ভুসুক পণ্ডিত ভারী অলস। পাঠশালায় পড়াতে পড়াতে ছেলেদের টাসক করতে গিয়ে প্রায় সময়েই ঘুমিয়ে পড়েন। আর ছেলেরা সেই সুযোগে দেদার ফাঁকি দেয়।
সময়টা ২০৯৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের সকাল। ভুসুক পণ্ডিত ছেলেদের একটা রচনা লিখতে দিলেন বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ? তারপর ঘুমোতে লাগলেন।
পাঠশালা বসে একটা প্রকাণ্ড শিমুলগাছের তলায়। নিয়ম হয়েছে সেই আগেকার দিনের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। তাই এই ব্যবস্থা। ভুসুক পণ্ডিত বসেন গাছতলায় উঁচু একটা বেদিতে। ছেলেরা বসে ঘাসের ওপর মাদুর পেতে।
ভুসুক পণ্ডিত ঘুমিয়ে পড়েছেন টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেরা নিজেদের কাজ শুরু করে দিল। একটি ছেলে পকেট থেকে ছোট্ট একটা লেসার রশ্মির পিস্তল বের করে টুকটাক ফল পাড়তে লাগল। একজন পকেট কম্পিউটারের সঙ্গে খেলতে বসে দাবা। জনা তিনেক একটা হাতঘড়ির সাইজের টেলিভিশনে চুপিচুপি অ্যাডভেঞ্চারের ফিলম দেখতে লাগল। একজন অ্যান্টিগ্র্যাভিটি সাইকেলে উঠে আকাশে চক্কর দিতে থাকল। একজন দুষ্টু ছেলে আর একজনকে ডেকে বলল, অ্যাই, আজ চল পণ্ডিত মশায়ের টিকি কেটে দিই।
দ্বিতীয় ছেলেটা চোখ গোল করে বলে ওঠে, ওরে বাবা! টের পেলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন।
কথাটা ঠিক। ভুসুক পণ্ডিতের চেহারাটা এমনিতে নাদুসনুদুস। পরনে হেঁটো ধুতি, খালি গা, কাঁধের ওপর একটা ভাঁজ করা উড়ুনি। পৈতেটা ধপধপ করছে সাদা। নিষ্ঠাবান মানুষ। চেহারাটা নিরীহ হলে কী, ভুসুক পণ্ডিত সাঙ্ঘাতিক রাগী লোক।
দুষ্টু ছেলেটা বলল, টের পেলে তো!
দ্বিতীয় জন ভয়ে ভয়ে বলে, পারবি?
খুব পারব। এই বলে ছেলেটা পকেট থেকে একটা খুদে ওয়াকিটকি বের করে অন্য সব ছেলেদের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘বন্ধুগণ, আজ ভুসুক পণ্ডিত মশায়ের শিখা কর্তন করা হইবে। তোমরা কেহ ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করিবে না যে, অপকর্মটি কে করিয়াছে। কেহ যদি প্রকাশ কর তাহা হইলে তাহাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হইবে।’
অন্য সব ছেলেরা তাদের গলার কাছে বাঁধা ট্রান্সরিসিভার যন্ত্রে ঘোষণাটা শুনতে পেয়ে ভারি উত্তেজিত হয়ে উঠল। কিন্তু কেউ কোনো শব্দ করল না।
দুষ্টু ছেলেটা তার ব্যাগ থেকে একটা সোনার রেঞ্জ বের করল। যন্ত্রটা দিয়ে ইচ্ছে মতো নানারকম শব্দ বের করা যায়, মাইক্রোফিলমের মতো এর ভিতরে আছে একটি প্রি—রেকর্ডেভ মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার। ছেলেটা একটা বোতাম টিপে যন্ত্রটা চালু করল। তারপর একটা পিস্তলের নলের মতো ব্যারেল লাগিয়ে সেটা তাক করল ভুসুক পণ্ডিত মশাইয়ের দিকে।
ব্যাপারটা হল, এই শব্দটা আসলে ঘুমপাড়ানি শব্দ। যার দিকে তাক করে শব্দটা নিক্ষেপ করা হবে সে ছাড়া আর কেউ তা শুনতে পাবে না। অবশ্য কানে শোনার শব্দও এটা নয়। এটা হল এক ধরনের কাঁপন বা ভাইব্রেশন, যা আধ মিনিটের মধ্যে যে—কোনো লোককে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে।
দুষ্টু ছেলেটা পুরো এক মিনিট শব্দটা চালাল। তারপর আস্তে আস্তে উঠল। প্রত্যেকে দুরুদুরু বুকে চেয়ে আছে দুঃসাহসী ছেলেটার দিকে। যন্ত্রের প্রভাবে পণ্ডিতমশাই গভীর নিদ্রায় ডুবে গেছেন বটে, কিন্তু এক সময়ে তো জাগবেন! তখন যে কী কুরুক্ষেত্রটাই হবে। ছেলেটা পকেট থেকে ধারালো কাঁচি বের করে পণ্ডিত মশাইয়ের পেছনে গিয়ে কুচ করে টিকিটা কেটে এক দৌড়ে পালিয়ে এল নিজের জায়গায়। পাঠশালায় এক চাপা হাসির হররা বয়ে গেল।
সেই শব্দেই কিনা কে জানে, আচমকা পণ্ডিতমশাই চোখ মেলে চাইলেন।
ছেলেরা তো ভয়ে কাঠ। শ্বাস বন্ধ করে বসে আছে সব। একটু অবাকও হয়েছে তারা। ভাইব্রেটার দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে পণ্ডিতমশাইকে, এত সহজে তো তাঁর জাগবার কথা নয়।
ভুসুক পণ্ডিতমশাই চোখ চেয়েই বিশাল একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলেন হঠাৎ। ছেলেরা স্তম্ভিত। তারা কখনো পণ্ডিমশাইকে হাসতে দেখেনি।
কিন্তু তাদের আরও স্তম্ভিত করে দিল, পণ্ডিতমশাই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, আজ তোমাদের ছুটি! ছুটি!
ছেলেরা সমস্বরে বলে উঠল, ছুটি পণ্ডিতমশাই?
পণ্ডিতমশাই হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বললেন, কীসের লেখাপড়া হ্যাঁ! অ্যাঁ! লেখাপড়া অত কীসের? বাচ্চচা ছেলেরা নাচবে, গাইবে, দুষ্টুমি করবে, তবে না! ওঠো সব, উঠে পড়ো! আজ আমাদের গান হবে। নাচ হবে। হুল্লোড় হবে।
বলেন কি পণ্ডিতমশাই? ছেলেদের চোখের ভাব ক্রমশ আরও গোল হয়ে উঠছে।
ভুসুক পণ্ডিত হঠাৎ নিজেই তড়াক করে বেদি থেকে নেমে পড়লেন। তারপর দু—হাত তুলে গান ধরলেন, আজ আমাদের ছুটি রে ভাই, আজ আমাদের ছুটি…গাও! গাও!
ছেলেরাও গাইতে লাগল।
ভুসুক পণ্ডিত নাচতে নাচতে বললেন, শুধু গাইলেই হবে না, নাচো! সবাই নাচতে শুরু করো।
তা ছেলেদের তো পোয়া বারো। রচনা ছেড়ে নাচ—গান! এ কি ভাবা যায়! তারা সবাই পণ্ডিমশাইয়ের সঙ্গে নাচতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ নাচ—গান হওয়ার পর ভুসুক পণ্ডিতমশাই বললেন, শুধু নাচ—গান নয়। চলো সবাই মিলে একটু দুষ্টুমি করা যাক। চলো সনাতন মুৎসুদ্দির বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করি।
ছেলেরা নিজের কানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল, বলেন কী পণ্ডিতমশাই?
কিন্তু ভুসুক পণ্ডিতের যেই কথা সেই কাজ। তিনি সবার আগে গিয়ে সনাতনের বাগানের বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের বেড়াটিকে এক জায়গায় কেটে ফাঁক করে ঢোকার রাস্তা বানালেন। তারপর বাগানে ঢুকে নিজেই ঢিল মেরে এবং একটি ছেলের কাছ থেকে লেসার গান চেয়ে নিয়ে তাই দিয়ে মেলা পেয়ারা পেড়ে ফেললেন। সনাতনের রোবট চাকরগুলো তেড়ে আসায় পণ্ডিতমশাই ছেলেদের নিয়ে পালিয়ে এলেন। তারপর বললেন, চলো, একটু ফুটবল খেলা যাক।
ছেলেদের আনন্দ আর ধরে না। পড়াশুনা ছেড়ে এরকম মজার সময় কাটানো মহাভাগ্যের ব্যাপার। পণ্ডিতমশাই নিজে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে নেমে পড়লেন। বিস্তর আছাড় খেলেন বটে, কিন্তু খেললেনও চমৎকার। দুটো দারুণ গোল করলেন।
পণ্ডিতমশাইয়ের এত বিদ্যের কথা কেউ জানত না।
খেলার শেষে পণ্ডিতমশাই বললেন, ওহে, চল পুকুরে স্নান করতে নামি।
ছেলেরা এই প্রস্তাবে হইহই করে উঠল। কাছে চমৎকার বাঁধানো পুকুর। পণ্ডিতমশাই ছেলেদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে। তুমুল আনন্দে সবাই স্নান করতে লাগল।
কিন্তু আচমকাই তাদের আনন্দের মধ্যে একটা বজ্র এসে পড়ল যেন। আকাশ থেকে একটা ছোট্ট নৌকোর সাইজের রকেট নেমে এল। তা থেকে গম্ভীর চেহারার একজন লোক নেমে এসে ভুসুক পণ্ডিতমশাইকে একটা ধমক দিয়ে বলল, শিগগির উঠে আসুন।
ভুসুক পণ্ডিত যেন একটু ভয় পেয়ে জল থেকে উঠলেন। সঙ্গে ছেলেরা।
লোকটা ভুসুক পণ্ডিতমশাইকে ভালো করে লক্ষ করল, ঘুরে ফিরে দেখল, তারপর ছেলেদের দিকে চেয়ে বলল, এর অ্যানটেনাটা কে কেটেছে?
ছেলেরা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
লোকটা বলল, দুষ্টু ছেলে! ছিঃ।
এই বলে সকলের চোখের সামনে লোকটা একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে পণ্ডিতমশাইয়ের মাথার খুলিটা ফাঁক করে ফেলল, তারপর একটা নতুন টিকি বসিয়ে দিয়ে মাথাটা আবার জুড়ে বলল, ‘এঃ, এই কম্পিউটারের একটা পারটস খারাপ ছিল? কেউ লক্ষই করিনি, টিকিটা কাটায় ভালোই হয়েছে। যাও, এবার আর পণ্ডিতমশাই ঘুমোবেন না।’
টিকিটা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুসুক পণ্ডিতমশাই আবার গম্ভীর ও রাগী হয়ে গেলেন। গাছতলায় পাঠশালায় ছেলেদের জড়ো করে গমগমে গলায় বললেন, এবার আঁকের খাতা খোলো সব। করো, একসারসাইজ ষোলোর এক থেকে দশ নম্বর পর্যন্ত আঁকাগুলো।
ছেলেরা প্রাণভয়ে আঁক কষতে লাগল। কারণ ভুসুক পণ্ডিতের চোখে ঘুমের লেশমাত্র আর নেই। দুই চোখ ভাঁটার মতো চারদিকে ঘুরছে।