ঠেলাঠেলি
ঠিক এই রকমটি হয়। একজন আসছেন ওই দিক থেকে, একজন যাচ্ছেন এই দিক থেকে। দুজনেই দুজনের পরিচিত। প্রথমে দু-জনের মুখে হাসি ফুটবে, টোল খাওয়া আলুর পুতুলের মতো। তারপর যে-কেউ একজন প্রশ্ন করবেন,
‘কী কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি।’
‘আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি।’ অথবা ‘ওই ভাই একরকম চলে যাচ্ছে।’
দুটো মেল ট্রেন দুদিকে চলে গেল বেগে। কারোর দাঁড়াবার সময় নেই। একজনের কাল মাঝরাত থেকে দাঁতের যন্ত্রণায় চোখে ধুঁতরো ফুল দেখছেন। আর একজনের বাতের যন্ত্রণা। মনে হচ্ছে, কুকুরে ডানপায়ের গুলিটা চিবোচ্ছে। তবু দুজনেই ভালো আছেন। কারণ দুজনেই জানেন, এই প্রশ্নটা ঠিক প্রশ্ন নয়। একে বলে প্রশ্নোত্তরের ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার। প্রশ্নকারী প্রকৃতই জানতে চান না, উত্তরদাতা কেমন আছেন। আর উত্তরদাতাও জানেন, ভালো আছি, বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই ভালো। এর বেশি এগোলে ভদ্রলোকের ধৈর্যের ওপর ট্যাকস করা হবে। তা ছাড়া, কেমন আছেন, প্রশ্ন করাটাই অন্যায়। কারণ, সবাই জানেন, এই যুগে কালোবাজারি, মজুতদার আর মন্ত্রীরা ছাড়া কেউই ভালো নেই। বরং একটু ব্যঙ্গের গলায়, ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে, ‘কী মশাই, কেমন আছেন?’ তখন বেশ জোর গলায়, উত্তর দেওয়া যায়, ‘উ:হু, খুউব ভালো।’
সেদিন বেশ মজা হল। জনৈক পরিচিত আমার পথ আটকে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার মতোই প্রবীণ; কিন্তু মনে হল চিউইংগাম চিবোচ্ছেন, চ্যাকোর চ্যাকোর করে। জিগ্যেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’
ভাবলুম, সত্যিই বোধহয় জানতে চাইছেন। আমি ছোট করে জানাতে চাইলুম, আমার প্রকৃত অবস্থাটা কী। সবে শুরু করেছি, ‘আমি কোনও রকম টিঁকে আছি; কিন্তু আমার বাড়ির অবস্থা…।’
ভদ্রলোক প্রশ্নের পর যতটুকু ফাঁক দিয়েছিলেন, তাতে ওইটুকুই বলা গেল। ভদ্রলোক আদৌ শুনতে পেলেন না। তিনি বলতে লাগলেন, ‘শুনেছেন বোধহয় মৌ ক্যানেডিয়ান ইউনিভারসিটির স্কলারশিপ পেয়ে, ব্রুকলিন যাচ্ছে। পাসপোর্ট, ভিসা সব হয়ে গেছে।’
আমার রোক চেপে গেল। চালাকি পেয়েছ! তুমি সাতসকালে পথ আটকে মৌকাহিনি শোনাবে, আর আমি কীর্তনিয়ার দোহারের মতো কেবল বলে যাবো, ‘আহা বেশ, বেশ, বেশ!’ আমার কথার অন্তত ইঞ্চিখানেক তোমার শোনা উচিত ছিল। তুমি শোনো, না শোনো, আমি বলে যাব। তখন আমাদের অবস্থাটা দাঁড়াল এই রকম। দুজনেই প্রাণপণে দুজনের দিকে কথা ঠেলতে লাগলুম।
ভদ্রলোক : মৌ এবার রেকর্ড মাকর্স পেয়ে ফিলোজফিতে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছে।
আমি : রাত, বারোটা, সবে শুতে যাব পদ্মর হার্ট অ্যাটাক।
ভদ্রলোক : মৌ ওখানে পি. এইচ. ডি. করবে।
আমি : কোথাও ডাক্তার পাই না। বাড়িতে ফোন…।
ভদ্রলোক : তার আগে আর একটা এম…।
আমি : নেই। অমাবস্যার রাত। রাস্তায় কু…
ভদ্রলোক : এ করতে পারে। তারপর পি…
আমি : কুর, ভয়ে একা বে…
ভদ্রলোক : এইচ. ডি. করে অ্যা…
আমি : রোতে পারছি না। পাছে কাম…
ভদ্রলোক : মেরিকা যাবে। সেখানে…
আমি : ড়ে দেয়। তখন করলুম কি…
ভদ্রলোক : ফেলোশিপ নিয়ে সেটল…
আমি : ঝগড়া শুরু করলাম। ঝগড়ার মতো কোরামিন…
ভদ্রলোক : করে যেতে পারে। এদিকে তো বি…
আমি : আর কি আছে? উঠে বসল। নেমে এল খাট থে…
ভদ্রলোক : য়ের ব্যবস্থা পাকা। ছেলেটি সো…
আমি : কে নেমে এল। মারলে…
ভদ্রলোক : নার চাঁদ।
আমি : এক থাপপড়। আমি বল…
ভদ্রলোক : ম্যাসসাচ্যু…
আমি : লুম, যাও, বেঁচে গেলে থ্রম…
ভদ্রলোক : সেটস। ইউ…
আমি : বোসিস থেকে বেঁচে…
ভদ্রলোক : ইউনিভারসিটিতে থিসিস করছে, ভা…
আমি : গেলে।
দুজনে এই চলল। প্রায় আধঘণ্টা। ঠেলাঠেলি। যেন গ্যালারির দর্শক আর পুলিশে ইট-ছোঁড়াছুঁড়ি। শেষে ভদ্রলোক বললেন, ‘চলি, কেমন আছেন আপনি?’
আমি জানি, ভদ্রলোক কিছুই শুনবেন না। তাই বললুম, ‘হনুমান।’
‘বা: ভালো থাকলেই ভালো। মৌ-এর খবরটা বাড়িতে বলবেন। বলা দরকার। কেমন আছেন মিসেস?’
‘অকসিজেন।’
‘বা: বা:। মৌ এই সবে বাইশে পড়ল। আচ্ছা, ফাইন্যালি চলি। ফরেন এক্সচেঞ্জের জন্যে, রি…
‘একমাত্র দাওয়াই।’
‘জার্ভ ব্যাঙ্কে যাই।’