ভূতুড়ে ঘোড়ার গাড়ি ও কালো বাক্স

ভূতুড়ে ঘোড়ার গাড়ি ও কালো বাক্স

ছোট্ট টুনটুন কিছুতেই ভূতের ভয় পেতে চায় না৷ কতই বা তার বয়স, বড়জোর সাড়ে পাঁচ বছর৷ আমরা ছ’বছর বয়েসের আগে ইশকুল কাকে বলে তাই-ই জানতাম না, এখন তিন বছর বয়স থেকেই বাচ্চারা ইশকুলে যায়, তাই ওরা খুব চটপটেও হয়৷

টুনটুন আমার বন্ধু অরূপ আর অনন্যার ছেলে৷ ওদের বাড়ি টালিগঞ্জে মেট্রো স্টেশনের খুব কাছে৷ পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি, দু’পাশে দুটো বেশ বড় ঝাঁকড়া গাছ৷ ওই গাছ দুটোর জন্য বাড়িটাকে দিনের বেলা বেশ সুন্দর দেখায়, কিন্তু রাত্তিরবেলা বেশি-বেশি অন্ধকার মনে হয়৷

ওইটুকু ছেলে টুনটুন, কিন্তু তার অনেক গুণ৷ সে বেশ তবলা বাজাতে পারে৷ দুর্দান্ত টেবিল টেনিস খেলে আর গড়গড়িয়ে কবিতা মুখস্থ বলতে পারে৷

একদিন একজন সাহেব এসেছিল ওদের বাড়িতে৷ তখন অরূপ আর অনন্যা কেউই বাড়ি ছিল না৷ কাজের লোকটি দরজা খুলে ঘাবড়ে গেল৷ সে তো ইংরেজি বলতে পারবে না৷ তখন টুনটুন এসে দিব্যি ইংরেজিতে কথা চালাতে লাগল সেই সাহেবের সঙ্গে৷

এই টুনটুনকে আমি একদিন বলেছিলাম, ‘তোমার নাম তো টিনটিন রাখলে আরও ভালো হত৷’

টিনটিনের অনেক বইয়ের গল্প টুনটুন জানে৷ সব এখনও পড়তে পারে না, কিন্তু তার মায়ের মুখে গল্প শুনেছে৷ আমার কথা শুনে সে গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘মোটেই না৷ আমি কেন টিনটিন হব? আমি টুনটুন৷ আমার নাম বেশি ভালো৷ মা-বাবা আমাকে এই নামে ডাকে৷’

ওদের বাড়িতে আমি গেলেই টুনটুন আমার কাছে গল্প শুনতে চায়৷ আমি অবশ্য ওকে দেশ-বিদেশের গল্প শোনাই৷ ভূতের গল্প কখনও বলিনি৷ ভূতের গল্প আমি জানিই না!

ভূতের গল্প শোনান ওর ছোটদাদু!

আমি এই শনিবার গেছি ওদের বাড়িতে৷ দরজা খোলার পরই টুনটুন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকু বলো তো, ঘোড়া কখনও ভূত হয়?’

পিছন থেকে ওর বাবা বললেন, ‘অ্যাই টুনটুন, কাকুকে আগে ভিতরে এসে বসতে দে৷’

সোফায় বসে, টুনটুনকে কাছে টেনে এনে ওর নরম চুলে হাত বুলোতে-বুলোতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘোড়া-ভূতের ব্যাপারটা কী?’

টুনটুন ঠোঁট উলটে বলল, ‘ঘোড়ারা আবার ভূত হয় নাকি? ছাই!’

অরূপ বলল, ‘আজকালকার বাচ্চারা কী পাকা হয়েছে দ্যাখ৷ ওর মতন বয়সে জব্বর ভূতের গল্প শুনতে আমাদের ভয়ে গা ছমছম করত৷ মায়ের কোল ঘেঁষে বসতাম৷ আর আমার ছেলে ভূতের কথা শুনলেই ঠোঁট উলটে বলে, বাজে গল্প৷’

অনন্যা বলল, ‘আমি সাত-আট বছর বয়সে একটা পাখি-ভূতের গল্প পড়ে খুব ভয় পেয়েছিলাম৷ কুকুর-ভূতের বিখ্যাত গল্প ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’৷ তা হলে ঘোড়া-ভূত হবে না কেন? যাদের গ্রাণ আছে, তারাই ভূত হতে পারে৷’

টুনটুন ফুরফুর করে হেসে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তা হলে, তা হলে, গাড়ির কি প্রাণ আছে? গাড়ি কী করে ভূত হয়!’

এ-প্রশ্ন শুনে অনন্যাও যেন ঘাবড়ে গেল৷ চুপ করে রইল উত্তর না দিতে পেরে৷

আমি ভূতের গল্প লিখতে পারি না৷ কিন্তু পড়তে কিংবা শুনতে বেশ ভালো লাগে৷

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গাড়ি-ভূত ব্যাপারটা কী?’

অরূপ বলল, ‘ছোটকাকা ওকে একটা গল্প বলেছে৷ বেশ জমজমাট ভূতের গল্প৷ টুনটুন সে গল্প শুনে মোটেই বিশ্বাস করতে চায় না৷ শুধু হাসে৷’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গল্পটা কী?’

অরূপ কিছু বলবার আগেই টুনটুন বলল, ‘আমি বলছি, আমি বলছি৷’

অনন্যা বলল, ‘দাঁড়াও, আগে চা আনি৷ সুনীলদা, তুমি চায়ের সঙ্গে নিমকি খাবে? ভালো নিমকি আছে৷’

টুনটুন মা’কে বকুনি দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, আগে খাওয়ার কথা নয়৷ আগে গল্প৷’

আমিও বললাম, ‘হ্যাঁ, আগে গল্প৷’

টুনটুন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘একদিন…ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত…কপ কপ করে ঘোড়া চালিয়ে আসছে একজন সাহেব…’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুধু ঘোড়া, না ঘোড়ার গাড়ি?’

টুনটুন বলল, ‘আরে আগে শোনো না সবটা৷ ঘোড়া চালিয়ে আসছে সাহেব, খুব টায়ার্ড, কপালের ঘাম মুছছে৷’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কোথায়? বিলেতে?’

টুনটুন বলল, ‘না, কলকাতায়৷ প্রথম আরম্ভ হয়েছিল অনেক…অনেক দিন আগে৷’

অরূপ বলল, ‘তখন কলকাতায় অনেক সাহেব ছিল৷ সবাই ঘোড়ায় চড়ত৷’

টুনটুন বলল, ‘বাবা, আমি বলব, আমি বলব৷…অনেক রাত, সাহেবটা বাড়ি ফিরছে৷ খুব কাছে এসে গেছে৷ এমন সময় দ্যাখে কী, তার আগে-আগে যাচ্ছে একটা কালো রঙের ঘোড়ার গাড়ি৷ সে গাড়িতে তিন-তিনখানা ঘোড়া৷’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগে সে ঘোড়ার গাড়িটা দেখতে পায়নি?’

অরূপ বলল, ‘হয়তো পাশের কোনও গলি থেকে এসেছে!’

টুনটুন আবার হাত তুলে বলল, ‘অ্যাই, তোমরা কেউ বলবে না! আমি বলব! আমি বলব৷ না, ওই সাহেবটা আগে ঘোড়ার গাড়িটা দ্যাখেনি৷ হঠাৎ চলে এল কোথা থেকে৷ তারপর ঘোড়ায় চড়া সাহেবটার বাড়ির একেবারে দরজার কাছে সেই গাড়িটা থেমে গেল৷ সঙ্গে-সঙ্গে দরজা খুলে আর-একজন সাহেব লাফিয়ে নেমে পড়ল সেই গাড়ি থেকে৷ তারপর দৌড়ে ঢুকে গেল ভিতরে৷ লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে৷’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে বাড়িটার দরজা খোলা ছিল অত রাতে?’

টুনটুন বলল, ‘কী জানি, তা জানি না!’

অরূপ বলল, ‘অন্য সাহেবকে দেখে আপনি-আপনি দরজা খুলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই!’

টুনটুন বলল, ‘আগের ঘোড়ায়-চড়া সাহেবটাও নেমে পড়ে পিছন-পিছন এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কে? কে?’ অন্য সাহেবটা শুনলই না৷ কোনও উত্তরই দিল না৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল, উঠতেই লাগল৷ অন্য সাহেবটাও তাকে ফলো করছে৷ হঠাৎ অন্য আগের সাহেবটা একেবারে উপরে উঠে ফিরে দাঁড়াল৷ অন্য সাহেবটার দিকে থুঃ করে অনেকখানি থুতু দিল৷ তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল৷ সেই সাহেবটা ভূত!’

অনন্যা বলল, ‘অ্যাই টুনটুন, তুই এই জায়গাটা নিজে বানাচ্ছিস! মোটেই থুতু দেয়নি৷ এমনিই অদৃশ্য হয়ে গেছে৷’

টুনটুন খিলখিল করে হাসতে-হাসতে বলল, ‘ততক্ষণে সেই কালো ঘোড়ার গাড়িটাও অদৃশ্য হয়ে গেছে৷ সাহেবটাও নেই, ঘোড়ার গাড়িও নেই৷ সব ফক্কা৷ সাহেবটাও ভূত, গাড়িটাও ভূত! তিন-তিনটে ঘোড়া!’

টুনটুনের হাসি আর থামেই না!

অরূপ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সুনীল, তুই এই গল্পটা তো আগে শুনেছিস, তাই না?’

আমি বললাম, ‘এটা তো বিখ্যাত গল্প! ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূত৷ অনেকেই নাকি দেখেছে! বছরে একবার আসে! এত দিন পরেও কি আসে?’

অরূপ তার ছেলেকে বলল, ‘ওয়ারেন হেস্টিংস কে ছিল জানিস না তো! আমাদের দেশ তখন পরাধীন৷ ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন গভর্নর জেনারেল, মানে বড়লাট৷ তিনি অনেক অন্যায় করেছিলেন৷ আমাদের মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দিয়েছিলেন৷ দেশে ফিরে যাওয়ার পর, মানে, লন্ডনে ফিরে যাওয়ার পর এই ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার হয়৷ তাঁকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়, বুঝলি!’

টুনটুন বলল, ‘মরে গিয়ে ভূত হল লন্ডনে৷ তা হলে কলকাতায় ফিরে আসে কেন? ভূত কি এত দূর আসতে পারে?’

অরূপ বলল, ‘ভূতেরা সব পারে৷ ওয়ারেন হেস্টিংস ভূত হয়ে কলকাতায় কেন ফিরে আসে জানিস? হেস্টিংসসাহেব যখন কলকাতা ছেড়ে চলে যান, তখন সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সময় একটা ছোট কালো বাক্স নিতে ভুলে গিয়েছিলেন৷ সেই বাক্সটায় ছিল অনেক দরকারি কাগজপত্র৷ সেই কাগজপত্রগুলো দেখাতে পারলে বিচারের সময় অনেক সুবিধে হত৷ হয়তো, ওঁর দোষ অনেক কমে যেত৷ কিন্তু তখন আর ফেরার উপায় ছিল না৷ তাই ভূত হয়ে ফিরে আসে৷’

টুনটুন বলল, ‘ভূত কি প্লেনে চেপে আসে?’

অরূপ বলল, ‘ধ্যাত, তখন তো প্লেন আবিষ্কারই হয়নি! ভূতরা নিজেরাই আকাশে উড়তে পারে৷’

টুনটুন আবার খিলখিল করে হাসতে লাগল৷

অরূপ বলল, ‘দেখেছ, দেখেছ, ছেলেটা এখনও হাসছে!’

টুনটুন বলল, ‘তিন-তিনটে ঘোড়া-ভূত! আবার গাড়িটাও ভূত!’

ছেলেটার হাসি দেখে আমারও হাসি পেয়ে গেল!

অনন্যা একটু বাদে চা আর নিমকি নিয়ে এল৷

চায়ে চুমুক দিতে-দিতে আমি বললাম, ‘এসব তো দু’শো বছরেরও আগের কথা৷ কোনও মানুষ দু’শো বছর বাঁচে না৷ ভূতের আয়ু কি মানুষের চেয়েও বেশি?’

অরূপ বলল, ‘সেই বাড়িটা কিন্তু এখনও আছে৷ হেস্টিংস হাউজ৷ হেস্টিংসসাহেব চলে যাওয়ার পর সেখানে অন্য সাহেবরা থাকত৷ তারপর অনেক হাত বদল হয়েছে৷ একনও নাকি পনেরোই ফেব্রুয়ারি রাত্তিরে সেখানে ঘোড়ার গাড়িটা দেখা যায়!’

আমি বললাম, ‘টুনটুন কিন্তু একটা কথা ঠিকই ধরেছে৷ মানুষ মরলে ভূত হয়, এরকম অনেক শোনা গেছে৷ কেউ মানে, কেউ মানে না৷ যাদের প্রাণ আছে, তারাই ভূত হতে পারে, যদি একথা ধরেই নিই, কিন্তু কাঠের তৈরি একটা গাড়ি, সেটা কী করে হঠাৎ দেখা যাবে? কী করেই বা অদৃশ্য হয়ে যাবে? কাঠের গাড়ি তো ভূত হতে পারে না!’

অনন্যা কলল, ‘একটা কাজ করলে হয় না? পরশুই তো পনেরোই ফেব্রুয়ারি৷ সেই রাতে আমরা ওই বাড়িতে গিয়ে যদি রাত্তিরে থাকি, তা হলে আমরা নিজেরাই পরিক্ষা করে দেখতে পারি!’

অরূপ বলল, ‘আমরা ও বাড়িতে থাকব কী করে? আমাদের পারমিশান দেবে কেন?’

আমি বললাম, ‘সে ব্যবস্থা বোধহয় করা যাবে!’

টুনটুন বলল, ‘হ্যাঁ, চলো, চলো, আমরা ভূত দেখব, ভূত দেখব!’

সে ব্যবস্থা করতে তেমন অসুবিধে হল না৷

সরকারের একজন বড় অফিসারের সঙ্গে আমার চেনা ছিল, সেই ব্যবস্থা করে দিল৷

রাত্তিরবেলা ও বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার থাকে৷ দিনের বেলা এখানে একটা কিছু ট্রেনিং কলেজের ক্লাস হয়, রাত্তিরে ফাঁকাই পড়ে থাকে৷

কেয়ারটেকারের নাম ঘনশ্যাম দাস৷ খুব গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা, মুখে বড় গোঁফ৷ তার একটা বন্দুকও আছে৷

ঘনশ্যামকে দেখেই টুনটুন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ঘোড়ার গাড়ির ভূত দেখেছেন? সে গাড়ি এখনও আসে?’

ঘনশ্যাম বলল, ‘হ্যাঁ, অনেকবার দেখেছি৷’

টুনটুন আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ভয় পান না?’

ঘনশ্যাম বলল, ‘ভয় পেলে কি আর এই চাকরি করতে পারতাম খোকা? আমার আগের অনেক লোক ভয়ে পালিয়েছে৷ এখনকার যা দিনকাল পড়েছে, বাঘ-সিংহ-ভূত কিছুরই ভয় পেলে আর চাকরি থাকে না!’

অরূপ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি সত্যিই কি দেখেছেন? ঘোড়ার গাড়িটা আসে?’

সে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বছরে একদিন আসে!’

অরূপ আবার জিজ্ঞেস করল, ‘হেস্টিংসসাহেবকে সে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছেন?’

ঘনশ্যাম বলল, ‘হ্যাঁ, তাও দেখেছি! এমনকী এক রাতে উপরের একটা বাথরুমে দরজা খুলে দেখি, সেখানে একজন সাহেব দাঁড়িয়ে আছে৷ যেমন ছবি আছে, সেইরকম চেহারা৷’

টুনটুন বলল, ‘সেই সাহেব-ভূত আপনাকে দেখে কী বলল?’

ঘনশ্যাম বলল, ‘সেই সাহেব চোখ পাকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘ড্যাম ফুল, গেট আউট!’ আমিও বললাম, ‘নো গেট আউট! এটা আমার চাকরি!’ ব্যস, অমনি সাহেব অদৃশ্য হয়ে গেল!’

টুনটুন আবার হাসতে-হাসতে বলল, ‘নো গেট আউট! নো গেট আউট!’

উপরের হলঘরটায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল৷

অনন্যা টিফিন কেরিয়ার ভর্তি করে লুচি, আলুর দম, কিমার তরকারি আর দু-তিন রকম সন্দেশ নিয়ে এসেছে৷ আর ফ্লাস্কে চা৷

আটটা বাজতে না-বাজতে খিদে পেয়ে গেল৷

খাওয়া শুরু করার পর অনন্যা বলল, ‘কেয়ারটেকার ভদ্রলোককেও কিছু খাবার দেওয়া উচিত৷’

আমি বললাম, ‘একটা বাটিতে সবকিছু দাও৷ আমি ওকে দিয়ে আসছি৷’

ঘনশ্যামকে ডেকে আমি একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে ওর হাতে খাবারের বাটিটা দিয়ে আমি বললুম, ‘শুনুন, আপনি ভূত দেখেছেন কি দেখেননি, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না! আমরা এখানে সারারাত থাকব, তারপর যা ঘটবার ঘটবে! কিন্তু আপনি মিথ্যে-মিথ্যে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবেন না৷ আমাদের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে আছে, হঠাৎ ভয় দেখালে ওর ক্ষতি হতে পারে!’

ঘনশ্যাম বলল, ‘ওই বাচ্চা ছেলেটা স্যার, মুখ দেখেই বোঝা যায়, দারুণ চালু! ওকে ভয় দেখানো খুব শক্ত৷ আসল ভূত এলেও লজ্জা পেয়ে যাবে!’

রাস্তা দিয়ে অনেক গাড়ি চলে৷ রাত দশটা বাজার পর গাড়ির শব্দ ক্রমশ কমে এল৷

আমরা যদিও আলো জ্বেলে রেখেছি, তবু এক-এক সময় গা কেমন ছমছম করে৷ ভূতে বিশ্বাস না করলেও এরকম হয়!

হেস্টিংসসাহেবের ঘোড়ার গাড়ি আসবার কথা রাত ঠিক বারোটার সময়৷ সেই পর্যন্ত জেগে থাকতেই হবে৷ এমন কিছু কষ্টকর নয়৷

কিন্তু রাত পৌনে এগারোটার সময়ই আমরা বাড়ির সামনের রাস্তায় কপ কপ আর ঝনঝন করে ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেলাম৷

অমনি সবাই ছুটে গেলাম জানলার ধারে৷

সত্যিই একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে, সাদা রঙের, সেটা টানছে দুটো ঘোড়া৷

সে গাড়িটা কিন্তু এ বাড়ির সামনে থামল না৷ সোজা চলে গেল৷

অরূপ বলল, ‘এ পাড়ার বড়লোকদের এখনও দু’-একখানা ঘোড়ার গাড়ি আছে৷ দু’ঘোড়ার গাড়িকে বলে জুড়িগাড়ি৷’

অনন্যা বলল, ‘রাত্তিরবেলা এরকম গাড়ির আওয়াজ শুনলেই অনেকে ভাবতে পারে, ভূতের গাড়ি!’

টুনটুন বলল, ‘ভূতের গাড়ি সাদা হয় না৷ কালো! নট গেট আউট! নট গেট আউট!’

আবার আমরা ফিরে এলাম ঘরের মধ্যে৷ একটা গোল টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার রয়েছে৷ এই চেয়ারেই বসে-বসে রাত কাটাতে হবে৷ সঙ্গে লুডো আর তাসও আছে৷

খানিক বাদে হঠাৎ বেশ জোরে একটা শব্দ শোনা গেল৷ কেউ যেন মাটিতে কোনও পাথরের জিনিস ঘষছে৷ শব্দটা শুনে প্রথমটা বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে৷ অনন্যা তো বলেই উঠল, ‘ওরে বাবা, ওটা কিসের শব্দ!’

শব্দটা আসছে এই বাড়ির ভিতর থেকে৷

আমি অরূপকে বললাম, ‘তুই এখানে থাক, আমি দেখছি!’

অরূপ বলল, ‘চল, আমিও যাচ্ছি তোর সঙ্গে৷’

অনন্যা বলল, ‘আমি একা থাকতে পারব না!’

টুনটুন অমনি বলে উঠল, ‘একা মানে? আমি আছি না?’

ঠিকই তো, এরকম সাহসী ছেলে আছে, অনন্যার ভয় কী!

খানিকটা খুঁজতেই দেখা গেল, দোতলাতেই একটা ছোট ঘরে শুয়ে আছে ঘনশ্যাম৷ শব্দটা আর কিছু না, তার নাসিকা গর্জন! কোনও মানুষের এত জোর নাক-ডাকা আমি আগে শুনিনি৷

আমরা দু’জনে মিলে ঘনশ্যামকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিলাম৷ তাতে তার নাক ডাকা থামল, কিন্তু ঘুম ভাঙলও না৷

ঘরে ফিরে এসে আমরা তাস খেলা শুরু করলাম তিনজনে৷

হঠাৎ একসময় খেয়াল হল, টুনটুন তো ঘরে নেই! সে কোথায় গেল!

টুনটুনকে বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল, সে এই ঘরেই থাকবে, আর কোথাও যাবে না৷

এই ঘরের সঙ্গে আছে একটা বাথরুম৷ উঁকি দিয়ে দেখলাম, টুনটুন সেখানেও নেই৷

আমরা ডাকতে লাগলাম তার নাম ধরে, ‘টুনটুন! টুনটুন!’

কোনও সাড়া নেই৷ ছটফটে ছেলেটা গেল কোথায়?

একতলায় যাওয়ার সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে রেখেছিলাম, সেটা ভিতর থেকে বন্ধই আছে৷ তার মানে ও নীচে যায়নি৷

উপরতলার কয়েকটা ঘর তালাবন্ধ৷ দুটো মাত্র ঘর খোলা, সেখানেও তাকে দেখা গেল না৷

ঘনশ্যাম এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে৷

কয়েকবার তাকে ডাকাডাকি করেও কোনও লাভ হল না৷ কিছুতেই তার ঘুম ভাঙে না৷

এত যার গভীর ঘুম, তার আবার ভূতের ভয় থাকবে কী করে? তবে তার চাকরি কেয়ারটেকারের, সে এরকম ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েই ডিউটি দেয়৷

তা হলে কি ছাদে গেছে টুনটুন?

আমরা তিনজনেই উঠে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে৷ উপরের দরজাটার একটা পাল্লা ভাঙা, সুতরাং সেটা বন্ধ করার প্রশ্নই নেই৷

মস্ত বড় ছাদ৷ আকাশে এখন জ্যোৎস্না৷ সেই ছাদে কোথাও দেখা গেল না টুনটুনকে৷

আমাদের সবারই গলা শুকিয়ে গেল৷

কোথায় গেল টুনটুন? সে কী একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল?

ঘরের বাইরে গেলেও সে আমাদের ডাকে সাড়া দেবে না কেন?

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অনন্যা৷

আমি আর অরূপ দৌড়ে গেলাম পাঁচিলের কাছে৷

সামনের রাস্তায় এখন গাড়িটাড়িও নেই৷ সব দিক একেবারে ফাঁকা৷

অরূপ বলল, ‘কী হল বল তো! কোথায় যেতে পারে? তা হলে তো এক্ষুনি থানায় খবর দেওয়া দরকার৷’

আমারও একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খাবার মতন অবস্থা৷ একটা ছেলে কী করে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, তা মাথাতেই ঢুকছে না৷

এই সময় হঠাৎ কী একটা পাখি সেখানে এসে ডানা ঝাপটাতে লাগল৷ আমাদের খুব কাছেই৷

অনন্যা আরও ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও মা গো!’

অনন্যা একটা পাখি-ভূতের কথা বলেছিল৷ গল্পে পড়েছে৷ এটাকেও নিশ্চয়ই পাখি-ভূত ভেবেছে৷

ভালো করে তাকিয়ে দেখি, সেটা একটা বাদুড়৷

এখানে এই সময়ে একটা বাদুড়ই বা এল কী করে? অনেক ভূতের গল্পে বাদুড় থাকে৷

তারপরই মনে পড়ল, এই আলিপুরের দিকে অনেক বাদুড় আছে, আমি আগে দেখেছি৷ দিনের বেলা একটা উঁচু গাছে ঝোলে৷

বাদুড়টা কয়েক পাক ঘুরেই চলে গেল৷

তারপরই একটা শব্দ হল ছাদের এক কোণে৷

আগে লক্ষ করিনি, ছাদের ভিতরের দিকে পাঁচিলের একপাশে দু’খানা ছোট-ছোট ঘর আছে৷ খুবই ভাঙাচোরা চেহারা৷ জ্যোৎস্নার আলোয় ঠিক বোঝা যায় না৷

এইরকম সময় যে-কোনও শব্দ শুনলেই বুক কেঁপে ওঠে৷ একটা সামান্য বাদুড়কে দেখলেও অন্যরকম মনে হয়৷

আমি আর অরূপ সেই শব্দ-হওয়া দিকটায় খানিকটা এগিয়ে যেতেই একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল টুনটুন৷ তার হাতে কী যেন রয়েছে৷

অরূপ দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলি? কী করছিলি?’

অনন্যা হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে, প্রথমে সে টুনটুনকে দেখতেই পায়নি৷ এবার হাত সরিয়ে সে ছেলেকে দেখে আরও জোরে কেঁদে উঠল৷ এ কান্নাটা আনন্দের৷

টুনটুন যে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল, আমি সেটার মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলাম৷

অজস্র কাগজপত্র আর ভাঙা জিনিসপত্রের জঞ্জাল সেখানে জড়ো করা রয়েছে৷ ফুটো বালিশ থেকে আরম্ভ করে ভাঙা কাপ-ডিশ, সবই রয়েছে সেখানে৷

টুনটুনের হাতে ওটা কী?

টুনটুন বলল, ‘এই দ্যাখো, কী পেয়েছি!’

একটা চ্যাপটা মতন কালো বাক্স, তার উপরে ইংরেজি বড়-বড় অক্ষরে লেখা ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’!

অরূপ জোরে বলে উঠল, ‘এই তো ওয়ারেন হেস্টিংসের সেই ফেলে যাওয়া বাক্স! তুই খুঁজে পেলি?’

বাক্সটার তলা খুলে গেছে৷ উপরটাও ফাটা-ফাটা, ব্যবহারের অযোগ্য৷ তাই এতদিন কেউ নেয়নি৷ ভিতরের কাগজপত্র বেরিয়ে আসছে৷

আমি একটা কাগজ নিয়ে দেখতে গেলাম, অমনি সেটা ঝুরঝুর করে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গেল৷

কোনও কাগজই এখন আর পড়ার অবস্থা নেই৷ এতদিন আগেকার জিনিস, হাত দিলেই গুঁড়িয়ে যায়৷

অরূপ বাক্সটা উলটে সব কাগজের গুঁড়োগুলো ছড়িয়ে দিল বাইরে৷

আমি বললাম, ‘ইশ, বেচারি ওয়ারেন হেস্টিংস এই বাক্সটা খুঁজে পেলে, ভূত হয়ে এত দূরে বারবার ছুটে আসতে হত না!’

ঠিক তখনই আমরা রাস্তায় পেলাম একটা ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ৷

আমরা ছুটে গেলাম রাস্তার ধারের পাঁচিলের দিকে৷ সত্যিই একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটে আসছে এ বাড়ির দিকে৷ চোখের ভুল নয়, সত্যি দেখছি৷

আমার বুক ধকধক করছে৷ এই তবে সেই ভূতের গাড়ি! জীবনে প্রথম এখানে ভূত দেখব?

গাড়িটা কিন্তু এ বাড়িটার গেট পর্যন্ত এল না৷ একটু আগে থেমে গেল৷ একটা ঘোড়া ডেকে উঠল চিঁ হিঁ হিঁ করে৷

তারপর গাড়িটা ঘুরে গেল উলটো দিকে৷ কপ-কপিয়ে চলে গেল অনেক দূরে৷

সেটা ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূতের গাড়ি, না সে পাড়ারই কোনও ধনী ব্যক্তির জুড়িগাড়ি, তা আমি জানি না৷

তবে একটা কথা ঠিক, ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূতের গাড়ি এখানে আর কোনওদিনও আসবে না৷ কারণ সেই বাক্সটার মধ্যে যে এখন আর কিছুই নেই!

অরূপ তার ছেলেকে বলল, ‘দেখলি, দেখলি তো? ভূতের গাড়ি!’

টুনটুন ঠোঁট উলটে বলল, ‘ভূত না ছাই! এ তো সেই সাদা গাড়িটা! দুটো মোটে ঘোড়া!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *