2 of 2

ভূতের গল্প – পৌলোমী সেনগুপ্ত

ভূতের গল্প – পৌলোমী সেনগুপ্ত

লেখক জীবনের অষ্টম বছরে পৌঁছে আদিত্যর মনে হল, ৩৮/৫ শ্রীপতি পুতিতুণ্ডি লেনের দোতলার ঘরে বসে আর যাই হোক, গপপো লেখা যায় না। এই দুপুর থেকেই মাইক লাগিয়ে চরম উৎসাহে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন চলেছে। হ্যালো হ্যালো মাইক টেস্টিং করতে—করতে পাড়ার সকলের ভয়েস টেস্টিং হয়ে গেল। তারপর এই গরম! হাওয়া নেই একফোঁটা। এভাবে লেখা যায়? আদিত্য রায় গজগজ করতে—করতে ল্যাপটপটা অফ করল। আগে তাও রবীন্দ্রজয়ন্তী আর চরম গ্রীষ্মের সঙ্গে শান্তিও ছিল, এখন জোনাকি হালদারের পাল্লায় পড়ে শান্তিটুকু গেছে। সুকুমারবাবু সম্পাদক/থাকাকালীন এত চাপ নিতে হত না লেখকদের। উনি ফরমায়েশ করতেন, আদিত্যরাও ভেবেচিন্তে গল্প—উপন্যাস দাঁড় করিয়ে জমা দিয়ে আসত। ছাপাও হয়ে যেত। সেভাবেই তো আদিত্য রায় আজকের এই জনপ্রিয় লেখকে পরিণত হয়েছে। বইমেলায় গেলে লোকে অটোগ্রাফ নেয় বলে কথা, মফসসলের দিকে তো সভায় ভিড় হয় প্রচুর। কিন্তু তাতে কী? ‘শুভায়ন’ পত্রিকায় সুকুমারবাবুর পর সম্পাদক হয়ে এলেন জোনাকি হালদার। সম্পাদক নয়, সম্পাদিকা বলা উচিত। কিন্তু আজকাল মেয়েদের মেয়ে বললে মেয়েদের রাগ হয়… ঠিক যেমন কানাকে কানা বলিতে নাই। জোনাকি অবশ্য বয়সে আদিত্যদের সমসাময়িক। সম্পাদক হওয়ার পক্ষে বয়সটা কমই। সুকুমারবাবু ছিলেন পাকা বয়সের লোক, চুলে পাক ধরেছে পাণ্ডুলিপি ঘাঁটতে—ঘাঁটতে। কার মাথায় যে সুবুদ্ধি হল, ওঁর পর জোনাকিকে এনে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়ার! জোনাকি আগে বম্বেতে একটা ইংরেজি ফ্যাশন ম্যাগাজিনে ছিল…তা ফ্যাশনেই থাকলে পারত…বাংলা সাহিত্যের ঘাড়ে এসে চাপতে গেল কেন কে জানে! আদিত্যদের দুঃসময়ের শুরু এই জোনাকির আমল থেকে। নতুন—নতুন সব নিয়ম চালু হচ্ছে রোজই। মোটামুটি বিখ্যাত লেখকদের লেখাও এখন ‘শুভায়ন’—এ মনোনয়নসাপেক্ষ। মানে জমা দিলে পড়া হবে, তারপর পরীক্ষায় পাশ করলে সেই লেখা ছাপা হবে। দিলুম আর ছেপে বেরোল, সে—নিয়ম আর নেই। জোনাকি হালদার ভারি কড়া মহিলা! লেখা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতে ভোলে না, লেখা মনোনীত না হলে ছাপা হবে না। আদিত্যর কোনো লেখা এখনও ফেরত আসেনি ঠিকই, কিন্তু তার বন্ধু সৌম্য সিংহ, রাজদীপ শীল এবং দেবশ্রী তরফদারের লেখা অমনোনীত হয়ে ফেরত গিয়েছে। আদিত্য তাই আর চান্স নিতে চায় না। এই বত্রিশ বছর বয়সে অবিবাহিত, পি ডব্লু ডির আরামপ্রিয় চাকুরে, ঝাড়া হাত—পা লেখকের গল্প—টল্প যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে আর বছর পাঁচেক পরে তো লেখাই ছেড়ে দিতে হবে। তা ছাড়া ‘শুভায়ন’নে লেখা ছাপা না হলে জনপ্রিয়তার ভাটা পড়তে দেরি হবে না, তা বিলক্ষণ জানে সে। সপ্তাহখানেক আগেই জোনাকি ফোন করেছিল, একটা ভূতের গল্প চাই। বড়োদের ভূতের গল্প। অবশ্যই মনোনয়নসাপেক্ষে। এর আগে আদিত্য প্রেম, রহস্য, কল্পবিজ্ঞান ইত্যাদি নানা কাহিনি লিখেছে বটে, কিন্তু ভূত নিয়ে লেখা হয়ে ওঠেনি। তাতে কী? চ্যালেঞ্জ নিতে হবে না? ভূতের গল্পই জমিয়ে লিখতে হবে। কিন্তু আদিত্য ঠিক করেছে, একটি দেবে না। দেবে দুটি গল্প। সম্পাদককে চাপে ফেলবে। আদিত্য রায়ের দুটি গল্পই পছন্দ করতে হবে জোনাকিকে। মনোনয়ন? ডবল মনোনয়ন করতে হবে! জোনাকির বড়ো বড়ো চোখ আর ছোটো ছোটো চুল ঘেরা মুখটি মনে পড়তেই আরও রোখ চেপে যাচ্ছে। কিন্তু একটাই সমস্যা। উত্তর কলকাতায় এই বাড়িটা কেবলই অসহ্য মনে হচ্ছে আদিত্যর। জোনাকি হালদারকে কলমের জোর আর ক্রিয়েটিভিটি দেখাতে গেলে একটা এক্সপ্যান্স চাই….একটু নিশ্বাস ফেলার জায়গা…..

রাবংলার হোটেলের বিরাট খোলা জানালা দিয়ে সামনের পর্বতশ্রেণির দিকে তাকাল আদিত্য। দুপুরেই ভারী বৃষ্টি—বৃষ্টি বাতাস ছেড়েছে। হাফসোয়েটার পরে থাকা সত্ত্বেও গা শিরশির করে শীত করছে এখন। একটা আলোয়ান গায়ে চাপিয়ে তৃপ্ত দৃষ্টিতে ল্যাপটপে খোলা পাতাটার দিকে তাকাল সে। একটা গল্প এইমাত্র প্রায় শেষ করেছে।

আদিত্য ভেবে দেখেছে, তিন ধরনের ভূতের গল্প বাঙালি খায় ভালো। সাহেব ভূত, অন্তঃপুরচারিণী রহস্যময়ী নারীভূত (যারা লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেড়ায়) এবং পাড়াগেঁয়ে ভূত (যারা মাছচোর এবং উপকারী, এই দুই প্রজাতিতে বিভক্ত)। তার যা ইমেজ তাকে পাড়াগেঁয়ে ভূতের গল্প লেখা মানায় না। আর ওই ধরনের গল্পে বড়োদের এলিমেন্ট ঢোকালে ঠিক জমবে বলে মনে হয় না। তাই সাহেব ভূতই বেছে নিয়েছে আদিত্য, প্রথম গল্পটার জন্য। বিহারের ছোট্ট এক শহরে ঝড়ের রাতে কার্লটন সাহেবের পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় চার ছাত্র। দুটি ছেলে, দুটি মেয়ে। অর্থাৎ দুটি জোড়া। প্রেম—টেম আছে। বট্যানি ক্লাসের জন্য ট্যুরে বেড়িয়ে তারা ফিরতে পারেনি হোটেলে। বা ফিরতে চায়নি। রাত বাড়ে। চারটে টর্চ সম্বল করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাত কাটাতে বাধ্য হয় তারা। অবশ্য এভাবে রাত কাটাতে পেরে তারা যে ভারি অখুশি হয়েছিল, তাল নয়। এখানটাতেও একটু অ্যাডাল্ট টাচ এনেছেন আদিত্য। একটু প্রেম, একটু শরীরী সম্পর্ক। অল্পবয়সের ছেলেমেয়ে, নিজেদের মধ্যে মেতে ছিল তারা। কিন্তু মাঝরাতে শুরু হয় হাড়কাঁপানো সব কাণ্ডকারখানা। ছায়া, আলো, কালো বেড়াল, কুকুরের কান্না, হু—হু শব্দে বয়ে যাওয়া ঝোড়ো বাতাস। আর সবশেষে ক্লাইম্যাক্স। শেষ প্যারাগ্রাফটা আবার পড়ল আদিত্য :

দরজার চৌকাঠে ও কীসের ছায়া? বাইরের বারান্দার ঘন কালো অন্ধকার ভেদ করে আরও একটু ঘন অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার চৌকাঠে। একটা ওভারকোট আর টুপির ছায়া দেখা যাচ্ছে না? এক পুরুষের অবয়ব ফুটে উঠেছে অন্ধকারের ফ্রেম জুড়ে। তারই মাথায় টুপি, গায়ে ওভারকোট। খুব লম্বা দোহারা চেহারা সেই পুরুষের।

‘কে? কে?’ মল্লিকা দ্রুতহাতে সোয়েটারটা টেনে ঠিক করল, ‘ওখানে কে?’

সম্বুদ্ধ সোজা হয়ে উঠে বসেছে।

হঠাৎ চমকে উঠল বিদ্যুৎ। ভাঙা জানালার কাচ ঝলসে ওঠার সঙ্গে—সঙ্গে দু’জনে দেখতে পেল সেই অপার্থিব মুখ…নীল চোখে জিঘাংসার বহ্নিশিখা… সোনালি চুল বিদ্যুতের আলোয় আরও সোনালি! পরিষ্কার বোঝা যায়, সেই ছায়ামূর্তি এদেশীয় নয়। এক অদ্ভুত সুরেলা অথচ গুরুগম্ভীর গলায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে ভাঙা দেওয়ালের পলেস্তারা খসিয়ে দিয়ে…হু হ্যাজ এন্টারড মাই হাউজ উইদাউট পারমিশন?’

পাশ থেকে আঁ—আঁ শব্দ পেয়ে সম্বুদ্ধ বোঝে, মল্লিকা ভিরমি খেল। কিন্তু ছায়ামূর্তির দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না সে।

আর একটু ডিম্যান্ড করছে। আর একটু লিখতে হবে গল্পটা।

আদিত্য ঘাড়ের পেছনে হাতের তালু ঠেকিয়ে চাপ দিল। একটানা লিখে ঘাড়ে ব্যথা করছে। কিন্তু থামলে চলবে না। অন্য গল্পটাও অনেকটা লেখা হয়ে রয়েছে। আজকে বেশ জোশ এসে গিয়েছে। যতটা পারা যায় এগিয়ে রাখতে হবে। কালকের দিনটা শুধুই ফিনিশিং টাচের জন্য বরাদ্দ। তার পরের দিন কলকাতার দিকে রওনা হয়ে যাবে সে। পৌঁছেই গল্প দুটো ‘শুভায়ন’—এর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতে হবে। জোনাকির তাগাদা এর মধ্যেই এসে গিয়েছে। ওর ডানহাত চন্দ্রিমা মজুমদার কাল সন্ধেয় ফোন করে কড়া গলায় রিমাইন্ডার দিয়ে দিয়েছে। এই মেয়েগুলোও হয়েছে সাংঘাতিক। জোনাকি হালদারের নারীবাহিনী পেরিয়ে সোজাসুজি ওর সঙ্গে কথা বলতে পাওয়ায়ও দুষ্কর। গল্প লেখা সেরে যে একটু ছুটি কাটিয়ে ফিরবে, আদিত্যর কপালে তাও লেখা নেই।

টকটক। দরজায় টোকা। ‘আ জাও!’ হাঁক দিল আদিত্য।

দরজা ফাঁক করে ঢুকল নেপালি বেলবয়। মুখে হাসি। অবশ্য এদের মুখে সব সময়ই হাসি।

‘বাবু, কাল স্ট্রাইক বুলায়া। বনধ,’ নেপালি ছেলেটি এখনও হাসছে।

‘স্ট্রাইক? কে ডাকল? কোথায়?’

‘দার্জিলিংয়ে বাবু। গোর্খারা ডেকেছে।’

‘আ। ক—দিনের? এরা তো আবার লম্বা—লম্বা বনধ ডাকে…’ আদিত্য একটু টেনশনেই পড়ে যায়।

‘অভি তো দো দিন কা বুলায়া। আঠতালিস ঘণ্টে।’

‘তাও ভালো।’

‘লেকিন সিকিম কা রাস্তা ভি বনধ হো জায়েগা সর। ইসলিয়ে ম্যানেজার সাব মেরেকো ভেজা।’

আরও কিছু প্রশ্ন করে আদিত্য বুঝল ব্যাপারটা। দার্জিলিংয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টার বনধে সিকিমের রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা অন্য নানারকম ঝামেলা হতে পারে, এই ভয়ে বাকি টুরিস্টরা তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছে শিলিগুড়ির দিকে। ম্যানেজার জানতে চাইছেন, আদিত্যও কি নেমে যাবে, নাকি থাকবে? আদিত্য জানিয়ে দিল, সে থাকছে। এখনই নেমে কী হবে? কাজ শেষ হয়নি এখনও। আর আদিত্য একা মানুষ। বাড়িতেও কেউ অপেক্ষা করে নেই যে চিন্তাটিন্তা করবে। আসার সময় কাজের লোক সত্যকে ছুটি দিয়ে এসেছে। চিন্তা করার লোক বলতে কে? উত্তরটা টপ করে মাথায় এল তার নিজের মনেই হেসে ফেলল আদিত্য। জোনাকি হালদার, আবার কে? ঠিক সময়ে গল্প জমা না পড়লে নির্ঘাৎ ভদ্রমহিলা স্মরণ করবেন… ব্যাপারটা ভেবে ভালোই লাগল আদিত্যর…কেউ একজন তো ভাববে আদিত্য কোথায়, কী করছে! না হয় রাগ করেই ভাববে, কিন্তু আলটিমেটলি ভাববে তো। জোনাকি ভারী স্পষ্টবক্তা, একটু কাঠকাঠ ধরনের, দেখে মনে এখনই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে, এমন অনেক কথাই বাইরে লোকে বলে। লেখকদের আড্ডায় নিন্দে হয় প্রচুর। তবে আদিত্যর অতটা খারাপ মনে হয় না মেয়েটিকে। একটু কড়া হলেও মন্দ কী? পত্রিকাটার ভালোর জন্য চেষ্টা তো করছে। বরং যদি আদিত্য আটকে পড়ে এখানে, যদি সময়মতো কলকাতায় না ফিরতে পারে, তবে নিশ্চয়ই জোনাকি নিজে বা ওর হয়ে কেউ খোঁজ নেবে। আহা! হে ভগবান, যেন আটকেই পড়ি, এমন ব্যবস্থা করে দাও…দু—দিন শান্তিতে কাটাব, তারপর ফের সেই গরমের কলকাতা, আদিত্য ভাবে।

রাতের খাবার দিতে এসে নেপালি ছেলেটি জানাল, হোটেলে আর কোনো গেস্ট নেই। সব ঘর খালি করে নেমে গিয়েছে। বাবু যেন খেয়ে ঘরেই বাসনটা রেখে দেন। ওরা আজ সকাল—সকাল ঘুমিয়ে পড়বে কারণ কোনো কাজ নেই। চারতলা হোটেল। আদিত্য রয়েছে সবচেয়ে ওপরের তলায়। হোটেলের কর্মচারীরা বেসমেন্টে একটা ঘরে শোয়। ওয়েটাররা একটা ঘরে আর তার পাশের ঘরেই ম্যানেজার। বয়টি অবশ্য বলে গেল, খুব দরকার হলে বেল দিতে। খুব দরকার আর কী হবে?

খাবার গরম থাকতে—থাকতে খেয়ে নিয়ে আদিত্য দ্বিতীয় গল্পটা লিখতে বসল। বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। শুধু রাতের অন্ধকার নয়, সব জানালায় অন্ধকার। লোকে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। টুরিস্টবিহীন রাবংলা বড্ড নিঃশব্দ আজ। অকাতরে ঘুমোচ্ছে। আদিত্য জানালা বন্ধ করে ভারী পরদা টেনে দিয়েছেন আগেই। সামনেই রাস্তা, কিন্তু লোকজন নেই, দোকানপাট বন্ধ। হোটেলেও কোনো সাড়াশব্দ নেই আর। লেখায় মনোনিবেশ করার পক্ষে আদর্শ পরিস্থিতি। আদিত্য কম্বলটা ভালো করে গায়ে টেনে নিয়ে মাউজটা নাড়ল। রবীন্দ্রনাথের ছবিওয়ালা স্ক্রিনসেভারটা মিলিয়ে গিয়ে বাংলা অক্ষরগুলো ফুটে উঠল।

দ্বিতীয় গল্পটার নাম ‘মোমবাতি’। এবার অকুস্থল রাজস্থানের একটি হাভেলি। পুরোনো স্থাপত্য নিয়ে রিসার্চ করতে রাজস্থানে এসেছে কলকাতার ছেলে কুনাল মুখার্জি। রিসার্চ গাইডের ইনফ্লুয়েন্স, পরিচিতি আর চেনাশোনার সুবাদে রাজস্থানের একটি গ্রামের হাভেলিতে উঠেছে সে। হাভেলির মালিকের পরিবারে সকলেই শহরে থাকে। অজ পাড়াগাঁর এই বাড়িটা পড়ে থাকে কেয়ারটেকারের জিম্মায়। কেয়ারটেকার নিজে থাকে আউটহাউসে, বউ বাচ্চা নিয়ে। হাভেলির দোতলায় একটা ঘরে কুনালকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে শুরু করে আলো থাকা পর্যন্ত বাড়িটার থাম, দরজা, জানালা, জাফরি, ব্যালকনি এসবের ছবি আঁকে সে, সন্ধ্যা হলে খাতাপত্র গুটিয়ে হাঁটতে বেরোয়। অধিকাংশ দিনই লোডশেডিং থাকে গ্রামে। ঘরে একটি লণ্ঠন জ্বেলে রেখে যায় কেয়ারটেকার। রাত হলে এক পেগ হুইস্কি নিয়ে কুনাল একা। সিচুয়েশনটার মধ্যে ঢোকার জন্য মিনিটখানেক চোখ বুজে মেডিটেট করে নেয় আদিত্য। তারপর লিখতে আরম্ভ করে :

আলো—আঁধারের ছায়ার মধ্যে দিয়ে বারান্দার দিকে তাকাল কুনাল। ডানদিকে একটা নাম—না—জানা লতানে ফুলের ঝাড়। লাল—লাল—থোকা—থোকা ফুল ফুটে আছে, তাতে অদ্ভুত মাদক একটা গন্ধ। সেই ঝুপসি গাছটার পাশে অন্ধকারের রং যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে। অথচ সেই জমাট বাঁধা ছায়ার গায়ে লেগে আছে চাপা আলো। চোখ জোরে চেপে বন্ধ করল কুনাল, তারপর ধীরে ধীরে খুলল। আশ্চর্য। সেই আলোর ছায়া এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। লণ্ঠনটা দপ দপ করে উঠল হঠাৎ, যেন নিবে যাবে। কুনাল সলতে বাড়ানোর ছোট্ট চাকাটায় আঙুল ছোঁয়ানোর সঙ্গে—সঙ্গে ছায়াটা আস্তে—আস্তে কাছে এগিয়ে এল। ঠিক তখনই কুনালের চোখে পড়ল নারীমূর্তির আপাতদৃশ্যমান অবয়ব, পিঠ ভরে থাকা চুলের ঢাল, সাদা ঘাগরার চিকমিকে জরির পাড়। মাতৃভাষায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কুনালের, ‘কে? কে আপনি?’

নারীমূর্তি তার গলার স্বরে থমকে দাঁড়াল যেন, বাঁদিকে ঘাড় বেঁকিয়ে অদৃশ্য চোখের নজর নামিয়ে আনল কুনালের দিকে। গলা শুকিয়ে এসেছে, তবু সে জিজ্ঞেস করল, ‘কৌন হ্যাঁয় আপ?’

কেউ দেয়নি উত্তর, কিন্তু তার মনে হয় বারান্দায় ঝাঁকড়া গাছটা নড়ে উঠেছে যেন। বাতাসে উত্তর আসছে, ‘ম্যাঁয় হুঁ, হেমবতী…’

আদিত্য আড়মোড়া ভাঙল এই পর্যন্ত লিখে। ব্যাপারটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে এখন। শুধু একটু সময় দরকার। খেলিয়ে লিখতে হবে। আর কালকের গোটা দিনটা যখন নির্জনতার সঙ্গী হয়েই আছে, তখন আজ আর কষ্ট করা কেন? শুয়ে পড়া যাক। সে কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়ল, খাটের পাশে রাখা টেবল ল্যাম্পটা অফ করে দিল। পরদার ফাঁক দিয়ে আসা রাস্তার আলো দেওয়ালের গায়ে এসে পড়েছে। নাকটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে এল আদিত্যর। সে কান পর্যন্ত কম্বলটা টেনে নিয়ে চোখ বুজল।

ঘুম ভাঙতে বুঝল, ঠান্ডাটা আরও জাঁকিয়ে পড়েছে। চোখের এককোণ ফাঁক করে জানলাটার দিকে তাকাল…না, এখনও ভোরের আলো ফোটেনি। নড়েচড়ে উঠে বসতে গিয়ে আদিত্য দেখল, পরদার ফাঁক দিয়ে আসা রাস্তার আলোটা দেওয়ালে আর নেই। যাহ, পাওয়ার কাট বোধহয়। এখানে অবশ্য গভীর রাতে কারেন্ট চলে গেলে কোনো সমস্যা নেই। ফ্যান চালানোর দরকার নেই যখন! শুধু হাতড়ে হাতড়ে নতুন জায়গায় বাথরুমে যাওয়াটাই ভোগায়। শ্বাস ফেলে বালিশের পাশে রাখা চাদরটার দিকে হাত বাড়াল। একটু শক্ত, একটু খড়খড়ে….তার চাদরটা তো এমন নয়। এটা কী? বিরক্ত হয়ে কম্বলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে উঠে বসল আদিত্য। এবং বসার পরই তার পিঠ বেয়ে যে ঠান্ডা স্রোতটা বয়ে গেল, তার কারণ শুধুমাত্র ঘরের তাপমাত্রা নয়।

ঘরের একমাত্র বেতের চেয়ারটির ওপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। আদিত্য ভুরু কুঁচকে তাকাল চেয়ারের ওপর বিছিয়ে থাকা অবয়বটির দিকে। কী ওটা? বেড়াল? নাহ! দিনতিনেক ধরে ভূতের গল্প লিখে মাথাটাই খারাপ হল নাকি? জ্বলজ্বলে চোখদুটো আর দেখা যাচ্ছে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পাশের টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে হিম—কনকনে জলই ঢকঢক করে খেয়ে নিল সে। তারপরই সেই জল গলায় শুকিয়ে গেল। চেয়ারে আবার সেই দুটো চোখ। সে এবার ভালো করে দেখল। বেড়াল না, কুকুর। লোমওয়ালা, ছাই রঙের একটা বড়ো কুকুর। চেয়ারে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দরজাটা কি খোলা থেকে গিয়েছিল? ছিটকিনি দিতে ভুলে গিয়েছিল সে? দরজা খোলা পেয়ে কুকুরটা ঢুকেছে? বিছানা থেকে দরজাটা সোজা দেখা যায় না, একটা ছোটো প্যাসেজ দিয়ে দরজার দিকে যেতে হয়। তাই নিশ্চিত হতে পারল না আদিত্য। সে মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করে কুকুরটাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কুকরটা নড়ছে না। তার আওয়াজ—টাওয়াজ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে থাবার ওপর মুখ রেখে সোজা তাকিয়ে রইল। মহা জ্বালাতন! উঠলে যদি কামড়ে—টামড়ে দেয়? আদিত্য চারদিকে তাকাল। তার চাদরটা বালিশের পাশে গোল্লা পাকিয়ে রাখা আছে, যেমন ছিল। হাতে তখন শক্তমতো যেটা ঠেকল, সেটা তাহলে কী? যাই হোক, আগে তো কুকুরটাকে তাড়াতে হবে। সে আস্তে—আস্তে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপরেই চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপটার দিকে। উফ! আবার ল্যাপটপ বন্ধ করতে ভুলে গেছে সে। ঢাকনিটা নামানো আছে বটে, কিন্তু স্তিমিত আলো ফুটে বেরচ্ছে সেটার থেকে। এ এক রোগ হয়েছে আদিত্যর।

আগে সে হাতেই লিখত। সম্প্রতি ল্যাপটপ কিনে বাংলা টাইপ অভ্যাস করার পর থেকেই এখন আর হাত চলে না। কিন্তু এটা প্রায়ই হয়। ঠিকমতো যন্ত্রটা বন্ধ করতে ভুলে যায় সে। কলমের এসব ঝামেলা ছিল না। কিন্তু প্রথমে ল্যাপটপ না, প্রথমে এই উড়ে এসে জুড়ে বসা কুকুরটাকে দূর করতে হবে। আলোটাও এসময়ই গেছে! উফ! আদিত্য হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে অর্ধেক ভরা জলের বোতলটা তুলে নিল। জল ছিটালে বেড়াল পালিয়ে যায়, কুকুর কি পালাবে? দেখা যাক! সে বোতলের ঢাকনিটা খুলে এক ঝটকায় অনেকটা জল কুকুরটার দিকে জল ছুড়ে দিল। কুকুরটার মাথায় জল আছড়ে পড়তেই একটা চাপা গজরানোর শব্দ করে সেটা চেয়ার থেকে নেমে এল। এই প্রথমবার আদিত্য বুঝতে পারল কুকুরটার সাইজটা ঠিক কত বড়ো। দাঁড়ালে আদিত্যর কোমরের কাছে পড়বে। ঘাড় বেঁকিয়ে, লোম ফুলিয়ে কুকুরটা আদিত্যর দিকে তাকাল। গলা থেকে চাপা শব্দ বের করে কুকুরটা এগিয়ে আসছে। আদিত্য ঘষটে—ঘষটে খাটের কোনার দিকে সরতে শুরু করেছে। হাতে কিছুটা জল ভরা বোতল। জানোয়ারটা আক্রমণ করলে ওটাই তার শেষ অস্ত্র। দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তার প্রত্যেকটা নড়াচড়া ফলো করছে। সরতে—সরতে থামল সে, কারণ পিছনে হিমঠান্ডা দেওয়াল। পিঠটা জমে গেল যেন। শিউরে উঠতে—উঠতেও আদিত্য টের পেল, বিশাল চেহারার জন্তুটা নীচু হচ্ছে। লাফ দেওয়ার ঠিক আগে যেমন হয়, সেভাবে পিঠ বেঁকিয়ে স্টান্স নিল কুকুরটা। আর মুহূর্তের মধ্যে বিরাট লোমশ শরীরটা জ্যামুক্ত তিরের মতো খাটের ওপর ছিটকে উঠল। ঝকঝকে দাঁতগুলো অন্ধকারে ঝিলিক দিল। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে মাথাটা নীচু করল আদিত্য, চোখ বুজে দু—হাতে মাথা ঢাকল। ঠিক তখনই কানে পৌঁছল গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘লুসিফার!’

এক মুহূর্ত সব স্থির যেন। তারপর সন্তর্পণে চোখ খুলল সে। আর দেখল সেই আশ্চর্য দৃশ্য। কুকুরটার বিশাল শরীরটা তার মাথার ওপর হাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় স্থির। হৃৎপিণ্ড আটকে আছে তার গলায়। এক… দুই… তিন… সে দেখল, ধীরে ধীরে ভাসতে—ভাসতেই পেছতে লাগল জন্তুটা। তারপর খুব আস্তে চেয়ারের ওপর নেমে গেল। দম ছেড়ে সোজা হয়ে বসল আদিত্য। কুকুরটাও যেন তার দিক থেকে সব আগ্রহ হারিয়েছে। চেয়ারে বসা অবস্থাতেই সেটা পেছন ফিরে কী যেন দেখতে লাগল। চেয়ারের পেছনে দরজার দিকে যাওয়ার প্যাসেজের মুখে চোখ আটকে গেল আদিত্যর।

প্যাসেজের সরু মুখটায় ও কীসের ছায়া? ঘন কালো অন্ধকার ভেদ করে আরও একটু ঘন অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা ওভারকোট আর টুপির ছায়া দেখা যাচ্ছে না? এক পুরুষের অবয়ব ফুটে উঠেছে অন্ধকারের ফ্রেম জুড়ে। তার মাথায় টুপি, গায়ে ভারী পোশাক। খুব লম্বা দোহারা চেহারা সেই পুরুষের।

‘কে? কে’ আদিত্য দ্রুতহাতে চাদরটা টেনে নিল গায়ে, ‘ওখানে কে?’

হঠাৎ চমকে উঠল বিদ্যুৎ। ভাঙা জানালার কাচ ঝলসে ওঠার সঙ্গে—সঙ্গে দু—জনে দেখতে পেল সেই অপার্থিব মুখ…নীল চোখে উজ্জ্বলতা….সোনালি চুল বিদ্যুতের আলোয় আরও সোনালি! পরিষ্কার বোঝা যায়, সেই ছায়ামূর্তি এদেশীয় নয়। এক অদ্ভুত সুরেলা অথচ গুরুগম্ভীর গলায় সেই মূর্তি এবার কথা বলে ওঠে, ‘লুসিফারের গায়ে জল পড়লে ও খুব চটে যায়।’

আদিত্যর মনে হয় সে জ্ঞান হারাবে।

ছায়ামূর্তি আবার বলে, ‘তা ছাড়া, এখানে যা ঠান্ডা! তার উপর বাইরে বৃষ্টিও নেমেছে। ওর গায়ে জল দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার।’

কুকুরটা এবার জিভ বের করে ছায়ামূর্তির হাত চেটে দেয়। ছায়ার হাত যদি চাটা যায়, তবেই অবশ্য…

আদিত্যর গলা দিয়ে ঘঙঘঙে গলা বেরোয়, ‘সরি।’

‘আরে, সরি বলার কী আছে? আপনি তো জানতেন না। কিন্তু আমি না খেয়াল করলে একটা সমস্যা হয়ে যেতে পারত।’

”আপনি কে? কীভাবে এলেন আমার ঘরে?”

লোকটার সদাশয় ব্যক্তিত্বে একটু ভরসা পেয়ে আদিত্য প্রশ্ন করল।

লোকটা যেন অবাকই হল একটু, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না আপনি? আমি কার্লটন, স্যাম কার্লটন।’

সে আবার শিউরে ওঠে।

‘কার্লটন? মানে ওই…’

‘এগজ্যাক্টলি। ওই কার্লটন। আমারই পোড়ো বাংলো থেকে আপনি মনে—মনে ঘুরে এসেছেন। রিমেমবার? বিহারের জঙ্গলে?’

‘আপনি তো বাংলা বলছেন।’

‘বলছি। কারণ আমাদের দুনিয়ায় ভাষা কোনো বাধা নয়। একবার জীবন পেলে আর কোনও বাধা কাজ করে না আমাদের মধ্যে।’

‘আপনাদের দুনিয়া?’

‘আমাদের, মানে, কল্পনার জীবদের দুনিয়া। আমাদের মতো যাদের জন্ম হয় আপনাদের কল্পনার মধ্যে দিয়ে, তাদের কাছে ভাষা কোনো সমস্যা নয়।’

‘আমাদের কল্পনা…আমার লেখা গল্পে…চরিত্ররা জন্মায়?’

‘না, সবাই না। শুধু ভূতেরা। জীবন্ত মানুষের চরিত্রগুলোর এ সৌভাগ্য হয় না। এটা শুধু মৃতদের জন্য। কল্পনার মৃতদের জন্য নতুন জীবন…’

আদিত্য হাঁ করে থাকে।

লোকটা আবার বলে, ‘আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমি। আমাকে জীবন দেওয়ার জন্য।’

‘আপনাকে? আমি…জীবন…কিন্তু আমার তো পুরোটাই কল্পনা…’

‘আরে হ্যাঁ। আপনাদের কল্পনাতেই তো আমরা জীবন পাই। বেঁচে উঠি। অবশ্য যদি ভূত হয়েও বেঁচে ওঠা যায়! হাঃ হাঃ। ভূতের আবার বাঁচা, কী বলেন?’

আদিত্য স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। লোকটা বলতেই থাকে, ‘আসলে অনেক ক্ষেত্রে আমরা জীবন পেয়েও মিলিয়ে যেতে হয়। অস্তিত্বের যথেষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি বেঁচে রইলাম, কেন জানেন?’

‘কেন?’

‘প্রেম, মিঃ রাইটার। প্রেমের জন্য আমি বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারলাম না।’

‘প্রেম? আমি তো প্রেম নিয়ে কিছু লিখিনি, মানে…’

ভদ্রলোক (নাকি ভূতই বলা উচিত, ভদ্রভূত?) এবার হালকা হেসে ডাকলেন, ‘হেমবতী!’

পাশের টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা যেন জীবন পেল। সেটার ঢাকনির তলা থেকে বেগুনি ধোঁওয়া বেরিয়ে ঘর ছেয়ে ফেলেছে। আদিত্য পিটপিট করে দেখল, সেই ধোঁওয়া থেকে আস্তে—আস্তে রূপ নিচ্ছে একটি মেয়ের মূর্তি। ছায়ার মতো তরল এবং আবছা সেই কান্না আস্তে—আস্তে কাছে এগিয়ে এল। ঠিক তখনই আদিত্যর চোখে পড়ল নারীমূর্তির আপাতদৃশ্যমান অবয়ব, পিঠ ভরে থাকা চুলের ঢাল, সাদা ঘাগরার চিকমিকে জরির পাড়। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল আদিত্যর, ‘কে?’

নারীমূর্তি তাঁর গলার স্বরে থমকে দাঁড়াল যেন, বাঁদিকে ঘাড় বেঁকিয়ে অদৃশ্য চোখের নজর নামিয়ে আনল তার দিকে। গলা শুকিয়ে এসেছে, তবু সে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কী?’

বাতাসে মাখামাখি হয়ে উত্তর এল, ‘ম্যাঁয় হুঁ। আমি, হেমবতী।’

কার্লটন মৃদু হাসলেন কিনা ঠিক দেখা গেল না, কিন্তু গলার স্বরে একটু হাসি ছলকে উঠল যেন, ‘হেমবতীর সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। ও—ও তো আমার মতো আপনারই কল্পনায় জন্মেছে। আপনি ওকে চেনেন। রাজস্থানের হাভেলি হন্ট করতে করতে ও জীবন পেয়েছে। আর ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আপনার ল্যাপটপেই, আমার পাশের গল্পে। ঠিক যেমন লুসিফারকে পেলাম, পাশের আর—একটা গল্পে।’

কুকুরটার মাথায় হাত গুলিয়ে দিলেন কার্লটন সাহেব। ভীষণ বিস্ময়ের মধ্যেও মনে পড়ে গেল আদিত্যর, মাসছয়েক আগে একটা বাচ্চাদের পত্রিকার জন্য একটা দুষ্টু কুকুরের গল্প লিখেছিল। গল্পের শেষে কুকরটা মারা যায় আর তার নামটা সে নিজেই খুব কায়দা করে দিয়েছিল, ‘লুসিফার।’ বিস্ময়ে কথা নতুন করে বন্ধ হয়ে গেল তার। সে বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে রইল কুকুরটার দিকে।

স্যাম কার্লটন বলে চললেন, ‘হেমবতীর সঙ্গে, বুঝলেন মিঃ রাইটার, দেখামাত্র একটা কেমিস্ট্রি কাজ করতে লাগল। আমার চোখে মুখে আপনি যেসব জিঘাংসা আর কাঠিন্য ভরে দিয়েছিলেন, হেমবতীর সৌন্দর্য আর রহস্যে সেসব কেথায় উবে গেল! আমরা প্রেমে পড়লাম। হেমবতীর মতো সুন্দরীর প্রেমে না পড়াটাই তো অদ্ভুত, তাই না?’

হেমবতী নাম মহিলা অল্প হেসে বেগুনি ওড়নাটা গায়ে টেনে দিলেন। শীত করে উঠলে মেয়েরা যেমন করে। কার্লটন সহসাই নড়ে উঠল। খাটটার দিকে ভেসে এসে বলল, ‘দেখি, হাতটা সরান তো। ওর ঠান্ডা লাগছে।’

মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাতটা সরাল আদিত্য। কার্লটন হাত বাড়িয়ে তুলে নিল একটি ওভারকোট। আদিত্যর হাতে সেটার খড়খড়ে কাপড়টা ঘষে গেল। এটাতেই তার হাত লেগেছিল একটু আগে, চাদর খুঁজতে গিয়ে। ওভারকোটটা হেমবতীর কাঁধে তুলে দিল কার্লটন। বলল, ‘এবার ভাল লাগবে, দেখো। লেখক যে কেন এই পাহাড়ের কনকনে শীতে আমাদের জীবন দিলেন।’

হেমবতী হাসে, ‘উনি হয়তো ভাবেননি আমাদেরও গরম লাগে, শীত করে। তাই না, লেখক?’

আদিত্য মাথা নাড়ল। আশ্চর্য! ভাষা সমস্যা নয়, কিন্তু শীত করে?

হয়তো ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই হেমবতী বলল, ‘সত্যি—সত্যি হয়তো করত না, কিন্তু আমাদেরও কখনো কখনো মানুষের মতো হতে ইচ্ছে হয়।’

কার্লটন বলল, ‘মানে, এই উইন্টার ইজ সো রোমান্টিক, তাই না মিঃ রাইটার?’

হেমবতী আবার বলল, ‘কিন্তু এই শীতের মৌসমে আমাদের একটা ভালো জিনিস উনি দিয়েছেন। পাস আনে কা মওকা। হঠাৎ পাওয়া এই জিন্দগিতে আমরা খুব কাছাকাছি থাকতে পারব…’

কয়েক মিনিট কেটে গেল, নাকি কয়েক ঘণ্টা, খেয়াল নেই আদিত্যর। সে শুধু দেখল, হেমবতী এগিয়ে গিয়েছে কার্লটনের দিকে। দুটি ছায়াময় শরীর পরস্পরের আলিঙ্গনে হারিয়ে যাচ্ছে। কপালের শিরা দপদপ করতে থাকে তার। খুব ভারী হয়ে আসে দু—চোখ। সে শোনে এক নারীর স্বর, ‘আমাদের মিলিয়ে দেওয়ার জন্য শুক্রিয়া, লেখক!’

এবং এক পুরুষের স্বরও, ‘অ্যান্ড লাভ উইল কাম টু ইউ টু। যাও, গিয়ে তাকে মনের কথা বলো।’

এক সুগন্ধি কুয়াশায় ডুবে যেতে—যেতে চুম্বনের শব্দে বিভোর হয় আদিত্য…স্বপ্নের ঘোরে ভাবে, ফিরেই জোনাকিকে বলতে হবে। রাবংলার অদ্ভুত এই ঘটনা এবং আরও অনেক কিছু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *