ভুল হয় না ভূতের – বলরাম বসাক

ভুল হয় না ভূতের – বলরাম বসাক

এক যে ছিল মাস্টারমশাই। তার ছিল এক ছাত্র। অবশ্যই তাঁর অনেক ছাত্র ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে একটা এমন গুরুতর ছাত্র যে কিনা বড্ড বে…।

এমনিতেই ছেলেটার নাম বেণুবদন। তার ওপর তার সঙ্গে জুড়ে যায় অনেকগুলো বে… বেয়াদব, বেয়াড়া, বেচারা, বেহায়া, বেপরোয়া, বেভুলু, বেঢপ, বেশরম, বেখাপ্পা…।

আর তার মাস্টারমশাই-এর নাম ভীষণ ভৈরব ভট্টাচার্য। তার সবই ‘ভ’ দিয়ে—ভয়ানক স্যার। কখনো বা ভস্মলোচন স্যার। কখন? যখন তাঁর দেখা পরীক্ষার খাতায় কেউ যদি গোল্লা পায়, তখন সেই গোল্লা পাওয়া ছাত্রটি তাঁর চোখের সামনে দাঁড়াতে পারে না। বিলকুল ভস্ম হয়ে যাবে। শোনা গেছে, অনেক মা-বাবাই তাঁদের ছেলে গোল্লা পাবার মতো পরীক্ষা দিয়েছে টের পেলে পড়ি-মরি করে ছুটে এসে ভস্মলোচন স্যারের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বলেন ‘ক্ষমা করে দিন স্যার, আর ভুল হবে না স্যার, আমাদের ছেলে নেক্সট পরীক্ষায় কমসে কম ‘এক’ তো পাবেই—কথা দিচ্ছি আর গোল্লায় যাবে না…।’ এ ছাড়া তাঁর আরেকটা নাম ‘ভল্লধর’ (কারণ তিনি যে বেত হাতে নিয়ে সারা ইস্কুল ওপর-নীচ করে বেড়ান, সেই বেতটা কোথাও মোটা কোথাও লিকলিকে সরু, ওপরটা ছুঁচোলো, দেখতে নাকি ভল্ল মতন ছেলেদের চোখে, যারা তাঁকে ‘ভল্লধর’ খেতাব দিয়েছে।)

যাই হোক, বর্তমানে ইস্কুল প্রতিদিনের মতোই কলকল খলখল করে চলছে। কেবলমাত্র বেণুবদনদের ক্লাসঘরে কোনো আওয়াজ নেই।

সেখানে ভীষ্মভৈরববাবু চোখ পাকিয়ে প্রত্যেকটি ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন। এই মুহূর্তে তাঁর ভস্মলোচন নামটাই মজবুত কারণ ওনার দেখা পরীক্ষার খাতাগুলো উনি জুল-জুল চোখো ছাত্রদের সামনে হাজির করেছেন। বেণুবদন ছাড়া প্রত্যেকেই ‘4’, ‘3’ ’10’, ‘7’, ‘5’ ইত্যাদি নম্বর পেয়েছে। বেণুবদন শুধু পেয়েছে ‘1’। ভাগ্যিস জিরো কেউ পায়নি, পেলে কে জানে বাবা তাকে হয়তো সত্যি সত্যি ভস্ম হয়ে যেতে হত। বেণু অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। বেণু ‘1’ পেয়েছে কারণ পরীক্ষার খাতায় উত্তরগুলো লিখতে সে মোট চারশো বারোটা শব্দ লিখেছে, তার মধ্যে চারশো এগারোটা শব্দের বানান ভুল। একটা শব্দের বানান সঠিক হওয়াতে দয়ালু ভস্মলোচন স্যার তাকে ‘1’ নম্বর দিয়েছেন। দিলেও খুশি হননি। বিপুল সংখ্যক বানান ভুলের জন্যে বেণুবদনকে শাস্তিস্বরূপ পেতে হবে চারশো এগারোটা বেত্রাঘাত ( ভল্লাঘাত)। উরে বাপরে। ওটা পেতে হবে বুঝতে পেরে বেণুবদন ক্লাস থেকে দে চম্পট।

পালাবে কোথায়? চম্পট দিলেই হল? ভস্মলোচন স্যার, থুড়ি, এবারে আর ভস্মলোচন নামটা ব্যবহার না-করে বলা যাক ভল্লধর স্যার ‘ভল্ল’ হাতে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বেণুবদনের পেছন পেছন ছুট লাগালেন।

বেণুবদন পাঁই পাঁই করে ছুটে ইস্কুলের নীচতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলা, থেকে চারতলায়, ছাদে উঠল।

চারতলার ছাদে একটি মাত্র ঘর। সবসময় খালি পড়ে থাকে। জানালাগুলো বন্ধ থাকে একটা মাত্র দরজা ভেজানো থাকে। ও ঘরে কেউ আসে না। উঁচুতলার এই খালি ঘরটাকে চামচিকে-ভূত, পেচকিনী-পেতনি, গিটার বাদক গুঁফো ভূত, সূচনখা শাঁকচুন্নি, বংশীবাদক নেকো ভূত, বেঁটেমোটা ঢাকি ভূত, কলসি ভূত, গামবুট-ভূত, ঝুল ঝাড়ু-পেতনি, সব্বাই মিলে তখন এক থঁড়ি ‘ইসপিশাঁল সাঁইজ’ ভূতুড়ে পানতুয়া নিয়ে বসে ছিল। আর সব্বাই মিলে ভূজ্জাতীয় (ভূত + জাতীয়) সংগীত সমবেত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে গাওয়ার মহড়া চালাছিল। কণ্ঠস্বর অতিমিষ্টি রাখার জন্যে একটি করে পানতুয়া কোঁৎ করে গিলছিল। মিষ্টি-মিহি-চিঁচিঁ-স্বরে ফিসফিসিয়ে এই গানের মহড়া চালাতে হচ্ছিল কারণ এ যে দিঁবাকাঁল—চোঁপ ইঁসকুল চোঁলছে’। ‘নিশাঁকাল’ হলে গলা ছেড়ে দাপিয়ে মহড়া হত।

চারতলার ছাদের এই একমাত্র ঘরটাতে বেঞ্চি-টেঞ্চি আছে কয়েকটা, ব্ল্যাকবোর্ডও একটা ঝুলছে দেয়ালে। কিন্তু ভূতের ঘর বলে কেউ এ ঘরে ক্লাস করতে চায় না। তবে মাঝে মাঝে অভিযান হয় মাস্টারমশাইদের। ‘দেখিতো কেমন ভূত’ বলে তাঁরা একটা ছেঁড়া রামায়ণ হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকেন। তাঁদের পেছনে পেছন বুক দুরু দুরু ছাত্রদলও ঢোকে। হাতে থাকে বেত, ডাস্টার, টিনের স্কেল, ইস্পাতের স্কেল, ইস্পাতের এল স্কেল। ছেঁড়া রামায়ণটাকে ঢাল করে সামনে ধরে অস্ত্রধর স্যাররা বেতগুলোকে শূন্যে সপাং সপাং করে চালাতে থাকেন, প্রচণ্ড জোরে ডাস্টার ঠুকতে থাকেন বেঞ্চিতে, উঁচু ক্লাসের ‘বীর’ ছাত্রেরা টিনের স্কেল, ইস্পাতের স্কেল তলোয়ারের মতো শূন্যে এদিক-ওদিক ঘোরাতে থাকে। ভূত-পেতনিরা অবশ্য তখন কেউই ভেতরে থাকে না। ওরা ঘরটাতে ঢুকবার আগেই কেটে পড়ে।

যাইহোক, আজ এই মুহূর্তে বেণুবদন ছুটতে ছুটতে ওই ঘরেই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে। তাকে ঢুকতে দেখে ‘ভূজ্জাতীয়’ সংগীত গানের মহড়ায় রত ভূত-পেতনি-শাঁকচুন্নিরা আঁৎকে উঠেছিল। মনে করেছিল ‘জ্যান্ত’রা ভূত তাড়ানোর অভিযান করতে ভেতরে ঢুকছে। তখন সবকটা ভূত-পেতনি-শাঁকচুন্নি দরজা দিয়ে পালাতে চাইছিল। কিন্তু দরজায় ‘ভল্ল’ হাতে ভল্লধর স্যার—ওঁরে বাঁপুরে বলে তারা তাড়াতাড়ি যার যার শরীর খুদে টিকটিকির ছানার মতো করে ফেলল, কেউ কেউ মাকড়সারূপ ধারণ করল। তারপর দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে ভেন্টিলেটার গলে পালাতে লাগল। তখন ভেন্টিলেটারে ট্রাফিক জ্যামের মতো ভৌতিক জ্যাম হয়ে গেছিল। তাই কলসি-ভূত পালাতে পারেনি। তখন সে কী করে ? একটা বেঞ্চির ওপর দাঁড়ায়, এবং দ্রুতগতিতে বেণুবদনের রূপ ধারণ করে ফেলে। কারণ ও ভেবেছে বেণুবদনরা ভল্লস্যারকে নিয়ে ভূত তাড়াতে এসেছে। ওরা তো জ্যান্ত মানুষকে পেটাবে না, ভূত পেটাবে। তাই সে খুউব বুদ্ধি করে তক্ষুনি বেণুবদনের রূপ ধারণ করেছিল। করে যে কী ভুল করেছিল—ওহ।

যা ঘটল…! ঘরের দরজা বন্ধ করে ভীষণভৈরব ওরফে ভস্মলোচন ওরফে ভল্লধরবাবু বেঞ্চির ওপর দাঁড়ানো বেণুবদন-রূপ ধরা কলসি ভূতকে হুমম হুমম চোখ গুড়ুম করে বললেন ‘ইবার, ইবার যাবি কুথায়…’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে ‘ভল্ল’-টাইপ বেত চালিয়ে গেলেন বেধড়ক। কলসি ভূতকে বেদম পিটিয়ে দিতে দিতে বললেন ‘তুই আমার পরীক্ষার খাতায় বানান ভুল লিখিস অ্যাঁ… একটি দুটি নয় অ্যাত্তো অ্যাত্তো বানান ভুল, অ্যাঁ বানান ভুলের সুনামি …. যত বানান ভুল করেছিস তত ঘা বেত তোকে খেতেই হবে।…’

কলসি ভূত পিটুনি খেতে খেতে মিনমিন করে বলেছিল, ‘আঁমি বেঁণুবঁদন নঁই স্যাঁর….। আঁমাকে ছেঁড়ে দিঁন স্যাঁর…।’ এমন খিনখিন গলার স্বর তার ওপর চন্দ্রবিন্দু বসানো—যে ভীষ্মস্যারের কানে কথাগুলো ঠিক ঠাক প্রবেশ করেনি। ওইরকম মিহি কণ্ঠস্বরে সে বলে চলছিল ভূতের কক্ষনো বানান ভুল হয় না। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। আসলে বেণুবদন তো মানুষের ছানা। সে করেছে বানান ভুল। আর মার খেতে হচ্ছে তার মতো কলসি ভূতকে। ‘ভেঁউ ভেঁউ—ওই গঁদা নাঁকি ভঁল্ল দিয়ে-উঁরে বাঁপুরে-ভেঁউ ভেঁউ ভেঁউ …অঁত বেঁতপিঁটুনি খেঁলে স্যাঁর কঁলসি ভেঁঙে যাঁবে। ত্যাঁখন যেঁ মোঁর নাঁম ভাঁঙা কঁলসি ভূঁত হঁয়ে যাঁবেন স্যাঁর… সেঁ বঁড়ো বিঁচ্ছিরি নাঁম-ভেঁউ ভেঁউ ভেঁউ।’ কাঁদতে কাঁদতে কলসি-ভূত কথা দিল যে সে এবার থেকে বেণুবদনের মাথায় ভর করে বসবে। এবং দেখবে পরীক্ষার সময়—ওর বাংলা বানান কিছুতেই যেন ভুল না-হয়—ভুল করে ফেললে কলসি ভূত নিজে সংশোধন করে দেবে… ‘ভেঁউ… ভেঁউ… ভেঁউ। করতে করতে কলসি ভূত ওপরে তাকাল। দেখল ভেন্টিলেটারে ভৌতিক জ্যাম শেষ হয়ে গেছে। তাই সে তাড়াতাড়ি ভিমরুল রূপ ধারণ করে ভেন্টিলেটার দিয়ে ভোঁ করে বেরিয়ে গেল।

ওদিকে চোখ বুজে ভীষ্মবাবু বেত পেটানোর ঘোরে দেয়াল পেটাচ্ছেন। টেবিল পেটাচ্ছেন। হাইবেঞ্চি পেটাচ্ছেন। বন্ধ দরজা পেটাচ্ছেন। পরে খেয়াল হল—আরে কাকে পেটাচ্ছি।—কই—? বেণুবদনতো নেই। পালাল কোনদিক দিয়ে? দরজা জানালাতো বন্ধ।

বেণুবদন, স্যারের ঢুকবার কয়েক সেকেন্ড আগেই ভূতদের পানতুয়ার হাঁড়িটা বগলদাবা করে বেঞ্চির তলা গলিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চম্পট দিয়েছিল। ‘ভল্ল’ হাতে স্যার ততক্ষণে দরজার সামনে এসে পড়েছিলেন, দেখে বেণুবদন স্যারের পেছনে চলে গিয়ে ছুট লাগিয়ে দিল। আর স্যারও বেত লাগানোর ঘোরে কিচ্ছুটি খেয়াল না-করে ঘরে ঢুকেই বেঞ্চির ওপর দাঁড়ানো বেণুবদনকে (যে কিনা আসলে কলসি ভূত) দেখতে পেয়ে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর বেণুবদনরূপ ধরা কলসি ভূত যা পিটুনি খেল। ভেন্টিলেটার দিয়ে বেরিয়ে কলসি ভূত পিঠ বেঁকিয়ে কোমর বেঁকিয়ে আঁহ ওঁহ আওয়াজ করতে করতে তেঁতুলতলার বাসায় ফিরল। তারপর পিঠে কোমরে পায়ে হাতে বিচুটি পাতার তেলমালিশ করতে বসল। মালিশ করতে সাহায্য করল বেঁটেমোটা ঢাকি ভূত। হাতপাখা-পেতনি হাওয়া করতে বসে গেল। উঁহ ইহঁ করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল—সে যে বেণুবদনের স্যারকে কথা দিয়ে এসেছে।

ভূতেরা কথা দিলে কথা রাখে। নইলে ভূতের বাবা চরখিডিগবাজি শাস্তি দেন। চরখির মতো বনবন ঘুরপাক খাওয়া ডিগবাজি কমসে কম দশহাজার বার। কাজ নেই কলসি ভূত ভাবল। তার চেয়ে কথা রাখা ভালো। বেণুবদনের মাথায় ঢুকে, ওর মাথায় ভর করে পরীক্ষার সময় ওর বানান ভুল শুদ্ধ করে দিতে হবে—এ যে কথা দিয়ে ফেলেছে কলসি ভূত ভীষ্মভৈরব বাবুকে। এবারে কথা রাখার প্রথম ধাপ হচ্ছে কলসি ভূত বেণুবদনের মাথায় ঢুকবে। কী করে ঢুকবে?

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় বেণুবদনের…। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে দেখে একটা ইয়া লম্বা ছায়া, যার বুক নেই, গলা থেকেই শুরু হয়ে গেছে ইয়া গোল পেট—যেন একটা কলসি—তার ওপর এইটুকুন মাথা, বড়ো বড়ো কান, লালবাতি চোখ—দাঁতকিড়িমিড়ি হেসে বলল, ”বঁৎসো বেঁণুবদন, ভঁয় পেওনা ভঁয় পেওনা। আমি তোমায় মারব না। শুধু আমার হাতে এই ছেনি, আর ওই হাতে হাতুড়ি মেরে ছেনির ঘায়ে আমি তোমার মস্তক ফুটো করিব। সেই ফুটো দিয়া আমি তোমার মস্তকে প্রবেশ করিব। করিয়া তোমার বানান ভুল…।” সঙ্গে সঙ্গে বেণুবদনের কী জোরে গলাফাটানো চিৎকার—কলসি ভূতকে পুরো বলতে দিল না। তার আগেই প্রচণ্ড জোরে হাঁউমাঁউ চেঁচামেচি করে ধড়মড় করে উঠে বসল বেণুবদন। আর বাড়িশুদ্ধু লোক দাদু-বাবা-মা-দিদি-দাদা সব ছুটে এল।

‘কী হয়েছে…কী হয়েছে…!’

‘একটা ভূত। বলে কি মাথায় ছেনি বসিয়ে হাতুড়ি ঠুকে মাথা ফুটো করবে…অ্যাঁ-অ্যাঁ।’ কেঁদে ফেলল বেণুবদন।

‘কোথায় ভূত?’ সবাই সারা ঘর-দালান-বারান্দায় খুঁজে দেখল। বেণুবদনের দিদি বলল ‘যাহ-একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছিস…।’

বেণুবদনের মাথায় ঢোকা হল না। কিন্তু ঢুকতেই হবে যে। কথাতো রাখতে হবে কলসি ভূতকে। হাতুড়ি ছেনি ফেলে দিয়ে সফেদাগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে, সফেদা পেড়ে, তারপর সফেদার শাঁস খামচে খামচে ফেলে দিয়ে, তার বিচিগুলো কড়মড় করে চিবিয়ে ভাবতে লাগল। তার পাশে বসে বেঁটেমোটা ঢাকি ভূতও ওইরকম করে সফেদার বিচি চিবুচ্ছিল। সে বলল,’ ‘অ্যাক কাজ করো। বেণুটা নিশ্চয় ভূতের অত বড়ো বড়ো পানতুয়া খেয়েছে।’

‘তা খেয়েছে।’

‘তবে ওর মুখের হাঁ বড়ো হয়ে গেছে। যখন দেখবি হাঁ করে ঘুমোচ্ছে, তখন তুই তোর বডির সাইজটা পানতুয়ার মতন করে ফেলে ওর হাঁ-এর ভেতরে ঢুকবি।’

‘বেশ তো না-হয় ঢুকলাম। সোজা পেটের ভেতর চলে গেলাম…।’

‘খবরদার না। পেটে গেলে তোকে হজম করে ফেলবে। অত্তোগুলো পানতুয়া হজম করে ফেলল ছোঁড়াটা—তাও কিনা ভূতের পানতুয়া। তুই ওর গলা পর্যন্ত ঢুকবি, তারপর তোর বডিটাকে সেদ্ধ চাউমিনের মতো সরু লম্বা করে ফেলবি। ফেলে ওর শরীরের ভেতরে শিরা ধমনির লাইন ধরে মাথার ভেতরে ঢুকে পড়বি…।’

যাইহোক পরীক্ষা এলে বেণুবদন টের পেল মাথাটা কী ঝাঁ-ঝাঁ করছে। করুক পরীক্ষায় তো বসতেই হবে। পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে লিখতে ঘুম পাচ্ছিল। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে লিখতে হচ্ছিল। পরীক্ষা-শেষে বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ল। একেবারে ঘুমে বেহুঁশ। হাঁ করে নাক ডাকা শুরু করে দিল। হাঁ-থেকে একটু পরে বেরিয়ে এল গোল পানতুয়ার মতন কলসি ভূত। হাঁ কথা রাখা হয়ে গেছে।

হ্যাঁ সত্যি সত্যি কথা রেখেছে কলসি ভূত। পরীক্ষার খাতায় বেণুবদনের একটা বানানও ভুল হতে দেয়নি। প্রত্যেকটা বানান শুদ্ধ। যেখানে ‘স’ বসাবার কথা সেখানে ‘শ’ বা ‘ষ’ বসানো হয়নি। ‘স’ ই বসানো হয়েছে। ‘ণ’ লিখবার কথা যে শব্দে সেখানে ‘ণ’ লেখা হয়েছে ‘ন’ নয়। কিন্তু তবু ভস্মলোচন স্যার খাতা দেখবার সময় কিন্তু-কিন্তু করে উঠলেন। সবগুলো বানানেই শব্দের মাথায় চন্দ্রবিন্দু বসানো। এ যে ভূতের ভাষায় বিশুদ্ধ বানান—চন্দ্রবিন্দু লাগানো। এ্যহ্ এ যে প্রত্যেকটা শব্দে চন্দ্রবিন্দু। বসিয়ে দেবেন নাকি জিরো’?

নাহ। ‘জিরো’ বসাতে পারলেন না ভস্মলোচন ওরফে ভীষ্মভৈরববাবু—কারণ পুরো লেখা খাতায় যতটা শব্দ আছে তার মধ্যে কিছু শব্দের বানানতো উচ্চারণে ভূতের আর মানুষের একই—যেমন ইঁদুর, চাঁদ, কাঁধ, ঝাঁপ, পঁচিশ, দাঁত… এমন করে গোটা ছাব্বিশ শব্দ পাওয়া গেল বেণুবদনের খাতায়—যেগুলো ভূতে যা লেখে মানুষেও তাই লেখে। অগত্যা বেণুবদনকে নম্বর দিতেই হবে—দিয়ে দিলেন ভীষ্মভৈরববাবু ছাব্বিশ নম্বর দরাজ হাতে।

আহা কী আনন্দ বেণুবদনের…।

আর কী আনন্দ ভূত-পেতনি শাঁকচুন্নির—কলসি ভূত কথা রেখে দারুন ‘ছাঁকছেঁচফুল। সব ভূত-পেতনিরা আনন্দে ডগমগ হয়ে ইস্কুলের ছাদে নাচতে শুরু করে দিয়েছে…. হৈঁ হৈঁ হঁল্লা হঁল্লা রৈঁ রৈঁ রৈঁরাঁ-রা রাঁ-রা’ নাচের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে নীচে দড়াম করে পড়ে গেল কলসি ভূত—চুঁক চুঁক চুঁক। পড়ে গিয়ে না মাথা ফাটেনি কোমরও ভাঙেনি (ভূতদের ওসব ভাঙেটাঙে না), শুধু কলসি ভূতের কলসি ভেঙে গেল—এঁ হেঁ হেঁ। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ভাঙা কলসি ভূত। নামটাও যে হয়ে গেল ‘ভাঙা কলসি ভূত’—ইঁস্সস…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *