ভূতের কাছারি – রূপক চট্টরাজ
সেদিন ছিল শনিবার। দুপুর দুটোয় অফিস ছুটি। ছুটির পর সব্যসাচীবাবুর সঙ্গে বইমেলায় যাচ্ছিলাম। ধর্মতলা আসতেই দেখা হয়ে গেল বারিদবাবুর সঙ্গে। অপেক্ষা করছিলেন দেখে জিজ্ঞেস করলাম— কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে কেন এখানে?
উত্তরে বললেন, বইমেলায় যাব, কিন্তু রাস্তায় যা মিছিল। দেখুন, ট্রাম—বাস সব ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। কী করে যাই বলুন তো?
সব্যসাচীবাবু বলে উঠলেন, আরে আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি। চলুন হেঁটেই যাওয়া যাক। তিনজনে আছি, কতক্ষণ আর সময় লাগবে। মাইল দেড়েকের পথ হবে। গল্প করতে করতেই পৌঁছে যাব।
বেশ তাই হোক, বলে তিনজনে হাঁটতে শুরু করলাম।
শীতের শেষে রোদটা বেশ আরাম লাগছে। সামনের ধুধু মাঠ। দূরে বইমেলার টিনের চালাগুলো আবছা ভেসে উঠছে। একটু এগিয়ে যেতে সব্যসাচীবাবু বললেন, একটা ভূতের গল্প বলছি শুনুন। যদিও এটা ভূতের গল্পের পরিবেশ নয়, সময়টা কাটানোর জন্যই বলছি। এটা বেশ জমাটি গল্প। অবশ্য এ গল্পটা বাবার মুখে শোনা—
বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখন আনুমানিক ১৯৪৬ সাল হবে। বাবা উল্টোডাঙার একটা বেসরকারি সংস্থার স্টোরস ইনচার্জ। অফিসের এক বন্ধুর পর পর তিনদিন অনুপস্থিতিতে ওঁর বাড়ি গেলেন খবর নিতে। গিয়ে শুনলেন ওঁর ছেলের ভীষণ অসুখ। থেকে থেকে শুধু মুখ দিয়ে রক্তবমি উঠছে। কোথাও কোনো আঘাত লাগেনি। ওর স্বাস্থ্যটাও বেশ ভালো অথচ কেন এমন হল জানি না। ডাক্তাররাও হিমশিম খাচ্ছেন রোগ ধরতে।
বাধ্য হয়ে গতকাল হাসপাতালে পাঠাতে হল ছেলেকে। কিন্তু কোনো সুরাহা হল না। এখানে রোগ ধরা পড়েনি। ছেলের একই অবস্থা।
বাবা একটু চিন্তা করে বন্ধুকে বললেন, আপনি কি তুকতাক বা ঝাড়ফুঁক বিশ্বাস করেন? যদি করেন তবে আপনাকে একজনের কাছে নিয়ে যেতে পারি। উনি পেশায় ওঝা। এসব ব্যাপারে ওঁর বেশ নামডাক আছে।
বন্ধুটি বাবার কথায় রাজি হয়ে সেই ওঝার কাছে গেলেন। ওঝা সব শুনে বললেন, এটা এমন কিছু নয়। তাড়াতাড়ি সেরে যাবে। এখনই জপ করে দিচ্ছি। হাসপাতালে গিয়ে দেখুন সব ভালো হয়ে গেছে।
ঠিক তাই হল। বাবা আর বন্ধুটি একসঙ্গে হাসপাতালে এলেন, তারপর খবর নিয়ে জানলেন রক্তবমি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কী হয়েছিল সেটা ডাক্তার এখনও বুঝে উঠতে পারেননি তাই ছেলেকে অবজারভেশনে রেখেছেন।
বন্ধুটি ও বাবা বাড়ি ফিরলেন। পরদিন সকালে ফের বন্ধুটি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ওঝার কাছে গেলেন ছেলের সুস্থ সংবাদ জানাতে এবং কিছু দক্ষিণা দিয়ে আসতে।
ওঝা হাসতে হাসতে বললেন, এসব আবার কেন? যদি কিছু দিতে ইচ্ছে করে তবে মাদারিপুরের জঙ্গলে গিয়ে দিয়ে আসুন। আপনাকে কিন্তু একা যেতে হবে। ক্যানিং রেল স্টেশনের থেকে তিন—চার মাইল দক্ষিণে একটা গাঁ আছে। ওটার নাম মাদারিপুর। গাঁ পেরিয়ে আরও দক্ষিণে গেলে একটা জঙ্গল দেখতে পাবেন। মাইল দুয়েক জঙ্গলের ভিতরে যাবেন। দেখবেন একটা ফাঁকা চালাঘর আছে। ওখানে গেলেই দেখতে পাবেন একটা মস্ত পুকুর। আর তার বাঁদিকে একটা সরু পথ পূর্ব দিক বরাবর চলে গেছে। ওই পথ ধরে তিরিশ পা মতন এগোলেই দেখতে পাবেন বুড়ো গাব গাছ। গাছটার তলায় একটা গর্ত আছে। ওখানে গিয়ে একটা জ্যান্ত শোলমাছ আর একছড়া পাকা কলা ওই গর্তে রেখে দিয়ে আসুন। যদি ফিরতে সন্ধে হয়ে আসে তবে জঙ্গল ছেড়ে আসবেন না। ওই ফাঁকা চালাঘরে রাতে বিশ্রাম নেবেন। নইলে পথে বিপদ হবে। সকালের আলো ফুটলেই বাড়ি ফিরে আসবেন।
ওঝার কথামতো সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বন্ধুটি পরদিন ভোরে রওনা হলেন। রাত কাটাবার মতো খাবার—দাবার পুঁটলি বেঁধে সঙ্গে নিয়েও গেলেন। তখন ওই পথে যাতায়াতের এতটা সুযোগ ছিল না। অনেকটা পথ হেঁটে নদী পেরিয়ে গিয়ে হাজির হলেন সেই জঙ্গলে।
কিছু দূর যাওয়ার পর সেই চালাঘরটা দেখতে পেলেন। দেখে একটু ধাতস্থ হলেন। তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। পোঁটলা—পুঁটলি ওই চালাঘরে রেখে পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে ওঝার কথামতো তিরিশ পা দূরে বুড়ো গাব গাছের তলার গর্তে জ্যান্ত শোলমাছ আর কলা পুঁতে দিয়ে এলেন। চালাঘরে ফিরে এলেন তারপরে।
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে ভেবে বন্ধুটি সেই রাতটা ওই চালাঘরে বিশ্রাম নিলেন আহারাদি সেরে। সারাদিনের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
মাঝরাতে বন্ধুটির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখলেন সামনেই ফাঁকা মাঠে একজন চেয়ারে বসে আছেন। বিশাল চেহারা। পিছনে ধুধু মাঠ। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। কোনো গাছপালার চিহ্ন সেখানে নেই। একটা অস্ফুট স্বর কানে ভেসে এল। দেখলেন চেয়ারে বসা লোকটির সামনে এসে কে একজন আবছা অশরীরী চেঁচিয়ে অপর একজনের নাম ধরে ডাকল। চেয়ারে বসা লোকটি আদেশ জারি করল। পরক্ষণেই আরেকটি লোক অন্য একজনকে ধরে নিয়ে এল।
চেয়ারে বসা লোকটি জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাকে শাস্তি দিল। দোষ স্বীকার করার পর ওর মুক্তি হল।
এইভাবে পাঁচ—ছয়জনকে মুক্তি দিল চেয়ারে বসা লোকটি। এবার বন্ধুটির ডাক এল। বন্ধুটি শুয়ে শুয়েই দেখলেন যে ঠিক তার মতো চেহারার একজন লোক ওই নামে এসে হাজির হল চেয়ারে বসা লোকটির সামনে। অত আলোতেও লোকটিকে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল যেন নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এক নাম, এত মিল যেন ভাবাই যায় না।
চেয়ারে বসা লোকটি তাকে বলল, একবার যাচ্ছিলাম তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে। যখন যাচ্ছিলাম তখন তোমার ছেলে আমার গায়ে থুতু ফেলেছে। তাই অভিশাপ দিয়েছি যে ওর থেকে থেকেই রক্তবমি উঠবে। তুমি তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেছ, আর আমার প্রিয় শোলমাছ ও কলা আহারের জন্য দিয়েছ, তাই তোমার ছেলে এখন থেকে মুক্তি পেল। ওর আর রক্তবমি হবে না। যাও, তুমি এখন বাড়ি যাও।
চমকে উঠলেন বন্ধুটি। ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলেন একি! এতক্ষণ তিনি নিজেকেই দেখছেন শুয়ে শুয়ে। কোনো ভূত—টুত নয়তো।
এদিকে সকাল হয়ে এসেছে। চোখ রগড়াতে রগড়াতে আরও ভাবলেন, নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছিলেন। এখন তিনি একা জঙ্গলের মধ্যেই পড়ে আছেন। তাড়াতাড়ি উঠে বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
বাড়ি ফিরে এসে পরদিন ফের সেই ওঝার কাছে গেলেন। সব ঘটনাটা খুলে বললেন। ওঝা চেয়ারে বসা লোকটির চেহারার বর্ণনা শুনে বললেন, ঠিক আছে, আপনার আর ভয়ের কিছু কারণ নেই। আপনার ছেলে আরও সুস্থ হয়ে উঠবে। আপনি যে কাল রাতে ভূতের কাছারিতে গিয়েছিলেন। ওদের বিচার দেখে এসেছেন নিজের চোখে। চেয়ারে বসা লোকটি ওদের বিচারক। আর আপনার কোনো ভয়—ভাবনা নেই। যান, এখন বাড়ি ফিরে যান।
গল্পটা শুনে বারিদবাবু ও আমি অবাক হয়ে গেলাম। গল্পের টানে আমরা বইমেলার গেটের কাছে চলে এসেছি। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে কিছু বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল— কোথাও লেখা ‘সব ভূতুড়ে’, কোথাও বা ‘ভূতেরা চাউমিন ভালোবাসে ।’ আরও এক জায়গায় লেখা ‘ভূতগুলো সব গেল কোথায়’, এবং তার পাশেই ‘সব ভূত এইখানে’… ইত্যাদি।