ভুল (২)
মানুষ ভুল করে।
মানুষ মাত্রেই ভুল করে।
পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে কখনও ভুল করেনি। মানুষ চিরকাল ভুল করেছে। এখনও ভুল করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও ভুল করবে।
পরীক্ষার খাতায় চেনা অঙ্ক ভুল হয়ে যায়। অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুঞ্জয় সার্জন ভুল করেন, মোক্ষম মুহূর্তে ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ ভুল করেন। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে প্রশ্নের জবাবে প্রার্থী প্রথম মুঘল সম্রাটের নাম মনে করতে পারে না।
এইসব ধরনের ভুল কখনও হালকা হাসির, কখনও বিপজ্জনক।
মজার ভুলের গল্প আছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশায়ের। এক ব্যক্তি সান্ধ্যভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে বিছানায় নিজে না শুয়ে সেখানে তাঁর হাতের লাঠিটি শুইয়ে নিজেকে লাঠিভ্রমে দরজার পাশে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখেন।
একদা ভুলে ভরা কলকাতার গান গেয়ে দাদাঠাকুর অর্থাৎ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত কলকাতা শহর মাতিয়েছিলেন।
সবই সামান্য সাধারণ কথা। ভুলে ভরা শহর কলকাতা। এখানে গোলদিঘি গোল নয়। মুরগিহাটায় মুরগি কিনতে পাওয়া যায় না। বউবাজারে বউ পাওয়া যায় না। এখানে চোরবাগানে সাধুদের বাস। এ রকম সব বালকোচিত ভূলের তালিকায় ভরা সেই গান জনসাধারণের হৃদয় জয় করেছিল।
ভুলের আদি-অন্ত নেই। ভুল করার দুঃখে ভরা কত গান, কত কবিতা। মুম্বইয়ের হিন্দি সিনেমার অধিকাংশ গল্প ভুলের পরিণাম নিয়ে। স্বামী-স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী-স্বামীকে ভুল সন্দেহ করে। বন্ধু বন্ধুকে ভুল বোঝে—এইসব নিয়ে কাহিনী।
এগুলি গোঁজামিল ভুল। আসল ভুলের কথায় যাই।
প্রথমেই আদিকবি বাল্মীকি।
রামায়ণ মহাকাব্যের সেই অংশটি তো সকলের জানা। ইন্দ্রজিতের শক্তি শেলে লক্ষ্মণ যখন মূৰ্ছাহত, মৃতপ্রায় সেই সময় রামচন্দ্র বিলাপ করেছিলেন,
দেশে দেশে কলত্রানি,
দেশে দেশে চ বান্ধবাঃ।
ত্বং তু দেশম ন পশ্যামি
যত্র ভ্রাতা সহোদরঃ॥
ভ্রাতৃপ্রেম বিষয়ে বিখ্যাত এই শ্লোকটির বঙ্গানুবাদ হল:
দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যাবে, দেশে দেশে বন্ধু পাওয়া যাবে, কিন্তু এমন কোনও দেশ নেই যেখানে সহোদর ভাই পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু লক্ষ্মণ কী করে রামের সহোদর হলেন? লক্ষ্মণের সহোদর ভাই শত্রুঘ্ন, তাঁদের মা সুমিত্রা। রাম কৌশল্যার পুত্র। রাম-লক্ষ্মণ সহোদর নন, বৈমাত্রেয় ভাই। অথচ এই শ্লোকে রাম-লক্ষ্মণকে সহোদর ভাই বলছেন।
আমার কেমন মনে হয়, এই পঙ্ক্তিটি প্রক্ষিপ্ত। পরবর্তীকালে কোনও আবেগাকুল কবির দ্বারা সংযোজিত। আমি বাল্মীকি মূল রামায়ণে খুঁজে দেখেছি পঙ্ক্তি দুটি দেখতে পাইনি। আমার অনিশ্চিত দৃষ্টির জন্য অবশ্য তা হতে পারে।
আদিকবির পর বিশ্বকবি। ভাবাই যায় না যে, রবীন্দ্রনাথের ভুল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও একটি অস্বাভাবিক ভুল করেছিলেন। এটি একটি বিখ্যাত ভুল, অনেকেই জানেন।
অনেকের কাছে ভুলটি সামান্য হলেও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এ রকম ভুল করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভব ভুলটি তিনি করেছিলেন। সকালবেলায় সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, তখন ছায়া খুব লম্বা হয়। তারপর সূর্য যেমন যেমন মাথার উপরে উঠতে থাকে, ছায়া তেমনই হ্রস্ব থেকে হ্রস্বতর হতে থাকে। সূর্য যখন মধ্যগগনে তখন হ্রস্বতম ছায়া। এর পর সূর্য যেমন নামতে থাকে ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠিক এর বিপরীত বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেখানে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছায়া বড় হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথের এই ভুল সজনীকান্ত দাশ ধরিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ভুল স্বীকার করে দীর্ঘতর ছায়াকে পরবর্তী সংস্করণে হ্রস্বতর করেছিলেন।
অতঃপর পরশুরাম। অর্থাৎ, রাজশেখর বসু। ‘চলন্তিকা’ বাংলা ভাষার একটি বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় অভিধান। ভাবা যায়, সেই অভিধানের রচনাকার নিজে ভুল বানান লিখছেন।
কয়েকবছর আগে এম সি সরকারের পুস্তক প্রকাশালয় থেকে একটি চটিবই বেরিয়েছিল, ‘অপ্রকাশিত রাজশেখর’ এই নামে। সেই বইয়ের প্রথম দিকে রাজশেখরবাবুর হাতে লেখা একটি পৃষ্ঠার ছবি ব্লক করে মুদ্রিত আছে। গল্পের চরিত্রগুলির কোনটার চেহারা কী রকম হবে স্বয়ং পরশুরাম স্বহস্তে এঁকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশাবলির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন হাসি মুখ, স্পষ্টই হাসি বানানে তিনি দীর্ঘ ঈকার দিয়েছেন।
এই ঘটনা অবশ্য চলন্তিকা প্রকাশের এক দশক আগের। আমার কেমন মনে হয়, বাংলা বানানে দুর্বলতা ছিল জেনেই নিজেকে সংশোধন করার জন্য অভিধান রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বা পরশুরাম শুধু নন, ভুল সত্যজিৎ রায়-ও করেছিলেন। ফেলুদা কাহিনীতে কলিংবেল বেজেছিল লোডশেডিংয়ের সময়। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুল করছেন এই পত্রিকার সম্পাদক, যিনি আমার মতো ভেজাল লেখকের গোঁজামিল লেখা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ছেপে চলেছেন।