিল সুখির পেটে। ”দেওয়ালকা দিক মে মুখ ফিরাও।”

সুখি দাস দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ভয়ে থরথরিয়ে সে কাঁপছে আর বিড়বিড় করে কীসব বলছে। চোখে জল। সুমির বাহুতে ছোরার ফলাটা শান দেওয়ার মতো দু’বার ঘষে কলাবতী বলল, ”তুমি ভি দেওয়াল দেখো।” সুমি সঙ্গে—সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল। কলাবতী পিস্তলটা প্যান্টে গুঁজে রাখল। একটা ছোট টুল ঘরে কোনায় রয়েছে দেখে টেনে আনল। সুমি মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল, কলাবতী ‘অ্যাই’ বলে চিৎকার করতেই সে নিমেষে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ছোরাটা দাঁতে চেপে ধরে টুলে উঠে দু’হাতে থলিটা পেড়ে নিয়ে সে ফাঁক করে দেখে নিল জিনিসটা আছে কি না। তার মুখে সাফল্যের হাসি ফুটে উঠল। বেশ মোটাসোটা অ্যাটাচি কেসটা। এবার সে পায়ে পায়ে পিছু হটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দরজা বন্ধ করে শিকল তুলে দিল। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল। তখন আর একটা ‘হোওওও’ বোলতার আকাশে পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে পাক দিচ্ছে।

”কালু শিগগিরি, এদিকে, এদিকে।” সুশির চাপা গলা শোনা গেল। তখন বাবার সড়কে জনমানব নেই। চশমা আর ক্যাপ চটপট খুলে, ছোরাটার ফলা ভাঁজ করে নিয়ে কলাবতী পকেটে ভরল। রান্নাঘরের দরজা ধাক্কাবার অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে। সাইকেল হাতে ঘন্টু দাঁড়িয়ে। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে, মুখ টসটসে। কারও তখন কথা বলার মতো অবস্থা নয়।

ঘন্টু সাইকেল ধরে রয়েছে। কলাবতী উঠে বসে ভারী অ্যাটাচি কেসটা ডান হাতে ঝুলিয়ে বাঁ হাতে হ্যান্ডেল ধরে প্যাডেলে পা রাখল। ঘন্টু সাইকেলটা ধরে ঠেলতে ঠেলতে কিছুটা ছুটে গিয়ে ছেড়ে দিল। প্রথমে টলোমলো হওয়ার পরই ব্যালান্স ঠিকমতো পেয়ে গিয়ে সাইকেল সোজা হয়ে গেল। সুশি আর ঘন্টু তাকিয়ে দেখল দূরে একটা বাঁক ফিরে কলাবতী অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এবার তারা বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। রান্নাঘরের দরজায় দুমদাম কিল আর লাথির শব্দ, সেইসঙ্গে হাউমাউ চিৎকার তখন তাদের পেছনে। ওরা যখন বাড়ি পৌঁছল তখন ”হোওওও”—র বদলে আওয়াজ উঠল ”হাআআআ”। ঘন্টু বলল, ”খেলা শেষ হল। আমরা জিতেছি।”

.

উঠোনের রকের গায়ে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রেখেই হাঁফাতে হাঁফাতে কলাবতী দোতলার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করল। অ্যাটাচি কেসটা খাটের তলায় ঠেলে দিয়ে, ঝুলফি, গোঁফ, দাড়ি খুলে পাখাটা চালিয়েই বিছানায় নিজেকে ছুড়ে দিল। শারীরিক পরিশ্রমের থেকেও ধকল বেশি নিয়েছে মন। মাথার মধ্যে বোঁ বোঁ ঘুরছে একটা টেবিল ফ্যান। স্কুলের স্পোর্টসে গুণ্ডা সেজে শ’খানেক লোককে ভড়কি দেওয়া এক ব্যাপার। আর ডাকাত সেজে সত্যি—সত্যি ডাকাতি—ধরা পড়লে তো জেল হয়ে যাবে! এখনও সে বুঝে উঠতে পারছে না কাণ্ডটা এত মোলায়েম ভাবে সে ঘটাল কী করে? সবই কীরকম ঠিকঠাক ভাবে হয়ে গেল! ওরা দু’জন যে এত ভিতু হবে সে ভাবেনি। বাইরের কেউ তখন এসে পড়তে পারত! আসেনি। সরা যদি না বলে দিত তা হলে ওর মাকে দিয়ে কীভাবে অ্যাটাচি কেসটা বার করাত? ঠিকই বার করত তবে একটু সময় লাগত, একটু খোঁচাখুঁচিও করতে হত। ভাগ্যি ভাল। সেই অপ্রিয় কাজটা তাকে করতে হয়নি। একটা সরল অঙ্কের মতো শেষপর্যন্ত অ্যানসারটা রাইট হয়ে গেল।

দরজায় টোকা আর ”কালু, কালু” ডাক শুনে সে দরজার খিল খুলল। সুশি উত্তেজিত। ঘরে ঢুকেই এধার ওধার তাকিয়ে বলল, ”কোথায় রেখেছিস?”

কলাবতী আঙুল দিয়ে খাটের তলা দেখাল। তখন ঘন্টু এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। কলাবতী তাকে বলল, ”রাঙাদার জিনিসগুলো দিয়ে এসো। জামাটা পরে দিচ্ছি। আর একটা কথা, তোমাদের এখানে তো এসটিডি ফোন আছে, আমি কলকাতায় কাকার সঙ্গে কথা বলব। টাকাটা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”

”এসটিডি আছে বাজারে বোলতা বস্ত্রালয়ে। তবে মাঝে—মাঝেই লাইন খারাপ থাকে।”

”আজ খারাপ থাকবে না। গড়ের শিবের আশীর্বাদে আজ সব কাজই পার হো যায়গা। ম্যাচের রেজাল্ট কী? সরানন্দ মহাপাত্র কী করল?”

”রাস্তায় তো দেখা হল দুটো মুনিষ আর একটা সাইকেলচড়া লোকের সঙ্গে, জিজ্ঞেস করার মতো একজনকেও পেলুম না, তবে জিতেছি যে সেটা শিওর।”

”এই ডাকাতির ব্যাপারটা কেউ যেন জানতে না পারে, সরাও নয়। জানাজানি হলে সবার হাতে হাতকড়া পড়বে। মা—দিদি হেনস্থা হয়েছে এটা সরা ভাল ভাবে নিতে পারবে না।”

সুশি অ্যাটাচি কেসটা খাটের ওপর রেখে বলল, ”তুই ছোরা দিয়ে ওদের রক্তটক্ত বার করে দিসনি তো?”

”মাথা খারাপ!” তারপরই ডাকাতের গলায় কলাবতী বলল, ”বাহার মে হামকো দো দোস্ত, সুশীল পরসাদ আউর ঘন্টেলাল বম হাতে খাড়া হায়। কোঠিমে আগ লাগায় গা। এইসব বলতেই কাজ থ্রি—ফোর্থ হয়ে গেল। বাকিটা একটু খোঁচাটোঁচা। এরা দু’জন বড়দির থেকেও ভিতু। একটু যদি চেঁচামেচি করত তা হলে পালাবার পথ পেতুম না। গড়ের শিব আমাকে আজ পার করে দিয়েছেন।” সে জোড় হাত কপালে ঠেকাল।

আর তখনই একসঙ্গে বহু লোকের হইচইয়ের শব্দ ভেসে এল। তার মধ্যে স্লোগান দেওয়ার মতো জয়ধ্বনি উঠছে। ওরা সবাই ছুটে গেল বারান্দায়। অন্তত শ’ দুয়েক নানান বয়সী লোক মিছিল করে আসছে। মিছিলের সামনে দু’জনের কাঁধে বসে রয়েছে ন্যাড়ামাথা সরানন্দ। গলায় গাঁদাফুলের মালা।

”বোলতাকে ফাইনালে তুলল কে।”

”সরানন্দ, আবার কে।”

”বংশী বাজাবে মহাপাত্র।”

স্লোগান এগিয়ে এসে বাড়ির দরজায় থামল। সরা নামল কাঁধ থেকে। ভূদেব খেটো ব্যস্ত হয়ে ভিড় সামলাচ্ছেন। ”যাও, যাও, তোমরা, এবার ওকে বিশ্রাম নিতে দাও। ছ’ছটা গোল করার ধকল কী কম! এখন ওকে রেস্ট নিতে দাও।”

কে একজন বলল, ”দাদু, ওকে ফাইনালেও পাব তো?”

”ফাইনালেও আজকের মতো ডবল হ্যাটট্রিক কিন্তু চাই।”

ভূদেব জবাব দেওয়ার আগেই অপ্রত্যাশিত বিশুদ্ধ বাংলায় সরা বলল, ”যদি তিনদিনের মধ্যে গড়ের মাঠে কলেজ তৈরির ডিসিশন আপনারা নেন, যদি এই জমিতে কলেজ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি লিখিতভাবে আমাকে দেন তবেই আমি ফাইনালে খেলব, নয়তো খেলব না।”

বিশাল জনতা চুপ। অবাক কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”শাবাস স্বরাজ দাস।”

সুশি বলল, ”ওর সব অন্যায় ধুয়েমুছে গেল।”

জনতার মধ্যে থেকে প্রশ্ন ভেসে এল। ”আপনি কি জানেন ওখানে একটা পাতালঘর আছে, সেখানে প্রেত বাস করে, তাদের হাতে অনেক মানুষ মরেছে।”

সরা পালটা প্রশ্ন করল, ”আপনারা কেউ কি পাতালঘরটা দেখেছেন?”

জনতা চুপ।

”তা হলে আসুন আমার সঙ্গে। পাতালঘরটা দেখে যান।”

সরা কয়েক পা এগিয়ে গেল। ওর সঙ্গে কেউ যেতে চাইল না। তখন ভূদেব খেটো এগিয়ে গেলেন। ”আমি যাব।” রণক্ষেত্রের সেনাপতি তলোয়ার তুলে যেভাবে সৈন্যদের আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান, ভূদেব সেইভাবে ছাতা তুলে বললেন, ”বোলতার জনগণ এসো আমার সঙ্গে। পাতালঘর চলো।”

ভূদেব খেটোর সঙ্গে গেল জনাদশেক।

ব্যাংকাকা ব্যস্ত হয়ে ভিড়ের মধ্যে জনাকে খুঁজে বার করলেন। ”মই, মই।”

বিরক্ত হয়ে জনা বলল, ”এখন কোথায় খই পাব?”

”সিঁড়ি—সিঁড়ি।” হতাশ ব্যাংকাকা কপাল চাপড়ালেন। হইহট্টগোলের মধ্যে জনা চেঁচিয়ে বলল, ”পিঁড়ি এনে দিচ্ছি।”

ব্যাংকাকা এবার নিজেই মই আনতে ছুটলেন।

কলাবতী বলল, ”অ্যাটাচি খুলে দেখে নিতে হবে সাড়ে তিন লাখ ঠিক ঠিক আছে কিনা।”

”খুলবি কী করে,” সুশি বলল, ”ওটার তো চাবি দেওয়া। লকটা তা হলে ভাঙতে হবে, ভাঙব?”

”না, না, এখন থাক, পরে দেখা যাবে। ঘন্টু তো নীচে চলে গেল, যাবি ওদের সঙ্গে পাতালঘর দেখতে?”

”না। এখন একটু আড়ালে থাকাই ভাল। এসটিডি করতে যাবি তো? শাড়িটা পরে নে। টিপ পর, আমার চুড়ি দুটো হাতে গলা। ডাকাতের চিহ্ন যেন কোথাও না থাকে,” সুশি পরামর্শ দিল। ”সরাদের বাড়ি থেকে নিশ্চয় থানায় খবর দেবে। সাবধানে থাকতে হবে।”

নিখুঁত মেয়ে সেজে কলাবতী বারান্দায় এসে দাঁড়াবার পর কথা বলতে বলতে পাতালঘর দেখে ওরা ফিরে আসছে।

”সরানন্দ কীরকম সরসর করে নেমে গেল মই দিয়ে, একটুও ভয় করল না।”

”যেভাবে নামল, যেন জায়গাটা ওর খুব চেনা।”

”ওই কি নামা? সরসর করে কেমন বাংলা বলল!”

”শ্যামপুকুর কি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ডেফিনিটলি ওকে তুলে নেবে, দেখে নিস।”

”এতকাল কীসব বাজে কথা আমরা বিশ্বাস করে এসেছি!”

বাইরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে ফলাফল জানার জন্য। ওরা বাড়ি থেকে বেরোতেই, ”কী দেখলি রে…পাতালঘর সত্যি আছে?” এইসব বলে ওদের ঘিরে ধরল। কলাবতী শুনল একজন চেঁচিয়ে বলছে, ”ভূতপ্রেত সব বাজে কথা। কালকেই সরানন্দ মহাপাত্রকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হোক। আমাদের দাবি, মাঠ চাই, কলেজও চাই।”

ভিড়ের থেকে কে বলল, ”বংশীবদনও চাই।”

স্লোগান উঠল, ”মাঠ নাও, কলেজ দাও।”

”বোলতা তুমি বংশী বাজাও।”

নীচের থেকে ঘন্টু উঠে এল। ”তোমরা রেডি। ভিড়টা চলে যাক তারপর বেরোব। যাক, সরা এবার ছাড়া পাবে। টাকাটা তো ফেরত দিতেই হত, যাদের পাওয়ার কথা তারাই পাবে।”

সুশি বলল, ”কোনও অন্যায় আমরা করিনি, করেছিল সরার মা। টাকাটা ধরে রেখে ছেলেরই ক্ষতি করছিল। ওর ট্রান্সফার নেওয়াও আটকে গেছে দুই ক্লাবের দাবিতে।”

কলাবতী বলল, ”তার থেকেও বেশি, বোলতার এতদিনকার ভূতের ভয়টা তো ভাঙল। কলেজও হবে।”

ঘণ্টু বলল, ”বলাবলি হচ্ছিল, এবারের গাজন মেলাটা গড়ের মাঠেই বসাবে। শিবমন্দিরটাও সরিয়ে শিবপ্রতিষ্ঠা করবে।”

মিনিটদশেক পর ভিড় সরে যেতে ওরা তিনজন বাজারের দিকে রওনা হল। বোলতা বস্ত্রালয় বেশ বড় দোকান। নানারকম শাড়ি, শার্টিং ও সুটিংয়ের কাপড়ও বিক্রি হয়। টানা কাউন্টারের পেছনে কাচের আলমারি। দোকানে ঢোকার মুখেই এসটিডি—র কাচের বুথ, ফোন করছে খাকি শার্ট প্যান্ট পরা একজন। ভুঁড়ি দেখেই বোঝা যায় পুলিশের কেউ।

ঘন্টু মালিকের কাছে গিয়ে বলল, ”কলকাতায় একটা ফোন করবে ব্যাংজ্যাঠার ভাইঝি।” সে আঙুল দিয়ে কলাবতীকে দেখাল।

”থানার ফোন খারাপ, এখন এস পি—কে জরুরি ফোন করছেন মেজোবাবু, ওঁর করা হয়ে যাক। একটা বড় ডাকাতি হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে।” মালিক বলল।

ঘন্টু অবাক হয়ে বলল, ”তাই নাকি? কোথায়?”

”দাসপাড়ায়।”

কলাবতী আর সুশি শুনতে পাচ্ছে চেঁচিয়ে বলা মেজোবাবুর কথাগুলো।

”হ্যাঁ সার, বাবার সড়ক সিল করে দেওয়া হয়েছে। বড়বাবু এখন ডাকাতির স্পটে রয়েছেন। মোটরসাইকেলে দু’দিন আগে এসে থ্রেট করে গেছল…বোধ হয় তাদেরই কাজ। একটা বড় গ্যাং এসেছিল জনাসাত—আটের। বাইরে অপেক্ষা করছিল।…বাড়িতে ছিল শুধু মা আর মেয়ে…ডাকাতটা দু’জনের নাম বলেছে সুশীল পরসাদ আর ঘণ্টেলাল।…হ্যাঁ সার ইউ—পি কি বিহারের…শুধু পিস্তল আর ছোরা…এ কে ফরটিসেভেন ছিল না। খবরটবর নিয়েই মনে হচ্ছে ডাকাতিটা করেছে। …না সার থানার জিপের গিয়ার বক্সটা চারদিন হল ভেঙে রয়েছে তবে সাইকেল রিকশায় দু’জন কনস্টেবল টইল দিচ্ছে আর দু’জন পাড়ার সব বাড়িতে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে।…ডেসক্রিপশন যা দিয়েছে তাতে মনে হয় রেলডাকাতি করে, অন্তত ডজনখানেক মার্ডার করেছে। কাল আপনি আসছেন?…বাড়িতে পুলিশ পোস্টিং? বড়বাবুকে নিশ্চয় বলে দোব। হাঁ সার, বড় ডাকাতি এখানে আগে হয়নি।…নমস্কার, নমস্কার।”

রুমালে কপালের ঘাম মুছে মেজোবাবু দোকানির দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ”আজ আসতে পারবেন না, রাইটার্সে পুলিশমন্ত্রীর কনফারেন্স থেকে এইমাত্র ফিরলেন, টায়ার্ড!” তারপর ঘন্টুর দিকে ফিরে বলল, ”বিকেলে মোটরবাইকে কালো জামা, কালো চশমা পরা ছাগল দাড়িওলা কাউকে বাবার সড়কে যেতে দেখেছ?”

”আমি তো মাঠে খেলা দেখছিলুম।” নিরীহ ভীতমুখে ঘন্টু বলল। মেজোবাবু সুশির দিকে তাকাতেই সে বলল, ”বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা ওইরকম কালো জামা পরা লোককে বাইকে চড়ে পুবদিকে যেতে দেখেছি।”

মেজোবাবু উৎসাহে দু’হাতের তালু ঘষে উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলেন, ”এই তো ক্লু পেয়ে গেছি। পুবদিকে গেছে? তার মানে রসবেড়িয়া থানার এলাকায় ঢুকেছে। ওদের তা হলে অ্যালার্ট করে দিতে হবে।”

মেজোবাবু লাফ দিয়ে ফোনের বুথে ঢুকে ডায়াল করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”আবার ঝামেলা বাড়াতে গেলি কেন?”

”মজা দ্যাখ না!”

”হ্যালো, হ্যালো, রসবেড়িয়া থানা? আমি বোলতা থানার মেজোবাবু। এখানে সাড়ে তিন লাখ টাকার ডাকাতি হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। মোটরবাইকে টাকাসমেত পালিয়েছে আপনাদের এলাকার দিকে। কালো জামা, কালো চশমা, দাড়িও আছে। অ্যাঁ কত বড় দাড়ি? রামছাগলের মতো…ফায়ার আর্মস? পিস্তল, ছোরা…।

সুশি চেঁচিয়ে বলল, ”পিঠে একটা মোটাসোটা বন্দুক দেখেছি বাঁধা ছিল।”

”হ্যালো, হ্যালো, একজন বলছে, সঙ্গে এ কে ফরটিসেভেন আছে।…অ্যাঁ? আপনি এখন ভীষণ ব্যস্ত? গোরুচোরকে জেরা করছেন!” মেজোবাবুকে হতাশ দেখাল। রিসিভারটা রাখতে রাখতে বলল, ”এ কে ফরটিসেভেন না বললেই হত।”

মেজোবাবু চলে যাওয়ার পর কলাবতী বুথে ঢুকল। মাত্র দু’বারের চেষ্টায় লাইন পেয়ে সে সত্যশেখরকে তার সেরেস্তায় পেল।

”কাকা, আমি কালু, বোলতা থেকে বলছি।…খুব ভাল আছি। দাদু চলাফেরা কেমন করছে?…নীচে নামছে! এবার কাজের কথা, একটা সাহায্য চাই। তুমি হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট পতিত ভটচাযকে চেনো? ব্রাদার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি…চেনো? খুব আলাপ! তা হলে তো ভালই হল। এবার শোনো—।”

কলাবতী খুব দ্রুত গতকাল থেকে সরাকে নিয়ে যা—যা ঘটেছে বলে গেল। ”এখন যা করতে হবে সরাকে নিয়ে দুটো ক্লাবে যে জট পাকিয়েছে সেটা ছাড়ানো অর্থাৎ মিটমাট।” কলাবতী দেখে নিল দোকানদার কতদূরে, সুশি তাকে ব্যস্ত রেখে আলমারি থেকে শাড়ি পাড়াচ্ছে। একটু গলা নামিয়ে কলাবতী বলল, ”টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য রেডি। সরার মন ব্রাদার্সে পড়ে আছে ওকে নিয়ে শ্যামপুকুরের কোনও লাভ হবে না, ওকে ওরা ছেড়ে দিক। মনপ্রাণ দিয়ে শ্যামাপুকুরে খেলা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। শ্যামপুকুরের ব্রজদাকে এটা বুঝিয়ে বলুক পতিত ভটচায। মনে হয় রাজি হয়ে যাবে। ওরা টাকাটা ফিরিয়ে নিয়ে ওর সই করা যে সব কাগজপত্তর আছে ফিরিয়ে দিক। তরশু এখানে ফাইনাল ম্যাচ। সরা খেলবে। তার আগেই ব্যাপারটা চুকে গেলে ও খোলা মনে খেলতে পারবে। এগেনস্টে তারকেশ্বর ইয়ুথ, খুব কড়া টিম। বোলতার বংশীবদন শিল্ডটা জেতা খুব দরকার নয়তো ভূতের বাসা ভাঙা যাবে না। ব্রজদা বা ওদের কেউ পরশুই সুশিদের বাড়িতে এসে, বাড়িটা ওদের লোক চেনে, সব কিছু চুকিয়ে দিয়ে যাক।”

আরও দু—চারটে কথা বলে ফোন রেখে কলাবতী বুথ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল সুশি দুটো ধনেখালি তাঁতের শাড়ি বেছে রেখেছে।

”টাকা তো সঙ্গে আনিনি, আপনি আলাদা করে রেখে দিন, কাল এসে নিয়ে যাব।” সুশি বলল দোকানিকে। ”কালু, কাকার সঙ্গে সব কথাবার্তা হয়ে গেছে?”

.

কলাবতী ঘাড় নেড়ে এসটিডি—র জন্য ব্যাগ থেকে টাকা বার করছিল, সুশি বাধা দিল। ”কী কথা হয়েছিল মনে নেই? কাঁকুড়গাছিতে না ফেরা পর্যন্ত সব খরচ আমার। ঘন্টু, এখানে কোন দোকানে সন্ধেবেলায় গরম—গরম রসগোল্লা পাওয়া যাবে?”

”মহাদেবের দোকানে।”

তিনজনে মহাদেবের দোকানে এসে শুনল রসগোল্লা শেষ হয়ে গেছে। বোলতা স্পোর্টিং ফাইনালে ওঠার সুখ তারিয়ে—তারিয়ে উপভোগ করেছে জনগণ, ভূদেব খেটোর দাক্ষিণ্যে।

বাড়ি ফিরেই ওরা জনাদার কাছে শুনল, সরা উধাও। কে যেন ওকে বলেছে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তাই শুনেই সে ছুটে বেরিয়ে গেছে।

”যাক, তা হলে, হাঁটুর জন্য ভয়টা আর নেই।” সুশি আশ্বস্ত গলায় বলল, ”তবে টাকাটার জন্য সরা আবার আর এক দুর্ভাবনায় পড়বে। ওকে কি বলা উচিত কে ডাকাতি করেছে?”

কলাবতী আঁতকে উঠে বলল, ”একদম নয়। শ্যামপুকুর টাকা ফেরত নেওয়ার আগে পর্যন্ত কিছুতেই নয়।”

”আমি একবার সরাদের বাড়ি ঘুরে আসি,” ঘন্টু কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল।

.

আধঘণ্টা পর ঘন্টু হাঁফাতে—হাঁফাতে ফিরে এল।

”করেছ কী?” কলাবতীকে সে বলল। রেকর্ডারে বাজছিল হ্যারি বেলাফন্টের ক্যাসেট। সেটা বন্ধ করে কলাবতী ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ”কী করেছি?”

”এত বড় হাঁ করে হা হা হা করে হেসেছিল? তুমি জানো না তোমার ডান কষের ওপরের পাটির একটা দাঁত নেই?”

কলাবতী ডান গালে হাত দিয়ে বলল, ”নেই। নড়ছিল তাই একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় টান মেরে ফেলে দিয়েছি।”

”এখন সেই টান মারার হ্যাপা সামলাও। সরার ছোড়দি দেখেছে তোমার একটা দাঁত নেই। তোমার নাকের ওই নাকছাবি পরার ফুটোটাও ওর চোখে পড়েছে। যখন ছোরাটা পেটে চেপে রেখেছিলে তখন ছোড়দি লক্ষ করেছে তোমার ডান বুড়ো আঙুলের নখটা খুব বড়।”

কলাবতী আঙুল তুলে চোখের সামনে ধরে শিউরে উঠে বলল, ”সত্যিই তো! অনেক কাজে লাগে বলে নখটা বড় রেখেছি।”

অধৈর্য সুশি বলল, ”তারপর কী হল? ওরা তো কালুকে চেনে না, জানে না, আগে কখনও দ্যাখেওনি। কিন্তু কালুর দাঁত, নাক, নখ তো সরা দেখেছে। তার ওপর সুশীলপরসাদ ঘন্টেলাল শুনেই ওর মাথায় সুশি—ঘন্টু নাম দুটো ধাক্কা দিয়েছে।”

”ইসস, খুব বোকামি হয়ে গেছে। সরা এখন কী করবে?” আফসোসে কলাবতীর গলা বসে গেছে। ”যদি পুলিশকে বলে দেয়?”

”দেয় কী, দিয়েছে!” ঘন্টুর স্বরে আতঙ্ক।

”তা হলে তো পুলিশ এখানে আসবে।” কলাবতী বলল। ”সুশি, কী করা যায়?”

”কী আর করার, তুই হাওয়া হয়ে যা। আমরা দু’জন থেকে যাচ্ছি। সন্দেহটা তো তোকেই।”

”কীভাবে এই রাত্তিরে হাওয়া হব! আমি তো রাস্তাঘাট চিনি না। সড়ক তো বন্ধ করে দিয়েছে!”

সুশি চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত ভেবে শান্ত গলায় বলল। ”পাতালঘর।”

”তার মানে!”

”মানে অ্যাটাচি কেস, মাদুর—বালিশ, টর্চ এইসব নিয়ে তুই পাতালঘরে নেমে পড়। মইটা এখনও গর্তে লাগানো আছে বোধ হয়। চটপট কর। তুই এগো, আমি জিনিসপত্তর নিয়ে যাচ্ছি। আর ঘন্টু শিগগিরি রাঙাদার কাছে যাও, ওর মেকআপ বক্স থেকে ছোরা পিস্তল দাড়ি ঝুলপি সব সরিয়ে ফেলতে বলো। বলা যায় না পুলিশ ওর কাছেও যেতে পারে।”

কলাবতী পাতালঘরে নেমে যাওয়ার মিনিট দুই পরই থানার বড়বাবু, মেজোবাবু আর দু’জন কনস্টেবল হাজির হল, সঙ্গে ব্যাংকাকা। তাঁকে ক্লাবঘর থেকে ওঁরা প্রায় গ্রেফতারই করে এনেছেন।

”কী অদ্ভুত কাণ্ড দ্যাখ তো সুশি। বড়বাবু বলে কিনা বাড়িতে ডাকাত রয়েছে, সাড়ে তিন লাখ টাকা ডাকাতি করেছে, বাড়ি সার্চ করবে।” মাথায় হাত দিয়ে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন।

”তোমার নাম কী? সুশিকে বড়বাবুর প্রশ্ন।

”সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”

”কলাবতী কার নাম?” বড়বাবু ধমকের সুরে জানতে চাইলেন।

”আমার বন্ধুর নাম।”

”কোথায় সে?”

”ওর খুব ভূত দেখার শক, তাই গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে গেছে।”

বড়বাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। ”কী বললে? গড়ের মাঠে? ওখানে দিনের বেলাতেই লোকে যায় না, আর রাত্তিরে হাওয়া খেতে গেছে? বললেই হল?” তিনি মেজোবাবুকে নির্দেশ দিলেন, ”তন্নতন্ন করে সার্চ করুন। বড় অ্যাটাচি কেস। আলমারি খুলে দেখবেন, খাটের তলা দেখবেন। তারপর গোয়ালঘর, তারপর রান্নাঘর। ব্যাংবাবু আপনিও ওদের সঙ্গে যান।”

মেজোবাবু দুই কনস্টেবলকে নিয়ে সার্চে যাওয়ার আগে বললেন, ”সার এই মেয়েটি, এর সঙ্গে আর একটি মেয়ে আর ছেলেকে কাপড়ের দোকানে দেখেছি ফোন করার সময়। বোধ হয় ফোন করতে গেছল।”

বড়বাবু নীচের ঠোঁচ কামড়ে বললেন, ”আর—একটা ক্লু পাওয়া গেল। কাকে ফোন করতে গেছলে?”

সুশি গম্ভীর মুখে বলল, ”কালু ফোন করতে গেছল ওর কাকাকে। কাকার বন্ধু পুলিশের ডি জি, তাকে একটা খবর দিতে।”

বড়বাবুর দেহ সটান হয়ে গেল। চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ল। গলার স্বর বদলে গেল। ”ডিই জিই! কেন, কীজন্য, কী খবর দিতে?”

”এত বড় একটা ডাকাতি হল আর কিনা থানার ফোন খারাপ, জিপ ভাঙা!”

”তা আমি কী করতে পারি। আমি তো আর খারাপ করে রাখিনি বা ভেঙে দিইনি।”

”আমিও ঠিক তাই বললুম কালুকে। বড়বাবু তো আর কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এসব করে রাখেননি। উনি খুব কাজের লোক।”

”এটা কি কলাবতী ডি জি—কে বলেছে?”

”অবশ্যই বলেছে। আরও বলেছে, ডাকাতরা ক’দিন আগেই সরাদের বাড়িতে গিয়ে থ্রেট করে বলে গেছে টাকা না পেলে দানা খাইয়ে দেবে। সেটা কি আপনি জানেন?”

”আজ জানলুম স্বরাজ দাসের মায়ের কাছে।”

”কেন, সেইদিনই থানায় গিয়ে জানায়নি? এত বড় একটা হুমকি দিয়ে গেল সেটা কি পুলিশকে না জানিয়ে থাকা যায়? এর মধ্যে একটা রহস্য আছে বলে কি আপনার মনে হচ্ছে না? আসলে ডাকাতরা সরাদের খুবই পরিচিত তাই থানাকে জানায়নি।”

”হুমম।” বড়বাবু ঘোরতর চিন্তায় পড়ে গেলেন। ”সেদিনই জানালে আমরা ওয়াচ রাখতে পারতুম, পুলিশ পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করতুম।”

”ঠিক এই কথাগুলোই কালু বলেছে ওর কাকাকে। কাকা বলেছেন কালই ডি জি—কে জানিয়ে দেবেন, সরার বাড়ির সবাইকে আচ্ছাসে জেরা করার জন্য বোলতার বড়বাবুকে যেন ইনস্ট্রাকশন দেন।”

”দেবেন কী করে, ফোনই তো খারাপ। তবে ফোন না করলেও জেরা তো অবশ্যই করব। আমার এলাকায় ডাকাতরা এসে দানা খাওয়াবে বলে গেল আর আমি কিনা জানতে পারব না? হুঁউউ মনে হচ্ছে রহস্য আছে।” বড়বাবু নাক টিপে ধরে চোখ বুঝে মাথা নাড়লেন।

সুশি এবার গলা নামিয়ে বলল, ”আর একটা কথা কি আপনার মনে হয়নি, সত্যি—সত্যিই কি আজ ডাকাতি হয়েছে ওদের বাড়িতে? কালুর কাকা বড় ব্যারিস্টার, তিনিও প্রশ্নটা তুলেছেন।”

”অ্যাঁ!” বড়বাবু যেন অগাধ জলে পড়লেন। ”ডাকাতি হয়নি?”

”শ্যামপুকুর ক্লাবকে ফলস দেওয়ার জন্য মিথ্যে করে বানিয়ে বলতেও তো পারে, পারে কিনা বলুন?”

”হুমমম।”

”ডাকাতিটা নিজেরাও তো কাউকে দিয়ে করাতে পারে, পারে কিনা বলুন? মা আর মেয়ে ছাড়া বাইরের কোনও লোক কি দেখেছে?”

”হুমমম।”

”স্বরাজ দাস ফলস নামে, মাথা ন্যাড়া করে আজ খেলল কেন? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে।”

বড়বাবু আর থই পাচ্ছেন না। ফ্যালফ্যাল করে সুশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মেজোবাবু সদলে ফিরে এলেন। ”সার, কোথাও কিছু পেলাম না।”

”পাবেন কী করে!” বড়বাবু হতাশ স্বরে বললেন, ”ডাকাতি সত্যি—সত্যি হয়েছে কিনা সেটা কি আপনি জেনেছেন?”

”না তো!” মেজোবাবু থতমত।

”জানা উচিত। একজন বড় ব্যারিস্টার, ডি জি—র বন্ধু পয়েন্টটা তুলেছেন। তবে এসেছি যখন কলাবতীর সঙ্গে অভিযোগের বর্ণনার মিল কতটা সেটা একবার দেখে নেওয়ার দরকার। ওকে ডাকো তো।” বড়বাবু সুশিকে বললেন।

”এই রাত্তিরে আমি গড়ের মাঠে যাব ডাকতে? আপনিই তো বললেন দিনের বেলাতেও লোকে যায় না।”

”তা হলে বলাই তুমি গিয়ে ডেকে আনো।” বড়বাবু একজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দিলেন।

”আমি স্যার!” বলাই ঢোক গিলল। ”এখানে থেকে চেঁচিয়ে ডাকব?”

”এখান থেকে নয়, সদর দরজার বাইরে গিয়ে ডাকো।”

বলাই বাইরে গিয়ে দু’হাতের চেটো মুখের দু’পাশে রেখে ”কলাবতী, কলাবতী” বলে পাঁচবার চিৎকার করে ফিরে এল।

মেজোবাবু বললেন, ”সার, ডাকাতিটা জেনুইন কিনা সেটা কখন জানব?”

”কাল সকালে। কলাবতীর গড়ের মাঠে ভূত দেখতে যাওয়াটাও রহস্যময় ঠেকছে। ব্যাংবাবু, কাল সকালে আমি আসছি, ওকে বাড়িতে থাকতে বলবেন। এখন আমরা যাচ্ছি।”

বড়বাবুরা চলে যাওয়ার পর ব্যাংকাকা জিজ্ঞাসা করলেন, ”কলাবতী কোথায় রে, সুশি?”

”পাতালঘরে। তোমার টর্চটা দাও তো ওকে ডেকে আনি। রাতটা মিছিমিছি কেন আর ওখানে কাটাবে?”

”হঠাৎ পাতালঘরে কেন?” বিভ্রান্ত ব্যাংকাকা হাঁ করে রইলেন।

”পরে বলব।”

রাতটা কলাবতী দোতলার পালঙ্কে শুয়েই কাটাল। সকালে চিড়ে দুধ আম ফলার করে পাতালঘরে যাওয়ার আগে সে বলল, ”সুশি, একটা গল্পের বই দে তো। সময় কাটাতে বড় কষ্ট হয়।”

”কাকা তো গল্পের বইটই পড়ে না। একটা অভিধান আছে দেখেছি, বাংলা থেকে বাংলা, ওটাই নিয়ে যা, অনেক শব্দ শিখতে পারবি।”

কলাবতী অভিধান হাতে পাতালঘরে নেমে গেল। সুশি ছিপ নিয়ে বসল মাছ ধরতে। বড়বাবু সকালে আসবেন বলেছিলেন, তার বদলে এল সরা।

”কলাবতী কোথায়” সুশিকে সে জিজ্ঞেস করল। ”জানো, আজ ভোরবেলা থানা থেকে আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিল। বলে কিনা ডাকাতি যে হয়েছে তার প্রমাণ কই? আরে ডাকাতরা কি প্রমাণ রেখে ডাকাতি করে? কোথায় কলাবতী? প্রমাণ করে দোব কে ডাকতি করেছে।”

সুশি তেরিয়া গলায় বলল, ”কলাবতীকে কী দরকার? তুমি কি বলতে চাও একটা মেয়ে তোমাদের বাড়িতে ডাকাতি করেছে?”

”মেয়ে ডাকাত কি হয় না? ফুলন দেবী? আমি একশো পার্সেন্ট শিওর কলাবতী ডাকাত সেজে টাকাটা নিয়ে গেছে। ও মেয়ে সব পারে। ওর দাঁত, ওর নাক, ওর নখই প্রমাণ।”

”একটা মিথ্যেবাদীর কথা পুলিশ বা কোর্ট মানবে ভেবেছ? তুমি মিথ্যে ডায়েরি করে বলোনি টোকেন হারিয়ে গেছে?” কথাটা বলে সুশি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল সরার দিকে। কী একটা বলতে গিয়ে সরা ঢোক গিলল।

”টোকেনটা কালুর কাছে তুমি লুকিয়ে রেখে দিয়েছ। তেমনই কালুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ওকে দিয়ে ডাকাতি করিয়েছ। অ্যাটাচি কেসটা তুমি কোথাও লুকিয়ে রেখেছ। কলাবতীকেও তুমি কোথাও সরিয়ে দিয়েছ কিংবা গুম করেছ। এসব কথা তো এখনও পুলিশকে বলিনি।” সুশি মাছ ধরার সময়ই ভেবে ঠিক করেছে কলাবতীকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরাকেই পালটা ধাক্কা দিতে হবে। এজন্য একটা—দুটো মিথ্যে কথা বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয় যদি হোক। সে ভেবে ঠিক করে ফেলে, সব দোষ সরার ঘাড়ে চাপিয়ে ওকে কোণঠাসা করে দেখবে চুপসে যায় কি না। এটা তো সত্যি, সরা দুটো মারাত্মক অন্যায় করেছে—মিথ্যে ডায়েরি আর দুটো ক্লাব থেকে অ্যাডভান্সের টাকা নেওয়া।

সরা চুপসে গেল না, ভেঙে পড়ল। রকের ওপর উবু হয়ে বসে দু’হাতে ন্যাড়া মাথাটা চেপে ধরল। ”এইসব ডাহা মিথ্যে কথা তুমি বলবে?”

”বলব। যদি তুমি কালু সম্পর্কে পুলিশকে আর একটা কথাও বলো, তা হলে বলব।”

সরা একদৃষ্টে উঠোনে পাঁচিলের ধারে নয়নতারা গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মনে কী আলোড়ন চলছে সুশি তা বোঝার চেষ্টা করতে—করতে নরম গলায় বলল, ”আমরা তো তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই চাই। কালু যা কিছু করেছে সব তো তোমার ভালর জন্যই। তোমার বাবা—মা তো টাকা দিতে চাইছিল না। তাই তো ডাকাত সেজে টাকাটা ও এনেছে, শ্যামপুকুরকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই। কালই ও কাকাকে ফোন করেছে। ব্রাদার্সের পতিত ভটচায কাকার খুব পরিচিত। তাকে দিয়ে শ্যামপুকুরের সঙ্গে মিটমাট করে টাকাটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে তো কালুই। এবার কি ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে?”

সরা চোখ ছলছল করে উঠল। ধরা গলায় সে বলল, ”এত সব কাণ্ড করেছে আমি কিছু জানতুম না। এখন আমি বড়বাবুকে কী বলব?”

”বলবে, টাকাটা পাওয়া গেছে। ডাকাতটা অ্যাটাচি কেসটা গড়ের মাঠে ফেলে ভূতের ভয়ে পালিয়ে গেছে। কলাবতী সেটা কুড়িয়ে পেয়েছে।”

শুনতে—শুনতে সরার মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল। ”বুঝেছি, কলাবতী তা হলে ওখানে।” কথাটা বলেই সে তীরবেগে ছুটল পাতালঘরের দিকে, তার পিছু—পিছু সুশি।

পাতালঘরের গর্তের কাছে দাঁড়িয়ে সরা, ”কলাবতী, কলাবতী” বলে তিন—চারবার ডাকল। কোনও সাড়া এল না। মইটা লাগানোই রয়েছে। সরা নেমে গেল পাতালঘরে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে বলল, ”আমি পুলিশকে কিছু বলব না কলাবতী, তুমি বেরিয়ে এসো।” কিন্তু কলাবতীর কোনও সাড়া নেই। সে অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে কুঁজোয় ঠোক্কর খেল। তারপর পায়ে লাগল টর্চটা। সেটা তুলে নিয়ে জ্বালল, চারদিকে ঘুরিয়ে—ঘুরিয়ে দেখল, কয়েকটা চামচিকে ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই।

সে ওপরে উঠে এসে অবাক স্বরে সুশিকে বলল, ”ভেতরে কেউ নেই। গেল কোথায়?

দুর্ভাবনা ফুটে উঠল সুশির চোখে, গলার স্বরে। ”ওর তো এখানেই থাকার কথা! যাবে কোথায়? অ্যাটাচিটা দেখলে কী?”

”না, নেই।”

ওরা গড়ের মাঠে ঘুরে—ঘুরে ঝোপঝাড় দেখল। গড়ের বাড়ির ভাঙা দেওয়ালের এধার—ওধার খুঁজল। কয়েকবার নাম ধরে ডাকল। তারপর দিঘির পাড় ধরে এগিয়ে গেল, যদি জলে পড়ে গিয়ে থাকে।

”কী রে সুশি, বড়বাবু আসবে কখন?”

দু’জনেই চমকে উঠে দিঘির দিকে তাকাল। জলে নলখাগড়ার বনের মধ্যে নৌকায় বসে কলাবতী। হাতে অভিধানটা।

”অনেকক্ষণ নৌকোয় বসে ‘অ’—টা এখনও শেষ হল না। অক্ষত মানে আতপ চাল, অয়স মানে লোহা, অররু মানে শত্রু, অষ্টাপদ মানে সোনা—আর শুনবি? কী দারুণ ইন্টারেস্টিং বই, এতদিন জানতুমই না।…বড়বাবু চলে গেলে বলিস।”

”তুমি এবার ডাঙায় ওঠো।” সরা হাত নেড়ে ডাকল। ”আমি এখনই থানায় যাচ্ছি। গিয়ে বলব অ্যাটাচি কেসটা তুমি গড়ের মাঠ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছ। ডাকাতি নিয়ে আর আমাদের কোনও অভিযোগ নেই।”

কলাবতী দাঁড় বেয়ে নৌকাটাকে ঘাটে নিয়ে এল। অ্যাটাচি কেস হাতে পাড়ে নেমে সরাকে সে বলল, ”চাবিটা আছে নাকি তোমার কাছে? তা হলে খুলে দেখতুম। একসঙ্গে সাড়ে তিন লাখ টাকা কখনও দেখিনি তো!”

”ঠাট্টা পরে করবে। সত্যিকারের ডাকাত কিন্তু এসে পড়তে পারে। এটা নিয়ে ওপরে চলে যাও। আমি থানায় যাচ্ছি।”

ওরা দু’জন দোতলায় উঠে যাওয়ার পর সরা বেরোতে যাচ্ছে, তখনই বড়বাবু, মেজোবাবু আর কনস্টেবল বলাই বাড়িতে ঢুকল। তাদের পেছনে একটা ভিড়, নেতৃত্বে ভূদেব খেটো। বোলতার লোক ইতিমধ্যে জেনে গেছে সরানন্দ মহাপাত্র আসলে স্বরাজ দাস।

গম্ভীর চালে বড়বাবু সরাকে বললেন, ”শুনলুম তুমি প্রমাণ করেছ গড়ের মাঠে, পাতালঘরে ভূত নেই। এটা কি সত্যি?”

একগাল হেসে সরা বলল, ”আজ্ঞে হ্যাঁ। এটাও সত্যি, ভূতেই টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।”

”তা হলে মিথ্যে ডাকাতির অভিযোগ করেছিলে। জানো এর ফল কী হতে পারে?”

”কী আবার হতে পারে।” গর্জন করে ভূদেব এগিয়ে এলেন। ”বংশীবদন আগে ঘরে উঠুক, তারপর ফলটল দেখাবেন।” মুঠোকরা হাত তুলে জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি কথা শেষ করলেন, ”কী বলো হে তোমরা?”

হইহই করে উঠল জনগণ।

”পুলিশের জুলুম চলবে না।”

”থানা ঘেরাও করব।…দাদু কালই বোলতা বনধ ডাকুন।”

”এসব বোলতাকে হারাবার জন্য ছ’গোল খাওয়া বিদ্যুৎপুরের চক্রান্ত। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বড়বাবু।”

”বড়বাবুর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।”

এক পা এক পা করে পিছু হটে যাচ্ছেন বড়বাবু। দরদর ঘাম গড়াচ্ছে কপাল থেকে গাল বেয়ে। জনতাও এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর দিকে।

মেজোবাবু ফিসফিস করে বললেন, ”সার, বংশীবদনের আহ্বানে, বোলতার জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে, স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য—”

”আঃ, কী খটোমটো বাংলা বলছ।” বড়বাবু ধমক দিলেন। তারপর হাত জোড় করে জনতাকে উদ্দেশ করে বললেন, ”স্বরাজ দাস বলেছে ভূতে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। ব্যস, আর কোনও সমস্যা নেই। তা হলে এবার আমাদের যেতে দিন।”

”যেতে দাও, যেতে দাও,” বলে ভিড় পথ করে দিল। ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে এসেই বড়বাবু খিঁচিয়ে উঠলেন, ”পাবলিকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি? এইজন্যই তো পুলিশের এত বদনাম।” পরশু ফাইনাল খেলা লিচুতলা সহযাত্রীর সঙ্গে। সরা বাড়ির দিকে রওনা হতেই জনতা তার সঙ্গ নিল।

”যাক বাবা, একটা ফাঁড়া কাটল,” দোতলার বারান্দায় সুশি বলল।

.

সাদা মারুতি গাড়িটা সরাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে থামল, চালাচ্ছেন পতিত ভটচায, তাঁর পাশে সত্যশেখর, পেছনে কালো শার্ট পরে সেই যুবকটি, যার হাঁটা দেখলেই মনে হয় বগলে ফোঁড়া হয়েছে। ওর নাম বদু। আর আছে বিশ্বনাথ ওরফে বিশুবাবু, শ্যামপুকুর ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ। বদু এবং বিশুবাবু সরাদের বাড়িতে আগে এসেছে।

গাড়ি থেকে সবাই নামল। বিশুবাবুর হাতে পাতলা একটা অ্যাটাচি কেস। সে বলল, ”বদু, তুই যাসনি, গাড়িতে থাক। দরকার হলে ডাকব।”

”কেন বিশুদা, দানাটানা খাওয়াবার কথা বলতে হবে না? সঙ্গে করে এনেচি।”

”না, না, ওসব আজ নয়।” বিশুবাবু ওকে থামাল।

বদু বলল, ”চলো, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।”

সামনে দু’জন পেছনে তিনজন বাবার সড়ক থেকে সরু একটা রাস্তা ধরে এগোল। তখন সুমি সামনের বাড়িতে এক বউকে ডাকাতির গল্প শোনাচ্ছিল। তিনজন সরাদের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পর বদু রাস্তায় পায়চারি শুরু করল। গল্প করতে—করতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে সুমির চোখে পড়ল কালো জামাপরা সেই লোকটাকে, যে কয়েকদিন আগে তাদের পিস্তল দেখিয়ে দানা খাওয়াবে বলে গেছল।

”বউদি, ওই তো সেই ডাকাতটা। আবার আমাদের বাড়িতেই এসেছে। ওরে বাবা, এখন কী হবে! কেউ নেই বাড়িতে দিদি আর মা ছাড়া।”

বউদি জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে বদুকে দেখে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, ”ডাকাত, ডাকাত…ওগো কে কোথায় আছ, ডাকাত পড়েছে…বাঁচাও, বাঁচাও।”

পাড়ায় সবাই জানে দু’দিন আগেই ডাকাতি হয়ে গেছে। পাড়ায় এত বাড়ি, এত লোক থাকতেও কিনা পরিচ্ছন্নভাবে ডাকাতিটা করে সটকে পড়ল! ডাকাতটাকে ধরা গেল না। এজন্য সারা পাড়ার নারীপুরুষ খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ে। বউটির চিৎকার শুনে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে এল, তবে তারা পুরুষ নয়। তখন বেলা প্রায় দশটা বাজে, পুরুষরা কাজেকর্মে বেরিয়ে গেছে। নানান বয়সী মেয়ে, তাদের হাতে খুন্তি, কাটারি, চ্যালা কাঠ, লোহার শিক। এমনকী ইটের খণ্ড, মাটির ঢেলা।

বদু প্রথমে বুঝতে পারেনি রে রে করে যারা তেড়ে আসছে তাদের লক্ষ্য সে নিজেই। একটা মাটির ঢেলা তার মাথায় লেগে ভেঙে যেতে সে সচকিত হয়ে পালাবার জন্য এধার—ওধার তাকাল।

”ডাকাত, ডাকাত,” চিৎকারে দাসপাড়া মুখর। তার মধ্যেই একজন বলে উঠল, ”শিগগিরি থানায় গিয়ে খবর দে।”

ফ্রকপরা দুটি মেয়ে ছুটল থানার দিকে। আর বদু ছুটল বাবার সড়ক ধরে। এখানে সে কিছুই না চিনলেও এখন তার মনে পড়ছে সুশিদের বাড়িটা। সেখানে গিয়ে আপাতত লুকিয়ে থাকা যায়। তাই সে ছুটল সুশিদের বাড়ির দিকে।

সত্যশেখররা সরাদের বাড়ির মধ্যে তখন। তাদের দেখে তো সরার মা সুখির মুখ গম্ভীর।

শ্যামপুকুর ক্লাবের বিশুবাবু দু’হাত জোড় করে বলল, ”চিনতে পারছেন। আমিই এসে অ্যাডভান্সের টাকা দিয়ে গেছলুম। পতিতবাবু কাল বললেন সরা ওটা ফেরত দিতে চায়। তাই ফেরত নিতে এসেছি। কোর্টের স্ট্যাম্প পেপারটাও ফেরত দোব বলে এনেছি। সরা কোথায়?”

সরার দিদি অমিতা বলল, ”সরা বাজারে গেছে। বাবা গেছে শ্যাওড়াফুলিতে, কাজে।”

পতিত ভটচায বলল, ”দুটো ক্লাব থেকে টাকা নিয়ে সরা খুবই অপরাধ করেছে। এজন্য ও শাস্তি পেতে পারে। যাই হোক, শ্যামপুকুরের ব্রজবাবু অদ্দুর আর যেতে চান না। আমাদের অনুরোধে সরাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন। বিশুবাবু এসেছেন টাকা ফেরত নিতে। ওকে দিয়ে দিন।”

সুখি দাসের থমথমে মুখে এবার কান্না ভেঙে পড়ল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ”সে টাকা কি আর আছে, সে তো পরশুদিন ডাকাতে এসে নিয়ে গেছে।”

সত্যশেখর অবাক স্বরে এবার বলল, ”তা কী করে হয়! আমার ভাইঝি কালু এখান থেকে টেলিফোন করে পরশুই বলল টাকাটা রেডি করা আছে। কখন ডাকাতি হয়েছে?”

অমিতা বলল, ”বিকেলে, যখন ফুটবল খেলা চলছিল।”

সত্যশেখর বলল, ”আর কালু তো আমায় ফোনে বলল সন্ধে বেলায়!”

বিশু বলল, ”এখানে একটা বাড়িতে গেছলুম সেখানে ছিপছিপে লম্বা কালো রঙের একটি মেয়েকে দেখেছি নাম কলাবতী, সেই কি?”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভাইঝি।”

”চলুন তো, মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি।”

বিশুবাবু কথাটা সবে শেষ করেছে তখনই পাড়া কাঁপিয়ে ”ডাকাত, ডাকাত” রব উঠল।

এদিকে বদু ছুটতে—ছুটতে সুশিদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। কলাবতী তখন ঘন্টুদের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধানভানা দেখতে যাওয়ার জন্য দোতলা থেকে নামছে। ঢেঁকি সে কখনও দ্যাখেনি। দাদুর কাছে শুনেছে দেশ থেকে নাকি ঢেঁকি তাড়িয়ে দিয়েছে রাইস মিল। হঠাৎই বদুকে ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে সে পথ আটকে বলল, ”এ কী! কোথায় যাচ্ছেন? আজও কি বাড়ি সার্চ করবেন নাকি?”

”আমাকে ডাকাত বলে তাড়া করেছে সরার পাড়ার মেয়েরা। হাতে বঁটি, কাটারি, আরও কত কী, মেরেই ফেলে দেবে। সরার বাড়িতে আমরা গেছলুম টাকাটা ফেরত নিতে।”

”আমরা কারা?”

”ব্রাদার্সের পতিতদা, শ্যামপুকুরের বিশুদা আর সত্য বলে একটা লোক।”

”ওহহো, কাকাকে তো বলাই হয়নি টাকাটা কোথায়!”

”থানায় খবর দিতে গেছে। আমাকে কিছুক্ষণ ঘাপটি দিয়ে থাকতে হবে। এখনও তিনটে পুলিশ কেস ঝুলছে। কী বিপদে যে পড়লুম ক্লাবের জন্য সার্ভিস দিতে এসে।”

”লুকিয়ে থাকতে চান? আচ্ছা আসুন, লুকোবার খুব ভাল জায়গা আছে।”

দ্রুত পায়ে কলাবতী নীচে নেমে এল। পেছনে বদু। খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে দিঘির ধার দিয়ে শিবমন্দিরের পেছনে হাজির হল। পাতালঘরের গর্তে মইটা লাগানোই রয়ে গেছে। সে আঙুল দেখিয়ে বলল, ”শিগগিরি নেমে পড়ুন। থানার বড়বাবুর ডাকাত ধরার খুব শখ, এক্ষুনি এসে পড়বেন।”

বদু ইতস্তত করে বলল, ”এই গর্তটা কীসের?”

”পাতালঘরের, ডাকাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। নেমে পড়ুন, নেমে পড়ুন।” কলাবতী তার পিঠে ধাক্কা দিল। দূরে বাবার সড়ক দিয়ে কয়েকটি লোক উত্তেজিত ভাবে লাঠি হাতে যাচ্ছে। বদু আর একটিও কথা না বলে মই বেয়ে নীচে নেমে গেল। সে নামামাত্রই কলাবতী মইটা টেনে তুলে নিল।

”এ কী, এ কী! পাতালে নামিয়ে মই কেড়ে নিলে কেন? আমি উঠব কী করে?” বদুর আর্তস্বর গর্ত থেকে উঠে এল।

”মই না থাকলে পুলিশও নামতে পারবে না। এটাই কি ভাল হল না?”

”তোমার খুব বুদ্ধি আছে। পরে মই লাগিয়ে দেবে তো?”

”নিশ্চয় দোব।” কলাবতী মইটা গর্তের পাশে রেখে ফিরে এল। তাকে দেখে সুশি বলল, ”কোথায় গেছলি? চল ঘন্টুদের বাড়ি।”

”পরে যাব। এদিকে একটা খুব মজা হয়েছে।” কলাবতী তারপর যা ঘটেছে সুশিকে বলল।

সুশি শুনে বলল, ”বাছাধন এখন ভূতেদের দানা খাওয়াক।”

কলাবতী সবে সদরে পৌঁছেছে। তখন সদলবলে বড়বাবু বাড়িতে ঢুকলেন। সঙ্গে সরা, সত্যশেখররা এবং প্রায় সারা বোলতাবাসী।

”এখানে ডাকাত ঢুকেছে?” সুশিকে সামনে পেয়ে বড়বাবুর প্রথম প্রশ্ন।

সুশি আকাশ থেকে পড়ল। ”ডাকাত! কই, না তো!”

”তুমি কতক্ষণ এখানে আছ?”

ছেলেমানুষি গলায় সুশি বলল, ”সকাল থেকেই। কাউকে তো বাড়িতে ঢুকতে দেখিনি। আপনি শুধু আমাদের বাড়িতেই ডাকাত ঢুকতে দেখেন।”

মেজোবাবুর দিকে তাকিয়ে বড়বাবু বললেন, ”তা হলে কোথায় গেল ডাকাত?”

”পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি সার্চ করে দেখব সার?”

”চলুন।”

ওরা বেরিয়ে যেতেই কলাবতী জড়িয়ে ধরল সত্যশেখরকে। ”কাকা, যা সব কাণ্ড এখানে হচ্ছে।”

”খুব বেঁচে গেছি রে কালু। এ কোথায় এসে পড়লুম! মেয়েরা ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করে দিল। ভাগ্যিস এই স্বরাজ দাস এসে পড়ে আমাদের বাঁচাল।”

বিশুবাবু বলল, ”হতভাগা বদুটাই যত নষ্টের গোড়া। কেন যে সঙ্গে করে আনলুম। এত টাকা নিয়ে মোটরে যাব, পথে যদি কিছু ঘটে তাই ভাবলুম সঙ্গে একটা গার্ড থাকা ভাল।”

সত্যশেখর বলল, ”কিন্তু গার্ডটি গেল কোথায়?”

