ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল – বলরাম বসাক

ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল – বলরাম বসাক

আমি ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল। আমাকে দেখতে নাকি খুউব সোন্দর। আমার গায়ের রং সাদা ধবধবে। লেজের অর্ধেকটা কালো ডুরে। মাথার খানিকটায় কালো ঢেউ ঢেউ মতন। এমনটা কোন হুলোর আছে ভাই! কেমন তুলতুলে তুকতুকে মাখম মাখম রেশম রেশম গা আমার। এমনটি কার আছে বল দেখি। কথাটা বেড়াল বলল,—খোঁটায় বাঁধা ঘন্টি-ছাগলকে।

গলায় ঝুমঝুমির সঙ্গে ঘন্টা বাঁধা বুড়ো ছাগল। ঝুম-ঝুম টুন-টুন করে ঘাড় নাড়ল। বিটকেল গন্ধ ছড়িয়ে দাড়ি নাড়ল। হুঁ-হুঁ-হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল,—তা অবশ্যি কারও নেই, কিন্তু আমার মতো এমন চমৎকার দাড়ি আছে তোমার?

দাড়ি?—নাক সিঁটকে চোখ ঘুরিয়ে বলল হুলো বেড়াল : দাড়ি? মরে যাই মরে যাই। অমন একটা বিটকেল, বিচ্ছিরি দাড়ি কে চায় শুনি, হুঃ। ম্যাউ-উ-উ-উ-উ। বলি আমার মতো এমন মোলায়েম মিহি আটগাছি রোঁয়ার গোঁফ আছে তোমার?

ক্যা-ক্যাও—কি হল গা? ঝগড়াটা কীসের?—অনেক উঁচুতে কাঠের বিমের হুকে একটা খাঁচা ঝুলছে। কাকাতুয়া ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে ঘাড় কাত করে সেখান থেকে বলল : বলি ঝগড়াটা কীসের গো?

ঝগড়া? ঝগড়া কোথায় করছি র‌্যামোউ র‌্যামো-ও-ঔ-? —বলল হুলো বেড়াল খাঁচার দিকে মাথা তুলে। চোখ পাকিয়ে কটমট করে কাকাতুয়ার দিকে তাকিয়ে, এদিক-ওদিক জিব বের করে গাল চেটেপুটে : উঁচুজগতের লোক তুমি তুয়াকাকা—নীচে তো আর কোনোদিন নামলে না, আমাদের ধম্ম-কম্ম কি আর তোমার মাথায় ঢুকবে?

—নীচে নামতে কি আমার ইচ্ছে করে না? খুউব ইচ্ছে করে। আগে তো নীচেই থাকতুম গো। তোমার আবির্ভাবের পর থেকেই ভুলোবাবু আমাকে এতটা উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখলেন।

ঝুম-ঝুম ঠুন-ঠুন করে ঘন্টি-ছাগল বলল,—কথাটা খুব সত্যি। তুমি এ পাড়ায় আসবার পর থেকেই আমার বন্ধুবান্ধবের আর দেখা পাচ্ছি না। ইঁদুর ভায়া থাকত ওই গর্তটায়। ভুলোবাবুর রামায়ণ মহাভারত বইদুটো খুব ভালো করে পড়েছে। বইদুটোর কিচ্ছু বাকি রাখেনি। পড়াশুনোয় ওর ভারি মন। যে বই-ই পড়ে, শেষ করে ছাড়ে। ওকে দেখে আমারও একদিন ব্যাকরণ পড়তে খুব ইচ্ছে হল। কথাটা ইঁদুর ভায়াকে বললাম। ইঁদুর ভায়া অনেক খুঁজলে। ঝট করে পাওয়া যায় নাকি সে বই? ভুলোবাবুর ছোটোছেলে টুলোবাবু বইপত্তর কোথায় যে রাখেন তার কি ঠিক-ঠিকানা আছে? শেষপর্যন্ত টুলোবাবুর টুলের তলায় পাওয়া গেল বইটা। ইঁদুরভায়া সে বইটা আমার কাছে আনতে না-আনতেই শেষ করে এনেছে প্রায় অর্ধেকটা। কী বলব, একেবারে জলের মতো গিলে খেয়েছে। এমনি পড়াশোনায় মন ছিল ওর। কিন্তু ভাই হুলো, তুমি যেই না এ পাড়ায় এলে অমনি ওর পাত্তাটি নেই।

হুলো এতক্ষণ শুয়ে বসে কাত হয়ে নানারকম যোগাসন দেখিয়ে নিজের পিঠের ডানপাশটা বাঁ-পাশটা কখনও এপাশের ঠ্যাং দিয়ে কখনও ওপাশের ঠ্যাং দিয়ে চুলকে নিচ্ছিল। কখনও গড়াগড়ি খেয়ে গা ঘষছিল। ঘন্টি-ছাগলটার কথাও শুনছিল। হঠাৎ চটে উঠে বলল,—তা যদি বলো তো বিদদে চচচা আমিও কিছু কম করি না। আমাকেও ইঁদুর খরগোশ চড়াই পাখি ইত্যাদি ইত্যাদি ইসটাডি করতে হয়। সে কথা থাক।

বলেই ‘ফ্যাঁস’ করে উঠল। বলল, —ইঁদুরের কেন দেখা পাচ্ছ না সে আমি কী করব? দোষটা কি আমার?

তবে কার?—কাকাতুয়া বলল ওপর থেকে।

কার দোষ তা তুয়াকাকা কি করে বলল! ভুলোবাবু আমাকে আদর করে ডেকেছেন।—হুলো বলতে থাকল : আদর করে পিঠ বুলিয়ে দিয়েছেন। লেজ বুলিয়ে দিয়েছেন। আ-চু-চু আদর করে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমার আসার জন্যে কারও ক্ষতি হচ্ছে কিনা আমি সেসব পরোয়া করি না। ব্যাস, আমি ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল। ফ্যাঁস ফ্যাঁস ফ্যাঁউ-উ-উ…।

ঝুম-ঝুম ঠুন-ঠুন আওয়াজ করে ঘন্টি-ছাগল হুলো বেড়ালের কথা একটুও গ্রাহ্য করল না। বলল,—আগে চড়ুই দিদি এখানে কত আসত। কত গল্প করত। নদী পারের গল্প। ঘন বনের গল্প। রেলগাড়ির গল্প। জাহাজে চড়ার গল্প। সবুজ ধানখেতের কথা। নীলপুকুরে লাল শালুক- ফুলের রূপকথা। সূর্যের রাঙা আলোয় ফুরফুর করে উড়ে হালকা হাওয়ায় পাখা নেড়ে নেড়ে চলে যেত নদীর ওপর হলদে কাঠের পোলে। ঝির ঝির করে পাতা নড়ত। শন শন করে হাওয়া বইত।

মরে যাই, মরে যাই!—বলল হুলো বেড়াল : ঘন্টা গলায় বুড়ো রামছাগল, তা বেশ ভাবুক দেখছি। দাড়ি নেড়ে কোবতে লেখো বুঝি? তা ওসব কবিত্ব-টবিত্ব আমারও আসে একটু-আধটু। নেহাত সারাটা দিন ইলিশমাছের ধান্দায় ঘুরে বেড়াই, তাই সময় পাই না। কখন খসখস করে পাতা সরল। কখন চোখে-মুখে ধুলো ছড়িয়ে হাওয়া বইল। কখন কখন ঝুপ ঝুপ করে ফালতু ফালতু বৃষ্টি পড়ল। ওসব খেয়াল করার সময় কোথায়?

ওপর থেকে কাকাতুয়া বলল,—তা খেয়াল করারই বা কি দরকার? কথায় বলে—

রটায় নাকি নিন্দুকে

চোরের মন সিন্দুকে।

আমাকে চোর বললে তুয়াকাকা!—বলল হুলো।

—না মোটেই তা বলিনি।

—হ্যাঁ বলেছ।

—না বলিনি।

—নিশ্চয়ই বলেছ। এই ঘন্টি-ছাগল সাক্ষী।

আ-আমাকে এর মধ্যে টেনে আনা কেন বাপু?—ঝুম ঝুম ঠুন ঠুন আওয়াজ করে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ ডাক ছেড়ে বলল ঘন্টি-ছাগল : খ্যামা করে দাও না, আমাকে কেন!

তারপরই কাকাতুয়ার সঙ্গে হুলো বেড়ালের তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল। সে কী ঝগড়া! কিছুতেই থামে না। কাকাতুয়া সপ্তমে গলা চড়িয়ে ওপর থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে পাখা ঝাপটিয়ে, ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে হুমকি দিচ্ছে,—দেখে নেব আয় না উঠে ওপরে! উঠে দ্যাখ না, কী তোর হাল করি, ঠুকরে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেব।

নীচ থেকে হুলোও তেমনি সমান তালে নেচে-কুঁদে থাবা বাগিয়ে, দাঁত কিড়িমিড়ি করে, ‘অঁঅঁঅঁ’ ‘ওঁওঁওঁ’ ‘মঁ-অঁ-অঁ’ ইত্যাদি তারস্বরে হুমকি দিয়ে চলল,—তুই নেমে আয়! নেমে দ্যাখ না, কেমন টিসুম টিসুম করি। করে করে তোকে কোরমা বানিয়ে খাই…।

হঠাৎ কোথায় একটা জানালা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ হল— ঝপাস।

ইসসস : হুলো বেড়ালের আস্ত গা-টাই ভিজে গেল।

আরেকটা শব্দ হল ঝুপ। খাঁচা লক্ষ করে। কাকাতুয়াও ভিজেছে। তবে কম।

ঘন্টি-ছাগল মুখ তুলে দেখাল, জল ছুড়েছেন স্বয়ং ভুলোবাবু।

যেই না শব্দ হল—ঝপাস। হুলো বেড়াল বলল,—বাপস।

যেই না শব্দ হল,—ঝুপ। কাকাতুয়াও চুপ।

2

হুলো বেড়াল চিঠি লিখছে, পিসতুতো ভাইকে।

ভাই কেলো,

ভুলোবাবুর বাড়িতে আমি বেশ আছি। চিন্তা করো না। তোমাদের ওখানে ইলিশমাছ কেমন পাওয়া যাচ্ছে? এখানে ভুলোবাবুর বাড়িতে, তার পাশের বাড়িগুলোতে, পেছনের সামনের বাড়িগুলোতে ইলিশমাছ দেদার পাওয়া যাচ্ছে। তবে বড্ড কড়া পাহারা। হাতা খুন্তি নারকেল কাঠির ঝাঁটা ইত্যাদি অস্ত্রগুলো ঠিক ঠিক সময়ে প্রস্তুত থাকে। তা আমিও ভুলোবাবুর ভেজা বেড়াল। ভুলোবাবু নিজের হাতে ঝপাস করে জল ঢেলে আমাকে ভিজে বেড়াল করে ছেড়েছেন। সবাই দেখেছেন আমি ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানি না। তাই অন্যমনস্ক তাঁরা যখন অন্য কাজে মন দিচ্ছেন, তখন ছোঁ মেরে কাঁচা মাছটি নিয়ে ভোঁ করে দৌড় মারছি। তবে ভাই, দুধের বড্ড অভাব। ভুলোবাবু ছাগলের দুধ খান। র‌্যামোঁ-ও-ও র‌্যামো-ও-ঔ! ছাগলের দুধে যা বিটকেল গন্ধ! একবার চেখে দেখেছি—ঠিক আমাদের ঘন্টি-ছাগলের দাড়ির মতো বিচ্ছিরি আর বিটকেল। ওই বুড়ো ছাগলটার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব প্রায় হয়ে গেছে। খালি কাকাতুয়াটার সঙ্গেই এখনও হয়নি। বড্ড বেয়াড়া পাখি রে। যখন-তখন গালাগাল দেয়, ছড়া কাটে। আজকাল আমাকে নিয়ে একটা ছড়া বানিয়েছে—

ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল

নেই কো চুলো চাল,

ভাঁড়ার ঘরে পাহারা নিয়ে

খাচ্ছে বাবুর গাল।

বলো তো ভাই কেলো, এর উত্তরে কী বলি? কেমন করে কাকাতুয়াকে জব্দ করা যায় তার একটা উপায় বাতলে দিতেই হবে তোমাকে। তোমরা সবাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভালো আছো তো? ইতি—

হুলো

চিঠি লেখা শেষ করে হুলো বেড়াল আরেকবার পড়ে নিল। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল,—ও হুলো ভাই, জলপাই খাবে?

হুলো তাড়াতাড়ি চিঠিটা একটা উলটে পড়া ভাঙা কাঠের বাক্সের তলায় গুঁজে রাখল। তারপর পেছন ফিরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল ও-পাশের পাঁচিলের ওপর কাঠবেড়ালি।

—জলপাই খাবে?

—জলপাই? নাহ। টক টক লাগে।

—খাবে না তাহলে?

—না।

—বেশ, তাহলে পেয়ারা খাবে?

—পেয়ারা আমি খাই না।

—তাহলে কলা খাবে?

শুনে হুলো একচোট হাসল। বলল,—ভুলোবাবুর ভাঁড়ার ঘরে কততো কলা, আলু, মুলো, কড়াইশুঁটি—! তার একটাও আমি খাওয়া তো দূরে থাক, চোখে পর্যন্ত দেখিনি।

—ওহ, ওসব তো তুমি খাও না।

ধ্যুৎ! ওসব খেয়ে কী হবে?—হাই তুলল হুলো। বলল : একটা ইঁদুর বড্ড উৎপাত করছিল ভাঁড়ার ঘরে। আমার ভয়ে ইঁদুরটা আর ভাঁড়ার ঘরে ঘেঁসছে না। ওটাকে ধরতে পারলে ভুলোবাবুর কাছ থেকে আস্ত একটা ইলিশমাছ পাব।

কাঠবেড়ালি চোখ গোল গোল করে বলল,—তাই বুঝি?

— তা নয়ত কী? ভুলোবাবু তো আমাকে ওই জন্যেই এখানে এনেছেন।

—আমি ভাই মাছ-টাছ খাই না।

—তা খাবে কেন? সাধে কী তোমাকে লোকে বলে ‘কাঠবিড়ালি’? আকাঠ মুখ্যু। তোমার দ্বারা কিসসু হবে না।

—কোথায় যাচ্ছ হুলো ভাই?

—যাব আবার কোথায়? বাঁ-পাশের ওই সাদা বাড়িটায়।

—কেন, ওখানে কী?

—ওখানে ঠিক এই সময়ে নান্টুর বাবা পাঁউরুটি দিয়ে মাংসের ঝোল খান। খেতে ভাই চমৎকার লাগে, আহা! আমি ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল ওখানে না-গিয়ে কি পারি? অবশ্যি গেলেই নান্টুটা আমার দিকে বন্দুক তুলে ধরবে। গুলি করবে।

বন্দুক? গুলি? বলো কী!—কাঠবেড়ালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল।

—হ্যাঁ, তা অমন বন্দুকের তোয়াক্কা করি না। পাঁচশো আটচল্লিশ বার গুলি করেছে আমাকে। একটাও লাগেনি।

—তা, একদিন তো লেগে যেতে পারে। কী সাংঘাতিক!

লাগুক। —হুলো বলল চলতে চলতে : অত ভয় করলে পাঁউরুটি জুটবে না, মাংসের ঝোলও জুটবে না। ভীতু কোথাকার।

হুলো বেড়াল লাফিয়ে পাঁচিলে উঠল। কাঠবেড়ালিও পাঁচিলের ওপর ঝুঁকে পড়া পেয়ারা গাছে উঠে পড়ল। পাঁচিল পেরিয়ে লাফিয়ে ওপারে নেমে হুলো বেড়াল হেঁটে চলল লেজ দুলিয়ে। গোঁফ ফুলিয়ে। নান্টুদের বাড়ি। খাবার ঘরের জানালার ওপারে ঘাপটি মেরে বসে রইল। খাবার টেবিলে মাংসের ঝোল আর পাঁউরুটি রেখে নান্টুদের কাজের মাসি নান্টুর বাবাকে যেই-না ডাকতে চলে গেল, অননি হুলোটা ছুটটে ভেতরে এসে খাবার টেবিলে লাফিয়ে উঠে চকচক করে মাংসের ঝোল গোঁফ ভিজিয়ে খেয়ে নিল। তারপর মাংসের হাড় কটমট করে চিবুতে চিবুতে শুনতে পেল ‘হায়-হায় হই-হই-গেল-গেল-মার-মার!’

পাঁউরুটিটায় মুখ দেওয়া গেল না। শুধু হাড়ের টুকরোটা মুখে নিয়ে আর একটা মোটা বই-এর ঘা খেয়ে পাড়ি থেকে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে লাফ মেরে পালিয়ে আসতে হল। হাড়টা চিবিয়ে খাওয়া শেষ করে ঢেকুর তুলল। ঝোলটা বেশ ছিল। তবে বড্ড গরম। জিভ পুড়ে গেছে।

তারপর কেলো বেড়ালকে মনে পড়তেই চিঠিটার কথা মনে পড়ল। চলে গেল উলটে পড়া বাক্সের কাছে। বাক্সের তলায় লেজ বুলিয়ে দিল। কোথায় চিঠি? একগাদা কাগজের কুচি চিঠির বদলে। হুঁ—এ সেই ইঁদুরটার কাজ। আমার লেখা চিঠিটা কুচি কুচি করে কেটেছে।

কোনদিন তোমার লেজটাই না কুচি কুচি করে কাটে। —বলল কাকাতুয়া।

ঘন্টি-ছাগল কিচ্ছুটি বলল না, শুধু শব্দ হল ঝুম ঝুম ঠুন-ঠুন।

হুলো বেদম চটে গিয়ে থাবা ছুড়ে মারল একটা চিৎকার, —অঁ অঁ অঁ অঁ অঁ —আমি ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল, দেখে নেব হতচ্ছাড়া ইঁদুরটাকে। এবার সত্যি সত্যি দেখে নেব। হুঁ-উঁ-উঁ-উঁ-উঁ।

3

ইঁদুর ধরা এক ঝকমারি ব্যাপার।—আপন মনে বিড়বিড় করল হুলো বেড়াল মুখটা বিতিকিচ্ছিরি করে : যাচ্ছেতাই অবস্থা হচ্ছে ওই হতচ্ছাড়ার জন্যে। দিনের পর দিন ঘুম নেই। ভাঁড়ার ঘরে ওঁত পেতে বসে থাকা। পিঠ ব্যথা। মাথা ব্যথা। ঠ্যাং-এ টন টন। শিরদাঁড়ায় কটমট। এমন সুন্দর সাদা তুলতুলে গা আমার কালি হয়ে গেল। ছ্যা-ছ্যা। বেড়াল-সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। একটা অতিসামান্য পুঁচকে ইঁদুর আমাকে এমন নাজেহাল করে ছাড়বে? এর চেয়ে ইলিশমাছের ধান্দায় থাকা যে কত ভালো! কতদিন ধরে সেই ধান্দা ছেড়ে ভাঁড়ার ঘরে পড়ে আছি।

হঠাৎ যেন কী নড়ে উঠল। অ্যাঁ। হুলো একটুও না-নড়ে রোঁয়া খাড়া করল। একটা কড়াইশুঁটি নড়ছে। কড়াইশুঁটি কি নিজে নিজে নড়তে পারে কখনও?

থেমে গেল কড়াইশুঁটির নড়া। ভুল দেখছে নাকি হুলো। ওই তো একটা কড়াইশুঁটি চলতে শুরু করছে গুটি গুটি। কড়াইশুঁটি কি নিজে নিজে চলতে পারে?

ওইতো ওইতো বাছাধন নেংটি ইঁদুরের কান। ওইতো ওর লেজ। আ-রে আরে একটা কড়াইশুঁটি নিয়ে ইঁদুরটা ছুট দিচ্ছে। হুলো ছুটল পিছু পিছু। চেঁচিয়ে বলল,—আর ছাড়া পাচ্ছো না বাছাধন।

ইঁদুরটা কড়াইশুঁটি মুখে ভাঁড়ারঘর থেকে বেরিয়ে খাবার ঘরের খাবার টেবিলের তলায় ঢুকল। সেখান থেকে শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলায়। সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরের ঘরের সোফার তলায়। সেখান থেকে বেরিয়ে বারান্দায় বেঞ্চির তলায় ভুলোবাবুর বুটজুতোর ভেতর গিয়ে লুকাল। হুলোও সঙ্গে সঙ্গে জুতোর ভেতর থাবা ঢুকিয়ে দিল। পেল শুধু কড়াইশুঁটির খোসা। আর কিছু নেই।

সে কি, গেল কোথায়? জুতোর ভেতর ঢুকে পালাবে কোথায়? ম্যাজিক না কী? জলজ্যান্ত ইঁদুরটা ভ্যানিশ হয়ে গেল?

জুতোটা উলটে দিতেই ভ্যাবাচাকা খেতে হল ভুলোবাবুরহুলোকে। আচ্ছা ঠকা ঠকতে হল। জুতোটার অর্ধেকটা তল্লি একেবারেই নেই।

ক্ষুণ্ণ মেজাজে হুলো বেড়াল চলল রান্না ঘরের দিকে। ভুলোবাবু আজ ভেটকিমাছ এনেছেন।

হুলো রান্নাঘরে চলে গেলে নেংটি ইঁদুর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলে কী হবে, ওদিকে যে খুব খিদে পেয়েছে। একটা কড়াইশুঁটির দুটো দানায় কি পেট ভরে? পেট না-চললে বাঁচবে কী করে নেংটি ইঁদুর? হুলোটা আজকাল এমন করে পাহারা দিচ্ছে এদিক-ওদিক ওঁত পেতে, যে ভাতে মারা পড়বার মতো অবস্থা হয়েছে ইঁদুরের। গর্ত থেকে বের হতেই পারছে না। এখন হুলো ভেটকির গন্ধে রান্নাঘরে। এই তো সুযোগ। পেয়ারা গাছের তলায় এল চুপি চুপি ইঁদুর। তারপর ডাকল ফিস ফিস করে,—কাঠবেড়ালি ভাই! কাঠবেড়ালি ভাই!

—কী বলছ?

—কয়েকটা পেয়ারা ফেলে দাও না ভাই।

পেয়ারা? বেশ দিচ্ছি।—বলল কাঠবেড়ালি : কাল টুলোবাবু গাছে উঠে ডাল ভেঙেচুরে কত যে পেয়ারা পেড়ে নিয়ে গেছে। গাছখানা প্রায় খালি করে দিয়েছে। এই নাও মাত্র দু-তিনটে হাতের কাছে পেলাম। বলেই গোটা তিনেক পেয়ারা নীচে ফেলে দিল কাঠবেড়ালি।

ইঁদুর সেগুলো কুড়িয়ে একদিকে জড়ো করতে করতে দেখতে পেল হুলো আসছে ভীষণ ছুটে। পেয়ারা ফেলে ইঁদুরও দে ছুট।

ছুট। ছুট।

ছুটতে ছুটতে হুলো হুংকার দিয়ে উঠল, —শিগগির ধরা দে বলছি।

কে কার কথা শোনে। ছুটতে ছুটতে ইঁদুর ভাঁড়ারঘরে। সেখান থেকে খাবার ঘরে। সেখান থেকে শোবার ঘরে। সেখান থেকে বাইরের ঘরে। সেখানে থেকে বারান্দায়। বেঞ্চির তলায়। বুটজুতোর ভেতর। বুটজুতোর তলার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এবার ইঁদুর কোনদিকে পালাবে? এবার আর ম্যাজিক দেখিয়ে নিজেকে ভ্যানিশ করতে পারবে না বাছাধন। বেঞ্চিরটার শেষে জুতোর তাক। তাকের পেছনে কাঠের ছোট্ট পার্টিশন। পার্টিশনের ওপারে উলটে পড়া ভাঙা বাক্স, একটা পায়া ভাঙা টেবিল। তার পাশে বৃষ্টিভেজা ছাতা মেলে রেখে গেছে ভুলোবাবু। ওটা শুকোচ্ছে। আর আছে টিনের কৌটো, প্লাস্টিকের কৌটো আর নানারকম হাবিজাবি। ওখান থেকে আরও একহাত দূরে উঠানে খোটায় বাঁধা ঘন্টি-ছাগল ঘুমোচ্ছে। বারান্দার শেষে একটা বিমে খাঁচায় ঘুমোচ্ছে কাকাতুয়া।

কাঠের ছোট্টো পার্টিশনে একটা ফুটো আছে। জুতোর তলা থেকে বেরিয়ে ইঁদুর জুতোর তাকের পেছনে ঢুকল। সেখান থেকে আরেকটু ছুটে কাঠের ছোট্টো পার্টিশনের ফুটোর মধ্যে নিজেকে গলিয়ে দিতেই হুলো বেড়ালও সঙ্গে সঙ্গে ফুটোর ভেতর সামনের ডান পা ঢুকিয়ে দিল, হুড়মুড় করে জুতোর তাক ফেলে দিয়ে।

ফুটো দিয়ে ডান পা পার্টিশনের ওপারে অনেকখানি ঢুকিয়ে থাবা দিয়ে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল। কী সেই বিকট চিৎকার,—এইবার যাবি কোথায় বাছাধন…। ধরেছি ধরেছি, ধরে ফেলেছি, অনেক দিনের সাধনার ফল। কতদিন কত কষ্ট করেছি এই নেংটিটাকে ধরতে—হুঁ হুঁ আমি ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল—আমাকে কিনা দিনের পর দিন ফাঁকি দিয়েছে পুঁচকেটা। ইস এখনও গায়ের জোর দেখাচ্ছে বীরপুরুষ। এতটুকু ইঁদুরের গায়ে এত জোর—কিছুতেই আসছে না তো! কী কামড়ে ধরে আছে হতচ্ছাড়াটা? মারো টান হেঁইও— লাগাও টান—হেঁইও। জোরসে টানো—হেঁইও…।

হুড়মুড় করে পার্টিশন ভেঙে পড়ল। ওদিকে শব্দ হল ফটাস ডুম। তার আগেই ফুটো দিয়ে কী একটা যেন বের করে এনেছে হুলো। থাবা দিয়ে খামচে ধরে, ওটা কী, লম্বা মতন, নেংটি ইঁদুর কি অত লম্বা হয়, না কি ওটা নেংটি ইঁদুরের লেজ! এত শক্ত, এত মোটা, এত খাড়া! ওদিকে শুকোতে দেওয়া বৃষ্টিভেজা ছাতার কাপড় ছিটকে পড়েছে ঘন্টি-ছাগলের পিঠের উপর। ঘন্টি-ছাগল ঝুম ঝুম ঠুনঠুন করে লাফিয়ে উঠেছে। ভূতের ভয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ।

আর কাকাতুয়া? কাকাতুয়া ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে সুর করে ছড়া কাটছে :

ভুলোবাবুর হুলো বেড়াল
দেখান কত ডাঁট,
ইঁদুর ধরতে গিয়ে ধরেন
বাবুর ছাতার বাঁট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *