ভূতনাথের বাড়ি
‘আচ্ছা মশাই, এদিকটাতেই কি ভূতনাথবাবুর বাড়ি?’
‘না না, এ পাড়ায় ভূতনাথ বলে কেউ থাকে না।’
‘কী আশ্চর্য! কিন্তু আমার কাছে যে ঠিকানাটা দেওয়া আছে তাতে স্পষ্ট লেখা অশ্বিনী মিত্র রোড, হাকিমপাড়া, তা এটা কি হাকিমপাড়া নয়?’
‘তা হবে না কেন? এটা হাকিমপাড়া হতে বাধাটা কীসের? আটকাচ্ছে কে?’
‘তাহলে অশ্বিনী মিত্র রোডটা?’
‘এটা অশ্বিনী মিত্র রোডও বটে।’
‘কিন্তু তাহলে ভূতনাথবাবুর বাড়িও তো এখানেই হওয়া উচিত।’
‘না মশাই, কক্ষনো এখানে ভূতনাথবাবুর বাড়ি হওয়া উচিত নয়।’
‘বলছেন! কিন্তু তা হয় কী করে? ভূতনাথবাবু নিজেই এই ঠিকানা দিলেন যে!’
‘আর আপনিও অমনি ফস করে বিশ্বাস করে ফেললেন তো?’
‘যে আজ্ঞে। ভূতনাথবাবুকে বিশ্বাস করা কী উচিত হয়নি মশাই?’
‘বিশ্বাস করা না করা আপনার দায়। আমার তো নয়। তবে একথাও বলতে ইচ্ছে করে, কেউটে সাপ বা সোঁদরবনের বাঘকেও কী বিশ্বাস করা উচিত?’
‘আজ্ঞে না। তাদের কথা আলাদা। বন্যপ্রাণী আর মানুষে তফাত আছে।’
‘তফাতটা কী? তফাতটা কোথায়? ভূতনাথ বিশ্বাসকে যদি বিশ্বাস করা যায় তাহলে কেউটে সাপ বা সোঁদরবনের বাঘের দোষ কী বলুন!’
‘আপনি বলতে চান ভূতনাথ বিশ্বাস সাপ বা বাঘের মতোই বিশ্বাসের অযোগ্য।’
‘অতটা বলতে চাই না। তা ছাড়া আমি তো বলেই দিয়েছি, ভূতনাথ বিশ্বাস নামে কেউ এ পাড়ায় থাকে না।’
‘তবে তিনি থাকেন কোথায়? সম্প্রতি কি বাসা বদল করেছেন?’
‘করাই উচিত। বাসা বদলালে বহু মানুষের উপকারই হত। তবে ওসব আমি বলতে চাইছি না। তা আপনি আসছেন কোথা থেকে?’
‘আমি আসছি নিশিগঞ্জ থানা থেকে।’
‘অ্যাঁ! বলেন কী? থানা থেকে? আরে, তা আগে বলতে হয়। তা সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন তো!’
‘তা আর আনিনি! সার্চ ওয়ারেন্ট আছে, অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে, আদালতের সমন আছে। আমার কাছে সবকিছু পাবেন।’
‘বাঃ, বাঃ! এ তো খুব ভালো কথা মশাই! তা আসুন না, এই গরিবের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দেবেন। কাছেই আমার বাড়ি। ওই যে সামনের লাল বাড়িটা।’
‘তা মন্দ কী? পথ তো আর কম নয়। দুপুরের এই রোদে এতটা পথ আসতে বড়ো হাঁপসে পড়েছি মশাই।’
‘আহা, আমারই দোষ। মান্যগণ্য লোক আপনি, এভাবে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখাটা আমার ঠিক হয়নি। আসুন আসুন।’
‘বাঃ, আপনার বাড়িটি তো বেশ।’
‘সবাই তা বলে বটে। তবে এ আর এমন কী বলুন। হারু ঘোষের বাড়ি আরও পেল্লায়।’
‘তা আপনার বাড়িই বা কম কীসে? ক—বিঘে জমি নিয়ে বাগানখানা করেছেন বলুন তো!’
‘না না, জমি কোথায়! বাড়িখানাই তো অর্ধেক জমি গিলে খেল। এখন মোটে বিঘে দশেক পড়ে আছে।’
‘বাপ রে! দশ বিঘে জমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো জিনিস! তা মার্বেল বসিয়েছেন বুঝি মেঝেতে?’
‘মার্বেলই বটে। তবে এক নম্বর সরেস জিনিসটা তো আর পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে ইটালিয়ান মার্বেলই বসাতে হল।’
‘ইটালিয়ান মার্বেল! সে তো অনেক দাম মশাই। তার চেয়ে সরেস মার্বেল পাবেন কোথায়?’
‘লোকে তাই বলে বটে। তবে এই অখাদ্য জায়গায় ভালো জিনিসের সমঝদারই বা কোথায় বলুন। বসুন তো, এই সোফায় বসুন। আমি বরং ঠান্ডা মেশিনটা চালিয়ে দিই। আপনার তো বেশ ঘাম হচ্ছে দেখছি।’
‘ঠান্ডা মেশিনও লাগিয়েছেন? বাঃ, আপনার নজর তো খুব উঁচু।’
‘কী যে বলেন! ওসব আজকাল হ্যাতাপ্যাতাদের ঘরেও থাকে। তা এই গরমে কী একটু লেবুর শরবত খাবেন?’
‘না না, এসব ঝামেলা করতে হবে না। অন্য ডিউটি আমাদের এসব খেতে—টেতে নেই।’
‘আহা ডিউটি করতে করতেই খাবেন। এক গেলাস শরবত বই তো নয়। দাঁড়ান, ভিতরে বলে আসছি। … হ্যাঁ, তারপর বলুন তো, ভূতনাথের কেসটা কী?’
‘খুব খারাপ কেস মশাই, খুব খারাপ কেস।’
‘কত ধারায় মামলাটা ঠুকছেন?’
‘ধারা—টারা উকিলের ব্যাপার, তারা বুঝবে। আমরা চার্জশিট দাখিল করব, তারপর কেস কোর্টে যাবে।’
‘বাঃ বাঃ, এ তো খুব ভালো খবর মশাই। মা কালীকে জোড়া পাঁঠা মানত করা ছিল।’
‘আচ্ছা, জোড়া পাঁঠা কেন মানত করেছিলেন বলুন তো!’
‘অতি দুঃখেই মানত করতে হয়েছিল মশাই।’
‘কিন্তু দুঃখটা কীসের?’
‘সে আর বলবেন না। দুঃখ কী একটা? ভূতনাথের জ্বালায় এ পাড়ার সবাই অতিষ্ঠ। ধরুন কেউ হয়তো শীতলা পুজোয় একটু মাইক—টাইক লাগিয়েছে। তা পুজো—টুজোয় ও তো লোকে লাগিয়েই থাকে। ভূতনাথ তার দলবল নিয়ে এসে সব চোঙা—টোঙা খুলে নিয়ে যায়। তারপর ধরুন কেউ হয়তো রাস্তার ধারে একটু তরকারির খোসা বা মাছের আঁশ ফেলেছে, অমনি ভূতনাথ এসে কী হম্বিতম্বি! তারপর অধরবাবুর খিটখিটে বুড়ো বাপটা সারাদিন খাই খাই করে পেট নামিয়ে ফেলে, তাই অধরবাবুর বউ শ্বশুরকে বলেছিল, অত খাওয়া কী ভালো? হয়তো একটু ঝাঁঝের গলাতেই বলেছিল, তাইতে ভূতনাথ এসে চড়াও হয়ে মানবাধিকার কমিশনের ভয় আর সামাজিক বয়কটের জুজু দেখিয়ে কী অত্যাচারটাই না করে গেল। ওই যে নবকুমার, তার দোষ হয়েছিল, বাগানের পাঁচিলটা তোলার সময় মাপজোকের ভুলে রাস্তার খানিকটা সীমানায় ঢুকে যায়। ভূতনাথ সেই দেয়াল ভাঙিয়ে তবে ছাড়ল।’
‘এ তো ভূতনাথের খুব অন্যায়!’
‘অন্যায় নয়? আমাকেই কী কম জ্বালাতন হতে হচ্ছে মশাই? শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়ে কোনোমতে বাড়িটা খাড়া করেছি, ভূতনাথ এসে রোজ দলিল দেখতে চায়, ভয় দেখায়। আমি নাকি সরলাবালা নামে এক বিধবার জমি চালাকি করে লিখিয়ে নিয়েছি।’
‘লিখিয়ে নেননি তো!’
‘তা লিখিয়ে নেব না কেন? নিয়েছি বই কী। কিন্তু তার জন্য তিন কিস্তিতে ন্যায্য দামও সরলাবালাকে মিটিয়ে দিয়েছি। রসিদও আমার কাছে আছে। কিন্তু কলিকাল তো, ভালো মানুষদের বড়ো দুর্দিন। ভূতনাথ আমার বিরুদ্ধে লোককে খেপিয়ে তুলছে।’
‘না—না, এসব তো ভালো কথা নয়।’
‘আপনারা পাঁচজন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এসে দেখুন কতবড়ো অবিচার এবং অনাচার চলছে এখানে। ওই যে, মিষ্টিটুকু মুখে দিয়ে ঠান্ডা ঘোলটা একচুমুকে মেরে দিন তো, শরীর ঠান্ডা হবে।’
‘ও বাবা। এত আয়োজন! না মশাই, আমার পক্ষে দশ—বারোটা মিষ্টি খাওয়া সম্ভব নয়। আমি পেটরোগা মানুষ।’
‘আহা, আপনি তো ইয়ংম্যান। কতটা হেঁটে আসতে হয়েছে। লজ্জা করবেন না, খেয়ে নিন।’
‘তাহলে ভূতনাথবাবুর জন্য আপনারা শান্তিতে নেই?’
‘না মশাই, সে বিদেয় হলে বাঁচি। তা তার বিরুদ্ধে কীসের মামলা বলুন তো! খুন—জখম—রাহাজানি, নাকি চারশো বিশ ধারা, নাকি ট্যাক্স ফাঁকি?’
‘কেসটা আমি খুব ভালো জানি না। তবে তার নামে সরকারি চিঠি আছে।’
‘সেই চিঠিতে কী আছে মশাই? যাবজ্জীবন হলে খুব ভালো হয়, ফাঁসি হলে তো চমৎকার, নিদেন আট—দশ বছরের কয়েদ তো বোধ হয় হচ্ছেই। কী বলেন?’
‘তাও হতে পারে। সবই সম্ভব। আচ্ছা, আপনার কি একটা দশ লাখ টাকার ব্যাঙ্ক লোন আছে?’
‘অ্যাঁ! ব্যাঙ্ক লোন! দাঁড়ান, মনে করে দেখি! আচ্ছা আচ্ছা মনে পড়ছে, একটা লোন যেন ছিল! তা তো এতদিনে শোধ করে যাওয়ার কথা! গেছেই বোধ হয়। তা এ—খবর কে দিল আপনাকে? ভূতনাথ নাকি?’
‘জয়কৃষ্ণ সরখেল তাঁর বাড়িঘর আপনার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় বাঁধা রেখেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর কি আপনি পঞ্চাশ লাখ টাকার দাবিতে তাঁর নাবালক পুত্র—কন্যাকে বের করে দিয়ে জমি—বাড়ি দখল করেছেন?’
‘এই দ্যাখো কাণ্ড! তাই বলেছে বুঝি ভূতনাথ? একদম বিশ্বাস করবেন না মশাই, আমার বড্ড নরম মন। পাঁচ হাজার নয়, অনেক বেশিই নিয়েছিল জয়কৃষ্ণ। কাগজপত্র সব পরিষ্কার।’
‘না, আপনি যে ভালো লোক তা যেন বুঝতে পারছি। তবে কিনা সেটা প্রমাণ করা বেশ শক্ত হবে। কলিকাল তো। এই কলিকালে ভালোমানুষদের যে কষ্ট পেতেই হয়। চলুন মশাই কষ্ট করে একটু থানায় চলুন। বড়োবাবু আপনার জন্য বসে আছেন।’
‘সে কী? আর ভূতনাথ?’
‘তাকে তো সরকার কী খেতাব—টেতাব দেবে বলে শুনছি। সেই চিঠিও আমার সঙ্গেই আছে।’