ভুলোমন স্বামী
ভুলোমন অধ্যাপক নিয়ে অনেকরকম গল্প আছে। সেই অধ্যাপকদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেকেই বিবাহিত এবং তাঁদের স্ত্রী বিদ্যমান।।
স্বামীদেবতা যদি ভুলোমন হন, সেটা পত্নীঠাকরানির পক্ষে সুবিধেজনক হয় না অসুবিধেজনক হয় এ রকম জটিল প্রশ্নের মধ্যে না গিয়ে প্রথমে একটি নিরতিশয় সরল প্রকৃতির ভুলোমন স্বামীর গল্প বলি। একদিন এই ভুলোমন স্বামী বাড়ি থেকে হনহন করে বেরিয়েছেন, একটা বিশেষ জরুরি দরকারে তিনি কোথায় যেন তাড়াতাড়ি ছুটে যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মোড়েই এক ডাক্তারের চেম্বার। পাড়ার পুরানো ডাক্তার, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে রীতিমতো বন্ধুত্ব রয়েছে ভদ্রলোকের। হনহন করে ডাক্তারের চেম্বারের মধ্যে প্রবেশ করলেন ভদ্রলোক। ভর দুপুর! ডাক্তারখানা একদম খালি। ডাক্তারবাবু একা একা বসে ঝিমোচ্ছিলেন, হঠাৎ ভদ্রলোকের প্রবেশে তিনি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন, খুশিও হলেন। রাস্তার ধারে ফুটপাথের একটা দোকানে একটা হাঁক দিয়ে দু’ভাঁড় আদা-চা আনতে বলে ডাক্তারবাবু ভদ্রলোককে ‘আসুন, আসুন’ বলে স্বাগত জানালেন।
গনগনে দুপুরে উষ্ণ চায়ের পাত্রে চুমুক দিয়ে দু’জনের আড্ডা জমে উঠল। কলকাতার ফুটবল মরশুমে দলবদল, খলনায়কের অশ্লীল গান, ইলিশের চড়া দাম, পুজো এসে গেল ইত্যাদি বিষয়ে আধঘণ্টাখানেক আলোচনার পর ভদ্রলোক উঠলেন, সেইসময় ডাক্তারবাবু মামুলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এমনিতে সব ভাল তো? বাড়িতে বউদি ভাল আছেন ?’ দ্বিতীয় প্রশ্নটি শোনামাত্র ভদ্রলোক ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন, ডাক্তারবাবুকে বললেন, ‘সর্বনাশ, আমি তো একেবারে গিয়েছিলাম, আমি তো আপনাকেই ডাকতে এসেছিলাম।’
বিস্মিত ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’ ভুলোমন স্বামী বললেন, ‘আর কেন? আপনার বউদি বাসায় ফিট হয়ে পড়ে আছেন। আপনাকেই ডাকতে এসেছিলাম। এতক্ষণে কেমন আছে কে জানে, এখন তাড়াতাড়ি চলুন।’
সুখের কথা, এই ক্ষেত্রে স্ত্রীর জ্ঞান একা একাই ফিরে এসেছিল, চিকিৎসার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি।
ভূ.ম. স্বামীর এর পরের গল্পটি অবশ্য অবিশ্বাস্য এবং আরও গোলমেলে। ঘটনাটি নাকি কোনও এক বছর শারদীয়া পুজোর আগে। ভদ্রলোক বাজারে গিয়েছিলেন। হাতে একটা বিরাট লিস্টি। সেই লিস্টিতে জামা, কাপড়, জুতো, মোজা, স্টেশনারি জিনিস, প্রসাধন দ্রব্যাদি সবই রয়েছে। সব কিনে-কেটে তিনি একটা ট্যাক্সি ধরলেন কিন্তু তাঁর মনে হল তিনি কী যেন একটা ফেলে যাচ্ছেন। হাতের লিস্টির সঙ্গে নতুন কেনা প্যাকেটগুলো দু’বার-তিনবার মেলালেন। না, সবই তো ঠিকই আছে, কিছুই তো ফেলে আসেননি। পকেটে হাতড়িয়ে দেখলেন মানিব্যাগ, কলম, রুমাল, সিগারেট, দেশলাই সবই ঠিকঠাক আছে। অবশ্য তাঁর মনে বারবার খটকা লাগছে, কী যেন ফেলে এসেছেন মনে হচ্ছে। সমস্যার সমাধান হল বাড়ি ফিরে। ট্যাক্সি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নামামাত্র মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, মা কোথায়?’ ভু.ম. স্বামী দোকানে-বাজারে কোথায় যে স্ত্রীকে ফেলে এলেন কে জানে।
অন্য একজন ভূ.ম. স্বামীর কথা বিলক্ষণ জানি। তিনি আমাদের খুব কাছের লোক, তাঁর স্ত্রীও আমাদের নিজের লোক। এই ভূ.ম. স্বামী ভদ্রলোকটি একজন চূড়ান্ত চুরুটখোর। কখনও তাঁর চুরুটের আগুন নেভে না। একদিন ভদ্রলোক খেয়াল না করে অ্যাশট্রেতে রাখা জ্বলন্ত চুরুট হাতে তুলে আগুনের দিকটা নিজের মুখে গুঁজে দেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট পুড়ে গিয়ে আর্ত চিৎকার করে চুরুটটা মাটিতে ফেলে দেন।
এই ঘটনার সময় তাঁর স্ত্রী তাঁর কাছেই ছিলেন। পরে ভদ্রমহিলা স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস তুমি মুখে দেওয়া মাত্র ভুলটা বুঝতে পারলে, তাই শুধু ঠোঁটটার ওপর দিয়ে গেছে, না হলে মুখের ভেতর জিব-টিব, তালু-টালু পর্যন্ত পুড়ে যেতে পারত।’ সেই অর্থে ভুলোমন আমরা সকলেই। আমরা প্রয়োজনীয় লোকের ঠিকানা ভুলে যাই, ফোন নম্বর হারিয়ে ফেলি। শ্যালিকার ননদের নাম ভুলে যাই। আমরা ট্রামে কিংবা রেস্তোঁরায় ছাতা ফেলে আসি, ইন্সিওরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে ভুলে যাই। তবে সবচেয়ে বেশি ভুল হয় বোধহয় চিঠি পোস্ট করতে। লোকে লেখা চিঠি পকেটে ভরে নিয়ে পোস্ট না করে বাসায় ফিরে আসে, তখন পকেটের মধ্যে আবিষ্কৃত হয় ডাকে না ফেলা জরুরি পত্রটি।
শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের নায়ককে তাঁর স্ত্রী চিঠি ডাকে দিতে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেই রাস্তায় বেরিয়েছেন সবাই তাঁকে বলতে লাগল, ‘দাদা, বউদির চিঠিটা পোস্ট করতে ভুলবেন না।’ বাসেও তাই হল, অফিসেও তাই হল, এমনকী চিঠিটা ডাকে ফেলে দেওয়ার পরেও চেনা-অচেনা লোকেরা তাঁকে বলতে লাগল, ‘দাদা, বউদির চিঠিটা পোস্ট করেছেন তো?’ এর কারণ অবশ্য আর কিছু নয়, ভদ্রলোকের জামার পিঠে তাঁর স্ত্রী আলপিন দিয়ে গেঁথে একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন, ‘আমার বরের খুব ভুলোমন, ওঁকে দয়া করে আমার চিঠিটা পোস্ট করতে মনে করিয়ে দেবেন।’ অবশেষে চিঠি ডাকে দেওয়ার কথোপকথন দিয়ে ভুলোমন কাহিনী শেষ করি।
স্ত্রী: আমার চিঠিটা পোস্ট করেছ?
স্বামী: না।
স্ত্রী: পোস্ট করোনি। অথচ তোমাকে আমি পইপই করে বলেছিলাম।
স্বামী: কিন্তু।
স্ত্রী: কিন্তু আবার কী? আমার জরুরি চিঠিটা তুমি পোস্ট করলে না?
স্বামী: কিন্তু দোষ আমার নয়, দোষ তোমার।
স্ত্রী: আমার আবার কী দোষ?
স্বামী: চিঠিটা দ্যাখো। তুমি চিঠিটার ঠিকানা লেখনি।