ভূতুড়ে

ভূতুড়ে

ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তর্ক হচ্ছিল। অনিলবাবু বললেন, আমি একটা ঘটনা বলি শোনো : তখন আমি এম এসসি পাশ করে শিক্ষা বিভাগে চাকরি নিয়েছি। আমার কাজ হল জেলায় জেলায় ঘুরে স্কুল পরিদর্শন করা। সেইসূত্রে আমাকে একবার পাবনা যেতে হয়েছিল। বলা বাহুল্য তখন ছিল ইংরেজের রাজত্ব ; বাংলা দেশ বলতে পূর্ব-পশ্চিম গোটা বাংলা দেশকেই বোঝাত। জেলায় জেলায় যখন আমি ঘুরতাম তখন আমাকে রাতটা প্রায়ই ডাকবাংলোয় কাটাতে হত। পাবনায় স্কুল পরিদর্শন করতে গিয়ে আমি ডাকবাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করলাম। ভদ্রলোক আমার কথা শুনে বললেন যে ডাকবাংলোটা রাত্রিবাসের পক্ষে উপযুক্ত নয়, আমি যেন অন্য ব্যবস্থা করি। অন্য কোনো ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না কারণ আমার পদটা গালভরা হলেও মাইনে ছিল নেহাত অল্প। হোটেলে থাকার অর্থই হচ্ছে অতিরিক্ত খরচ, সাধ্যমতো তাই আমি সেটা পরিহার করে চলতাম। তা ছাড়া ভদ্রলোকের কথাবার্তার ধরন দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল; মনে হল তিনি প্রকারান্তরে আমাকে ডাকবাংলোয় রাত কাটাতে নিরুৎসাহ করছেন। আমারও জেদ চেপে গেল। ভদ্রলোক যখন দেখলেন আমি ডাকবাংলোতেই থাকব বলে স্থির করেছি তখন তিনি অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমি ডাকবাংলোয় পৌঁছে চৌকিদারের দেখা পেলাম। সে আমাকে একখানা ঘর খুলে দিল। ঘরটা অপরিচ্ছন্ন, তা ছাড়া ডাকবাংলোটাও খুব পুরোনো এবং জীর্ণ। এখানে-সেখানে পলেস্তারা খসে পড়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ছাদের অনেক জায়গায় ভাঙা। ছাদের ফাটলের ভেতর দিয়ে বাদুড়, পায়রা ঢুকে পড়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। চৌকিদারকে আমি ঘরটা পরিষ্কার করতে বললাম। সে ঝাঁটা নিয়ে কাজে লেগে গেল। হঠাৎ মানুষের আবির্ভাবে শান্তিভঙ্গ ঘটায় বোধ হয় বিরক্ত হয়েই বাদুড়, পায়রাগুলো ঝটাপট করতে করতে বেরিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে একটা লোহার খাট ছিল। আমি আমার বিছনাটা তার ওপর পেতে ফেললাম। চৌকিদার বেরিয়ে যেতেই আমি বাথরুমে ঢুকলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি আমার বিছানাটা নোংরায় ভরে গেছে। আমি আশ্চর্য হলাম— এই অল্প সময়ের মধ্যে কে বিছানাটা নোংরা করল! তবে কি বাদুড়গুলি আমার অনুপস্থিতিতে আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যেই বিছানাটা নোংরা করে গেল? যাই হোক, আমার তখন দেরি হয়ে গেছে। ভাববার সময় ছিল না। বিছানাটা সাধ্যমতো পরিষ্কার করে আমি স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।

স্কুলে সারাদিন কেটে গেল। বিকেল বেলা স্কুল ছুটির সময় প্রধানশিক্ষক মশাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় উঠেছি। ডাকবাংলোর কথা শুনে তিনি বলে উঠলেন যে ওখানে থাকার দরকার নেই, তিনি তাঁর বাড়িতেই ব্যবস্থা করবেন। আমি একটু কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপারটা কী? ডাকবাংলোয় রাত কাটানোয় আপত্তি কী থাকতে পারে? তিনি বললেন, ডাকবাংলোটার খুবই দুর্নাম আছে। রাতে নানারকম শব্দ হয়। ভৌতিক ব্যাপার। ওখানে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমার তখন জোয়ান বয়স। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অবস্থায় শ্রেষ্ঠদেহী প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিলাম। মনে সাহসও ছিল প্রচুর। আমি হেসে তাঁকে বললাম যে ভূতটুতে আমার বিশ্বাস নেই; তা ছাড়া ভূত যদি সত্যিই থাকে তবে তার সঙ্গে মোলাকাত করার এমন সুযোগ আমি হারাতে রাজি নই।

প্রধানশিক্ষক মশাই আমাকে নিবৃত্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন, রাত্রে তাঁর বাড়িতে খাওয়ার কথাও বললেন। আমি শেষে বললাম, খেতে আমার আপত্তি নেই, তবে তিনি যদি ডাকবাংলোয় খাবারটা পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন তবে আমি বাধিত হব। ভদ্রলোক আমার নাছোড়বান্দা ভাব দেখে অগত্যা তাতেই রাজি হলেন।

আমি ডাকবাংলোয় যখন ফিরলাম তখন প্রায় সন্ধে। চৌকিদারকে বললাম আমার জন্য তাকে আর খাবার তৈরি করতে হবে না। সে তখন ছুটি চাইল। রাত্রিবেলা সে নাকি বাড়ি চলে যায়। আমি তাকে ছুটি দিয়ে বারান্দায় একটা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা গল্পের বই খুলে বসলাম।

বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম, হঠাৎ মনে হল কে যেন আমার পেছন দিয়ে চট করে সরে গেল। পেছন ফিরে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। মনের ভুল ভেবে আবার বইয়ে মনসংযোগ করলাম। কিন্তু আবার সেই অনুভূতি। মনের মধ্যে কেমন যেন খচ খচ করে উঠল। উঠে চারদিক ঘুরে দেখলাম। হঠাৎ ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। একটা বাদুড় পাক দিয়ে উড়ছে আর হ্যারিকেন লন্ঠনের আলোয় তার ছায়াটা এমনভাবে পড়ছে যে মনে হচ্ছে কারো ছায়া দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে মনে হেসে চেয়ার টেনে বসলাম।

খানিক বাদেই একটি লোক সাইকেল চেপে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার সঙ্গে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। প্রধানশিক্ষক মশাই তাঁর কথা রেখেছেন। আমি লোকটিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে চটপট খেতে বসে গেলাম। লোকটি একটু আমতা আমতা করে শেষে উপায়ান্তর নেই বুঝে দাঁড়িয়ে রইল এবং খাওয়া শেষ হতেই প্রায় পড়িমরি করে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে দৌড় লাগাল।

ডাকবাংলোটা ছিল বেশ নির্জন জায়গায়, আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। সুতরাং ভূতের ভয় পাবার পক্ষে প্রকৃষ্ট স্থান, সন্দেহ নেই।

এবার শোবার পালা। আমি ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ভূতের আবির্ভাব না ঘটুক চোর ডাকাতের উপদ্রব হতে তো বাধা নেই! ভাবলাম জানালাগুলি বন্ধ করে দেওয়াই নিরাপদ। কিন্তু জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি একটারও ছিটকিনি ঠিক নেই। অগত্যা জানালা খুলে রেখেই শুয়ে পড়তে হল।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আর আমি চমকে উঠলাম। পাশের ঘর থেকে একটি কচি মেয়ের কান্না ভেসে আসছে। মনে হল কেউ যেন সঙ্গেসঙ্গে তার মুখটা চেপে ধরল। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার গায়ের সমস্ত লোম তখন খাড়া হয়ে উটেছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে সাহস ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করলাম, তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার কাছে অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটা পাঁচ ব্যাটারির মস্ত বড়ো টর্চ। তার এক ঘায়ে যেকোনো লোককে কাবু করা যায়। আমি সন্তর্পণে দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলাম, তারপর বারান্দা দিয়ে একেবারে পাশের ঘরের সামনে। যা থাকে বরাতে তাই হবে। মনের দ্বিধা কাটিয়ে দরজায় সজোরে মারলাম এক লাথি। দরজাটা ভেজানো ছিল, সশব্দে খুলে গেল। সঙ্গেসঙ্গে টর্চের তীব্র আলোয় ঘরটা ভরে গেল। পরমুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে আমি লক্ষ করলাম একরাশ ধুলো যেন কোন অদৃশ্য মন্ত্রবলে মাটি থেকে ওপরদিকে উঠে যাচ্ছে। আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

কয়েকটা মুহূর্ত কোথা দিয়ে কেটে গেল মনে নেই, তার পরই চট করে সমস্ত জিনিসটা আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। বন্ধ দরজাটা খুলে যাওয়ায় বাইরে থেকে দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে স্তূপীকৃত ধুলোকে নাড়া দিয়েছে। ফলে ধুলো উড়তে শুরু করেছে আর টর্চের আলো তার ওপর প্রতিফলিত হওয়ায় মনে হচ্ছে একরাশ ধুলো যেন নীচে থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সকাল বেলা একফালি সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকলে যেমন অসংখ্য ধুলোর কণা ভেসে বেড়াচ্ছে দেখা যায় ঠিক সেইরকম, তবে অনেক বেশি পরিমাণে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘টিন্ড্যাল এফেক্ট’।

ঠিক সেই সময় ঘরের মধ্যে আবার কান্নাটা শোনা গেল। শব্দ লক্ষ করে আমি টর্চ ফেলে যা দেখলাম তাতে হাসব কি কাঁদব ভেবে পেলাম না। ঘরে কড়িকাঠের ওপর কয়েকটা বাচ্চা কবুতর, আর তাদেরই কচি গলার স্বর শিশুর কান্নার আওয়াজের মতো শোনাচ্ছে। বুঝলাম কেন এতদিন লোকে ভয় পেত এবং কেনই-বা ডাকবাংলোটার ভূতুড়ে বলে দুর্নাম ছিল। এবার আমি ঘরে ফিরে এসে নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রার আয়োজন করলাম।

ঘুম যখন ভাঙল তখন প্রায় বেলা আটটা। দরজা খুলে বেরুবার সঙ্গেসঙ্গেই দেখি প্রধানশিক্ষক মশাই এবং আরও কয়েকজন ভদ্রলোক এসে হাজির হয়েছেন। আমাকে বহাল তবিয়তে দেখে তাঁরা যে বিস্মিত হলেন তা বলাই বাহুল্য। রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছিল কি না জিজ্ঞাসা করাতে আমি হাসিমুখে জবাব দিলাম যে চমৎকার ঘুম হয়েছিল। তাঁরা যেন একটু নিরাশ হলেন, তার পর প্রশ্ন করলেন রাত্রে আমি কোনো শব্দটব্দ শুনেছি কি না। আমি তখন তাঁদের আদ্যোপান্ত খুলে বললাম এবং ভূতের ব্যাপারটা যে আজগুবি এবং কোনো ভীতু লোকের উর্বর কল্পনাপ্রসূত তাও জানালাম। আমার কথা শুনে তাঁরা কিন্তু খুশি হলেন বলে মনে হল না। এতদিনের স্থির বিশ্বাস এবং রসাল ভৌতিক ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত যে প্রহসনে দাঁড়াবে তাতে যেন তাঁদের মন সায় দিচ্ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *