ভুলের ওজন পঁচিশ পাউণ্ড – নির্বেদ রায়
ভুল মানুষ মাত্রেই হয়ে থাকে। সেটা এমন কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মানুষই আবার সে ভুল শুধরে নেয়। কিন্তু উইলফ্রেড ম্যাকনিলি নামে উত্তর আয়ারল্যাণ্ডের বাসিন্দা শ্বেতাঙ্গ মানুষটির ভুলের ধরনটা হয়ে পড়েছিল একটু বেয়াড়া গোছের। সাধারণত এই ধরনের ভুল-টুল হলে খুব কম মানুষই সে ভুল শুধরে নিয়ে পৃথিবীর ওপর হেঁটে চলে বেড়াবার সুযোগ পায়। ম্যাকনিলি অবশ্য সে সুযোগ পেয়েছিল, তবে তার মুখের ওপর ভালোভাবে একটু চোখ বুলিয়ে আনলেই বোঝা যেত যে, সেই ভুলের মাশুল হিসেবে তাকেও কম খেসারত গুনতে হয়নি। তার কপালের প্রায় পুরোটা জুড়ে দুটো চোখের ওপর পর্যন্ত নেমে আসা গভীর দাগগুলো যে আসলে বীভৎস কতগুলো ক্ষতচিহ্নের স্মৃতি, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
ভারতবর্ষ।
আজকের স্বাধীন ভারত নয়, তখন ব্রিটিশ অধিকৃত উপনিবেশ। সেই সময় বিলেতে ‘কার্টার-ডাউনেস লিমিটেড’ নামে একটি কাপড়ের কল থেকে ম্যাকনিলিকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল তুলোর চাষের তদারকি করতে। বিদেশে তখন ভারতের তুলোর চাহিদা খুব বেশি। ভারত থেকে তুলো নিয়ে গিয়ে, সেই তুলোয় কাপড় তৈরি করে আবার ভারতবর্ষেই সেই কাপড় বেচে তখন রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে ওঠে ম্যানচেস্টারের মিলগুলো। ‘কার্টার-ডাউনেস’ তারই একটা।
মাদ্রাজে নেমে ম্যাকনিলি প্রথম দেখা করল এস. টি. মজুমদার নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। মজুমদার তাকে নিয়ে গেল উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ের ঢালে তুলোর চাষ দেখাতে। সপ্তাহখানেক ধরে চাষবাসের তদারকি করল দু-জনে।
অবসর সময়ে মজুমদার ঘুরে বেড়াত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিমালয়ের কোল ঘেঁষে ছড়ানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর বিচিত্র বর্ণময় ফুল ও লতা-পাতার ঝোপেঝাড়ে। তার নেশা ছিল উদ্ভিদতত্ত্ব। কাজের ফাঁকে সারাদিন ঘুরে ঘুরে সে তাই ছবি তুলত যত দুর্লভ লতা-পাতা আর ফুলের। অন্য দিকে সেই সময়ে ম্যাকনিলি বসে থাকত একান্ত বেকার হয়ে। অথচ এই পরিবেশে তাঁর বেকার বসে থাকার কথা নয়। বহুদিন ধরেই উইলফ্রেড ম্যাকনিলির প্রিয় নেশা—শিকার! আর শিকারের তীর্থক্ষেত্র ভারতবর্ষের অরণ্য-প্রকৃতির মাঝে এসে একজন শিকারির পক্ষে দিনের পর দিন হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকা কী করে সম্ভব?
যে বিরাট ভূখন্ডের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বুকে শিং-এর সঙিন উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায় বুনো মোষের পাল অথবা খড়্গধারী গন্ডার—তৃণভূমির ওপর সন্ত্রস্ত ও সদাসতর্ক হয়ে বিচরণ করে চিতল অথবা সম্বর হরিণ আর তাদের পিছনে হলুদ ঝোপের ছায়ায় ছায়ায় গা মিলিয়ে শিকারের সন্ধানে হানা দিয়ে ফেরে বাঘ অথবা লেপার্ডের দল—আকাশছোঁয়া প্রকান্ড গাছের মোটা ডাল থেকে পাক খুলতে খুলতে বিপুল দেহকে অলস মন্থর ভঙ্গিতে নামিয়ে আনে বিরাট ময়াল—নদীর পাড়ে কাদামাটিতে শুয়ে নি:সাড়ে রোদ পোহায় ক্ষুধার্ত কুমির আর গোলপাতার জঙ্গলে মৃত্যুর জাল বিছিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে যে বুকে-হাঁটা জীবগুলো, যাদের ছোবল মানেই যমের পরোয়ানা, সেসবের আস্তানা ভারতবর্ষে এসে একজন শিকারির পক্ষে একেবারে খালি হাতে দেশে ফেরা কি সম্ভব?
প্রায় রোজ রাত্রেই তাঁবুতে ফিরে ম্যাকনিলি তাঁর বন্দুকগুলো পরিষ্কার করে তেল-টেল দিত, কিন্তু মজুমদারের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে রয়েছে তার নিজের খেয়ালে—তার উদ্ভিদতত্ত্ব নিয়ে। ফলে সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করার পরে ম্যাকনিলিকে নিজেই উদ্যোগী হতে হল।
আধুনিক যুগে আগ্নেয়াস্ত্রের অনেক উন্নতি ঘটেছে। তপ্ত সিসার মৃত্যুদংশন বহুদূর থেকে অব্যর্থ লক্ষ্যে শুইয়ে দিতে সক্ষম যেকোনো ভয়ংকর জানোয়ারকে। ফলে শিকারের বিপজ্জনক খেলা হয়ে পড়েছে আগের চেয়ে অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু ‘শিকার’ শব্দটি বলতেই যাদের মনে জেগে ওঠে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চের স্বাদ, শিকার বলতে যারা শুধু নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডকেই বোঝে না, বোঝে সমান সুযোগ নিয়ে জীবন দেওয়া-নেওয়ার তীব্র আরকে ভেজানো এক খেলাকে, এ ধরনের মানুষেরা নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার মধ্যে শিকারের আনন্দ খুঁজে পায় না। জীবনকে বাজি ধরে মরণ খেলার খেলোয়াড় হয়েই তারা খুঁজে পায় আনন্দের স্বাদ। খেলার একান্ত নিয়মেই তারা কখনো হারে, আবার কখনো জেতে। পুরষ্কার হিসাবে কখনো তাদের ভাগ্যে জোটে হিংস্র শ্বাপদের সুন্দর চামড়া কী অতিকায় তৃণভোজীর বিরাট সুদৃশ্য মাথা, আবার কখনো তাদের দুর্ভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে অরণ্যভূমির বুকে পড়ে থাকে নখ, দাঁত অথবা শিং-এর আঘাতে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ।
এত সব জেনেও কিন্তু বেপরোয়া মানুষ ওইভাবেই প্রাচীন অথবা মধ্যযুগীয় প্রথায় শিকার করতে ভালোবাসে। উইলফ্রেড ম্যাকনিলি ছিল ঠিক ওই ধরনের মানুষ। তাই আফ্রিকার ‘মাসাই’ অথবা ‘নান্দি’ উপজাতির মানুষরা যেরকম সামান্য একটা হাতে তৈরি বর্শা সম্বল করে পশুরাজ সিংহের মুখোমুখি হয়, আরব দেশের মানুষ যেমন শুধুমাত্র তলোয়ার হাতে ক্ষিপ্ত বন্য হাতির মোকাবিলা করে, তেমনই সঙ্গে বন্দুক থাকলেও শিকারের জন্য ম্যাকনিলির প্রিয় হাতিয়ার ছিল তির-ধনুক। এবার ভারতে আসার সময় সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ‘ফাইবার-গ্লাসের’ তৈরি একটা ধনুক, যার গুণের টান ছিল পঞ্চাশ পাউণ্ড।
একদিন সকালে বেরোবার সময় সেটাকে সঙ্গে নিয়েই বেরোলো ম্যাকনিলি। আর নিল চওড়া ফলাওয়ালা কটা তির। পথ চলতে চলতে চোখে পড়ল রং-বেরঙের পাখির ঝাঁক, একটার পর একটা, অগুণতি। কিন্তু কোনোটাকেই ঠিক তিরের আওতায় পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমে সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে গেল। তারা এসে পৌঁছোল ছোটো ছোটো পাথর-সাজানো একটা বাগানের মতো চত্বরে। ক্লান্তির পথচলা।
হঠাৎ একটু দূরে একটা ঝোপের মধ্যে নড়াচড়া চোখে পড়ল ম্যাকনিলির। সঙ্গেসঙ্গে ধনুকে তির লাগিয়ে তৈরি হল সে। তারপর একটা নুড়ি তুলে নিয়ে ছুড়ে দিল ঝোপ লক্ষ্য করে। মুহূর্তের জন্য ধূসর-বাদামি রঙের একটা ধাবমান দেহ ম্যাকনিলির চোখে ধরা দিল, ভালো করে তার সঠিক রূপটাও দেখতে পেল না সে। কিন্তু শিকারির হাতের অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায় সাঁ করে ছুটে গেল হাতের তির। লক্ষ্য অব্যর্থ! শিকার লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর। একটা ‘হগডিয়ার’—ছোটো জাতের হরিণ।
ম্যাকনিলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ওনডি। তার মুখের চামড়ায় বয়সের অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে। জাতে নেপালি। ওস্তাদ পথপ্রদর্শক। পানের ছোপওয়ালা দাঁত বের করে সে হাসল—‘সাহেব, তুমি খুব পাকা শিকারি। তবে তোমার একজন সঙ্গী থাকলে আরও ভালো হয়। তোমার আপত্তি না থাকলে আমিই তোমার সঙ্গী হতে পারি।’ এ প্রস্তাবে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না; ম্যাকনিলিরও ছিল না।
এদিকে ততক্ষণে মজুমদারও এসে পড়েছিল। শিকার দেখে সেও বন্ধুকে অভিনন্দন জানাল, আর সেই সঙ্গে বোধহয় এত দিন পরে একটা সোজা কথা তার বোধগম্য হল যে, তার নিজের মতো ম্যাকনিলিরও একটা শখ আছে এবং তাকেও সেই শখ মেটাবার সুযোগ দেওয়া উচিত। ফলে পরের দিন থেকে যে যার প্রয়োজনমতো জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে নিজের নিজের সুবিধামতো পথে বেরোতে শুরু করল। মজুমদারের সঙ্গে থাকত একজন কী দুজন পথপ্রদর্শক আর ক্যামেরা। ম্যাকনিলি সঙ্গে নিত তির-ধনুক আর ওনডিকে।
চওড়া ফলার তির ম্যাকনিলির সঙ্গে খুব বেশি ছিল না। তবে যে ক-টা ছিল সেগুলোকে কাজে লাগিয়েই দিন কয়েকের মধ্যে সে শিকার করেছিল একটা সম্বর হরিণ, দুটো চিতা আর অনেকগুলো বুনো কুকুর। কিন্তু ভারতের বনে যেসব কুলীনদের বাস, তাদের মুখোমুখি হতে গেলে আরেকটু শক্তিশালী হাতিয়ারের প্রয়োজন। ম্যাকনিলি ইস্পাত আর কাঠের তৈরি দুটো মজবুত ধনুক বিলেত থেকে আনিয়ে নিল। এই দুটো ধনুকেরই গুণের টান ছিল আগেরটার তুলনায় পঁচিশ পাউণ্ড বেশি, অর্থাৎ পঁচাত্তর পাউণ্ড।
পরের বছরের বসন্তাগত দিনগুলোতে ম্যাকনিলি ছুটি কাটাল গাড়োয়াল আর কুমায়ুনের মাঝের পর্বতমালার ঢালে। তুষারমৌলি নন্দাদেবীর কোলে শিকারের খোঁজে ঘুরে এবার তার ভাগ্যে জুটল বড়ো পাহাড়ি ভালুক আর চিতাবাঘ। সুতরাং, আর কী চাই? চাই নিশ্চয়ই—এখনও বাকি ভারতীয় অরণ্যভূমির একচ্ছত্র অধিপতির সঙ্গে মোলাকাত—ডোরাকাটা কেঁদো বাঘ!
কিন্তু রাজদর্শন তো আর সহজে মেলে না, তার জন্য ধৈর্য ধরতে হয়। ম্যাকনিলিও সুযোগের অপেক্ষায় রইল। অবশেষে সে সুযোগ এল প্রায় ছ-সাত মাস বাদে, সে বছর নভেম্বর মাসে।
শিকারের অপেক্ষায় একা জলাশয়ের পাড়ে পঞ্চাশ পাউণ্ডের ধনুকটায় তির জুড়ে অপেক্ষা করছিল ম্যাকনিলি। উদ্দেশ্য, যদি রাতে খাবারের টেবিলে কোনো সুস্বাদু মাংসের ব্যবস্থা করা যায়।
এমন সময় ওনডি দৌড়োতে দৌড়োতে এসে খবর দিল—‘বাঘ, সাহেব বাঘ! ওই নালাটার মধ্যে ঢুকেছে।’
ওনডির কথায় নেমে এসে দেখল ম্যাকনিলি। হ্যাঁ, বাঘই বটে। ভুল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। নালার মুখে বিরাট গোল গোল নিখুঁত পায়ের ছাপগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই অভিজ্ঞ শিকারি ম্যাকনিলির বুঝতে অসুবিধে হল না যে, বাঘটা শুধু পূর্ণবয়স্কই নয়, রীতিমতো স্বাস্থ্যবানও বটে। কিন্তু পঞ্চাশ পাউণ্ডের ধনুকে বাঘ মারা যায় না, তাঁবুতে ফিরে গিয়ে উপযুক্ত হাতিয়ার নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু ততক্ষণ বাঘটা কি আর এখানে থাকবে?
ওনডি সেকথা জিজ্ঞাসা করতে তার মুখে আরও গোটাকয়েক ভাঁজ পড়ল। একটু চিন্তা করে সে বলল—‘আমার মনে হয় বাঘটা এখন ঘুমোবে, তাই খেয়ে-দেয়েই নালার মধ্যে ঢুকেছে।’
ওনডির কথায় ভরসা করা যায়। দেরি না করে ম্যাকনিলি সঙ্গেসঙ্গে ছুটল তাঁবুর দিকে। হিমালয়ের ঢালে নানা রঙের বাহারি ফুলের মাঝে টানটান করে বাঁধা সাদা তাঁবু। সামনের ফাঁকা জমির ওপর দাঁড়িয়ে মজুমদার একটা হেলিকপ্টারকে হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছিল। এই হেলিকপ্টারটা ডাকের চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া করে। ম্যাকনিলিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে দেখে সে একটু অবাক হল—‘কী ব্যাপার! কী হল আবার…’
‘একজনের সাথে জরুরি দেখা করার কথা। তাই একটু তাড়াতাড়ি করছি।’ উত্তর দিল ম্যাকনিলি।
‘দেখা করার কথা? এখানে? কার সাথে?’ মজুমদার বেশ কিছুটা অবাক।
‘মানে, ওই একটা বাঘের সঙ্গে আর কী…’ খুব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দেওয়ার মাঝেই কাজ করে যাচ্ছিল ম্যাকনিলি। হাতের ধনুকটা দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখে সে পঁচাত্তর পাউণ্ডের ধনুকে গুণ পরাতে বসল। আগেই বলেছি, পঁচাত্তর পাউণ্ডের দুটো ধনুক ছিল ম্যাকনিলির। তাদের মধ্যে ইস্পাতেরটা সে আনিয়েছিল সুইডেন থেকে, আর কাঠের ধনুকটা সে বানিয়েছিল তার পছন্দমতো অর্ডার দিয়ে ইংল্যাণ্ডের এক পাকা কারিগরের থেকে। রাজদর্শনে যেতে হলে সব দিক দিয়ে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া ভালো। তাই এখন সে তার প্রিয় কাঠের ধনুকটাই বেছে নিয়ে গুণ পরিয়ে নিল।
নালার কাছে পৌঁছে একটা গাছের তলায় কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করে নিল ম্যাকনিলি। এতটা পথ দৌড়ে যাওয়া-আসা করে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এখন কিছুটা দম নিয়ে নেওয়া দরকার। বাঘের মুখোমুখি হতে গেলে প্রথমেই দরকার ঠাণ্ডা মাথা, শান্ত স্নায়ু। উত্তেজনার লেশমাত্র যেকোনও সময়ে মারাত্মক বিপদ ঘটাতে পারে।
দম নিয়ে তৈরি হওয়ার পর ম্যাকনিলি এবার ওনডিকে বিদায় দিল, ‘ঠিক আছে, এবার তাহলে তুমি যেতে পারো ওনডি।’
ওনডিকে সঙ্গে না নেওয়ার কারণ আছে। পথপ্রদর্শক হিসাবে ওনডি যতখানি ওস্তাদ, বন্দুক ছোড়ায় সে ততটাই আনাড়ি। আর মজার কথা হল, ওনডি নিজেও একথাটা জানত। তাই ম্যাকনিলির কথায় কোনো প্রতিবাদ করল না সে। শিকারের সময় আনাড়ি লোক সঙ্গে রেখে অযথা বিপদের ঝুঁকি বাড়িয়ে লাভ কী?
এবার ধীরে ধীরে নালার পাশে এসে দাঁড়াল ম্যাকনিলি। নালার দুটো পাড় খাড়া হয়ে উঠে গেছে—দু-দিকেই ঝোপঝাড় ভরতি। ফলে বাঘের পালাবার পথ বন্ধ। মুখোমুখি লড়াইয়ে তাকে নামতেই হবে।
নালার জল বরফের মতো ঠাণ্ডা। দুরন্ত স্রোত, কিন্তু কোথাও খুব একটা গভীর নয়। পায়ের গোড়ালির বেশি ডোবে না। নালা পেরিয়ে অপর পারে গিয়ে ম্যাকনিলি একটা পাথরের টুকরো তুলে নিল। নালার প্রান্তে একটা বড়ো ঝোপ। ম্যাকনিলির বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওই ঝোপের মধ্যেই বিশ্রামের আয়োজন করেছে বাঘ। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিয়ে সে এবার পাথরের টুকরোটা ছুড়ে দিল ঝোপ লক্ষ্য করে, আর ঠিক সেই সময়ে ঝোপের দিক থেকে বয়ে-আসা একঝলক বাতাসে তার নাকে এসে লাগল বাঘের গায়ের উগ্র গন্ধ। পাথরটা গিয়ে পড়ল ঝোপের মধ্যে। ততক্ষণে পিঠের থেকে তির টেনে নিয়ে ধনুকে জুড়ে ফেলেছে ম্যাকনিলি।
ঝোপের মধ্যে বাঘ একটু দিবানিদ্রার আয়োজন করছিল। ম্যাকনিলির ছোড়া পাথরের টুকরো তার সেই নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। বিরক্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তার রাজত্বে ঠিক এই ধরনের বেয়াদবি সহ্য করতে সে অভ্যস্ত নয়। মৃদু গর্জনে বিরক্ত প্রকাশ করে সে বেরিয়ে এল ঝোপের বাইরে। বেরিয়ে এসে একটা অতিকায় বেড়ালের মতো সামনের দু-পা ছড়িয়ে প্রথমে শরীরের আড়মোড়া ভাঙল, মাটি আঁচড়াল বার কয়েক, তারপর মাথা তুলে তাকাল। অত্যন্ত ধীরস্থির ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি বরফের মতো ঠাণ্ডা।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে ম্যাকনিলি তাকিয়ে দেখল যে ধনুকে সে ভুল তির জুড়ে বসে আছে!
মাত্র কুড়ি গজ দূরে দাঁড়িয়ে জান্তব মৃত্যু। ম্যাকনিলি সাধারণত ওই কুড়ি গজ দূরে একটা সিগারেটের প্যাকেট রেখে তার মধ্যে দিয়ে অব্যর্থ লক্ষ্যে পরপর ছ-টা তির চালিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে একটু অন্যরকম।
যে তিরটা ম্যাকনিলি জুড়ে বসেছে, এটা পঞ্চাশ পাউণ্ডের ধনুক থেকে ছোড়ার পক্ষে একটা আদর্শ তির সন্দেহ নেই, কিন্তু পঁচাত্তর পাউণ্ডের ধনুক থেকে ছুড়লে এ তির ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না; কেঁপে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে। আর এখন তির পালটাবার প্রশ্নই ওঠে না, বাঘ এসে পড়েছে কুড়ি গজের আওতায়। ম্যাকনিলির সমস্ত শরীর বেয়ে বয়ে গেল একটা আতঙ্কের শিহরন। তবু সেই আতঙ্কের মাঝেই ধনুকে আকর্ণ গুণ আকর্ষণ করল ম্যাকনিলি। তিরের ফলা চেপে বসল তার প্রসারিত বাঁ-হাতের মুঠোর ওপর, ছিলার দু-পাশ থেকে বেরিয়ে আসা লেজের পালকগুলো এসে ঠেকল তার গালের পাশে।
বাঘের আক্রমণের ধারাটা জানা ছিল ম্যাকনিলির। পারতপক্ষে বাঘ সোজাসুজি আক্রমণ করে না, সবসময় চেষ্টা করে ঘুরে গিয়ে পিছন থেকে শত্রুকে কাবু করতে। এখানে সে সুযোগ নেই, তবু একটু ঘুরে এসে সে গুঁড়ি মেরে বসল। আক্রমণের পূর্বাভাস বলতে ওইটুকুই। আর কোনো সংকেত নেই—নেই লেজের আন্দোলিত আস্ফালন, নেই দুই ঠোঁঠের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে আসা হিংস্র দাঁতের সারি, নেই অবরুদ্ধ গলার চাপা গর্জন। এককথায়, এই বাঘটা যেন অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা মানে শান্ত নয়, পেশাদার খুনির মতোই ভাবলেশহীন।
ম্যাকনিলিও ঘুরে গিয়ে বাঘের মুখোমুখি হল। মুহূর্তমাত্র! পরক্ষণেই হলুদ-কালোর ডোরাকাটা একটা বিদ্যুৎ উড়ে এল ম্যাকনিলির দিকে। ওই উড়ন্ত বিদ্যুৎ ঝলকের মাঝে লক্ষ্য স্থির রাখা সোজা কথা নয়। তবু ম্যাকনিলির চোখে পলকের জন্য ধরা দিল হলুদ-কালোর মাঝখানে একফালি সাদা অংশ—বাঘের বুক আর পেট! সেই অংশটুকু লক্ষ্য করেই তির ছেড়ে দিল ম্যাকনিলি, আর সেই সঙ্গে ডান দিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল বাঘের উদ্যত আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। তবু শেষরক্ষা হল না। চকিতের জন্য ম্যাকনিলি অনুভব করল, যেন একটা কঠিন রবারের প্যাডের ওপর বসানো কয়েকটা ধারালো ছুরির ফলা তার কপাল ছুঁয়ে গেল—বাঘের থাবার স্পর্শ! ছিটকে পড়ল সে মাটির ওপর। মাটিতে শুয়ে প্রতিমুহূর্তে ম্যাকনিলি অপেক্ষা করছিল মৃত্যুর জন্য; এখনই যেকোনও সময়ে বাঘের নখ আর দাঁতের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তার দেহ…।
কিন্তু কই, আঘাত তো এল না। ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ম্যাকনিলি। সারা দেহ তার অক্ষত ঠিকই, কিন্তু চোখের সামনে যেন ঝুলছে একটা পরদা; পরিষ্কারভাবে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। ম্যাকনিলির বুঝতে অসুবিধা হল না ওই পরদার উৎস কোথায়? বাঘের থাবা তার কপালের ওপর ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করেছে।
পরীক্ষা করার জন্য হাত দিয়ে ক্ষতস্থান স্পর্শ করতেই অসহ্য যন্ত্রণার একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার কন্ঠ ভেদ করে; এক ঝটকায় মাথাটা পিছন দিকে সরিয়ে নিল সে। আর চোখের সামনে কালো পরদাটাও সরে গেল তখনি, অবশ্য দু-এক সেকেণ্ডের জন্য, তারপরই আবার নেমে এল পরদা। কিন্তু ম্যাকনিলি এবার বুঝতে পারল ক্ষতটা কী ধরনের। আসলে বাঘের থাবায় ওই অল্প একটু আঁচড়েই তার কপালের বেশ খানিকটা চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে ঝুলে পড়েছে দুটো চোখের ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে ম্যাকনিলি সেই ঝুলে-পড়া চামড়াটাকে হাত দিয়ে চেপে ধরল যথাস্থানে। এবার পরিষ্কার দেখতে পেল সে—একটু দূরেই পড়ে আছে বাঘ—নিস্পন্দ, মৃত। কাত হয়ে পড়ে থাকা তার শরীরের মধ্যে আমূল বিঁধে রয়েছে তিরটা। শুধুমাত্র পালকগুলো ছাড়া তিরের আর কোনো অংশই দেখা যাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে নালাটা পার হল ম্যাকনিলি। কিন্তু বরফের মতো ঠাণ্ডা জল এবার তার মধ্যে কোনো অনুভুতিই জাগাল না—তার সমস্ত শরীর-মন জুড়ে তখন শুধু এক তীব্র যন্ত্রণার স্বাদ।
কিছুদূর গিয়েই ওনডির দেখা মিলল। ‘বাঘটা মরে পড়ে আছে, তুমি আমার ধনুক আর তিরগুলো একটু গুছিয়ে নিয়ে এসো,’ এর বেশি আর কোনো কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না ম্যাকনিলির।
তাঁবুতে যখন ম্যাকনিলি ফিরল তখন হিমালয়ের কোল ঘেঁষে সন্ধ্যা নেমে আসছে। তাঁবুতে ফিরে দেখা হল মজুমদারের সঙ্গে।
‘শেষ পর্যন্ত তির দিয়েই বাঘটাকে মারলাম, বুঝলে মজুমদার,’ বলল ম্যাকনিলি, ‘তবে ওটা ভুল তির ছিল।’
ওই একটিমাত্র কথা, তারপরই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূর্ছার অন্ধকার।
পরে নিজের জীবনের এই কাহিনি কোনো বন্ধুকে বলতে বসলে ম্যাকনিলি বলত, ‘আমার এই গল্পটা থেকে একটা শিক্ষা অন্তত নেওয়া উচিত—তা হল একান্তই যদি কখনো তির-ধনুক দিয়ে বাঘ শিকার করতে হয় তবে নিদেনপক্ষে তিরটা একবার ভালো করে পরীক্ষা করে নেওয়া বড়ো দরকার। নয়তো, চরম মুহূর্তে আমার মতো ঘটনা ঘটলে, ভাগ্য ছাড়া তোমাকে আর কেউ যে নতুন করে পৃথিবীর আলো দেখাবার বন্দোবস্ত করতে পারবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’