ভুলোর ছলনা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
ভুলো কে জানো? ভুলো মানুষ নয়। ভুলো কুকুরও নয়। ভুলো মানে ভ্রান্তি—যা ভোলায়; মিথ্যে ভুলে ভোলায়। আমাদের দেশে বলে—ভুলো হল একরকম ভূত। ব্ৰহ্মদৈত্য, মামদো, শাঁখচুন্নী, গোদানা, গলায়-দড়ের মত এও এক রকমের ভূত! নিশির নাম অনেকে জানে—ভুলো অনেকটা নিশির মত। কিন্তু নিশি ডাকে ভোরবেলা কি মাঝরাত্রে, ভুলোর খেলা সব সময়েই। তবে ঠিক সন্ধ্যার পর থেকে একটু অন্ধকার হলে ভুলোর খেলা জমে ভাল। নিশি, ভূত বা প্রেতিনীর সঙ্গে মিল এর অনেকটা। তফাত—নিশি ডাকে ঘুমের মধ্যে আর ভুলোর খেলা জাগ্রত মানুষের সঙ্গে।
হয়তো কেউ সন্ধেবেলা যাচ্ছে মাঠের মধ্যে দিয়ে রাস্তা ধরে, ভাবছে কোন বন্ধুর কথা কি আপন জনের কথা, হঠাৎ একসময় সে বন্ধু তার সামনে এসে দাঁড়াল, বলল—এই যে রে!
সে বললে—তুই? আরে তোর কথাই ভাবছিলাম যে!
—হ্যাঁ রে, তাই তো এলাম। এখন আয়, আমার সঙ্গে আয়।
মানুষটার মনেও হবে না যে বন্ধু হঠাৎ কোত্থেকে এল। হয়তো তখন আসল বন্ধু দশ বিশ মাইল কি একশো মাইল দূরে রয়েছে, সে কথা লোকটি জানে, তবুও তার মনে সেই প্রশ্নই জাগবে না। ভুলোর মায়া। সে বিগলিত হয়ে যাবে তাকে দেখে; এবং মুহূর্তে মন্ত্রমুগ্ধের মত তার পিছনে পিছনে চলবে। ভুলো চলবে পথ ছেড়ে অপথে বিপথে, খানাখন্দ কাঁটা খোঁচা ভরা জায়গার উপর দিয়ে, মায়ায় ভোলা মানুষটার মনে সে কথা উঠবে না, জিজ্ঞাসাও করবে না যে এদিক দিয়ে কোথায় চলছিস ভাই। মনে তখন ঘোর লেগেছে তার, সে চলবে মুখ বন্ধ করে।
তারপর? তারপর মানুষটার দেহ হয়তো পাওয়া যাবে কোন খানাখন্দের মধ্যে; নয়তো কোন নদীর দহে। নয়তো কোন উঁচু জায়গার নিচে একটা পাথরে মাথা ছেঁচে পড়ে থাকবে।
লোকটা ভুলো-ভূতের সঙ্গী হয়ে গেল এরপর থেকে।
তার বাসা হল যে জায়গায় সে মরেছে সেই জায়গায় আর ভুলো ফিরে গেল আপন জায়গায়। রাত্রে দুজনে মাঠের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে লাগল আর কাকে সঙ্গী করা যায়। আর না হয় তো রাত্রে মাঠের মধ্যে নাচতে গাইতে লাগল—
হায় কি মজা হায় রে—
ভুলের খেলা মজার খেলা খেলবি যদি আয় রে।
ফুস মন্তর ভুল ভুলিয়া—যাবি রে সব দুখ ভুলিয়া—
এমনি ধরনের গান। গানটা অবশ্য আমি আন্দাজ করে লিখলাম। কারণ কী গান যে তারা গায় সে আমি কানে তো শুনি নি। তবে হ্যাঁ, ভুলো-ভূতে লোককে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এ আমি দেখেছি। আরে বাপ্, সে কী কাণ্ড! ভুলোয় ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—একশো লোক ভুলোলাগা লোকটাকে ধরবার জন্যে ছুটেছে; কিন্তু তাকে কিছুতে ধরতে পারছে না। ভুলো দেখছে লোকে দেখেছে তার কাণ্ড, ছুটে আসছে ওকে ধরে জোর করে আটকাবার জন্যে, লোকটা সোজা ছুটলে ধরে ফেলবে, সুতরাং ভুলো-ভূত তখন এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল—সোজা চলছে, হঠাৎ ডাইনে বেঁকল, তারপর আবার বাঁয়ে, তারপর আবার বাঁয়ে—তারপর বাঁয়ে, কখনও বা একেবারে উলটো মুখে; আর তার পিছনে ভুলোলাগা মানুষটা ঠিক সেই পথে তেমনি করে এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল। ফলে যারা পিছন থেকে ধরতে আসছে তারা কিছুতেই তাকে ধরতে পারছে না। অবশেষে ভুলো-ভূত একটা গাছে মিলিয়ে গেল—কি সামনে নদী পড়ল তো তার মধ্যে ডুবল। পিছনের ভুলোলাগা লোকটাও গাছে ধাক্কা খেয়ে মরল, নয়তো নদীতেই ভুলোর সঙ্গে ডুবল।
কখনও কখনও লোকে ধরে ফেলে, কিন্তু তাতেও বিপদ, লোকটা তখন সব ভুলে গেছে। মা বাপ-স্ত্রী সব। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এ আমি চোখে দেখেছি। ভুলোলাগা লোকটাকে বহুকষ্টে ধরেছি। তারই কথা বলছি তোমাদের।
একেবারে হুবহু সত্য, আগাগোড়া। বানানো নয়। সেইজন্যে এ কাহিনীর মধ্যে যে ‘আমি’ বলে লিখছে সে আমিই—তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাড়ি লাভপুর।
ঘটনাটা অনেক দিনের। বলি শোন।
ইংরেজী ১৯২৯ সাল। আমি তখন লাভপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। সেকালে ইউনিয়ন বোর্ড ছিল; এখন উঠে গিয়ে পঞ্চায়েত হয়েছে।
পাঁচ-সাত কি ন’দশ খানা গ্রাম নিয়ে ইউনিয়ন বোর্ড। লোকের উপর ট্যাক্স করে, সেই ট্যাক্স আদায় করে চৌকিদারদের মাইনে দেয় আর যা বাড়তি থাকে তা থেকে করে কিছু গ্রাম্য রাস্তা-ঘাট, কিছু পানীয় জলের জন্যে কুয়ো। আর দেশে তখন প্রচণ্ড ম্যালেরিয়া—তার জন্যে সরকারের কাছ থেকে পাওনা সিনকোনা ট্যাবলেট বিতরণ করে। ডোবায় কেরোসিন দেয় মশার ডিম মারবার জন্যে।
তখন আমি সাহিত্যিক নই। তখন দেশের কাজ করি, কংগ্রেস করি, বাসনা দেশের সেবা করব। দেশ স্বাধীন করব। তার সুবিধের জন্য ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়েছি। কিছু কাজ তো করা যায় এ থেকে! আমার বয়স তখন একত্রিশ বছর। রাস্তাঘাট করাই; তার সঙ্গে এই ম্যালেরিয়া নিবারণের কাজটা নিয়েছি। মশা মারতে হবে। অ্যানোফিলিস মশা দূর হলেই ম্যালেরিয়া যাবে। কারণ মাছি যেমন কলেরার বীজ ছড়িয়ে বেড়ায় তেমনি অ্যানোফিলিস-ই ম্যালেরিয়ার বিষ ঢুকিয়ে দেয় মানুষের দেহের রক্তে।
সে সময় গুরুসদয় দত্ত ছিলেন জেলার ম্যাজিস্ট্রেট। মশা মারবার জন্যে তিনি একটা নতুন সহজ পন্থা আবিষ্কার করেছেন তখন।
আগে জঙ্গল সাফ করে, ডোবায় কেরোসিন দিয়ে মশা মারবার উপায় আমাদের জানা ছিল। কিন্তু সে প্রায় কামান দেগে মশা মারার মত ব্যাপার। গ্রাম অঞ্চলে কত জঙ্গল পরিষ্কার করবে। কত খানা ডোবায় কেরোসিন দেবে। সে খরচের টাকা কোথায়?
দত্ত সাহেব পথ বের করেছেন—সহজ পথ, কামান না, বন্দুক না, লাঠি না। মশাও তোমাকে মারতে হবে না; তুমি টোপা ‘ডুঁরুলি বা পানা নির্মুল করে ফেল, তাহলে অ্যানোসিলিস ঝাঁকবন্দী থাকলেও ওদের কামড়ে ম্যালেরিয়া হবে না। ওই টোপা পানার রস খেয়েই অ্যানোফিলিস মশার ভিতর ম্যালেরিয়া জন্মায়, তখন সে কামড়ালে ম্যালেরিয়া হয়।
ধর, মাতালের উপদ্রব হয়েছে! মাতালেরা দাঙ্গা করছে। নিত্য চেঁচামেচি করছে, গালাগাল করছে মাতাল অনেক। সুতরাং মাতাল তুমি কত ধরবে কত বাঁধবে? তার থেকে তুমি যদি মদের দোকানই তুলে দাও, তবে মাতাল আর কেউ হবে না। লোকগুলো তো আর মদ না খেলে মাতলামি করতে পারবে না।
মদের দোকান তোলা যায় না। কিন্তু মশার বিষ শেষ করতে টোপা ডুঁরুলি বা পানা নিশ্চয় শেষ করা যায়। খরচও এতে অনেক কম। সুতরাং ইউনিয়ন বোর্ডে বোর্ডে হুকুম এল—টোপাপানা বা ডুঁরুলি তুলে ফেল।
দত্ত সাহেব নিজে উৎসাহী হয়ে দলবল জুটিয়ে পুকুরের ডোবায় নেমে টোপাপানা পরিষ্কার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কাজ শুরু করেছিলেন। টোপাপানা তুলে তার চারপাশে খড়কুটো দিয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতেন। তার চারপাশে তাঁর দলের লোকেরা ঘুরত এবং গান করত—
মশার মাসী, সর্বনাশী; আয় দোব তোর গলায় ফাঁসি—
ছিঁড়ব রে তোর ঘেরাটোপ—পোড়াব তোর দাঁড়ি গোঁফ।
আরও বড় গান। সব ঠিক মনে নেই। যাই হোক, টোপাপানা মশাদের দাঁড়িগোঁফওয়ালা মাসী—সেই সর্বনাশী মাসীকে নির্মূলের ব্যবস্থা করা ছিল তখন ইউনিয়ন বোর্ডের কাজ।
প্রথম একদফা অনেক লোক লাগিয়ে গ্রামের যে সব পুকুরে টোপাপানা ছিল—তা সব তুলে দিয়ে পুড়িয়ে ব্যবস্থা করা হল যে নিয়মিত ভাবে দুজন করে লোক কাজ করবে প্রতি গ্রামে যাদের কাজ হবে পুকুরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা আর একটা দুটো যেমন দেখা যাবে অমনি তুলে ফেলা।
লাভপুরের এই কাজের জন্যে দুজন বাউড়ী জোয়ানকে রাখা হয়েছিল। নিতাই এবং পাঁড়ে। নিতাইয়ের নাম তোমাদের শোনা নাম কিন্তু পাঁড়ের নাম ‘পাঁড়ে’ অর্থাৎ পাণ্ডে কেন তার অর্থ বলব কি আমিও ঠিক জানি না। পাঁড়ে বাউড়ী। অর্থাৎ দস্তুর মত নাম। পাঁড়ে আজ বেঁচে নেই কিন্তু নিতো আজো আছে। বুড়ো হয়েছে। এরা দুজনে ছিল বন্ধু। খুব কড়া খাটুনি তারা খাটতে নারাজ ছিল; চাষ করত না, কারুর ঘরে ‘মান্দেরি’ও করত না। হালকা কাজ খুঁজে বেড়াত। এবং তার জন্যে মজুরি তারা কম হলেও আপত্তি করত না। এই গ্রাম ঘুরে এখানে ওখানে ডুঁরুলি বা টোপাখানা খুঁজে তুলে ফেলার কাজটা তারা খুশি হয়ে নিয়েছিল। সকালে উঠে—তামাক টামাক খেয়ে দুজনে বের হত; বিড়ি টানত এবং ডুঁরুলি দেখলে তুলে ফেলে গাছতলায় জিরিয়ে নিত, গান গাইত। খাবার বেলা অথাৎ বারোটা বাজতে বাজতে চক্কর দেওয়া শেষ করে দেখাবার জন্যে কিছু ডুঁরুলি গামছায় বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরত। জল খেয়ে বটতলার ছায়ায় ঘুম এবং আড্ডা। বিকেলে চারটের পর স্নান করে টেড়ি কেটে কিছু মদ খেয়ে আসত ইউনিয়ন বোর্ড আপিসে। ডুঁরুলিগুলো দেখিয়ে ফেলে দিত গর্তে, মাটি চাপা দিত—তারপর ইউনিয়ন বোর্ডের খাতায় বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে প্রত্যেকে ছ-আনা পয়সা ট্যাঁকে গুঁজে মদের দোকানে গিয়ে আনা দুই-তিনের পচাই মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরত। আমি তখন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে থাকতাম। পয়সাকড়ি দিয়ে সকলকে বিদায় করে আমিও ফিরতাম বাড়ি। বন্ধুরা বসে আছেন তখন আসর জমিয়ে, তাস খেলছেন।
এরই মধ্যে একদিন—১৯২৯ সালের শ্রাবণ মাসের শেষ। তার আগে একটা কথা বলার দরকার। সেটা এই যে, বাঙলা দেশে ১৯২৯ সালে খুব ভাল বর্ষা হয়েছিল; শ্রাবণের তৃতীয় সপ্তাহ আসতে আসতে শেষ হয়ে গেছে। মাঠ সবুজ ধানে ভরে উঠেছে। আষাঢ়ে পোঁতা জমিতে ধান বেশ বড় হয়েছে; তা প্রায় উঁচুতে হাঁটুর সমান এবং ঝড়ে-গোছেও বেশ মোটা হয়েছে। পুকুর ডোবা নালা নদী জলে টইটুম্বুর। আমাদের গ্রামের গায়ে দক্ষিণে পূর্বে-পশ্চিমে লম্বা রেললাইন, তার দক্ষিণে মাইলখানেক বিস্তৃত ধানের ক্ষেতের ওপারে কুয়ে নদী। কুয়ে তখন ভরাভর্তি।
সেদিন বিকেলে সাড়ে চারটের সময় বোর্ডে গেলাম। দেখলাম নিতো বা নিতাই এসে বসে আছে—পাঁড়ে আসেনি। নিতোকে বলেছে—তু চল এগিয়ে, আমি যাচ্ছি! তু কিন্তুক আগে ভাগে নিয়ে যেন চলে আসিস না। দুজনে পয়সা নিয়ে মদের দোকানে ফিরব।
সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা, পাঁচটা থেকে ছটা পর্যন্ত আমরা অর্থাৎ সেক্রেটারি এবং আমি বোর্ডের কাজকর্ম সারলাম—অপেক্ষা কেবল পাঁড়ের, সে এলে নিতোর এবং তার টিপ নিয়ে পয়সা দিয়ে বাড়ি ফিরব।
ছ-টার সময় বললাম—কই রে, পাঁড়ে এল কই!
নিতো মদ খানিকটা খেয়েছিল—তার ঝেঁকে এবং চুপচাপ বসে থাকায় ঝিমুনিতে সে মধ্যে মধ্যে ঢুলছিল। আমার কথায় সজাগ হয়ে উঠে চোখ কচলে বললে—তাই তো মশায়, কই এল। সে নিশ্চয় আসবে বলেছে।
খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল সে। —তাই তো!
কিন্তু আমরা বসে থাকি কত? সন্ধে হয়ে আসছে। সেক্রেটারি বাড়ি যাবার জন্যে উসখুস করছে, আমার মনও টানছে তাসের আড্ডায়। তবুও আরও মিনিট দশেক বসে থেকে বললাম—তাহলে টিপ ছাপ দিয়ে তোর পয়সা নিয়ে যা। পাঁড়ের পয়সা বাকি রইল, কাল নেবে।
তাই নিয়েই সে যেন চিন্তিত মনে উঠে গেল। বিড়বিড় করতে করতে গেল—শালার কাজ দেখ দিকি। শালা বদমাশ কোথাকার!
কথাটা আমার কানে এল। আমরা বোর্ড থেকে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম নিতো পশ্চিম মুখে চলেছে। যাবার কথা তার পুব মুখে। বুঝলাম, পশ্চিম মুখে একটু এগিয়ে গিয়ে সে রেললাইন ধরবে। পুব মুখে ফিরে সোজা এসে উঠবে তাদের পাড়ায়। তাদের পাড়াটা আমার বাড়ির দক্ষিণ-পূর্বে, একেবারে লাগাও। স্টেশনের গায়ে।
বাড়ি ফিরলাম—তখন অন্ধকার হয়েছে। আমার বৈঠকখানায় তখন আলো জেলে তাসুড়ে বন্ধুরা বসে গেছেন। আমিও পাশে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই থ্রি হার্টস, থ্রি নো-ট্রামসের ডাকের নেশা জমে উঠল।
হঠাৎ নেশাটা যেন একটা ঠোক্কর খেয়ে ভেঙে গেল। ঠিক দক্ষিণ দিকে একটা গোলমাল উঠল।
—গোলমাল? কিসের গোলমাল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে আগুনের ভয় থাকে কিন্তু এটা বর্ষাকাল এবং সেবারকার মত ভরাভর্তি জমজমাট বর্ষাকাল। আগুন লাগার তো কথা নয়। কান বাজিয়ে শুনলাম।
বহু লোকের একটা আক্ষেপ এবং শঙ্কাপূর্ণ একটা ‘গেল রে—গেল রে’ শব্দ!
ঠাওর করতে পারল না—কী গেল! গেল বা যাচ্ছে—যেন টেনে ছিঁড়ে কিছু চলে যাচ্ছে বা কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!
কোলাহলটা নিকটে—ওই রেললাইনের ধারে। আমার বৈঠকখানা থেকে ধীরে সুস্থে পাঁচ-ছ মিনিটের পথ। দৌড়ে গেলে তিন-চার মিনিট লাগে।
আমরা কেউ বসে থাকতে পারলাম না ওই গেল গেল শব্দ শুনে। সকলে ছুটেই বেরিয়ে এলাম। এবং মিনিট দুয়ের মধ্যে গ্রামপ্রান্তে এসে নজরে পড়ল রেললাইনের উপরে অনেক লোক। তারা দাঁড়িয়ে ওই ‘গেল রে—গেল রে’ বলে একরকম হাহাকারই করছে। লাইনের ওপারে মাঠে দেখলাম গোটা দুই লণ্ঠনের আলো যেন ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। একবার এদিক একবার ওদিক, কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে! আলেয়ার মত।
লাইনে এসে উঠে দেখলাম বাউড়ীপাড়ার মেয়েপুরুষেরা সারিবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে ওই হায় হায় করছে। কতকগুলি পুরুষ চেঁচাচ্ছে—গেল রে। গেল রে। ওই রে!—কতকগুলি ভদ্রলোকও তখন এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা বলছেন—ওই! ওই! না?
—কী হয়েছে?—জিজ্ঞাসা করলাম সামনে যাকে পেলাম।
সে আমাকে চিনে কেঁদে উঠে বললে—ও গো বাবু গো, নিতোকে ভুলোতে নিয়ে গেল গো। নিতোকে ভুলোতে নিয়ে গেল।
ভুলোতে নিয়ে গেল—কথাটা চট করে বুঝিনি। বললাম, নিতকে ভুলোয় নিয়ে গেল কি?
সে বললে—হ্যাঁ বাবু, ওই দেখ মাঠে মাঠে ছুটছে গো, আর চেঁচাচ্ছে—দাঁড়া রে দাঁড়া রে—পাঁড়ে রে দাঁড়া রে।
বিরক্ত হয়ে বললাম—মানে কী?
—ও গো ভুলো ভূত, পাঁড়ে সেজে এসে ওই দেখ মাঠে মাঠে ওকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে, কেউ ধরতে পারছে না। নিয়ে গিয়ে নদীতে ডুবিয়ে মারবে গো; ছামুতে নদী দুকুল পাথার আঃ আঃ ভরা জোয়ান গো—আঃ আঃ।
—পাঁড়ে কোথায়?
—সি ওই দেখ, ওইখানে রইচে গো। ভয়ে ডরে সিও কাঁপছে। নিতো মলে সে যে ওকে লেবে গো!
অর্ধেক বুঝলাম, অর্ধেক বুঝলাম না! তবু মাঠে নেমে পড়লাম। আমার সঙ্গে জন দুই সঙ্গী সামনে ওই বিস্তীর্ণ এক মাইল স্কোয়ার জলে টইটুম্বুর ধানভরা ক্ষেতের মধ্যে। প্রায় দুশো গজ দূরে তখন আলোগুলো ইতস্তত ছুটোছুটি করছে—এদিক ওদিক সেদিক কখনও সোজা কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে। জল ও ধান-ভরতি জমির আলের উপর দিয়ে আলো হাতে যেতে গেলে এমনিই হবে। আর এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে অন্ধকার-অভ্যস্ত চোখে দেখলাম—কালো কালো মানুষ অন্তত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন, কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকারে প্রেতযোনির মত ছুটোছুটি করছে। এবং তার খানিকটা আগে চিৎকার হচ্ছে, তারস্বরে আর্তকণ্ঠে ব্যাকুল হয়ে কেউ প্রাণ ফাটিয়ে ডাকছে—দাঁ-ড়া-রে, দাঁ-ড়া-রে—পাঁ-ড়ে-রে, দাঁড়া রে, ও রে দাঁড়া রে!
কণ্ঠস্বর নিতোর তা চিনতাম। কিন্তু কাকে বলছে? পাঁড়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে কাঁপছে ভয়ে। কিন্তু নিতো যাকে ডাকছে সে যে তার সামনে—তাতে তো সন্দেহ নেই। সে যেন নিতোর চেয়েও জোরে ছুটে চলেছে সামনে এঁকে-বেঁকে—কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে কখনও সোজা। যেন সে হাওয়ায় উড়ছে। নিতো দুই হাত বাড়িয়ে তাকে ধরবার জন্যে ছুটছে—ছুটছে। যেন সে হারিয়ে যাবে, যেন সে পালিয়ে যাবে। নিতো আর তার কখনও নাগাল পাবে না।
পিছনের লোকেরা বহু জনে একসঙ্গে ডাকছে, নিতো! নিতো থাম—থাম! কিন্তু নিতো বধির হয়ে গেছে। সে শুনতে পাচ্ছে না। তার ভ্রূক্ষেপ নেই, সে যেন সমস্ত পিছনটা চিরদিনের মত ফেলে চলে যাচ্ছে।
কে যেন টর্চ ফেললে। টর্চের আলোটা নিতোর চিৎকার লক্ষ্য করে ছুটে গিয়ে পড়ল, দেখলাম—দু-হাত বাড়িয়ে নিতো ছুটছে; আশ্চর্য সে হাত বাড়ানো। এবং আশ্চর্য সে তার ছোটা। ঊর্ধ্বশ্বাসেই শুধু নয়, দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্যের মত ছুটছে। জল এবং ধান-ভরা মাঠ ভেঙে ছুটছে। কখনও বাঁয়ে কখনও ডাইনে কখনও সোজা। কখনও কখনও পড়ছে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠে আবার সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে। একবার দাঁড়ায় না। আরও আশ্চর্য এই যে, পিছনের অনুসরণকারীরা যখন কাছে এসে পড়ছে তখন হঠাৎ আরেক দিকে বেঁকে সে ছুটে যাচ্ছে মাঠের মধ্যে দিয়ে জল ভেঙে কাদা ভেঙে। অনুসরণকারীরাও প্রাণপণে ছুটছে—কিন্তু জলে ধানের মধ্যে নামতে পারছে না তারা। তারা আইলে আইলে ছুটছে। ঘূর হচ্ছে। ততক্ষণে নিতো আরও এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনের আলোর ছটার প্রতিও তার দৃষ্টি ফিরছে না। মানুষটা যেন উন্মাদ, মানুষটা যেন দানবের মত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে প্রাণের ব্যাকুলতায় ব্যর্থতায় ব্যগ্রতায়।
—পাঁ-ড়ে-রে—পাঁ-ড়ে-রে—দাঁ-ড়া রে—দাঁড়া রে!
চলছে কিন্তু ঠিক পূব-দক্ষিণ মুখে। নদীর দহের দিকে। রেললাইন সোজা পূর্বমুখে এসে একটা বাঁকে দক্ষিণমুখে মোড় নিয়ে নদীর উপর ব্রিজ বেঁধে পার হয়ে চলে গেছে। তার পাশেই প্রকাণ্ড দহ—সেই মুখে চলেছে।
মুহূর্তে মুহূর্তে দূরে চলে যাচ্ছে—নিতোর সামনে ভুলো পাঁড়ের চেহারা ধরে হাওয়ায় ভর দিয়ে ডেকে নিয়ে চলেছে। আয়—আয়—আয়।
আমরা কেউ দেখতে পাই বা না পাই, নিতো তাকে দেখছে। ওই চলছে নিতো—ওই—ওই!
আলোগুলো কাছে গেল। এইবার ওকে ধরবে।
কিন্তু মুহূর্তে নিতোর কণ্ঠ উলটোমুখী হয়ে ছুটে চলল—। যাঃ—আলো অনেক পিছনে পড়ে গেল দেখতে দেখতে। নিতো ছুটেছে পুলের দিকে। পুলের ওপাশে দহ। আর পুলের মুখটা বড় বড় পাথর দিয়ে ঢেকে তারের জাল দিয়ে বেঁধে অন্তত দোতলা বাড়ির সমান উঁচু এবং লাইনের মুখটা লোহার স্পাইক দিয়ে মানুষ জন্তু জানোয়ারের পক্ষে অনধিগম্য করে রেখেছে। যেন কেউ লাইন ধরে ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার না হতে পারে।
দহে পড়লেও মরবে নিতো ডুবে। পুলে উঠলে হয় জালে পা বেঁধে পাথরে আছাড় খেয়ে পড়ে মরবে। নয় উপরে উঠে ওই স্পাইকে গেঁথে যাবে।
নিয়ে গেল নিয়ে গেল—ভুলো তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
তখন আমি রেললাইনের দক্ষিণে প্রায় সিকি মাইল মাঠ ভেঙে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এবং নিতো তখন আরও সিকি মাইলের বেশি দক্ষিণে নদীর দিকে ক্রমশ ঢালু এবং জলা ধানভরা ক্ষেতের মধ্যে উন্মাদের মত ছুটোছুটি করে মিনিটে মিনিটে আরও দক্ষিণে নদীর কিনারার দিকে চলেছে।
শুনতে পাচ্ছি,—দাঁড়া রে—দাঁড়া রে—দাঁড়া রে।
ক্রমশ কণ্ঠস্বর দূরবর্তী হচ্ছে। এরপর নদীগর্ভে, নয়তো ওই ব্রিজের মুখে দোতলা সমান উঁচু বাঁধে উঠে আছড়ে পড়বে। ওই ভুলো—সে তাকে নৃশংসভাবে ডুবিয়ে অথবা পাথরে আছড়ে মেরে নিঃশব্দে হাসবে!
মনে পড়ছিল এখানকার গল্প। চলিত গল্প এই যে, বহুকাল পূর্বে এই মাঠে একজন পাষণ্ড বন্ধুর ছদ্মবেশে একজনকে ভুলিয়ে নিয়ে এসে মাঠের মধ্যে হত্যা করেছিল। তখন থেকে সেই খুন হওয়া মানুষটি এখানে ভুলো-ভূত হয়ে আছে। সুযোগ পেলেই আত্মীয় বা বন্ধুর বেশ ধরে অন্যমনস্ক মানুষকে এমনি ভাবে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। মনে পড়ল আমাদের গ্রামের সুধীরবাবুকে ঠিক এমনি সন্ধেবেলা তাঁর দাদা সেজে এসে ডেকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অন্য মানুষের চোখে পড়েছিল—তাই রক্ষা পেয়েছিলেন; তারা তাঁকে ধরে ফেলেছিল। তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর অবশ্য জ্ঞান হয়ে সুস্থ মানুষ হয়েছিলেন। কিন্তু কেউ না দেখলে হয়তো তাঁরও বিপদ ঘটত।
আরও অনেক ঘটনা। ঠিক ওই রেললাইনে একটা মাইলপোস্ট যেখানে পোঁতা আছে ওইখানেই নাকি এই ভুলোর আত্মা ঘুরে বেড়ায়। ওইখানেই নাকি তাকে মেরেছিল বিশ্বাসঘাতকতা করে।
ভাবছি—এমন সময় একজনকে পেলাম। সে শশী ডোম। আমাদের ওখানকার বিখ্যাত চোর। লম্বা ছিপছিপে মানুষ। শশী চুরির জন্যে জেল খেটেছে অনেকবার কিন্তু কেউ কখনও তাকে ধরতে পারেনি। তিন হাত সামনে থেকে ছুটলে মিনিটে তিন হাত ব্যবধান সাত হাত হয়ে যায় এবং পাঁচ মিনিটে সেটা বেড়ে পঁচিশ হাত এবং তারপরই সে মিলিয়ে যায়। এমন তার গতিবেগ। এমন সে দৌড়তে পারে।
ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটা রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে চলে গেছে এবং নদীর ব্রিজের ঠিক মুখটায় একটা অন্যটাকে কেটে চলে গেছে। মনে হল, শশী যদি সেই দৌড় দৌড়ে যায় তাহলে নিতোর আগেই হয়তো ব্রিজের মুখটা আগলাতে পারে। নিতোকে যদি ভুলো নদীতে নিয়ে গিয়ে ফেলে তবে হাত নেই, কিন্তু যদি ব্রিজের বাঁধে তুলে পাথরে আছড়াতে চায় তবে হয়তো শশী তাকে রক্ষা করতে পারেবে। নিতোকে ধরে ফেলতে পারবে।
শশীকে বললাম—শশী একবার চেষ্টা করতে পারিস। তুই একবার সেই দৌড় দে না বাবা। গিয়ে দাঁড়া ব্রিজের উপর।
শশী বললে—যদি নদীতে যায়—
বললাম—তা হলে হাত নেই। তবু দেখ!
শশী ছুটল এবং শ্রাবণ মাসের মেছাচ্ছন্ন কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির মধ্যে মিনিট দু-তিনের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ছুটবার সময় শশীর হাঁটুতে মটমট শব্দ হত। সে শব্দটাও শুনতে পেলাম না।
পিছন পিছন আমি এবং আরও দু-তিন জন ছুটলাম। তখন আমার ফুটবল খেলা অভ্যেস ছিল। দৌড়তে আমিও পারতাম। বয়সও তখন তিরিশ-একত্রিশ।
ওদিকে মাঠের মধ্যে শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রিতে জলো মাঠের মধ্যে কয়েকটা আলো ছুটোছুটি করছে, দিশাহারার মত ছুটছে, কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে কখনও সোজা; আর তার সামনে এক বুক ফাটানো ডাক—দাঁড়া রে! দাঁড়া রে! দাঁড়া রে! পাঁড়ে রে!
সম্মুখে তার ছুটেছে পাঁড়ের ছদ্মবেশী প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেত ভুলো-ভূত। তাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না, দেখছে শুধু ওই ভুলোর ছলনায় মোহগ্রস্ত নিতো। দু-হাত বাড়িয়ে সে ছুটছে—তাকে ধরবে, তাকে ধরবে! ‘পাঁড়ে ভাই!’ তার কাছে স্থান বিলুপ্ত কাল বিলুপ্ত সব বিলুপ্ত। এতগুলো আলো সে দেখতে পাচ্ছে না। এত ডাক সে শুনতে পাচ্ছে না। পায়ের তলায় কাঁটা বিঁধছে, সে বুঝতে পারছে না। ভুলো ছলনায় তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। সে হাঁফাচ্ছে, হৃৎপিণ্ড ফেটে পড়তে চাইছে, স্থির চোখদুটো হয়তো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে—তবু তার থামবার উপায় নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে তার বন্ধুকে ধরবার ব্যগ্রতা উদ্দাম থেকে উদ্দামতর হয়ে উঠছে। পরম বন্ধুর ছদ্মবেশী প্রেত নিঃশব্দ হাসি হেসে বলছে—আয় আয় আয়! ওই নদীতে পাথারে ঝাঁপ খাব দুজনে। কিংবা আয় না ওই পুলের বাঁধের উপর দুজনে জাপটাজাপটি করে পড়ব পাথরের উপর। তারপর দুজনে বসে—হি—হি কত মজা করব।
ছুটছিলাম আর ভাবছিলাম। পাকা রাস্তাটা রেললাইনের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম দিকে বেঁকল—পুব মুখ থেকে দক্ষিণ মুখে, সামনে ‘দেড় শ’ গজ দূরে লাইন আর রাস্তা একসঙ্গে মিশেছে। এরপর রাস্তাটা চলে গেছে রেললাইন ক্রস করে পূব দিকে। যদি ওইখানে—শশী গিয়ে—
ভাবনাটা সম্পূর্ণ হল না। অন্ধকার চিরে শশীর ডাক শুনলাম, —ধ-রে-ছি।
ধরেছে! শশী ধরেছে! আঃ! —আমরা আরও জোরে ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম মানুষের কাছে ভুলো হয় হেরেছে নয় নিতোকে নিয়ে খানিকটা নিষ্ঠুর আমোদ করে বা এতগুলা মানুষের ব্যগ্রতা দেখে নদীতে না ডুবিয়ে ওই পুলের বাঁধের উপর তুলে শশীর হাতে তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।
আমরা যেতে যেতে যে আলোগুলো নিতোর পিছনে এতক্ষণ ব্যর্থ ছোটাছুটি করেছে তারা এসে গেল। স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়াল।
আমরা পৌঁছে দেখলাম, শশী নিতোকে ধরেছে। দশ বারোটা আলো চারদিকে তাকে ঘিরে রয়েছে। সর্বাঙ্গ জল কাদায় ভরা, তার সঙ্গে রক্তের চিহ্ন—নিতো বসে আছে পাথরের মূর্তির মত। তার চোখ দুটো স্থির, জবাফুলের মত রাঙা। হাপরের মত হাঁপাচ্ছে। দৃষ্টি বিহ্বল; এবং নির্বাক। বোবা! লোকে ডাকছে—নিতো! নিতো! সে বোবা। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে।
দেখতে দেখতে এল তার বাবা তার দাদা তার মা, স্ত্রী।
তারা ডাকলে—নিতো বাবা! নিতো!
ভাই ডাকলে—নিতো রে, নিতো!
স্ত্রী ডাকলে—ও গো! ওগো!
কিন্তু নিতো বোবা, নিতো কালা। সে বসে আছে সেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। কাউকে সে চিনতে পারছে না। এবার এল সত্যকারের পাঁড়ে। নিতো রে নিতো!
নিতো তাকেও চিনলে না। সে সব ভুলে গিয়েছে।
নিতোর জ্ঞান-চেতনা ফিরল অদ্ভুত ভাবে। তাকে ধরে নিয়ে আসা হল বাড়িতে। নির্বাক বিহ্বল নিতো যন্ত্রের পুতুলের মত এল। আমি ডাক্তার দেখাবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু তাদের বাড়ির দোরে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে সে ভয়ার্ত চিৎকার করে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর চোখে মুখে জল সিঞ্চনের ফলে তার জ্ঞান ফিরল।
তার মা ডাকলে—নিতো।
এবার নিতো সাড়া দিলে—অ্যাঁ। তারপরে বলে—পাঁড়ে? পাঁড়ে কোথায়?
পাঁড়ে সামনে এসে বললে—এই যে! আমি তো ঘরেই রইছি রে। তু এমন করে ছুটছিলি ক্যানে?
কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে দেখে বলে—তাহলে সে কে? অবিকল তোর মত! বলেই শিউরে উঠে চোখ বুজল!
অনেকক্ষণ পর বললে—বাবুর কাছে পয়সা নিয়ে আমি গেলাম পানু সহিসের বাড়ি। মনে করলাম তু সেখানে গিয়ে জমে গিয়েছিল। তা দেখলাম সেখানে তু যাস নাই। তখন দু-ঢোক মদ খেয়ে রেললাইন ধরে আসছি। মুখ আঁধার হয়েছে, তোর কথাই ভাবছি এমন সময় ওই মাইলের কাছে পাথরের ওপরে দেখলাম তু বসে রইছিস। আমি বললাম—পাঁড়ে। তা সে ঠিক তু—সে এসে আমাকে বললে—শালা মজার, ভারি মজার—আয়!
বললাম—কোথা?
তা আমাকে লাথি মেরে বললে—আয় ক্যানে শালা। ভারি মজা হবে। বলে, লাইন থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে ছুটতে লাগল। আমি বললাম, দাঁড়া দাঁড়া। তা সে হিহি করে হেসে—বললে, আয় শালা আয়। —কী ছুট ছুটল। আমিও ছুটলাম। দাঁড়া রে দাঁড়া রে।
থামলো নিতো। বললে—এক গেলাস জল খাব।
তার বাবা বললে—বাবা ভুলোতে ধরেছিল বাবা! খুব বেঁচেছিস রে। ওই নিমচের জোলের ভুলো!
নিতো শিউরে উঠল।
পণ্ডিতেরা শুনে বলেন—ভুলো তো ভূত নয়। প্রেতও নয়। ভুলো ভুল। নিতোরই মনের ভুল। মদের নেশার মধ্যে শুধু পাঁড়ের কথা ভাবতে ভাবতে আসছিল; তার মন থেকে বেরিয়ে এসেছিল পাঁড়ের একটা কল্পনায় গড়া ছবি। সে যত তাকে ধরবার জন্যে ছুটেছে তত ছবিটাও ছুটেছে। ক্রমে উম্মত্তের মত নিতো ছুটেছে। ভুলে গেছে সব কিছু।
আমিও ভেবেছি। যুক্তি তাইই বলে। মনের কল্পনা। যা একাগ্র মনে ভাবে মানুষ, তা ঘুমের ঘোরে নেশার ঘোরে, এমনকি চিন্তা যদি খুব গভীর হয় তবে এই ভাবেই মানুষ ভুল দেখে। ভুল শোনে। এ ভুল মনই করায়।
তোমরা যেন বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে এই ভাবে পথ হেঁটো না একলা অন্ধকারে। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ো না।
এ কথার পরেও কিন্তু আমার এই নিমচের জোলের ভুলো-প্রেত সম্পর্কে সংশয় যায়নি। মনে পড়ে এই মাঠে ওই জায়গাতেই অনেক মানুষ এমনি ভুল করেছে। এই ঘটনার বছরখানেক পরে আমি দেখেছিলাম একজনকে। এমনি করেই মাইল খানেক পথ হেঁটেছিলাম। সে অন্য কাহিনী। এবং কে যেন বলে মানুষের হিংসা মানুষের পাপ নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে। প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেত করেছে—সে যুগান্ত ধরে এমনি করেই সুযোগ পেলে ভুলিয়ে নিয়ে ছুটবে—নদীর দিকে, পাথরের দিকে, পুকুরের গভীর জলের দিকে আর অট্ট হেসে বলবে—আয়-আয়-আয়—হি-হি-হি—আয়! কেমন মজা দেখ।