ভূতের কথা – যমদত্ত
(অ-দার্শনিক প্রবন্ধ)
আমি বাঙালি ভূতের কথা বলিব৷ বাঙালি ভূতের সঙ্গে অতি শৈশব হইতে পরিচয়, যে ভূতের ভয়ে ছেলেবেলায় সন্ধ্যার পর বাঁশতলা দিয়া বাড়ি ফিরিতে হইলে রাম! রাম! বলিতে বলিতে দৌড়াইয়া যাইতাম৷ আমি বাঙালি ভূতের কথা বলিব বলিয়া কেহ যেন মনে না করেন যে খোট্টা ভূত, ইংরাজ ভূতদের অস্তিত্ব অস্বীকার করিতেছি৷ আমি আদৌ parochial বা communal বা sectarian নহি৷ বাংলাদেশে মরিয়া যাঁহারা ভূত হইয়াছেন, যেমন চুড়েল, দেও, ghost, মাও-ছে-লাই-পিঙ, তাঁহাদের অস্তিত্ব স্বীকার করি৷ একবার আচিপুরের চীনা গোরস্থানের পাশ দিয়া মোটরে করিয়া যাইতেছি—সেদিন শনিবার অমাবস্যা৷ যেই গোরস্থানের কাছে আসিলাম, অমনি হাজার হাজার ছোট ছোট আরশুলা, বড় বড় আরশুলা উড়িয়া আমাদের নাকে-মুখে বসিতে লাগিল, গাড়ি চালানো দুর্ঘট৷ শুনিলাম এই তিথিতে চীনা ভূতেরা গোর হইতে উঠিয়া আরশুলা ধরিয়া খায়—তাই আরশুলারা ভয়ে পলাইতেছে৷ এঁরা সব আছেন৷ আমি সতেরোটি হেডিং-এ ইঁহাদের সম্বন্ধে বলিব৷
ভূত কথাটি একটি generic term, সব রকম ভূতদের, যেমন (খাঁটি) ভূত, পেত্নী, শাঁকচুন্নী, ব্রহ্মদৈত্য, মামদো, আলেয়া, কন্ধকাটা, পেঁচো, কুনী, বুনী ইত্যাদি সকলকে বুঝায়৷ আমরা সাধারণত ভূত কথাটি ভূতদের, সর্বপ্রকার ভূতেদের জাতিবাচক generic term হিসাবে ব্যবহার করিব৷ আমাদের এই ভূতের সহিত বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোনো প্রকার সম্বন্ধ নাই৷
উৎপত্তি
প্রথমে ভূতের উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছু বলিব৷ মহর্ষি কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত অষ্টাদশ মহাপুরাণের অন্যতম গরুড় পুরাণে আছে যে জীবাত্মা চৌরাশী লক্ষ যোনি পরিভ্রমণ করিয়া মনুষ্যজন্ম লাভ করিবার অব্যবহিত পূর্বে গো-জন্ম লাভ করে৷ গো-জন্মের পর মনুষ্যজন্ম গ্রহণ করে এইজন্য বাংলায় একটি কথা চলতি আছে যে, ‘গো-জন্ম উদ্ধার হইল’ অর্থাৎ মানুষ হইল উন্নতির পথের গাঁট খুলিয়া গেল৷ আর মানুষ মনুষ্যজন্মে নিজ নিজ সুকৃতি-দুষ্কৃতির ফলে স্বর্গ-নরক ভোগ করে, কেহ কেহ নিরন্তর দুষ্কার্য করিলে, বাপ-মাকে অশ্রদ্ধা করিলে, খাইতে না দিলে ভূতযোনি প্রাপ্ত হয়৷
অনেকে আজকাল এইসব পৌরাণিক সত্য বিশ্বাস করেন না সেজন্য একটি পরোক্ষ প্রমাণ উপস্থাপিত করিব৷ আজকাল ইংল্যান্ড, আমেরিকার কথা বাদ দিলেও দেখা যায় পৃথিবীর সর্বত্র এমন কি হিন্দু-প্রধান ভারতবর্ষেও, পাকিস্তানের তো কথাই নাই— পাকিস্তানীরা তো ভারত হইতে জোর করিয়া গরু-বাছুর লুঠ করিয়া ‘‘লিয়াকতী-কাবাব’’ বানাইবার সনদ পাইয়াছেন—ব্যাপকভাবে গো-হত্যা হইতেছে৷ এইসব গরু পরজন্মে মানুষ হইয়া জন্মাইতেছে ফলে জনসংখ্যা দ্রুত, অসম্ভব দ্রুত বাড়িতেছে৷ এইরূপ হারে বাড়িতে থাকিলে আর ২৫০ বছর বাদে মানুষ পৃথিবীতে দাঁড়াইবার স্থান পাইবে না৷
ব্যাসদেবের কথা সেকেলে বলিয়া ছাড়িয়া দিলেও, একালে প্রখ্যাত লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, যিনি ভূত ও মানুষ লিখিয়া নাম করিয়াছেন, বলিয়াছেন যে মানুষ মরিয়া ভূত হয়, আর ভূত মরিয়া মার্বেল হয়৷ মানুষ মরিয়া যে ভূত হয় একথা জ্ঞান হইবার পূর্ব হইতে ঠাকুরমা, দিদিমা, ছোট পিসির মুখে শুনিয়াছি৷ আমাদের বাড়ির আহ্লাদি ঝি ও ‘‘আতর’’-এর মুখে শুনিয়াছি৷ পাঠশালার গুরুমহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি৷ স্কুলের লাইব্রেরিতে Ghost stories বলিয়া সুদৃশ্য বাঁধাই বই দেখিয়াছি৷ মানুষ মরিলে যে ভূত হয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকিতে পারে না৷
নিবারণ ঠাকুর্দা বলিতেন যে ব্রাহ্মরা ভূত বিশ্বাস করিতেন না এজন্য ব্রাহ্মরা মরিয়া ভূত হইয়া গিয়াছেন৷ সরকারি সেন্সাস রিপোর্টে আর তাঁহাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না৷ তবে সত্যের খাতিরে আমরা জাস্টিস মিত্র যে কথা বলিতেন, তাহাও উল্লেখ করিতে বাধ্য৷ তিনি বলিতেন, সেন্সাস রিপোর্টে ব্রাহ্মদের অনুল্লেখের অন্য কারণ আছে৷ ‘‘রাজা রামমোহন রায় হিন্দু থাকিয়া মুরগী খাইবার পন্থা আবিষ্কার করায় লোকে দলে দলে ব্রাহ্ম হইয়া গেল তখনকার দিনে যদি সেন্সাস লওয়া হইত তাহা হইলে দেখা যাইত লাখেলাখ ব্রাহ্ম৷ তাহার পর গোঁড়া আনুষ্ঠানিক হিন্দুরা মুরগীকে ‘‘সীতাপতি বিহঙ্গম’’ বলিয়া চালাইতে লাগিলেন৷ রামচন্দ্র নাকি পঞ্চবটি বনে নিত্য বন্য কুক্কুট শিকার করিতেন, এজন্য উহার একটি নাম রামপাখি৷ লক্ষ্মণ-শূকর-মাংসের শিক্কাবাব করিতেন—যাহাকে শূলপক্ক বরাহমাংস বলে৷ কালিদাস তাঁহার কাব্যে একথা লিখিয়া গিয়াছেন৷ বুদ্ধদেব শূকর-মাংসের পিঠা খাইয়া দেহত্যাগ করেন৷ হিন্দুরা প্রথমে গোপনে, পরে প্রকাশ্যে সীতাপতি বিহঙ্গম খাইতে লাগিলেন৷ লোকে কি দুঃখে আর ব্রাহ্ম হইবে?
‘‘একবার দেওঘরে বেড়াইতে গিয়া দেখিলাম যে ঘড়ি-ঘরের নিকট টাকায় ৮ ১০ টা করিয়া সীতাপতি বিহঙ্গম বিক্রয় হইতেছে৷ এক হিন্দু স্ত্রীলোক শিবগঙ্গায় স্নান সারিয়া বাবা বৈদ্যনাথের পূজা দিয়া কপালে প্রসাদী চন্দন ও বাঁ হাতে বেশ বড় চ্যাঙড়া প্রসাদী পেঁড়া লইয়া ফিরিতেছেন৷ মুখে তৃপ্তির হাসি তারপর ঘড়িঘরের কাছে আসিয়া ডান হাতে যতগুলির ঠ্যাং ধরে ততগুলি সীতাপতি বিহঙ্গম খরিদ করিয়া বাড়ি চলিলেন৷ আর এক ব্রাহ্মিকা সকাল হইতে পায়চারি করিয়া কড়া মেঠো রৌদ্রে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন— তিনি শিবগঙ্গায় স্নান, বাবা বৈদ্যনাথ দর্শন করিতে পারেন না, বাবার প্রসাদী চন্দন বা প্রসাদী পেঁড়া লইতে পারেন না, পৌত্তলিকতা দোষে দুষ্ট হইবার ভয়ে৷ আর দোকানীরা সব পেঁড়াই বাবার প্রসাদী পেঁড়া বলিয়া হাঁকিতেছে৷ তিনি কেবলমাত্র সস্তা বলিয়া গোটাকয়েক সীতাপতি বিহঙ্গম লইয়া ঘরে ফিরিলেন৷ লোকে কি আশায় আর ব্রাহ্ম হইবে! আর হিন্দুদের পর্দা তো ছিঁড়িয়া ফর্দা ফর্দা হইয়া গিয়াছে৷’’
মানুষ মরিয়া ভূত হয় সত্য—কিন্তু ইহাই ভূত হইবার একমাত্র পন্থা নয়৷ তবে সাধারণত মানুষ মরিয়া ভূতেদের খুব বেশি সংখ্যাধিক্য৷ অন্যান্য উপায়েও দুই চারিটি ভূত হয়৷ বাংলায় একটা কথা খুব চলিত আছে—‘‘ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ’’৷ ভূতের ছেলে ভূত না হইলে এই কথাটির সৃষ্টি হইত না আর ভূত-পেত্নীর যখন বিবাহ হয়, তখন তাহাদের ছেলেপুলে হওয়া সম্ভব৷ বুনীর ছেলে হইয়াছিল৷ দুই চার জন ভূত এইরূপে ভূতের ছেলে ভূত—ইহারা খাঁটি দুই পুরুষে ভূত, ইহাদের ভৌতিক কৌলীন্য খুব বেশি৷
আবার কোনো কোনো মানুষ না মরিয়াও ভূত হয়—যেমন আবাগীর বা আবাগের বেটা ভূত৷ যুধিষ্ঠির না মরিয়াও সশরীরে স্বর্গে গিয়াছিলেন, একথা স্বয়ং ব্যাসদেব মহাভারতে লিখিয়াছেন৷ যুধিষ্ঠির যদি না মরিয়াও স্বর্গে যাইতে পারেন, তবে আবাগের বেটাকে কেন মরিয়া ভূত হইতে হইবে? তিনি সশরীরে সোজা ভূত হইতে পারিয়াছেন৷ আমরা অতি কষ্টে বহু অনুসন্ধানে এই আবাগের বেটা ভূতের বংশতালিকা সংগ্রহ করিয়াছি৷ আপনাদের অবগতির জন্য বলিতেছি শুনুন৷ যথা :—
১৷ আবাগে
২৷ ভূত
৩৷ অদ্ভুত
৪৷ কিম্ভূত
৫৷ কিমাকার
৬৷ বিচ্ছিরি
৭৷ বিদিকিচ্ছিরি
৮৷ বিদকুটে
৯৷ আককুটে
১০৷ উড়ন-চৌড়ে
১১৷ নচ্ছার
১২৷ পাজী
১৩৷ ছুঁচো
Evolution-সূত্রে যেমন বানর হইতে মানুষ হইয়াছে, তেমনই মানুষ হইতে devolution-সূত্রে কেন ছুঁচো হইতে পারে না? ইহা হওয়া সম্ভব এবং আমরা ইহা হওয়া সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি৷
দেখা যাইতেছে যে তিন রকমে ভূত হয়—(১) মানুষ মরিয়া ভূত (২) ভূতের বেটা ভূত (৩) আর আবাগের বেটা ভূত—ইঁহারা না মরিয়াই বহু পাপবলে ইহজন্মেই সশরীরে ভূত হইয়াছেন৷
স্থিতি
ভূতের উৎপত্তির কথা বলিলাম৷ এইবার ইঁহাদের মর্ত্যে স্থিতির কাল সম্বন্ধে কিছু বলিব৷ মানুষ বা অন্য প্রাণী হইলে বলিতাম ইঁহারা গড়ে কত বছর বাঁচেন৷ মানুষ বা অন্য প্রাণীদের শৈশব, যৌবন, বৃদ্ধত্ব ও অবশেষে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি আছে৷ ভূতেদের কিন্তু শৈশব নাই৷ সকলেই একেবারে সাবালক ভূত হয়৷ তাঁহাদের কাণ্ডকারখানা দেখিয়া মনে হয় যে তাঁহাদের বেশ বয়স হইয়াছে৷ ভূতেদের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হইতে পারে না—কারণ তাঁহারা পঞ্চভূতে সৃষ্ট নহেন৷ কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহারা যে অমর, চিরস্থায়ী, তাহাও নহে৷
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হইয়াছে অন্তত ৫,০০,০০০ লক্ষ বছর আগে৷ উত্তর আফ্রিকায় ও আফ্রিকার রিফটভ্যালিতে যেসব অস্মীভূত নর-কঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে তাহাদের রেডিও-কার্বন ও রেডিও-পটাসিয়াম পদ্ধতিতে বয়স, অর্থাৎ সেগুলি কতদিন আগেকার, নির্ণয় করা হইয়াছে৷ সেই সময়ে পৃথিবীতে ১০,০০০ হাজার মানুষ ছিল বলিয়া পণ্ডিতগণ মনে করেন৷ আর আজ ২৫,০০০ লক্ষ মানুষ৷ গড় ধরিলে ১২,৫০০ লক্ষ মানুষ বরাবর ছিল৷ আর জীমূতবাহন বলিয়াছেন ২০ বছরে এক পুরুষ৷ বাঙালি যতীন্দ্রমোহনবাবু দেখাইয়াছেন যে এইসব মানুষের গড় পরমায়ু ৩০-এর কাছাকাছি৷ এমতে ৫,০০,০০০ বৎসরে হয় ২৫,০০০ পুরুষ৷ তাহা হইলে মোটামুটি হিসাবে ১২,৫০০,০০,০০০ x ২৫,০০০ মানুষ মারা গিয়াছে৷ এই বিপুল সংখ্যাটি ভাবিয়া দেখুন—৫৫ x ১০১০৷ এত লোক ভূত হইয়া থাকিলে প্রত্যেক মানুষের পিছনে ১২,৫০০ করিয়া ভূত৷ যদি একহাজার মানুষের মধ্যে একজনও মরিয়া ভূত হয়, তাহা হইলে প্রত্যেক মানুষের পিছনে ১২ ১৩ জন করিয়া ভূত৷ এত ভূতের দাঁড়াইবার স্থান নাই৷ সুতরাং বাধ্য হইয়া ধরিতে হয় যে বহু ভূতের ভূতত্ত্ব লোপ পাইয়াছে৷
আমরা হিন্দুরা পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহকে পিণ্ডদান করি৷ বৃদ্ধ-প্রপিতামহকে পিণ্ড দিতে হয় না৷ এক এক পুরুষ জীমূতবাহনের ব্যবস্থানুযায়ী ২০ বছর ধরিলে ৮০ বছরে আমার পূর্ব-পুরুষ উদ্ধার হইয়া গিয়াছেন৷ এমতে ভূতের ভুতত্ত্ব থাকিবার গড় কাল ৮০ বছর৷ কোনো কোনো ভূতের মেয়াদ ইহার ডবল হইতে পারে৷ ইহার মধ্যে যদি গয়ায় পিণ্ডদান করিয়া থাকি তো আরো শীঘ্র তাঁহারা ভূতত্ত্ব পরিত্যাগ করিয়াছেন৷ এই হিসাব হইল সাধারণ ভূতের বেলায়, অর্থাৎ যাঁহারা মানুষ ছিলেন, পরে মরিয়া ভূত হইয়াছেন৷
কিন্তু এই হিসাব ভূতের বেটা ভূত ও আবাগের বেটা ভূতের বেলায় খাটে না৷ আমাদের মনে হয় তাঁহাদের ভুতত্ত্ব সহজে যায় না৷ কতদিনে তাঁহাদের ভুতত্ত্ব শেষ হয় এ বিষয়ে গবেষণা আবশ্যক৷ তবে নিবারণ ঠাকুর্দার মত এই যে, আবাগের বেটা ভূতের বংশে যখন ছুঁচোর আবির্ভাব হয় তখন তাহার ভুতত্ত্ব ঘোচে৷
ভূতেদের বয়স বাড়ে না, যে যে বয়সে ভুতত্ত্ব লাভ করিয়াছে সেই বয়সের ভূতই থাকে৷
লয়
গয়ায় পিণ্ড দিলে ভূতের ভুতত্ত্ব শেষ হইয়া যায়৷ আবার ৮০ হইতে ১৬০ বৎসরের মধ্যে সকল ভূতের ভুতত্ত্ব কালক্রমে নষ্ট হয়৷ যাহারা মানুষ মরিয়া ভূত হইয়াছে, তাহারা মরিলে মার্বেল হয়—একথা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বলিয়াছেন৷ গয়ার চারিদিকে যে রামশিলা, প্রেতশিলা, আকাশ-গঙ্গা, ব্রহ্মযোনি প্রভৃতি পাহাড় আছে, তাহা এই উক্তির সত্যতা প্রমাণ করিতেছে৷ ফল্গু বালিচাপা পড়িয়া অন্তঃসলিলা হইয়াছে এই কারণে৷
সংখ্যা
পৃথিবীতে বহুপ্রকারের বহু ভূত আছে ইহাদের সংখ্যা কত তাহা এযাবৎ নির্ধারিত হয় নাই৷ পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় ভূতের সংখ্যা কম বলিয়া মনে হয়—কারণ পৃথিবীর সকল লোকই ‘ভূত’ নহে, একটা মোটা রকমের অনুপাত হইতেছে সাধারণ লোক৷ অথচ বাংলার কৃষিবিভাগ হইতে প্রকাশিত এক পুস্তিকায় লিখিত আছে যে ‘বাংলায় যতেক সংখ্যক লোক, তাহার অর্ধেক সংখ্যক গরু’৷ এই সব গরু মরিয়া ভূত হইতে পারে না—কাজে কাজেই ভূতের সংখ্যা জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি হইতে পারে না৷
আমরা ভূতেদের সংখ্যার একটি upper limit নির্ধারণ করিবার চেষ্টা করিব—কতদূর সফল হইয়াছি তাহা আপনারা বিচার করিবেন৷ চিত্রগুপ্তের বিচারালয় দ্বাদশ যোজন লম্বায় ও দ্বাদশ যোজন গ্রন্থে৷ আর আমাদের পরমাত্মা অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ৷ সাধারণ বুড়া আঙ্গুলের ঘের মাপ ১ ৪ বর্গ ইঞ্চির কম নহে৷ চিত্রগুপ্তের বিচারালয় যদি এই অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ পরমাত্মায় ভরিয়া যায়, আর তিলধারণের স্থান না থাকে, তাহা হইতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চচ পরমাত্মার সংখ্যা হইতেছে ঃ—
(১২ × ৪ × ২ × ১৭৬০ × ৩ × ১২)২ × ৪ = ৬৪, ২৩, ১৮, ৩৩৬৷ এক কথায় ৬৫ কোটি৷ আর ইহাদের মধ্যে সকলেই ভূত হয় না, যাহাদের স্বর্গ ও নরক বাসের হুকুম হয় তাহারা এই সভা ছাড়িয়া যাইতে বাধ্য হয়৷ এমতে ভূতের ঊর্ধ্বসংখ্যা হইতেছে ৬৫ কোটি—আর বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা, ৬৫ কোটি চীনাদের ধরিয়া মোটমাট ২৫০ কোটি৷
বয়স
পূর্বেই বলিয়াছি যে ভূতের শৈশব নাই, একেবারে সাবালক হইয়া ভূত হয়েন৷ মানুষ ইহজীবনে পাপ করিলে মরিয়া ভূত হয় মার্কণ্ডেয় মুনি বলিয়াছেন যে ৫ বছরের কম বয়সের শিশুদের কোনো পাপ হয় না৷ তাহার পর সাবালক না হওয়া পর্যন্ত যে পাপ করে তাহা যমরাজ মাপ করিয়া দেন, কিছুকাল ধরিয়া ঘৌড়দৌড় করাইবার পর৷ যমদূতেরা কান ধরিয়া যে বেগে ঘোড়দৌড় করান তাহাতে প্রাণান্ত হইতে হইতে কোনোমতে টিকিয়া থাকে৷ সাবালক না হইলে মানুষকে পাপ অর্শায় না—আর হিন্দুমতে ১৬ বছরে সাবালক হয়৷ জীমূতবাহনের মতে বাঙালিরা সাবালক হয় ১৫ পার হইয়া ১৬য় পা দিলেই আর খোট্টা, উড়িয়া, অন্ধ্র, মারাঠীরা প্রভৃতি হয় পূর্ণ ১৬ হইলে৷ এমতে বাঙালি ভূতের সংখ্যা বা অনুপাত কিছু বেশি৷ তবে বাঙালিরা বেশিদিন বাঁচেন না অন্যান্য প্রদেশের তুলনায়৷ বাঙালি ভূতের গড় বয়স হইতেছে ৩০ হইতে ৩৫৷ তাহার পর তাঁহারা ৮০ বছর ধরিয়া ভূতগিরি করেন—যদি না তাঁহাদের গয়ায় পিণ্ড দেওয়া হয়৷
আগে গয়ায় যাওয়া খুব কষ্টকর ছিল৷ গ্রামের একজন যদি গয়ায় যাইত, তবে পাড়া-পড়শীর নাম ও গোত্র লইয়া যাইত ও তাহাদের নামে পিণ্ড দিত৷ এমতে ভূতের সংখ্যা খুবই কমিয়া যাইত৷ আজকাল গয়ায় যাইবার সুবিধা হওয়া সত্ত্বেও ছেলেরা বাপেরই গয়া করেন না, তা অন্য লোকের গয়া করিবেন৷ ফলে relatively বাঙালি ভূতের সংখ্যা বেশ বাড়িয়া গিয়াছে৷ আর ইঁহারা মাঝে মাঝে আমাদের ঘাড়ে চাপেন৷ ইঁহারা যে আমাদের ঘাড়ে চাপেন তাহার প্রমাণ সর্বত্রই ছড়াইয়া আছে—কি স্কুলে, কি কলেজে, কি মিটিংয়ে, কি ট্রামে বাসে রাস্তায়, লোকের কথাবার্তা ও আচরণ দেখিয়া মনে হয় যে কোনো দুষ্ট ভূত ঘাড়ে চাপিয়াছে৷
অঙ্গুষ্ঠ-পরিমাণ বায়ু হইল আমাদের পরমাত্মা৷ এই পরমাত্মাই ভূত হয়েন৷ যম যখন সত্যবানের প্রাণবায়ু আকর্ষণ করিয়া লইলেন, তখন এই অঙ্গুষ্ঠ-পরিমাণ বায়ুই আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিলেন৷ মহাভারতের বনপর্বে এই কথা বিস্তারিত ভাবে লেখা আছে৷ মানুষের অঙ্গুষ্ঠের পরিমাণ গড়ে ৩ কিউবিক সেন্টিমিটার, আর বায়ুর ওজন প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ০.০০১২৯৩ গ্রাম৷ সেমতে গড়ে পরমাত্মার ওজন ১৭ ১৮ গ্রেন৷ ইহার সবটাই ভূত হয় না৷ সরিষার মধ্যে ভূত ঢুকিলে সরিষার ওজন বাড়িয়া যায়—এটি প্রত্যক্ষ সত্য৷ কিন্তু সরিষার ওজন বাড়ে ৬ ৭ গ্রেন করিয়া৷ সেমতে ভূতের ওজন ৬ ৭ গ্রেন হইতে ১৭ ১৮ গ্রেণের মধ্যে৷ আমরা সর্বাপত্তি খণ্ডনের জন্য ভূতের ওজন ইহার মাঝামাঝি, অর্থাৎ ১১১ ২-১২১ ২ গ্রেন ধরিলাম৷ এ বিষয়ে আরো গবেষণা আবশ্যক৷ বাংলায় আজকাল পিল-পিল করিয়া D.Phil হইতেছে যাঁহারা D.Phil-প্রত্যাশী তাঁহাদের মধ্যে যদি কেহ পুরাতন ও নবীন বঙ্গ-সাহিত্য ঘাঁটিয়া নিম্নলিখিত সমীকরণের সমাধান করেন, তাহা হইলে নিখুঁতভাবে ভূতের ওজন নির্ধারিত হইতে পারে৷ সমীকরণটি এই :—
ভূতের ওজন কম হইলেও, তাহাদের হাত-পা লিকলিকে সরু কাঠির মতন হওয়াতে তাহাদের Ponderal index খুব বেশি৷ অতি সহজেই মানুষের ঘাড় মটকাইয়া দিতে পারে৷
ভূতের size
গ্যাস যেমন অল্প জায়গায় থাকিতে পারে, আবার বাড়িয়া পৃথিবীব্যাপ্ত হইতে পারে, ভূতেরাও তেমনি নিজেদের শরীর ইচ্ছামতো কমাইতে পারে৷ বাংলায় একটি কথা চলতি আছে যে ‘‘সরিষার মধ্যে ভূত’’ ভূত ছোট হইয়া সরিষার মধ্যেও ঢুকিতে পারে৷ আবার তালগাছ সমান লম্বা হইতে পারে৷ ভূতেরা যখন মানুষকে ভয় দেখাইতে ইচ্ছা করে তখন তালগাছ-সমান উঁচু হয় আর তালগাছের মাথায় বসিয়া পা ঝুলাইয়া নিচে দিয়া যেসব মানুষ যায় তাহাদের গলায় পা দিয়া টিপিয়া মারিয়া ফেলে৷ ভূতেরা যে শুধু ইচ্ছামতো ছোট-বড় হইতে পারে তাহা নহে, ছোট থাকিয়াও একটা হাত বা পা খুব বেশি লম্বা করিতে পারে, গলাটা লম্বা করিয়া ও-বাড়ির দোতলায় কি হইতেছে দেখিতে পারে৷ ‘‘গদখালির হাত’’এর ব্যাপারটা বলিলে আপনারা সহজে বুঝিতে পারিবেন৷
ঘটনাটি আজ হইতে ৭০ ৮০ বছর আগেকার৷ যশোহর জেলার গদখালি একটি প্রসিদ্ধ গণ্ডগ্রাম গ্রামে মহামারী দেখা দিল, বাড়িকে বাড়ি উজাড়, কে কাহাকে দাহ করে ঠিক নাই, অনেকে গ্রাম ছাড়িয়া পলাইয়া গেল৷ বিদেশে এক যুবক চাকুরি করিত দেশে মা ও স্ত্রী থাকিত খবর না পাইয়া খবর লইতে দেশে আসিল৷ গ্রামে যখন পৌঁছাইল তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে অন্ধকারে মনে হইল যেন দুই-চারিজন পরিচিত লোক পাশ কাটাইয়া চলিয়া গেল, কেহ কথা কহিল না৷ বাড়িতে গিয়া হাঁক দিল ‘মা! মা! বাড়ি আসিয়াছি’৷ ঘোমটা দিয়া স্ত্রী জলভরা গাড়ু রাখিয়া গেল৷ মা থালায় করিয়া খাবার দিয়া বসিয়া আছেন, সবই অন্ধকার—বুঝিল প্রদীপে দিবার মতন তৈল নাই তাই অন্ধকারে খাইতে দিয়াছেন৷ মা কিন্তু কোনো কথা বলেন না খাইতে খাইতে যুবকটি বলিল যে আচার হইলে ভালো হইত৷ মা (তখন ভূত হইয়াছেন) অমনি হাত বাড়াইয়া শিকার উপর হইতে আচারের হাঁড়ি নামাইয়া দিল৷ যুবকটি বুঝিল মা মরিয়া ভূত হইয়াছেন, তাই কথা কহিতেছেন না৷ বাড়ির বাহির হইয়া ছুটিয়া রেল স্টেশনে আসিল ও মিটিমিটি আলোয় রাত কাটাইয়া ভোরের ট্রেনে কলিকাতায় আসিল৷ এই ঘটনার কথা তখনকার দিনের বিখ্যাত সাপ্তাহিকপত্র বঙ্গবাসীতে (যে বঙ্গবাসীর নামে সর্বপ্রথম সিডিসানের মোকদ্দমা হয়) প্রকাশিত হয়৷ সেই হইতে ‘‘গদখালির হাত’’ প্রবাদে পরিণত হইয়াছে৷
ঠাকুরমার পেয়ারের ঝি আহ্লাদির মুখে এই গল্পটি শুনিয়াছি : পাশের বাড়িতে ভূতের উপদ্রব, ঢিল ফেলে, ময়লা ফেলে৷ এ বাড়ির ছোট কর্তা বলিলেন যে দুষ্ট লোকের কাজ, ভূত যদি সত্য সত্য থাকে তো গলা বাড়াইয়া দেখা দিক৷ সেদিন শনিবার, অমাবস্যা, টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িতেছে—যে-ই ছোট কর্তা ঐ কথা বলিলেন, অমনি জানলার গরাদ ভেদ করিয়া এক কালো তিজেল হাঁড়ির মতন মুখ, গলাটা সরু হাঁসের গলার মতন, চোখ দুটো ভাঁটার মতন ছোট—কর্তার সামনে হাজির৷ ছোট কর্তা অজ্ঞান হইয়া গেলেন আমরা সব রামনাম করিতে লাগিলাম৷ ভূত হাওয়ায় মিলাইয়া গেল৷
ভূতের রং
বাঙালিদের মধ্যে ফরসা লোকের অভাব নাই৷ কেহ বা ধবধবে ফরসা, কেহ গৌরবর্ণ, বেশির ভাগ উজ্জ্বল শ্যাম বা শ্যামবর্ণ, অনেকে কালো, দুই-চারিজন মিশমিশে কালো৷ আবার এমন লোকও আছে, কালো হইতে হইতে একেবারে নীল হইয়া গিয়াছে৷ বাঙালির গাত্রবর্ণ লইয়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এযাবৎ হয় নাই৷ আমরা বাঙালি সাহিত্যিকদের, অর্থাৎ যাঁহারা কবিতা ছাপাইবার জন্য মাসিকপত্রের সম্পাদকদের কাছে যাওয়া-আসা করেন, এইরূপ ২৩৪ জনের গাত্রবর্ণ Martin’s scale-এ মাপিয়াছিলাম৷ নিম্নে তাহা শতকরা হিসাবে দিলাম৷ এই তথ্য সমগ্র বাঙালি জাতির পরিচায়ক না হইতেও পারে৷ হিসাবটি এইরূপ :—
শতকরা
খুব ফরসা গৌর বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম শ্যাম কালো ঘোর কালো মায় নীল
১ ৯ ১৭ ৩০ ৪১ ২
ভূতেদের মধ্যে বর্ণ-বৈচিত্র্য থাকিলেও বেশির ভাগ ভূত পনেরো আনা তিন পাই ভূত—ঘোর কালো৷ ইহারা সকলেই বাঙালিভূত৷ পেত্নীদের মধ্যে শতকরা ১০৮ জন মিশমিশে কালো৷ এক ব্রহ্মদৈত্যই যা ফরসা বা গৌরবর্ণ৷ পেঁচো নীলবর্ণের—কালো নহে৷ ভূতেরা আলকাতরার মতন কালো, তামাক খাইবার টিকার মতন খশখসে কালো৷ এইজন্য বাংলায় বলে ‘‘ভূতের মতন কালো’’ পৌষ সংক্রান্তিতে যখন মেটে হাঁড়ি ফেলিয়া দেওয়া হয় তখন তাহার তলাটি ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় এমন কালো হয় যে আমরা বলি তলাটি হইয়াছে ঠিক যেন ‘কেলে ভূত’৷
ভূত যে কালো তাহা নিরীশ্বরবাদী রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করিয়াছেন৷ তাঁহার পুরাতন ভৃত্যে :—
‘‘ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর৷’’
… … … …
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত, তামাক সাজিয়া আনে৷’’
ভূতেদের মধ্যে কালো রংয়ের প্রাধান্য দেখিয়া মনে হয় পূর্বে বাঙালিরা—বেশির ভাগ খাঁটি বাঙালি খুব কালো ছিল এখন অল্পে অল্পে মোগল যুগে রেড়ির খোল ও সর মাখিয়া, ইংরাজ আমলে সাবান ঘষিয়া, এখন স্বাধীনতার যুগে সাবান স্লো, ট্যালকম পাউডার মাখিয়া ও ঔষধ খাইয়া ফরসা হইতেছে৷ ব্রহ্মদৈত্যরা বরাবরই ফরসা, কেহ কেহ ধবধবে ফরসা, কেহ কেহ গৌরবর্ণ কন্ধকাটারা ও পেঁচো নীল রংয়ের৷ কন্ধকাটাদের নীল হইবার একটি কারণ খুঁজিয়া বাহির করিয়াছি—আগেকার দিনে নবাব-বাদশাহরা যাহাদের গর্দান লইতেন, তাহারাই অপঘাতে মৃত্যু হওয়ায় কন্ধকাটা হইত আর রক্ত ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িয়া যাওয়ায় তাহাদের কালো দেহ রক্তহীনতাহেতু নীল হইয়া যাইত৷ পেঁচো কেন যে নীল তাহা বাহির করিতে পারি নাই৷ মামদোরাও কালো৷
ভূতের চেহারা
ভূতের বা পেত্নীর চেহারা কদাকার রং তো কালো, তাহার উপর চেহারায় কোনো লালিত্য নাই৷ সুপুরুষ ভূত আর কাঁটালের আমসত্ত্ব বা সোনার পাথরবাটি একই কথা৷ রাম দেখিতে খুব কদাকার এইজন্য রামের চেহারা বর্ণনা করিবার সময় বলি রামকে ভূতের মতন দেখিতে৷ ভূতের চোখ দুইটি ভাঁটার মতন, লাল গোল গোল—যেন কোটর থেকে ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতে চাহিতেছে৷ আমাদের মতন পদ্মপলাশলোচন বা অঞ্জননয়না নহে৷ ভাঁটা কাহাকে বলে আজকালকার ছেলেছোকরারা তো বটেই, অনেক বয়স্ক শহুরে লোকেও জানেন না৷ বড়ই দুঃখের বিষয়, এই না-জানাটাকেই তাঁহারা গৌরবের মনে করেন৷ অনেক শহুরে লোকের মতন তাঁহারা ধানগাছের তক্তা ও আফিমকাটের বাড়ি বলেন৷ এজন্য যদি ভাঁটা কাহাকে বলে বুঝাইবার চেষ্টা করি তো আপনারা রাগ করিবেন না, ধৈর্য ধরিয়া শুনুন৷ আমরা বাল্যকালে পাড়াগাঁয়ে ভাঁটা লইয়া খেলা করিয়াছি৷ ‘ছাঁদা’-মাটির গোল্লা—২ ৩ ইঞ্চি ব্যাস আগুনে পুড়াইয়া ইটের মতন লাল করা হইত৷ এই ভাঁটা দৈবাৎ কিনিতে পাওয়া যাইত সচরাচর তৈয়ারি করিয়া লইতে হইত৷ কুমোরবাড়ির ‘ছাঁদা’-কাদায় বড় বড় গোল্লা তৈয়ারি করিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া লওয়া হইত, তারপর কুমোর যখন ‘পোনে’ আগুন দিত সেই সময়ে পোড়াইয়া লওয়া হইত৷ ‘পোন’ ভাঙ্গিলে ছাই ঘাঁটিয়া ভাঁটা বাহির করা হইত৷
ভূতের চোখগুলা তো ভাঁটার মতন, দাঁতগুলা মূলার মতন লম্বা ও সাদা অন্ধকারেও দূর হইতে ঠাহর হইত৷ কশের পাশের দুইটি দাঁত আরো বড় বড়, হাতির দাঁতের ন্যায় সর্বদাই বাহির হইয়া থাকে৷ ভূতেরা নখ কাটিতে পায় না, এজন্য নখগুলি বাড়িয়া বড় বড়৷ আঁচড়াইয়া দিলে সারি সারি দাগ কাটিয়া রক্ত বাহির হয়৷ এজন্য ছোট ছেলেরা কাঁটা-বনে খেলা করিতে গেলে যদি সরু সরু সারি সারি ছড়ে যাওয়ার দাগ হইত তো বলিত ভূতে আঁচড়াইয়া দিয়াছে৷ কান দুইটি কচুপাতার মতন—মানুষের তুলনায়, গাধার তুলনায় খুব বড় বড়৷
ভূতের নাক চ্যাপ্টা খ্যাঁদা নাক৷ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় খ্যাঁদা ভূতের কথা বলিয়াছেন, ‘ইনি ভূতেদের মধ্যেও খ্যাঁদা’৷ এই খ্যাঁদা চ্যাপ্টা নাকের দরুন ভূতেরা খোনা খোনা কথা বলে—যেমন দেঁ-না, দেঁ-না, মাঁ-ছ খাঁ-বোঁ-ও, মাঁ-ছ, খাঁ-বোঁ-ও৷ নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলে, নাকিসুরে ফিড়িঙ, মিড়িঙ, পিঙ,… এই রকম শব্দ শুনা যায়৷ শাঁখচুন্নীরা যেন শাঁখের ভিতর ফুঁ দিয়া কথা বলিতেছে বলিয়া মনে হয়৷ অনেকটা ভোটের সময় চোঙ্গা-ফোঁকার মতন তফাত এই যে মোটা আওয়াজের বদলে নাকি সরু আওয়াজ৷ ভূতেরা খ্যাঁদা হইলেও পেত্নীরা নহে৷ নাকেশ্বরী ভূতিনীর (ইনি ভূতের পত্নী যখন নিশ্চয়ই পেত্নী) কথা আপনারা সকলে জানেন৷ নাকেশ্বরী ভূতিনীর নাক আড়াই হাত লম্বা কিন্তু তাই বলিয়া পেত্নীদের নাক অত লম্বা নয় তবে মানুষের তুলনায়, ভূতেদের তো কথাই নাই, নাক খুব লম্বা৷ আমরা যতদূর জানিতে পারিয়াছি তাহাতে পেত্নী, গুয়ে-পেত্নী ও শাঁখচুন্নীদের নাক গড়ে ৪ আঙ্গুল লম্বা৷ পেত্নীরা দীর্ঘ নাকের সাহায্যে এক ক্রোশের মধ্যে ইলিশ মাছ ভাজা হইলে তাহার গন্ধ পায় ও খাইতে ছুটে৷ জব্দ হইয়াছিল আমাদের পাড়ার নেড়ি গোয়ালিনীর কাছে৷ নেড়ি ইলিশ মাছ ভাজিতেছে, ছেঁচা ব্যাড়ার পাশে এক পেত্নী মাছভাজা খাইবার লোভে দেঁ-নাঁ এঁ-ক-টা দেঁ-নাঁ এঁ-ক-টা বলিতেছে৷ নেড়ি দিচ্ছি বলিয়া খুন্তী পুড়াইয়া হাতে ছ্যাঁকা দিয়াছিল৷ সেই থেকে নেড়িকে আর পেত্নীরা জ্বালাতন করিত না৷ একথা আমরা নেড়ির নিজমুখ হইতে শুনিয়াছি৷
ভূতের দেহ লিকলিকে প্যাঁকাটির মতন, হাত-পা খুব সরু সরু, যাকে বলে অস্থিপঞ্জর-সার৷ মাথাটা কিন্তু দেহের তুলনায় খুব বড়—যাকে বলে হেঁড়ে মাথা৷ এইজন্য হেঁড়ে মাথার ছেলেকে সহজে ভূতে পায়৷ ভূতেরা সাধারণত খুব লম্বা হইয়া থাকে তালগাছে পা ঝুলাইয়া বসিলে পা মানুষের গলাসমান ঝুলিয়া থাকে৷ ভূতের ‘গোড়-মুড়ো’টা কিন্তু উল্টানো৷ অর্থাৎ পায়ের আঙ্গুলগুলি পিছনদিকে থাকে, মানুষের মতন সামনের দিকে নহে৷ অনেক শিশু-পাঠ্য ভূতের গল্পের বইতে কিন্তু ভুল করিয়া পায়ের আঙ্গুল সামনের দিকে করিয়া ছবি ছাপা আছে—ইহাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভূতের সম্বন্ধে ভুল ধরণা হইবে এবং সর্বভারতীয় ভৌতিক পরীক্ষার বাচনিক অংশে ফেল করিবে৷ ইং ১৮৩০ সালে ছাপা এক ভূতের গল্পের বইয়ে ভূতের যে ছবি ছাপা আছে তাহাতে গোড়-মুড়া উল্টানো দেখানো আছে—এই বই অত্যন্ত দুর্লভ, কোনো পুস্তকাগারে নাই, আমাদের কাছে ইহার কয়েকটি ছেঁড়া পাতা আছে—আপনারা ইচ্ছা করিলে দেখিয়া যাইতে পারেন৷ ভূতেদের গোড়-মুড়ো যে উল্টানো তাহার আর একটি প্রমাণ হইতেছে যে তাহারা অতি নিঃশব্দে চলিতে পারে৷
ভূতেরা যে প্রস্রাব করে তাহার প্রমাণ পাইয়াছি৷ ইং ১৯৩০ সালের শীতকালে আমি ও আমার এক ভাই—ইনি বিজ্ঞান কলেজের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত অধ্যাপক, রাত্রি ৯ ১০টার সময় দাঁইহাট স্টেশনে নামিয়া, গরুরগাড়ি না পাইয়া, হাঁটাপথে বাশুলীর মিত্র-জমিদারবাবুদের বাড়িতে এক সরু মেটে জঙ্গলাকীর্ণ গলিপথ দিয়া হাঁটিয়া রওনা দিই৷ এক জায়গায় খুব ঘন বাঁশঝাড়, সেই বাঁশবনের মধ্য দিয়া যাইতেছি এমন সময়ে জামার উপর, গালের উপর জল পড়িল, ভয়ানক দুর্গন্ধ—ভূতের প্রস্রাব কিনা! দুষ্ট লোকে ভয় দেখাইতেছে মনে করিয়া টর্চ জ্বালাইলাম, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না পরে ভয় পাইয়া উচ্চৈস্বরে রামনাম করিতে ও চারিদিকে টর্চ ফেলিতে বাঁশঝাড়ের উপর লাফালাফি শুরু হইল—ভূতেরা পলাইতে লাগিল৷ বোধ হয় লেজ ছিল৷
পেত্নীদের নাকের কথা বলিয়াছি তাহারা দেখিতে কিরূপ সে সম্বন্ধে দুই-চারি কথা বলিব৷ ৬০ ৭০ বছর আগে ‘প্রতাপবোসের নীরি’ বলিয়া এক বিখ্যাত গায়িকা ছিলেন, ইনি ছিলেন কিন্নরকণ্ঠী৷ নাটোরের ছোট তরফের রাজা গোলকেন্দ্র ইঁহার গান শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া ইঁহাকে ‘‘বাঁধা’’ রাখিতে চাহেন, নীরি রাজি হয়েন নাই৷ পরে সরল মিত্র—যাঁহার পিতামহকে দেখিয়া বঙ্কিমবাবু বিষবৃক্ষে শ্রীশচন্দ্রের ছবি আঁকিয়াছেন—ইঁহাকে ‘বাঁধা’ রাখেন৷ এই নীরিকে নাকি পেত্নীর মতন দেখিতে—একথা সেকালের বহু বড় মানুষের, বড় মানুষদের মোসাহেবের ও মাহিনা-করা ওস্তাদদের মুখে—যাঁহারা নীরিকে বহুবার দেখিয়াছিলেন, তাঁহাদের মুখে বহুবার শুনিয়াছি৷ নীরিকে দেখি নাই, বহু অনুসন্ধানে নীরির ছবি বা ফটোও পাই নাই৷ পাইলে আপনাদের দেখাইতাম পেত্নী কিরূপ দেখিতে৷ পেত্নীরা দেখিতে অতি কদাকার৷
ভূতেরা (এক আলেয়া ছাড়া) কেহ জল ছোঁয় না, স্নান করে না—এজন্য কথায় বলে ‘‘গুলিখোর ভূত’’৷ আবগারী বিভাগের অত্যাচারে গুলিখোরের সংখ্যা কমিয়া যাইতেছে৷ গুলিখোরেরা স্নান করে না, পাছে নেশা কাটিয়া যায়৷ বাবা জগন্নাথ বছরে একবার স্নানযাত্রার দিন স্নান করেন—ফলে ১৪ ১৫ দিন জ্বর হয় পাকা গুলিখোরেরা বাবাকেও টেক্কা দিয়াছে৷ রূপচাঁদ পক্ষীর আড্ডার বিশুখুড়ো একজন সেকেলে পাকা গুলিখোর, তিনি বলিতেন, বিবাহের পর এই ৫০ ৬০ বছর স্নান করি নাই, যেদিন কাশীমিত্রের ঘাটে যাইব সেইদিন ছেলেরা জোর করিয়া স্নান করাইয়া দিবে৷ স্নানে শুধু যে নেশা কাটিয়া যায় তাহা নহে, দেহও পচিয়া যায়, যেমন আলনার দড়ি কতদিন টেঁকে, আর পাতকুয়ার দড়ি কত শীঘ্র শীঘ্র নষ্ট হয়৷ এই স্নান না করা বা জল না ছোঁয়ার দরুণ ভূতেদের গায়ে ভয়ানক দুর্গন্ধ৷ ভূতেদের গায়ে দুর্গন্ধ হইলেও, কেহ কেহ এমন কি পায়খানায় বাস করিলে—খুব বেশি দুর্গন্ধ বোধ হইলে ভূতেরা পলাইয়া যায়—এজন্য কথা আছে ‘গন্ধে ভূত পলায়’৷ কিরূপ দুর্গন্ধ হইলে ভূত পলায় তাহার একটি নমুনা দিব৷ রাসায়নিক পরীক্ষাগারের Kipp’s apparatus হইতে যে গন্ধ বাহির হয় তাহাতে ভূত পালায়, একথা কলেজে পড়িবার সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মুখে বহুবার শুনিয়াছি৷ তিনি যে একথা বলিয়াছিলেন, হয় না হয় জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন বাবু ও জ্ঞান মুখার্জীকে প্রশ্ন করিতে পারেন৷
ভূত তাড়াইবার তিনটি উপায় : (১) দুর্গন্ধে ভূত পালায়৷ (২) মন্ত্রপূত সরিষা পড়ায় দৌড় দেয়, আর (৩) মারের চোটে সরিয়া পড়ে৷ এই তিনটির মধ্যে সহজ হইতেছে গন্ধে ভূত ভাগানো৷
ভূতেদের চুল খোঁচা খোঁচা, শুয়োর-কুচির মতন ইহারা টেরি কাটিতে পারে না৷ পেত্নীরা এলোচুলে থাকে৷ মামদোদের মাথা কামানো, তবে দাড়ি আছে৷ কাহারও বুব্বুর দাড়ি, কাহারও নূর, কাহারও গালপাট্টা, আবার কাহারও চাপদাড়ি৷ দাড়ির রং হয় সাদা, না হয় ঘোর বাদামী৷ L’ Aumaine de Moude Mussulman নামক বিখ্যাত পত্রিকায় ফারসী বইয়ের আশেপাশে যেসব চিত্রবিচিত্র করা থাকে তাহা ছাপা হইয়াছিল৷ তাহা দেখিয়া আমরা মামদোদের দাড়ির বর্ণনা করিলাম৷
ব্রহ্মদৈত্যদের গলায় পৈতা—মোটা, সাদা ধবধবে, অন্ধকারেও ঠাহর হয়, মাথায় জটা, ঋষিতুল্য দাড়ি পায়ে ঘোঁড়তলা কাঠের খড়ম, খটাখট করিয়া চলেন, গোড়-মুড়ো উল্টানো নহে৷ এই বর্ণনা আমরা অধর মিত্রের মায়ের মুখে শুনিয়াছি, তিনি একহাতে গঙ্গামৃত্তিকা লইয়া বুকের ভিতর কাপড় চাপা দিয়া শিব গড়িয়া নিত্য গঙ্গাস্নান সারিয়া পূজা করিতেন বলিতেন দুই হাতে শিব গড়িলে বাঁ-হাত ঠেকিয়া শিবের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়৷
পিশাচদের মুখ গাধার মতন—গাধার মুখের চেয়ে লম্বা, সরু ও উল্টানো৷ অর্থাৎ পিছনদিকে মুখ ফেরানো৷ পায়ে ঘোড়ার ন্যায় ক্ষুর—লাফাইয়া লাফাইয়া চলে হেলিকপ্টারের মতন শূন্যে উঠিতে পারে ইহারা ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়িলে জিভ বাহির করিয়া খায়, চাটিয়া খাইতে পারে না৷ খুব রোগা৷ দেহের রং কালো, মুখের রং গাধার মতন৷ যাহারা বাপ-মাকে খাইতে দেয় নাই, তাহারাই নাকি মরিয়া পিশাচ হয়৷
পেঁচোর রং নীল, মাথাটা দেহের তুলনায় খুব বড়—একটি ছোট ছেলের মাথায় ধোবার বোঝা চাপাইলে যে রকম দেখিতে হয় সেই রকম৷ ছোট ছোট আঁতুড়ে ছেলেদের পেঁচোয় পাইলে তাহারা যে নীল হইয়া যায় তাহার কারণ পেঁচো স্বয়ং নীল৷ পেঁচো রক্তের ন্যাকড়ায় বাস করে, তখন খুব ছোট হইয়া থাকে৷
আলেয়া জলায় থাকে হাঁ করিলে দপ করিয়া আলো জ্বলিয়া থাকে, মুখ বন্ধ করিলে খপ করিয়া নিবিয়া যায়৷ ইহাদের দেহ কেহ দেখিতে পায় না, গায়ে একরকম বিশিষ্ট গন্ধ, সে গন্ধ বেশি নাকে যাইলে মানুষ অজ্ঞান হইয়া যায়, সময়ে সময়ে মরিয়াও যায়৷ ইহারা মানুষকে পথ ভুলাইয়া ঘোরাইতে ভালোবাসে, সহজে মারিতে চাহে না, তবে কখনো কখনো জলার পাঁকে ডুবাইয়া দেয়৷
যেসব শ্যাওলা-আগাছা-পূর্ণ দীঘিতে ‘‘জটে বুড়ি’’ থাকে, সে সব দীঘিতেও ইহারা থাকে৷ তবে জটে বুড়ির সঙ্গে ইহাদের কোনো সম্পর্ক নাই বলিয়াই মনে হয়৷
এবার কন্ধকাটার কথা বলিতেছি খালি মাঠে-ঘাটে ঘুরিয়া বেড়ায়, একেলা কাহাকেও পাইলে, বিশেষ করিয়া ছোট ছোট ছেলে, ধরিয়া খায়৷ ইহার এক মাটির মূর্তি দেখিয়াছি৷ হুগলী জেলার কামারকুণ্ডু রেল স্টেশনে নামিয়া মাইলখানেক দূরে এক বিলের ধারে৷ মূর্তিটি উচ্চতায় আন্দাজ ৩ ফুট, লিকলিকে হাত-পা, নখ খুব বড় বড়, মাথা নাই, কাঁধের উপরটা প্লেন, আমাদের যেখানে নাভিকুণ্ডলী সেখানে প্রকাণ্ড এক হাঁ, দাঁত বাহির করিয়া আছে, চোখ নাই, নাক নাই, কান নাই৷ জিজ্ঞাসা করিলাম এ কার মূর্তি, বলিল কন্ধকাটার৷ ধান-কাটা হইলে অনেকে ধান চুরি করে, এই মূর্তি ধান-ক্ষেতে বসাইয়া দিলে কন্ধকাটা চোরেদের তাড়াইয়া দেয়৷
চণ্ডুর শুধু মাথা আছে ঘরের কড়িকাটে মাঝে মাঝে আইসে৷ সহজে মাথাটিও দেখিতে পাওয়া যায় না, শুধু গলার স্বর শুনিতে পাওয়া যায়—যে কোনো মানুষের স্বর অনুকরণ করিতে পারে৷ চণ্ডু এইমাত্র আমার স্বর অনুকরণ করিল, একটু পরে হেঁড়েগলায় কথা বলিল, আবার খানিকক্ষণ বাদে চিঁচিঁ করিয়া ক্ষীণকণ্ঠে কথা বলিল৷ চণ্ডুকে নাকি সহজে পোষ মানাইতে পারা যায়৷ আমাদের পাড়ার ‘‘হাপু’’ খেলোয়াড় নিতাইয়ের এইরূপ একটি পোষা চণ্ডু ছিল৷ সে অনেকের স্বর অনুকরণ করিতে পারিত৷ কখনো তালগাছের মাথা থেকে, কখনো মাটির নীচে থেকে কথা বলিত৷
দানো নাকি মানুষের চেয়েও বড় তবে তাহাকে যে কেহ দেখিয়াছে একথা শুনি নাই৷ মড়ার উপর দানো বসিলে মড়া ভয়ানক ভারি হয়৷ কখনো কখনো মড়া খাটিয়ায় উঠিয়া বসে৷ দানো জ্যান্ত মানুষকে ধরে না৷ যেসব মানুষ মরিবার কালে ‘‘দোষ’’ পায়, তাহাদেরই খালি দানোয় পায়৷
কোনো কোনো ভূতের আবার শিং গজায়৷ এই শিং মাথার মধ্যখান দিয়া গজায়—এই শিং হরিণের শিংয়ের মতন ডাল-পালাওয়ালা নহে, মহিষের মতন বাঁকানোও নহে, গরুর শিংয়ের মতন—১১ ২ হাত খাড়া উঁচু৷ কারণ, ঠাকুমার পেয়ারের আহ্লাদি ঝি ও দিদিমার ঝি ‘‘আতর’’ (‘‘আতরের’’ একটা নিজস্ব নাম ছিল, দিগম্বরী বা নিস্তারিণী এই রকম একটা কিছু, দিদিমাকে সেই নাম ধরিতে নাই, তাই দিদিমা আদর করিয়া তাহাকে ‘‘আতর’’ বলিয়া ডাকিতেন) উভয়ের মুখ হইতেই শুনিয়াছি৷ যাহারা জীবৎকালে স্ত্রীর রোজগারে খায়, তাহারা মরিয়া ভূত হইলে এইরূপ বড় শিং গজায়৷
বেশির ভাগ মামদোর একটা গোঁজের মতন লেজ আছে৷ এই লেজ সাধারণত বেঁড়ে নেড়ি কুত্তার মতন গুটাইয়া রাখে৷ একবার যদি মানুষের ঘাড়ে চাপিয়া এই লেজ মাটিতে পুঁতিতে পারে, তাহা হইলে রোজার বাপের সাধ্য নাই যে তাহাকে তাড়ায়৷ একথা আমরা মুন্সী তামিজুদ্দীনের মুখে বহুবার শুনিয়াছি৷
ভূতের শক্তি
ভূতেরা সাধারণত খুব পরিশ্রমী হয় ভূত চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে না—একটা না একটা কাজ বা অ-কাজ করা চাইই চাই৷ গঙ্গাচরণ ময়রা বলিয়া একজন প্রসিদ্ধ ভূতের ওঝা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে কলিকাতায় বর্তমান ছিলেন—তাঁহার নামে শ্যামবাজার অঞ্চলে একটি রাস্তা আছে৷ শুনা যায় যে তাঁহার বসতবাটিতে পোষা ভূত ছিল ইহাদের তিনি একটা না একটা কাজে সর্বদাই নিযুক্ত রাখিতেন৷ কালক্রমে তাঁহার একটি বাড়তি ভূত জুটিল তাহাকে কাজে নিযুক্ত রাখিতে হইবে, এইজন্য তিনি উঠানে একটি বাঁশ পুঁতিয়া তাহাকে আদেশ দিলেন যে ওঠা-নামা করো৷ ওঠা-নামা শেষ হইলে তোমাকে অন্য কাজ দিব৷ সে ক্রমাগত ওঠা-নামা করিতে লাগিল৷
ভূতের নিজের কোনোও লাভ নাই এমন কাজও ভূত করিতে ভালোবাসে৷ এইজন্য ‘‘ভূতের বেগার খাটা’’ প্রবাদের সৃষ্টি হইয়াছে৷ ভূতের চেহারা লিকলিকে সরু কাঠির মতন হইলে কি হয়, খুব ভারি ভারি বোঝা—যাহা মানুষে তুলিতে পারে না, ভূতেরা অনায়াসে বহিতে পারে৷ এইজন্য ‘‘ভূতের বোঝা’’ কথার সৃষ্টি হইয়াছে৷
ভূত সাধারণত গাছে বাস করে একটি ভূত নিমগাছে থাকিত ও গৃহস্থকে জ্বালাতন করিত৷ ওঝা আসিয়া তাহাকে মন্ত্র দিয়া বাঁধিয়া বলিল, ‘কি হইলে তুই চলিয়া যাইবি?’ যে ভূত, সে মানুষ থাকা কালের নাম ও গোত্র বলিল, আর বলিল যে আমার নামে গয়ায় পিণ্ড দিলে চলিয়া যাইব৷ ওঝা বলিল, ‘কি করিয়া জানিব যে তুই চলিয়া গিয়াছিস?’ ভূত বলিল যে, আমি যাইবার আগে নিমগাছটি ভাঙ্গিয়া দিয়া যাইব৷ গৃহস্থ অনেক পয়সা খরচ করিয়া গয়ায় পিণ্ড দিলেন যেদিন পিণ্ড দেওয়া হইল সেদিন দ্বিপ্রহরে কোথাও কিছু নাই, হাওয়া নাই, ঝড় নাই, বৃষ্টি নাই, মড়মড় করিয়া প্রকাণ্ড নিমগাছটি ভাঙ্গিয়া পড়িল৷ এই নিমগাছের গুঁড়িটি দেড়হাত ব্যাসের—নিমকাঠ খুব শক্ত কাঠ—ইহা হইতেই বুঝিতে পারি যে ভূতের গায়ে কি জোর!
ভূতেরা খুব দ্রুত যাইতে পারে৷ মরিবার পর মানুষের জীবাত্মাকে যমদূতেরা যমপুরে লইয়া যায়৷ ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে আছে যে এখান হইতে যমালয়ের দূরত্ব ৯৯,০০০ হাজার যোজন৷ যমদূতেরা ভুল করিয়া যদি কাহাকেও লইয়া যায়, তাহা হইলে সে লোককে মৃত বলিয়া মনে হইবে৷ আর ফেরত দিয়া গেলে সে আবার বাঁচিয়া উঠিবে৷ যমদূতের এই যাতায়াতের জন্য মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দিগকে ১২ দণ্ড বা ১২ x ২৪ = ২২৮ মিনিট অপেক্ষা করিতে বলিয়াছেন স্মার্ত ভট্টাচার্য৷ যমদূতেরা মানুষের জীবাত্মাকে প্রতি সেকেন্ডে ৩৬ মাইল বেগে লইয়া যায় ও লইয়া আসে৷ জীবাত্মা যদি মরিয়া ভূত হয়, তাহা হইলে এই ভূতও অত দ্রুত যাইতে পারে৷ জেট-প্লেন ঘণ্টায় ৩০০ ৪০০ শত মাইল যায়—ভূতের গতির তুলনায় জেট-প্লেন গরুরগাড়িরও অধম৷
বাসস্থান
ভূত কোথায় থাকে? ভূত ও পেত্নী সাধারণত আশশেওড়া গাছের ডালে থাকে নিম, অশ্বত্থ প্রভৃতি গাছেও থাকে, বাঁশবনেও থাকে৷ কোনো কোনো ভূত তালগাছের মাথায় থাকে কিন্তু বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি বলিয়া নারিকেল গাছে থাকে না৷ মামদোরা খেজুরগাছের মাথায় থাকে৷ দৈবাৎ পোড়ো পাকা বাড়ি বা পাইখানা পাইলে সেখানে থাকে৷ গুয়ে-পেত্নীরা কিন্তু কুয়া-পায়খানায় থাকিতে ভালোবাসে৷ ব্রহ্মদৈত্যরা বেলগাছেই থাকিতে ভালোবাসে, কখনো কখনো অশ্বত্থ গাছে থাকে৷ পরশুরাম বলিয়াছেন যে পরিত্যক্ত ইট খোলায় ভূতেরা থাকেন—কিন্তু এইটে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বলিয়া মনে হয়৷ আমাদের দেশের শিবমন্দিরের কাছে একটা প্রকাণ্ড কনকচাঁপার গাছ আছে এই গাছে এক ব্রহ্মদৈত্য থাকেন রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর খড়ম-পায়ে খটাখট করিতে করিতে শিবমন্দিরের চারিদিক প্রদক্ষিণ করিতে ইঁহাকে অধর মিত্রের মা দেখিয়াছেন—এমন কি পূর্ণিমার রাতেও৷ যে অধর মিত্র পরে কাশীবাসী রামলিঙ্গস্বামী বলিয়া পরিচিত, যিনি পূর্বাশ্রমে নিজের অন্নদাতা, আশ্রয়দাতা, গৃহদাতা ননুবাবুকে ভুবনমোহিনীর কথায় বিষ দিয়াছিলেন ইহার একমাত্র পুত্র, আমাদের পঞ্চুদাদা, বিবাহের একমাসের মধ্যে দীননাথ ভট্টাচার্যের ব্রহ্মশাপে মরিয়া কলিকালেও যে ব্রহ্মশাপ ফলে প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন৷ ইনি কেবলমাত্র ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা বলিয়া এ্যাফিডেবিট করিয়া প্রকৃত সত্যকে এপিঠ-ওপিঠ করিতে পারিতেন৷ খসুদত্ত বলিতেন যে, অধর পারে না এমন কাজ পৃথিবীতে নাই৷
আলেয়ারা জলায় থাকে, কুনী-বুনীদের কুনী ঘরের কোণে ময়লা, ঝুল, মাকড়সার জাল, ধুলো পাইলে সেখানে থাকেন আর বুনী গৃহস্থবাড়ির আনাচে-কানাচেতে ভাঁটগাছ, শেয়ালকাঁটা, মুক্তকেশী, বনকচু প্রভৃতি আগাছার বনে ছেঁড়া ন্যাকড়া, ছেঁড়া চুল, ভাঙা কুলা, ভাঙা ধুচুনি প্রভৃতি পড়িয়া থাকিলে সেখানে থাকেন৷ ইঁহারা দুই বোন৷ বুনীর ছেলে হইলে ভট্টাচার্য মহাশয়কে ডাকিয়া বলিলেন, ‘‘কুঁনীকে বঁলবেঁ বুঁনী�র ছেঁলেঁ হঁইয়াঁছে৷’’ ভট্টাচার্য ভয় পাইয়া গিন্নীকে এই কথা বলিলে কুনী ঘরের কোণ হইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘কঁয় দিঁবস?’’ কঁয় দিঁবস?’’ ভট্টাচার্য অজ্ঞান হইয়া গেলেন৷
ভূতেরা আগে শ্মশানে-মশানে থাকিত বিশেষ করিয়া যদি কাছেপিঠে নিমগাছ, অশ্বত্থগাছ প্রভৃতি থাকিত৷ এখন শ্মশানে এমন কি পাড়াগাঁয়ের শ্মশানেও রাত্রিতে আলো জ্বলে৷ এইজন্য নিমতলা, কাশীমিত্র, কেওড়াতলা, রতনবাবুর ঘাটে ভূত নাই৷ মশান তো উঠিয়া গিয়াছে৷ ভূতেরও থাকিবার কষ্ট হইতেছে৷ তাহারা আজকাল ভালো-মানুষ বা মানুষী সাজিয়া মানুষের ঘাড়ে ভর করিতেছে৷
ভূতের ধর্মবিশ্বাস
ভূতদের অপর নাম অপদেবতা, এইজন্য ইঁহারা হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতাকে গ্রাহ্য করে না৷ কিন্তু হিন্দুর তিন প্রধান দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্যে ইঁহারা শিবের ভক্ত৷ শিব ভূতেদের পালন-সংরক্ষণ করিবার ভার নন্দী ও ভৃঙ্গীর উপর ছাড়িয়া দিয়াছেন৷ নন্দী বা ভৃঙ্গী ইঁহারা স্বয়ং কেহই ভূত নহেন৷ নন্দী পূর্বে দধীচি মুনির শিষ্য ছিলেন৷ শিবমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া ক্রমে একজন প্রধান শিবভক্ত হইয়া উঠেন৷ ইনি একদা স্বীয় গুরুসহ দক্ষালয়ে যায়েন দক্ষের মুখে শিবনিন্দা শ্রবণ করিয়া দক্ষকে ছাগমুণ্ড হইবে বলিয়া শাপ দেন৷ পরে ইনি শিবের প্রধান অনুচর হয়েন, এবং দক্ষযজ্ঞ নাশের সময় বীরভদ্রকে সাহায্য করেন৷ ইনি শিবের কাছে যে সব ভূত, প্রেত, দানা, দৈত্য ইত্যাদি থাকে তাহাদের নিত্য সিদ্ধিপানের ব্যবস্থা করিয়া থাকেন৷
ভৃঙ্গী পূর্বে অন্ধকাসুর ছিলেন মহাদেবের বরে ভৃঙ্গী-নামে তাঁর অনুচর হয়েন৷ একবার মা-দুর্গার কথা না শুনায় মা-দুর্গার শাপে বানর-মুখ হয়েন৷
বাংলা দেশে বহু দেবোত্তর আছে, কিন্তু কোনো ভূতোত্তর নাই৷ উত্তরপ্রদেশে কিন্তু ভূতোত্তর আছে৷ একবার এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই প্রশ্ন তোলা হয় যে, ভূত যখন দেবতা নয়, তখন ভূতোত্তর অসিদ্ধ৷ জজেরা কিন্তু ভূতোত্তর সিদ্ধ বলিয়া সাব্যস্ত করেন৷
ভূতেরা কিন্তু রামনাম সহ্য করিতে পারে না৷ রামনাম শুনিলেই দূরে পালায়৷ ঠিক কি কারণে পালায় জানি না তবে মনে হয় ইহাদের সমগোত্রীয় রাক্ষসদের রামচন্দ্র নিধন করিয়াছিলেন বলিয়া ভয়ে পালায়, কি জানি যদি আমাদেরও নিধন করেন৷
ভূতেদের কতকগুলি prejudice আছে৷ সবগুলি জানি না—যেমন আলো ভালোবাসে না, লোহা ছুঁইতে পারে না, হলুদ পোড়ার গন্ধ সহ্য করিতে পারে না, গঙ্গাজল ছুঁইতে বা ডিঙ্গাইতে পারে না তুলসীগাছের সাত হাতের মধ্যে থাকে না৷ পরশুরাম গঙ্গার পূর্ব-পারের পানিহাটির ভূতকে গঙ্গাপার করাইয়া রিষড়া-কোন্নগরে লইয়া গিয়াছেন৷ খুব সম্ভব এইসব ভূত নৌকা করিয়া বা হাঁটিয়া বিবেকানন্দ ব্রিজ দিয়া পার হইয়াছিল৷
ভূতের সম-শ্রেণী বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী
চণ্ডীর দেবী কবচে আছে যে দেবী কবচ পাঠ করিতে কুলজা, মালা, ডাকিনী, শাকিনী, ঘোরা, অন্তরীক্ষচরা উপদেবতা, মহারথা ডাকিনী, গ্রহ, ভূত, পিশাচ, যক্ষ, রাক্ষস, ব্রহ্মদৈত্য, বেতাল কুষ্মাণ্ড ও ভৈরব প্রভৃতিরা ক্ষতি করিতে পারে না৷ আমরা ইঁহাদের সকলকে ভূতের সমশ্রেণী বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী বলিতে পারি৷ রাক্ষসের কথা উঠিলে খোক্কোসের কথা মনে পড়ে—তামিল, তেলেগু, হিন্দিতে খোক্কসের প্রতিশব্দ নাই৷ ইনি খাঁটি বাঙালি৷ বেতালের কথা উঠিলে বিক্রমাদিত্যের তালবেতালের কথা মনে পড়ে, ‘তাল’ও একরকম উপ-দেবতা৷ মা-কালীর কাছে ডাকিনী-যোগিনীরা থাকেন৷ যোগিনীদের সম্বন্ধে যোগিনীতন্ত্র আছে৷ যক্ষর কথা উঠিলে কিন্নরদের কথা মনে পড়ে৷ মা ছিন্নমস্তার এক পার্শ্বে আছেন বর্ণিনী৷ এ ছাড়া আছেন অসুরগণ জ্বরাসুর ইঁহাদের একজন৷ ইনি দেখিতে কিরূপ সে সম্বন্ধে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বর্ণনা আছে৷ যথা :—
‘‘সর্বরোগমধ্যে জ্বর অতি ভয়ঙ্কর৷
সেই জ্বর শিবভক্ত অতি অসুন্দর৷৷
তিনপাদ ছয় হস্ত নয়টি লোচন৷
কালান্তক যমসম বিকট নিষ্ঠুর ৷৷
বায়ু পিত্ত কফ আর ত্রিদোষজ জ্বর৷
চতুর্বিধ রোগে প্রাণী ভোগে নিরন্তর৷৷’’
তবে আজকাল হেমচন্দ্র বলিয়াছেন—
দেবতা অসুরগণ ক্রমে হয় অদর্শন
ঈশ্বরেরই সিংহাসন উঠিতেছে টলিয়া৷
তাই ইঁহাদের বড় একটা দেখা যায় না৷ দেখিতে না পাইলেও ইঁহারা আছেন৷ ভূতেদেরও সেই অবস্থা৷ আগে ভূতের উৎপাত প্রায়ই শুনা যাইত, আজকাল প্রায় ঘরে ঘরে ভূত, তথাপি ভূতের উৎপাতের কথা যে শুনিতে পাওয়া যায় না, তাহার কারণ ঘরের কেচ্ছা সহজে কেহ প্রকাশ করিতে চাহে না৷ ভূতের উৎপাতের কথা কমিলেও ভূতের সংখ্যা কমে নাই৷
***
১৩৬৯ সালের ফাল্গুন সংখ্যার কথাসাহিত্য হইতে পুনমুদ্রিত৷