পতিত ভটচায বলল, ”গার্ড চুলোয় যাক, টাকাটা যে ডাকাতি হয়ে গেছে।”

কলাবতী আর সুশি মুখ টিপে হাসছিল। সরা তাই দেখে পকেট থেকে একটা চাবি বার করে দেখিয়ে বলল, ”আমার টোকেনটা এবার দেবে তো?”

ছোঁ মেরে সুশি চাবিটা সরার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ”ফাইনালটা খেলে দেওয়ার পর টোকেন। আপনারা বৈঠকখানা ঘরে বসুন, টাকা আনছি।” বলেই সুশি ছুটল দোতলায়।

তিনজনেই যথেষ্ট অবাক। যে টাকা ডাকাতি হয়েছে বলে তারা শুনেছে সেই টাকা আনতে গেল কিনা এই মেয়েটি!

সত্যশেখর বলল, ”ব্যাপার কী রে কালু?”

কলাবতী জবাব দেওয়ার আগেই সরা বলল, ”ব্যাপার কিছুই নয়, ডাকাতরা ভূতের তাড়া খেয়ে অ্যাটাচি কেসটা মাঠে ফেলে পালিয়ে যায়, কলাবতী সেটা কুড়িয়ে পেয়েছে।”

”বাবা বলছিল এখানে ভূত আছে বলে লোকে বিশ্বাস করে। তা হলে সত্যি—সত্যিই আছে। তোকে তাড়া করেনি তো কালু?”

মুখটাকে গম্ভীর করে কলাবতী বলল, ”করবে কী করে, বড়দি পইপই করে বলে দিয়েছিল বেলগাছ, শ্যাওড়াগাছের দিকে না যেতে। আমি একদম যাইনি। বলে দিয়েছিল ভূতেদের পা খুব লম্বা হয়, তাড়া করলে শাড়ি পরে ছুটতে পারবে না। আমি শাড়ি পরিনি।”

সুশি অ্যাটাচি কেস নিয়ে এল। চাবি দিয়ে ঢাকনাটা খুলতেই দেখা গেল বাণ্ডিল করা হাজার টাকার নোট থরে—থরে বিছানো। বিশুবাবু তার অ্যাটাচি থেকে কোর্টের স্ট্যাম্প পেপার বার করে সরার হাতে তুলে দিল। তার মুখে জ্বলজ্বল করে উঠল মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। কৃতজ্ঞ চোখে সে কলাবতী, সুশির দিকে তাকাল।

”তা হলে বাবা কাল বংশীবদন বি এস সি—র ঘরে উঠছে!”

সবাই ফিরে তাকাল দরজার দিকে। ব্যাংকাকা দাঁড়িয়ে।

”জান লড়িয়ে খেলব,” সবার গলায় প্রতিজ্ঞার সুর। ”প্রত্যেক বছর আমি খেলে দিয়ে যাব, যদি কলেজটা হয়।”

”তা হলে এবার যাওয়া যাক।” বিশুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”পতিতদা আমাদের ‘নো অবজেকশন’ চিঠিটা কলকাতায় গিয়েই দোব।”

”এ কী, এখুনি যাচ্ছেন কী, একটু মিষ্টিমুখ না করলে হয়!” ব্যাংকাকা আপত্তি তুললেন। ”ইকড়ির সুবল সামন্তর মাখা সন্দেশ এই অঞ্চলের বিখ্যাত মিষ্টি। আনতে লোক পাঠিয়েছি।”

”বটে, বটে।” সত্যশেখর চেয়ারে বসে পড়ল। ”আগে তো কখনও শুনিনি অথচ আমি কিনা হুগলিরই সন্তান।” তাকে মর্মাহত দেখাল।

মিষ্টিমুখ সেরে, ফেরার জন্য গাড়িতে বসে পতিত ভটচায বলল, ”হ্যাঁ রে সরা, তুই ন্যাড়া হলি কেন?”

কলাবতী বলল, ”কলকাতার রোনাল্ডো হবে বলে।”

বিশুবাবু চিন্তিত স্বরে বলল, ”বদুটা যে গেল কোথায়!”

সত্যশেখর বলল, ”দু’ কিলো মাখা নিয়ে যাস রে কালু।”

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় শেতলের মা পড়িমরি দোতলায় ছুটে উঠে এল। ভয়ে তার চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে। ”ও দিদিমণিরা, কেমন যেন আওয়াজ হচ্ছে শিবমন্দিরে ওদিক থেকে। তোমরা যে বললে ভূতটুত সব মিচে কতা? কই আগুতে তো এখন আওয়াজ হতনি?”

সুশি বলল, ”হতনি তার কারণ তখন ভূতেদের খিদে পেতনি। কালু এবার চল দুটো দানাপানি খাইয়ে আসি ভূতটাকে।”

”কদ্দিন ওকে আটকে রাখবি?”

বংশীবদন ঘরে উঠলে ওকে ছাড়ব।”

.

বংশীবদন শিল্ড প্রথমবার জিতল বোলতা স্পোর্টিং ক্লাব। স্বনামেই খেলেছে স্বরাজ দাস। দর্শক সমাগমে কেউ কেউ দাবি করেছে এটা মহকুমার রেকর্ড। এম এল এ এবং রাজ্যের এক প্রতিমন্ত্রীর হাত দিয়ে পুরস্কার দেওয়া হয়। ভূদেব খেটো ঘোষণা করেন, গড়ের মাঠে কলেজ স্থাপন করা হবে। ম্যাচে সরা ডাবল হ্যাটট্রিক করতে পারেনি। কিন্তু বোলতার লোকেরা তাতে অখুশি নয়। তারা দেখল ম্যাচ শেষ হওয়ার সাত মিনিট আগে পর্যন্ত বি এস সি দু’ গোলে হারছিল, তারপর স্বরাজ দাস অলৌকিক খেলা খেলে তিনটি গোল দিল। এমন রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় তারা আগে কখনও পড়েনি বা এমন শিহরন তারা আগে কখন অনুভব করেনি। তারা পটকা ফাটাল, হাউই ওড়াল, আবির মাখল। বোলতা হাই স্কুলের হেডমাস্টার ঘোষণা করলেন, কাল স্কুলের ছুটি থাকবে।

ভি আই পি এনক্লোজারে বসা সুখি দাস গজগজ করে বলে, ”দুটো কেন, তিনটে ক্লাব থেকে সরা অ্যাডভান্স নেওয়ার মতো খেলেছে।”

সুশি কলাবতীর কানে—কানে বলল, ”সরাকে যেন ভূতে পেয়েছিল। সত্যিই দারুণ খেলল।”

ঘণ্টুকে ডেকে কলাবতী তার হাতে টোকেনটা দিয়ে বলল, ”এটা সরাকে দিয়ে এসো। ম্যান অব দ্য মাচের প্রাইজ।”

বাড়ি ফিরে কলাবতী আর সুশি পাতালঘরের গর্তের কাছে গেল। মইটা গর্ত দিয়ে নামিয়ে সুশি বলল, ”এবার উঠুন আর ভয় নেই। সারা বোলতা এখন নাচানাচি করছে, কেউ আর আপনার দিকে তাকাবে না।”

উঠে এল বদু ধুঁকতে—ধুঁকতে। ”আমি এখন সেফলি যেতে পারব তো?”

কলাবতী বলল, ”পারবেন, তবে ওই কালো জামাটা খুলে।”

আরও সাতদিন বোলতায় থেকে ওরা কলাকাতায় ফিরে আসে। আসার দিন সকালে ব্যাংকাকা একটা প্যাকেট কলাবতীর হাতে দিলেন। কলাবতী সেটা খুলে দেখল দুটো শাড়ি। এই দুটোই সুশি বেছেছিল বোলতা বস্ত্রালয়ে। শাড়িতে পিন দিয়ে কাগজ আঁটা। তাতে লেখা : ”বোলতার জনগণের কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা তোমরা গ্রহণ করো। আবার এসো। ইতি, ভূদেব খেটো।”

1 Comment
Collapse Comments

khub bhalo laglo.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *