ভুলভুলাইয়া
ভাঙা তক্তপোশটা ঠুকে জোড়া দিতে গিয়ে ডায়েরির জিরজিরে খাতাটা চোখে পড়ল। কীভাবে কে জানে সেটা তক্তপোশের একটা পায়ার ভেতরের দিকে ঠুসে দেওয়া ছিল। ঠোকাঠুকিতে নড়ে গিয়ে ঝুপ করে মাটিতে পড়ল। অনিরুদ্ধ সেটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখল; তাতে ওর কৌতূহল বিশেষ মিটল বলে মনে হল না। শেষে ডায়েরিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখুন তো শংকরদা, এটা কী ভাষা!
ডায়েরিটাকে কেন ডায়েরি ভাবলাম সেটা আগে বলি। ভেতরে কী ছাই লেখা আছে সেটা তো পরের কথা, খাতাটা আসলে অনেক দিনের এক ডায়েরিই। পাতায় পাতায় নকশা করে তারিখ ছাপা। তারপর এধার থেকে ওধার রুল টানা। কিন্তু হাতের লেখা খুদে হরফের বলে একজোড়া লাইনের মধ্যেই দু-লাইন করে লেখা। সেটা পাতা বাঁচানোর জন্য ততটা নয় যতটা হস্তলিপির ধারা বজায় রাখার জন্য। কারণ অনেক পাতাতেই লম্বা লম্বা জায়গা বাদ রাখা হয়েছে। ভাষা নিয়ে অনিরুদ্ধর ধন্দ কেন হয়েছে তাও বুঝলাম ডায়েরিটা হাতে নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ না বুলোলে ধরাই সমস্যা যে লিখিত ভাষাটা আসলে ইংরেজিই।
আসলে হাতের লেখার চলনটা বেশ অদ্ভুত। মাঝে মধ্যে ইংরেজির বানানগুলোও ততোধিক অদ্ভুত। যেমন ইংরেজি normal বানানটা লেখা হয়েছে normale, order বানানটা ordre, এবং আরও বিদঘুটে sky বানান skail এরকম যে কত তা পাতা চারেক ওলটাতে দিব্যি টের পেলাম। ক্রমে লেখাটা পড়তে পড়তে পরিষ্কার বুঝলাম যে, লেখক অ-ইংরেজ। যদিও ইংরেজি ভাষাটার ওপর পরিচ্ছন্ন দখল আছে। বস্তুত সেজন্যই তাঁর ইংরেজিটা বেশ সরল এবং বাগধারাবর্জিত, বলার ধরনটা নিটোল বর্ণনামূলক। এবং মানতেই হচ্ছে, একজন অ-ইংরেজের ইংরেজি হিসেবে রীতিমতো সুখপাঠ্য।
কিন্তু লেখকটি কে? নামটা কী? লেখাটা পড়ে ফেলার অদম্য কৌতূহল দমন করেই নামের তল্লাশি শুরু করলাম। তখনই অনিরুদ্ধ বলল, কাগজের মলাটটা ছিঁড়ে ফেলুন, নাম থাকলে ওখানেই থাকবে।
মন্দ বলেনি ছোকরা। আমি এবার মলাটটা ছিঁড়ে ফেললাম। আর অমনি জ্বলজ্বল করতে লাগল ধূসর রঙের মলাটের ওপর লাল কালিতে লেখা নাম-ডা. নিকোলা ফেরি। আমি বললাম, অনিরুদ্ধ, এ যে ইটালিয়ান সাহেব গো! ও রীতিমতো চমকে গিয়ে বলল, সে কী! লখনউয়ের চৌক পল্লিতে ইটালিয়ান সাহেব! তাও এরকম একটা এঁদো, ঘিঞ্জি মকানে! আমি মলাট ছেড়ে ফের ভেতরের পাতায় ঢুকলাম আর শুনলাম অনিরুদ্ধ দার্শনিকের মতো আপন মনে বলছে, তা না-হওয়ারই বা কী আছে! হাজার হোক কলম্বাস আর মার্কো পোলোর জাত তো! আর ততক্ষণে আমার চোখ আটকে গেছে একটা অদ্ভুত বাক্যে, যেন চিটে গুড়ে পিঁপড়ে।
সাহেব সেখানে লিখছেন—একটা গোটা পাতায় শুধু একটি বাক্য!—’আমি কাল রাতেও রৌশন বাইয়ের পায়ের ঘুঙুরের ধ্বনি শুনেছি আমার মাথার পাশে যদিও ঘরের দরজা এবং দুটো জানালাই পাট পাট করে আটকানো ছিল।
সাহেব নয়, এবার আমারই ঘুম ছুটে যাওয়ার পালা। অনিরুদ্ধকে বললাম, তোমার ওই বিজ্ঞানের বইটাকে সুটকেসে ভরে ফেলো। এখন থেকে শুধু এটাই পড়তে হবে। ও একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে? আমি ভোলা পাতাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, কিছু বুঝছ?
ও ওই বাক্যটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষে ওর দাড়ি-গোঁফে আচ্ছন্ন মুখে একটা নিষ্পাপ আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। আমার মনে হল আমি মাথার ভেতরে এরই মধ্যেই নূপুরনিক্কণ শুনতে পাচ্ছি।
২.
নিকোলা ফেরির লখনউ বাসের সময়টা বাস্তবিকই চাঞ্চল্যকর। ডায়েরির একটা বিশেষ দিনের কথা শুরু হচ্ছে এভাবে :
কাল থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। ছেলেবেলায় সেটোনিয়স, লিভি, পোল্লিয়ো, প্লুটার্ক প্রমুখ ঐতিহাসিকের রচনায় রোমক শাসকদের খুন বা মৃত্যুর কথা পড়ে রোমাঞ্চিত হতাম। কিন্তু কখনো ভাবিনি স্বচক্ষে একজন নৃপতির বিতাড়ন দেখতে পাব। এটা একেবারেই কোনো বাঞ্ছনীয় দৃশ্য নয়। কাল লখনউয়ের সিংহাসনচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে তাঁর প্রিয় শহর থেকে বিতাড়িত হতে দেখলাম। নবাব মিছিল করে শহরের কয়েকটি পল্লি ভ্রমণ করে জলপথে রওনা হলেন কলকাতার দিকে। শহরের মানুষ এই দৃশ্য দেখে বিহবল বোধ করছিল। একজন নবাবের মুখ যে কত করুণ হতে পারে তা কাল ওয়াজেদ আলি শাহের মুখ না দেখে থাকলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমি নিজেও কি তা পারতাম? সাহিত্যে পড়েছি জ্বলন্ত ট্রয় নগরী থেকে ঈনিয়স পিঠে তাঁর পিতাকে বহন করে মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন। সেই দৃশ্য কল্পনা করে খুবই উদবেল হয়েছি, কিন্তু বাস্তবে সে-দৃশ্য যে কত মর্মান্তিক হয় তা কাল বুঝলাম। সেই থেকে মনে মনে খুব দুঃখী হয়ে আছি।
ডায়েরির এই এন্ট্রিটা পড়ার পর আমি আর অনিরুদ্ধ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বসে রইলাম। অনিরুদ্ধ বলল, শংকরদা, এ তো উপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর হয়ে দাঁড়াবে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, ইতিহাস সেভাবে লেখা হলে তা-ই তো হয়। অনিরুদ্ধ ওর লম্বা চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, কিন্তু এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ডায়েরি ভদ্রলোক এভাবে ফেলে রেখে গেলেন কেন—সেটাও ভাবার। আর এতকাল ধরে বস্তুটি কেনই বা থেকে গেল এহেন এক বারোয়ারি ঠেক-এ তাও চিন্তার বিষয়। আমার কেন জানি না মনে হল এবং সেটাই বলে ফেললাম তড়িঘড়ি, সেসব প্রশ্নের জবাবও নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে ডায়েরির কোথাও না কোথাও।
আর যায় কোথায়! অনিরুদ্ধ তৎক্ষণাৎ খাতাটা তুলে সরবে পড়তে লাগল একেবারে গোড়া থেকে। আমারও কথা বন্ধ হয়ে গেল, আমরা লখনউয়ের এক পুরোনো, মলিন বাড়ির এক নির্জন ঘরে বসে সাহেবের রচনার দাক্ষিণ্যে নিক্ষিপ্ত হলাম এক ভিন্ন সময়ে, শহরটার এক বিস্মৃত-রূপ-রস-পরিবেশে। আমরা দুজনেই ভুলে গেছি আমরা লখনউয়ে এসেছি শহরটাকে নিয়ে এক বিস্তৃত ভ্রমণরচনা লেখার বরাত নিয়ে। ভ্রমণ একটা হচ্ছে বটে, এবং তা ওই লখনউয়েই; কিন্তু সে-লখনউ ছড়িয়ে আছে তার অজস্র প্রাচীন ইমারতে, কিছু প্রবীণ মানুষের চেহারা-চরিত্র-মেজাজে এবং একটি অজ্ঞাত পরিচয় বিদেশির স্মৃতি-আলেখ্যে, অনিরুদ্ধর হাতে ধরা নিকোলা ফেরির ডায়েরিতে। শুনলাম অনিরুদ্ধ পড়ছে :
ইংরেজরা এ-শহরে দাপিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু এর রোমাঞ্চ ও আবেদনের স্বাদ বিশেষ পায় না। লখনউয়ের একটা স্ফুর্তি ও প্রাণের বিস্তার আছে যা একজন ইটালীয় হিসেবে আমি ক্ষণে-ক্ষণে অনুভব করি। ইটালীয় বা ফরাসিরাই লখনউয়ের প্রকৃত কদর করার উপযুক্ত মানুষ, যদিও ইংরেজদের মতো এত নিয়মানুবর্তীভাবে তারা এখানকার ব্যাপার-স্যাপারের তদারকি করতে পারত কি না সন্দেহ।
শহরটা যে খুব প্রাচীন তা নয়। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য গত তিরিশ-চল্লিশ বছরের মধ্যেই হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে এর একটা প্রাচীন-প্রাচীন চেহারা ও মেজাজ তৈরি হয়েছে। বিকেলে রোদ যখন নরম হয়ে আসে আমি শহর পাক দিতে বেরোই। আর মনটা যেন এক অপরূপ বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আমি নরম রোদে গোমতী নদীর পাশে গিয়ে বসি। নবাবদের আহ্লাদের বাগান দেখি। ফেরার পথে চৌকের মোড়ে করিমের দোকানে মাংস-পরোটা খাই। তারপর এক খিলি পান। শেষে তুলোয় করে কিছুটা আতর কানে খুঁজে এখানকার বিস্ময়কর সব বাইজিরই কোঠার নীচে দাঁড়িয়ে গান শুনি। হারমোনিতে অভ্যস্ত আমার পাশ্চাত্য কানে প্রথম প্রথম এদের মেলোডিনির্ভর গানের ধারা একটু দুর্বোধ্য এবং কিছুটা ক্লান্তিকর ঠেকত। কিন্তু গত ছ-মাস ধরে শুনে শুনে এখন বেশ আরামদায়ক এবং আকর্ষণীয় ঠেকে। অনেকেই কৌতূহলের সঙ্গে আমার দিকে তাকায়, কিন্তু রাজকাজে নিরত ইংরেজ মনে করে ঘাঁটাতে সাহস পায় না।
এতে আমার সুবিধেই হয়। আমাকে অযথা বাক্যব্যয় করতে হয় না এবং আমি বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে যখন এখানকার হেকিমি ওষুধ নিয়ে উপযুক্ত লোকদের প্রশ্ন করি তারাও অযথা প্রশ্ন না করে যা জানানোর জানিয়ে দেয়। এভাবে আমি হেকিমি চিকিৎসার অনেক কিছুই জেনে গেছি। রোমে ফিরে এই চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অঢেল লাভ হওয়ার আশা আছে। আজও ইটালিতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে সবিশেষ বিস্ময় ও কৌতূহলবোধ আছে। ফলে এই চিকিৎসা ও ঔষধের উপকার আমি পাবই। কিন্তু সেসব অনেক পরের কথা।
অনিরুদ্ধ এবার পড়া থামিয়ে প্রশ্নসূচকভাবে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, ঠিক বলেছি কি না? ডায়েরির মধ্যেই লেখক লুকিয়ে আছেন। অনিরুদ্ধ বলল, কিন্তু ওঁর লেখা পড়ে তো মনে হচ্ছে আমরাও এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। জিজ্ঞেস করলাম, তাতে লাভ? সে লখনউ কি আর আছে? অনিরুদ্ধ বলল, কিন্তু সেই খুঁজে বেড়ানোটাই লাভ হবে। তাই? স্বীকার করতেই হল ছেলেটার মগজ আছে। হারিয়ে যাওয়া শহরটাকে খুঁজতে খুঁজতেই তো চমৎকার একটা ভ্রমণ হয়ে যাবে। অনিরুদ্ধ যোগ করল, সেই সঙ্গে রসদও জোগাড় হয়ে যাবে আমাদের লেখাটার।
অনিরুদ্ধ ডায়েরি বন্ধ করে ফেলেছে। আমরা আর সময় ব্যয় না করে বেরিয়ে পড়লাম পুরোনো লখনউয়ের খোঁজে। থুড়ি, ডা. নিকোলা ফেরির লখনউয়ের খোঁজে।
বাইরে যেন বিকেলের রোদ নরম হয়ে এসেছে।
৩.
বিকেলের রোদে আমরা বসে বসে গোমতী নয়, ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম ইংরেজদের বাস এবং কর্মকেন্দ্ৰ রেসিডেন্সি। অনেকটাই প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, প্রভূত যত্ন করে সেসব নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। বাড়ির চেহারা-চরিত্র পাক্কা ইংরেজ, এই রেসিডেন্সি আক্রমণের ঘটনা নিয়ে লেখা কবি টেনিসনের কবিতা বড়ো ব্লো-আপ করে টাঙানো আছে দেয়ালে। যেসব গোলা এসে আছড়ে পড়েছিল বাড়িটায় তার কিছু কিছু সংগ্রহ করে সাজিয়ে রাখা আছে এখানে-ওখানে। অনিরুদ্ধ তেমন একটা গোলা হাতে তুলে বলল, বাপরে! এই পদার্থ বুলেটের মতো এসে পড়লে কী কেলেঙ্কারিটাই যে হয়
আমি বললাম, এরকম একটা গোলাতেই এই ঘরে মারা পড়েছিল এক যুবতী।
ব্যাপারটা আমার আবিষ্কার নয়, দেওয়ালেই সেই তথ্য মুদ্রিত হরফে ঝোলানো আছে। সেনানায়ক লরেন্স কীভাবে এই রেসিডেন্সির প্রতিরক্ষা করেছিলেন তারও বর্ণনা আছে।
এরপর বাড়ির তলার সুড়ঙ্গ পথ ধরে আমরা নামছিলাম। সেই সিঁড়ি ধরে অন্ধকারে নামতে নামতে হঠাৎ কেন জানি না মনে পড়ে গেল ফেরির ডায়েরিটা। চোখের সামনের সব বাস্তব, সব ইতিহাসের চেয়ে ঢের বেশি ঔৎসুক্য তৈরি হয়ে গেছে ফেরি বর্ণিত পুরোনো লখনউয়ে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে এগোতে অনিরুদ্ধকে বললাম, বাসায় ফিরে একবার দেখলে হয় ফেরি কী লিখে গেছেন রেসিডেন্সি নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে অবাক করে ছোকরা বলল, ঠিক একথাটাই ভাবছিলাম একটু আগে। ভীষণ ইচ্ছে করছে ঘরে বসে আরও পড়ি সাহেবের খাতাটা। তাতে শহরটা সম্পর্কে খানিকটা গবেষণাও হয়ে যাবে।
রেসিডেন্সির ফটক পেরোচ্ছি যখন আমরা, তখন আমিই তুললাম কথাটা : ফেরি শহর বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতেন করিমের দোকানে মাংস-পরোটা খেয়ে। আমরাও তাই করি কী বলো?
অনিরুদ্ধ বলল, তারপর চলুন পান খাই। একটু গন্ধ মাখি। তারপর গিয়ে দাঁড়াই কোনো বাইজির বাড়ির তলায়। আর গান শুনি।
শেষের কথাগুলো বলার সময় অনিরুদ্ধর গলা একটু ধরে এল। কারণটা সুবোধ্য। সবই ঠিক আছে, কিন্তু বাইজির গান শোনা সম্ভব নয়, কারণ গোটা লখনউয়ে একটিও বাইজি নেই আর। ১৯৫৮-য় আইন করে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বাইজিদের গান-বাজনা, নাচ, মুজরা। মুজরা বা জলসা বসালে আইনের দন্ডভোগ করতে হবে। তাই শহরের এক পুরোনো বাই-ঘরের শেষ প্রতিনিধি জারিনা বাইয়ের সঙ্গে লেখার ব্যাপারে কথাবার্তা হলেও তাঁর গান শোনার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।
আমি বললাম, গান না শুনতে পাই, জারিনা বাইয়ের কাছে পূর্বের দিনের কিছু কাহিনি অন্তত শুনতে যেতে পারি। তাই না? অনিরুদ্ধ হাসল। বলল, সেটা মন্দ বলেননি, শংকরদা।
আমাদের সিঁড়ি ধরে উঠতে দেখেই লখনউয়ের উষ্ণ আতিথ্যের কণ্ঠে বলে উঠলেন জারিনা বাই, আইয়ে পরিয়ে। আসুন, বসুন। কী মনে করে হঠাৎ? আমরা ঘর অবধি উঠে এসে বললাম, এই এলাম আপনার সঙ্গে একটু গল্প করতে। ভদ্রমহিলা বালিকার মতো মুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন, হায় আল্লাহ! গল্প শুনতে আমার কাছে? আমি আবার কী গল্প বলব? আমার গল্প তো সাবেক দিনের বড়ড়া বড়ো গায়িকা, নর্তকীদের নিয়ে। সে অতশত শুনে আর আপনাদের কী লাভ? অনিরুদ্ধ বলল, সেই গল্প শুনব বলেই তো আসা। জারিনা বাই খুশি হয়ে বললেন, তা হলে বসুন। আমি একটু চা আর পানের ব্যবস্থা করতে বলে আসি।
জারিনা ফিরে এলেন, একটু পরে চা আর পান এল। তিনি ভালো করে গালিচায় গুছিয়ে বসে বললেন, বলুন, কোন গায়িকার কথা জানতে চান আপনারা?
আমি তেমন কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই বলে বসলাম, রৌশন বাইয়ের কথা। অমনি বড়ো বড়ো চোখ করে মহিলা বললেন, হায় আল্লাহ! রৌশন বাই তো তিনজন ছিলেন লখনউয়ে। একজন আমার মায়ের মাসি। তিনি একজন সাধুবাবার ভক্ত হয়ে বেনারসে ভজনগায়িকা হয়ে যান। তাঁরও অনেক আগে ছিলেন এক রৌশন আরা বাই যিনি নবাব বংশের ফতেহ আলি খাঁর মেহফিলে গান গেয়ে এত নাম করেছিলেন যে, নবাব তাঁকে গাইতে বারণ করে দেন। শুধু তাঁরই জন্য গাইতেন রৌশন আরা। ফলে পৃথিবীর কাছে তাঁর পরিচয় মুছে যায়। আর ছিলেন এক রৌশন বাই নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সময়…
এইবার জারিনা বাই একটু চুপ করলেন। যেন গর্হিত কোনো বিষয় নিয়ে বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অনিরুদ্ধ ছাড়বার পাত্র নয়। খেই ধরাবার জন্য বলল, হ্যাঁ, আর ওই তৃতীয় রৌশন বাই। জারিনা কিন্তু তারপরও চুপ করে রইলেন, বিষয়টা নিয়ে কিছু বলায় বেশ অনীহা দেখা গেল তাতে! একটু পর জারিনা বললেন, থাক না আজ ওই রৌশনের কথা। আমি বললাম, কেন, কোনো অসুবিধে আছে? জারিনা মুখে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব করে বললেন, অসুবিধে ঠিক না। তবে সন্ধ্যের দিকে …
আমি আর অনিরুদ্ধ দু-জনেই একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম কথাটায়। অনিরুদ্ধ আর উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলেই ফেলল, কেন, কোনো খারাপ, অশুভ ব্যাপার আছে নাকি ওর গল্পে? জারিনা বললেন, গল্প তো নয়, সবই সত্যি। তবে ঘটনাটা তো খুব ভালো নয়।
এবার আমার আর উত্তেজনা চেপে রাখার উপায় রইল না। বললাম, কেন, কোনো খুন টুনের ব্যাপার ছিল?
-না, খুন নয়। আত্মহত্যা।
—আত্মহত্যা? তা সেকথা বলতে অসুবিধে কী?
আসলে সেই থেকে রৌশনের আত্মা চৌক পল্লি ছেড়ে যায়নি। এখনও লোকে বলে যে, ওর কথা সূর্য ডোবার পরে তুললে রাতে ও ফিরে আসে চৌকে।
এবার অনিরুদ্ধ আর আমি দু-জনেই চমকে উঠে বললাম, সে কী! এই সওয়া-শো বছর পরেও সে ফিরে আসে? জারিনা একটা স্লান হাসি হেসে বললেন, আসে। সেজন্যই তো চৌকের একটা বাড়ির ঘর আজও ভাড়া হয় না। বছরের পর বছর খালি কোঠা হয়ে পড়ে আছে। কেউ এক রাতও সেখানে থাকেনি বহুকাল।
জিজ্ঞেস করলাম, চৌকের কোন বাড়ি সেটা? জারিনা বললেন, চৌকের যে গলি দিয়ে ঢুকে আমাদের এই ‘মুনির মঞ্জিল’-এর দিকে আসেন সেই বাঁকের থেকে একটু পশ্চিমে। নীচে একটা গয়না, তামাক আর গন্ধের দোকান আছে। ওই ঝরঝরে বাড়িটার তিনতলার ঘর সেটা। গোটা তিনতলায় ওই একটাই ঘর।
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার চলাচল শুরু হয়ে গেছে। আমি আর অনিরুদ্ধ চোখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। জারিনা যে ঘরটার কথা বলছেন সেই ঘরের বাসিন্দা আমরা গত তিনদিন। আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ওই ঘরেই কি থাকতেন রৌশন? জারিনা মাথা নেড়ে বোঝালেন ‘না। মুখে বললেন, ওখানে থাকতেন এক বিলাইতি সাহাব। ডাক্তার ছিলেন। রৌশনের চিকিৎসা করেছিলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। পরে রোজ রাতে রৌশনকে দেখতেন, ওঁর ঘরে নাচের পোশাক আর ঘুঙুর পরে আসত রৌশন। শেষে …
অনিরুদ্ধ অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করল, শেষে? জারিনা হাতজোড় করে বললেন, না থাক, বাবুসাহেব। সন্ধ্যের পর ওসব কথা বলতে চাই না। আমার ক্ষতি হবে। ছেলেপুলে নিয়ে বাস করি। রাতে অশুভ ব্যাপার চাই না এখানে।
আমরা আর জোরাজুরি করলাম না। চা আর পান খেয়ে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে অনিরুদ্ধকে বললাম, এখন তা হলে ঘরে ফিরে ডায়েরি চর্চা হোক? আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সোৎসাহে ও বলল, সে আর বলতে! এইমাত্র যা শুনলাম তারপর ওই ডায়েরি ছাড়া আর কোনো কিছুতেই আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
ছেলেটার এই ব্যাপারটাই আমার খুব ভালো লাগে, আমার সঙ্গে মেলে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও অলৌকিকের প্রতি এক দুর্বার টান।
ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতে কিন্তু আলো জ্বলল না। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। অনিরুদ্ধ বলল, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো, শংকরদা? বললাম, আমিও তো সেটাই ভাবছি। ডুমটা কাটল তো? অনিরুদ্ধ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার আলোয় বালবটা খোলার চেষ্টা শুরু করল।
আমি স্পষ্ট গন্ধ পেলাম একটা খুব দামি আতরের। যেন আশপাশেই কোনো মহিলা মজুদ আছেন। গন্ধটা একটু একটু করে চড়া হচ্ছে। বাইরে চৌকের রাস্তা থেকে হাঁক শোনা গেল বেলফুলওয়ালার। বেলফুল! বেলফুল! অথচ আমাদের এখন ভীষণ দরকার একটু আলো।
৪.
ডুমটা খুলে অনিরুদ্ধ দেশলাই জ্বালল। দেখা গেল বালবে কোনো গোলমাল নেই। তখন দু জনে মিলে ফের নামলাম একতলায় জব্বর খাঁর সেরেস্তায়। এবাড়ির নায়েব বলা যায় জব্বর খাঁকে। তিনিই কিছুটা মুখ ভেটকে বলেছিলেন, চৌক মহল্লায় কোনো কোঠা খালি পাওয়া যায়। না। আপনারা অন্য কোথাও হোটেলে থাকছেন না কেন? আমরা বলেছিলাম, সে তো আমরা চাইলেই থাকতে পারি। কিন্তু একটা কাজের জন্য চৌকের কোথাও একটা থাকা খুব দরকার। তখন ঝাঁঝিয়ে উঠে জব্বর বললেন, কিন্তু আমি কী করতে পারি, বাবুসাহাব?।
আমি ওঁকে শান্ত করার জন্য নরম করে বলেছিলাম, আমরা শুনেছি আপনার তিনতলার ঘরটা খালি থাকে সারাবছর।
-তা থাকে ঠিকই। কিন্তু ও ঘর কিরায় যায় না। এবার অনিরুদ্ধ বেশ শান্ত স্বরে বলেছিল, কিন্তু কেন?
—কারণ কিছু নেই। কিন্তু দিই না।
ঠিক তখনই আমি কড়কড়ে পাঁচটা এক-শো টাকার নোট ওঁর সামনে রেখেছিলাম। ভদ্রলোক একদিকে ইতস্তত করছেন, অন্যদিকে জুলজুল করে নোটগুলো দেখছেন। শেষে ঝটকা মেরে বললেন, ঠিক আছে থাকুন, কিন্তু দু-জনে থাকুন। একজনকে দেব না।
আমরা স্বস্তি বোধ করে বলেছিলাম, তা হলে চাবিটা দিন। এরপর জব্বরের সঙ্গে আসতে যেতে বার কয়েক দেখা হয়েছে। ভদ্রলোক যেন একটু অবাক হয়েই দেখেন আমাদের আর দস্তুরমতো বলে যান—সালাম আলেকুম। আমরাও দস্তুরমতো তাঁর সম্ভাষণ ফিরিয়ে দিই আলেকুম সালাম বলে। ভদ্রলোক আমাদের দেখে কী ভাবেন জানি না, কিন্তু আমরা ভাবি ওঁর এত অবাক হওয়ারই বা কী আছে! একটা তালাচাবি আঁটা ধূলিমলিন, করুণ চেহারার ঘর আশাতীতরকম বেশি টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়েছি, এই তো? তাতে এত অবাক হওয়ার কী আছে? কেবল টাকা পোড়াবার জন্য এটা করছি, তেমন বোকা গর্দভ তো আমরা নই।
কিন্তু এখন যখন সেরেস্তায় নেমে দেখছি কপাটে তালা ঝুলছে, এমনকী, জব্বরের নৌকর ছও ধারেপাশে কোথাও নেই তখন নিজেদের বোকা গর্দভ ভাবতে শুরু করেছি। ভাগ্যিস শীতকাল! না হলে ওই হাওয়াবন্ধ ঘরে তো সারারাত নেয়েধুয়ে যেতাম আমরা। লাইনের গন্ডগোল যখন, তখন সকাল হওয়া অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া তো উপায় নেই। ইচ্ছে ছিল। কম্বলের নীচে ঢুকে দু-জনে মিলে জমিয়ে ডায়েরি পড়ব; তা না, এখন মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুম লাগাতে হবে।
আমরা ফের পচা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে টুকটুক করে তেতলায় উঠলাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে যে-যার খাটে গিয়ে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলাম। অনিরুদ্ধ বলল, শংকরদা, আপনার কী মনে হয়? এ ঘরে কদ্দিন কেউ থাকেনি? আমি একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, বহু যুগ। তক্তপোশ এবং দেওয়ালের যা দশা। অবাক হব না যদি শুনি এই শতাব্দীতেই কেউ থাকেনি এ ঘরে। অনিরুদ্ধ ওর সিগারেটে আগুন ছোঁওয়াতে যাচ্ছিল, থেমে পড়ে বলল, বলেন কী!
বললাম, এখানকার মানুষের সংস্কার বড়ো প্রবল। কিছু একটা মাথায় গেঁথে বসলে তা থেকে নিষ্কৃতি নেই। তুমি তালাটা খেয়াল করে দেখোনি; অমন তালা এ শতাব্দীর জিনিস বলেই মনে হয় না। অনিরুদ্ধ এবার সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলে উদাস স্বরে বলল, ঠিকই বলেছেন। এই তক্তপোশও এই শতাব্দীর নয়, জলের কলসিটাও নেই নেই করে একশো বছরের পুরোনো হবে।
আমাদের কথার ধ্বনি ভেদ করে ঘরের মধ্যে ভেসে এল দূরে কোথাও বাজানো রেডিয়োতে আজকের দিনের হিন্দি ফিলমের গান। কীরকম একটা ছন্দপতনই ঘটে গেল যেন। বাই-ঠুংরির সেরা পীঠ লখনউয়ের চৌক পল্লিতে বোম্বাইয়ের খাজা গান! আমি ‘ধুত্তোর!’ বলে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে বললাম, আমরা ঘুম লাগাই, অনিরুদ্ধ। এই পরিবেশে, এই সুন্দর নীল অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আজগুবি হিন্দি গান শোনা অসম্ভব। এর চেয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুরোনো লখনউয়ের স্বপ্ন দেখাও ঢের শ্রেয়।
অনিরুদ্ধ বলল, যা বলেছেন। আমাদের লেখার পক্ষে এই জবরজং কান্ড হয়তো কাজে আসবে, কিন্তু মেজাজের পক্ষে বিপর্যয়। আমিও ঘুমোলাম, শংকরদা। সাতটার আগে ওঠা নেই।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম খেয়াল নেই, হঠাৎ মাথার কাছে একটা হিমেল হাওয়া। কম্বলের ভেতর থেকে কোনোমতে হাতটা গুটি গুটি বার করে কপালে রাখলাম। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম কপালে একটা ঈষদুষ্ণ বাতাসের ছোঁওয়া পড়ছে, যা শীতের রাতে একটা শিরশিরে ভাব ছড়াচ্ছে শরীরে। উষ্ণ হলেও হাওয়া তো, তায় শীতের রাতে। আমি উঠে বসে দেখতে পেলাম জানালা বন্ধ পায়ের দিকে, কিন্তু কপালে হাওয়া লাগছে কোত্থেকে এসে।
আর উঠে বসেই দেখলাম ঘরের অন্য তক্তপোশে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘাড় নীচু করে বসে আছে অনিরুদ্ধ। আমি উঠে বসেছি দেখে প্রশ্ন করল, ঘুম ভেঙে গেল, শঙ্করদা? বললাম, তুমিও তো জেগে আছ দেখছি?
—জাগব না? সেই কখন থেকে একটা বাতাস পড়ছে মাথায়!
—সে কী? তোমারও মাথায় বাতাস! আমিও তো সেইজন্যই জেগে পড়লাম। অনিরুদ্ধ চিন্তিত স্বরে বলল, কিন্তু ভেবে দেখেছেন কী যে পায়ের কাছে জানালা, অথচ মাথার ওপর হাওয়া নামছে? মাথার দিকের দেওয়ালে কি ফাটল ধরল নাকি?
ওর কথার জবাব দেওয়ার ফুরসত পাইনি, তার আগেই দু-জনের খাটের মাঝখানে একটা ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেলাম। অনেকক্ষণ চেপে রাখার পর নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে যেমনটি শোনায় কোনো নিঃশব্দ কক্ষে তেমন একটা নিঃশ্বাস আমাদের মাথার পাশ থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে পায়ের কাছে ঝরে পড়তে লাগল। তারপর নিঃশ্বাসটা চলতে শুরু করল আমার তক্তপোশের পায়ের দিকে এবং আসতে আসতে এগিয়ে এল আমার খাটের বাঁ-পাশে। অনিরুদ্ধ আর আমি দু-জনে এতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে বসেছিলাম, ধ্বনিটা আমার বাঁ-দিকে এসেছে দেখে ধরা গলায় অনিরুদ্ধকে বলতে শুনলাম, কী ব্যাপার বলুন তো, শংকরদা!
গলা শুকিয়ে এসেছে আমারও, তবুও দম নিয়ে বললাম, কেউ একটা ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছে বলে মনে হয় না? অনিরুদ্ধ বলল, ঠিক তাই! কিন্তু লোকটা ঢুকল কী করে ঘরে? নাকি আগে ঘরে ঢুকে বসেছিল? আমরা তো অন্ধকারে দেখিইনি খাটের তলায় কেউ কোথাও সেঁধিয়ে আছে কি না!
ফের নিঃশ্বাসটা এগিয়ে আসছে আমাদের খাটের মাঝখানে, মাথার দিকে। তারপর আওয়াজ হল কলসির মাথার গেলাস ওঠানোর, জল ঢালার, শেষে কলকল কলকল করে জল খাওয়ার। এ সময়ই আমরা আওয়াজ পেলাম চুড়ির। কলসির মাথায় গেলাস বসিয়ে ফের নিঃশ্বাসটা একটু একটু করে সরে যেতে লাগল পায়ের দিকে। যখন অনিরুদ্ধ চাপা স্বরে প্রশ্ন করে উঠল, কে! কে আপনি; সঙ্গে সঙ্গে আমিও বলে উঠলাম, কে? কে?
তৃতীয়বার ‘কে?’ বলা আর হল না। ততক্ষণে মৃদুমন্দ ঘুঙুরের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ছম ছম ছম ছম ছম … আমরা দুজনেই মাথার বালিশ বুকের কাছে টেনে নিয়ে টান টান হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেসে বসলাম। যেকোনো মুহূর্তে একটা অভাবনীয় কিছু হওয়ার আশঙ্কায় দু-জনেই স্তব্ধ হয়ে আছি। আমি অনুভব করলাম যে, ওই কঠিন শীতের রাতেও আমার কপাল জুড়ে ঘাম ঝরছে। কানের কাছগুলো অসম্ভব গরম হয়ে উঠেছে। আর পায়েলের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে মগজ জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে আমার হৃৎস্পন্দের আওয়াজ।
এরপরই একটা গোঙানির মতো আওয়াজ এল, ক্ষণিকের মধ্যে খেয়াল হল ওটা অনিরুদ্ধর কণ্ঠস্বর। ও কিছু বলতে যাচ্ছিল আমাকে, সেই কথাটাই গলায় আটকে গিয়ে গোঙানির চেহারা নিয়েছে। আমি উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, কী হয়েছে, অনিরুদ্ধ? কিন্তু আমার গলাতেও স্বর আটকে গেল। মনে হল আমিও গোঙাতে শুরু করেছি। শরীরটা কীরকম অবশ হয়ে আসছে, পিঠের বালিশ হেলে পড়ল, আমি বালিশটা টানতে গিয়ে শুনলাম অনিরুদ্ধ ধপাস করে শুয়ে পড়েছে ওর বিছানায়। আমিও কীরকম হড়কে হড়কে পড়ে যাচ্ছি খাটে। আর ঠিক তখনই আপনা থেকে জ্বলে উঠল ঘরের আলোটা অহেতুকভাবে। আমরা দুজনে দু-জনের দিকে চেয়ে বসে রইলাম।
আলোটা কেন নিভেছিল আমরা জানি না। কী করে এল তাও জানি না। কিন্তু কিছুক্ষণ যাবৎ যে প্রচন্ড ভয় আমাদের গ্রাস করেছিল তা নিমেষে উবে গেল নিঃশ্বাসটা মিলিয়ে যেতে এবং আলোটা ফিরে আসতে। একটা অশুভ উপস্থিতিই যেন মুছে গেল আলোয় আবির্ভাবে।
ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছিল আমার, কিন্তু ওই কলসি থেকে জল খেতে সাহস হল না। উপায়ান্তর না দেখে একটা সিগারেটই ধরালাম। অনিরুদ্ধ বলল, আমায়ও একটা দিন তা হলে।
দিলাম। দুটো সুখটান দিতেই বুঝলাম রাতের মতো ঘুম গায়েব হয়েছে। হাতঘড়িতে সময় দেখলাম রাত তিনটে। দু-একটা কাশি ঝেড়ে গলা পরিষ্কার করে বললাম, অনিরুদ্ধ, ঘুম তো গেল, মনে হচ্ছে। ও ম্লান হেসে বলল, তা তো গেল।
–তা হলে?
—তা হলে আর কী? সাহেবের ডায়েরিটাই পড়ন। আমি শুনি।
আমাকে ফের একবার চমৎকৃত করল ছেলেটি। ও কী করে, কী করেই যেন জেনে যায় আমি কখন কী চাই। আমি বললাম, অতি উত্তম প্রস্তাব। তা হলে শোনো, আমি পড়ছি। আমি পড়তে শুরু করলাম।
৫.
লখনউয়ের মানুষের মধ্যে একটা অসাধারণ সৌজন্যবোধ এবং বিনীত ভাব লক্ষ করি সারাক্ষণ, যেটা বেলজিয়ামের মানুষের মধ্যে খুব বেশিরকম নজরে আসে। এদের বিনয় ও ভদ্রতা নিয়ে মজার মজার সব গল্প চালু আছে। যার একটা হল খুব ধনী সম্প্রদায়ের লোকও কাউকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালে বলে ‘মেরা গরিবখানেমে যরাসা তসরিফ রখিয়েগা। তো এরকম একটা গরিবখানায় গিয়ে তো আমার চক্ষুস্থির!
গরিবখানা বলে নিয়ে গিয়ে আমাকে ইউসুফ আলি খাঁ সাহেব বসিয়ে দিলেন একেবারে এক মার্বেলের প্রাসাদের বৈঠকখানায়। পাথরের মধ্যে জাফরির কাজ। আমরা বসলাম পাথরের বেদিতে ছড়িয়ে দেওয়া নরম গদিতে। সামনে শ্বেতপাথরের বিশাল গোলটেবিল। তাতে রুপোর বাটায় সেরা লখনউয়ি পান আর অনুপম জরদা। যে জরদার সুবাস আমাদের ইটালির সেরা পাইপের তামাকের সুবাসকে ছাড়িয়ে যায়।
আমাদের মাথার উপরে শত প্রদীপের ঝাড়বাতি। আর একটু বাদে খানসামা রুপোর রেকাবিতে করে দু-টি পাথরের গেলাসে চমৎকার বাদাম শরবত এনে দিল। ইউসুফ সাহেব একটি গেলাস আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই গেলাসের পাথর কিন্তু আপনার দেশ থেকে আনানো। আমি বাধ্য হয়ে কবুল করলাম যে, এত দামি পাথরের গেলাস আমি দেশে কখনো চোখে দেখিনি। তখন ইউসুফ সাহেব দরাজ গলায় হাসতে হাসতে বললেন, এ আপনার বিনয়। এ কি কখনো হয়? আমি বললাম, এই যে চার ঘোড়ার জুড়িগাড়িতে করে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন, এমন গাড়িতেও আমি আজ অবধি চড়িনি। তখন ইউসুফ আলি আমাকে আরও একবার অবাক করে দিয়ে বললেন, তা হলে এবার তো আপনি বলবেন যে, দেশে আপনি মহিলাদের নাচও কখনো দেখেননি।
এবার আমি বললাম, তা নিশ্চয়ই বলব না। তবে এখানকার মতো ঘরে ঘরে নাচগান আমাদের রোম, মিলান, নেপলস, ফ্লোরেন্স বা ভেনিসে কখনো হয় না। কাজেই…
ইউসুফ সাহেব বললেন, আজ আপনাকে এখানে আনানোর আসল কারণটা বলি তা হলে? সাগ্রহে বলে দিলাম অবশ্যই! ইউসুফ বললেন, নবাব সাহেব লখনউ ত্যাগ করার পর তখনকার নাচ-গানের মহল জোর ধাক্কা খেয়েছে। তবুও কিছু তবায়েফ বা বাইজি এখনও সেই ধারা ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছু খানদানি রইস আদমিও যতটা পারছেন গানবাজনার জন্য করছেন, কিন্তু তাতেও সব ভালো বাইজিকে এ শহরে ধরে রাখা যাচ্ছে না। নুর বাই, মগন বাই, দুলারি বাই, শাগুফতা বাই, দিলরুবা বেগম, বড়ে চঞ্চলা, ছোটে চঞ্চলা, ঝিন্নন নাকি বাঈ—এরা তো সবাই শহর ছেড়ে চলে গেল। এর পর যদি রৌশনও চলে যায়, তা হলে লখনউয়ের রৌশনাই মুছে যাবে। তা কি হতে দেওয়া যায়?
ইউসুফ সাহেব যাদের নাম করলেন তারা আমার কাছে কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছু নয়। এদের কাউকে আমি চোখে দেখিনি, এদের কারও কারও নাম এক-আধবার এখানে-ওখানে শুনেছি। কিন্তু ভদ্রলোকের বলার ধরন বা উৎকণ্ঠা থেকে বুঝতে পারলাম বিলক্ষণ যে এদের লখনউ ত্যাগ খুবই ক্ষতিকর হয়েছে শহরটার পক্ষে। তাই শেষোক্ত মহিলার প্রস্থানও যে উটের পিঠে শেষ আঁটির বোঝার মতো হবে তাতে আমি নিঃসন্দেহ হলাম। এবং আন্তরিকভাবে উদবিগ্ন হয়ে বলে বসলাম, কক্ষনো না। রৌশন বাইকে শহর ছেড়ে চলে যেতে দেওয়া যায় না কিছুতেই। ইউসুফ সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, শহর ছেড়ে নয়, জনাব ফেরি। বলুন দুনিয়া ছোড়কে!
মানে?
মানে, রৌশন বাই গুরুতর রকম অসুস্থ। আমার এখানেই এক নাচের আসরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নাচের চক্করদার তেহাই দিতে দিতে চক্কর খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর সেই থেকে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে, কেউ জানে না আর কতদিন টানতে পারবে এভাবে। আমাদের শহরের সব হেকিম দেখেছে, আংরেজদের ডাগড়ার নাইট সাহেব আর মর্গান সাহেবও দেখেছেন, কিন্তু সেরকম ফয়দা কিছু হয়নি। শেষকালে…
আমি অবাক এবং বিব্রত কণ্ঠে বললাম, এঁরাই যখন কিছু করে উঠতে পারলেন না, তখন আমাকে দিয়ে আর কদূর কী হতে পারে জনাব?
ইউসুফ আলি ওঁর শ্মশ্রুগুমন্ডিত সুন্দর মুখে এক অদ্ভুত রহস্যের হাসি বিস্তার করে বললেন, আপনিই পারবেন। আমি ফের অবাক হয়ে বললাম, আমি! ইউসুফ বললেন, আমাদের পল্লির ঝাড়ফুকওয়ালা মিরন বক্স বাটি চেলেছিল।
তার মানে?
বাটি চালা হল একটা বাটির মধ্যে জিন নামানো। সেই বাটি তখন টলটল করে চলে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠে, নামে, রাস্তা দিয়ে গড়ায়, এভাবে যে বাড়িতে প্রয়োজনীয় লোক আছে সেখানে গিয়ে পৌঁছে যায়। শহরে চোর ধরা হয় এই করে; শগুফতা আলি একবার বাটি চেলে তার গুম হওয়া ছেলেকে বার করেছিল কৈসারবাগের সহিস নানু মিঞার পট্টি থেকে।
আমি এক বিচিত্র ধন্ধের মধ্যে পড়ে, রহস্যের জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বললাম, তো বাটি চালাচালির সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? ইউসুফ আমার ওজর-আপত্তির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকার মতো করে বললেন, মিরন বক্সকে বাটি চালতে বলেছিলাম ডাক্তার বাছতে। যাঁর দাওয়াইয়ে রৌশন এ যাত্রায় বাঁচতে পারেন। ওর সেই বাটি চৌকে আপনার তিনতলার কামরায় গিয়ে হাজির হয়েছে। এখন আপনি বলুন, আপনি রৌশনের চিকিৎসা করবেন কি করবেন না।
আমি শরবতের গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রেখে বললাম, তা হলে চলুন। আপনার রোগীকে দেখি। ইউসুফ আলি খাঁ হাসলেন—ইয়েহি ন বাত! আমি জানতাম আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। আমরা একটার পর একটা অলিন্দ পার হয়ে প্রাসাদের অন্দরমহলে ঢুকলাম। খানসামা কাচের বেলুনে বসানো আলোর প্রদীপ ধরে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। যত ভেতরে যাই তত চড়া হয় আতরের সুরভি। বুঝতে অসুবিধে হয় আমরা মরদের এলাকা ছেড়ে জেনানার দিকে পা বাড়াচ্ছি। একসময় ইউসুফ আলি আমার কাঁধের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনার আগে বাইরের খুব বেশি পুরুষ এতদূর আসেনি এই জেনানায়। ডাগডারদেরই এটা বিশেষ সুযোগ।
ঠিক কতগুলো ঘর বা অলিন্দ পেরিয়ে এসেছি খেয়াল নেই; শেষে কেবল একটা প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল এক কক্ষে এসে দেখলাম সাদা মসলিনের চাদরে ঢাকা একটি দেহ শোয়ানো আছে পেতলের পালঙ্কে। অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কতজন মহিলা মুখের ওপর পরদা টেনে বসে আছেন রৌশন বাইয়ের পায়ের দিকটায়। ইউসুফ আলি ওঁদেরই একজনকে নির্দেশ দিলেন রৌশনের হাতটা চাদরের তলা থেকে বার করে আমার হাতে দিতে। নাড়ি দেখতে হবে, অথচ রোগিণীর হুঁশই নেই। তার নিজের পক্ষে হাত বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
একজন মহিলা একটা লম্ফ এনে ধরেছেন, আমি সেই সামান্য আলোয় চমকে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। এ হাত তো আমার খুব অচেনা নয়! কার হাত যেন? এমন কোন মানুষের যার শুধু হাতটুকু দেখেই আমি তাকে চিনে নিতে পারি। হ্যাঁ হ্যাঁ, কবজির পাশে সেই ছোট্ট কাটা দাগটাও তো আছে! এ হাত কি তা হলে…
রৌশনের মুখের কাপড়টাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর আমার হৃৎপিন্ডটা মুখ দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আমার বাল্যের বান্ধবী রোজানা পাউলি এই মুহূর্তে আমার সামনে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে রৌশন বাই নামে! হা ঈশ্বর! বিধির এ কেমন লিখন। নেপলসের বেলাভূমিতে একদিন যার সঙ্গে নিয়মিত খেলা করেছি সেই পরমাসুন্দরী বালিকাকে আজ বিদেশ বিভুঁইয়ে কীভাবে আবিষ্কার করতে হল। আমি হাঁ হয়ে অপরূপা রৌশনের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে ইউসুফ বললেন, বিলাইতি রক্ত আছে ওর শিরায়। যে কারণে ওর ডাকনাম আছে একটা–বেলাইতি বেগম।
আমার ঠোঁট বেয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল—রোজানা! ইউসুফ ব্যাপারটা ধরতে না পেরে বললেন, রোজানা নয়, রৌশন, তবে শুনতে কিন্তু একইরকম লাগে।
আমি পালঙ্কের পাশে টুলে বসে রোজানার, থুড়ি রৌশনের, নাড়ি দেখতে লাগলাম। আমার মনে পড়ল সেই বাল্যকালেও খেলতে খেলতে রোজানা মাঝে মাঝেই অচেতন হয়ে পড়ে যেত। ওর বাবা জানতেন যে মেয়ের মৃগী রোগ আছে।
জ্বর কিন্তু তেমন নেই। তা হলে এরকম অজ্ঞান হয়ে আছে কেন? জিজ্ঞেস করতে উপস্থিত মহিলাদের একজন বললেন, জ্বর না থাকলেও বেগম সাহেবা মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যান। আমি ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য মহিলাদের একজনকে একটা ন্যাকড়া পুড়িয়ে আনতে বললাম। সেই পোড়া ন্যাকড়ার ধোঁয়া শোঁকাতেই চাপা গোঙানির আওয়াজ করে ফিট ছাড়ল। বুঝলাম, মৃগীর ব্যাপারটা না ধরতে পেরেই উলটোপালটা চিকিৎসা হয়েছে মেয়েটির। হঠাৎ মনটা ভীষণ দমে গেল, বড় কষ্ট হতে লাগল। বালক বয়সে, যাকে এত ভালোবেসেছিলাম তাকে এত বিচিত্র এক পরিবেশে এত কষ্টের মধ্যে দেখে আমার চোখ ভিজে এল। আমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের গাম্ভীর্য কণ্ঠে আরোপ করে হুকুম জারি করলাম, ঘরে একজন শুধু মহিলা থাকুন এবং বাকি সব বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি স্টেথোস্কোপ দিয়ে রোগিণীর শ্বাসকষ্ট ও ব্যথা পরীক্ষা করব।
সবাই চলে যেতে আমি সেবিকাকে বললাম রৌশনকে ধরে বসাতে। বসতে বসতে রৌশন চোখ মেলল, আমি ইতালীয় ভাষায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, রোজানা, তুমি আমায় চিনতে পারছ? আমি নেপলসে তোমাদের বাড়ির পাশে থাকতাম। তোমার সঙ্গে সমুদ্রতীরে খেলতাম। তোমায় কথা দিয়েছিলাম বড়ো হয়ে ডাক্তার হব আর তোমাকে বিয়ে করব। তোমার সেই প্রিয় নিকোলা আমি। নিকোলা ফেরি। আমি ডাক্তার হয়েছি, খুব নাম করেছি, কিন্তু তোমাকে পেলাম না। তাই বিয়েও করিনি। বললা তুমি আমায় চিনতে পারছ, রোজানা? আমি তোমায় সারিয়ে তুলব আর ফিরিয়ে নিয়ে যাব নেপলসে।
কিন্তু হায় নিয়তির এ কী নিষ্ঠুর পরিহাস। রোজানা এমনভাবে চেয়ে রইল আমার দিকে যেন ইতালীয় ভাষার একটি বর্ণের সঙ্গেও তার পরিচয় নেই। ওদিকে সেবিকা মহিলা এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে রইলেন যেন আমি কোনো ভাষা বলিনি, কোনো গর্হিত মন্ত্র উচ্চারণ করেছি। আমি তখন ফের কিছুদিন যাবৎ রপ্ত আমার ভাঙা হিন্দিতে বলতে শুরু করলাম, তব ঠিক হ্যায়। অব লেট যাও। আঁখ খোলো। জোরসে দম লো। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমার কথামতো রৌশনও তাই করতে লাগল এবং সেবিকা মহিলা নিশ্চিত হলেন যে, বাইজি কোনো বিলাইতি ভাষা জানে না। আমারও ক্রমে কীরকম কীরকম সন্দেহ হতে শুরু করল, কই, কিছু ভুল বুঝলাম না তো? আবার তার পরেও ধন্ধ থেকে গেল ওই মৃগীর ব্যাপার আর হাতের ছোট্ট কাটা দাগটা নিয়ে। কিন্তু চিকিৎসা তো চালিয়ে যেতেই হবে। আমি হাতের ব্যাগ খুলে একটা ওষুধের নাম লিখে বললাম, এই ওষুধ আনিয়ে দিনে দু-দাগ করে খাইয়ে দেবেন। আর অজ্ঞান হলে ওই ন্যাকড়া পুড়িয়ে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরিয়ে আনবেন। বেশিক্ষণ ধরে অজ্ঞান থাকলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।
ইউসুফ আলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি, দেখি একজন খানসামা একটা রুপোর রেকাবিতে দুটো সোনার মোহর নিয়ে এসে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে বললাম, এ আবার কী? ইউসুফ আলি সামান্য হেসে বললেন, এ তো আপনাকে গ্রহণ করতেই হবে, জনাব। একে ফিজ বলুন আর যাই বলুন। এ আমার পরিবারের তেহজিব। বাড়িতে মেহমান এলে খালি হাতে ফেরাতে নেই।
বলতে নেই, লখনউয়ে থেকে থেকে দু-টি উত্তম শব্দের মুখোমুখি হতে হয়। এর একটা তেহজিব যার ইংরেজি হবে grace এবং অন্যটি তমিজ, যার ইংরেজি হতে পারে manners. বলা যায় এই দুটি শব্দই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে লখনউয়ের জীবনযাত্রা, মানুষের সম্পর্কের সৌন্দর্য। আমি নিজেই ক্রমশ প্রভাবিত হয়ে পড়ছি এই ব্যাবহারিক সৌকর্যে। আমার কেবলই ধারণা হচ্ছে যে, লখনউয়ের মানুষ আসলে ফরাসিদের আত্মার পড়শি। আর তাদের শহরটা হল এক আধুনিক রোম নগরী। আমার পসার যদি জমে তবে এই শহরে আরও অন্তত একটা বছর থাকার ইচ্ছে আছে। যদি না…না, না, এত তাড়াতাড়ি ওরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। সত্যিই রৌশন ‘রোজানা’ কি না নিঃসন্দেহ হতে হবে। জানতে হবে এই অদ্ভুত জীবনধারা পরিত্যাগ করে ও ফের নেপলস ফিরে যেতে চাইবে কি না। সর্বোপরি লখনউ শহর ওকে চলে যেতে দেবে কি না।
৬.
ডায়ারির এই দীর্ঘ রোমাঞ্চকর এন্ট্রিটা পড়া শেষ হল যখন, তখন আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। ভোর হয় হয়। অনিরুদ্ধ বলল, এবার একটু মুখটুখ ধুয়ে চা খাওয়া যাক। তারপর দিনের প্রথম আলোয় একটু বড়া ইমামবাড়া আর রুমি দরওয়াজার চত্বরটা ঘুরে আসা যাক। তাতে ডায়েরির রসটা আরও বেশি পাওয়া যাবে।
এতক্ষণ একটানা শব্দ করে পড়ার পর বাস্তবিকই একটু চায়ের টান হচ্ছিল। বললাম, ভালো বলেছ! রাতটা যা গেল, এখন খানিকটা চা-পরোটা হলে ধড়ে প্রাণ আসে। বাইরে ঘুরে এলেও ভালো লাগবে। নিকোলা ফেরি আর রৌশন যেন বুকের ওপর চেপে বসছে।
রুমি দরওয়াজাকে যদিও পরিকল্পনা করা হয়েছিল বড়া ইমামবাড়ার তোরণ হিসেবে ওটা কিন্তু গোটা শহরটার প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছিল লোকের চোখে। এমনিতে তিনতলা তোরণটি যথেষ্টই উঁচু, কিন্তু বাস্তবে যে সত্যিই কতখানি উঁচু তা ওর চুড়োয় চড়লে জ্ঞান হয়। আমরা চা-পরোটা খেয়ে সাতসকালে একেবারে চুড়োর ছোট্ট চৌখুপ্পিতে উঠতে হঠাৎ করে মনে হল গোটা শহরটাই যেন মুঠোর মধ্যে চলে এল। লখনউয়ের গর্ব যেসব পুরোনো ইমারত বা বাগিচা তার সব কটিই নাগালে এসে গেল আমাদের। চোখ খোলা রেখেও সহজেই ভেবে নিতে পারলাম আমরা নিকোলা ফেরির লখনউয়ে আছি।
মুগ্ধ হয়ে দিনের প্রথম, নরম আলোয় সাদাৎ আলি খাঁ, নবাব আসফ-উদ-দৌল্লা আর ওয়াজেদ আলি শাহের শহরটাকে চোখ মেলে পান করছিলাম যখন হঠাৎ নজরে এল অনিরুদ্ধর সামান্য তৎপরতা। দেখি ওর ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডারের ডেনিম ব্যাগ থেকে সন্তর্পণে বার করে আনছে ফেরির ডায়েরি।
আমি ওর কান্ডটা নজর করেছি দেখে একটু লজ্জিত হয়ে বলল, এটা ছেড়ে আসতে পারলাম না। ভাবলাম যদি বেড়াতে বেড়াতে ফের পড়ার শখ হয়। বললাম, সেই শখ কি হচ্ছে এখন? ও সেই লজ্জিত হাসিটাকে মুখময় বিস্তৃত করে বলল, খু-উ-ব! আমি বললাম, কোথায় বসে পড়বে ভাবছ? ও অবাক হয়ে বলে উঠল, কেন এইখানেই? এবার আমিই অবাক হয়ে চুপ করে গেলাম। এত উঁচুতে, এত সংকীর্ণ একটা জায়গায় বসে ছেলেটা একটা রোমহর্ষক দিনলিপি পড়বে! শেষে ভয়ে ভয়ে বললাম, তা হলে বেছে বেছে নিরাপদ জায়গা থেকে পড়ো। এমন কিছু পোড়ো না যা শুনে টলে পড়তে হয় এখান থেকে। অনিরুদ্ধ বলল, তা হলে দেখি কী পড়া যায়! ও ফরফর করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় এসে থেমে বলল, দেখুন তো এ জায়গাটা কেমন লাগে?
অযোধ্যার যে-নবাবি শাসন মাত্র কদিন আগে করুণভাবে শেষ হয়ে গেল এবং যার প্রত্যক্ষদর্শী রয়ে গেলাম আমি তার পত্তন শোনা যায় সাদাৎ আলি খাঁর তখতে আসীন হওয়া থেকে। সেটা ১৭৩২ সালের ঘটনা। ওঁর সময়ে, এবং ওঁর ভ্রাতুস্পুত্ৰ মনসুর আলি খাঁর সময়ে অবিশ্যি অযোধ্যা বা অবধের বা ঔধের রাজধানী ছিল ফৈজাবাদ। পরে এই বংশের সবচেয়ে উজ্জ্বল কীর্তির মানুষ আসফউদ্দৌলার সময়ে রাজধানী সরে আসে এখানে লখনউয়ে। এই আসফউদ্দৌলার শাসনকালকেই বলা হয় আউধের স্বর্ণযুগ।
এই শাসনকালেই তৈরি হয়েছিল বড়া ইমামবাড়া।
এই লাইনটায় অনিরুদ্ধ একবার থেমে আমার দিকে তাকাল। ভাবখানা এমন—কী করে হঠাৎ এই বড়া ইমামবাড়ার জায়গাটাতেই পড়া শুরু হল আপনাআপনি। সেভাবে তো বাছাবাছি সত্যি কিছু হয়নি। আমি নীরবে হাসলাম, ডায়েরিটা ক্রমশ একেকটা অস্বাভাবিক কান্ডের কারণ হচ্ছে। যাকে অলৌকিক বললেও তেমন ভুল হয় না। অনিরুদ্ধ ফের পড়া শুরু করল :
বড়া ইমামবাড়া উৎসর্গীকৃত ছিল পয়গম্বরের উত্তরসূরি ইমাম হুসেন এবং হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে। ওঁদের শহিদ হওয়াকেই স্মরণ করা হয়েছে। এই উৎসর্গের পাশাপাশি ইমামবাড়ার একটা প্রতীকমূল্যও আছে। ১৭৮৪-তে আউধ রাজ্য যখন মন্বন্তরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তখন আর্ত মানুষের সাহায্যের জন্যই ইমামবাড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল এভাবেই জনগণকে কাজের জোগান দিয়ে যাওয়া। এই নিয়ে একটা জনপ্রিয় কাহিনি আছে শহরে।
তাতে বলছে যে, নবাবের নির্দেশেই সারাদিনের কাজ রাতেরবেলায় ভেঙে তছনছ করা হত। ফলে পরের দিন সকালে কাজ শুরু হত সেই গোড়ার থেকে। লোককে লাগাতার কাজে নিযুক্ত রাখার এই উদ্যোগ মানুষের কাছে ভীষণ প্রিয় করেছিল নবাব বাহাদুরকে। তারা ওঁর প্রশংসায় একটা কথাও চালু করেছিল সে-সময়—’যিসকো ন দে মত্তলা, উসকো দে আসফউদ্দৌলা। যার অর্থ হল–ঈশ্বর যাদের জন্য জোগাননি, তাদের জন্য জোগান আসফউদ্দৌলা।
এই বড়া ইমামবাড়ার একটা আশ্চর্য অঞ্চল হল ভুলভুলাইয়া গোলকধাঁধা। ছেলেবেলা থেকে পড়ে এসেছি গোলকধাঁধায় ঢুকে গ্রিক নায়ক থেসেয়ুস তরবারি দিয়ে নিহত করেছিলেন ষন্ডদৈত্য মিনোটরকে। আর ফিরে এসেছিলেন জীবিত অবস্থায় রাজকুমারী আরিয়ানের কাছে। সেই থেকে একটা গোলকধাঁধায় ঢোকার অদম্য বাসনা ছিল আমার। কিন্তু একটা গোলকধাঁধা যে শেষ অবধি কী ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা হতে পারে তা লখনউয়ের ভুলভুলাইয়াতে না এলে কোনোদিনও জানা হত না।
রৌশনকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলে এনেছি। বিনিময়ে প্রায় পনেরোটা স্বর্ণমোহরও আয় করেছি। অথচ আজও স্পষ্ট জানলাম না যে, মেয়েটি আদৌ আমার বাল্যসখী রোজানা কি না। এক-দু-বার ওর পূর্বপরিচয় জানার জন্য ইউসুফ আলিকে কথাটা পেড়েছি, কিন্তু ভদ্রলোক কীরকম ভাসা ভাসা জবাব দিয়ে সবটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিষয়টির উত্থাপন যে তাঁকে বিশেষ প্রীত করে না সেটা বুঝতে আর বাকি থাকেনি। শেষে রৌশন যখন সম্পূর্ণ সেরে গেল, তিনি আমাকে অনেক উপহার ও পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বললেন, আপকো বহৎ বহৎ মেহেরবানি। আপকো ইয়ে হমদর্দি হম কভি নহি ভুলেঙ্গে। বলা বাহুল্য, একথার অর্থ—আর আপনাকে এ বাড়িতে আসতে হবে না। আমার ভেতরটা এই কথায় যৎপরোনাস্তি দমে গেল। রৌশন কে, এই প্রশ্নের উত্তর না জানতে পেরে মনটা ভয়ানক আনচান করতে লাগল। অতঃপর মনের এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য খাওয়াদাওয়া আর গান শোনার আরাম পরিত্যাগ করে মধুর বিষণ্ণতার শহরটাকে ঘুরে ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। উষ্ণ বিরিয়ানি, চাঁপ ইত্যাদি সুখাদ্যের থেকে মন সরে গেল ইট-কাঠ-পাথরের শীতল সান্নিধ্যে। এবং এভাবে ক্রমে চৌক, আমিনাবাদ, হজরতগঞ্জের ঘরদুয়োর দেখার পর রেসিডেন্সি, ইমামবাড়া, বরাদরি, লা মৰ্তিনিয়ের, কৈসরবাগ, ছত্তর মঞ্জিল ইত্যাদি দেখার পর একদিন আপন মনে ঢুকে পড়লাম ছেলেবেলার সেই শখের ক্ষেত্র গোলকধাঁধায়। বড়া ইমামবাড়ার ওই প্রসিদ্ধ ভুলভুলাইয়ায়।
ভুলভুলাইয়া বাস্তবিকই ভুলভুলাইয়া। অর্থাৎ ভুলের ওপর ভুল চাপিয়ে রাস্তা হারিয়ে বসা। ঢুকে পড়েই বুঝতে পারলাম যে, এই অন্ধকার কুঠুরির বিস্তার থেকে, সংকীর্ণ অলিন্দের জট থেকে সহজে আলোর রাস্তায় ফিরে আসা হবে না আমার। বড়ো কথা, ওই ভুলের স্বর্গ থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষাও আমার ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা এই মনের অবস্থা আমার। আমি উত্তরোত্তর পথ হারাতে হারাতে কোথায় যে তলিয়ে গেছি ঈশ্বরই জানেন—হঠাৎ আমার কানের পাশে একটা মধুর স্বরে কে যেন ডেকে বসল ‘নিকোলা!’
আমি চমকে উঠে আশেপাশে তাকালাম, কিন্তু ওই গভীর অন্ধকারে কাউকে কোথাও দেখলাম না। নীচে তাকাতে বুঝলাম আমি একটা মস্ত গ্যালারির একটা ছোট্ট কক্ষে দাঁড়িয়ে আছি। নীচে প্রশস্ত সভাকক্ষ একটা, আর তার চারধারে চার-পাঁচতলা ধরে গোল হয়ে ছড়িয়ে আছে কুঠুরির সারি, সারি, সারি। ফের শুনলাম মিষ্টি স্বরে কে ডাকল ‘নিকোলা!’ আমার হৃৎস্পন্দনও এবার ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার কানে। আমি বুকে দু-হাত চাপা দিয়ে বললাম ইংরেজিতে, তারপর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে, কে আপনি? আর কানের পাশে পাথর থেকে বেরিয়ে এল মৃদু মিষ্টি ইটালিয়ানে, ‘আমি তোমার রোজানা, প্রিয়!
আনন্দে, ভয়ে, রোমাঞ্চে আমার সারাশরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি পাথরের দেওয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলে বললাম, রোজানা, তুমিই কি রৌশন? ওপার থেকে কাচভাঙা হাসি হেসে রোজানা বলল, আবার কে? জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়? উত্তর এল, তুমি চোখ নামিয়ে ডান দিকের গ্যালারির দিকে তাকাও। তাকালাম, দেখলাম দূরে এক অন্ধকার কুঠুরিতে কালো বোরখা পরে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, ওটাই রোজানা।
বললাম, এভাবেই বুঝি গোলকধাঁধাটা তৈরি, না? যাতে বিশেষ একটা কুঠুরি থেকে। গোলকধাঁধার বিশেষ কোনো কুঠুরিতে বার্তা পাঠানো যায়?
-এবং প্রেমালাপ করা যায়!
কথাটা বলে রোজানা হাসল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমাদের এভাবে কথা বলতে হচ্ছে কেন?
—কারণ, তুমি পরদেশি!
–পরদেশি তো তুমিও।
–কে জানে আমি পরদেশি। এখানে আমি লখনউয়ের মুকুটের এক শেষ মণি রৌশন বাই।
–কিন্তু…কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে?
–সে আমার ভাগ্য!
—সেকথা জানতে পারি না কি?
–জেনে লাভ?
—সে তো অনেক পরের কথা। আগে তোমার ঘটনাটা শুনি।
ওপারে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তারপর একটা দীর্ঘ নীরবতা। পরে নীরবতা ভঙ্গ করে একটা চাপা কান্না ফুটে উঠল। আমি বিব্রত বোধ করে তড়িঘড়ি বলে বসলাম, কেঁদো না প্লিজ। তা হলে আমার ভগ্নহৃদয় একেবারেই ভেঙে পড়বে। আমি তোমার কাহিনি থেকে সাহস অর্জন করতে চাই, রোজানা।
রোজানার কান্না থামল। একটা দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ শুনলাম। একটু পর একটা তৃপ্তির প্রশ্বাস। জিজ্ঞেস করলাম, দেশলাই জ্বালালে কেন? উত্তর এল, বদভ্যাস। চুরুটের নেশা আছে আমার। বললাম, কেন? উত্তর এল, ওভাবেই নিজের নিঃসঙ্গ সময়গুলো কাটাই, নিকোলা।
—কিন্তু নিঃসঙ্গ কেন?
—কারণ, রোজানা যে নিকোলা ছাড়া কাউকে ভালোবাসেনি।
এবার কেঁদে ফেলার উপক্রম আমার। তবু চোখের জল চেপে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বললাম, কিন্তু তুমি ওভাবে হারিয়ে গেলে কেন?
স্পষ্ট শুনলাম রোজানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সম্ভবত চোখও মুছল। তারপর বলল, তুমি জানো নিকোলা, আমার বাবা স্থপতি ছিলেন।
বললাম, খুবই জানি। বাবাকে ওঁর কোম্পানি লখনউয়ে পাঠিয়েছিল মেহমুদ আব্বাস ইলাহি সাহেবের প্যালেস তৈরির জন্য। সম্পূর্ণ ইটালিয়ান মার্বেলে হওয়ার কথা ছিল সে-প্যালেসের। তবে ফিরিঙ্গি ডিজাইনে। রেসিডেন্সি যেমন।
-বুঝলাম।
—বাবার খুব শখও ছিল মেয়েকে উর্দু শেখানোর। কারণ, ওঁর ধারণা হয়েছিল উর্দু ফরাসির মতো মিষ্টি ভাষা।
-বেশ।
–আমার উর্দু শিক্ষক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আমার উচ্চারণ শুনে। বলেছিলেন, আমি একদিন উর্দুতে সেরা কবিতাও মুশেরায় মুশেরায় পাঠ করতে পারব। কিন্তু…
—কিন্তু?
-একদিন আব্বাস ইলাহি পাথরের মেঝেতে পা হড়কে পড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তখন ডিজাইন বোঝাতে বাবাকেই যেতে হত ওঁর বাড়িতে। এবং এরকম একদিন রাস্তার মাঝখান থেকে ওঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেল ইংরেজদের চররা…
আমি উদবিগ্ন হয়ে রোজানার কথার মধ্যেই প্রশ্ন করে বসলাম, কেন? কী দোষে? ইংরেজদের সন্দেহ হয়েছিল বাবা ইলাহি সাহেবের বাড়িতে চোরাকুঠি এবং সুড়ঙ্গ বানানোর নকশা করছেন। এই ইলাহি সাহেব ছিলেন লখনউয়ের নবাবদের বড়ো পরামর্শদাতা। ওঁর মাধ্যমেই অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটার কাজ চলত বলে সন্দেহ হয়েছিল ইংরেজদের। বাবাকে ওরা সাত দিন সময় দিলেন লখনউ ত্যাগের। তখন বাবা বাড়িতে এসে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, রোজা, তোর আর উর্দু শেখা হল না। চল, চলে যাওয়ার আগে অন্তত ল্যাবিরিন্থটা দেখিয়ে আনি। আর ওই বেড়াতে যাওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাল হল।
-কীরকম!
—ওই ভুলভুলাইয়াতেই আমি বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। যত পথ খুঁজি বাবার কাছে পৌঁছোব বলে ততই রাস্তা হারিয়ে ফেলি। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ বোধ করলাম আমার মৃগী রোগের অ্যাটাকটা আসছে। তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার। তারপর…
তারপর জ্ঞান হল যখন, তখন দেখলাম আমি একজন বাইজির কোঠায় শুয়ে আছি। চারপাশে নাচ, গান, রেওয়াজ চলছে। আমি বাড়ি যাব! বাড়ি যাব! বলে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করলাম। কোঠার লোকজন শহর ছেনেও আমার বাবাকে খুঁজে পেল না। শেষে খবর এল আমাকে হারিয়ে ফেলে বাবা পাগল হয়ে গিয়ে ইংরেজদের কাছে ফের ধরা দেয়। ওরা পরের দিনই জাহাজে তুলে পাঠিয়ে দেয় কলকাতায়। তারপর তাঁর খোঁজ আর কেউ পায়নি।
আমরা নেপলসে শুনেছিলাম তোমার বাবা লখনউয়ে এক মুসলমান নারীকে বিয়ে করে ওখানেই থেকে গেছেন। তাই শুনে তোমার মা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন এবং বছর আষ্টেক পর টিবি হয়ে মারা যান।
ওপার থেকে একটা হাহাকার ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল পাথরের পর্দায় পর্দায়। আমি কুক্ষণে জন্মেছিলাম, হে ঈশ্বর! সব দুঃখের গোড়া আমি। কেন আমায় বাঁচিয়ে তুলেছিলেন মেহরুন বেগম। কেন আমার ছুড়ে ফেলেননি গোমতীর জলে! আমি ওকে শান্ত করার জন্য বললাম, কিন্তু ঈশ্বর তো মুখ তুলে চেয়েছেন। তাই না আমায় পথ ভুলিয়ে শেষ অবধি এনে ফেলেছেন ভুলভুলাইয়াতে!
—কিন্তু এই ভুলভুলাইয়া থেকে তো আমার আর মুক্তি নেই, নিকোলা।
-কেন বলছ ও কথা, রোজানা? তুমি কি মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাও না আর আমার হাত ধরে?
—ভীষণরকম চাই, নিকোলা, মেহফিলে মেহফিলে নেচে-গেয়ে আমি যে আর পারছি না।
–তা হলে ভয় কীসের?
-ভয় ইউসুফ আলিকে! অসম্ভব ভদ্র মুখোশের পিছনে একটা পিশাচের চেহারা আছে। লোকটার। যে ভয়ে বাড়িতে আমি তোমাকে চেনার কোনো ইঙ্গিতই দিইনি। ওর প্রধান চর ওই বুড়ি মহিলা। উনি ঠিক লাগিয়ে দিতেন যদি একটি ইতালীয় বাক্যও আমি উচ্চারণ করে বসতাম।
—সেকী! মানুষটা এইরকম?
—এ তো কিছুই না।
–তা হলে তুমি এখানে এলে কী করে?
—আমি পালকি করে মসজিদে যেতে যেতে তোমাকে দেখে অনুসরণ করেছি। তারপর তুমি ভুলভুলাইয়াতে ঢুকছ দেখে গোপনে একটা কুঠুরিতে এসে অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি যতক্ষণ-না তোমার কুঠুরিতে ঢুকছিলে আমি কথা কইতে পারছিলাম না।
—কিন্তু আমি যদি এই ঘরে না আসতাম।
—তা হলে অন্য একটা ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতাম।
—কিন্তু সে-ঘরেও যদি না যেতাম?
–তা হলে অন্য কোথাও!
—তাতেও যদি না মিলতাম?
—মিলতামই। জীবনে একটিবার আমার তোমার সঙ্গে কথা হওয়ার দরকার ছিল।
—শুধু এটাই বলতে যে, তুমি আর দেশে ফিরবে না কোনোদিন?
—না। শুধু এইটুকু যে, তোমাকেই, শুধু তোমাকেই আমি ভালোবেসেছি। আমার গজল শুনে এখানকার রইস লোকেরা যখন আবেগের সঙ্গে ‘সুহানাল্লা! সুহানাল্লা!’ করেন তখন ওঁদের কেউই ভাবতে পারে না আমি কার জন্য গাইছি।
—এত কিছুর পরেও তোমাকে এখানে ছেড়ে যেতে বলছ আমাকে?
-কী আর করব বলো? ইউসুফ সাহেব এক হাজার মোহর দিয়ে আমাকে কিনেছেন মেহরুন বেগমের কাছ থেকে, সে-দাম আমি শোধ দেব কোত্থেকে?
—কিন্তু উনি যে বললেন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তোমায় বাধ্য হয়ে রেখে দিয়েছেন ওঁর প্রাসাদে।
প্রত্যেকের জন্য একটা পছন্দসই গল্প আছে ওঁর। তোমাকেও তেমন কিছু বলেছেন সম্ভবত।
—কিন্তু আজকের দিনে এরকম দাসপ্রথা কি চলতে পারে? উপরন্তু তুমি ইতালীয়, ভারতীয় নও। প্রয়োজন হলে আমি ইংরেজ রেসিডেন্ট সাহেবের কাছে অভিযোগ করব।
–খবরদার! ওই একটা কাজ তুমি একেবারেই করবে না। তা হলে খাঁ সাহেবের বাড়ি থেকে আমার জানাজা বেরোবে। আমার মৃতদেহ।
-তাহলে?
-তুমি চৌকের ঘরে রোজ রাত্তিরে তৈরি হয়ে অপেক্ষায় থাকবে। আমি জানি না কবে হবে সেটা, কিন্তু যেদিনই হবে আমি কালো বোরখা পরে মাঝরাত্তিরে চলে আসব। আর সেদিনই আমরা লখনউ ছেড়ে চলে যাব, ততদিন আর আমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। বিদায়।
এরপর আমি আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম রোজানাকে, কিন্তু ওই তরফ থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। তারপর অনেক ঘুরে একটা উন্মুক্ত জায়গায় এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বেশ কিছুদিন পরে ফের একটা আনন্দ বোধ করতে লাগলাম শরীরে ও মনে।
ফেরার পথে চুটিয়ে ফের বিরিয়ানি আর চাঁপ খেলাম। আর একটা ভালো ব্র্যাণ্ডি কিনে বাড়ি ফিরে জীবনের প্রথম চুরুটটা ধরালাম। রোজানা চুরুট খায় শুনে এই আকর্ষণটা হঠাৎ ছেয়ে ফেলেছে মনটাকে। আজ রাত থেকেই আমি রাতজাগা অভ্যাস করব। কে জানে কখন ও আসে!
৭.
রুমি দরওয়াজার চুড়োয় বসে ডায়েরির একটা বড়ো অংশ পড়া শেষ হল যখন, তখন বড়া ইমামবাড়ায় কিছু কিছু লোক জমেছে। এদের অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য ভুলভুলাইয়া ঘুরে দেখা। আমি অনিরুদ্ধকে বললাম, চলো যাই আমরাও একটু ব্যাপারটা দেখে আসি।
ভুলভুলাইয়ার যে বর্ণনা ডায়েরিতে পড়েছি আমরা তার সঙ্গে হুবহু মিল খুঁজব সর্বত্র। আমরা দিব্যি মনের আনন্দে এগলি থেকে ওগলি, এচত্বর থেকে ওচত্বর, একুঠুরি থেকে ওকুঠুরি ঘুরে বেড়ালাম। অনেক জায়গাই ভেঙে ধুলো ধুলো হয়ে গেছে, বেশ কিছু কুঠুরি ভেঙে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু জায়গার রহস্যময় অন্ধকার ও মজা কিন্তু সম্পূর্ণ অটুট আছে। আমরা সেই রহস্য উপভোগ করতে করতে সংরক্ষণের মান নিয়ে মন্তব্য করতে করতে তিনতলার এক কুঠুরিতে এসে পৌঁছোলাম।
একটু ঝুঁকে দু-জনে আমরা চারধারের গ্যালারি দেখছি আর ভাবছি নিকোলা ফেরি ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে কথা কয়েছিলেন রোজানার সঙ্গে। হঠাৎ পাশ থেকে স্পষ্ট হিন্দিতে কথা ভেসে এল–নিকোলার ডায়েরিটা আমাকে ফিরিয়ে দিন, প্লিজ!
আমরা চমকে উঠে আমতা আমতা শুরু করলাম। অনিরুদ্ধ বলল, কিন্তু কে আপনি? উত্তর এল, আমাকে আপনারা ভালোই চেনেন। আমি এবার বুকে বল সঞ্চয় করে বললাম, আপনি রোজানা? ওপার থেকে কোনো জবাব এল না। অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জীবিত মৃত? এবার পাথরের গায়ে সেই গেলাসের কাচভাঙা খিলখিল হাসি। সমানে। কিন্তু কোনো উত্তর নেই।
আমি বললাম, কিন্তু আপনি কোন কুঠুরিতে? কোথায় গিয়ে দেব ডায়েরিটা?
—আমি এখানেই আছি। কিন্তু আমায় আপনারা খুঁজবেন না।
কথাটা শোনার আগেই কিন্তু আমি আর অনিরুদ্ধ কুঠুরি থেকে মাথা বাড়িয়ে রোজানাকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু কেউ কোথাও নেই!
অনিরুদ্ধ এবার বলল, আপনাকে তো কোথাও দেখছি না। কী করে দেব খাতাটা?
পাথরের গায়ে কথা ফুটে উঠল : আপনাদের কোথাও যেতে হবে না। আমি নিজেই এসে নিয়ে যাব আপনাদের ঘর থেকে। আমি বললাম, আমাদের ঘর আপনি চিনবেন কী করে?
নিকোলা ফেরির ঘরেই আপনারা আছেন। অনিরুদ্ধ বলল, তা হলে এতদিন ডায়েরিটা নিয়ে যাননি কেন? ওই ঘরেই তো পড়েছিল জিনিসটা বরাবর।
কারণ ওতে একটা রুপোর ক্রস আছে। ক্রসটা বার করে নিয়ে ওটা টেবিলে রেখে দেবেন। আমি আসব।
-কখন?
—যখন আসি আমি ওখানে।
–মানে মাঝরাতে?
ওপার থেকে কোনো উত্তর হল না। অনিরুদ্ধ আর আমার দু-জনেরই একটা কাঁপুনি শুরু হল শরীরে। ভাগ্যিস ক্রসটা ছিল ডায়ারির মধ্যে! না হলে অভাবনীয় কিছু একটা ঘটে যেতে পারত কাল রাতেই। সেই অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেই আমি কাতরভাবে বলে ফেললাম, কিন্তু ডায়েরিটা যে আমাদের সম্পূর্ণ পড়া হয়নি! জবাব এল, আজ বাকি দিনটুকু সময় দিলাম। পড়ে ফেলুন। বললাম, কিন্তু এত সুলিখিত এই ডায়েরিটা যদি আমরা ছাপতে চাই? পাথর কাঁপিয়ে নিষেধাজ্ঞা ধ্বনিত হল, না, আপনাদের দোহাই, ওটা প্রকাশ করবেন না। ওভাবে নিজেদের অমঙ্গল ডেকে আনবেন না। ফেরির আত্মাকে শান্তি দিন। অনিরুদ্ধ বলল, কিন্তু যদি আমরা নিয়ে যাওয়ার কথাই ভাবি? জবাব এল, আপনারা কিছুতেই তা পারবেন না। ওঘর থেকে ওটা নিয়ে কেউ যেতে পারেনি। ক্রসটা সরিয়ে দিলে কেউ, আমি ওটা নিয়ে যাব। আমি বললাম, তাতে কী লাভ আপনার? উত্তর এল, তা হলে আর যুগ যুগ ধরে ওটার পাহারা দিতে হবে না আর। আমি নিজেকে সরিয়ে নেব চৌক থেকে!
এরপর পরিবেশটা ফের নিথর, নীরব হয়ে গেল। আমরা ভুলভুলাইয়া থেকে বেরিয়ে বেড়াতে বেড়াতে হজরতগঞ্জ চলে এলাম। একটা ভালো দোকান দেখে খাবার অর্ডার করে বসলাম। তারপর ঝোলার থেকে ডায়েরিটা বার করে হাতড়াতে লাগলাম ক্রসের খোঁজে। কিন্তু কোথায় ক্রস! কোথাও তো নেই সেটা।
আমি বললাম, অনিরুদ্ধ, মলাটটা ছিঁড়ে ফেলো তো। দেখো তো ওখানে কিছু সেঁধিয়ে আছে কি না।
বলতে না বলতে ও ফড়ফড় করে মোটা ব্রাউন পেপারে মলাটটা ছিড়তে লাগল। আর তখনই স্পাইন থেকে খসে পড়ল চামড়াতে গদ দিয়ে সাঁটা একটা পাতলা, সোনালি ক্রস। আমরা অবাক হয়ে দু-জনে দু-জনের চোখের দিকে চেয়ে রইলাম নির্বাকভাবে। সহসা ডায়েরির আর যেটুকু-যা বাকি আছে তা পড়ে ফেলার জন্য যেন জ্বর ধরল গায়ে। আজ রাতেই তো আসবে বলল রোজানা! ওকে কি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে?
দাঁতে মাংসের টুকরো ছিড়তে ছিড়তে অনিরুদ্ধ বলল, আপনি যাই বলুন আর তাই বলুন, আমি কিন্তু ডায়েরিটা ফেরত দেওয়ার পক্ষপাতী নই!
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কিন্তু ও তো ওটা নিতে আসবে। বিজ্ঞানের ছাত্র অনিরুদ্ধের এবার স্বরূপ প্রকাশ পেল, ও মানে কে? আমি উত্তরে কী বলব ভেবে পেলাম না। চুপ করেই রইলাম। শেষে অনিরুদ্ধই বলল, আমাদের এইসব অভিজ্ঞতার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না কোনোদিন যদি এই ডায়েরিটা সঙ্গে করে নিয়ে কলকাতায় না ফিরতে পারি।
ওকে সাময়িকভাবে নিরস্ত করার জন্য বললাম, ঠিক আছে, সেটা দেখা যাবে। আপাতত বাড়ি ফিরে বাকি অংশের কিছুটা অন্তত তো পড়া যাক। রাত তো অনেক পরের ব্যাপার।
৮.
দিনটা হঠাৎ মেঘলা হয়ে এসেছে। ফলে ঠাণ্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে নেমেছে। আকাশের আলোয় আর কিছু পড়ার জো নেই। ঘরের একটিমাত্র আলো জ্বালিয়ে যে-যার তক্তপোশে কম্বল জড়িয়ে বসে সিগারেট ধরিয়েছি। লখনউয়ে যে কাজের বরাত নিয়ে আসা তা আপাতত ডকে উঠেছে। আমাদের রাতের ঘুম আর দিনের সব মনোযোগ সম্পূর্ণ দখলে নিয়ে নিয়েছে অনিরুদ্ধর হাতে ধরা গত শতাব্দীর পর্যটক ডা. নিকোলা ফেরির আশ্চর্য ডায়েরি। একটা লম্বা ধোঁয়া রিং করে হাওয়ায় ভাসিয়ে ও পড়তে শুরু করল।
পর পর উনিশটা রাত গেল আমি চোখের পাতা এক করিনি। আমি ছোট্ট এক লক্ষ জ্বেলে ঘুমোই। কিন্তু রাতের একটা বিশেষ সময় সেটা আপনা আপনি নিভে যায়। তারপর ঘরটা ভরে ওঠে নারীদেহের অপূর্ব আতরগন্ধে। একটা নূপুরধ্বনি শুরু হয় অনতিবিলম্বে এবং আমার খাটের চারপাশে একটা নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজ শুনতে পাই। আমি তখন আর্তস্বরে একটা কথাই বলি তখন, তুমি রোজানা? রোজানা তুমি এসেছ? কিন্তু যেই থাকুক আমার ঘরে তার কোনো জবাব শুনতে পাই না। শেষে একসময় আমার জলের কলসি উপুড় করে সেই সত্তা ঢকঢক করে খানিকটা জল পান করে। আমি বেশ কবার সে-সময় হাত বাড়িয়ে ওকে স্পর্শ করতে গেছি। কিন্তু অন্ধকারে আমার হাত হাওয়া ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পায়নি।
অনিরুদ্ধ ফের পাতা ওলটাতে শুরু করল। লন্ড্রির হিসেব, কিছু ওষুধ বিষয়ক তথ্য, একটি জুড়িগাড়ির বর্ণনা ইত্যাদি বিভিন্ন কথাবার্তা এড়িয়ে ফের ও এসে দাঁড়াল আর একটি পৃষ্ঠায়। বলল, হ্যাঁ, এখানে আবার আমাদের জানার কথা শুরু হচ্ছে। পড়ি তা হলে? আমি উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললাম, পড়ো, পড়ো। ও পড়া শুরু করল :
দেখতে দেখতে তেত্রিশটা দিন পেরিয়ে গেল। রোজানা কিন্তু এল না। রাতের বেলা কে যে এসে ঘোরাফেরা করে আমার কামরায় আমার মাথায় খেলে না। কাউকে সাহস করে কিছু বলতেও পারি না পাছে আমাকে পাগল বা অবৈজ্ঞানিক মানুষ ভাবে।
হায় ঈশ্বর! শেষে আমার মতো কট্টর বৈজ্ঞানিক মনের মানুষকেও অলৌকিকে বিশ্বাস জন্মাতে হয়। এখন আমি স্থির জানি ঠিক কখন কীভাবে কী কী ঘটে যাবে আমার অন্ধকার কক্ষে। এই রুটিন বদলে দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। আমি নিরুপায় দর্শকের মতো সব সহ্য করছি এবং একটু একটু করে প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করতে বসেছি। কিন্তু আর পারছি না।
আমি আজ সরাসরি ইংরেজ পলটনের কাছে গিয়ে অভিযোগ নথিবদ্ধ করলাম। হ্যারি ট্রলোপ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, সিনিয়র ফেরি, আপনার কেন মনে হচ্ছে আপনার ঘরে যে আত্মার উপস্থিতি রোজ রাতে লক্ষ করেন তা আসলে রৌশন বাইয়ের?
বললাম, তার কারণ আমার সন্দেহ হচ্ছে যে, ইউসুফ আলি রৌশনকে হত্যা করেছেন। ট্রলোপ চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, এটা প্রমাণ করা তো কঠিন নয়। ওঁর প্রাসাদে গেলেই হয় তদন্তে। কিন্তু মোটা টাকা খরচ করে সারিয়ে তুলে উনি ওকে হত্যা করতে চাইবেন কেন?
বললাম, কারণ রৌশন আমার সঙ্গে ইতালি চলে যেতে চেয়েছিল।
-তা হলে তো জানতে হবে আপনার সঙ্গে রৌশনের পালিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
অগত্যা ট্রলোপকে সমস্ত ঘটনা সবিস্তার বললাম। ভুলভুলাইয়ার ঘটনাবলি শুনে বেচারি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন। শেষে রীতিমতো বিরক্তির ভাব এনে বললেন এরকম একটা অদ্ভুত কেস আমার হাতে আসেনি কখনো। জানি না ইউসুফ আলির বাড়িতে গিয়ে আবার কী শুনব!
ইউসুফ আলির মুখে যা শুনলাম তাতে যৎপরোনাস্তি অবাক হয়ে গেলাম আমি নিজেই। ইউসুফ বললেন, রৌশন বাই নিহত? আপনারা কি খেপেছেন? ও তো জেনানায় বসে এখন দরবারি রাগে আলাপ করছেন। আপনারা শুনবেন?
এই বলে হাততালি দিলেন ইউসুফ। দু-জন খানসামা এসে আদাব করল আমাদের। তারপর ইউসুফ কী একটা নির্দেশ পাঠালেন জেনানায়। এর মিনিট পঁচিশ পর এক গ্লাস করে শরবত এবং দু-খিলি করে পান খেয়ে আমরা ভেতরে গিয়ে দেখলাম দিব্যি সাদা সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরা সাদা গালিচার ওপর আয়েসের ভঙ্গিতে বসে আছে রৌশন। আমার রোজানা।
আমি ইতালীয়তে বললাম, রোজানা, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি। আমার সঙ্গে ইংরেজ অফিসার আছেন। তোমার কোনোই ভয় নেই। একবার শুধু বলো তুমি কে, আর তুমি আমার সঙ্গে দেশে ফিরতে রাজি, তা হলেই কাল তোমাকে নিয়ে আমি জাহাজে উঠব নেপলসের পথে। রৌশন হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। যেন এইমাত্র শোনা ভাষাটার একটি শব্দও তার বোধগম্য হয়নি।
হ্যারি ট্রলোপ আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, চলুন সিনিয়র ফেরি। এঁদের আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
আমি লজ্জিত মুখে ইউসুফ আলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। মাথাটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না ভুলভুলাইয়াতে শোনা কণ্ঠটি কার। রাতের বেলায় আমার ঘরের নিত্যঅতিথি কে? কিংবা এই রৌশন বাই সত্যি সত্যি কে?
আমি বাড়ি এসে একটা প্রচন্ড জ্বর অনুভব করলাম শরীরে। হাতের পাশেই ব্যাগে মাথার যাবতীয় ওষুধ, কিন্তু আমি ওষুধের দিকে হাত বাড়ালাম না। ওষুধে যাবার মতো জ্বর এ নয়। রৌশন-রোজানা রহস্যের সমাধান না হলে এ অসুখ আমার যাবে না। আর ততদিন লখনউ ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। খাই বা না খাই, বাঁচি বা না বাঁচি এই ডায়েরি আমাকে লিখে যেতেই হবে। আমার মগজ ঠিক রাখতে হবে, যুক্তি বজায় রাখতে হলে, পাগল না হতে হলে এই ডায়েরি লিখে যেতে হবে। এই ডায়েরিই আমার প্রিয়তমা রোজানার একমাত্র পরিচয়, সঠিক পরিচয় ধরে রাখবে। আমি জীবিত অবস্থায় নেপলস না ফিরলেও এই ডায়েরিতেই রোজানা বেঁচে থাকবে। রৌশন বেগম হিসেবে আমি ওকে মরতে দেব না। কিন্তু আর লেখা নয়, এখন আমাকে তৈরি হতে হবে রোজানার জন্য। লম্ফ নিভে এল বলে, যেকোনো মুহূর্তে দপ করে নিভে যাবে। আর ঘরটা ভরে যাবে রোজানার দেহের আতরগন্ধে। আমি শুনব ওর নূপুরধ্বনি। ওর নিঃশ্বাস পড়বে আমার কপালে, হাতে, বুকে। শেষে ও জল পান করবে আমার কলসি থেকে। তারপর…
অনিরুদ্ধ বলল, এখানেই পাতাটা শেষ। আমি বললাম, হয়তো তখনই লম্ফটা নিভে গিয়েছিল। কিন্তু তুমি অন্য পাতা থেকে ফের পড়তে শুরু করো না। লেখা তো আরও আছে। অনিরুদ্ধ বলল, না, আর পড়ব না এখন। দেখি না রাতে কী হয়! তা হলে পরবর্তী অংশগুলো আরও তারিয়ে তারিয়ে পড়া যাবে। সাসপেন্স বজায় থাকবে। খাতা তো আর আমরা ফেরত দিচ্ছি না। যতই যা হোক।
এরপর আমরা নাক অব্দি কম্বল টেনে ঘুম লাগালাম। উপায় ছিল না অন্য কিছু করার, কারণ দুপুরের মেঘলা আকাশ ততক্ষণে ঘন কালো হয়ে উঠেছে, কিছু বিদ্যুল্লতা ঘরের মধ্যে ঝলসে উঠেছে এবং শেষে শীতের অকালবৃষ্টিও নেমেছে। একটা হিমশীতল হাওয়া দৌড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের ছোট্ট ঘরে। ঘুম দেওয়ার পক্ষে এর চেয়ে ভালো সময় ক্যালেণ্ডারে আর কিছুই থাকতে পারে না। মিনিট কয়েকের মধ্যে অনিরুদ্ধর নাক ডাকা শুরু হল। ছোকরার একটা চাপা সর্দি সব-সময়ই লেগে থাকে। ফলে নাকটা বোধ হয় ঘুমের সময় একটু অসুবিধেয় পড়ে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি সে কি আর নিজেও জানি? হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল এক বিশ্রী আওয়াজে। প্রথমে কানের থেকে কম্বল সরালাম। তাতে আওয়াজটা আরও তেজি হয়ে উঠল। বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার গোঙানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে অনিরুদ্ধর গোঙানি। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে প্রথমে দৃশ্যটা দেখলাম। দেখি অনিরুদ্ধর শরীরটা বেঁকে বেঁকে ঠেলে উঠছে বিছানার থেকে আর গলা থেকে ছিঁড়ে বেরোচ্ছে একটা বিকট আওয়াজ। ছেলেটা কি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল?
আমি ওর তক্তপোশের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকলাম, অনিরুদ্ধ! কী ব্যাপার? গোঙাচ্ছ কেন?
ও কোনো উত্তর দিল না। উলটে গোঙানিটা আরও বেড়ে গেল। আমি আমার তালুটা রাখলাম ওর কপালে, শরীরটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ভয়ে আরও হিম হয়ে গেল আমার মাথাটা। আমি দুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে চলে গেলাম হেকিম সাহেবকে ডেকে আনতে। বুড়ো থুথুড়ে উসমান হেকিম পাক্কা পাঁচ মিনিট লাগিয়ে দিলেন তেতলায় উঠতে। আরও পনেরো মিনিট লাগালেন রোগের লক্ষণ বার করতে। তারপর আরও দশ মিনিট ধরে ওষুধ খুঁজলেন। এরপর পাঁচ টাকা দক্ষিণা নিয়ে যখন বিদেয় হলেন আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
অনিরুদ্ধকে হেকিমের বড়ি গোটা কয়েক খাইয়ে ফের নীচে গেলাম রাতের খাবার আনতে। কাবাব আর রুটি নিয়ে ঘরে এলাম যখন, তখনও অনিরুদ্ধ সমানভাবে কাতরে যাচ্ছে। ওষুধে যেন কিছুই হয়নি ওর। আমি যে ওকে কিছু খেতে বলব সে-সুযোগও হল না। আমি নিঃশব্দে বসে ঘড়ি দেখে যেতে লাগলাম। কে যেন কবে বলে রেখেছিল—টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার!
চোখের সামনে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, সময় বয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে, আর অনিরুদ্ধ জ্বরে বেহুঁশ হয়ে গোঙাচ্ছে।
এভাবে রাত দশটা বাজল। আমি প্যাকেট আর ভাঁড়ের খাবার যেমনটি ছিল তেমনটি রেখে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লাম। ভোর হলেই সফরসঙ্গীকে নিয়ে কলকাতা ফিরে যাব মনস্থ করেছি। মনটা এমনিতে বেশ দমেই ছিল, অনিরুদ্ধ অসুস্থ হতে সেটা প্রায় ভেঙেই গেছে। এ সফর থেকে লেখা আর কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। বিষণ্ণ ভাবটা যত বাড়ছে ততই যেন মাথাটা ক্লান্ত হয়ে আসছে। না চাইতেও একসময় ঘুম জড়িয়ে আসতে লাগল চোখে। আমি সিগারেট ধরিয়ে জেগে থাকার ক্ষীণ প্রয়াস করলাম।
হঠাৎ আলোটা নিভে গেল। ঝড়ের তোড়ে জানালার বন্ধ কপাট খড়খড় করে কাঁপতে লাগল। হঠাৎ এক বিদ্যুতের ঝলকে স্পষ্ট দেখলাম সাদা সালোয়ার কামিজে এক পরমাসুন্দরী তবায়েফ বা বাইজি মৃদু নূপুরধ্বনি তুলে এগিয়ে আসছে আমার খাটের দিকে। আমার সহসা মনে পড়ল হেকিম সাহেব অনিরুদ্ধকে দেখতে বসেছিলেন যখন ওর খাটে আমি ফেরির ডায়েরিটা তুলে রেখেছিলাম আমার মাথার পাশে টেবিলের ওপর। আমি মহিলাকে সেদিকে আসতে দেখে খাতাটার ওপর হাত চাপা দিলাম। আর হাতের ওপর সমানে উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ শুনতে লাগলাম।
আমার হাত কাঁপছিল কিন্তু আমি হাত তুলে নিইনি। অনিরুদ্ধর বড়ো ইচ্ছে এটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে কলকাতা। কিন্তু নিঃশ্বাসের বহর বাড়ছে, হাত আমার অবশ হয়ে আসছে। আর…আর…ও কী! অনিরুদ্ধ অমন ভাব করছে কেন, যেন কেউ গলা টিপে ধরেছে ওর?
আমি সোজা হয়ে পিঠ ঠেকালাম দেয়ালে। আর তখনই ফের এক বিদ্যুতের ঝলকে দেখলাম কালো কোট পরা এক তরুণবয়সি বিদেশি চড়ে বসেছে অনিরুদ্ধের বুকের ওপর। কিছু একটা চাই ওর অনিরুদ্ধের কাছ থেকে।
আমি অনিরুদ্ধ! বলে চিৎকার করে হাত সরিয়ে নিলাম ডায়েরির ওপর থেকে। আমার পাশের নিঃশ্বাসটা কিন্তু তাও সরে গেল না। ডায়েরিটা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। আমি ধরা ধরা গলায় ওই ছায়ামূর্তিকে বললাম, আপনি ডায়েরি নেবেন, নিয়ে যান। আমার বন্ধুকে ছেড়ে দিন। কিন্তু সে সরল না। শুধু অনিরুদ্ধর কাতর ধ্বনি আরও কাতর হল। আমি শুধু ভগবানকে ডাকতে শুরু করলাম যেন জ্ঞান না হারাই। আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে, জ্ঞান হারানোর অর্থ মৃত্যু নয়, দু-দুটো মৃত্যু।
হঠাৎ ফের একটা বিদ্যুৎ ঝলক। দেখলাম দেয়ালে বিদ্যুতের রেখায় একটা ক্রস হয়ে নিমেষে মিলিয়ে গেল। আর তক্ষুনি আমার মনে পড়ল ডায়েরির মধ্যেকার ক্রসটার কথা। তড়িঘড়ি ডায়েরির পাতা ঝেড়ে ক্রসটা বার করে হাতে নিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে জ্বলে উঠল আলো!
দেখলাম টেবিলে ডায়েরি নেই এবং অনিরুদ্ধ শান্তভাবে, নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে! উঠে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখলাম, দেখি দিব্যি সুস্থ শরীর, জ্বরের লেশমাত্র নেই।
আমি আলো নিভিয়ে দিয়ে এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লাম। জল-ঝড়েরও কোনো শব্দ নেই কোথাও। শোওয়ামাত্র গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার ক্লান্ত মস্তিষ্ক।
আমাদের ঘুম ভাঙল নমাজের আওয়াজে। আকাশে ফুটফুটে রোদ। তাতে শীত আরও কড়া হয়েছে। অনিরুদ্ধ বলল, শংকরদা, চলুন চা খাব।
৯.
চা খেয়ে টুকটুক করে আমরা হন্টন লাগালাম মুনির মঞ্জিলের দিকে। আমাদের দেখে জারিনা বাই তো অবাক! এত সকালে আমাদের আবার কী চাই!
অনিরুদ্ধ বেশ জোরের সঙ্গে বলল, আজ কিন্তু আপনাকে মুখ খুলতেই হবে।
কী ব্যাপারে?
রৌশন বাইয়ের ব্যাপারে।
কিন্তু ভাইসাব, ছেলেপুলে নিয়ে ঘরসংসার করি, কেন ঝুটমুট ঝামেলায় ফাঁসি বলুন তো?
এবার আমি বললাম, আর কোনোদিনও কোনো ঝামেলা হবে না। সে-ব্যাপার আমরা মিটিয়ে দিয়েছি বরাবরের মতো। আপনি শুধু বলুন আপনি কী জানেন! জারিনা বললেন, তা হলে ভিতরে আসুন।
ক্রমে চা এল, পান এল। আমরা পান সরিয়ে রেখে চা পান করলাম। জারিনা বড়ো দু খিলি পান মুখে গুঁজে বললেন, আমার ঠাকুমার ঠাকুমার নাম রৌশন। রৌশন আরা বেগম। শুনেছি তিনি ফিরিঙ্গি ছিলেন। ইতালি না কোথাকার মেম। তবে আসল কথা হল উনি মেম ছিলেন না। একজন মেম হয়ে ওঁকে তখনকার এক রইস ইউসুফ আলির বাড়িতে বন্দি থাকতে হয়েছিল। কারণ ইউসুফ সাহেব সত্যিকারের রৌশন বাইকে গলা টিপে মেরেছিলেন সে যখন তার ফিরিঙ্গি দোস্তের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই চৌকের এক কোঠাতে থাকত সে সাহেব। তার সঙ্গে রাতেরবেলায় বোরখা পরে দেখা করতে যাচ্ছিল রৌশন। ইউসুফের লোকেরা ওকে পাকড়াও করে নিয়ে যায়। তারপর তো যা হওয়ার হল। কিন্তু ইউসুফ জানতেন ইটালিয়ান সাহেব ওর বান্ধবীর খোঁজ করবেই। তাই দু-দিন বাদেই তিনি আমার ঠাকুমার ঠাকুমাকে তুলে নিয়ে গেলেন চৌক থেকে। ঠাকুমার দোষ, সমঝদাররা বলতেন, তিনি নাকি লউনউয়ের দ্বিতীয় রৌশন। রূপে, গুণে, ব্যক্তিত্বে। আরও মজার ব্যাপার আমার ঠাকুমার ঠাকুমা গানও শিখেছিলেন রৌশন বাইয়ের কাছে। তাই তাঁকে যখন রৌশন সাজিয়ে দূর থেকে দেখানো হয়েছিল সাহেবকে, সে ধরতেই পারেনি।
এর কিছুদিন পর সাহেবের দরজা খটখটিয়ে দেখা গেল সে ঘুমের মধ্যে মরে গেছে। লোকজন বলল যে, কয়েক সপ্তাহ ধরে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল সাহেব। নিজের ঘর থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর মৃত্যুর পর ওই ঘরে কেউ কোনোদিন পর পর দু রাত থাকতে পারেনি। শেষে ঘরটা বরাবরের মতোই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওটার নাম হয় ‘ফেরি কোঠা। যতদূর জানা যায় ওই সাহেবের নাম ছিল ফেরি। আর আরও তাজ্জব কি বাত ইউসুফ সাহেবও এর কিছুদিন পর ঘুমের ঘোরে মারা যান। ওঁর গলায় দশ আঙুলের ছাপ ছিল স্পষ্ট। ওঁর খানসামারা হলফ করে বলেছিল, ইউসুফের সব দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কারণ প্রতি রাতেই উনি কালো কোট-পরা এক ফিরিঙ্গি সাহেবকে ওঁর কামরায় ঢুকে আসতে দেখতেন।
ইউসুফ সাহেবের মৃত্যুর পরও সেই সাহেবের আসা-যাওয়া থামেনি। শেষে আমার ঠাকুমার ঠাকুমা ওই প্রাসাদ ছেড়ে ছেলেপুলে নিয়ে চলে আসেন চৌকের এই মুনির মঞ্জিলে। নিজের নাম তিনি বদলে ফেলে করে দিলেন ফিরদৌসি বাই। আর সবাইকে নিষেধ করে দিলেন মুখে রৌশন কি ফেরির নাম না নিতে। কী বলব বাবুসাহেব, আমাদের এই বাড়িতেও আমরা মাঝে মাঝে রৌশন বাই আর সাহেবের আসা-যাওয়া দেখেছি। আমার সন্তানের মাথায় হাত রেখেও বলতে পারি।
জারিনা বাই চুপ করলেন। চুপ করে বসে রইলাম আমরাও। অনেকক্ষণ পর পকেট থেকে ফেরির ডায়েরির ক্রসটা বার করে মহিলাকে দিয়ে বললাম, আপনি ধর্মভীরু মুসলমান। তবে উদার মানুষও বটে, যেভাবে আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করলেন অ্যাদ্দিন। দয়া করে এই ক্রসটা বাড়ির কোথাও রাখবেন, তা হলে আর কখনো ওই দুই আত্মার আসা-যাওয়া দেখতে হবে না।
জারিনা বাই পরমভক্তিভরে ক্রসটা হাতে নিয়ে দরদের সঙ্গে বললেন, শুকরিয়া!
১০.
জারিনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমেই দু-জনে দুটো দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ডায়েরিটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয় এবং মগজের দু-টি ভারই যেন হাওয়ায় উবে গেছে। আমাদের এবার পুরোদমে আসল কাজটায় ফিরে যাওয়া দরকার। অনিরুদ্ধ বলল, এবার তা হলে? বললাম, আমাদের সেই প্রথম দিনের রুটিনমাফিক কাজে নামা দরকার। ও বলল, কিন্তু? বললাম, কিন্তু?
একবার গোলকধাঁধায় গিয়ে শেষবারের মতো মিলিয়ে দেখলে হয় না ব্যাপারটা সত্যি সত্যি মিটল কি না?
কথাটা যে আমার মনেও উঁকি দেয়নি তা নয়। শুধু সাহস হচ্ছিল না মুখ ফুটে বলার। কে জানে আবার সেই পুরোনো চক্করে পড়ি কি না। কিন্তু অনিরুদ্ধ কথাটা তোলায় বেশ জোর এল মনে, বটেই তো! সব উলটোপালটা জিনিসেরই শেষ দেখে নেওয়া দরকার। তাতেই বিজ্ঞানবোধ ও বিবেক—দুটোই স্বস্তি পায়। তাই বললাম, বেশ! কিন্তু যাই-ই ঘটুক, আমরা তাতেই ঘটনার ইতি টানব। না হলে যে-কাজের জন্য আসা সেটাই মাঠে মারা যাবে। ও বলল, নিশ্চয়ই, শংকরদা! ভূত আছে কি না-আছে সেটা প্রমাণ করতে তো আমরা আসিনি। শুধু মিলিয়ে নেব ওই ভুলভুলাইয়ার ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হল কি হল না। আমাদের চৌকের ঘরের কান্ডটা তো মিটেছে বলেই মনে হয়।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ভুলভুলাইয়াতে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়াল নেই। চারিদিক শুনশান, কোথাও কেউ নেই। একটা সুন্দর হাওয়া কোত্থেকে বয়ে আনছে শীতের কামড়। নীল আকাশ, চকচকে রোদ এবং ঠাণ্ডা মিশে একটা অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে। এমন একটা মনোরম পরিবেশেও ভুলভুলাইয়ার রহস্য আমাদের তাড়া করছে-কী বিচিত্র আমাদের দুটি মন!
আমরা একটু একটু করে ঘুরপাক খেতে খেতে ফিরে এলাম সেই ছোটো কুঠুরিতে, যেখান থেকে রোজানার কণ্ঠ শুনেছিলাম পূর্বে। অনিরুদ্ধ বলল, আপনি এইখানেই থাকুন। যে জায়গা থেকে কথা কইলে আপনি শুনতে পাবেন আমি সেই কুঠুরিতে যাচ্ছি। আপনি খেয়াল রাখুন, আমি হাত নাড়ব। তারপর কথা বলব আমরা। এই বলে ও চলে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে দুটো সুখটান দিয়ে ওই ঘন অন্ধকারে অপেক্ষায় রইলাম ওর কণ্ঠধ্বনির।
দুটোর পরে আরও ক-টা সুখটান দিয়েছিলাম খেয়াল করিনি। দেখলাম হাতের চারমিনার ফুরিয়ে এসেছে। সেটাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চাপা দিয়ে দিলাম। আর মাথা বাড়িয়ে ডানদিকের সেই কুঠুরির দিকে চাইলাম। দেখি হাত নাড়ছে অনিরুদ্ধ। আমি ভেতরে সরে এসে দেয়ালে কান পেতে জিজ্ঞেস করলাম, বলো, কী বলবে, অনিরুদ্ধ। তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
একটা দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ হল। বুঝলাম অনিরুদ্ধ সিগারেট ধরাচ্ছে। আমি একটু সময় দিয়ে ফের বললাম, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, অনিরুদ্ধ?
ওপার থেকে এবার ধ্বনি ভেসে এল—নারীকন্ঠে! ‘সি সিনিওর!’ অর্থাৎ ‘হ্যাঁ, মহাশয়। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে গলায় বল এনে বললাম, তুমি অনিরুদ্ধ না!
—আমি রোজানা!
—অনিরুদ্ধ, তুমি ইয়ার্কি করছ না তো?
—আপনি কাকে খুঁজছেন? এখানে তো আর কেউ নেই। শুধু আমি।
—আপনি রোজানা?
—হ্যাঁ।
—আপনি তো ডায়েরি পেয়ে গেছেন। এরপর আর কী চাই?
—তোমাকে। নিকোলা! প্রিয়তম নিকোলা। নিকোলা ফেরি!
আমার হাঁটু কাঁপছে। রোজানার ধ্বনি থেমে যাওয়ার পর আমার হৃৎপিন্ডের দারুণ দামামা কানে আসছে। হার্ট অ্যাটাকের আগে এমনটি হয় বুঝি! মহিলা আমাকে নিকোলা ফেরি ঠাউরেছেন। চিৎকার করে বললাম, রোজানা, আমি নিকোলা নই! আপনি ভুল করছেন।
—আস্তে কথা বলো, নিকোলা। ওভাবে চিৎকার করলে সবাই জেনে যাবে আমরা এখানে।
-না, না, আপনি ভুল করছেন, রোজানা!
—তোমার শরীর খারাপ, নিকোলা। তুমি উত্তেজিত হোয়য়া না লক্ষ্মীটি! তুমি চুপ করে দাঁড়াও, আমি আসছি। তারপর দু-জনে আমরা…
—আমার কানে আর কিছু যাচ্ছে না। এ কোন গোলকধাঁধায় এসে পড়লাম, হে ভগবান। বাঁচতে হলে তো এক্ষুনি আমার এখান থেকে বেরিয়ে পড়া দরকার। আমাকে বাঁচতে হবে।
আমি কুঠুরির বাইরে পা বাড়িয়ে অন্ধকার গলিতে পড়লাম এবং হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগলাম। কিন্তু… কিন্ত… আমার গলির পাশের গলি দিয়ে ওটা কে হাঁটছে। অনিরুদ্ধ? তা কী করে হয়? ও পায়ে তো নূপুরধ্বনি হচ্ছে। নূপুরের আওয়াজ আমার দিকেই আসছে। হাওয়াতে একটা চেনা আতরের সুবাসও ছড়িয়ে পড়ছে। আর আমি অন্ধকারে অন্ধের মতো দেওয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোচ্ছি। কিন্তু অন্ধকার ক্রমশ ঘন জমাট পাথর হয়ে উঠেছে। এরকম অন্ধকার অমাবস্যার রাতে ছাড়া দেখিনি কখনো। অন্ধকারের মধ্যে যেন আরও একটা অন্ধকারের প্রলেপ। আর সেই অন্ধকারটা চারপাশ থেকে আমার শরীরে চেপে বসছে। আমি হাত দিয়ে অন্ধকারটাকে ঠেলছি, কিন্তু আমার শক্তি আর কতটুকু! পায়েলের আওয়াজে একটা চক্ৰধার তেহাই পড়ল শুনলাম। কথক নাচ হচ্ছে কোথাও। পাথুরে অন্ধকারে নাচ শুনতে শুনতে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। একটা গভীর, অন্তহীন অন্ধকারে শুধু পড়ছি, পড়ছি আর পড়ছি।
আর একটা তেহাই সম-এ এসে পড়ল এবং আমি যন্ত্রণায় লুটিয়ে পড়েছি মাটিতে।