ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
মানুষের জীবনে এমন—সব ঘটনা ঘটে, যার কোনো মানে পাওয়া যায় না। ভাবতে গেলে দিশেহারা হয়ে যেতে হয়। কেন ঘটল কে জানে—বলে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই।
সেরকম ঘটনা যে সকলের জীবনে সব সময়েই ঘটছে তা নয়। কদাচিৎ কখনো কারও কারও জীবনে হয়তো ঘটে থাকে। আমার জীবনে মাত্র একবার ঘটেছে।
গল্পটা বলি শোনো।
বর্ষাকাল। দিবারাত্র ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। কলকাতার পথ—ঘাট সব কাদায় কাদায় একাকার হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরোবার উপায় নেই।
সেদিন বিকালে বৃষ্টি একটু ধরেছিল। কয়েকদিন ধরে দিবারাত্র কেমন যেন অন্ধকার মেঘলা—মেঘলা আকাশ আর কুয়াশার মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দেখে দেখে প্রাণ যেন একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে! হঠাৎ যেন একটুখানি সূর্যের আলো দেখা গেল। ছাতি হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
কোথায় যাব তার কোনো স্থিরতা নেই। মোটরের চাকায় কাদা ছিটকে একদিন আমার ফরসা কাপড়—জামা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেকথা আমি আজও ভুলিনি। তাই যথাসম্ভব কাপড়—জামা সামলে ফুটপাথের একপাশ ঘেঁসে চলেছি তো চলেইছি। এমন উদ্দেশ্যহীনের মতো কতক্ষণই বা ঘুরব?
পথের ধারে উঁচু একটা রকের ওপর সারি সারি পুরোনো বইয়ের দোকান। গত কয়েকদিনের বাদলের জন্যে দোকান তারা খুলতে পারেনি, আজ আকাশের অবস্থা একটু ফরসা দেখে ভরসা করে আবার তারা বই সাজিয়ে বসেছে।
ভাবলাম, ভালো বই কিছু থাকে তো দেখাই যাক। বই দেখবার জন্যে দাঁড়ালাম। এটা—সেটা উলটে—পালটে দেখছি। বাজার ক—দিন ধরে ভারি মন্দা গেছে। দোকানদার যা হোক একটা—কিছু বই কেনাবার জন্যে একেবারে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভালো বই একটাও নেই।
আকাশটা মনে হল আবার যেন অন্ধকার হয়ে এসেছে। গুড় গুড় করে একবার মেঘও ডেকে উঠল। ভাবলাম, কাজ নেই আর বই দেখে। বাড়ি ফিরে যাই।
ফেরবার জন্যে যেই পিছন ফিরেছি, এমনি অদৃষ্ট, আমার হাতের ছাতিটার খোঁচা লেগে রকের ওপর সারি—সারি সাজানো বইয়ের থাক থেকে একখানা বই হঠাৎ ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ে গেল। ছি ছি, করলাম কী!
বইখানা রাস্তা থেকে তুলতে গিয়ে দেখি—জলে—কাদায় কয়েকটা পাতা তার নষ্ট হয়ে গেছে! দোকানদার হায় হায় করতে লাগল। দেখলাম, এ অবস্থায় বইখানি দোকানদারের হাতে ফেরত দিয়ে চলে যাওয়া আমার উচিত নয়। বইখানা নষ্ট হল যখন আমারই দোষে, দামটা অন্তত তার দিয়ে দেওয়া ভালো।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কত দাম?’
দোকানদার বললে, ‘দাম তো বাবু বেশি নয়, চার আনা দাম, কিন্তু আজ চারদিন ধরে একটি পয়সার বেচা—কেনা হয়নি!’
বেচারার মুখের অবস্থা দেখে দয়া হল।
পকেট থেকে চার আনা পয়সা বের করে তার হাতে দিলাম। দেখলাম লোকটি বেশ খুশি হয়ে উঠেছে। তৎক্ষণাৎ বইখানি সে তার কাপড় দিয়ে বেশ করে মুছে একখানি কাগজ জড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে বললে, ‘নিন বাবু।’
ও নিয়ে আর আমি কী করব! বললাম, ‘রেখে দাও তোমার কাছে, কেউ নিতে চায় তো তাকে বিক্রি করে দিয়ো।’
দোকানদার কিন্তু রাজি হল না। বইয়ের দাম সে পেয়ে গেছে, সুতরাং বইখানি সে আমাকে গছিয়ে দেবেই। দেখলাম, বইয়ের নাম ‘ধর্ম্ম ও জীবন’।
—দূর ছাই! ও বই নিয়ে আমিই—বা কী করব?
কিন্তু বাধ্য হয়ে নিতে হল। ভাবলাম—দেব কোথাও রাস্তার মাঝখানে ফেলে।
এইবার সে এক ভারি মজার কাণ্ড!
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বইখানি হাতে নিয়ে চলেছি। খানিক দূর গিয়েই রাস্তার ধারে বইখানা ছুড়ে ফেলে দিলাম।
ফেলে দিয়ে আর সেদিক পানে তাকালাম না। না তাকিয়েই এগিয়ে চললাম। কিন্তু কিছু দূর যেতে—না—যেতেই দেখি, পিছন থকে একটি ছোকরা ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে বললে, ‘মশাই, শুনুন।’
ফিরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমায় ডাকছ?’
ছোকরাটি সেই কাগজ—মোড়া বইখানি আমার হাতে দিয়ে বললে, ‘বইখানা আপনার হাত থেকে পড়ে গেল—আপনি বুঝতে পারেননি!’
বইখানা আমি ইচ্ছা করেই ফেলে দিয়েছিলাম, সে—কথা আর বলতে পারলাম না। আবার সেখানি হাতে নিয়েই চলতে লাগলাম।
যেতে যেতে বাঁহাতি একটা বাড়ির সুমুখে দেখলাম, রকটা ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই, বইখানি ধীরে—ধীরে রকের ওপর নামিয়ে দিলাম। ভাবলাম, যার খুশি সে নিয়ে যাবে, আমার ও বইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এবারেও ঠিক তাই!
লোকজন কেউ কোথাও ছিল না, অথচ কয়েক পা যেতে—না—যেতেই দেখি—ছোট্ট একটি ছেলে বইখানি হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। বললে, ‘বইখানি আপনি ফেলে যাচ্ছিলেন!’
কী আর করি, হাত পেতে নিলাম বইখানি। নিয়ে ভাবলাম এবার একে এমন জায়গায় ফেলব, যেখান থেকে কেউ আর তা দেখতে পাবে না।
পাশের একটা গলির ভেতর ঢুকলাম।
রাস্তায় লোকজন খুব কম। ভালোই হয়েছে। এবার আর কেউ দেখতে পাবে না। কোথায় ফেলি, কোথায় ফেলি, ভাবতে ভাবতে চলেছি। হঠাৎ দেখি—রাস্তার পাশেই প্রকাণ্ড একখানা বাড়ি, তার পরেই বাগানের মতো কী যেন একটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখলাম—কেউ কোথাও নেই। এই উপযুক্ত সময় ভেবে প্রাচীরের ওপর বইখানি হেলাফেলা করে তুলে দিলাম। কিন্তু হাত ছেড়ে দিতেই ওদিকে ঢিপ করে শব্দ হল, বুঝলাম—বইখানি প্রাচীরের ওপারে পড়ে গেছে।
আঃ, বাঁচলাম! এবার বোধ হয় নিষ্কৃতি পাওয়া গেছে!
নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ নারী—কণ্ঠস্বরে একটুখানি চমকে পিছনে ফিরলাম। দেখি—একটি বারো—তেরো বছরের সুন্দরী মেয়ে হাসতে হাসতে আমার দিকেই ছুটে আসছে। কাছে আসতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, তারও হাতে আমার সেই বই!
মেয়েটি বললে, ‘দোতলার জানালায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম, বইখানি আপনি পাঁচিলের ওপর রাখলেন, ওপাশে পড়ে গেল বলে আর খোঁজ করলেন না বুঝি?’
কী আর বলব, মৃদু হেসে বইখানি তার হাত থেকে নিলাম।
সর্বনাশ! আচ্ছা ভূতুড়ে বই তো! ভাবলাম, আমার কাছ থেকে এ যখন কিছুতেই যাবে না, তখন থাক আর একে ফেলে কাজ নেই, বাড়িতেই নিয়ে গিয়ে রাখি।
সেলফের ওপর অনেক বই জড়ো হয়েছে, তারই একপাশে তাকেও দিলাম রেখে। মনে—মনেই বললাম, যেতে যখন চাইলে না কিছুতেই, তখন থাকো।
মা ডাকলেন, ‘চা খাবি আয়।’
পাশের ঘরে চা খেতে গেলাম। চা খেতে—খেতেই সন্ধে হল। বাইরে তখন ঝমঝম করে আবার বৃষ্টি নেমেছে। আমার ঘরে এসে সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। ভাবলাম, এই বাদলের দিনে বসে বসে কিছু পড়া যাক।
বই নেবার জন্যে সেলফের কাছে এগিয়ে যেতেই বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালাম! দেখলাম, সেই বইখানা আমার টেবিলের ওপর খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দেখে মনে হল—এইমাত্র কে যেন পড়তে পড়তে উঠে গেছে! কিন্তু আমার এ—ঘরে এ—সময় কেই—বা আসবে? বাড়িতে শুধু মা আর আমি। একটা বোন আছে, সেও তো বোর্ডিং—এ। বাড়িতে একটা চাকর পর্যন্ত নেই। তবে কি বোর্ডিং থেকে অণিমাই এল নাকি? মা—র কাছে ছুটে গেলাম। মা বললেন, ‘কই না, অণিমা তো আসেনি।’
সেলফ থেকে বইখানা কি পড়ে গেল?—বেড়াল ফেলে গেছে? কিন্তু তারও কোনো সম্ভাবনা দেখলাম না; সেলফের যে জায়গায় বইখানা ছিল, সেখান থেকে বেড়ালে ফেলতে পারে না। তা ছাড়া ফেললে সেখান থেকে সেটা মেঝেতেই পড়ত; টেবিলটা ছিল দূরে, তার ওপর পড়তে যাবে কেন?
বইটায় হাত না দিয়ে ভালো করে দেখবার জন্যে তার ওপর ঝুঁকে পড়লাম। কেনবার সময় তখনও দেখেছিলাম, এখনও দেখলাম—বইখানি কে যেন লাল পেনসিলের দাগ দিয়ে অতি যত্নে পড়েছে!
বইয়ের যে পাতাটা খোলা, তারই নীচের দিকে যে জায়গাটা লাল পেনসিলের দাগ দেওয়া ছিল, অন্যমনস্কের মতো সেই লাইন ক—টা পড়ে ফেললাম।
লেখা রয়েছে—’মানুষের মৃত্যুর কোনও স্থিরতা নাই। যে কোনও মুহূর্ত্তে তুমি মরিয়া যাইতে পার। সুতরাং তাহার পূর্ব্বে তোমার ঋণ তুমি পরিশোধ করিও। তাহা না হইলে…’
সত্যিই ভাবিয়ে তুললে। কার কাছে আমার কী কী ঋণ আছে, আমি ভাবতে বসলাম। মনে পড়ল—আমার এক বন্ধুর কাছে পাঁচটি টাকা আমি একবার ধার নিয়েছিলাম। দিচ্ছি দিচ্ছি করে আর দেওয়া হয়নি। সে আজ প্রায় পাঁচ—ছ’মাস হয়ে গেল। বন্ধুর সঙ্গে আমার আর দেখাও হয়নি, তার কোনো খবরও নিতে পারিনি। টাকার কথা আমার মনেই ছিল না।
তৎক্ষণাৎ ড্রয়ার থেকে পাঁচটি টাকা বের করে পকেটে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। শ্যামবাজারে বন্ধুর বাড়ি।
গিয়ে দেখি—বন্ধু আজ দু—মাস ধরে শয্যাগত। ধরতে গেলে একরকম মৃত্যুশয্যায়। এমনি রুগণ কঙ্কালসার হয়ে গেছে যে, দেখলে আর চেনবার জো নেই। বিকারগ্রস্ত রুগি, আমায় দেখে সে চিনতেই পারলে না।
তার বিধবা দিদি আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। দেখলাম, চোখ দুটি তাঁর ছলছল করছে। আসবার সময় টাকা পাঁচটি তার দিদির হাতেই দিলাম। বললাম, ‘অজিত পেত আমার কাছে।’
দিদির মুখখানি কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল! আর সঙ্গে সঙ্গে দুইচোখের কোণ বেয়ে দুটি অশ্রুর ধারা গড়িয়ে এল। ঠোঁট—দুটো একবার চেপে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিয়ে দিদি বললেন, ‘কী উপকার যে তুমি আমাদের করলে ভাই—পাঁচটি টাকার কথাই আজ আমি সারাদিন ভেবেছি। ডাক্তার বলে গেছেন, টাকা না পেলে তিনি আর ইনজেকশন দেবেন না।’
তারপর খবর পেয়েছি, অজিত সেরে উঠেছে। মৃত্যুর মুখ থেকে একরকম বেঁচে ফিরে আসাই বলতে হবে।
দিদি বলেন, আমার দেওয়া সেই পাঁচটি টাকা না পেলে বোধহয় সে বাঁচত না। কিন্তু তার এই বাঁচার সঙ্গে আমার সেই ভূতুড়ে বইটারও কি কোনো সম্বন্ধ আছে?
আছে কি না সে—কথা আমি মাঝে মাঝে ভাবি।
ভেবে কোনো কূলকিনারা পাই না।