ভূতের গন্ধ
প্রথমেই বলে রাখি, আমি কুকুর। আমার জীবন হল ঘেউঘেউ জীবন। মানে যতই কথা বলি না কেন সবই আমার মালিকের কাছে ঘেউঘেউ। কিছুতেই আমার কথা লোকটা বুঝতে চায়, শুনতেও চায় না। অথচ আমি মালিকের সব কথা শুনি বসতে বললে বসি, হাঁটতে বললে হাঁটি, লাফাতে বললে লাফাই। এমনকী ভোরবেলা মালিকের দোতলার বারান্দায় যখন ধপ করে খবরের কাগজ এসে পড়ে, তখন ছুট্টে গিয়ে সেটা মুখে করে নিয়ে এসে মালিককে দিই।
মালিক আমাকে আদর করে, যত্ন করে, রোজ ভালো-ভালো খেতেও দেয়। এসব না করে উপায় কী! মালিকের যে আর কেউ নেই! শুনেছি মালকিন একজন ছিল। সে কী একটা অসুখে বছর পাছ-ছয় আগে মারা গেছে। তখনও আমি এ-বাড়িতে আসিনি।
আমার মালিক একটু মেয়ে-ঘেঁষা। সাধু বাংলায় বলতে গেলে নারীজাতিকে শ্রদ্ধা করে। তবে শ্রদ্ধার পরিমাণটা বড্ড বেশি। ওর সঙ্গে রাস্তায় বেরোলেই এই শ্রদ্ধার প্রবলেমটা আমাকে ফেস করতে হয়।
কেন ফেস করতে হয় সেটা বলি।
ভোরবেলা গঙ্গার ধারে হাঁটতে কার না ভালো লাগে! আবার সন্ধেবেলাও সেই একই রুটিন। সেই বেড়ানোর সময় কোনও সুন্দরী লেডিজ দেখতে পেলেই হল! মালিক আমাকে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাবে এবং আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে সেই মেয়েটিকে বলবে, দেখেছেন, আপনাকে দেখে পম কেমন লেজ নাড়ছে। আসলে এ হল একেবারে খাঁটি জাতের পমিরেনিয়ান। তাই ওর নাম রেখেছি পম। দেখুন, লোমগুলো কী সুন্দর–সফট আর ফ্লাফি। ওর সেন্স এত…।
এই চলল মালিকের কুকুর রচনা। কী যে বোরিং!
আমি চেঁচিয়ে বললাম, তুমি এত মেয়ে হ্যাংলা কেন? হ্যাংলামি ছেড়ে কাউকে একটা বিয়ে করে ফেললেই পারো!
আঃ, এত চেঁচানোর কী আছে, পম! আমাকে ধমক দিয়ে কোল থেকে নামিয়ে দিল মালিক। তারপর মেয়েটিকে বলল, আপনাকে ঘেউঘেউ করে হ্যালো বলছে। ওর যা বুদ্ধি না!
আমি আবার বললাম, একটু মানুষের মতো হও না! একটা বউ নিয়ে সুখে থাকো। আমাদের ডগ সোসাইটিতে বিয়ে করার সিস্টেম নেই–এর ওর কাছে গিয়ে ছোঁকছোঁক করার সিস্টেম। তোমার যদি সেটাই পছন্দ তো তাই করো। তার সঙ্গে আমাদের অন্য স্বভাবগুলোও রপ্ত করে নাও। আবর্জনা দেখলেই নাক ঠেকাও, অপোজিট সেক্স দেখলেই জিভ বের করে লালসার হাঁপানি শুরু করো, আর ল্যাম্পপোস্ট দেখলেই দৌড়ে গিয়ে এক ঠ্যাং তুলে কাত হয়ে ছোট বাইরে সেরে নাও।
কিন্তু আমার কথা শুনলে তো! মুগ্ধ ভেড়ার চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মালিক তখন বলছে, আপনাকে পমের দারুণ পছন্দ হয়েছে। আপনি কি রোজ এই সময়ে বেড়াতে আসেন?
তো এই চলতে থাকে। শেষে মেয়েটা যখন আচ্ছা, আসি বলে পট করে চলে যায় তখন মালিকের বুক ঠেলে বড় একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে।
দেখলি পম, চলে গেল!
আমি কোনও জবাব দিলাম না। কারণ, ততক্ষণে গঙ্গার পাড়ের রেলিং-এর পাশে বাদামি রঙের একজন অপোজিট সেক্সকে আমি দেখতে পেয়েছি। লেজটা রিং-এর মতো বাঁকানো। কী সুন্দর নাক, মুখ, চোখ! আর বডিটা দারুণ সেক্সি।
আমি জিভ বের করে সেদিকে এগোতেই মালিক খেপে গিয়ে হাঁক পাড়ল, কী হচ্ছে, পম! কুত্তা কি আর সাধে বলে! ব্যাটা ভাদুরে কুকুর! মেয়েছেলে দেখলেই হল! আয়, এদিকে আয়…।
চমৎকার। নিজের বেলায় দোষ নেই। যত দোষ আমার বেলায়। অথচ এটাই আমাদের জাতীয় ধর্ম! এটাই আমাদের লাইফ স্টাইল।
তো একদিন সন্ধেবেলা আমরা দুজনে গঙ্গার ধারটায় বেড়াচ্ছি। মালিকের এক হাতে একটা রঙিন ম্যাগাজিন–একটু আগেই একটা বুকস্টল থেকে কিনেছে। আর অন্য হাতে আমার গলায় বাঁধার শেকলটা। আমার গলায় বেল্ট আছে বটে, কিন্তু শেকল ছাড়া পেয়ে আমি এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করতে করতে মালিকের সঙ্গে-সঙ্গে এগোচ্ছি। বাঁশি বাজিয়ে চক্ররেলের লাইনে একটা ট্রেন চলে গেল। রেল লাইনের ওপাশ থেকে কী সুন্দর জঞ্জালের গন্ধ পাচ্ছি। আমি আনচান করতে লাগলাম। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা গরম লুচির গন্ধে মালিককে এরকম আনচান করতে দেখেছি।
রেল লাইনের দিকটা যেমন নোংরা তেমন অন্ধকার। আর শীতকাল বলে পথে লোকজনও বেশি নেই। গঙ্গার দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছে। গঙ্গার গভীর জল টলটল করছে। তাতে ভাঙা ভাঙা চাঁদের ছায়া। দূরের জল এমনিতেই ভালো করে দেখা যায় না। তার ওপরে এখন আবার দুধের সরের মতো কুয়াশা।
মালিক উদাস হয়ে রেলিং-এ ভর দিয়ে গঙ্গার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। আর মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। হঠাৎই বলল, জীবনটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল রে, পম।
আমি তখন এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিলাম–কোনও লেডিজ কুকুর খুঁজছিলাম। নাঃ, একটাও চোখে পড়ছে না। তাই হতাশ হয়ে বললাম, হ্যাঁ, মালিক, জীবনটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল।
মালিক পম, কাম, কাম– বলে আমাকে কাছে ডাকল। তারপর নীচু হয়ে আমার মাথা চাপড়ে দিল : তোর ডাক শুনেই বুঝতে পারছি তুই আমার মনের কথাটা ধরতে পেরেছিস। তোর…।
হঠাৎই মালিক যেন চমকে উঠল। চট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তাকাল নির্জন পথের দিকে।
আমি চোখ বুজে আদর খাচ্ছিলাম। মালিকের আদর বন্ধ হতেই চোখ খুলে তাকিয়েছি। তারপর মালিকের নজর ফলো করে দেখি…ও, এই ব্যাপার!
পারফিউমের গন্ধটা আগেই পেয়েছিলাম, এবার চুড়ির রিনরিন শুনতে পেলাম।
হালকা রঙের শাড়ি পরে ছিপছিপে ফরসা বিউটিফুল একজন লেডিজ পথ ধরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আশ্চর্য, এই শীতেও ওর গায়ে সোয়েটার বা শাল-টাল কিছু নেই।
ব্যস! মালিক আমাকে চাপা গলায় বলল, পম, কাছে-কাছে থাকিস। যার মানে হল, আবার সেই কুকুর রচনা।
একটু আগেই যে-লোকটা উদাস কবি কবি ভাব নিয়ে মনমরা ছিল, সে এখন একপায়ে খাড়া তেজি ঘোড়া।
মেয়েটি আমাদের কাছে এগিয়ে আসতেই আমি অন্যরকম একটা গন্ধ পেলাম।
আরে, এ কে? এ কী? এ তো মানুষ নয়! ওইজন্যেই গায়ে শীতের পোশাক নেই!
নিমতলা ঘাটটা কোনদিকে একটু বলতে পারবেন?
কী সুন্দর দেখতে! কী মিষ্টি গলার স্বর! ল্যাম্পপোস্টের ঘষা আলোয় মেয়েটিকে সুপারন্যাচারাল মনে হচ্ছে।
আমি গন্ধ পেয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই চিৎকার করে বললাম, মালিক, চলে এসো। ওর বডির ভেতরে অসংখ্য সাপ, কেন্নো আর কাঁকড়াবিছে কিলবিল করছে। ওর বুকের ভেতরটা বরফ দিয়ে ঠাসা। গঙ্গার জলের তলা থেকে এই ভয়ংকর প্রেতিনী উঠে এসেছে। ও তোমার মতো একজন টগবগে শিকার খুঁজছে–যার রক্ত দিয়ে তেষ্টা মেটাবে। চলে এসো, মালিক–চলে এসো।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! মালিক গদগদ হয়ে মেয়েটিকে বলল, নিমতলা ঘাট? ওই তো সামনে…পাঁচমিনিট হাঁটলেই…। দেখেছেন, পম আপনাকে হ্যালো বলছে। ও আপনাকে পছন্দ করে ফেলেছে।
হুঁ! নিজে পছন্দ করে আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছে!
না, না! প্রায় আঁতকে উঠে সরে গেল মেয়েটি? ওকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখুন। কুকুর আমি খুব ভয় পাই।
এই তো, চেন লাগিয়ে দিচ্ছি– চাকরের মতো মেয়েটির কথা শুনল মালিক।
আমি মেয়েটির চোখে তাকালাম। ওর চোখের তারায় নীল আলো ধকধক করে জ্বলছে। ও বুঝতে পেরেছে, আমি ওকে চিনে ফেলেছি।
মালিক মেয়েটিকে বলল, এই ঠান্ডার মধ্যে এই নির্জন রাস্তায় আপনি একা-একা…মানে…।
হাসল মেয়েটি। হাসির সঙ্গে-সঙ্গে ওর ফঁপা শরীর থেকে ঠান্ডা জমাট বাতাসের হলকা বেরিয়ে এল। বলল, আমি তো একাই–দোকা আর কোথায় পাব!
জানেন, আমিও ভীষণ একা। মালিক কাতর গলায় বলল, কী সাংঘাতিক একা আপনি ভাবতে পারবেন না।
মালিক, ওর কথাটা ভালো করে বোঝো। ওরা সবসময় একা-একা ঘোরে মরণফঁদ পাতে–তোমাদের মতো বোকা হাঁদা ল্যাবাকান্তদের জন্যে। মালিক, প্লিজ, বাড়ি চলো।
কিন্তু মালিক আমার কথা শুনবে কি! হাঁ করে মেয়েটাকে গিলছে।
বাব্বা! আপনার কুকুরটা কী ঘেউঘেউ করছে! আপনি ওকে আড়াল করে রাখুন।
ব্যস, অমনি আমাদের মাঝে পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে-বলতে নিমতলা ঘাটের দিকে এগোল।
মালিকের দুপাশে আমরা দুজন। তবুও চলার সময় এগিয়ে-পিছিয়ে আমি মেয়েটাকে দেখছিলাম। ঠিকই বলেছে মেয়েটা। নিমতলা ঘাটই ওর আসল ঠিকানা। ওর শিরায়-শিরায় রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই–আছে ঠান্ডা শুকনো বাতাস। আর হাড়ের বদলে রয়েছে গঙ্গার পলিমাটি, শ্যাওলা আর মরা গাছের ডালপালা।
আমার নাকে পচা শ্যাওলার গন্ধ আসছিল। তার সঙ্গে পারফিউমের গন্ধ। হঠাৎই বুঝলাম, পারফিউমের গন্ধটা অগুরু সেন্টের। ওঃ, মালিক যে কেন বুঝতে পারছে না মেয়েটা আর বেঁচে নেই!
জানেন, এই কুকুরটা আমার একমাত্র সঙ্গী। ফাঁকা বাড়িতে আমি একা-একা থাকি। বুকটা একেবারে খাঁ-খাঁ করে।
তাই? ঘাড় বেঁকিয়ে সুন্দর করে তাকাল মেয়েটা। কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে মিষ্টি করে হাসল।
নিমতলা ঘাটে আপনার কী দরকার?
মাঝে-মাঝে ওখানে যাই–মন ভালো করার জন্যে। অন্ধকারে, নির্জন জায়গায় একা-একা থাকতে আমার বেশ লাগে।
মাঝে-মাঝে ওখানে যান..অথচ আমাকে জিগ্যেস করলেন…। মালিকের কপালে ভাঁজ পড়ল। চোখে ফুটল সন্দেহের ছায়া।
খিলখিল করে হাসল মেয়েটি। হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কী!
না, না, ভয় পাবেন না। আমার অ্যামনেজিয়া গোছের অসুখ আছে। হঠাৎ-হঠাৎ সব ভুলে যাই….আবার হঠাৎ-হঠাৎ সব মনে পড়ে যায়।
আমি চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করলাম, মিথ্যে কথা! এটা ওর ছল, মালিক। এখনও সময় আছে– ফিরে চলো।
মালিক আমাকে ধমক দিল ও চুপ কর! চুপ কর বলছি! স্টপ বার্কিং, পম।
জানেন, রাস্তা হঠাৎ ভুলে গেলে পর কাউকে জিগ্যেস করতেও ভয় লাগে। আজকালকার লোকগুলো যা গায়ে পড়া। হাসল রূপসি। তারপর গলা নামিয়ে বলল, অবশ্য আপনি সেরকম নন।
এ-কথায় মালিক তো আটখানা।
হঠাৎই একঝলক ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা ছুটে এল। মালিক শিউরে উঠল। হাতে-হাত ঘষে ম্যাগাজিনটা বুকের কাছে আঁকড়ে বলল, কী শীত! উঃজ্যাকেটটা পরে এলে হত। তারপর, এতক্ষণ পর, যেন এইমাত্র খেয়াল করেছে এমনভাবে বলল, আপনার শীত করছে না?
মেয়েটা হাসল। উড়ে যাওয়া শাড়ির আঁচল টেনে ধরে বলল, শীতে আমার কিছু হয় না। আমি শীত ভালোবাসি। আপনি?
আমিও–আমিও শীত ভালোবাসি। শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমার বোকা-হাঁদা মালিকটা বলল।
দূরে কয়েকটা দোকানের আলো দেখা যাচ্ছিল। রাস্তার ধারে কতকগুলো বড়-বড় লরি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। বাঁ-দিকে পুরোনো আমলের বিশাল মাপের সব গোডাউন। তার গা-ঘেঁষে কয়েকটা ঝুপড়ি–সেখানে কেরোসিনের আলো জ্বলছে।
আপনি কি রাতে বেড়াতে বেরোন? মালিক ওকে জিগ্যেস করল, আসলে জায়গাটা তো ভালো নয়–একেবারে কঁকা-ফাঁকা…।
একা-একা থাকার এটাই সমস্যা। তা ছাড়া বিকেল-বিকেল বেরোলে রাস্তায় লোকজন বড় বিরক্ত করে।
চলুন, তা হলে আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি…।
মালিকের হ্যাংলা-উৎসাহ কুকুরকেও হার মানাল।
কিন্তু দেখলাম, যা ভেবেছি তাই। মালিকের প্রস্তাবে মেয়েটা একেবারে আঁতকে উঠল, না, না, বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। কে কী বলবে তার ঠিক আছে!
ওর বাড়ি হল জলের তলায়, মালিক। ও বহু বছর ধরে সেখানে থেকে-থেকে পচে গলে শেষ হয়ে গেছে। ওর গা থেকে তুমি পচা গন্ধ পাচ্ছ না? অবশ্য কী করে পাবে! তোমার তো আর আমাদের মতো ঘ্রাণশক্তি নেই!
মেয়েটা আবার বলল, এই ঠান্ডায় আপনার সঙ্গে বসে এক কাপ চা কিংবা কফি খেলে বেশ হত। আপনি আমাকে হেল্প করলেন। মানে…অথচ…এদিকে সেরকম দোকান বা রেস্টুরেন্ট নেই…।
আমার বাড়িতে গেলে আমি কিন্তু আপনাকে কফি খাওয়াতে পারি। হেসে বলল মালিক, তা ছাড়া আমি ভালোই রান্না করতে পারি। যদি বলেন…।
তাকিয়ে দেখি মালিকের প্রস্তাবে মেয়েটার চোখ চকচক করে উঠল। ও জিভ বুলিয়ে নিল ঠোঁটের ওপর। বলল, সত্যি, এটা তো ভেবে দেখিনি! চলুন, এই ঠান্ডায় কফি দারুণ জমবে! কত দূরে আপনার বাড়ি?
এই তো কাছেই। ননী ঘোষ লেন। শোভাবাজার ঘাট থেকে ডানদিকে হেঁটে সাত কি আট মিনিট।
চলুন, আপনার সঙ্গে হাঁটতে আমার ভালোই লাগবে।
সর্বনাশ করেছে! কী হবে এবার?
নিমতলা ঘাটে আপনি যাবেন না? মালিক জিগ্যেস করল।
নাঃ, আজ আর যাব না। সেখানে যাওয়ার চেয়ে আপনার কম্প্যানি অনেক বেটার, অনেক অ্যাট্রাকটিভ।
ব্যস! আমরা উলটো দিকে ঘুরলাম। হাঁটতে শুরু করলাম শোভাবাজার ঘাটের দিকে।
আমি তো চিন্তায়-চিন্তায় পাগল হয়ে গেলাম। কী করি এখন? কী করে এই পিশাচীর হাত থেকে বাঁচাই আমার হ্যাংলা মালিককে?
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, থামো, মালিক থামো! এই রক্তপিশাচকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেয়ো না–তোমার সর্বনাশ হবে।
আপনার কুকুরটা খেপে গেছে। বড্ড ঘেউঘেউ করছে।
আমার চেন ধরে টান মারল মালিক। বলল, পম, স্টপ বার্কিং। তারপর মেয়েটার দিকে। ফিরে বলল, আপনার কোনও চিন্তা নেই। বাড়িতে ঢুকে পমকে সিঁড়ির নীচের ঘরে বন্ধ করে রাখব। তারপর শুধু আপনি, আমি, আর কফি। কথা বলতে বলতে মালিক চোখ দিয়ে মেয়েটাকে চেটে নিল।
নাঃ, আর চুপ করে থাকা যায় না। আমি এক হ্যাঁচকা টানে মালিকের হাত থেকে চেন ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর বিদ্যুঝলকের মতো মালিককে পাশ কাটিয়ে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মেয়েটার ওপরে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! হাওয়া, শুধু হাওয়া!
শাড়িটায় নাক ঠেকতেই বিশ্রী কটু গন্ধ পেলাম। বাতাসে দুলে উঠল শাড়িটা। আর কী ঠান্ডা, কী ঠান্ডা! যেন এভারেস্টের চুড়োয় নাক ঘষছি।
আমাদের অবাক করে শাড়িটায় আমার বডি জড়িয়ে গেল। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। আর মেয়েটির পোশাক–শাড়ি, ব্লাউজ সবখসে পড়ল মাটিতে। তবে মেয়েটা কোথাও নেই– পুরোপুরি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
গঙ্গার দিক থেকে বাতাস ছুটে এল। কালো জল খলখল করে হেসে উঠল। আকাশে উড়ে যাওয়া একটা ধূসর পাচা কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল হঠাৎই।
মালিক থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছিল। ম্যাগাজিনটা হাত থেকে খসে পড়ে গিয়েছিল। এবার মৃগী রুগির মতো হাত-পা ঠকঠক করে বসে পড়ল রাস্তায়। কঁদো-কঁদো স্বরে ডেকে উঠল, পম! পম! তুই আমাকে বাঁচালি!
আমি মালিকের কাছে গিয়ে ওর গায়ে গা ঘষলাম, বললাম, তোমাকে তো কখন থেকে সাবধান করছি! তুমি তো আমার কথা কানেই তুলছ না!
আমার ঘেউ-ঘেউ শুনে মালিক আমার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল। বারবার আমার নাম ধরে ডাকতে লাগল।
হঠাৎই চোখ ফিরিয়ে দেখি মেয়েটার পড়ে থাকা জামাকাপড়গুলোও আর নেই। সেগুলোও কোন জাদুমন্ত্রে কখন যেন উধাও হয়ে গেছে!
মালিক কাঁপতে কাঁপতে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আমার চেন ধরে টান মারল? চল, চল, বাড়ি চল–জলদি।
ভয় পাওয়া খরগোশের মতো আমরা দুজনে তরতর করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। রাস্তা তখন আরও নির্জন হয়ে গেছে। হালকা কুয়াশা কালো রাতকে ধীরে-ধীরে ঘোলাটে করে দিচ্ছে।
আমি দুঃখে মাথা নাড়ছিলাম। যদি আমার মালিকের আগেই একটা হিল্লে হয়ে যেত তা হলে আজকের প্রেতিনীর ফাঁদে মোটেই পা দিতে হত না। ব্যাপারটা আর-একটু এগোলে কী সর্বনাশ হত কে জানে!
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আমরা শোভাবাজার ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে সবে ডানদিকে বাঁক নিয়েছি, এমন সময়…এমন সময় একটি মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
লম্বা, স্মার্ট চেহারা, চোখে হালফ্যাশানের চশমা, কাঁধে ঝোলানো সাইডব্যাগ, হাতের মুঠোয় একটা রুমাল।
রাস্তার আলোয় মেয়েটির শাড়ির রং গাঢ় বলেই মনে হল। আর গায়ের শালটা সাদাটে।
ঠান্ডায় গায়ের শালটাকে প্রায় আঁকড়ে ধরেছে মেয়েটি। শীতে কষ্ট হলেও মুখে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে মালিককে জিগ্যেস করল, নন্দরাম সেন স্ট্রিট কীভাবে যাব একটু বলে দেবেন? স্ট্যান্ডে একটাও অটো পেলাম না। রাস্তাটা অন্ধকার-অন্ধকার…কী বলব..মানে একটু ভয়-ভয় করছে..।
আমি শুধু পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তার সঙ্গে আর কোনও ভয়ের গন্ধ ছিল না। তাই মালিককে বললাম, লেডি ইন ডিসট্রেস। নাও, হেল্প করো। আমাদের সঙ্গে ওকে ডেকে নাও। আমরাও তো অনেকটা সেদিকেই যাব।
আমি কথা বলায়–মানে, ঘেউঘেউ করায়–মেয়েটা আমাকে খেয়াল করল, সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, কী সুন্দর পমিরেনিয়ান! দারুণ দেখতে।
নাও, নাও, শুরু করো তোমার কুকুর রচনা। কুইক।
মালিক পাথরের মতো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ চকের মতো সাদা। দেখলাম, ওর ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছে না। আর হাতের আঙুলগুলো অল্প-অল্প কাঁপছে।
বুঝলাম, মালিক ভয় পেয়েছে।
আমি চেঁচিয়ে মালিককে বললাম, তুমি ভুল করছ, মালিক। তুমি যা ভাবছ ও তা নয়। তোমার লাইফটাকে পালটে নেওয়ার এটা একটা সুযোগ।
আপনার কুকুরটা তো ভীষণ চেঁচাচ্ছে! একটু মজার সুরেই বলল মেয়েটা, কী নাম ওর?
মালিক সেকথার জবাব না দিয়ে আমার দিকে আঙুলের ইশারা করে বলল, জাম্প, পম, জাম্প!
মালিকের এই কথায় আমি থতমত খেয়ে গেলাম। লাফ দেব! কিন্তু কেন?
মালিককে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করে বললাম, লাফ দেব কেন, মালিক? এই মেয়েটি তোমারই মতো রক্ত-মাংসের তৈরি–অন্য কিছু নয়। তুমি যা ভাবছ তা নয়।
মালিক শুনলে তো আমার কথা!
আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল মালিক। আঙুলের ইশারা করে মেয়েটিকে দেখিয়ে আমাকে শক্ত গলায় বলল, জাম্প আই সে! লাফ দে, হারামজাদা শিগগির!
সুতরাং কী আর করি! সামান্য কুকুর হয়ে কী করে মালিকের আদেশ অমান্য করি!
তাই দিলাম লাফ! একেবারে মেয়েটির গায়ে গিয়ে পড়লাম। ওর শরীরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম রাস্তায়।
আর সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটি হাউমাউ করে একেবারে লাফিয়ে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় পেঁচিয়ে মালিককে বলল, কী বাজে লোক আপনি। বিপদে পড়ে হেল্প চাইলাম আর আপনি কুকুর লেলিয়ে দিলেন! ছিটেফোঁটাও কি ভদ্রতা শেখেননি? দাঁড়ান, আপনার নামে আমি পুলিশে কমপ্লেন করব। আনকালচারড ব্রুট।
শেষ কথাটা মেয়েটি বোধহয় আমাদের দুজনকেই বলল। দেখলাম ওর চোখে জল এসে গেছে। শাড়িতে শালে আমার জল কাদা মাখা পায়ের নোংরা ছাপ। বারবার ও নিজের পোশাকের হাল দেখছে আর বলছে, দেখলেন, আমার শাড়ির কী অবস্থা করল শয়তান কুকুরটা! ইশ! শালটারও কী সর্বনাশ করল!
আমি মালিককে বললাম, তোমাকে বারবার বললাম, তাও তুমি শুনলে না। সেই কেলো করে ছাড়লে!
মালিক তখন মুখ নীচু করে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। সেই অবস্থায় ঘন-ঘন শ্বাস ফেলছে। আর মাথা নাড়ছে।
এদিকে মেয়েটির চেঁচামেচিতে এই শীতেও দেখি দূর থেকে দু-চারজন লোক এগিয়ে আসছে। ওরা যদি কাছে এসে পড়ে তা হলে পরিণাম নির্ঘাত গণধোলাই। আর আমার মালিকের যা খ্যাংরাকাঠি চেহারা–ওই পাবলিক পালিশ সইতে পারলে হয়।
সুতরাং মালিকের প্যান্ট কামড়ে ধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। বললাম, বাঁচতে চাও তো শিগগির পালিয়ে চলো।
মালিক আমার এই কথাটা বোধহয় পুরোপুরি বুঝতে পারল। কারণ, আর দেরি না করে ছুট লাগাল, সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও ছুটলাম।
ছুটতে ছুটতে একটা কথা ভেবে আমার হাসি পেল। ভূতের কাছ থেকে যত না জোরে আমরা ছুটে পালিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি জোরে ছুটে পালাতে হচ্ছে মানুষের কাছ থেকে।
একেই বোধহয় বলে কপাল– কুকুরের কপাল।