ভূতের দৌলতে
‘স্যাফিরা’ জাহাজটার বরাত ভালো বলতে হবে, ওর ক্যাপ্টেন আর প্রথম মেট দুটো লোকই উল্লেখ করবার মতো।
ক্যাপ্টেন জন প্রেততত্ত্বে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, ভূতেদের আকৃতি, প্রকৃতি, ইতিহাস, ভূগোল— সবই তাঁর নখদর্পণে। যেকোনো জায়গায় যেকোনো লোককে দুই মিনিটের জন্য হাতের নাগালে পেলে ভুতুড়ে গবেষণার ফাঁদে আটকে তাকে দিনে-দুপুরে ভূত দেখিয়ে ছাড়বেন।
আর মেট বার্টন? লন্ডনের ডকে হাজার লোকের মধ্যে বার্টন গিয়ে দাঁড়াক, সেই হাজার লোকেরই হাজার জোড়া চক্ষুর দৃষ্টি একসঙ্গে বার্টনের উপর গিয়ে নিবদ্ধ হবে। কারণ আর কিছু নয়, তার চুল দাড়ি। অমন মিশমিশে কালো চুল দাড়ি— সাহেবের দেশে কেউ কখনো দেখেনি। কয়লা কালো, কালোজাম কালা, অমাবস্যার নিশি, দাঁত-মাজার মিশি এবং বঙ্গযুবা ‘গদাধরের পিসি’— এরা নিঃসংশয়ে কালো বটে, কিন্তু বার্টনের মাথার চুল এবং মুখের দাড়ি আরও অনেক-অনেক বেশি নিবিড় কালো। ডকের লোক ওর নামই দিয়েছে ‘কালো মেট’।
ডক-অঞ্চলে অনেকেই অনেককে চেনে, কিন্তু বার্টন একেবারে অচেনা মুখ। কোথায় ছিল ও এতদিন? নাবিকমহল নানা জল্পনাই করে এ নিয়ে। তারমধ্যে যেটাকে কতক লোক অন্তত সত্যি বলে মেনে নিয়েছে, তা হল এই যে, লোকটা গ্রহের ফেরে পড়ে মেটগিরি করতে এসেছে। আগে ও নিজেই ক্যাপ্টেন ছিল, দৈবাৎ কয়েক বছর আগে ভারত মহাসাগরে ওর জাহাজ ডুবে যায় এবং তার ফলে ওর লাইসেন্স বাতিল হয় এক বৎসরের জন্য।
তারপর ও আবার লাইসেন্স পেয়েছে বটে, কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসেবে আর নয়, মেট হিসেবে। এত দিন পশ্চিম উপকূলে ছিল, স্টিমারে স্টিমারে আইরিশ সমুদ্র পারাপার করত, এবার কী জানি কেমন করে স্যাফিরার মালিকদের নজরে পড়ে গিয়ে বাগিয়ে ফেলেছে ওই চাকরিটা।
লোকটা যে জাহাজ লাইনের চণ্ডীপাঠ থেকে জুতোসেলাই সবকিছু জানে এবং জানে বেশ ভালো করেই, তার পরিচয় স্যাফিরার মাল্লারা নিয়তই পাচ্ছে। এমন কাজ নেই যা ও করতে পারে না এমন কাজ নেই, দরকার হলেই যাতে ও হাত না-লাগায়। কুড়েমি বা দেমাক কোনোটাই নেই ওর ধাতে। মোটামুটি ওকে পছন্দই করে ওর অধীন লোকেরা।
অবশেষে স্যাফিরা ছাড়ল ডক থেকে। যাবে কলকাতা। সুয়েজ খাল তখনও কাটা হয়নি। যাবে আফ্রিকা বেড় দিয়ে, উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে।
ক্যাপ্টেন জন তাঁর মেটকে এতদিন বাজিয়ে দেখার সুযোগ পাননি। জাহাজ যতদিন ডকে ছিল, ক্যাপ্টেন ছিলেন ডাঙায়, তাঁর দিদির বাড়িতে। চল্লিশ বছর বয়সেও দিদি এখনও জনকে নাবালক জ্ঞান করেন। সকালে যদি জন বেরুলেন এবং ফিরলেন রাত্রে, তবে ফেরার পরই দিদিকে হিসাবে দিতে হবে— তিনি কত পাউন্ড কত শিলিং পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তার মধ্যে কী বাবদে কত খরচ করলেন, কোথায় কতক্ষণ কাটিয়েছেন, কার কার সঙ্গে দেখা হল, কে তাঁকে কী বলল— ইত্যাদি ইত্যাদি—
দিদিকে কিন্তু সে-বিষয়টি সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে কখনোই ভরসা পান না জন। যে-বিষয়টি নিয়ে শয়নে স্বপনে তিনি গবেষণায় মত্ত। ভূতপ্রেতের কথা উক্ত মহিলার কাছে উত্থাপন করতে গেলেই তিনি অ্যায়সা তাড়া লাগান যে, ক্যাপ্টেন জন পালিয়ে যেতে পথ পান না। কাজেই জাহাজ যখন ছাড়ল, সবদিক দিয়েই স্বাধীনতা লাভ করে তিনি মনের আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন।
প্রথম স্বাধীনতা, পয়সার এবং যাওয়া-আসার হিসাব আর দিদিকে দিতে হবে না। দ্বিতীয় স্বাধীনতা, নতুন মেটকে প্রেততত্ত্বে দীক্ষিত করে দিতে পারবেন। তৃতীয় স্বাধীনতা, অনবরত খিটিমিটি করে করে জাহাজের এক-শো একটা বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীর কাছে নিজেকে ভূতের মতোই ভয়াবহ করে তুলতে পারবেন। যারা নিজের ঘরে মুখ বুজে থাকতে বাধ্য হয়, তারাই বাইরে গিয়ে মুখ ছোটায় বেশি।
প্রথম দিনই জনের আচরণ অদ্ভুত ঠেকল বার্টনের কাছে। কথা কইছে না ক্যাপ্টেন, শুধু চারপাশে ঘুরঘুর করছে। একবার ডান দিক থেকে, একবার বাঁ-দিক থেকে, কখনো-বা পিছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে মেটকে। বার্টন টের পাচ্ছে বই কী, সবই টের পাচ্ছে। রেগে যাচ্ছে মনে মনে। জিবের ডগায় এসে পড়ছে এই জাতীয় কটুকাটব্য, ‘দেখছেন কী মশায় উঁকি দিয়ে? আমার লেজ নেই, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন।’ অতিকষ্টে সামলাতে হচ্ছে নিজেকে।
দ্বিতীয় দিনে বার্টনকে নিয়ে ক্যাপ্টেন সারা জাহাজ ঘুরে বেড়াল, প্রতি ইঞ্চি জায়গা। খুঁতখুঁত খুঁতখুঁত! ‘এখানটা ভারি অপরিষ্কার হয়ে আছে, আপনি কিছুই দেখেন না। সেখানটা তো ভারি পরিষ্কার দেখাচ্ছে! কত লোক কতক্ষণ ঝাড়ু মেরেছে ওখানে? কিছুই দেখেন না আপনি।’
জাহাজময় চক্কোর দিতে দিতে এইরকম খুঁতখুঁতুনি ক্রমাগত। তারপর চক্কোর যখন শেষ হল, তখন হঠাৎ বার্টনের দিকে ফিরে তাকিয়ে একেবারে গলার সুর বদলে ফেললেন ক্যাপ্টেন। যেন কতকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু, এইরকম ভাবখানা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পরলোক সম্বন্ধে কিছু ভেবেছেন আপনি কখনো?’
‘পরলোক?’ মেট বার্টন যেন আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়ল।
‘হ্যাঁ, পরলোকই তো আমরা বলি তাকে। মৃত্যুর পরে ও-জীবন শুরু হয় কিনা লোকের! তাই ওকে বলি পরলোক। তা, ভেবেছেন কিছু ও-সম্বন্ধে? না-ভেবে থাকলে, ভাবুন। সময় আছে এখনও। ভাবা ভালো। সকলকেই তো একদিন ও-জীবনে প্রবেশ করতে হবে! ও-সম্বন্ধে আগে থাকতে কিছু কিছু জ্ঞানসঞ্চয় যদি হয়ে থাকে তো ভালো হয় না?’
‘জ্ঞান কী করে সঞ্চয় করব?’— কিছু না-বললে চলে না বলেই একথা বলল বার্টন।
‘পড়াশুনো করে কিছু হতে পারে।’— বললেন ক্যাপ্টেন, ‘আমার যা হয়েছে, তা সেইভাবেই। এ ছাড়াও আরও একটা উপায় আছে। ভাগ্যবান ছাড়া সে-উপায় আর কেউ পায় না। সেটা হল মুখোমুখি কোনো প্রেতের মুখ থেকে শোনা। আমি এত চেষ্টা করেও পাইনি তার সুযোগ। অথচ অনেকে পেয়েছে। বরাত ভালো হলে আপনিও পেতে পারেন—’
‘ভূত দেখার সুযোগ?’— তেতো মেজাজ আর বাগ মানল না বার্টনের, ‘ভূত এত সস্তা না কি মশায়? পথেঘাটে পড়ে আছে?’
‘সস্তাও নয়, পড়েও নেই পথেঘাটে’— বলেন ক্যাপ্টেন মিষ্টি সুর বজায় রেখেই, ‘কিন্তু সংখ্যা তাদের প্রচুর প্রচুরের চাইতেও বেশি। যত লোক মরছে, সবাই হচ্ছে তো ভূত! দেখতে পাচ্ছি না আমরা, সে আমাদের দুর্ভাগ্য, কিন্তু হাওয়ার রাজ্য থিকথিক করছে ভূতে। মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমি যখন ভূত হব, তখন হয়তো দাঁড়াবার জায়গাও পাব না সেখানে—’
‘আপনি আর ভূত হবেন কী—’ বলেই জিভ কামড়ে ধরল বার্টন, বলতে যাচ্ছিল যে, আপনি আর ভূত হবেন কী, ভূত তো হয়েই আছেন। কিন্তু ঠিক সময়ে সামলে নিল।
ক্যাপ্টেন কিন্তু উলটো বুঝলেন। তিনি ভাবলেন, তাঁর ভূত হওয়ার মতো যোগ্যতা নেই বলেই ধারণা মেটের। তিনি কাজেকাজেই রেগে গেলেন। এরকম একটা সার্বজনীন বিষয়ে যোগ্যতার অভাব থাকা যে বড়োই লজ্জার কথা! তিনি রেগেমেগেই জবাব দিলেন, ‘তার মানে? আপনি কী বলতে চান? এই কি বলতে চান যে আমার আত্মা নেই? আত্মাই দেহমুক্ত হলে ভূত হয়। আমার নেই সে-আত্মা? ভূত হওয়ার জন্য যতটুকু আত্মা দরকার, ততটুকুও নেই?’
ক্যাপ্টেনের পা দুটো বাঁকানো, প্রায় ধনুকের মতোই। তাই হাঁটতে গেলেই একটু বেঢপ দেখায় তাঁকে। আজ তো রাগের মাথায় জোরে জোরে পা চালাতে গিয়ে তিনি একটা হাস্যকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে বসলেন। নাবিকেরা পিছন থেকে দেখল যেন একটা কানা গোরু গলিপথ দিয়ে ছুটছে, পাশের বেড়ায় ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে একবার এপাশে ঘুরছে, একবার ওপাশে।
এই দিনের সদালাপের পর ক্যাপ্টেন আর প্রেততত্ত্ব আলোচনা করতে আসেননি বার্টনের সঙ্গে। দূর থেকে আগুন-দৃষ্টি হেনেই তুষ্ট আছেন। সুযোগ পেলে ধমক-চমক অবশ্যই দিতেন, কিন্তু কাজেকর্মে বার্টনের দক্ষতা এত বেশি যে, সেদিক দিয়ে সত্যি সত্যি তার গলদ বার করা অসম্ভব। বকতে হলে একটা উপলক্ষ্য তো চাই!
দিনগুলো গড়িয়ে যায় আটলান্টিকের ঢেউয়ের মতোই মসৃণভাবে। উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে পড়ল স্যাফিরা।
এখানকার ঢেউ কিন্তু তত ভদ্র নয়। একদিন হুড়মুড় করে জাহাজের ডেক পর্যন্ত ধাওয়া করে এল, দুর্দান্ত জলদস্যুদলের মতো। বার্টনের তখন কাজের পালা নয়, সে দরজা বন্ধ করে কেবিনে বসে ছিল। দেয়ালে গজাল দিয়ে আটকানো খাটিয়া, খাটিয়ার নীচে গজাল দিয়ে আটকানো দুটো দেরাজ। সেই দেরাজ খুলে কী সব জিনিসপত্র গোছগাছ করছিল যেন।
বাইরে নাবিকদের চেঁচামেচি শুনে সে হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলেই ছুটে বেরিয়ে গেল ডেকে। দেরাজ যে খোলা পড়ে আছে, তা আর খেয়াল করল না সে। ঢেউ যখন নেমে গেল ডেক থেকে, তখনই ফুরসত হল বার্টনের, কেবিনের কথা ভাববার। অমনি আবার আগের চেয়েও দ্বিগুণ হন্তদন্ত হয়ে সে ফিরে এল।
আর এসেই ‘সর্বনাশ’ বলে সে আর্তনাদ করে উঠল। সে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ঢেউ এসে তার কেবিনেও হানা দিয়েছিল, দেরাজের সব জিনিস জলের টানে বেরিয়ে এসে ভেঙেচুরে ছড়িয়ে পড়ে আছে পাটাতন জুড়ে। ঝাড়ুদার এসে খুঁটে তুলল কয়েকটা ভাঙা বোতলের কাচ।
দুই-একজন নাবিক যারা কাছাকাছি ছিল, তারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এগুলো কি মদের বোতল? মেট কি লুকিয়ে মদ রেখেছিল কেবিনে? সে কি এত বেশি পানাসক্ত যে, জাহাজের বরাদ্দ সুরায় তার তৃপ্তি হয় না? কথাটা বিশ্বাস করবার মতো কথা নয়। এমন একটা ধীর গম্ভীর লোক কি তেমন নেশাখোর হতে পারে? এক দিনও এক সেকেন্ডের জন্যও তো মেটকে কেউ মাতাল দেখেনি!
জিনিসটা লোকে ভুলে গেল চট করেই। কারণ বার্টন একটা দুর্ঘটনায় পড়ে গেল ঠিক এই বোতল-ভাঙারই পিঠ-পিঠ।
দুই জন মেট জাহাজে, বার্টন আর ডিকিনসন— এরাই পালা করে জাহাজের খবরদারি করে। সেদিন শেষ রাত্রির দিকে বার্টনের ডিউটি।
ক্যাপ্টেন নিজের কেবিনে ঘুমিয়ে আছেন, হঠাৎ তার দরজায় ধাক্কা। কী?— ফার্স্ট মেট পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়েছে।
মাস্তুলের মাথা বরাবর একটা ছোট্ট পাটাতন আছে, তাকে বলে ‘পুপ’। সেইখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালে দিগন্ত পর্যন্ত সব পরিষ্কার চোখে পড়ে। সাধারণ পাহারা তো সেখানে থাকেই, তা ছাড়া মেটও মাঝে মাঝে সেখানে ওঠে, এমনকী ক্যাপ্টেন নিজেও।
ওঠা-নামার জন্য একটা কাঠের মই আছে। একেবারে জাহাজের খোল থেকে ওই পুপ পর্যন্ত। এই মই থেকে পড়েছে বার্টন। মাথাটা ফেটেছে, তবে অবশ্য সাংঘাতিকরকম কিছু নয়। জ্ঞান নেই, মুখে কোনো কাতরানি নেই, ঠিক মরার মতো পড়ে আছে।
মাথার চুল খানিকটা কেটে দিয়ে ডাক্তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। পরের দিন বার্টনের জ্ঞান হল বটে, চোখ মেলে সে তাকাচ্ছেও বটে, কিন্তু কথা ফুটছে না তার মুখ দিয়ে। ক্যাপ্টেন এসে বার বার দেখে যাচ্ছেন, বার বার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কী হয়েছিল বার্টন? দৈবাৎ পড়ে গেলে? না, মৃগী রোগ আছে তোমার? না কি, অতিরিক্ত মদ খেয়েছিলে? তোমার লুকোনো ভাঁড়ারের বোতলগুলো অবিশ্যি ঢেউ লেগে ভেঙে গিয়েছে সেদিন, তবু মোটের পক্ষে জাহাজের ভাঁড়ার থেকেও বরাদ্দের অতিরিক্ত মদ হাতানো অসম্ভব নয়।’
পুরো দুই দিন এসব প্রশ্নের কোনো জবাব এল না বার্টনের কাছ থেকে। তারপর তৃতীয় দিনেও ক্যাপ্টেন যখন তাঁর মামুলি বয়ান আউড়ে যাচ্ছেন—
বার্টন ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল, ‘দৈবাৎ নয়।’
‘তবে কি মৃগী?—’
‘না, তাও নয়।’
‘তবে কি অতিরিক্ত মদ—’
‘না, না, মদ কোথায় পাব?’
‘কী তবে? শুধু শুধু তো আর মানুষ মই থেকে পড়ে যায় না!’
বার্টন চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালে ক্যাপ্টেনের দিকে, সে-চোখের দৃষ্টিতে কী একটা অজানা বিভীষিকা যেন। ফিসফিস করে সে বলল, ‘আপনিই জিতেছেন ক্যাপ্টেন!’
‘মানে? মানে কী এ কথার?’ ক্যাপ্টেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন তার মুখের উপরে। বার্টন বলছে, ‘মানে মৃত্যুর ওপার থেকে একজন এসে দেখা দিয়েছিল আমাকে। ঠিক যখন মই বেয়ে নামছি তখন। ছায়ামূর্তিটা হাওয়ায় ভাসছিল। আমি ভয়ে হতজ্ঞান হয়ে এক পা পিছনে হটেছি কী অমনি পড়ে গেছি মই থেকে।’
ক্যাপ্টেন লাফাতে লাগলেন। তবে নাকি ভূতপ্রেত নেই? তবে নাকি ক্যাপ্টেন জন মাথাপাগলা? এখন কী হয়? হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে গেল তো? ঘোরতর অবিশ্বাসী বার্টনকেও তো ঠেকে স্বীকার করতে হল যে, ভূতপ্রেত কল্পনার জিনিস নয়, কঠোর সত্য?
সেই থেকে বার্টন হয়ে দাঁড়াল ক্যাপ্টেনের একান্ত প্রিয়। খুবই স্বাভাবিক। যে-লোক স্বচ্ছন্দে ভূত দেখেছে, তার চেয়ে ভাগ্যবান আর তো কাউকে দেখতে পান না ক্যাপ্টেন। আর তার কাছে ক্যাপ্টেনের কৃতজ্ঞতার ঋণও তো কোনোদিন শোধ হবার নয়! তিনি সারাদিনই প্রায় বার্টনের কেবিনে কাটাতে লাগলেন। ঠিক কীরকম অবস্থায় কীরকম চেহারার ভূত বার্টন দেখেছে, এক-শো বার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই একই প্রশ্ন।
তিন-চার দিন পরে বার্টন কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, ‘ক্যাপ্টেন! আমার মনে সদাই এত দারুণ ভয়, দেখুন সেই ভয়ের দরুন আমার চুল দাড়ি সব সাদা হয়ে যাচ্ছে।’
ক্যাপ্টেন চমকে গেলেন। অতি ভয়ে চুল রাতারাতি সাদা হয়ে যায়— একথা তাঁর আগে থেকেই শোনা আছে। বার্টনের যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে তারও যদি চুল দাড়ি মিশমিশে কালো থেকে ধবধবে সাদা হয়ে যায়, তাতে ক্যাপ্টেন অন্তত অবাক হবেন না।
জাহাজ তখন বঙ্গোপসাগরে। কলকাতা আর কয়েক দিনের মাত্র পথ। এইসময় বার্টন একদিন ডেকে এসে কাজ শুরু করল আবার। সে আবার বল পেয়েছে দেহে, চলছে-ফিরছে আগের মতোই চটপটভাবে, তফাত কেবল দেখা যাচ্ছে দুটো বিষয়ে। এক, তার মাথার চুল একদম সাদা এখন, দাড়িও সাদাই হত, যদি সে তা রোজ না-কামিয়ে ফেলত।
দ্বিতীয়, যে বিষয়টাতে বার্টন একদম বদলে গিয়েছে, সে হল ক্যাপ্টেনের প্রতি তার ব্যবহার। আগে সে ছিল প্রায় বিদ্রোহী, ক্যাপ্টেনটাকে সে যে মোটেই শ্রদ্ধা করে না, এ ভাবটা তার প্রতি কথায় প্রতি ভঙ্গিতে ফুটে বেরুত। আর এখন? এখন সে ভক্তিতে গদগদ। ক্যাপ্টেনের মতো অমন লোক আর হয় না— অমন পণ্ডিত, অমন তত্ত্ববিদ—
জাহাজ কলকাতায় রইল পনেরো দিন, তারপর ফিরল লন্ডনের দিকে।
লন্ডনের ডকে জাহাজ যেদিন ভিড়ল, বার্টনের বন্ধু কনরাড সেখানে হাজির। তিনি তো চমকে উঠলেন বার্টনের সাদা চুল দেখে। প্রথম সুযোগেই কানে কানে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আরে এ কী? ছয় বোতল কলপ দিয়ে দিলাম, এত শিগগির তো ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নয়—’
‘ফুরিয়ে যায়নি ভাই, ভেঙে গিয়েছিল ঢেউ লেগে।’
‘তারপর? চাকরিটা নেই তো? নিজের জাহাজ ডুবে যাওয়ার পরে তিন বছর তো বেকার রইলে শুধু এই কারণে যে, চুল তোমার পেকে গিয়েছে, তুমি বুড়ো হয়েছ। যদি-বা একটা ফিকির করলাম, তাও বরাতের দোষে—’
‘আরে, না ভাই, না, বরাতের দোষে নয়, গুণে—’ বার্টন হাসি-হাসি মুখে ফিসফিস করে বলে, ‘কলপের বোতল ভেঙেছিল, না ভালোই হয়েছিল। কতকাল আর ওই ঝামেলা পোয়ানো যেত, বলো! এ যা হয়েছে, বেঁচে থাকুক ভূতেরা। তাদের কল্যাণে চাকরি আমার পাকা হয়ে রইল। অন্তত যতদিন ক্যাপ্টেন জন ক্যাপ্টেন থাকবেন স্যাফিরার।’