ভূতেরা এল কলকাতায়

ভূতেরা এল কলকাতায়

ভূতবংশী গাছের জঙ্গল হয়ে আছে ওদিকটায়। তাই দিনেরবেলাতেও জায়গাটা একদম কুটি হয়ে থাকে। আকাশ মেঘলা হলেও যা, মেঘ ফুঁড়ে গনগনে রোদ উঠলেও তাই। থমথমগড়ের ওদিকটায় তাই বিশেষ কেউ যায় না।

আর থমথমগড়ের কথাই যদি বলো, সে গ্রামে হাই স্কুল তো দূরের কথা, একটা প্রাইমারি স্কুলই নেই। হাসপাতাল তো নেই-ই। এ গ্রামের যে দু-একজন পড়াশুনো করে, তাদের যেতে হয় চার কিলোমিটার দূরের গরলগাছি হাই স্কুলে।

গ্রামে লোকজনও বড্ড কম। মাত্র বিশ-পঁচিশ ঘর মানুষের বাস। কারও টালির ঘর, কারও বা খড়ে-ছাওয়া। সকলেই বড়ো গরিব। কারও বাড়ির সামনে একচিলতে উঠোন আছে কি নেই। কিন্তু সেখানে দ্যাখো, তিন-চারটে ভূতবংশী গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

ভূতবংশী গাছ হয়তো অনেকেই চেনে না। কিন্তু গাছটাকে চেনা মোটেও কঠিন নয়। গাছটা অনেকটা নিম গাছের মতো দেখতে। নিম গাছের মতো লম্বাও হয়। তার পাতাগুলো কিন্তু খাঁজকাটা ছোটো ছোটো পাতা নয়। ঠিক কদম গাছের পাতার মতো, অমন বড়ো বড়ো আর ঢলঢল। আম গাছে যেমন মুকুল আসে, ওরকম দেখতে সে গাছে মুকুলও আসে। তবে কেউ সে গাছে কখনও ফল ফলতে দেখেনি কোনোদিন। তাহলে গোটা গ্রাম জুড়ে অত নতুন ভূতবংশী গাছ হয় কী করে? সে এক অচানক প্রশ্ন। কিন্তু আশপাশের অন্য কোনো গ্রামে সে গাছ জন্মায় না।

লোকে বলে, ওই যে ঢ্যাঙা, রোগা, সুপুরি গাছের মতো দেখতে লোকটা থাকত থমথমগড়ে, লোকটার নাম ছিল নিবারণ সামুই। মৈনাক কখনও সখনও লোকটাকে ডাকলে ‘নিবারণদাদু’ বলেই ডাকত। মাথার নারকেল দড়ির মতো লালচে চুলে সাত জন্মে তেল পড়ত না। লোকটা কখনও চানটানও করত কিনা কেউ জানে না। একটা ফতুয়া আর হলদে রঙের তাপ্পিমারা পাজামা পরে খালি পায়ে সন্ধ্যের পর থেকে অমন বাঁইবাঁই করে হেঁটে বেড়াত গোটা থমথমগড়। গলায় নীল-কালো ইলেকট্রিকের তার ডাক্তারদের স্টেথোস্কোপের মতো ঝুলতে থাকত অকারণে।

তার গায়ের কাছে কেউ বিশেষ যেত না। ভয় বা অন্য কোনো কারণে নয়, একটা বিটকেল গন্ধ সব সময় ভেসে আসত তার গা থেকে। দু-একবার নিবারণদাদুর গায়ের কাছে গিয়ে দেখেছে মৈনাক, বিটকেল গন্ধের ব্যাপারটা গল্পকথা নয়, একদম সত্যি! ভূতবংশী গাছের একটা চারা নাকি নিবারণদাদু কোথাও থেকে এনে লাগিয়েছিল থমথমগড়ে।

এখন সে গাছটা একটা মহাবৃক্ষ! ক-বছর হল নিবারণদাদু মারা গেছে। কেউ বলে অপঘাতে মারা গেছে। কেউ বলে ভূতই টেনে নিয়ে গেছে তাকে। কেননা, লোকে বলত, নিবারণদাদু নাকি ভূত কেনাবেচার ব্যাবসা করত। কোথা থেকে ভূত কিনত আর কোথায়ই বা ভূত বেচত, কে জানে? তার খদ্দেরই বা কারা ছিল, সে খবর কেউ বলতে পারে না।

তবে এই কিছুদিন ধরে খুব কাছ থেকে নিবারণদাদুকে দেখছে মৈনাক। ওসব কথা তার এখন সবই গল্পকথা বলে মনে হচ্ছে।

কেন, মৈনাক নিবারণদাদুকে কাছ থেকে দেখছে কী করে? নিবারণদাদু মারা যাওয়ার পর, সকলে যেমন ভূত হয়ে যায়, নিবারণদাদুও তো কবেই ভূত হয়ে গেছে! মানুষ তো চোখে ভূতকে দেখতে পায় না। কথাটা ঠিক। কিন্তু কিছুদিন হল, কালনাগিনীর কামড়ে মারা যাওয়ার পর থেকে মৈনাকও যে ভূত হয়ে গেছে! তার থাকার জায়গা হয়েছে ওই ভূতবংশী মহাবৃক্ষে। ভূতবংশীর দুটো গা ছোঁয়াছুয়ি করা ডালেই তো আছে মৈনাক নিবারণদাদুর সঙ্গে। অমন ঝাঁকড়া ভূতবংশী গাছের অগুনতি পাতার মতো অগণন ভূতও থাকে ওই গাছে।

অত ভূতের সঙ্গে একদম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হয় মৈনাককে। সেই ভূতেদের মধ্যে পুব পাড়ার দেবেন সামন্তর ভূত যেমন আছে, নীরদা ঠাকুরমার ভূতও তেমনই আছে। আবার নিশা, যে-মেয়েটা মৈনাকদের পাড়ার পুকুর থেকে গুগলি তুলে বাজারে বিক্রি করতে যেত, একদিন ফেরার সময় বাজ পড়ে মারা গিয়েছিল। পুবদিকের নীচু হয়ে থাকা একটা ডালে নিশার ভূতকেও পলকের জন্যে একদিন দেখেছে মৈনাক।

শুধু তার ভূতই বা কেন, কাল অনেক রাতে মৈনাক স্পষ্ট দেখেছে কেদার শর্মার ভূতকেও। ওই যে, যে কেদার শর্মা মহকুমা শহরে মোটরবাইকে মরণকুয়ার খেলা দেখাতে দেখাতে বাইক নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গিয়েছিল!

তবে নিবারণদাদুর ওই ভূত কেনাবেচার ব্যাপারটা এখনও পুরোটাই ধোঁয়াশা হয়ে আছে মৈনাকের কাছে।

হ্যাঁ, রাত যখন গভীর হয়, যখন খুব ঘুম-ঘুম পায় মৈনাকের, তখন কিছু কিছু আবছা কথাও কানে ভেসে আসে। পরে ভোররাতে ঘুমটা যখন শীতের কুয়াশার মতো ফিকে হয়ে আসে, তখন টুকরো টুকরো মেঘের মতো সেইসব কথাগুলো জুড়ে-জুড়ে সাজিয়ে দেখেছে মৈনাক। হ্যাঁ, প্রতি রাতে নতুন নতুন কারা যেন আসে নিবারণদাদুর কাছে। মনে হয়, দরদাম চলে সারারাত ধরে। নাকি কে, কোথায় থাকবে এই নিয়ে বচসা হয়? গরলগাছি হাই স্কুলের ছেলেদের কাছি টানাটানি খেলার মতো নানা কথার টানাটানি চলতে থাকে সারারাত।

তবে তারা সকলেই সম্ভবত ভূতই হবে। না হলে তাদেরও গা থেকে অমন বিচ্ছিরি গন্ধ ভেসে আসে কেন? আবার এ কথাও হলফ করে বলতে পারে মৈনাক, যারা আসছে, তারা সব নতুন ভূত। এমন ভূত পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে দেখা যায় না। তারা যে কোথা থেকে আসছে, এখনও সবটা টের পায়নি মৈনাক।

তবে মৈনাক যখন মানুষ ছিল, গরলগাছি হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ত, তখন সকলের কাছ থেকে একটা কথাই সে শুনে এসেছে, মানুষকে চেনা বড়ো কঠিন। কে যে কী করে, কে যে কার শত্রু, কে যে কার মিত্র, সহজে চেনা যায় না। ভূতের বেলা সে ব্যাপারটা হয়তো আরও কঠিন!

একা নিবারণ সামুই মৈনাকদের গ্রামে দাপিয়ে বেড়াত। কেননা, তাকে বারণ করার মতো লোক একটাও থমথমগড়ে ছিল না। টাকাপয়সার দেমাক বললে, গোটা গ্রামে কিছুটা অর্থ তারই ছিল। তার যে কোথা থেকে আয়-উপায় হত, কেউ বলতে পারত না। তার কোমরে একটা তবিল থাকত সব সময়। তার মধ্যে দুমড়ানো মোচড়ানো একশো টাকার নোটগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমিয়ে থাকত, তা কেউ কেউ দেখেছে। আর থাকত কয়েকটা রুপোর টাকা। কোথা থেকে যে সে ওই রুপোর টাকাগুলো পেয়েছিল, কেউ জানে না। শুধু ঝনঝন শব্দ শোনা ছাড়া কেউ সেই রুপোর টাকাগুলো চোখেও দেখেছে, এমন লোক গোটা থমথমগড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অনেকে বলত, ‘ওগুলো এমনও হতে পারে, সব ক-টাই নকল টাকা। ওসব নিবারণের যত ফক্কিকারি। নিবারণ আবার রুপোর টাকা পাবে কোথা থেকে?’

তবে নিবারণদাদু যখন হাঁটত, তখন তার তবিল থেকে ঝনঝন করে শব্দ ভেসে আসত। সেই ঝনঝন শব্দটা এখনও স্পষ্ট কানে বাজছে মৈনাকের।

তা বাজুক! কিন্তু মৈনাক এখন দেখছে, এখানে নিবারণদাদুরই দেমাক সবচেয়ে বেশি। কেউ চেষ্টা করেও তাকে টেক্কা দিতে পারে না। তাই কেউ তার মুখের উপর কথাও বলে না। নিবারণদাদু যা বলে, সকলেই চুপ করে মেনে নেয়।

আজ তিনদিন হল, একটি মেয়ে-ভূত এসেছে ভূতবংশী মহাবৃক্ষে। সে দুমদাম করে নানা কথা বলে দিচ্ছে নিবারণদাদুর মুখের উপর। এ কী রে বাবা! সে জানেই না যে, বড়োদের মুখের ওপর অমন করে কথা বলতে নেই! কোথাকার ভূত সে কে জানে!

তার নামটাও ভারি অদ্ভুত, একদম ইংরেজি ঘেঁষা, অ্যারাবেলা। এটা আবার কোনো নাম হল নাকি? শেফালি, নয়নতারা, কুসুম, এমন কত নাম থমথমগড়ের মেয়েদের। কিন্তু কই, এই নামে থমথমগড়ে তো একটাও মেয়ে নেই। কী সব সাতপাঁচ ভেবে মৈনাক তার সঙ্গে আর ভাব করতে যায়নি।

গতকাল মৈনাক গভীর রাতে ভূতেদের মধ্যে কানাঘুষো শুনেছে, এই যে মেয়ে-ভূত অ্যারাবেলা ভূতবংশী গাছে এসেছে, নিবারণদাদু তাকে ডেকে এনেছে বলে সে এসেছে। এও কানাঘুষো শুনেছে, অ্যারাবেলাকে কোথাও নাকি পাঠাতে চায় নিবারণদাদু। তাকে কারও কাছে বিক্রি করে দিতে চায় নিবারণদাদু, নাকি কোনো কাজে কোথাও পাঠাতে চায়, সে কথা এখনও কুয়াশায় ঢাকা হয়ে আছে।

তবে অ্যারাবেলা নাকি অতলান্তিক মহাসাগর নিজের চোখে দেখেছে। আর দেখবে না-ই বা কেন? সে নাকি থাকত অতলান্তিক মহাসাগরেরই মাঝখানের একটা ছোট্ট দ্বীপে। মৈনাকের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ো হবে হয়তো।

একথা শোনার পর আজ সকাল থেকে অ্যারাবেলার সঙ্গে ভাব করতে ইচ্ছে করছিল তার। কারণটা আর কিছুই নয়, তার কাছ থেকে অতলান্তিক মহাসাগরের অনেক গল্প শুনবে। সকাল থেকে আর সে সুযোগ হয়নি। দুপুরবেলা যখন ভূতেরা সব ঘুমে কাদা, তখন অ্যারাবেলার গায়ের কাছে উড়ে গিয়ে ফস করে কথাটা বলে ফেলল মৈনাক, ‘তোমাদের গ্রামের নাম কী ছিল গো?’

অ্যারাবেলা ঘুম-ঘুম চোখটা একটুখানি ফাঁক করে বিচ্ছিরিভাবে হেসে বলল, ‘দূর, ওটা গ্রাম হতে যাবে কেন? ওটা তো দক্ষিণ অতলান্তিকের মাঝখানের একটা দ্বীপ! আমাদের দ্বীপের নাম সেন্ট হেলেনা!’

মৈনাক অবাক গলায় বলল, ‘বা:! বেশ সুন্দর নাম তো! তবে তোমাদের দ্বীপে শুধু মেয়েরাই থাকে নাকি? কেমন যেন মেয়ে-মেয়ে নামটা?’

‘আমাদের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে প্রথম দিকে একটাও লোক থাকত না। তার অনেক পরে তো লোকজন হল। তবে আমি তোমাকে বলি, ভূত হওয়ার আগে আমি ব্রিটেনে থাকতাম। তারপর কেমন করে যে ভূত হলাম, এখন আর সেসব কথা মনে পড়ে না। সে শ-পাঁচেক বছরেরও বেশি তো হবেই। অতদিনের কথা কি আর মনে থাকে? একদিন পোর্তুগিজদের একটা জাহাজ অতলান্তিকের দিকে যাচ্ছিল। আমি অমনি শাঁ করে উড়ে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসলাম জাহাজটার একেবারে মাস্তুলে। তাদের সঙ্গেই তো চলে এসেছিলাম সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। সেই থেকে দ্বীপের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম।’

মৈনাক গালে হাত দেওয়ার মতো করে বলল, ‘তুমি তো বেশ মেয়ে! তোমার একটুও ভয় করত না অমন ফাঁকা দ্বীপে ঘুরে বেড়াতে?’

অ্যারাবেলা পিটপিট করে মুচকি হাসল। তারপর বলল, ‘বুঝতে পারছি, তুমি সবে ভূত হয়েছ, না? তাই জানো না! ধুস, ভূতেদের আবার ভয় করে নাকি?’

একটা কথা মৈনাক বলতে গিয়েও বলল না। কথাটা হজমি গুলি গিলে নেওয়ার মতো করে পেটে চালান করে দিতে গিয়ে বলেই ফেলল কথাটা, ‘তুমি এখানে কী করে এলে? কার কাছে এই ভূতবংশী গাছের খবর পেলে?’

অ্যারাবেলা বলল, ‘কেন, ওই যে তোমার ভূতদাদু, ওই নিবারণদাদুই তো একদিন ডেকে পাঠাল আমাকে।’

নিবারণদাদু অ্যারাবেলাকে ডেকে পাঠাল কেন, সে প্রশ্নের উত্তর নিজে নিজে খুঁজে পেল না মৈনাক। তারপর বলল, ‘তোমার তা হলে বয়স তো অনেক হল?’

‘ভূতেদের আবার বয়স বাড়ে নাকি?’ বলে হি হি করে হেসে নিল খানিক। তারপর বলল, ‘তোমাকে একদিন সব বুঝিয়ে দেবখন, ভূতেদের কী কী জিনিস চিরদিন থেমে থাকে, কখনও একটুও বাড়ে না। সেসব পরে শুনে নিয়ো আমার কাছ থেকে। যে কথা বলছিলাম, আমাদের সেন্ট হেলেনায় একটা পাহাড় আছে। আমি সেই পাহাড়ের উপর থাকতাম। মেঘের সঙ্গে গল্প করতাম। রোদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতাম। কত কত দিন রামধনুর পিঠে উঠে নাগরদোলা চড়তাম।’

মৈনাক তেমনই থ’ হয়ে শুনছিল অ্যারাবেলার কথা। মেয়েটা কথা বলে বেশ ভালো। গলাটাও খুব মিষ্টি! বলল, ‘তোমার সেই পাহাড়টার নাম কী?’

‘একটাই মাত্র পাহাড় ছিল। সেই পাহাড়ের নাম ব্লু-হিল!’ তারপর একটু চুপ করে থাকার পর অ্যারাবেলা বলল, ‘জানো তো, আমি নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে খুব কাছ থেকে দেখেছি?’

এই ‘নেপোলিয়ন’ কথাটা যেন মৈনাকের খুব শোনা শোনা লাগল। কোথায় যেন শুনেছে কথাটা? হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ইতিহাস বইয়ে লোকটার কথা ছিল বটে! লোকটা খুব বড়ো যোদ্ধা ছিল। অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল মৈনাক, ‘তুমি কী করে দেখলে তাঁকে?’

‘ও মা, দেখব না কেন? নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল না? ওখানে খুব কষ্টে দিন কাটত নেপোলিয়নের। তারপর তো এক কঠিন অসুখ হল, ওখানেই মারা গেলেন। আমি সেদিন কী ভেবে যেন ওদিকেই ঘুরতে গিয়েছিলাম কিনা! নেপোলিয়নের মৃত্যু আমার নিজের চোখে দেখা!’

মৈনাক অ্যারাবেলার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ধুস, ওই নেপোলিয়নটন সব তোমার বানানো গল্প! মৃত্যু আবার চোখে দেখা যায় নাকি?’

তক্ষুনি শিরশির করে এমন একটা বাতাস বইতে শুরু করল যে, থম মেরে গেল চারপাশটা। একটা রাতজাগা পাখি কোঁ-ক্কো কোঁ-ক্কো করে ডেকে উঠল ভূতবংশী গাছের মগডালের দিক থেকে।

অমনি শাঁ করে ভূতবংশীর একদম মগ ডালটা নড়ে উঠল যেন। মৈনাক অন্ধকারে সেদিকে তাকাতেই দেখল, ওমা, এও তো একটা নতুন ভূত! একে তো কই আগে ভূতবংশী গাছে দেখিনি? উঁচু ডাল থেকে সাঁৎ করে নেমে এল ধুমসো একটা ভূত। তাকে দেখে গা ঘিনঘিন করে উঠল মৈনাকের। ছেঁড়া, ময়লা জামাকাপড় পরা। বিচ্ছিরি গন্ধে কেউ কাছে যেতে পারবে না। লোকটা তেমন লম্বাও নয়, আবার বেঁটেও বলা যাবে না। একমুখ দাড়ি। মাথায় এক-জন্মের না-কাটা চুল। নখগুলোও কতদিন যে কাটেনি, কে জানে! দাঁতগুলো হলুদ পাথরের মতো দেখতে।

ধুমসো ভূতটা নীচে নেমে এসেই বলল, ‘আমি মৃত্যুর চেয়েও একটা ভয়ংকর জিনিস দেখেছি! তার কাছে মৃত্যু তো কিছুই নয়, একটা ফ্যালনা জিনিস!’ বলে সে ভূতবংশী গাছের একটা মোটা ডাল বেশ জব্দ করে ধরল। তারপর বলল, ‘আমি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে সমুদ্রে পাহাড়ের মতো উঁচু আগুনের গোলা দেখেছি।’

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথাটাও খুব আবছা শোনা মনে হল মৈনাকের। ক্লাসে এক অঝোর বৃষ্টির দিন স্যার ছুটি না দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ পড়া নয়। আজ হবে রহস্যের ক্লাস।’ বলে সেদিন যে গল্প বলেছিলেন, সেই গল্পে ওরকম একটা কথা ছিল বটে, মনে পড়ে গেল মৈনাকের।

মৈনাক গলা তুলে বলল, ‘তা তুমি অত দূর থেকে যে এখানে এলে, এই ভূতবংশী গাছের খোঁজ পেলে কীভাবে?’

ধুমসো ভূতটা বলল, ‘আমি খুঁজে মরিনি। আমাকে তোমাদের নিবারণদাদু ডেকে এনেছে, কী না কী দরকার পড়েছে বলে। কী দরকার এখনও শোনা হয়নি।’

‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আগুনের গোলার গল্পটা বলো না শুনি! মনে হয় ওই গল্পটা আমার শোনা!’

ধুমসো ভূত রেগে গেল খপ করে, ‘আরে, তুই তো ভারি বিচ্ছু! এটা গল্প হতে যাবে কোন দুঃখে? এ আমার নিজের চোখে দেখা!’

তখনই অ্যারাবেলার দিকে একটু সরে গেল মৈনাক। এ ভূত হলেও কী হবে, এর তাকানোটা বেশ খারাপ, গুণ্ডা লোকেদের মতো। গুণ্ডা না হলেও ছেলেধরাটরা টাইপ তো হবেই।

অ্যারাবেলা নাক উঁচু করে বলল, ‘বলো না, শুনি কেমন সেই গল্পটা?’

ধুমসো ভূত বিচ্ছিরিভাবে হাই তুলল প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে। মৈনাক ভাবল, কেউ ভূত হলে কি তার হাই তোলাগুলোও কি ওরকম লম্বা হয়ে যায় নাকি? একদিন সে মিছিমিছি হাই তুলে দেখবে, তার হাইও এমন লম্বা হয় কিনা!

ধুমসো-ভূত বলল, ‘আরে সে এক আজবতাজ্জব কান্ড! আমি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথা শুনেছিলাম আর-একজন ভূতের মুখে। সেই ভূতটা রোজই ওই সব গল্প বলে আমাকে ভয় দেখাত। সেদিন ভাবলাম, যাই একবার ওদিকে। কী থেকে যে কী হয়, গিয়ে একবার নিজের চোখে দেখে আসি। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। অতলান্তিক মহাসাগর কি এইটুকুনি? তার উপর দিয়ে উড়তে বেশ লাগছে। ঝড়মড় করে ঝড় বইছে। পাহাড়ের মতো ঢেউ উঠছে।’ মৈনাকের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘অনেকটা তোমাদের রথের মেলায় বাচ্চা ছেলের হারিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ হচ্ছিল আমার?’ বলে লোকটা চুপ করে গেল।

মৈনাক আর অ্যারাবেলা আন্দাজ করতে পারছে না, এরপর কী বলবে ধুমসো ভূতটা। তাকাল অ্যারাবেলার দিকে। তারপর সে বলল, ‘আমি আসলে নাবিক ছিলাম। আমাদের ছোটো জাহাজটার নাম ছিল মারিয়া ক্যারোলিনা। তাতে করে আমরা একটা ছোটো দল তৈরি করে প্রায়দিন সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতাম। সেবার অমন মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। তারপর উঠল ভয়ানক ঝড়। সে ঝড়ে সমুদ্র-টমুদ্র কিচ্ছু ঠাহর করা যায় না। তখন আমরা একেবারে অতলান্তিকের মাঝ সমুদ্রে।’

বলেই থম মেরে গেল ধুমসো ভূত। মৈনাক আর অ্যারাবেলাও চুপ। শুধু শনশন করে হাওয়া বইছে। নিশুত অন্ধকার বললে কম বলা হয়। এটা কী মাস মনে করতে পারল না মৈনাক। একবার মনে হল, এটা জানুয়ারির শেষ হবে। তারপর মনে হল, না। এটা মার্চ মাসই হবে। না হলে এত গরম পড়েছে কেন? হয়তো আগস্ট মাসও হতে পারে। তবে এবার আগে আগে কেন যে ভূতবংশী গাছে এত ফুল ফুটেছে কে জানে? কালবৈশাখী না এলে তো আগে ভূতবংশী গাছে মুকুলই ধরত না। ওদের গ্রামে কে যেন বলেছিল, এখন সব কিছুই বদলে যাচ্ছে। বর্ষা আসে চলে যাওয়ার সময়। বসন্ত আসে এক-মেঘ কালবৈশাখী নিয়ে। এসব ভেবে কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিল মৈনাক। হুঁশ ফিরল অ্যারাবেলার গলা শুনে।

অ্যারাবেলা ধুমসো-ভূতকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম? কোন নামটা জানতে চাও বলো? ডাকনাম, নাকি স্কুলের নাম?’

ফট করে মৈনাক বলে ফেলল, ‘ডাকনামটাই বলো না, না হয়!’

ধুমসো ভূত হাসল। ওর গা থেকে তেমনই বিচ্ছিরি গন্ধটা ভেসে আসছে। একটু দূরে সরে গেল মৈনাক।

পিঁ পিঁ করে একটা শব্দ ভেসে এল ধুমসো ভূতটার মাথার পিছন দিক থেকে। ভালো করে কান পাততে মৈনাক বুঝল, শব্দটা আসছে ভূতটার মাথার পিছন দিক থেকে নয়, সামনের দিক থেকে। ওই শব্দটা আসলে ভূতটার একটা দীর্ঘশ্বাস।

ধূমসো-ভূতটা বলল, ‘আমার ডাকনাম ডোনাটো, মা আদর করে এই নামটা রেখেছিল। আমি মায়ের প্রথম সন্তান ছিলাম কিনা, তাই! ‘ডোনাটো’ কথার মানে জানো?’

মৈনাক আর অ্যারাবেলা দু-জনেই ঘাড় নাড়ল, না জানে না।

ভূতটা উদাসভাবে হাসল খানিক। সে হাসিতে কিছুটা তাচ্ছিল্যও লেগে ছিল বলে মনে হল মৈনাকের।

তারপর ধুমসো-ভূতটা বলল, ‘ডোনাটো কথার মানে হল, ভগবানের দান।’

মৈনাক বলল, ‘বা:! আর তোমার স্কুলের নামটা?’

ভূতটা বলল, ‘মার্সেলো।’

মৈনাক বলল, ‘তোমাকে মার্সেলোকাকু বলব। তোমার আপত্তি নেই তো?’

মার্সেলো ঘাড় নাড়ল। অ্যারাবেলা বলল, ‘সেই গল্পটা বলো না? সেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আগুনের গোলার গল্পটা?’

মার্সেলো কেমন একটা মন খারাপের হাসি হাসল। বলল, ‘আমাদের জাহাজ মারিয়া ক্যারোলিনা ঢেউয়ের তান্ডবে তলিয়ে গেল। আমরা সাতজন ছিলাম। কেউ কাউকে দেখতে পেলাম না। সকলেই নিশ্চয়ই ভূত হয়ে গেল খানিক পরে। আমিও ভূত হয়ে গেলাম। আমি তো ভালো নাবিক ছিলাম! জল ভালোবাসতাম। তাই ভূত হওয়ার পর ঠিক করলাম, আমি জলেই থাকব, আর ডাঙায় ফিরব না।’

অ্যারাবেলা ফিক করে হেসে বলল, ‘ভূত আবার জলে থাকতে পারে নাকি? এ তোমার কী কথা মার্সেলোকাকু? আজগুবি গল্প জুড়লে দেখছি!’

মার্সেলো বলল, ‘না না। আজগুবি হতে যাবে কেন? অনেক চেষ্টা করে ভূত হয়ে জলের উপর ভেসে থাকা শিখলাম। জলে ভাসতে ভাসতে এদিক যাই, ওদিক যাই। অতল নীল জল চারপাশে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝে খুব একা লাগত। তারপর একদিন দেখলাম, দূরে একটা জাহাজ ভেসে আসছে।’

মৈনাক জিজ্ঞেস করল, ‘ওই সমুদ্রে জাহাজ? তুমি কী বলছ মার্সেলোকাকু? সত্যি বলছ তো?’

মার্সেলো বলল, ‘প্রথমে আমিও তো তাই ভাবলাম। ভুল দেখছি না তো? ভালো করে নজর করলাম। না, ঠিকই দেখছি। শাঁ করে জাহাজটার কাছে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি, ওমা, জাহাজটার যে হেড নাবিক, তার বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। মাথায় কাঁচাপাকা বাবরি চুল। পুরো হাতা একটা কালো ঢিলঢিলে মোটা কাপড়ের জামা পরা। তিনটে বড়ো বড়ো পাল টাঙানো জাহাজটায়। তার তিনটেতেই বড়ো করে লাল ক্রস আঁকা। কয়েকটা পাল আবার গোটানো আছে দেখতে পেলাম। জাহাজটার হালের দিকে একটা খুঁটির মাথায় একটা পতাকা লাগানো। অনেক লোক জাহাজটার মধ্যে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে সাঁই সাঁই করে জাহাজটা দূরের দিকে চলে গেল।’

মৈনাক জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর তুমি কী করলে?’

‘আমি তো ছেড়ে দেওয়ার লোক না, আমার নামও মার্সেলো! বাতাসের বেগে জলের ওপর সাঁতরে গিয়ে সটান উঠে গেলাম জাহাজটার পাল বেঁধে রাখা যে মোটা খুঁটিটা, একেবারে তার ঘটের মতো দেখতে মাথাটার ওপর।’

চোখ ড্যাবা ড্যাবা করে মার্সেলোর কথা শুনছিল মৈনাক। বলল, ‘তুমি কী গো? তোমার একটুও ভয় পেল না মার্সেলোকাকু?’

মার্সেলো গল্প বলার ঢঙে বলল, ‘দূর, ভয় পাবে কেন? আমি তো তখন ভূত! তারপর ওই মাস্তুলের ওপর দু-পা ঝুলিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলাম। দিনরাত কত যে কথা শুনতাম ওদের, সেসব লিখে রাখলে একটা মোটা বই হয়ে যায়।’

মৈনাক বলল, ‘তুমি একদিন সময় করে বোলো তো মার্সেলোকাকু, আমি শুনে শুনে লিখে রাখব সব। যদি নিবারণদাদু একটা বই ছাপার ব্যবস্থা করে দেয়।’

মার্সেলো বলল, ‘নিবারণদাদু কী করে বই ছাপার ব্যবস্থা করবে?’

মৈনাক ঘাড় নেড়ে বলল, ‘তুমি তাও জানো না? নিবারণদাদুর তো কলকাতায় খুবই যাতায়াত আছে। কলকাতায় যেখানে বইয়ের বাজার, কলেজ স্ট্রিট, সেখানেও খুব চেনাজানা হয়েছে নিবারণদাদুর। আমি একদিন এখানে আলোচনা করতে শুনেছি নিবারণদাদুকে। বিশ্বাস না হলে একদিন দাদুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।’

অ্যারাবেলা মৈনাককে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুই থাম তো!’ তারপর মার্সেলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমি বলো তো মার্সেলোকাকু! তারপর কী করলে?’

মার্সেলোর চোখের গর্তে একটা রাতপোকা উড়ে এসে পড়ল তক্ষুনি। সরু সরু আঙুল ঢুকিয়ে পোকাটাকে বের করে দিয়ে বলল, ‘একদিন শুনলাম, ওই জাহাজটার নাম ‘সান্তা মারিয়া’। আর ওই যে হেড নাবিক, ওর নাম কলম্বাস। নাবিকটা নাকি জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে নানা দেশ আবিষ্কার করে বেড়াত। তাকে নাকি রানি ইসাবেলা আর রাজা ফার্নান্দো ওরকম দেশ আবিষ্কারের বরাত দিয়েছিল। রানি ইসাবেলা থাকত কোরডোবার আলকাজার ক্যাসেলে। সে এক সুন্দর একটা নদীর ধারে। কী যেন নাম ছিল নদীটার? ও, মনে পড়েছে। বেশ কঠিন নাম তো তাই চট করে মনে পড়ছিল না। সে নদীটার নাম ছিল গুয়াডালকুইভির।’

‘তারপর বারমুডায় যে আগুনের গোলাটা দেখলে?’ খেই ধরিয়ে দিল অ্যারাবেলা।

মার্সেলো হেসে বলল, ‘ও, সে একটা মস্ত আগুনের বল বটে! আমি অমন করে সান্তা মারিয়া জাহাজের মাস্তুলে বসে থাকি, আর নানা রকম গল্প শুনি নাবিকদের। সেদিন ক্যানারি দ্বীপের কাছ দিয়ে জাহাজটা যাওয়ার সময় একটা মস্ত বড়ো আগুনের গোলা আকাশ থেকে ঝপাং করে সমুদ্রে এসে পড়ল! আমার নিজের চোখে দেখা। কিছুক্ষণের জন্যে চোখ দুটো যেন ধাঁধিয়ে গেল আমার।’

মৈনাক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মার্সেলোকাকু, কত বড়ো সে আগুনের গোলাটা?’

মার্সেলো কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘তা প্রায় প্লুটো গ্রহের চেয়ে কিছু কমটম হবে হয়তো! কিন্তু মস্ত বড়ো! সমুদ্রে কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল অমন আগুনের গোলা, কে জানে! কলম্বাসের মুখ হাঁ হয়ে গেল আগুনের গোলাটা দেখে।’

মৈনাক ভাবতে লাগল, প্লুটো গ্রহ? এ নামটাও খুব শোনা-শোনা লাগছে। এটা মনে হয় ভূগোল বইয়ে পড়েছে সে। আর-একটা কথা মনে মনে ভাবল মৈনাক, ভূতেরাও যখন ভূগোল-ইতিহাসের এত কথা জানে, ওরাও নিশ্চয়ই স্কুলে পড়েছে!

গা শিরশিরে একটা মিহি শব্দ ভেসে আসছিল দূর থেকে। তার মাঝখানে একটা সিড়িঙ্গে মতো ভূত নেমে এল একেবারে মৈনাকের সামনের ডালে। বয়স বেশি নয়, মৈনাকের চেয়ে হয়তো বছর পাঁচেকের বড়ো। তবে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি তার ঢ্যাঙা চেহারা, তেমনি তার লম্বা লম্বা হাত-পা। কান দুটো ঝুলছে দেখো না, যেন একটা বাচ্চা হাতির কান! সে দুটো আবার নাড়াচ্ছে থেকে-থেকে। নাকটা নেই বললেই চলে! এসেই সিড়িঙ্গে ভূতটা বলল, ‘আমি শেরউডের জঙ্গলে ওরকম নানা আগুনের কান্ডকারখানা দেখেছি।’

মৈনাক জিজ্ঞেস করল, ‘শেরউডের জঙ্গল? তুমি অত দূরে গিয়েছিলে কেন? তোমারও ওখানে যেতে ভয় করল না?’

সিড়িঙ্গে ভূতটা বলল, ‘ভয় করলে ভয়, না হলে ভয় করবে কেন? আর ভয় করবেই বা কেন? আমি ভূত হওয়ার পর একটা টর্নেডোর মতো একটা সর্বনাশা ঝড়ে পড়েছিলাম। সেই ঝড়টাই তো আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ওখানে ফেলল শেরউডের জঙ্গলে। তারপর থেকে ওখানেই তো থাকতাম। এই তো ক-দিন হল ভূতবংশী গাছটায় এসেছি। তাও কি আসতাম নাকি, নিবারণদাদু অমন করে ডাকল বলে! বলেছে, খুব নাকি দরকারি কাজ আছে। ওখানে কতদিন ধরে ছিলাম। এখানে আসতেই মন টানছিল না।’

মার্সেলো ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ঠিকই তো! ও তো ভূত কিনা!’

অ্যারাবেলা বলল, ‘তোমার নামটা কী শুনি?’

মৈনাক তাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘কবে থেকে তুমি শেরউডের জঙ্গলে ছিলে?’

ছেলেটা বলল, ‘আমার নাম টবি। আমার বাড়ি ছিল নটিংহামশায়ার থেকে মাইল দশেক দূরের এক পাহাড়ি গ্রামে। আমার গ্রামের নাম বার্নস্টোনে। পাহাড়ে চড়তাম, খেলতাম, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। কখনও আমার বোন এরিনও সঙ্গে থাকত। সে ফুল পাড়ত গাছ থেকে। একদিন একা-একা একটা ছোটো টিলার মাথায় উঠছিলাম। তারপর পা ফসকে পড়ে গেলাম একদম নীচে। তারপর থেকে এই আমি ভূত!’

মৈনাক বলল, ‘তোমাকে টবিদা বলব। তুমি আমার চেয়ে বড়ো তো!’

অ্যারাবেলা মৈনাকের মুখের কথা ফুরোতে না ফুরোতে বলল, ‘আমি তোমাকে নাম ধরেই ডাকব কিন্তু! তুমি আমার চেয়ে এমন কিছু বড়ো না।’

টবি ওর কথার উত্তর দিল না। আগের কথার খেই ধরে বলল, ‘সে ডেকো যা ভালো লাগে। তুমি জানো কি, আমি শেরউডের জঙ্গলে রবিনহুডকে দেখেছি।’

মার্সেলো হেসে বলল, ‘দূর, সব বাজে কথা! ও নামে কোনো লোক কখনওই ছিল না। ওই লোকটাকে নিয়ে ওরকম কত না গল্প ছড়িয়ে আছে!’

টবি বলল, ‘বিশ্বাস না হলেও শোনো, মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুল আঁচড়াত রবিনহুড। শক্তপোক্ত চেহারা। দেখলে মনে হত, লোকটা লড়াই করতে জানে। দারুণ তির ছুঁড়তে পারত। বর্শা ছুঁড়তে পারত একদম সঠিক নিশানায়। রবিনহুড গরিবদের বন্ধু ছিল, এ আমার নিজের চোখে দেখা। কত লোককে যে সাহায্য করল লোকটা!’

টবির কথা তবুও বিশ্বাস করতে চাইল না কেউ। এ-ওর মুখের দিকে তাকাল শুধু। এমন সময় কোথা থেকে যেন বৃষ্টি আসার শব্দ হল। মৈনাকের মনে হল, বৃষ্টি আসছে কী? তারপর তার মনে হল, নাকি কেউ বুঝি নূপুর পরে এদিকে আসছে!

ভূতবংশী গাছে হঠাৎ হঠাৎ যেমন ঝড় বয়ে যায়, অমন করে হঠাৎ ডালপালাগুলো নড়ে উঠল কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো। মৈনাক, অ্যারাবেলা, টবি, মার্সেলো থম মেরে গেল যেন। কী ঘটল কিছু বুঝে ওঠার আগেই আর-একটা ভূত হঠাৎ ভূতবংশীর একটা মোটা ডালে ঝুলে দোল খেতে লাগল আপনমনে।

ওকে দেখে মৈনাক বেশ ভয় পেয়ে গেল। অমন দশাসই চেহারার ভূত সে আগে কখনও দেখেনি। অ্যারাবেলা মৈনাকের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এ ভূতটা আবার নতুন এল বুঝি এখানে? একেও কি নিবারণদাদু ডেকে এনেছে? ও বাব্বা, দেখো কত্ত বড়ো! আমাদের ব্লু-হিলে ওরকম একটা লোক ছিল। আমরা তাকে দৈত্য বলে খ্যাপাতাম। সে মটাস করে একটা গাছের ডাল ভাঙত। তারপর সেটা বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে কোথায় যে চলে যেত, কেউ বলতে পারত না! এ তার চেয়েও লম্বা!’

ওদের ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে লম্বা ভূতটা বেশ খেপে গেল। বলল, ‘আমি এখানে এমনি যেচে আসিনি। ওই লোকটা ডেকেছে, কী যেন একটা কাজ আছে। হুঁ হুঁ, আমি ফ্যালনা না। তা যদি ভেবে থাকো, তা হলে ভুল করছ!’

মার্সেলোকাকু হাত তুলে বলল, ‘আহা, আসা মাত্রই অমন রণং দেহি মূর্তি ধরলে কেন ভাই? একটুখানি বসে-জিরিয়ে নাও না কেন! তারপর না হয়…’

লম্বা ভূতটা মাথাটা রাবণের মতো ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি কারাকোরাম পর্বতমালার সিয়াচেন থেকে আসছি। সেটা জানো কোথায়? সেখানে কী হয়?’

অ্যারাবেলার মুখেই যেন উত্তরটা জুড়ে ছিল। বলল, ‘সেখানে যুদ্ধ হয়।’

কারাকোরাম পর্বতমালা কথাটা মৈনাকের স্পষ্ট মনে পড়ছে এখন। এটা কোন তিনটি দেশ দিয়ে চলে যাওয়া পর্বতমালা—এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে ভূগোল-স্যার তাকে একদিন গোটা ক্লাসটা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তাই ওটা আর কখনও ভোলেনি মৈনাক। এখন আবার কী বলতে কী ভুল হয়ে যায়, তাই চুপ করে থাকল সে।

অমনি মহা খুশি হল লম্বা ভূত। বলল, ‘জানো দেখছি! অনেকে তো সিয়াচেনটা কী, আইসক্রিম না পিৎজা, জানেই না। তা ভালো, বেশ ভালো কথা। যে-আমাকে ডাক পাঠাল, সে কোথায়?’

মৈনাক ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপনি কার কথা বলছেন? নিবারণদাদুর কথা কি? তাকে নিয়ে ওরকম হেনস্থা করে কথা বলবেন না! নিবারণদাদু কিন্তু এই ভূতরাজ্যের হেডভূত।’

‘আরে রাখ ওসব! কত হেডকে দেখলাম জীবনে। কোথায় সে?’

কথা ঘোরানোর জন্যে টবি জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার গায়ে সাদা-সাদা ওসব কী লেগে আছে? পুকুরে গিয়ে ধুয়ে আসোনি কেন?’

লম্বা ভূত তার খুব লম্বা হাতটা বাড়িয়ে দিল দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা টবির দিকে। বলল, ‘হাত দিয়ে ছুঁয়ে দ্যাখো না।’

টবি নিজেকে গুটিয়ে নিল। লম্বা ভূতটা বলল, ‘ওসব বরফ লেগে আছে আমার গায়ে। সোজা সিয়াচেন থেকে আসছি কিনা। আমি অনেক দিন আগে যুদ্ধ করতে গিয়ে শত্রুর বুলেটে খতম হয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম চল্লিশ ফুট বরফের তলায়। আমার দেশের সেনাবাহিনী খুঁজে পায়নি। তাই শহিদ হতে পারিনি আমি। আমি এখনও ‘নিখোঁজ’ তালিকায় ঝুলে আছি। তা ওই লোকটা কীভাবে যেন আমার খোঁজ পেয়ে ডাক পাঠাল। লোকটা জাঁহাবাজ ভূতই বটে! সৈন্যবাহিনী যার খোঁজ পেল না, লোকটা তাকে খুঁজে পেয়ে গেল? তাই তো বরফের তলা থেকে উঠে সটান চলে এসেছি। তাই এত বরফটরফ লেগে আছে!’

‘কী নাম আপনার?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যারাবেলা।

লোকটা বলল, ‘ওয়াং! সিয়াচেনে গিয়ে চিনের দিকের যাকেই আমার নাম বলবে, সে তোমাকে আমার যুদ্ধের অনেক গল্প শুনিয়ে দেবে।’

মৈনাক মিনমিন করে বলল, ‘ওয়াংজেঠু, যুদ্ধে যায় যারা, তারাও মারা গেলে ভূত হয়? বিশ্বাস হচ্ছে না। তারা যে দেশের জন্যে জীবন দান করল, তারাও যদি ভূতই হবে, তা হলে আর সাধারণ লোকের সঙ্গে তাদের তফাত থাকল কী?’

কারও মুখ থেকে আর একটিও কথা বেরোল না। কখন যে দিনের আলো নিভে গিয়ে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে, ওরা কেউ খেয়ালও করেনি। হঠাৎ তিনটে জোনাকি মৈনাকের মুখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে সে তাকিয়ে দেখল, কখন রাত নেমে গেছে। আজ কি অমাবস্যা নাকি? এখনও চাঁদের দেখা নেই আকাশে? মনে মনে ভাবল মৈনাক, এবার তবে নিবারণদাদুর আসার সময় হল!

খুব দূর আকাশে দু-একটা তারা ফুটল কি ফুটল না সেদিকে চোখ মেলার অবকাশ পেল না কোনো ভূতই। মনে মনে মৈনাক বলল, ‘আজ অন্ধকারটা বেশ জমকালো!’

চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সিঁ সিঁ করে কোথাও যেন শব্দ হল। ভূতবংশী গাছটা দুলে উঠল খুব জোরে। এ ক-দিনে এসবের মানে জানতে বাকি নেই মৈনাকের। এবার নিবারণদাদু আসবে। ভূতেরা চিঁ চিঁ খিঁ খিঁ করলে এক কড়া ধমকে সকলকে চুপ করিয়ে দেবে নিবারণবাবু। তারপর আজই মনে সেই সভা বসার কথা।

পরশু ভোররাতের দিকে ভূতবংশীর ডালে বসে ভূতসংগীত গাইছিল মৈনাক একা গুনগুন করে। নিবারণদাদু ওকে ভূতবংশীর পাতার আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে রেখেছে, ‘দরকার হলে তোকে ভূতেদের লিডার হয়ে কলকাতা যেতে হতে পারে। মনে মনে রেডি হয়ে থাকিস মৈনাক!’

মৈনাক মিনমিন করে বলেছিল, ‘দাদু ও নিবারণদাদু, আমি না তোমার থমথমগড়ের গ্রামের ছেলে? তুমি আমাকে কলকাতা পাঠিও না দাদু! কলকাতায় অত লোক, গাড়িঘোড়া, ট্রাম-হেলিকপ্টার, মেট্রোরেল-উড়ালপুল, ওসব দেখে ভড়কে গিয়ে আমি মানুষের হাতে ধরা পড়ে যাব পটাস করে!’

কে শোনে কার কথা! দাদু কানেই নেয়নি মৈনাকের কথা। সেই থেকে ভয়ে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে আছে মৈনাক। কথাটা সাহস করে কাউকেই বলেনি। অ্যারাবেলাকেও না।

নিবারণদাদু এসেই ভূতবংশী গাছের নীচে দাঁড়িয়ে হাঁকডাক শুরু করে দিল, ‘যে ক-জন বিদেশের ভূত আছ, তারা চটপট ভূতবংশী গাছ থেকে নেমে এসে আমার সামনে লাইন করে দাঁড়াও!’

মৈনাক ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়েছিল। আস্তে করে চোখ খুলে দেখল, লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়েছে প্রথমে অ্যারাবেলা, তারপর টবি, তার পিছনে মার্সেলোকাকু। এমনকী, অমন হম্বিতম্বি করা ওয়াংজেঠুও সকলের পিছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মৈনাক বুঝতে পারছে না, তাকেও এখন অমন লাইন করে দাঁড়াতে হবে কিনা। ওরকম বুঝতে পারছে না দেবেন সামন্তের ভূত, নীরদা ঠাকুরমার ভূত, নিশার ভূতও। তারা চুপ করে ভূতবংশী গাছের ডালেই ঝুলে থাকল। মৈনাক দূর থেকে অনুনয়ের ভঙ্গিতে হাত দুটো জড়ো করে তাকিয়ে আছে নিবারণদাদুর দিকে। যতই হোক, মৈনাক তো নিবারণদাদুরই থমথমগড়ের ছেলে। দাদু মৈনাককে নিশ্চয়ই এমন কিছু করতে বলবে না, যাতে মৈনাক মানুষের হাতে ধরা পড়ে যায়।

এই ফাঁকে কখন কেদার শর্মার ভূতও এসে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, খেয়াল করেনি মৈনাক। এখন কেদার শর্মার ভূতকেও চোখে পড়ল।

তক্ষুনি ডাক পড়ল মৈনাকের। নিবারণদাদু হাঁক পাড়লেন, ‘মৈনাক, এদিকে আয়!’ তারপর কেদার শর্মার ভূতের দিকে চোখ পড়তে নিবারণদাদু বলল, ‘ও, তুমিও এসেছ? তা এসেই পড়েছ যখন, তুমিও যাবে।’

মৈনাক সুড়সুড় করে নেমে এসে দাঁড়াল ভূতবংশী গাছে নীচে। এবার নিবারণদাদু হুকুম করল, ‘আজ কার্তিক মাসের কৃষ্ণাচতুর্দশী তিথি। এই দিনটাকে সকলে বলে ভূতচতুর্দশী। আজ আমার সঙ্গে এখনই তোমাদের কলকাতা যেতে হবে।’

কেন কলকাতা যেতে হবে, কী কাজ সেখানে, এসব কিছু জিজ্ঞেস না করে ভেউ ভেউ করে সকলের আগে কেঁদে উঠল মৈনাক। অ্যারাবেলা কাঁদল না বটে, তবে তারও যে একদম ভয় করল না, তা নয়। মার্সেলোকাকু থম মেরে শুনছে। একটাও কথা বলেনি। টবি ফট করে বলে বসল, ‘আমাকে শেরউডের জঙ্গল থেকে এখানে এনে ফের কলকাতা পাঠাচ্ছ কেন? এমন কথা তো আগে বলোনি? সেখানে ভূত থাকে নাকি?’

নিবারণদাদু হাসল ফিকফিক করে। তারপর বলল, ‘ভূতেরাই সেখানে বেশি থাকে। সেখানে ভূতেদের থাকার অনেক জায়গাও আছে! চলো, গেলে সব দেখতে পাবে!’ বলেই নিবারণদাদু থেমে একবার চারপাশটা দেখে নিল। তারপর বলল, ‘মৈনাক, তুই আমার কাছে কাছে থাকবি কিন্তু! এসো সকলে। আমরা এই পথটা উড়ে উড়ে যাব।’

তারপর আকাশে সাঁই সাঁই করে শব্দ উঠল। বোঁ বোঁ করে ঘুরে গেল ভূতবংশী গাছটা কয়েক পাক। ভূতচতুর্দশীর রাতটা আরও যেন গাঢ় অন্ধকারের কম্বল ছড়িয়ে দিল গোটা পৃথিবীময়। নিবারণদাদুর সঙ্গে ওড়ার আগে মৈনাক একবার পিছন ফিরে দেখল। দেবেন সামন্তের ভূত, নীরদা ঠাকুরমার ভূত আর নিশার ভূত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অন্ধকারে ওদের চোখ দুটোই শুধু জ্বলজ্বল করছে। চোখ ফিরিয়ে নিল মৈনাক।

উড়তে উড়তে নিবারণদাদুকে হুট করে একটা প্রশ্ন করে বসল মৈনাক, ‘হ্যাঁ গো দাদু, কলকাতা গিয়ে আমাদের কাজটা কী হবে, বললে না তো?’

সে কথার একটা ছোটো উত্তর ভেসে এল নিবারণদাদুর দিক থেকে, ‘মানুষকে বেশি করে ভয় দেখানোর কাজ!’ আর কোনো কথা হল না কারও সঙ্গে নিবারণদাদুর।

সাঁই সাঁই করে নিবারণদাদুর ভূত-ব্যাটেলিয়ান এসে পৌঁছে গেল কলকাতায়। একেবারে মনুমেন্টের মাথার গম্বুজটার ভিতরে ওদের থাকার ব্যবস্থা করে কোথায় যেন উড়ে গেল নিবারণদাদু। ভূতেরা এল কলকাতায়, এই খবরটা কাদের যেন দিতে গেল বলে মনে হল মৈনাকের। থমথমগড়ে থাকার সময় মৈনাক যে কথাটা শুনেছিল, নিবারণদাদু ভূত কেনাবেচার ব্যাবসা করে, তা হলে কি কথাটা সত্যি?

অ্যারাবেলা নীচু গলায় বলল, ‘সেন্ট হেলেনা দ্বীপের চেয়ে জায়গাটা বড্ড ছোটো! কলকাতাটা ভূতের থাকার পক্ষে খুব কি ভালো?’

মার্সেলোকাকু হাসল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। তারপর চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘কলকাতাটা তো কলম্বাসের সান্তা মারিয়া জাহাজ থেকে দেখা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সেই আগুনের গোলাটার চেয়ে ছোটো আর একটা আগুনের গোলা গো!’

টবি চুপ করে বসেছিল। অতক্ষণ উড়ে এসে সে ক্লান্ত। ওদের কথা শুনে বলল, ‘এ তো শেরউড জঙ্গলের চেয়ে আরও বড়ো একটা জঙ্গল! এখানে নিশ্চয়ই অনেক রবিনহুডও আছে! তারাও কি গরিবদের বন্ধু?’

ওয়াংজেঠুর চোখ পড়ে গেল দূরে ফোর্টউইলিয়ামের দিকে। আপন মনে বলল, ‘এখানেও সেই যুদ্ধের আয়োজন? যুদ্ধ আর ভালো লাগে না!’

কেদার শর্মার ভূতটা এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘এই কলকাতাটা তো গোটাটাই একটা মরণকুয়া গো!’

তখনই আর-একবার কী ভেবে পিছন ফিরে দূরের দিকে তাকাল মৈনাক। ওই তো দূরে অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে, ঘুমিয়ে থাকা তার গ্রাম থমথমগড়! হ্যাঁ, ওই তো একটা বিন্দুর মতো তার গরলগাছি হাই স্কুলও দেখা যাচ্ছে! মৈনাকের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠল।

রাত ফুরোলেই কাল থেকে কলকাতায় শুরু হয়ে যাবে নানা ভূতুড়ে কান্ড!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *