2 of 2

ভূতবাবার মেলায় – জয়দীপ চক্রবর্তী

ভূতবাবার মেলায় – জয়দীপ চক্রবর্তী

বারুইপুর থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর ডাবল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে বটে, তবু যতক্ষণ পর্যন্ত না সে—কাজ শেষ হচ্ছে এই পথে যাতায়াতের মেহনতি ও সমস্যার অন্ত নেই। সিঙ্গল লাইন বলে মাঝে মাঝেই ক্রসিং—এর জন্যে হাপিত্যেশ করে অপেক্ষায় থাকতে হয় অসহায়ের মতোই। তা ছাড়া কোনো কারণে একটা ট্রেন মিস হয়ে গেলেই বসে থাকো ঝাড়া একটি ঘণ্টা।

মাঝখানে আর ট্রেন নেই। এমনকী সড়ক পথেও যে কলকাতার দিকে ফিরে আসবে সে সুযোগও নেই বললেই চলে। আমি অভিজিৎকে পই পই করে বলেছিলাম মথুরাপুর স্টেশন থেকে অন্তত ছ—টার ট্রেনটা ধরার চেষ্টা করতে। তা ছ—টার ট্রেনটা তো ধরা গেলই না, এমনকী সাতটার ট্রেনটাও ছেড়ে গেল একটুর জন্যে। অবশ্য অভিজিৎকেই বা দোষ দিই কী করে! দীর্ঘদিন পরে এসেছে দেশের বাড়িতে, নিজের গ্রামে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা সহজে ছাড়বে ক্যানো? অগত্যা উঠছি উঠব করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল। তারপর কাশীনগর থেকে মথুরাপুর স্টেশনও কম রাস্তা নয়। অবশেষে মথুরাপুর থেকে যখন শিয়ালদহগামী ট্রেনে চেপে বসলাম তখন হাতঘড়িতে আটটা বেজে পাঁচ। এ সময়ে কলকাতার দিকে যাবার গাড়িতে ভিড়—ভাড়াক্কা থাকে না। যত ভিড় সব ফিরতি ট্রেনে। আমাদের কামরাতেও তাই হাতেগোনা কয়েকজনই মাত্র যাত্রী। জানলা—টানলা দেখে জুত করে বসে অভিজিৎ বলল, ‘এমন কিছু রাত্তির হয়নি কী বলিস?’ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে আমি বললাম, ‘ঠিকই। তবে এসব দিকে ট্রেনের গণ্ডগোল হলে ফেরার বিকল্প পথ নেই বলেই চিন্তা হয়—’

‘যাকগে! এই তো ফাঁকা গাড়ি পেয়ে গেলাম। দশটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব সব ঠিকঠাক চললে—’

আমি লম্বা করে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম মাথার ওপর দু—হাত তুলে! তারপর আলসে গলায় বললাম, ‘সব ঠিকঠাক চললে—’

অভিজিৎ হাসল। বলল, ‘বাদ দে। বল আমার গ্রামের বাড়ি তোর ক্যামন লাগল?’

‘খুব ভালো। ইনফ্যাক্ট যেকোনো গ্রাম দেখতেই খুব ভালো লাগে আমার। পুকুরঘাট, মাঠ, চাষের জমি, খোড়ো চালের মাটির বাড়ি—ফ্যানটাসটিক, মনে হয় যেন হাতে আঁকা কোনো ছবি—’ আমি বললাম।

‘কিন্তু সন্ধেবেলা যখন নিকষ অন্ধকার সব ল্যান্ডস্কেপ ঢেকে দেবে—বিজলি বাতি জ্বলবে না—শেয়াল ডাকবে বাঁশবনের আড়াল থেকে?’

‘তখন জোনাক জ্বলবে থোকায় থোকায়। বাঁশবাগানের মাথার ওপর পেতলের থালার মতন মস্ত চাঁদ উঠবে আকাশ আলো করে—’ বেশ কাব্য করে বললাম আমি।

‘কিন্তু ধর যদি চাঁদটাঁদ না—উঠে বাঁশবাগানের আড়াল—আবডাল থেকে উঁকি—ঝুঁকি মারতে শুরু করে তেনাদের কেউ কেউ?’

‘তেনাদের কেউ কেউ মানে?’ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করি আমি।

‘তেনাদের কথা জানিস না?’

‘উঁহু—’

‘এই রাতে নাম নেব?’ মুচকি হেসে বলল অভিজিৎ, ‘আমাদের গ্রামে অন্ধকার নামলে কেউ তাদের নাম করে না। তাও আজকে আবার শনিবার—’

‘ভূতের কথা বলছিস—’ হা হা করে হেসে উঠি আমি, ‘তুই আবার আজকাল ভূতবিশ্বাসী হয়ে উঠছিস নাকি?’

‘আমি বিশ্বাসী না—অবিশ্বাসী সেইটা আজ পর্যন্ত ভালো করে বোঝাই হল না। তবে ছোটোবেলায় ভূতের ভয় পেতাম খুব—’

আলোচনা ক্রমশ জমে উঠল। অভিজিতের গ্রামে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা ভূত—প্রেতের মুখোমুখি হয়েছেন বিভিন্ন ভাবে, সেই সব অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ উঠে আসতে লাগল এক এক করে। রাতের ট্রেন একটার পর একটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে হুড়মুড় করে। লোকজনের ওঠানামা বড়ো একটা নেই। অতএব গল্পের পরিবেশও জমজমাট। অভিজিৎ জমিয়েও দিয়েছে খুব। হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাইরে আবছা আলোয় মোড়া একটা নির্জন রেলস্টেশন। জানলা দিয়ে বাইরে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিয়ে অভিজিৎ বলল, ‘কৃষ্ণমোহন হল্ট। আর একটা স্টেশনের পরেই বারুইপুর।’

আমি আশ্বস্ত হয়ে বললাম, ‘যাক তাহলে তো এসেই পড়লাম প্রায়। আধঘণ্টার মধ্যেই সোনারপুরে নেমে পড়া যাবে।’

অভিজিৎও মাথা নাড়ল। আমি ওঁর হাঁটুতে চাপড় মেরে বললাম, ‘সবই ভালো লাগল তোর দেশের বাড়ি বেড়াতে এসে। শুধু একটাই অপূর্ণতা রয়ে গেল—’

‘কী?’ অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল।

‘গ্রামে—গঞ্জে কাটালাম সারাদিন, একটা ভূতটুত যদি চোখে পড়ত তো ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যেত। ছোটোবেলা থেকে কত গল্প শুনলাম, অথচ আজ পর্যন্ত তাঁদের একজনের সঙ্গেও দেখা করার সৌভাগ্য হল না। খুব আশা ছিল এবারে তোদের গ্রামে গিয়ে অন্তত—’

‘আহা তা থাকলে কতক্ষণ বলো? অন্তত দু—একটা রাত তো কাটাতে হবে—’ আমার কথার মাঝখানেই প্রতিবাদ করে উঠে অভিজিৎ।

আমি হেসে বললাম, ‘রাত না—কাটাই দুপুর তো কাটালাম। সেই ছড়াটা মনে নেই, ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা—’

অভিজিৎ আমার কথার উত্তর দিল না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার বল তো, ট্রেনটা তো অনেকক্ষণ হয়ে গেল দাঁড়িয়ে আছে। ছাড়ছে না ক্যানো। এখানে এ সময়ে তো সিগন্যালের সমস্যা হওয়ার কথা নয়—’

কথার মধ্যে খেয়ালই করিনি এতক্ষণ। অভিজিতের কথার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ট্রেনটা কৃষ্ণমোহন হল্ট স্টেশনেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।

‘কী ব্যাপার বল তো, ট্রেনটা ছাড়ছে না ক্যানো?’ একরাশ বিরক্তির সঙ্গে বলি আমি।

‘ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে—’ অভিজিৎ নয়, আমাদের উলটোদিকের জানলার পাশে বসা একটা লোক বলে উঠল মিহি গলায়। আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে কখন যে লোকটা কামরায় উঠে নিঃশব্দে বসে পড়েছে ওদিকে খেয়ালই করিনি। লোকটা আবার বলল, ‘ট্রেন কখন ছাড়বে তার ঠিকঠিকানা নেই আর—’

‘ক্যানো বলুন দেখি—’ চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করি আমি।

‘কাটা পড়েছে।’

‘সে কি—এই ট্রেনে?’

‘উঁহু, আগের ট্রেনে—’

‘কোথায়?’

‘কৃষ্ণমোহন আর শাসন স্টেশনের মাঝখানে—’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী—বিস্তির লোক জুটেছে। হইচই চলছে। বডি না—সরলে ট্রেন চলবে না—’

‘কী করে কাটা পড়ল?’

লোকটা এ প্রশ্নে জুলজুল করে আমাদের দিকে চেয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর আবার বলতে লাগল, ‘কী করে বলি বলুন! অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে, আবার সুইসাইডও হতে পারে! আসলে জায়গাটা তো সরেস। মৃত্যু এখানে মানুষকে আয় আয় করে ডাকে সর্বক্ষণ—’

‘মানে?’ চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করে উঠল অভিজিৎ।

‘আশ্চর্য ব্যাপার মশাই,’ লোকটা বলে চলল, খুন—দুর্ঘটনা—আত্মহত্যা মিশিয়ে ফি—বছর দু—তিনটে লোক অন্তত এখানে কাটা পড়বেই।’

‘বলেন কী?’

‘তা না—হলে আর বলছি কী। জায়গাটা একেবারে বিষিয়ে আছে মশাই— বাতাস ভারি হয়ে আছে সর্বক্ষণ—’

‘বুঝলাম না ঠিক—’

‘বুঝলেন না?’

‘উঁহু।’ দু—দিকে মাথা নাড়লাম আমি।

‘অশরীরী আত্মাদের একেবারে আখড়া হয়ে আছে জায়গাটা—’

‘বলেন কী?’ অবাক হয়ে গিয়ে বলে অভিজিৎ।

‘এলকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যেত। নেহাত ভূতবাবা চোখ রাখছেন সর্বক্ষণ—’

‘ভূতবাবাটি আবার কে? কোনো বাবাজি—টাবাজি নাকি?’ হালকা গলায় জিজ্ঞেস করি আমি।

‘আজ্ঞে না, উনি আসলে শিব। ভূতেদের জয় করেছেন বলে এখানে উনি ভূতনাথ। গ্রামের লোক ভালোবেসে ভূতবাবা বলে ডাকে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু এগোলেই তো ওনার মন্দির—’

‘আপনি এতসব জানলেন কী করে?’ জিজ্ঞেস করে অভিজিৎ।

‘আমি তো এখানেই থাকি। অধমের নাম নিবারণ দাস।’

ভূতবাবার ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল আমার। আমি বললাম, ‘ভূতবাবার ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন—’

নিবারণ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘কামরার ভেতরটায় ক্যামন বদ্ধ বদ্ধ ভাব একটা। চলুন প্ল্যাটফর্মে নেমে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করা যাক—’

অভিজিৎ কিন্তু কিন্তু করছিল। আমি বললাম, ‘নামা যাকই না। সিগন্যাল সবুজ হলে উঠে পড়লেই হল—’

নিবারণ আবারও বলল, ‘ট্রেন এখন ছাড়বে না—’

আমরা কামরা থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লাম।

নিবারণ আবার বলতে শুরু করল, এই মন্দির প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো। আর বাবাও খুব জাগ্রত। মন্দিরের সামনে মস্ত শ্যাওড়া গাছটায় এখনও দূর—দূরান্ত থেকে লোক এসে ঢিল বেঁধে মানত করে। আর বাবাও তাদের ভূতপ্রেতের হাত থেকে রক্ষা করেন।

অভিজিৎ খুব মন দিয়ে শুনছিল সব। নিবারণ থামতেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘ভূত—প্রেত কি সত্যিই এ অঞ্চলে আছে বলে মনে হয় আপনার?’

‘আমার মনে হওয়াটা তো বড়ো কথা নয় বাবু,’ নিবারণ হাসল, এখানকার প্রায় সব মানুষজনই বিশ্বাস করেন যে তেনারা আছেন—’

‘মাঝেমধ্যে দেখা যায় তাঁদের?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘তা যায় বই কী বাবু। কতলোকই তো তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ পায়।

তবে ভূতবাবার কৃপায় এঁরা খুবই শান্ত আর নির্বিবাদী। মানুষের ক্ষতি চিন্তা করেন না কখনো—’

‘একদিন তাহলে তো দেখতে এলে হয়—আমি হালকাভাবে বললাম।

‘আজ যাবেন?’ নিবারণ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

‘আজ?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলে উঠলাম আমি।

‘আজ এখানে ভূতবাবার মেলা বসেছে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে—আবডালে মৃদু আলোর লন্ঠন জ্বালিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা—’ নিবারণ বলতে শুরু করল।

‘এই রাত্তিরবেলা?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অভিজিৎ।

‘আজ্ঞে রাতেরই মেলা এটা,’ নিবারণ বলে, ‘শুনেছি মানুষের দেহ ধরে তেনারাও নাকি আসেন এ মেলায়। দোকানি সেজে দোকান দেন, কখনো ক্রেতা সাজেন—’

‘যাঃ—’ নিবারণের কথার মাঝখানেই অবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে উঠি আমি।

‘চলুন না, যাবেন? এই কাছেই তো—ওখান থেকে বারুইপুর যাওয়ার ভ্যানট্যানও পেয়ে যেতে পারেন। আপনাদের বাড়ি ফেরার সুবিধা হয়ে যাবে। ট্রেনের ওপর তো আর ভরসা নেই, কখন চলে না—চলে—’ নিবারণ উৎসাহের সঙ্গে বলে। অভিজিতের এ প্রস্তাবে একেবারেই সায় ছিল না। একে রাত বাড়ছে, তা ছাড়া একদম অচেনা একটা লোকের সঙ্গে এরকম হুট করে—আমার কিন্তু ক্যামন যেন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পেয়ে বসল। প্রায় জোরই করে বসলাম অভিজিতের ওপর। ওকে বোঝালাম যে দশ—বিশ মিনিট মেলায় ঘুরে সত্যিই যদি বারুইপুর দিয়ে বাড়ি ফিরি তাহলে অসুবিধা হবার কথা নয়। সময়ও খুব বেশি নষ্ট হবে বলে মনে হয় না। অভিজিত নিমরাজি হয়ে হাঁটতে শুরু করল আমাদের সঙ্গে।

মেলাটা অদ্ভুত। বিজলি বাতি নেই, লোকজনের হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি নেই। সব ক্যামন যেন নিস্তব্ধ নিঃঝুম। ঝুপসি অন্ধকারে জংলি ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে দু—চারটে দোকান। দোকানের আলো এত কম যে দোকানির মুখ পর্যন্ত দেখা যায় না ভালো করে। দু—চারজন মাত্র খরিদ্দার থমথমে গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ দোকান থেকে ও দোকানে। এমন ফিসফিস করে কথা বলছে সবাই যে পাশে দাঁড়িয়েও ভালো করে শোনা যাবে কিনা সন্দেহ।

একটা অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে আমাদের গায়ে। সেই হাওয়ায় শিরশির করে উঠছে গা। দোকানিরা অদ্ভুত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সে তাকানোয় কোনো আহ্বান নেই। ক্যানো কে জানে ভয়ানক অস্বস্তি হতে লাগল আমার। বুঝতে পারলাম বেশ ভয় পেয়ে গেছি আমি। অভিজিৎও আমার হাত ধরে আলতো টান দিল। চাপা গলায় বলল, ‘গতিক ভালো ঠেকছে নারে একটুও। চল পালাই।’

নিবারণ একটু তফাতে ছিল। আমাদের দিকে ফিরল হঠাৎ। হাসল ফিকফিক করে। জিজ্ঞেস করল, ‘ভয় পেলেন নাকি?’

আমার অস্বস্তি বাড়ল। নিবারণ আমাদের মনের কথা টের পেল কী করে! আমরা কোনো উত্তর দেবার আগেই একটা বুড়োমতো রোগা লোক এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। আমাদের মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে তাকাল নিবারণের দিকে। দাঁত বের করে হাসল খানিক। তারপর নিবারণের থুতনি ধরে আদর করে বলল, ‘আজই আসা হল মনে হচ্ছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ ছোট্ট জবাব দিল নিবারণ।

অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না কিছুই। তবু আমার ক্যানো যেন মনে হচ্ছে এখন ঝোপঝাড়ের আশেপাশে বসে থাকা দোকানিরা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। তাদের চোখ, তাদের চাউনি, তাদের মাথা কিংবা বসে থাকার ভঙ্গির মধ্যে যেন ভয়ানক রকমের একটা অসংগতি। এই অদ্ভুত গা—ছমছমে অন্ধকারে এরা সবাই প্রাণপণে কিছু একটা যেন ঢাকা দেবার চেষ্টা করছে আমাদের কাছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হল। মুহূর্তে ইঙ্গিত এল মস্তিষ্ক থেকে। অভিজিতের হাত ধরে সোজা দৌড়াতে শুরু করলাম রাস্তার দিকে। নিবারণ ডাক দিলে পিছন থেকে। সে ডাক কানে তুললাম না আমরা। বাতাসের মতো মিহি গলায় কারা যেন কলরব তুলল, ‘কিছু কিনে যাও, কিছু কিনে যাও—’

পিছন ফিরে সে কলরবের উৎস খোঁজারও সাহস হল না আমাদের। একছুটে বড়োরাস্তায় উঠে ভাগ্যজোরে একটা রিকশাভ্যান পেয়েছিলাম তাই রক্ষে। ভ্যানচালক মাধব দাস ঝড়ের গতিতে এনে দিল বারুইপুরে। ওখান থেকে বাড়ি ফেরার গাড়ি পেতে অসুবিধা হয়নি আর।

পরদিন ঘুম ভাঙতে দেরিই হয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম আটটা মিসডকল হয়েছে অভিজিতের ফোন থেকে। ওকে ফোন করাতে খুব উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কাগজটা দেখেছিস?’

বললাম ‘ক্যানো?’

ফোনের ওপার থেকে অভিজিৎ বলল, ‘দৈনিক বাংলার ছয়ের পাতার বাঁদিকে নীচের দিকে একটা ছোট্ট খবর আছে পড়—’

চায়ের টেবিলের ওপর কাগজটা পড়েছিল। তুলে নিয়ে দেখলাম লক্ষ্মীকান্তপুর শাখায় কৃষ্ণমোহন হল্ট ও শাসন স্টেশনের মাঝে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর খবর। মৃতের নাম নিবারণ চন্দ্র দাস। আশ্চর্যের ব্যাপার, আড়াই বছর আগে ওখানেই ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল নিবারণের রিকশাভ্যান চালক দাদা মাধবচন্দ্র দাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *