1 of 2

ভূতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভূতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

যে কাজ যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, কিংবা যে কাজ আশ্চর্যজনক ভাবে ঘটে যায়, তাকে আমরা বলি ভুতুড়ে কাণ্ড।

আবার ভূতেরা নিজে যে কাজ করে তাকে তো ভুতুড়ে কাণ্ড বলেই।

আমাদের পরিবারে এমনই এক ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটেছিল।

পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছি। দিদিমা আর মামাদের আদরের সঙ্গে প্রচুর আম জাম জামরুল খাচ্ছি। তোফা আনন্দে সময় কাটাচ্ছি।

তিন মামা। বড়মামা রেল অফিসে কাজ করতেন। বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে শহরের বাসাবাড়িতে থাকতেন। মাসে একবার বাড়িতে আসতেন।

তিনি মেজমামাকে তাঁরই অফিসে চাকরি করে দেবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মেজমামা রাজী নন। ছেলেবেলা থেকে মেজমামা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সব ব্যাপারেই বেপরোয়া।

তিনি বলেছিলেন, চাকরি-বাকরি আমার ধাতে পোষাবে না। আমি স্বাধীন ব্যবসা করব।

তা মেজমামা স্বাধীন ব্যবসাই শুরু করেছিলেন। পাঁচ মাইল দূরের মাছের ভেড়ি থেকে মাছ কিনে গঞ্জের হাটে ব্যাপারীদের কাছে সেই মাছ বিক্রি করা। পরিশ্রমের কাজ কিন্তু ভাল টাকাই হাতে থাকত।

ছোটমামা কিছু করত না। মামাদের চাষ বাসের জমি দেখত আর অবসর সময়ে জাল দিয়ে পাখি ধরত, কাঠি দিয়ে খাঁচা তৈরি করত আর তাতে পাখিগুলোকে রাখত। তবে বেশিদিন নয়। হঠাৎ একদিন খাঁচার দরজা খুলে পাখিগুলোকে উড়িয়ে দিত। এক নম্বরের খেয়ালী লোক।

আমাদের গল্প অবশ্য মেজমামাকে নিয়ে।

গল্পই বা বলি কেন, একেবারে আমার চোখে দেখা ঘটনা।

মেজমামা খুব ভোরে উঠে সাইকেলে রওনা হয়ে যেতেন। খুব ভোরে, তখন ভাল করে আলোও ফুটত না। রাস্তাটা অনেকটা পাকা নয়। মানুষের পায়ে পায়ে চলে সরু একটু রেখা। বেশ কিছুটা যাবার পর ইউনিয়ন বোর্ডের পাকা রাস্তা।

একদিন ভোরেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের গর্জন। বোঝা যাচ্ছে একটু পরেই ঝড়জল শুরু হয়ে যাবে।

মেঘের ডাকে আমিও ভোর ভোর উঠে পড়েছি। উঠে মেজমামার যাওয়ার তোড়জোড় দেখছি।

দিদিমা বললেন, ওরে, এই আবহাওয়ায় আজ না হয় নাই বেরোলি। আকাশের অবস্থা ভাল নয়। এখনই জোর তুফান উঠছে।

ঝড়কে দিদিমা তুফান বলতেন।

মেজমামা হাসলেন, তাহলে তো বর্ষাকালে বাড়ির বাইরে যাওয়া যায় না। আমার কাছে বর্ষাতি আছে। কোন অসুবিধা হবে না।

মেজমামা যখন বের হলেন, তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বাতাসও বেশ জোর।

আধ ঘন্টার মধ্যে দারুণ ঝড় উঠল। চারদিক অন্ধকার। বাজের শব্দে কান পাতা দায়। সেই সঙ্গে তুমুল বর্ষণ। এধারে ওধারে বড় বড় গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ল কি বাড়ির চালা উড়ে গেল। ধসে পড়ল মাটির দেয়াল। দিদিমার কথাই ঠিক। তুফানই বটে।

আমি জানলার ধারে চুপচাপ বসে প্রকৃতির তাণ্ডব দেখছি। একটু পরেই দিদিমা এসে আমার পাশে বসলেন।

বসেই আক্ষেপ করতে লাগলেন, এই সুযোগে বাড়ির কুকুর বেড়াল বাইরে বের হয় না, আর এত বারণ করা সত্ত্বেও ছেলেটা রাস্তায় বের হল।

সত্যিই চিন্তার কথা। এই ঝড়জলে বর্ষাতি আর মেজমামাকে কতটুকু বাঁচাতে পারবে। হাওয়ার দাপটে সাইকেল চালানোই মুশকিল। সাইকেল থেকে নেমে যে কোন গাছের তলায় আশ্রয় নেবেন, তাও নিরাপদ নয়। মাথার ওপর গাছের ডাল ভেঙে পড়লেই হল।

সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা ঝড়বৃষ্টি চলল। দিদিমা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে বিছানা নিলেন। মেজমামার নাম করে অঝোরে কান্না।

মেজমামা ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ। সাইকেল নেই। হেঁটেই এসেছেন। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। পরনের জামা কাপড় ছিন্নভিন্ন। বর্ষাতির খোঁজ নেই।

দিদিমা মেজমামাকে জাপটে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়বেন না। শুধু কি জাপটে ধরা, ভেউভেউ করে কান্না।

মেজমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ ছাড়! জাপটাজাপটি আমার ভাল লাগে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মেজমামা তোমার সাইকেল?

বটগাছ চাপা পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে।

বটগাছ চাপা?

হ্যাঁ, কাঞ্চনতলার কাছে দারুণ ঝড় উঠল। বটগাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ল আমার ওপর। সাইকেল চুরমার হয়ে গেল। আমি ছিটকে পড়লাম মাটির ওপর। এই দেখ না।

মেজমামা চুল সরিয়ে দেখালেন। মাথার এক জায়গায় রক্ত জমে কালো হয়ে আছে।

তারপর থেকে মেজমামা কেমন বদলে গেলেন।

মাছের ব্যবসা বন্ধ। সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটাতেন। রাত্রে বেরিয়ে যেতেন। কখন ফিরতেন কে জানে।

দিদিমা অনেক বলতেন, কিন্তু মেজমামা নির্বিকার।

শেষকালে দিদিমার নির্দেশে আমি শুতাম মেজমামার সঙ্গে। অবশ্য আলাদা খাটে।

একদিন খুব ভোরে মেজমামার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।

এই, এক কাপ চা খাওয়াতে পারিস?

ঘরের কোণে স্টোভ ছিল। তাকের ওপর চা, চিনি কাপ ডিশ। আগে আগে ভোরে বের হবার সময় মেজমামা নিজে চা করে খেতেন।

ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, তুমি নিজে করে খাও না।

মেজমামা যেন ভয় পেয়ে গেলেন, না, আমি আগুনের কাছে যেতে পারব না। ভয় করে।

ভয় করে কথাটা মেজমামার মুখে নতুন শুনলাম। মেজমামা চিরকাল দুর্দান্ত প্রকৃতির। দারুণ সাহস।

সেই দুর্ঘটনার পর থেকে মেজমামা যেন কুঁকড়ে গেছেন। কারও সঙ্গে ভাল করে কথাও বলেন না। কেউ ডাকতে এলে বলে দেন, বল, আমি বাড়িতে নেই।

আরও আশ্চর্যের কাণ্ড মাথার একদিকের রক্ত জমে থাকাটা একই রকম রয়ে গেল। ওষুধপত্র মালিশ কিছুতে কিছু হল না।

অগত্যা উঠে চা তৈরি করে দিলাম। নিজেও খেলাম এক কাপ।

আর এক রাতে এমন এক ব্যাপার ঘটল, তাতে একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। ক’দিন গুমোট গরম পড়েছে। হাতপাখা নেড়ে নেড়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি।

বহুকষ্টে যাও-বা একটু ঘুম এল, সেটা পেঁচার কর্কশ আওয়াজে ভেঙে গেল।

ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। কোথাও একটু অন্ধকার নেই।

মেজমামার দিকে চোখ ফিরিয়েই চমকে উঠলাম। আমার মামার বাড়ির সবাই বেশ একটু খর্বকায়। মেজমামা আবার সবচেয়ে বেঁটে।

সেই মেজমামাকে দেখলাম, বিরাট চেহারা। দেহ খাটের বাইরে গিয়ে পড়েছে।

দুটো চোখ রগড়ে নিয়ে আবার দেখলাম একই দৃশ্য।

খাট থেকে নেমে পালাবার চেষ্টা করতেই দৃশ্য বদলে গেল। মেজমামা যেন নিজের সাইজে ফিরে এলেন।

মনকে বোঝালাম ঘুম চোখে নিশ্চয় ভুল দেখেছি। না হলে এমন ব্যাপার হতে পারে নাকি!

একথা কাউকে কোনদিন বলি নি, জানি কেউ বিশ্বাস করবে না।

কিন্তু পরে যা ব্যাপার ঘটল, তাতে আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম।

এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, মেজমামা বিছানায় নেই। ভাবলাম প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গেছেন এখনই ফিরবেন, কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেল, মেজমামা ফিরলেন না।

উঠে পড়লাম। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ ফিরিয়েই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মেজমামা রোয়াকে বসে আছে। জানলার দিকে পিছন ফিরে।

একটু দূরে গোটা কয়েক গাছ পার হয়ে একটা জাম গাছে ছোটমামা জাল পেতে রেখেছে পাখি ধরবার জন্যে। জালের এক জায়গায় ফুটো ছিল, ছোটমামা বোধ হয় লক্ষ্য করেনি। সেই ফুটো দিয়ে আটকে থাকা পাখিগুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাচ্ছে।

মেজমামা বসে বসেই হাত বাড়ালেন। কি বিরাট হাত। বোয়াক থেকে জাম গাছটার দূরত্ব কম পক্ষে ত্রিশ গজ তো হবেই।

হাতটা সোজা গাছের ওপর চলে গেল। যেখানে জালের ফুটো সেখানে। মেজমামা আঙুল দিয়ে জালে গিট বেঁধে দিলেন। পাখিদের পালানো বন্ধ হল।

আমি বুকের ওপর হাত চেপেও দুপদুপ শব্দ বন্ধ করতে পারলাম না। মনে হল এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব। কোনরকমে কাঁপতে কাঁপতে খাটের ওপর শুয়ে পড়লাম।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। ভোরে উঠে দেখি মেজমামা খাটে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আশ্চর্য কাণ্ড, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কাল রাতে মেজমামা যখন রোয়াকে বসে তখন লক্ষ্য করেছি, দরজায় ছিটকানি।

তাহলে মেজমামা বাইরে গেলেন কি করে? বন্ধ দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যেই বা কি করে ঢুকলেন?

ঠিক করে ফেললাম, আর মামার বাড়ি নয়। কোন একটা অছিলায় বাড়ি পালাব।

এটাও কি চোখের ভুল? দু’ দুবার এরকম চোখের ভুল হতে পারে কখনও!

দুপুরবেলা কিন্তু মত বদলে গেল। ছোটমামা জালে আটকানো পাখিগুলো নিয়ে খাঁচায় পুরছিল। আমি বসে বসে দেখছিলাম। মেজমামাও বসেছিলেন।

বেশির ভাগই মনুয়া আর টুনটুনি পাখি। একটা শুধু বড় আকারের টিয়া। গাঢ় সবুজ রং। লাল চোখ। কিছুতেই ধরা দেবে না। ছোটমামার হাতে ঠুকরে রক্ত বের করে দিল।

আমি তো তখন দেখছিলামই, আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম। আড়চোখে দেখছিলাম উঠোনে মেজমামার ছায়া পড়েছে কিনা, আর তাঁর পায়ের আঙুলগুলো উল্টোদিকে কিনা!

দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। উঠোনের ওপর মেজমামার রীতিমত ছায়া পড়েছে আর তাঁর পায়ের আঙুলগুলো একেবারে স্বাভাবিক।

তার মানে রাত্রে নিশ্চয় আমি বিদঘুটে স্বপ্ন দেখেছি। পেট গরম হলে যা হয়। পেট ঠাণ্ডা করার জন্য রোজ সকালে একটা করে ডাব খেতে হবে।

আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিপদও আছে। এখানে দিব্যি হেসে খেলে বেড়াচ্ছি, আর ওখানে বাবা রোজ পাঁচপাতা হাতের লেখা আর দশটা অঙ্ক কষাবে।

বেশ কিছুদিন অলৌকিক কিছু চোখে পড়ল না। বুঝতে পারলাম নিজের ভয়ের বিকৃত রূপটাই দেখেছি।

মেজমামা যে মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, তাতে দিদিমা খুব খুশি। তাঁর দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে।

কিন্তু আমি ভাবি মেজমামার চলবে কি করে।

একদিন জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম।

হ্যাঁ মেজমামা, তুমি যে মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিলে? কি হবে?

মেজমামা চুল আঁচড়াচ্ছিলেন, ফিরে বললেন, কেন, তোর অসুবিধাটা কি হচ্ছে?

মুশকিলে পড়ে গেলাম। সামনে গিয়ে বললাম, না, অসুবিধা আর ক! আগে তুমি মাঝে মাঝে বড় বড় মাছ আনতে—

আমাকে থামিয়ে দিয়ে মেজমামা বললেন, ও, এই কথা। তোকে আজই বড় মাছ খাওয়াচ্ছি।

মেজমামা বেরিয়ে গেলেন। ‘ফিরলেন, হাতে একটা প্রকাণ্ড রুই মাছ নিয়ে।

আমি তো অবাক।

হ্যাঁ মেজমামা, এর মধ্যে এত বড় মাছ পেলে কোথায়?

মেজমামা হাসলেন, একজন জেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাছের ঝুড়ি নিয়ে হাটে যাচ্ছিল। আমার তো সবই চেনা। বলতেই দিয়ে দিল।

দিদিমার আনন্দ আর ধরে না। বঁটি নিয়ে এসেই মাছ কুটতে বসলেন। আমি কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম।

রোজ ছাই রঙা একটা উটকো বেড়াল এ বাড়িতে আসত। আহারের সন্ধানে। সেদিনও সে এসে হাজির।

বঁটির পাশে আঁশের স্তূপ। বেড়ালটা এগিয়ে এসে আঁশে মুখ দিয়েই বিকট স্বরে ম্যাঁও করে উঠল। অস্বাভাবিক স্বর। কেউ যেন তার গলা টিপে ধরেছে।

তারপর ল্যাজটা খাড়া করে সোজা পাঁচিলের ওপর গিয়ে উঠল। দিদিমাও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন।

তিনি বললেন, বেড়ালটার কি হল বল তো? ওভাবে চেঁচিয়ে উঠল! গলায় কাঁটা ফুটল না কি?

কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছি বেড়ালটা একটা আঁশও মুখে তোলে নি। খাওয়া তো দূরের কথা! কেবল শুঁকেই ওই রকম চিৎকার করে উঠল। সব ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়েছিল।

এমন কি দিদিমা যখন একটা কলাপাতায় বড় মাছের টুকরো ভেঙে আমাকে খেতে ডাকলেন তখন একটু ইতস্তত করেছিলাম।

তারপর মনে সাহস এনে মাছের টুকরো মুখে দিয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। না, কোন গোলমেলে ব্যাপার নেই। দিব্যি সুস্বাদু মাছ।

কত অল্পেতে আমরা ভয় পেয়ে যাই। বেড়ালটার ওভাবে চিৎকার করে ওঠার হাজার কারণ থাকতে পারে।

ভবে সেদিন থেকে বেড়ালটাকে আর ধারে কাছে দেখতে পাই না। বোধ হয় অন্য কোন বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে।

এতদিন কথাটা দিদিমা কিংবা ছোটমামাকে বলি নি। কারণ, প্রথমত সব ব্যাপারটা নিজেই ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি। হয়তো আমারই চোখের ভুল কিংবা ভয়ের ছায়াটা রূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

দ্বিতীয়ত প্রয়োজন হলে এই অলৌকিক কাণ্ড যে কাউকে দেখাতে পারব, এমন সম্ভাবনা কম।

তাছাড়া দিদিমাকে নিজের ছেলের সম্বন্ধে কি করে এসব কথা বলি।

তবে আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম আর একবার এরকম বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়লেই মামার বাড়ি থেকে পালাব। এখানে আদরযত্নের লোভে তো আর বেঘোরে প্রাণ দিতে পারি না।

বেশ কিছুদিন সব স্বাভাবিক। কোথাও কোন গোলমাল হল না। মেজমামা অবশ্য মাছের ব্যবসায় আর গেলেন না। বাড়িতেও বিশেষ থাকতেন না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতেন কে জানে।

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, একটা কিছু করবার চেষ্টায় আছি। কতদিন আর চুপচাপ বসে থাকব।

তারপরই অঘটন ঘটল।

মাঝরাতে বাথরুমে যাবার প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে দেখি, ছোটমামা রোয়াকের এককোণে দাঁড়িয়ে। একেবারে পাথরের মূর্তির মতন নিস্পন্দ, নিশ্চল।

আমি কাছে যেতেই আঙুল দিয়ে বাগানের দিকে দেখাল। যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল।

একটা গাছের ডালে মেজমামা পা ঝুলিয়ে বসে। মেজমামা মানে মুখটা মেজমামার, কিন্তু দেহটা বিরাট। মাথাটা প্রায় গাছের মগডালে ঠেকেছে। পা দুটো মাটির অল্প ওপরে।

কি খেয়ে খেয়ে বাগানের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলছেন। একটা ছিটকে এসে নোয়কের ওপর পড়তে নিচু হয়ে দেখেই চমকে উঠলাম। রক্তমাখা হাড়ের টুকরো।

সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল এখনিই বুঝি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ব।

ছোটমামা আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছিল।

তারপর দিন পনের কি হয়েছে আমি জানি না। দারুণ জ্বরে আমি প্রায় বেহুঁশ।

দিদিমা চেয়েছিলেন আমার বাবাকে খবর দিতে, কিন্তু ছোটমামা অনেক বুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করেছিল। ছোটমামা বলেছিল, শুধু ভয় পেয়ে আমার এই জ্বর। ডাক্তারেরও তাই মত। এর মধ্যে বাবাকে টেনে নিয়ে এলে আসল ব্যাপারটা তাঁকে জানাতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বাবা বিশ্বাস করবেন, এটা আশা করা যায় না।

অথচ তার পরের দিন সকালে দিদিমার পোষা ছাগলটা নিখোঁজ। খুঁজতে খুঁজতে বাগানের মধ্যে তার ছিন্নমুণ্ডটা পাওয়া গিয়েছিল। চারদিকে রক্তমাখা যে সব হাড়ের টুকরো পাওয়া গেল সেগুলো যে ছাগলেরই হাড় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু এমন কথা কে বিশ্বাস করবে? বিশেষ করে শহরের লোক।

মেজমামা নাকি আশ্চর্যভাবে শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। হাঁটুর ওপর মাথাটা রেখে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘরের মধ্যে। হাজার ডাকে সাড়া দিতেন না। খেতে ডাকলে রুক্ষকণ্ঠে উত্তর দিতেন, খিদে নেই। শরীর খারাপ।

দিদিমা যে মেজমামাকে এত ভালবাসতেন, সেই দিদিমা ছোটমামার কাছে সব শুনে মেজমামার ধারে কাছে ঘেঁষতে চাইলেন না।

আমি যখন সেরে উঠলাম, তখন ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়েছে।

শোবার ব্যবস্থা পালটে গেছে। একঘরে আমরা তিনজন শুতাম। একপাশে দিদিমা, অন্যপাশে ছোটমামা মাঝখানে আমি। সারারাত ঘরে আলো জ্বলত।

ছোটমামা দরজায় ভিতর থেকে ডবল তালা লাগিয়ে দিত। আমরা সবাই জানতাম অলৌকিক শক্তির পক্ষে এ তালা কোন বাধাই নয়, কিন্তু তবু বারণ করতে পারিনি।

ছোটমামা আর আমি ওই দৃশ্য দেখার পর, আমি আগে যা দেখেছি সব দিদিমা আর ছোটমামাকে বলেছি।

ছোটমামা বলল, কথাটা আগেই তোমার বলা উচিত ছিল, তাহলে আরও আগে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।

কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও ছোটমামা বলল।

বদনপুর এখান থেকে আড়াই মাইল। সেখানকার ভৈরব রোজা খুবই বিখ্যাত। তার খড়মের আওয়াজে ভূতপ্রেত থরথর করে কাঁপে।

তাকে পাওয়া একটু মুশকিল। লোকের ডাকে প্রায়ই ভিনগাঁয়ে চলে যায় আর দক্ষিণাও এক মুঠো টাকা।

দিদিমাকে ছোটমামা অনেক কষ্টে রাজী করাল। দিদিমা সব বুঝেও একটু ইতস্তত করলেন। হাজার হোক ছেলে তো।

ছোটমামা বোঝাল, বেশ তো, ভৈরব রোজা এলেই সব বোঝা যাবে।

খুব ভোরে ছোটমামা বেরিয়ে পড়ল। বদনপুরের ভৈরবকে যদি না পাওয়া যায়, তাহলে অন্য গাঁ থেকে তাকে ধরে আনতে হবে।

ছোটমামা যখন বের হয় তখন মেজমামা বাড়ি ছিলেন না। আধঘণ্টা পরে কোথা থেকে ফিরে এলেন।

চেহারা দেখে মনে হল অনেক দূর থেকে যেন ছুটতে ছুটতে আসছেন, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে। তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে ফতুয়াটা গাছের ডালে লেগে ছিঁড়ে গেছে।

দিদিমা রোয়াকে বসে তরকারি কুটছিলেন, আমি পাশে বসেছিলাম।

মেজমামা সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের দু পাশে ফেনা। লাল চোখ পাকিয়ে দিদিমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছোনে কোথায় গেছে?

ছোনে ছোটমামার ডাকনাম।

আমার বুকের দুপদাপ শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ভয় হল অবশ হয়ে বঁটির ওপর না পড়ে যাই।

দিদিমা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, নিজের কি একটা দরকারে গেছে।

নিজের দরকার না ছাই। মেজমামা দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিলেন, ভাই তো নয়, শত্তুর—শত্তুর! আচ্ছা, ঠিক আছে।

কথাগুলো বলেই মেজমামা জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির চারপাশে ঘুরতে লাগলেন, দুটো হাত পিছনে, কেবল মাথা নাড়ছেন, ধুতু ফেলছেন আর ঘুরছেন।

ব্যাপার দেখে দিদিমা আর সাহস পেলেন না। আমার হাত ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিলেন।

দিদিমার দিকে চেয়ে দেখি তার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মনের কষ্টটা বুঝতে পারলাম।

যতক্ষণ মেজমামা বাড়ির চারদিকে ঘুরতে লাগলেন, ততক্ষণ আমি আর দিদিমা ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে রইলাম।

কিছুক্ষণ পরে মেজমামাকে আর দেখা গেল না। দিদিমা উঠে জানলা দিয়ে দেখে যখন নিঃসন্দেহ হলেন যে মেজমামা ধারে কাছে কোথাও নেই, তখন আমাকে খেতে দিলেন।

নিজে কিছু খেলেন না। ছোটমামা এলে এক সঙ্গে খাবেন।

আমি খাব কি! তখনও শরীর থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে কিছু খেলেই বমি হয়ে যাবে।

মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, কোন রকমে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল সকালেই বাড়ি রওনা হব। এখানে এভাবে ভয়ে কুঁকড়ে থাকলে শীঘ্রই শক্ত অসুখে পড়ে যাব।

ছোটমামা ফিরল বেলা আড়াইটে নাগাদ। সাইকেল রিকশায়। সঙ্গে ভৈরব রোজা।

আমি জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম।

ভৈরবের পরনে লাল টকটকে কাপড়। গায়ে কোন জামা নেই। গলায় অনেকগুলো রুদ্রাক্ষের মালা। দু হাতে রুদ্রাক্ষের তাগা।

লাল দুটি চোখ। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা। ঝাঁকড়া পাকা চুল কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়েছে।

ভৈরব নেমে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাতাসে কি যেন শুঁকল, তারপর ছোটমামার দিকে ফিরে বলল, কেউ গৃহবন্ধন করেছে।

ছোটমামা অবাক।

গৃহবন্ধন কি?

কেউ মন্ত্র পড়ে গৃহবন্ধন করে দেয়, তাতে এই গৃহের মধ্যে কোন কাজকর্ম করলে তা ফল দেয় না।

কে এ কাজ করবে?

যাকে তাড়াতে চাও সেই করবে।

কিন্তু তার পক্ষে তো কিছু জানা সম্ভব নয়।

ছোটমামার কথায় ভৈরব খুব জোরে হেসে উঠল।

প্রেতাত্মার পক্ষে সব কিছু জানতে পারাই সম্ভব। মানুষের চেয়ে তারা অনেক বেশি শক্তির অধিকারী হয়।

তাহলে উপায়?

উপায় আছে বইকি। তুমি আগে সাইকেল-রিকশাকে বিদায় কর।

ছোটমামা সাইকেল-রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিল।

ভৈরব পাশে রাখা ঝোলা থেকে একটা মাটির সরা বের করল। তার ওপর চারটে পাকা লঙ্কা, একমুঠো সর্ষে, কতকগুলো কুশের ডগা রাখল। তারপর রাস্তার ওপরই বসে পড়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল।

মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই লঙ্কা, সর্ষে আর কুশের ডগা আমাদের বাড়ির দিকে ছুঁড়তে লাগল।

পিছনে নিশ্বাসের শব্দ হতে ফিরে দেখলাম দিদিমা এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর চোখে তখনও জল।

আধ ঘন্টা পরে ভৈরব উঠে দাঁড়াল।

ঠিক আছে। এবার বাড়ির মধ্যে চল।

ভৈরবের কাণ্ডকারখানা দেখে ইতিমধ্যেই রাস্তার ওপর গাঁয়ের কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। ভৈরবের পিছন পিছন তারা বাড়ির মধ্যে এসে ঢুকল।

উঠানে মাটি দিয়ে বেদী করা হল। তাতে কাঠ, শুকনো ডালপালা নিয়ে আগুন জ্বালানো হল। ভৈরব সেই অগ্নিকুণ্ড প্রদক্ষিণ করতে করতে মাঝে মাঝে কাঠি করে ঘি ছিটিয়ে দিতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে লাগল।

ততক্ষণে সাহস পেয়ে আমি রোয়াকে গিয়ে বসেছি। দিদিমা আমার পাশে। ছোটমামা ভৈরবের কাছে। তার ফাইফরমাশ খাটছে।

আধ ঘণ্টা কিছু হল না। সব নিস্তব্ধ। শুধু ভৈরবের রুক্ষ গলায় মন্ত্র পাঠের শব্দ শোনা গেল। হিং টিং ছট করে অদ্ভুত ভাষা।

আমি যখন ভাবতে শুরু করেছি যে সবটাই বুজরুকি, তখন হঠাৎ শোঁ শোঁ আওয়াজ। ঠিক অনেক দূর থেকে ঝড় এলে যেমন হয়।

পশ্চিম দিকের গাছপালাগুলো ভীষণভাবে দুলতে লাগল। গাছের ডালে বসা কাকের দল চিৎকার করে আকাশে পাক খেতে লাগল।

একটু পরেই গাছপালার পিছন থেকে মেজমামা এসে হাজির। দুটি চোখ বনবন করে ঘুরছে। ফুলে উঠেছে নাকের পাটা। মুখে একটা মুরগি। বেচারি মরণযন্ত্রণায় পাখা ঝটপট করছে। মেজমামার দু কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

মেজমামার সেই মূর্তি দেখে আমি ভয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলাম। দেখলাম উত্তেজনায় দিদিমাও ঠকঠক করে কাঁপছেন।

মেজমামা এসে দাঁড়াতে ভৈরবেরও চেহারা বদলে গেল। সে আরো জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে লাগল। আগুনে মুঠো মুঠো কি ফেলল, তাতে আগুন আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।

মেজমামা এগোতে পারলেন না। গাবগাছের তলা পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বিশ্রীভাবে ভৈরবকে গালাগাল দিতে লাগলেন। আধখাওয়া মুরগিটা ছুঁড়ে দিল তার দিকে। মুরগিটা এসে পড়ল আগুনের মধ্যে।

কে তুই? ভৈরব চেঁচিয়ে উঠল।

আমি দয়াল বাঁড়ুজ্জে। মেজমামা আরও জোরে চিৎকার করে বললেন।

না, তুই দয়াল ন’স। ঠিক করে বল, কে তুই?

দয়াল বাঁড়ুজ্জে মেজমামার নাম। ডাকনাম টোনা।

বলব না।

মেজমামার সে কি গর্জন। ঠোটের দুপাশে ফেনা এসে জমল।

বলবি না? আচ্ছা দেখি বলিস কি না।

ভৈরব পাশে পড়ে থাকা ঝাঁটাটা তুলে নিয়ে ঘটের ওপর মারতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মেজমামা আর্তনাদ করে উঠলেন। মনে হল ঝাঁটার প্রত্যেকটি ঘা যেন তাঁর দেহেই পড়ছে।

বলছি, বলছি, আর মারিস নি।

মেজমামা গাছতলায় বসে পড়লেন।

বল। ভৈরব ঝাটা আছড়ানো শব্দ করল।

আমি মহিন্দর ডোম।

ভৈরব দিদিমার দিকে চোখ ফেরাল, চেনেন মহিন্দর ডোমকে?

দিদিমা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আমি কখনও দেখিনি। বাবার কাছে শুনেছি মহিন্দর পুজোর সময় ঢাক বাজাত। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে গণ্ডগোল হওয়াতে তারা পিছন দিক থেকে মাথায় লাঠি মেরে লোকটাকে শেষ করে দিয়েছে।

মেজমামা আর বলব না। মহিন্দরই বলি।

মহিন্দর চুপচাপ সব শুনল। দিদিমার কথা শেষ হতে বলল, মাঠকরুণ ঠিক বলেছেন। শিবে আমার মাথায় লাঠি মেরেছিল। আমিও শোধ নিয়েছি। শিবের গুষ্টির ঘাড় মটকে পগারে ফেলে দিয়েছি। ওর বংশে বাতি দিতে আর কেউ নেই।

তুই দয়ালের দেহে এলি কি করে?

সেদিন খুব ঝড়জলের সময় দয়াল সাইকেলে চেপে বটগাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। ওটাই আমার আস্তানা। হঠাৎ মোটা একটা ডাল ভেঙে পড়ল দয়ালের মাথার ওপর। দয়াল খতম। তার সাইকেল চিঁড়েচ্যাপ্টা। আমি দেখলাম এমন সুযোগ আর পাব না। অমাবস্যায় বামুনের মড়া। অনেক বছর দেহহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সুড়সুড় করে ঢুকে পড়লাম।

এ দেহ তোকে ছাড়তে হবে। ভৈরব বলল।

মাথা খারাপ। আমি ছাড়ব না।

তবে রে।

আবার ঘটের ওপর ঝাঁটার আছড়ানি।

মাটির ওপর গড়াগড়ি দিয়ে মহিন্দর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল।

একটু পরে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।

কি করে বুঝব তুই গেছিস?

কি করতে হবে বল?

ভৈরব এদিক ওদিক দেখল। উঠোনের একপাশে মরচে ধরা একটা বরগা পড়েছিল। সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে ভৈরব বলল, ওটা দাঁতে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে। আর একটা কথা।

বল।

গাঁ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে চলে যেতে হবে।

ঠিক আছে। কাসুন্দিপুরের শ্মশানে আস্তানা বাঁধব। এদিকে আর আসব না।

যা তবে।

লোহার ভারী বরগা, যেটা তুলতে অন্তত জন চারেক লোকের দরকার, সেটা মহিন্দর অবলীলাক্রমে দাঁতে করে তুলে নিল।

আবার সেই ঝড়ো হওয়া। গাছপালার মধ্য দিয়ে বরগা নক্ষত্ৰবেগে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে নজর পড়তে দেখলাম মেজমামার প্রাণহীন দেহটা গাবগাছতলায় পড়ে আছে। দেহ থেকে বিশ্রী পচা গন্ধ বের হচ্ছে।

ভৈরব বলল, এখনই দেহটা সৎকারের ব্যবস্থা কর। অনেক দিনের বাসি মড়া।

দুম করে একটা শব্দ। দিদিমা অজ্ঞান হয়ে রোয়াকের ওপর ঢলে পড়লেন।

* * * *

এসব অনেক দিনের কথা।

দিদিমা কবে মারা গেছেন। মামারাও কেউ বেঁচে নেই। মামাতো ভাইবোনেরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, খবর রাখি না।

আমারও বেশ বয়স হয়েছে।

খুব ঝড়জল শুরু হলে সব ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কি এসব অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছিল!

কিন্তু চোখের সামনে দেখা সব কিছু অস্বীকারই বা করি কি করে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *