ভূতবাবু

ভূতবাবু

শিবনাথ সরখেলকে সকলে আড়ালে ডাকে ‘ভূতবাবু’। তাকে দূর থেকে দেখলেই আঁতকে ওঠে।

‘এই রে! ভূতবাবু আসছে। পালাই বাবা।’

মাঝবয়সি একজন মানুষকে এই নামে চেনবার কারণ কী? তাকে কি ভূতের মতো দেখতে? ফিনফিনে রোগা, কুচকুচে কালো, মাথার চুলগুলো সব খাড়া? মোটেও নয়। শিবনাথ সরখেল গোলগাল, স্বাস্থ্যবান, বেশি করে তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো একজন ভদ্রলোক। তবে কি তিনি ভূত নিয়ে গবেষণা করছেন? গবেষণার জন্য ভূতের বাড়ি, ভূতের হাসি, ভূতের কাশি ধরনের কোনও বিষয় ঠিক করেছেন? যাকে সামনে পান খপ করে ধরেন।

‘এই যে ছেলে, তোমার সন্ধানে কোনও ভূতুড়ে বাড়ি আছে? থাকলে ঠিকানাটা ঝটপট বলে ফেল। খাতা, পেন, নিয়ে একটা রাত কাটিয়ে আসব সেখানে।’

না, না, এসব কিছুই নয়। শিবনাথ সরখেল গবেষণা করেন না। তিনি অফিসে চাকরি করেন। হিসেব কষার চাকরি। সেখানে গবেষণার কোনও সুযোগ নেই। শুধু যোগ-বিয়োগের ব্যাপার। তাহলে আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক, অফিসের সহকর্মী সবাই তাকে ‘ভূতবাবু’ নামে চিনবে কেন? আর চিনলেই বা তাকে দেখে পালাতে চাইছে কীসের ভয়ে? শুধু বড়রা না, পালায় ছোটরাও। ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার অদ্ভুত। এক একজন মানুষের এক-একরকম শখ। কেউ গান গায়, কেউ ছবি আঁকে, কেউ অভিনয় করে, কেউ কয়েন, স্ট্যাম্প জমায়। আমাদের শিবনাথ সরখেলের শখ হল ভূতের গল্প বলবার। ভূতের গল্প খুবই ইন্টারেস্টিং। শোনবার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে। কিন্তু সেই গল্প শোনবার জন্য আলাদা পরিবেশ চাই। গা ছমছমে পরিবেশ ছাড়া ভূতের গল্প মোটে জমে না। সন্ধেবেলা বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। কারেন্ট চলে গেছে। হ্যারিকেনের আলোয় ঘরের দেয়ালে বড় বড় ছায়া পড়ছে। জানলার কপাট ক্যাঁচ কোঁচ করে একবার বন্ধ হচ্ছে, একবার খুলছে। এটা হল ভূতের গল্পের জন্য দারুণ সময়। গল্পের ভয় ডবল হয়ে যায়। শুধু ঝড়বৃষ্টি কেন? কনকনে শীতই বা কম যায় কীসে? এই সময় লেপের তলায় শুয়ে ভূতের গল্প শুনলে বুক ধুকপুক করে। মনে হয় লেপের ভিতর কার যেন ঠান্ডা হাত! ফসে-ফসে গরমের রাতে ছাদে যদি ভূতের গল্পের আসর বসে তাহলেও মারাত্মক। মনে হয় পাঁচিলের ওপাশ থেকে কেউ উঁকি দিচ্ছে। শিবনাথ সরখেল এসব পরিবেশ, মেজাজ মানেন না। তিনি যখন যেখানে পারেন ভূতের গল্প শুরু করে দেন। পথেঘাটে, বাজারে-হাটে, বাসে ট্রামে, অফিসের ক্যান্টিনে হাতের কাছে চেনাজানা কাউকে পেলেই হল। গল্প বলবার জন্য চেপে ধরবেন। বিয়েবাড়িতে খেতে বসেও রেহাই নেই।

‘এই যে বিল্টু কতবড় হয়ে গিয়েছিস। কতদিন পর তোকে দেখলাম। কোন ক্লাস হল রে? এইট? বাপরে তবে তো একেবারে জেন্টলম্যান হয়ে গেলি। আচ্ছা, তোকে একটা গল্প শোনাই। ভূতের গল্প কিন্তু। ভয় পাবি না তো? পেলে বুঝব এখনও বড় হসনি। বুঝলি বিল্টু, সেবার পুজোর সময় গিয়েছিলাম ঘাটশিলা। যে বাড়িটায় ছিলাম সেটা একটা পোড়ো বাড়ি, চারপাশে জঙ্গল। সন্ধের পর ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল। হঠাৎ শুনি কে যেন…।’

বিল্টুর খুব রাগ হল। সে তখন আয়েস করে চিকেনের হাড় চিবোচ্ছিল। চিকেনের হাড় চিবোতে চিবোতে ভূতের গল্প কখনও শোনা যায়? তার ওপর চারপাশে ঝলমলে আলো, গমগম করছে লোকজন, প্যাঁ প্যাঁ করে সানাই বাজছে। এই সময় ‘পোড়োবাড়ি’ আর ‘জঙ্গল’ চলে? গল্প তো গেলই, খাওয়াটাও মাটি হল। কয়েক বছর আগে শিবনাথ সরখেল হাসপাতালে অসুস্থ ছোটমামাকে দেখতে গিয়ে এক কাণ্ড করেছিলেন। রোগীর বেডের পাশে বসে ভূতের গল্প ফেঁদেছিলেন। ছোটমামি তো রেগে কাঁই। যতসব অলুক্ষুণে কাজ। ভূত তো হয় মরে যাওয়ার পর। হাসপাতালে শুয়ে থাকা মানুষকে কেউ মরে যাওয়ার কথা বলে? ছি ছি। এত বড় লোকটার একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকবে না? পাড়ার ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েও ঝামেলা পাকিয়েছেন শিবনাথ সরখেল। মাঠের পাশে বসে গল্প ফেঁদেছেন। খেলায় তখন টানটান উত্তেজনা। শিবনাথ সরখেল বললেন, ‘এ আর কী খেলা দেখছিস। মানুষের ফুটবল খেলায় কি আর উত্তেজনা থাকে? উত্তেজনা থাকে ভূতেদের ম্যাচে। সে খেলা হয় অমাবস্যার রাতে। বল থাকে অদৃশ্য। সেই অদৃশ্য বল নিয়ে মারামারি ঝটাপটি চলে।’ সেই গল্পের মাঝেই হয়ে গেল গোল। যারা গোল দিল সেই ক্লাবের সাপোর্টররা গেল বেজায় খেপে। ভূতবাবুর গল্পের জন্য নিজেদের গোলটাই ঠিক মতো দেখা হল না। এর পরেও ভূতবাবুকে দেখলে লোকে পালাবে না? আরও আছে। একবার অফিস যাবার সময় ট্রামে গল্প বলতে গিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছিল। ভিড় ট্রামে ভূতুড়ে ট্রামের গল্প ফাঁদলেন শিবনাথবাবু। সাহেবদের আমলের ঘোড়ায় টানা ট্রামের গল্প। সেই ভুতুড়ে ট্রাম নাকি শহরে ঘুরে বেড়াত মাঝরাতে আর টিং টিং করে ঘণ্টি বাজাত। শিবনাথবাবুর গল্পের মাঝখানেই হইহই। কী হল! দুজন যাত্রীর পকেটমার হয়ে গেছে। ভূতের গল্পের সুযোগে পকেটকাটা গেছে তাদের। একজন বলে উঠল, ‘ওই গল্প বলিয়ে লোকটাকে ধর। বেটার নিশ্চয় পকেটমারের সঙ্গে সাঁট আছে। নইলে অফিস টাইমে ভিড় ট্রামে কেউ ভূতের গল্প ফেঁদে মানুষকে অন্যমনস্ক করে?’ মাঝপথে ট্রাম থেকে নেমে সে যাত্রায় বেঁচেছিলেন শিবনাথবাবু। কিন্তু অভ্যেস বদলায়নি।

অভ্যেস বদলাল অন্য এক ঘটনায়। সে ঘটনা ভয়ংকর? নাকি ভূতের? কে জানে।

সেটা ছিল শীতের প্রথমদিক। তাড়াতাড়ি বিকেল হয়। বিকেল আর সন্ধের মাঝখানের সময়টায় অদ্ভুত একটা ঘোর লাগা আলো হয়। এরকম সময় শিবনাথ সরখেল বসেছিলেন ময়দানে। মনটা ভালো নেই। অফিসের বড়বাবু আজ ঘরে ডেকে কাজের ভুল নিয়ে বকাঝকা করেছেন। চোখের গোল চমশা নাকের ওপর নামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছেন, ‘সামান্য বিয়োগে ভুল! ছি-ছি। খবর পেয়েছি, এই হিসেব করবার সময় আপনি নাকি সহকর্মীদের গল্প শোনাচ্ছিলেন। আপনার মামাবাড়ির বন্ধ চিলেকোঠার গল্প। সেখানে নাকি খুটুর খুটুর করে সারারাত আওয়াজ হত। ভাঙা টেবিল-চেয়ার রাখলে সকালে মেরামত হয়ে যেত। বলেননি? দেখুন সরখেলবাবু ভূতে টেবিল-চেয়ার সারিয়ে দেবে, কিন্তু আপনার হিসেব ঠিক করে দেবে না। এসব আজগুবি গল্প বন্ধ করুন। ভূত বলে কিছু নেই, তাকে নিয়ে পড়ে থাকলে কাজে ভুল হয়। মনে রাখবেন, এই আমার লাস্ট ওয়ার্নিং।’ মনে দু:খ নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ময়দানে ট্রাম থেকে নেমে পড়েছেন শিবনাথবাবু। রাস্তা পার হয়ে গাছের তলায় বেঞ্চে বসেছেন। চারপাশ ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মাঠে যারা খেলতে আসে, বেড়াতে আসে ফিরে যাচ্ছে এক এক করে। ফিরে যাচ্ছে ফেরিওয়ালারা। দূরটা কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়াও লাগছে। কুয়াশা পড়তে কি শুরু করল? এমন সময়ে পাশে কেউ একজন এসে বসল নি:শব্দে। শিবনাথবাবু মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

‘বাদাম খাবেন?’

চেনা গলা শুনে চমকালেন শিবনাথবাবু। মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। না, ঘোলাটে মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে লোকটার চেহারা ভারিক্কির দিকে। গায়ে একটা পাতলা চাদরও রয়েছে। চাদর দেখে গা শিরশির করে উঠল। চাদর দেওয়ার মতো ঠান্ডা কি তবে পড়ে গেল? নাকি এই লোকের চাদর দেখে শীত লাগছে?

লোকটা আবার বলল, ‘বাদাম খাবেন।’

শিবনাথ সরখেল ভুরু কোঁচকালেন। চেনা গলাটা কার? কোথায় শুনেছেন? তারপর বললেন, ‘না, ধন্যবাদ।’

চাদর গায়ের লোক উলটো দিকে মুখ করে পা দোলাতে দোলাতে চিনেবাদাম খেতে লাগল। শিবনাথবাবুর অস্বস্তি হল। কার গলা? মুহূর্তে তিনি সেই অস্বস্তি ঝেড়েও ফেললেন। হোক যা খুশি। বয়ে গেছে। ময়দানের ওদিকটায় বড়বড় বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। বড় সুন্দর লাগছে। মিনিট খানেক পর চাদর গায়ের লোক ফের কথা বলল।

‘মনটা ভালো নেই দাদা।’

শিবনাথবাবু চমকে ঘাড় ঘোরালেন। লোকটা উলটো মুখ করে আছে। এবার একটা কিছু না বললে ভদ্রতা থাকে না। শিবনাথ সরখেল চাপা গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার? মন ভালো নেই কেন?’

খুকখুকে হাসির শব্দ হল। লোকটা হাসল মনে হয়। বলল, ‘অফিসে বকুনি খেয়েছি দাদা। বুড়ো মানুষ যোগ ভুল করে বুকনি খেলে তো মন খারাপ হবেই। হবে না?’

শিবনাথ সরখেল নড়েচড়ে বসলেন। এই লোক বলে কী! তারই মতো অফিসে বকুনি খেয়েছে! তাও আবার একই কারণে। হিসেবে ভুল। একটাই তফাত। তার যোগে, এর বিয়োগে। আজ কি ময়দানে সব বকুনি খাওয়া মানুষের ভিড় হল? শিবনাথবাবুর মজা লাগল। লোকটার সঙ্গে আলাপ করলে ভালো হয়। তিনি খানিকটা ঘুরে বসলেন। নরম গলায় বললেন, ‘মন খারাপ করবেন না ভাই। অমন হয়। দুটো বাদাম দিন দেখি। ময়দানে বসে বহুকাল বাদাম খাইনি।’

চাদর গায়ের মানুষ একটু যেন থমকে রইল। তারপর কৌতুক ভরা গলায় বলল, ‘বাদাম দিতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে দাদা। একটা ভূতের গল্প শুনতে হবে। আমার হল ভূতের গল্প বলার নেশা। যখন তখন, যেখানে সেখানে ভূতের গল্প বলে ফেলি। সবাই রাগ করে। কাজকর্মে ভুল হয়। কিন্তু নেশা ছাড়তে পারি না। বিচ্ছিরি ব্যাপার। যে জিনিসটা নেই, তাকে নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়েছি। নিন, দাদা বাদাম নিন। বাদাম খেতে খেতে গল্প শুনবেন।’ লোকটা ঘুরে বসল। ঠোঙা ধরা হাত বাড়িয়ে ধরল।

অন্ধকারে নিজেকে চিনতে একটু অসুবিধে হল না শিবনাথ সরখেলের। চোখ, মুখ, কণ্ঠস্বর তো বটেই, এমনকী রিস্টওয়াচ, আঙুলের আংটিটাও তার! শিবনাথবাবু কাঁপা গলায় একবারই মাত্র বলতে পারলেন, ‘ভূত! আমার ভূত!’ তার পরেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।

শিবনাথ সরখেল আর কখনও ভূতের গল্প বলেন না। কেউ বললে চুপচাপ উঠে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *