ভূতের পা
আমরা তখন কুমিল্লায় থাকি।
বাবা পুলিশের ডিএসপি। আমাদের বাসা ঠাকুরপাড়ায়। এক রাতের কথা। গভীর উৎকণ্ঠায় সবাই জেগে বসে আছি। মা জায়নামাজে তসবি পড়ে যাচ্ছেন। আমরা দোতলার বারান্দায়। গাড়ির শব্দ কানে এলেই চমকে উঠছি। আমাদের এই শংকিত প্রতীক্ষার কারণ আমার বাবা। তিনি পুলিশ ফোর্স নিয়ে গেছেন হোমনায়। সেখানে এর আগের দিন একজন এএসআই এবং দুজন পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রামবাসী ধরে নিয়ে। গেছে। এরা আসামী গ্রেফতার করে ফিরছিল। গ্রামবাসী আসামীদের ছিনিয়ে নেয় এবং পুলিশদেরও ধরে নিয়ে যায়। আজকের অভিযান ওদের উদ্ধার করে আনা।
রাত তিনটায় বাবা ফিরলেন।
মা সঙ্গে সঙ্গে দুরাকাত নফল নামাজ পড়লেন। বাবার সঙ্গে আমাদের এক ধরনের দুরত্ব ছিল–আমরা সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। মার কাছ থেকে জানলাম, পুলিশদের উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ওদের রাইফেল পাওয়া যায়নি। একজন পুলিশের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে কুমিল্লা মিলিটারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে।
বাবা রাত সাড়ে তিনটায় রাতের খাবার খেতে বসলেন। খেতে পারলেন না। কিছুক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লেন এবং বিষণ্ণ গলায় বললেন, পুলিশের চাকরি করব না। বাবা তার দীর্ঘ চাকরিজীবনে অসংখ্যবার বলেছেন–পুলিশের চাকরি করব না। তারপরও তাকে এই চাকরি করতে হয়েছে। তার সংসারের দিকে তাকিয়ে করতে হয়েছে।
চাকরির কারণে তাঁকে যেমন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমাদেরও ভোগ করতে হয়েছে। সবচে বেশী ভোগ করতে হয়েছে আমার মাকে। স্বামীর দুশ্চিন্তায় এই মহিলার কেটেছে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী।
আমার মার ধর্মকর্মের বড় অংশই নিবেদিত ছিল আমার বাবার মঙ্গলকামনায়। বাবা বাসায় নেই–গভীর রাত্র–মা কোরানশরীফ নিয়ে একমনে পড়ে যাচ্ছেন–ফাবিআয়ে আলাএ রাব্বিকুমা তুকাজজিবান। এ ছিল আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্যের একটি।
পুরানো প্রসঙ্গ মনে পড়ল পত্রিকায় নিহত পুলিশ অফিসারের ঘটনা পড়ে। তার নবজাত শিশুপুত্রটির ছবিও দেখলাম। আহা, কী সুন্দর ছেলে! আমার দ্বিতীয় কন্যার জন্মসময়ে তোলা ছবিটিও অবিকল এই রকম। তফাৎ এইটুকু–জন্মের পরপরই আমি আমার কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছিলাম। ফরহাদ সাহেবের এই সৌভাগ্য হল না।
মৃত্যুতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোন মৃত্যুই এখন বোধহয় আমাদের তেমন। স্পর্শ করে না। কিন্তু এই মৃত্যু আমাদের স্পর্শ করেছে। কেন করল? পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী দল। এদের বিপজ্জনক জীবনযাপন করতেই হবে। চাকরির শর্তই তাই। তারপরেও এই মৃত্যু আমাদের এতটা ব্যথিত কেন করল? তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কথা ভেবে? তার অবোধ শিশুটির কথা ভেবে?
পত্রিকায় খবরটা পড়ে আমার প্রথমেই মনে হল, আহা, এই মানুষটি বোধ হয় এখনো ঈদের বাজার করেননি। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ঈদের বাজার করার দিনক্ষণ শুধু করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঠিক করে রেখেছেন, এবার ঈদে নতুন শিশু যে এখনো পৃথিবীতে আসেনি তার জন্যেও কাপড় কেনা হবে। ছেলে হচ্ছে কি মেয়ে হচ্ছে যেহেতু জানা যাচ্ছে না–সেহেতু দুসেটই কেনা হবে।
যাদের জন্যে এমন এক দুঃখ গাথা তৈরি হল তারা এখন কোথায়? কি করছে তারা? যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা তারা আর কতদিন খেলবে? যারা তাদের দিয়ে এই খেলা খেলছেন-তাঁরা কবে জানবেন–প্রতিটি মানুষকে হিসাব দিতে হয় তার নিজের কড়িতে —ইংরেজিতে আরো সুন্দর করে বলা হয়–Everybody is paid back by his own coin..
এ দেশে সন্ত্রাস কি বন্ধ হবে? যদি হয় তবে কতদিন লাগবে সন্ত্রাস বন্ধ করতে? এক বছর, দুবছর, পাঁচ বছর? একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছিলেন, খুব। বেশি সময় লাগলে এক মাস লাগবে। আমরা প্রতিটি সন্ত্রাসীকে চিনি। তারা কোথায় থাকে জানি। কাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ তাও জানি। কিন্তু এদের ধরা যাবে না।
ধরলেও দ্রুত ছেড়ে দিতে হবে। আমি সেই পুলিশ অফিসারকে বলেছিলাম, আপনারা এক কাজ করুন না কেন–আপনাদের কাছে সন্ত্রাসীদের যে তালিকা আছে, সেই তালিকা খবরের কাগজে ছেপে দিন–তারপর আমরা দেখব কারা তাদের আশ্রয় দেন।
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। সম্ভবত আমি হাস্যকর কিছু বলেছিলাম। পুলিশ ইচ্ছা করলে কি সন্ত্রাস দূর করতে পারে? তাদের কি সেই সদিচ্ছা আছে? আমার কিন্তু মনে হয় না। দীর্ঘদিন আমি শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর ছিলাম। সেই সময়ে প্রায় হল রেইড হত। পুলিশ হল ঘিরে ফেলত। তখন দেখেছি, হলের যেসব ছেলেদের আমি সন্ত্রাসী হিসাবে চিনি, যারা প্রকাশ্যেই বন্দুক হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা বন্ধুর মত পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ঘুরছে। অমুক ভাই, তমুক ভাই বলে ডাকছে। আমরা যারা হল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারাও কি সন্ত্রাস নির্মূলে সাহসী ভূমিকা কখনো। রাখতে পেরেছি? আমার মনে হয় না। একটা ঘটনা বলি–একবার শহীদুল্লাহ হলের এক ছাত্র আমাকে গোপনে একটা খবর দিল। কোন একটা ঘরে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে। আমি আমার প্রভোস্টকে তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা জানালাম এবং বললাম ব্যবস্থা নিতে। প্রভোস্ট স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন–হুমায়ূন, তুমি এত অল্পতে উত্তেজিত হও কেন? চুপ থাক তো।
বর্তমান সময়ের একটাই বোধহয় স্লোগান–চুপ করে থাকো। আমরা চুপ করে থাকব। আমরা কথা বলতে পারব না।
কিন্তু আর কতদিন?
একটা কিছু করার সময় কি আসেনি?
বলা হয়ে থাকে, যে একবার বন্দুক হাতে নেয়, সে হাত থেকে বন্দুক নামাতে পারে না। বন্দুক নামালেই তার জীবন সংশয়। এই ব্যাপারটিও না হয় ভেবে দেখা যাক। ভুল পথে যাওয়া যুবশক্তিকে কাজে লাগানোর পথ খোঁজা যাক। সমাজবিদরা ভেবে দেখুন, কি করলে এরা ঠিক হবে। শাস্তির ভয়ে এরা কাবু হবার নয়। জীবন-মৃত্যু খেলা যারা খেলে, তারা এত সহজে ভড়কায় না। এদের জন্যে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা সবাই মিলে ভাববেন, এটা আশা করা অন্যায় নিশ্চয়ই নয়।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি–সবার জন্যে স্বাস্থ্য, সবার জন্যে শিক্ষা–… খুব ভাল। কথা, কিন্তু সবচে জরুরী কথা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা। সেই নিশ্চয়তা সম্পর্কে কঠিন পদক্ষেপ কি আমরা কোনদিন নেব না?
পুলিশ অফিসার ফরহাদ সাহেবের মৃত্যুর পর সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জেনে আনন্দিত হলাম। শোক প্রস্তাব নিতে তো এখন ঘেন্না লাগার কথা! শোক প্রস্তাবের বাইরে আমরা কি করছি? আসলেও কিছু করার ইচ্ছা কি আমাদের আছে?
নিহত পুলিশ অফিসারের সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানটির মায়াকাড়া মুখ দেখে বেদনায়। অভিভূত হয়েছি। এই ছেলেটি বড় হয়ে যখন প্রশ্ন করবে–কারা মারল আমার বাবাকে? কেন মারল? তখন আমরা কি জবাব দেব?
দেশে এখন জনগণের নির্বাচিত সরকার। এই সরকারের কাছে আমাদের অনেক দাবি, অনেক প্রত্যাশা। কারণ আমরা এই সরকারকে নির্বাচিত করেছি। সরকারের কাছে আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাইছি। জানি, এই কাজ সহজ নয়। সরকারের হাতে আলাদীনের যাদুপ্রদীপ নেই–কিন্তু সৎ ইচ্ছা যাদুপ্রদীপের চেয়েও কার্যকর। সৎ ইচ্ছা নিয়ে এগুতে হবে।
আমরা বিভিন্ন জায়গায় ধূমপানমুক্ত এলাকা ঘোষণা করছি–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্ত্রমুক্ত এলাকা ঘোষণার ব্যাপারটা কি ভাবা যায় না? সমগ্র দেশের সবচে নিরাপদ এলাকা হওয়া উচিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আজকাল সন্ধ্যার পর সেই এলাকায় রিকশা যেতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসাবে এই দুঃখ, এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি?
আমার কাছে একটি প্রাণের মূল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটি শিক্ষাবর্ষের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি। একটি প্রাণ নষ্ট হবার আশংকা যদি থাকে, তাহলে বন্ধ থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়। ধরে নিতে হবে, আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি হইনি। একদিকে বোমা ফুটবে, গুলি হবে, ছাত্র মরবে, অন্যদিকে আমরা নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্লাস করতে থাকব, এ কেমন কথা? আমরা কোথায় চলেছি।
ভূতদের পা থাকে উল্টো দিকে। তারা চলে উল্টো পথে। আমরা ভূত না, আমরা মানুষ। আমরা ভূতের মত উল্টো পায়ে হাঁটতে পারি না। অথচ অনেকদিন ধরেই উল্টোপায়ে হাঁটছি। কেন? কেন? কেন?