ভূতের পাল্লায় – শক্তিপদ রাজগুরু

ভূতের পাল্লায় – শক্তিপদ রাজগুরু

বন-পাহাড়ে ঘোরা, আমাকে যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। তাই দিশাহীন হয়ে বের হয়ে পড়তাম। ভারতের বহু অরণ্যে। মায় দুর্গম সুন্দরবনের গভীরে নৌকাতেই কাঠুরিয়াদের সাথে বেশ কিছুদিন বাসও করেছি। এইসব যাত্রায় মাত্র সমীরই আমার সঙ্গী হয়েছে। অন্য বন্ধুরা বিপদসংকুল এই অরণ্যজীবনের সাথি হতে চায় না।

সেবার সারান্দা অরণ্যে যাচ্ছি। গভীর-গহিন অরণ্য। আর সাতশো পাহাড়ের দেশ সারান্দা। বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। পাহাড়গুলোয় রয়েছে দামি আয়রন, নিকেল, তামা। আর প্রবাদ আছে এখানে নাকি কোন পাহাড়ে সোনার সন্ধানও পেয়েছেন তখনকার ইংরেজরা। তার প্রমাণ হিসেবে এখানের নদীর বালিতেও নাকি অনেকে সোনার কণা পায়। আর আছে হাতির দল। বাইসনের পাল। হরিণ-সম্ভর তো আছেই। বনের প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার ভিতরে রয়েছে বনবিভাগের অফিস, ওখানেই রয়েছে দু-একটা বাংলো। সেই থলকাবাদ বনাঞ্চলেই আমাদের যাত্রা। বাইরের শহর থেকে সাতদিনের মতো চাল, ডাল, আটা, নুন, তেল মায় আলু-পেঁয়াজ, দেশলাই-মোমবাতি, যা যা লাগে সবই তুলে নিতে হয়েছে। কারণ ওই গভীর অরণ্যে হাটবাজার নেই। সব রসদ নিয়ে জিপে তুলে যাত্রা শুরু হল বন-পাহাড়ের পথে।

গভীর অরণ্য। বিশাল গাছগুলোর গুঁড়িতে শ্যাওলা জমেছে। সূর্যের আলোও ঢোকে না। পাতা পড়ে রাস্তাই ঢেকে গেছে। গাছপালার ডাল ভেঙে পড়ে আছে। সমীর বলে,—এ কোথায় এলাম রে!

আমি বলি—বন-পাহাড়ের দেশে এসে বন দেখবি না, তাই কী হয়? বেশ আতঙ্কময় পরিবেশ। বন চলেছে চড়াই-এর পথে। আর্তনাদ করে সেও যেন তাড়া খাওয়া জানোয়ারের মতো চলেছে। বেশ খানিক পাহাড় উতরাই পার হয়ে আমরা একটু ফাঁকা জায়গায় এসেছি। জায়গাটা বেশ সমতল, উপত্যকার মতো। চারদিকে গভীর বনে ঢাকা পাহাড়ের প্রহরা। এইটাই থলকাবাদ। ওদিকে বনবসতি। কিছু ছড়ানো-ছিটানো প্রাচীন শালগাছের নীচে আদিবাসীদের বসতি। একটা নদী ওই রহস্যাবৃত বন-পাহাড়ের বুক চিরে বের হয়ে এসেছে। নদীতে বালিই বেশি। সামান্য জলধারা বয়ে চলেছে। হাঁটুভোর স্বচ্ছ জলধারা, পাথরে ঘা খেয়ে চঞ্চল গতিতে ছুটছে মৃদু শব্দ তুলে। ড্রাইভার এদেশীয় লোক। এই বনে সে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে আসে। সেই-ই বলে, সাবজি, এই সোনা নদী। এর বালিতে সোনার কণা খোঁজে আদিবাসীরা। এই বনে কোথাও নাকি সোনার পাহাড়ও আছে। সাহেবরা এখানে সোনার কারখানা গড়ার জন্য এসেছিলেন। ওদিকে একটা বাংলো। দেখে মনে হয় ইংরেজ আমলেই তৈরি। সমীর বলে,—এযে সাহেবি বাংলো রে! এখন সাহেব নেই, চল দেখি কী ব্যবস্থা আছে!

ড্রাইভার বলে—এখানেই থাকবেন নাকি? বনবাংলোতো ওদিকে, ফরেস্ট কলোনিতে!

এখানের পরিবেশটা মনোরম। একটা ছোটো পাহাড়ের মাথায় সমতল ভূমিতে বাংলো। নীচ থেকে একটা মোরাম ঢালা পথ পাহাড়ের গায়ে পাক দিয়ে উপরে উঠেছে। সেই সোনা নদীটা পাহাড়ের গায়ে পাক খেয়ে খেয়ে বের হয়েছে। বাতাসে প্রবাহমান জলধারার গুঞ্জরন ওঠে। নদীর উপর একটা কাঠের ব্রিজও আছে। পাহাড়ের চারদিকে কলকে ফুলের বন। হলুদ ফুলে পথটা ঢেকে আছে। স্তব্ধতার মাঝে নদীর জলের শব্দ আর পাখিদের ডাক শোনা যায়। আমি বলি,

—চল না, যদি ওখানেই ঠাঁই পাই! সুন্দর পরিবেশ!

ড্রাইভার আর কথা বলে না। গাড়ি নিয়ে উপরের বাংলোর দিকে যেতে থাকে। ঘুরপাক খেয়ে পথটা পাহাড়ের উপর বাংলোর কাছে এসে থামল। এককালে বাংলোর সামনে সুন্দর বাগান ছিল। এখন সেই বাগানের চিহ্ন হিসেবে দু-চারটে ফুলের গাছ এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাকি জায়গাটা আগাছায় ভরে গেছে। তবু বাংলোটা ঠিকঠাকই রয়েছে। দেখে মনে হয় লোকজনের যাতায়াত বেশি হয় না। চারদিকে স্তব্ধতা। কেউ আশপাশে নেই। দরজায় তালা। হাঁক পাড়ি,

—চৌকিদার, চৌকিদার—

কোনো সাড়া নেই! গাড়ি থেকে নেমে ওই আগাছার মধ্যে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠি। বারান্দাটা সাফসুতরো। চৌকিদারকে হাঁক দিই। হঠাৎ ঝোপের দিক থেকে একটা লোক দাঁড়ায়। ওদিকে কী যেন করছিল সে। লোকটাকে দেখে চমকে উঠি। ওর মুখের একদিকটা যেন খাবলানো। একটা চোখ স্থির। বাঁ-হাতটাও কেমন চোট খাওয়া। অন্য চোখটা বেশ জ্বলজ্বল করছে। ওর চেহারাটাই কেমন বীভৎস, বিকৃত।

লোকটা ভাঙা গলায় বলে,

—হামি, চৌকিদার আছে!

আমরা অবাক হয়ে চৌকিদারকে দেখছি। চৌকিদারও বুঝেছে তার দিকে চেয়ে চমকে উঠেছি। লোকটা সেই ভীত-চকিত ভাব কাটাবার জন্যই বলে,

—ভালুক হামাকে পাকড়েছিল। সেই ভালুককে হামভি খতম করে দিয়েছিলাম। লেকিন উভি এইসা জখমি করে দিল—

বুঝলাম, বনে এমন আরও বিকৃত চেহারার মানুষ আছে যারা কোনো পশুর সাথে লড়াই করে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

আমি বলি,—দরজা খোলো। এখানে ক-দিন থাকা যাবে তো?

লোকটা ইতিউতি করছে। আমরা যে থাকতে চাইছি এখানে, সেটা যেন ওর মনঃপূত নয়। বলে—ইখানে থাকবেন?

এসব চৌকিদারকে কী করে হাতে আনতে হয় তা বনে ঘুরে জেনেছি। পকেট থেকে দশটাকার নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে বলি,—তালা খোলো। ক-দিন তুমিও আমাদের খানা পাকাবে, সাথমে খাবে।

লোকটা টাকাটা ফতুয়ার পকেটে পুরে এবার নীরবে দরজার তালা খোলে।

বেশ সুন্দর ঘর। মেঝেতে স্যাটিং পাতা। ওদিকে দুটো খাট, বিছানাও রয়েচে। লাগোয়া বাথরুমও বেশ ভালোই। তবে জল আনতে হয় নীচে ওই নদী থেকে। বাংলোয় খান চারেক ঘর।

একটা ঘরই খুলেছে সে আমাদের জন্য। ওদিকে ব্রিটিশ আমলের ফায়ার প্লেস, চিমনি। দুটো জানলা খুলে দিতে ওদিকের ঘন জঙ্গলের দৃশ্য ভেসে ওঠে। সমীর বলে,

—ঘরটা ভালোই!

এর মধ্যে ড্রাইভার আমাদের মালপত্র সব নামিয়ে দিয়ে ত্রিশ কিলোমিটার বন পার হয়ে শহরে ফিরে যায়। আমরা সভ্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক-দিন থাকব এই বনের গভীরে। সাতদিন পর ও ফিরে এসে আমাদের নিয়ে যাবে।

জিপটা চলে যেতে আমাদের মনে হয় আমরা যেন সত্যিই বনবাসে নির্বাসিত হয়ে গেছি। বন-কলোনিও অনেক দূরে।

এখানে আমরা মাত্র দুজন। অবশ্যই চৌকিদারও আছে। ওর নাম সুখরাম। সে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে বাঁকে দু-দিকে দুটো বালতি ঝুলিয়ে ঝোরা থেকে জল নিয়ে এসেছে। ওদিকেই একটা টিনের চালায় রান্নার জায়গা। সেখানে কাঠের উনুনে রান্নাও চাপিয়েছে। লোকটা কথা কম বলে। তবে কাজটা ঠিকঠাকই করে।

ক্লান্ত দেহ। তাই দুপুরে খাওয়ার পর বেশ ছোটোখাটো ঘুমও দিয়ে উঠেছি। তখন রোদের তেজও কমে গেছে। চারদিকে উঁচু পাহাড়। বিকাল হতেই সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। তাই বিকাল এখানে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। সন্ধ্যার ছায়া নামে বন-পাহাড়ে। বাংলোর বাগানের বাইরে ঠিক পাহাড়ের গায়ে একটা সুন্দর বসার জায়গাও আছে। কাঠের পাটাতন করা একটা ছোটো বারান্দা মতো। নীচ থেকে গাছগুলোর মাথা পায়ের কাছে এসে ঠেকেছে। সেখানে বসে আছি। বাতাসে ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব শোনা যায়।

সুখরাম কাজে বেশ নিপুণ। বিকালের চা-টা এখানেই এনে বলে—সাবজি, রাতের খাবার বানিয়ে রেখে যাব, খেয়ে নেবেন। আমাকে বসতিতে ফিরতে হবে সন্ধ্যার পরই।

অবাক হই।—রাতে বাংলোয় থাকবে না?

সুখরাম বলে—নেহি সাব, ঘর যানা হ্যায়! ফিন সুবাহ মে চলে আসব হামি।

সমীরও বলে—রাতে এখানে থাকবে না তুমি?

—না, সাব,—ঘর যানা হ্যায়।

লোকটা তার মতামত জানিয়ে চলে গেল! আমি বলি,

—লোকটা ওইভাবে চলে গেল!

সমীর বলে—তাহলে রাতে আমরা দুজনে এখানে থাকব।

আমি বলি—থাকব! আরে বাব্বা, এক ঘুমেই রাত কাবার হয়ে যাবে।

কী করে রাত কাটল টেরই পাবি না।

তখন সন্ধ্যা নামছে। তারাগুলো মেঘমুক্ত আকাশের এখানে-ওখানে জ্বলজ্বল করছে। স্তব্ধ বাতাসে নদীর কলকল শব্দ শোনা যায়। আর বাতাসে মহুয়ার সুবাস যেন মাতাল করে দেয়। সুখরাম তার রাতের খাবার পোঁটলা বেঁধে যাবার জন্য তৈরি। বলে সে,—আব চলে সাবজি থোড়া হঁশিয়ার, রহিয়েগা—আভি আন্দার যাইয়ে। বাহারমে হাতি-ভালু ভি আতা হ্যায় ইধার।

সাবধান বাণী শুনিয়ে সে হন হন করে চলে গেল। সারা বাংলোয় আমরা দুটি প্রাণী। চারদিকে অন্তহীন, স্তব্ধতা। পাহাড়ের নীচেই বনভূমি। বন কাঁপিয়ে শাঁখের আওয়াজের মতো শব্দ ভেসে আসে। বুনো হাতির পাল কালো পাথরের মতো চলমান কয়েকটা জীব নদীর জল খাচ্ছে। উপর থেকে অস্পষ্ট দেখা যায় তাদের। সমীর বলে,—বুনো হাতির পাল।

আমরাও এবার উঠে বাংলোয় আসি। বাইরে থাকা সত্যিই নিরাপদ নয়। কে জানে, ভাল্লুকও আসবে এবার মহুয়া ফুল খেতে। হ্যারিকেনের ম্লান আলো জ্বলছে। ঘরের ভিতর পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়া, আলোর আভাস। আমাদের চলমান ছায়াগুলোই যেন রহস্যময় হয়ে কী বিচিত্র শিহরণ তোলে মনে। দুজনে পাশাপাশি বসে যেন কী অজানা একটা ভয়ে কথা বলতেও ভুলে গেছি। মন থেকে সেই অহেতুক আতঙ্কের ভাবনা ঝেড়ে ফেলার জন্য বলি—চল, পেসেন্স খেলি। তাস বের কর। রাত তো সবে আটটা।

সমীর ব্যাগ থেকে তাস বের করে। কিন্তু খেলাতেও মন বসে না। স্তব্ধ বাংলোয় আমরা ছাড়াও যেন আরও কারও অস্তিত্ব টের পাই। দরজায় যেন শব্দ ওঠে—খটখট! ক্ষীণ চাঁদের আলোয় দেখা যায় জানলার বাইরের গাছগাছালি। কে যেন ডাকছে। সমীর দরজা খুলতে যাবে। আমিই বাধা দিই।

—দাঁড়া, কে এল আগে দেখি।

জানলা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতে দেখা যায় একটা বড়োসড়ো কালো লোমশভালুক বারান্দায় উঠে এসে পিছন দিয়ে দরজায় ধাক্কা মারছে। সমীরকে বলি,

—কাকে দরজা খুলে ঘরে আসতে দিচ্ছিলি দ্যাখ!

ভালুকটা তখন দরজা ঠেলেই চলেছে নির্বিকার ভাবে। ওকে তাড়াতে হবে। একটা খবরের কাগজ পাকিয়ে আগুন ধরিয়ে বাইরে জানলা দিয়ে তার দিকে ছুড়ে দিতে আগুন দেখে সে পালাল। সমীর বলে,—কী সর্বনাশ হত বলত?

তখন কিছুটা সাহস আমরা ফিরে পেয়েছি। রাতে খাবার পর দুজনে শুয়ে শুয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি। হ্যারিকেনটা তবু জ্বেলে রেখেছি টিম টিম করে। রাত কত হবে জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। সন্ধ্যার পর আকাশে কখন মেঘ জমেছিল দেখিনি। রাতে সেই মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকে ঘুম ভেঙে যায়। দুজনেই উঠে পড়েছি। দমকা হাওয়ায় জানলাটা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। খোলা জানলা দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত অরণ্য-পর্বত যেন মোহময়ী হয়ে উঠেছে। সেই দৃশ্য দেখার জন্যই জানলার সামনে এসেছি। ওদিকের বন্ধ ঘরে বেশ কয়েকটা জানলা ছিল। সেই ঘরটাই চেয়েছিলাম থাকার জন্য। সুখরাম ওই ঘরের চাবি খোলেনি। ওটা নাকি ভি আই পি রুম। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে তাণ্ডব দেখছি। হঠাৎ ওপাশে বন্ধ ঘরের দরজা সপাটে খুলে গেল। দেখি একজন লম্বা চওড়া লোক, পরনে দামি স্যুট, হাতে একটা ওয়াকিং স্টিক। মাথার হ্যাট নিয়ে বারান্দায় বের হয়ে এইদিকেই এগিয়ে আসছে। সমীর বলে—আর কেউ এসেছে নাকি?

ভদ্রলোক এদেশি নয়, বিদেশিই। তবে তার মুখচোখ দেখলে কেমন আতঙ্ক বোধ হয়। চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসছে। চলছে কেমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে। জানলার কাছে এসেই দাঁড়াল সে। দেখছে এদিকে। এই সময় দমকা হাওয়ায় জানলাটা বন্ধ হয়ে যায়। আমিও লাফ দিয়ে ঘরে আসি। খোলা জানলাটা এবার ছিটকে খুলে যায়। ওদিকে বন্ধ দরজাও হাওয়ার প্রচণ্ড লাথিতে খুলে গেছে। বিদ্যুতের ঝলকে দেখতে পাই চোখের তারা দুটো যেন জ্বলছে লাল অঙ্গারের মতো। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে হাতের লাঠিটা শক্ত করে তুলে। সমীর ভয়ে খাটের নীচে, আর সাহেবের উদ্যত লাঠি পড়েছে বিছানায়। সমীর থাকলে ওর ঘাড়েই লাঠির আঘাত পড়ত। এই আক্রমণে আমি হকচকিয়ে চিৎকার করি—কে আপনি? মারতে চান কেন?

লোকটা এবার সমীরকে বের করে নিজের পকেট থেকে রিভলবার বের করতে সমীর নিমেষের মধ্যে খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াল। সাহেবও তার পিছু নিয়েছে। ওরা বের হতে আমি ভাবছি, সমীরকে কেন মারতে এল লোকটা? বাইরে তখন চলেছে মেঘের গর্জন। সমীর কোথায় গেল জানি না।

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় জানলাটা খুলে গেল।

বিদ্যুতের আলোয় দেখি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সেই মূর্তি, হাতে পিস্তল। এবার তার চোখে বিজয়ীর হাসি। গলার স্বরটা কেমন গম্ভীর আর ফ্যাসফ্যাসেও। আমার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে বলে,—একটার ব্যবস্থা করেছি, এবার তোমার পালা!

সাহেব যে ভালো বাংলা জানে তা বোঝা গেল। আমি তখন ঘামছি। রাতদুপরে নির্জন বাংলোয় কোন খুনির পাল্লায় পড়লাম জানি না।

সাহেব গর্জে ওঠে পিস্তল তুলে,

—কাম অন-কাম! তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা করেছি। এখানে সব ব্যবস্থাই আছে।

ওর কণ্ঠস্বরে যেন একটা কী শক্তি আছে! লোকটা এবার আমাকে নিয়ে বন্ধ দরজার কাছে আসে। তখনও ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। বৃষ্টির ঝাপটায় বারান্দা ভিজে গেছে। আমি বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে চলেছি। সাহেব আমাকে ওদিকের ঘরে এনেছে। জানি না কী করবে। ঘরের টেবিলটা মেঝের মাঝখানে। দেখি, কড়িকাঠ থেকে একটা দড়ির ফাঁস ঝুলছে! ওটা ফাঁস নয়, যেন মৃত্যুফাঁদ। সাহেব বলে—এবার এই টেবিলে উঠে গলায় ফাঁসটা পরো। আমি টেবিলটা সরিয়ে নেব। ওমনি দু-তিনটে ঝটকা। ব্যাস-ক্লিয়ার। কাম অন ইউ ব্লাডি ফুল!

এভাবে মরতে রাজি নই! একপাশে ফাঁসির দড়ি, অন্যদিকে রিভলবারের বুলেট! মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখব ভাবিনি। সমীরকেও শেষ করেছে। এবার আমাকেও শেষ করবে। আমি কিছু বলার চেষ্টা করি। সাহেব হেসে ওঠে,

—নো মারসি! আমাকেও কেউ দয়া করেনি। আমিও করব না। ফিনিশ-কাম অন।

এবার সে শক্ত হাতে আমার গলাটা ধরে। ঠান্ডা বরফের মতো হাত। মাংস নেই, যেন হাড়ের সমষ্টি। ওর স্পর্শে সারাদেহ শিউরে ওঠে। আমাকে সে টেবিলে তুলেছে! চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে!

কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। কাদের কোলাহলে আর ঠান্ডা জলের ঝাপটায় চোখ মেলে দেখি, সামনে সমীর আর বেশ কয়েকজন লোক। সমীর বলে,—কেমন আছিস?

আমি অপলক চেয়ে আছি ওর দিকে। তখন ভোরের আলো ফুটেছে। ঝড়ও থেমে গেছে! আমি জিজ্ঞাসা করি,

—সেই খুনি সাহেবটা কোথায়?

এবার এগিয়ে আসে এখানের রেঞ্জ অফিসার। তিনিই বলেন,—বন-বাংলো থাকতে এই সাহেব ভূতের বাংলোয় এসেছিলে?

অবাক হই—সাহেব ভূত!

অফিসার বলেন—এখানে সোনার খনির প্রজেক্ট নিয়ে এক সাহেব এসেছিলেন। তিনিই এই বাংলো তৈরি করেন। তারপর প্রজেক্ট ফেল করায় দেউলিয়া হয়ে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করে। এখনও নাকি তার আত্মা ঝড়-বৃষ্টির রাতে সজীব হয়ে ওঠে। এইভাবে আগেও এই বাংলোয় মারা গেছে। সমীরবাবু গিয়ে খবর দিতে আমরাও এসে দেখি আপনি টেবিলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। কী সর্বনাশ যে হত কে জানে!

সকালের আলো ফুটেছে। মেঘমুক্ত আকাশ! বৃষ্টির জলে সব মালিন্য মুছে শাল-পিয়াল বনে সবুজের স্নিগ্ধতা। আমরা সেই ভূত বাংলো থেকে বেরিয়ে বন বাংলোয় এসে উঠলাম। গত রাতের দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে এই অরণ্য পর্বতের চিরসবুজ রূপকে উপভোগ করার সুযোগ হারাতে চাইনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *