।।কওমি তারানা।।
২ নভেম্বর। শাহরুখ খানের জন্মদিন।
২ নভেম্বর। টলি অভিনেতা চিরঞ্জিতের জন্মদিন।
২ নভেম্বর। প্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও জন্মেছেন এই দিনেই।
২ নভেম্বর। একটি ভুলে যাওয়া ঐতিহাসিক ‘গান’-এর জন্মদিন। যার কথা কেউ বলে না।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত সেই গানটি নিজে একটি বিশ্রুত অধ্যায়, যাকে ভুলেছে ইতিহাস। যাকে ভুলেছি আমরাও। অনাদরে, অবহেলায় ইতিহাসের ধুলোমাখা, ছেঁড়া পাতা থেকে প্রতিবছর এই দিনটিতে সেই গানটি নিঃশব্দে মুখ বাড়ায়। অথচ আমরা দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। শুধু গানটি রয়ে যায়। রয়ে গেছে আজও।
১৯৪৩ সাল। সারাদেশ জুড়ে তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ। কাতারে কাতারে মানুষ ঝাঁপ দিচ্ছে সেই মহাযজ্ঞের আগুনে। ভারতের স্বতন্ত্রতা সংগ্রামের সেই লেলিহান অগ্নিকুন্ডের একদিকে দাঁড়িয়ে অহিংস অথচ অসহযোগ আন্দোলনের পুরোধা ‘মহাত্মা’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, অন্যদিকে সশস্ত্র সেনা অভ্যুত্থানের স্বপ্নে বিভোর ‘নেতাজী’ সুভাষচন্দ্র বসু। তার ‘দিল্লি চলো’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একটু একটু করে বর্মা সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লি দখলের স্বপ্ন দেখছে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। এমনই এক অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে জন্ম এই গানটির। বছর দুয়েক আগে গানটির কথা প্রথম মাথায় আসে ‘নেতাজী’র। এই গানটি তারই ‘ব্রেন চাইল্ড’।
বড়োই অস্থির হয়ে পড়েছেন সুভাষচন্দ্র। তার ‘আই এন এ’ শেষমেশ গঠন তো হয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর জন্য চাই একটি যুতসই গান। যাকে বলে ‘মিলিটারি মার্চ সং’। গত দু’ বছর ধরে এ নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেছেন তিনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারেননি। আর সেটাই হয়েছে মুশকিল।
সে বছরই অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে ‘Provisional Government of Free India’ (আর্জি-এ-হুকুমতে-আজাদ হিন্দ)-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিন ‘বন্দেমাতরম’ গেয়েছিলেন ‘আই এন এ-র সেনানীসহ সমবেত জনতা। তখন ‘বন্দেমাতরম’-এর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কিন্তু আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর অনেক অহিন্দুরা এই গানের দর্শন ও ভাষার সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েন। তখনই মনে মনে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন ‘নেতাজী’। একটি স্বতন্ত্র গান চাই। এমন একটি গান যাতে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং আঞ্চলিকতার ভেদাভেদ মুছে যাবে। যা শুনে রক্ত গরম হয়ে উঠবে সবার। যে গান গাইতে গাইতে দেশমাতৃকার জন্য আত্মহুতি দিতে পিছপা হবে না সেনারা। কিন্তু বাংলায় নয়, তা চাই হিন্দি বা হিন্দুস্থানীতে। কারণ, নেতাজীর আই এন এ-তে অহিন্দু ও অবাঙালী সেনার সংখ্যা কিছু কম নয়, বরং অনেকাংশে বেশিই। কালক্রমে তা-ই হয়ে উঠবে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর অলিখিত জাতীয় সংগীত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, রবি ঠাকুরের ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ শোনার পর আর কোনও গানের কথা ভাবতেও পারছেন না নেতাজী। ‘রানী ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগলেরও তা-ই প্রথম পছন্দ। কিন্তু সেখানেও যে ভাষাগত ও দর্শনের ‘পরিচিত’ সমস্যা। তাহলে উপায়? এমন সময়, হঠাৎই একদিন বিদ্যুৎ চমকের মতো নেতাজীর মাথায় খেলে গেল একটি ‘আইডিয়া’। একটি ‘স্বতন্ত্র’ ও বিকল্প গান—হ্যাঁ, হবে। ‘জনগণমন’ই হবে। শুধু ভাষাটি যাবে বদলে। অর্থাৎ, হিন্দি বা হিন্দুস্থানীতে হবে একটি বিশেষ সংস্করণ। সুর একই থাকবে, শুধু লয় ও তালে আসবে সামান্য দ্রুততা। ব্যাস! যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। ডাক পড়ল সেনাবাহিনীর উর্দু ও ফার্সির পন্ডিত ‘শায়ের’ ক্যাপ্টেন আবিদ হাসান ‘সাফরানী’ (মতান্তরে আবিদ আলী) ও গোর্খা ‘ব্যান্ডমাস্টার’ ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরি (মতান্তরে ঠাকুর)-র। হুকুম হল ‘জনগণমন’-র ‘মাধুর্য’ ও ‘অন্তর্ভাষ্য’ বহাল রেখে তা হিন্দিতে লিখবেন আবিদ মিয়াঁ। তাকে সাহায্য করবেন ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’র সঞ্চালিকা ও লেখিকা মমতাজ হুসেন। প্রয়োজনে নেতাজী নিজেও থাকবেন।
যন্ত্রসংগীতের বিরল প্রতিভা ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরি থাকবেন যন্ত্রানুসঙ্গ পরিচলন (মিউজিকাল অ্যারেঞ্জমেন্ট) ও সুরারোপের দায়িত্বে। পরবর্তীকালে পণ্ডিত বংশীধর শুক্লার রচনা ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’-তে সুর দিয়ে তা অমর করেন ঠাকুরি।
তারপর সৃষ্টি হল ইতিহাস। রচিত হল ‘শুভ সুখ চৈন কি বরখা বরষে/ভারতভাগ্য হ্যায় জাগা’। প্রকাশ্যে এল রবিচ্ছায়ায় নির্মিত সেই হিন্দি গান—যা পরবর্তীকালে ‘কওমি তারানা’ নামে প্রসিদ্ধ হবে। পরাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সংগীত। পরে, সেই গান শুনে খুশি হয়ে ক্যাপ্টেন ঠাকুরিকে একটি স্যাক্সোফোন ও বেহালা উপহার দেন নেতাজী। আবিদ আলি পান একটি সোনার কলম। ১৯৪৬ সালের ২০ জুন দিল্লিতে বিখ্যাত আই এন এ বন্দীদের ‘রেড ফোর্ট ট্রায়াল’-এর সময় গান্ধিজির উপস্থিতিতে নেতাজীর দেওয়া বেহালায় এই গান বাজিয়ে শোনান রাম সিং। স্বাধীনতা দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে তিনি ও তার অর্কেস্ট্রা দিল্লির লালকেল্লায় এই ‘কওমি তারানা’ পরিবেশন করেন। বাকিটা ইতিহাস। এরপরে কেটেছে কয়েক দশক। ‘নেতাজী’ জীবিত না মৃত তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ নেই। বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছেন এই গানের অন্যতম তিন রূপকার-ক্যাপ্টেন আবিদ হাসান সাফরানী, মমতাজ হুসেন ও ক্যাপ্টেন রামসিং ঠাকুরি। রয়ে গেছে শুধু গানটি।
২ নভেম্বর পরাধীন ভারতের সেই প্রথম ‘অলিখিত’ জাতীয় সংগীতের জন্মদিন।
शुभ सुख चैन की बरखा बरसे, भारत भाग है जागा
पंजाब, सिन्ध, गुजरात, मराठा, द्राविड़ उत्कल बंगा
चंचल सागर, विन्ध्य, हिमालय, नीला जमुना गंगा
तेरे नित गुण गाएँ, तुझसे जीवन पाएँ
हर तन पाए आशा।
सूरज बन कर जग पर चमके, भारत नाम सुभागा,
जए हो! जए हो! जए हो! जए जए जए जए हो! ।।
सब के दिल में प्रीत बसाए, तेरी मीठी बाणी
हर सूबे के रहने वाले, हर मजहब के प्राणी
सब भेड और फर्क मिटा के, सब गोद में तेरी आके,
गूंथें प्रेम की माला।
सूरज बन कर जग पर चमके, भारत नाम सुभागा,
जए हो! जए हो! जए हो! जए जए जए जए हो! ।।
शुभ सवेरे पंख पखेरे, तेरे हि गुण गाएँ
बास भरी भरपूर हवाएँ, जीबन में रूत लाएँ,
सब मिल कर हिन्द पुकारे, जय आजाद हिन्द के नारे।
प्यारा देश हमारा।
सूरज बन कर जग पर चमके, भारत नाम सुभागा,
जए हो! जए हो! जए हो! जए जए जए जए हो!।।
।।অভয় পদ কমলে।।
সাল ১৮৮৫, ২২ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণেশ্বর। পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ’র জন্মমহোৎসব। নরেন্দ্র রাখাল বাবুরাম ভবনাথ সুরেন্দ্র গিরীন্দ্র বিনোদ হাজরা রামলাল রাম নিত্যগোপাল মণি মল্লিক গিরিশ সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজসহ বহু ভক্তের সমাগম। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে চাঁদের হাট। চারদিন আগেই কেটেছে জন্মদিন। ঠাকুরের শরীর আগের চেয়ে ভালো। তাই ভক্তেরাও খুশি। কীর্তন শেষ হয়েছে খানিক আগেই। বেলা গড়াচ্ছে ধীরে, মন্থরে।
মাস্টার এসে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। ঠাকুর তাকে ইঙ্গিতে কাছে এসে বসতে বলেন। এইবার গান গাইবেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর যে তার গানের বিশেষ ভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে তানুপরাটি পেড়ে দিতে বলেন। পরম যত্নে কোলের উপর নিয়ে নরেন্দ্র তানপুরাটি বাঁধছেন। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চলছে তানপুরার কান মুলে মুলে শুদ্ধ স্বর বের করার কঠিন প্রক্রিয়া। বেশ অনেকটা সময় অতিক্রান্ত। এদিকে ঠাকুর ও অন্য সকলে ক্রমশ অধৈর্য। বিনোদ মুচকি হেসে বললেন, ”আজ শুধু বাঁধাই হবে, গান হবে আর একদিন।” ঘরভর্তি সকলে হো হো করে হেসে ওঠেন। নরেন্দ্রনাথ ভ্রূক্ষেপহীন। তিনি ধ্রুপদের তালিম পাওয়া ছাত্র। এসবে কান দেবেন কেন? শুদ্ধ স্বর চাই, শুদ্ধ স্বর। তা সে যতক্ষণ সময় লাগুক। শ্রীরামকৃষ্ণ হাসছেন আর বলছেন, ”এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে তানপুরাটা ভেঙে ফেলি। কী যে তখন থেকে শুধু টং টং টং—আবার তানা নানা নূম হবে।” এবার প্রিয় শিষ্যর কান ক্রমশ লাল হয়ে ওঠে। পালটা যোগ দিলেন ভবনাথ। আলতো কটাক্ষ, ”সব যাত্রার গোড়াতেই ওমন একটু হয়।” এবার ফোঁস করে ওঠে নরেন। বহু কষ্টে পাওয়া গেছে স্বর। শেষ পর্যায়ে তার বাঁধতে বাঁধতে রাগত স্বরে বললেন, ”সে না বুঝলেই হয়।” হেসে ওঠেন প্রেমের ঠাকুর। ”ওই দিলে দিলে…আমাদের সব উড়িয়ে দিলে।”
বাঁধভাঙা হাসি থামলে শুরু হল গান। অদ্ভুত তার সুর। কী অদ্ভুত চলন। নিবিষ্ট হয়ে গান গাইছেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর তার খাটে বসে শুনছেন। বাকিরা মাটিতে। প্রথম গান—’অন্তরে জাগিছ ও মা অন্তর যামিনী, কোলে করে আছ মোরে দিবস যামিনী’। ঠাকুর স্থির। ঘরভর্তি লোক বাকরুদ্ধ। সূচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। এবার দ্বিতীয় গান—’গাও রে আনন্দময়ীর নাম। ওরে আমার একতন্ত্রী প্রাণের আরাম’। ঠাকুরের সারা শরীর কাঁপছে। গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গান শেষ হতে তানপুরা নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন নরেন্দ্র। বারণ করলেন ঠাকুর। ”আহা, সেই গানটা ধর না…সেই গানটা।” যেন কোন ঘোরের মধ্যে থেকে ভেসে এল স্বর। আনত চোখ, দুটো হাত বুকের উপর। গায়কের হাতে ফিরে এল তানপুরা। চোখ বুজে আবার সুর মেলালেন নরেন্দ্র। তার অত্যন্ত প্রিয় গানগুলির একটি। ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের ধ্রুপদী রচনা। বাগেশ্রী রাগের অপার্থিব সুরলোকমণ্ডল। নিমেষের মধ্যে ঠাকুরের ভাবসমাধি। গঙ্গা থেকে যেন উড়ে আসছে চন্দনের গন্ধ। দূরে ভবতারিণী মন্দিরে একা হাসছেন ‘তিনি’। তাঁর চিন্ময়ী হাসিতে চরাচর জুড়ে আলোর সমুদ্র। ডুবতে ডুবতে, ভাসতে ভাসতে ভেসে চলছে জগত-সংসার।
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরি-গুহাবাসী।
অনন্ত আঁধার কোলে মহানির্বাণ-হিল্লোলে,
চিরশান্তি-পরিমল অবিরল যায় ভাসি।।
মহাকাল রূপ ধরি, আঁধার বসন পরি,
সমাধি মন্দিরে ও মা কে গো তুমি একা বসি।
অভয় পদ কমলে প্রেমের বিজলী খেলে,
চিন্ময়-মুখ মণ্ডলে শোভে অট্ট অট্টহাসি
।। কালী, দ্য মাদার।।
সাল ১৮৯৮। শ্রীনগর, কাশ্মীর। ডাললেকের উপর একটি হাউসবোটে বসে এক সন্ন্যাসী। ঝিলমের উপর সূর্যাস্ত দেখছেন। সেই সন্ন্যাসী, যিনি পাঁচবছর আগেই ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর ধর্মমহাসভা আন্দোলিত করেছেন তাঁর ভাষনে। তাঁর উদাত্ত কন্ঠে ‘হে আমার আমেরিকার ভাইবোনেরা’—সেই সম্বোধনে মুগ্ধ তামাম মার্কিনবাসী। এরপর দীর্ঘ চারবছর যিনি ইউরোপ চষে বেড়িয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন দেশে। দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পরিভ্রমণ ও হাওয়াবদল করতেই তাঁর কাশ্মীরে আসা। কিন্তু সেদিন কী যেন হল, শতাব্দী-প্রাচীন ক্ষীর-ভবানী মাতার মন্দিরদর্শনে গিয়ে। মাতৃবিগ্রহ দর্শনের সেই ঘোর তার কিছুতেই কাটে না। ভিতরে ভিতরে বাড়ছে প্রচণ্ড অস্থিরতা। তাঁর সেই অস্থিরতা, ভাবোন্মাদতা এতই তীব্র যে হাউসবোটের মালিক, জনৈক মুসলিম ব্যবসায়ীর ছ’বছরের মেয়েকে মাতৃজ্ঞানে পুজোও করেছিলেন স্বামীজি। তবু যেন সেই ভাব কাটতে চায় না। তাঁর অস্থিরতা আঁচ করতে পেরেছেন তাঁর সহযাত্রী সিস্টার নিবেদিতা, জেসোফিন ম্যাকলয়েড ও শ্রীমতী ওলে বুলও। অবশেষে সেই প্রগাঢ় অস্থিরতা কলমের আঁচড়ে শান্ত করলেন তিনি। সৃষ্টি হল ‘কালী, দ্য মাদার’ নামে সেই অসাধারণ, কালোত্তীর্ণ কবিতাটি যাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন দেশবাসী। মুগ্ধ হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র ও অরবিন্দের মতো মনীষীরা। মিস ওলে বুল পরবর্তীকালে জানিয়েছিলেন, রচনাটিতে সুর দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন বিবেকানন্দ। রোমান ওপেরার প্রভাব ছিল সেই সুরে। যদিও পরে সেই সুর আদৌ স্বরলিপিভুক্ত হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না। শুধু রয়ে গেছে কিংবদন্তি এই রচনাটি। আজও কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই ঘোর, সেই উন্মাদনা ও তিমিরনাশিনী অপার্থিব আলোর ছটা বিদ্যমান।
Kali, the Mother
The stars are blottted out,
The clouds are covering clouds,
It is darkness vibrant, sonant.
In the roaring, whirling wind
Are the souls of a million lunatics
Just loose from the prison-house,
Wrenching trees by the roots,
Sweeping all from the path.
The sea has joined the fray,
And swirls up mountain-waves,
To reach the pitchy sky.
The flash of lurid light
Reveals on every side
A thousand, thousand shades
Of Death begrimed and black–
Scattering plagues and sorrows,
Dancing mad with joy,
Come, Mother, come!
For Terror is Thy name,
Death is in Thy breath,
And every shaking step
Destroys a world for e’er.
Thou “Time”, the All-Destroyer!
Come, O Mother, come!
Who dares misery love,
And hug the form of Death
Dance in Destruction’s dance,
To him the Mother comes.
।। দেবীমাহাত্ম্য ও শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর আদিরূপ।।
ভারতীয় মার্গ সংগীত এক অপার সমুদ্র। প্রগাঢ় তার ব্যাপ্তি, তার গভীরতা, বৈচিত্র্য। শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন স্তর তাকে করে তুলেছে আরও সমৃদ্ধ, রত্নখচিত। সেখানে পরতে পরতে বিস্ময়। সংগীতের নিজস্ব নিয়মে সেখানে কখনও উঠে এসেছে প্রকৃতি, কখনও সময়, কখনও দেশকাল আবার কখনও গোটা ব্রহ্মাণ্ড।
মার্গ সংগীতের ভুবন বিস্তৃত জালে ধ্রুবতারার মতন জ্বলজ্বলে অবস্থান—বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর। অদ্ভুত তাদের নাম, ততধিক অদ্ভুত তাদের চলন, সাঁঝ সরগম। প্রতিটি শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিনীর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এক একটি অশ্রুত ইতিহাস, কিংবদন্তি। যুগ যুগ ধরে সেই সব রাগ-রাগিনী আমাদের কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে ও তারও ঊর্ধ্বে দিয়েছে রহস্যময়তা। অনাবিল সেই সব সুরের রৌদ্রজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় আমরা খুঁজে পাই ভগবত দর্শনের পরিপূর্ণতা। এ এক অবর্ণনীয় সুরেলা বর্ণমালা, যাকে সহজে কোনও চেনা সমীকরণের কাঠামোয় আটকানোর কল্পনা করা অসম্ভব।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে, যেখানে প্রেম-প্রকৃতি-ভক্তি-সমৃদ্ধির এত বিকাশ, সেখানে ভারতীয় লৌকিক দেব-দেবীদের প্রসঙ্গ থাকবে না, তা অকল্পনীয়। কথিত আছে, আদি সংগীতাচার্য হলেন স্বয়ং পিনাকপাণি মহাদেব। তার থেকেই উৎপত্তি শাস্ত্রীয় রাগরাগিনীর তত্ত্ব-কৌমুদীর। আর এখানেই তা স্বতন্ত্র, পথিকৃৎ। সময়ের সুদীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে তাই বারবার উঠে এসেছে দেব-দেবী বন্দনা, দেবী-মাহাত্ম্য গাথা। কখনও সুরের অপার্থিব মূর্ছনায়, আবার কখনও রাগ-রাগিনীর নাম-পরিচয়ের মাধ্যমে দৈবশক্তির পরিচয় করিয়েছে এই সুরলোক। সেই ঐশ্বরিক ভক্তিবাদ ও দৈবস্তুতির কথা আজ কতটাই বা আমরা মনে রেখেছি, মর্মস্থ করেছি। আজ পারিপার্শ্বিকের নিরিখে ভারতীয় রাগ-রাগিণীতে দেব-দেবী মাহাত্ম্য নতুন করে খুঁজে দেখা প্রাসঙ্গিক, সমকালীন।
কিংবদন্তি অনুসারে ও সারঙ্গদেব রচিত আকর গ্রন্থ ‘সংগীতরত্নাকর’ জানাচ্ছে দেবাদিদেব শিব হলেন সংগীতশাস্ত্রের আদিগুরু। তাঁর ভয়ংকর প্রলয়নৃত্যের সূত্র ধরেই উঠে এসেছে তাল-লয়-ছন্দ ও মাত্রার প্রকাশ। একই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে বহু রাগ-রাগিণীর। যেমন, শিবের পূর্বমুখ থেকে উঠে এসেছে রাগ ‘ভৈরব’, পশ্চিম মুখে নিঃসৃত রাগ ‘হিন্দোল’ বা ‘হিন্দোলম’, উত্তরমুখে প্রকাশ রাগ ‘মেঘ’-এর, দক্ষিণে ‘দীপক’ ও ঊর্ধ্বমুখ থেকে রাগ ‘শ্রী’। একইভাবে পুরাণ মতে দুর্গা বা পার্বতী থেকেও উৎপত্তি একাধিক রাগের, যার অন্যতম হল রাত্রি দ্বিপ্রহরের রাগ ‘মালকোষ’।
পুরান মতে, শিবের তাণ্ডবনৃত্য প্রশমিত করতেই এই রাগ সৃষ্টি করেন পার্বতী, যাতে ‘মাল’ ও ‘কৌশিকী’ দুটি রাগের রয়েছে অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই সূত্র ধরে কোথাও যেন এক হয়ে যায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্নাটকী মার্গ সংগীত ও তাদের সংস্কৃতির ইতিহাস। মহামতি মাতঙ্গ ও ত্যাগরাজের বর্ণনার সূত্র ধরে পাওয়া যায় শত শত বর্ষ পূর্বে বিভিন্ন দেব-দেবীদের উপর রচিত রাগ-রাগিনীর আখ্যান। সেই সব রাগ-রাগিনীর চলন, আরোহন-অবরোহনে ফুটে উঠেছে দৈবের প্রকাশ। শাস্ত্রমতে যা স্বয়ংসিদ্ধ। এর মধ্যে যেমন শিবমাহাত্ম্য নিয়ে পাওয়া যায়—’পান্থভারালী’ বা ‘পূর্বী’ ‘কেদারম’ বা ‘কেদার’ ‘হিন্দোলম’ বা ‘হিন্দোল’ ‘ভূপালাম’ বা ‘ভূপালী’ ‘কিরওয়ানী’ ‘শঙ্করা’ ‘ভৈরব’ ‘নট ভৈরব’ ‘খট’ ও ‘রেবতী’র মতো রাগের উল্লেখ।
বিষ্ণুকে নিয়ে রয়েছে—’বাওলী’ বা ‘ভূপাল টোরী’, ‘বৃন্দাবনী সারঙ্গ’ বা ‘সীমেন্দ্রমধ্যম’-এর মতো রাগ। কৃষ্ণবন্দনায় নিহিত রয়েছে—’কম্বোজি’, ‘কানাড়া’, ‘মোহনম’-এর মতো বিরল সব রাগ। শ্রীরাম-কে নিয়ে ‘নট্টকুরঞ্জিনী’, ‘সারং’, ‘খামাজ’, এমনকি ‘খরহরপ্রিয়া’ (মতান্তরে সীতা বা জানকীস্তুতি) বা ‘সম্মুখপ্রিয়া’-র মতো বিরল ও অপ্রচলিত রাগের হদিস পাওয়া যায়। এই তালিকার একটি বড়ো অংশ নিহিত রয়েছে দেবীমাহাত্ম্যের গভীর সংকলনে। দেবী যেখানে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণা, রাগিনীসিদ্ধা, সুরসম্ভুতা। দেবীবন্দনা ও মাহাত্ম্যকীর্তনেও বারবার ঝলকে উঠেছে মার্গ সংগীতের বিদ্যুৎ। সৃষ্টি হয়েছে বহু রাগ-রাগিনীর কথা। শুধু দেবীবন্দনাই সেখানে উপলক্ষ নয়, দেবীর ভাব, মনন, বৈশিষ্ট্যাবলীর আত্মদর্শন রূপে ঘটেছে তাদের প্রকাশ। প্রতিটি রাগ-রাগিনীর চলনে প্রস্ফুটিত হয়েছে দেবীর প্রকৃতি, করুণা, বরাভয় ও সমৃদ্ধির অন্তর্লীন অনন্ত আখ্যান। কর্নাটকী সংগীতে রয়েছে এর একাধিক দৃষ্টান্ত। দেবী দুর্গার মহিমান্বেষণে পাওয়া যায়—অতি প্রাচীন রাগ ‘পুন্নাগাভরলি’ বা ‘পিলু’ ‘সাভেরী’ ‘নদানামাক্রিয়া’ ‘ধ্যানেশ্রী’ ‘আহিরী’ ‘ভৈরবী’ ‘দুর্গা’ ‘মুখরী’ ‘আরোহী’ ‘শিবরঞ্জনী’ ও ‘শ্যামা’-র উল্লেখ। দেবী দুর্গার মতোই তাঁর সন্তানদের নিয়ে রাগ-রাগিনীর ঐতিহ্যও বিপুল। সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্য বন্দনাগীতিতে দেখা যায়—’বেহাগ’ ‘নট’ ‘কামোদ’ ও ‘হংসধ্বনি’র ব্যবহার। মহালক্ষ্মীর জন্য উঠে আসে—’শ্রীরাগ’ ‘মধ্যমাবর্তী’ ‘কলাবতী’ ‘বাহার’ অমৃতবর্ষীনী’ অথবা ‘নলিনীকন্ঠী’। বাগ্দেবী ও বিদ্যাধরী সরস্বতীর জন্য রয়েছে—’রাগ সরস্বতী’, ‘জ্ঞানরঞ্জনী’ ‘শ্রী’ ‘বাগেশ্রী’ ‘কল্যানী’ ‘কৌষিকী’, ও ‘হংসধ্বনি’র মতো একাধিক রাগ। দেব-সেনাপতি কার্তিকের মহিমা নিয়ে—’আদানা’ ‘আভোগী’ ‘সারঙ্গ’ অথবা ‘বাচস্পতি’র মতো বিভিন্ন রাগের কথা নারদমুনির ‘সংগীত মকরন্দ’-এ পাওয়া যায়। এমনকি, রাগ-মাহাত্ম্য থেকে বাদ পড়ে না মহিষাসুরও। দেবী দুর্গার সঙ্গে পুজো হয় তারও। ‘নারায়ণী’, ‘বিলহরী’ এবং ‘গোরখ কল্যাণ’ রাগে ধ্বনিত হয় মহিষাসুর-বন্দনা। এই তালিকা সুদীর্ঘায়িত ও মহা-বিস্ময়কর। এটাই ভারতীয় মার্গ সংগীতের অপার সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য।
পরিশেষে, এই কথা বলাই যায় হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সুনিবীড় ও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে যে সাঙ্গীতিক বলয় তা আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম, মিথ ও দৈব ভাবধারায় সম্পৃক্ত, সহজাত ও পরিপূরক। সময়ের নিবিড় কালখণ্ড ধরে শতাব্দীর পর শতাব্দী যা সঞ্চারিত হয়ে আসছে আমাদের মননে, শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে। সেই সাংগীতিক সমৃদ্ধিকে আজও সমাজ, দেশ ও কালের নিক্তিতে মাপা অসম্ভব। শারদ উৎসবে যখন ধর্মীয় লোকাচারের সংস্কৃতি অসুরদলনী, দশপ্রহরনধারিনী মাতৃবন্দনার বৃন্দগানে মিলিত হয়, তখনই হবে সেই আরাধ্য স্তুতিতে নির্মিত প্রাচীন রাগ-রাগিনীর অপার্থিব উদ্ভাস। নেপথ্যে থেকেও যা চির বাঙ্ময়। এখানেই শাস্ত্রীয়সংগীত ও প্রাচীন রাগ-রাগিনীর ঐতিহ্যের সম্পূরণ ও সার্থকতা। এই সেই প্রত্ন-সুর, দেবী আবাহনের…
ভবানী দয়ানী মহাবাকবাণী
সুর-নর-মুনি জনমানি, সকল বুধ জ্ঞানী
জগ জননী, জগ দানী, মহিষাসুরমর্দিনী
জ্বলামুখী চন্ডী অমর পদদানী।
(রাগ-ভৈরবী, তাল-ঝাঁপতাল,
কথা-প্রচলিত, সুরকার-ভাতখন্ডে)
।। বৈষ্ণব জন কো।।
এই তো সেদিনের কথা। হঠাৎই দেখা তাঁর সঙ্গে। দিল্লির চিত্তরঞ্জন ভবনে বইমেলার বাইরে। ভাঙা একটি বেঞ্চের উপর লাঠিতে ভর দিয়ে বসে তিনি। সেই গোল চশমা, শীর্ণ দেহ, হাঁটুর উপরে ওঠানো ধুতি আর বিবর্ণ সাদা চাদরে ঢেকে রাখা তাঁর রুগ্ন পাঁজর। শুকনো মুখ, অথচ উজ্জ্বল দুটি চোখে কী নিবিড় আকুতি। কেউ দেখেনি তাঁকে। দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি দেখেছি। তিনি তখন মহাত্মা নন, বেয়াদপ উইয়ের বুভুক্ষু দাঁতে কাটা জরাজীর্ণ ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস অফ এম কে গান্ধি’।
বইমেলার উদ্যোগীরা বাইরে এনে ফেলে দিয়ে গেছে পুরোনো জঞ্জাল। প্রাচীন, অচল, জগদ্দল সে সব বইয়ের স্তুপ। ইচ্ছে হলেই নিতে পারেন। যত খুশি তত। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। অথচ কেউ সেদিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না। ধুলোভরা পাতা উলটে কারও সময় নেই সে সব রদ্দি বই পড়ার বা সংগ্রহ করার। তিনি করুণ অথচ শান্ত, ক্ষমাসুন্দর চোখে স্মিত হেসে আমাদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন সে সব। আমরা তাকাইনি। পাত্তা দিইনি বিন্দুমাত্র সে সব মূল্যহীন, নোংরা কাগজের টুকরোকে। কারণ আমরা জানি, মহাত্মা কোনও বইয়ের পাতায় নয়, নোটের পাতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পড়ার টেবিলে নয়, নৃত্যরতা বিদেশিনীর সঙ্গে তাল মেলানো তার ‘জাল’ ছবি বেশি বিতর্কের বিষয়। তিনি ‘চোখের বদলে চোখ’-এর বিরোধীতা নিয়ে কী বলেছেন তার চাইতে তিনি কোন কোন মহিলাদের সঙ্গে কী কী যৌনাচার করেছেন, সে সব বেশি গুরুত্ব পায়। তার সত্যাগ্রহের চাইতে বেশি জরুরি তার ঘাতকের উগ্র জাতিয়তাবাদী আদর্শগাথা। যেন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বললেন, ”সঙ্গে নেবে?” ঘৃণা ও সমর্থনের ঊর্ধ্বে উঠে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিই। কিন্তু ফেলতে পারি না। এতটাই প্রাসঙ্গিক তিনি? আজও?
জানিনা আজ কেন বিজয়ার সুর ও মহরমের মর্শিয়া ছাপিয়ে সেই সুর আচ্ছন্ন করছে আমায়! সেই রহস্যময় ধুন। পঞ্চদশ শতকের প্রাচীন গুজরাতি ভাষায় ভক্তিকবি নরসিংহ মেহতার মিশ্র খামাজ রাগের রচনা। যে সংগীতে, সাংগীতিক দর্শনে আচ্ছন্ন ছিলেন সেই ‘অর্ধমগ্ন ফকির’। আমি তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন সুরালোকে ডুব দিই। কিন্তু তল খুঁজে পাই না। শুধু অনিবার্যভাবে গভীরতা বেড়ে চলে।
বৈষ্ণব জন তো তেনেরে কহিয়ে,
জে পীড় পরায়ি জানে রে
পর দুঃখে উপকার করে তোয়,
মন অভিমান না আনে রে…
।। সরদারী বেগম।।
রেওয়াজে বসেছেন বেগম। কন্ঠে ভৈরবী। টুকরো টুকরো সরগম, চিনির দানার মতো ছড়িয়ে পড়ছে তানপুরার তার ঘেঁসে, কোঠির আশপাশে। তার দু-চোখ বন্ধ, একটি হাতে যেন তানপুরায় অহল্যা-স্পর্শ, অন্যটি শূন্যে, ‘নাজুক’ হাওয়ার পাঁজর ছুঁয়ে মেপে নিচ্ছে ভাসিয়ে দেওয়া সুরগুলির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। যেন এক অনন্ত ‘ইবাদত’।
কিন্তু সে ধ্যানও ভাঙে। কিসের যেন হইচই! আবার দাঙ্গা শুরু হল না কি! বাইরে এত হইহল্লা, চিৎকার কিসের? রেওয়াজের সময়ই যত রাজ্যের ‘না-মুরাদ’গুলো এসে জোটে? সুর কেটে যায় বাঈয়ের। সারা মুখ জুড়ে তার বিষাদ-বিরক্তির গন্ধ। সাধনায় বাধা পড়ে। তানুপরা গোঁসা করে গড়িয়ে পড়ে। কিসের এত ‘শোর-শারাবা’! দেখতে উঠে আসেন তিনি। এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাগে গজরাতে থাকেন। চিৎকার করে বলতে চান—”বন্দ করো ইয়ে সব”! তখনই আক্রমণাত্মক সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে আসে একটা পাথর। সপাটে লাগে তার মাথায়। মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠেন—”ইয়া আল্লাহ”! কালচে রক্ত গড়িয়ে পড়ে লখনৌয় চিকনে। সব রাগরাগিনী মুহূর্তে যমুনার কালো জলে তলিয়ে যায়। তাকিয়ার উপর গড়িয়ে পড়ে সরদারী বাঈ’-এর নিস্পন্দ দেহ।
মেয়ে সাকিনা যতক্ষণে এসে তার আম্মির রক্তে ভেসে যাওয়া দেহ কোলে তুলে নেয়, ততক্ষণে এই পৃথিবীর সব সুর হারিয়ে গেছে সরদারী মহলের ঘন, কালো বেবাক অন্ধকারে…
শ্যাম বেনেগলের ‘সরদারী বেগম’ (১৯৯৬) প্রথম দেখি দূরদর্শনে। বহু বছর আগে। আখতারি বাঈ ফৈজাবাদী বা আমরা যাকে বেগম আখতার নামে চিনি, তাঁর জন্মতিথি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ টেলিকাষ্টে। এরপরেও বহুবার মুখোমুখি হয়েছি ‘সরদারী’র, কিন্তু সেই মৃত্যুদৃশ্যটি আজও ভুলতে পারিনি।
যতবার দেখেছি, ততবার প্রশ্ন করেছি নিজেকে ‘কে এই সরদারী’? এক সময় মনে হয়েছে ভারতীয় সংগীতের ‘বেগম’ বলতে যাকে বোঝায়, সেই আখতারী বাঈ ফৈজাবাদী বা বেগম আখতার নয় তো এর নেপথ্যচারিনী। কী অদ্ভুত মিল তাঁর জীবনের সঙ্গে। পরে অবশ্য সেই ভুল ভেঙেছে! সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও কাহিনিকার খালিদ মহম্মদ পরবর্তীকালে তার এক বিশেষ সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তারই দূর-সম্পর্কের দুই আত্মীয়াকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘মাম্মো’ ও ‘সরদারী বেগম’-এর গল্প। ভারতীয় আর্ট ফিল্মের ইতিহাসে দুটি সিনেমাই বহুচর্চ্চিত ও একইসঙ্গে দুটি চরিত্রের নামভূমিকায় অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন ফরিদা জালাল ও কিরণ খের। অর্থাৎ ‘সরদারী’ কোনও কাল্পনিক কথন নয়, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। কিরণ খের, রাজেশ্বরী সচদেব, অমরিশ পুরী, রজিত কপুর ও সুরেখা সিক্রি-র অভিনয়ের পাশাপাশি মাইলস্টোন গড়ে ছিল ‘সরদারী বেগম’ বনরাজ ভাটিয়া-র সংগীত ও জাভেদ আখতারের কলমে। জন্ম নিয়েছিল অবিস্মরণীয় কিছু গজল, ঠুংরি ও লঘু শাস্ত্রীয় সংগীতের বিদ্যুৎঝলক।
সিনেমাটিতে ব্যবহৃত হয়েছিল দশটি গান। দশটি অসামান্য কম্পোজিশন। অধিকাংশ গানই গেয়েছিলেন জয়পুর-আতরৌলি ঘরানার আরতী আংকলিকর-টিকেকর ও শুভা যোশী। ‘চাহে মার ডালো’ ও ‘মোরে কানহা’ দুটি গানে আশা ভোঁসলে ‘স্বর্গীয়’। প্রত্যেকটি গানই, বলা ভালো গজল ও ঠুমরি শ্রোতাদের ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ করেছিল।
এর মধ্যে নন্দ রাগে ‘ঘর নাহী হমরে শ্যাম’, নট মলহারে ‘ঘির ঘির আই বদরিয়া’ ও বিশেষ করে ভৈরবীতে ‘চলি পি-কে নগর’ গান তিনটি আজও আমাদের মুগ্ধ করে। পরের বছর ‘সরদারী’ ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে তিন তিনটি পুরস্কার জিতলেও অদ্ভুতভাবে সংগীতের জন্য কোনও পুরস্কার পাননি বনরাজ ভাটিয়া। আমার কাছে তা আজও বিস্ময়। সংখ্যায় অল্প হলেও, আজও কিন্তু সংগীত পিপাসু দর্শকেরা বিস্মিত ও আবেগমথিত হয়ে স্মরণ করেন ‘সরদারী বেগম’কে। কারণ, শুধু মাত্র অভিনয় বা সংগীত নয়, ‘সরদারী বেগম’ সেই সময়কার মহিলা সংগীতশিল্পীদের হারানো গৌরব ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তাদের অস্তিত্বরক্ষার অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরেছিল। তুলে ধরেছিল সেই সব ক্ষণজন্মা, সরস্বতীর মানসপুত্রীদের, সমাজ যাঁদের ‘বাঈ’ বা ‘তওয়াইফ’ বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
শেষ করি, সিনেমার শেষ দৃশ্যটি নিয়ে। দাঙ্গার আঘাতে সরদারী তখন অস্তাচলে। তাঁর ‘মকামে’র ভার নিয়েছেন তার একমাত্র মেয়ে সাকিনা, যে মায়ের গানের জগত থেকে একদিন সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। হারিয়েছে তার নিজস্ব কিছু স্বপ্ন, ভালোবাসার মানুষ, নিজস্ব পৃথিবী, ঘর সংসার আর যা কিছু একটা সাধারণ মেয়ে তার জীবনের কাছে আশা করে থাকে। কিন্তু আজ সে একা। সম্বল বলতে শুধু মায়ের শেখানো সুরের বিদ্যা। তাই মাথায় নিয়ে সেও রেওয়াজে বসেছে। গাইছে ভৈরবীতে সেই করুণ সুর—’চলি পি-কে নগর’, যা মৃত্যুপথযাত্রী মা, সরদারী বেগমকে শুনিয়েছিল সে। সেই সুর চার দেয়ালের গণ্ডি ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে রুক্ষ্ম, মাটির পৃথিবীতে। বাইরে পুরোনো দিল্লি, জামা মসজিদ এলাকা। সাইকেল চড়ে চলে যেতে যেতে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় একটা মানুষ, যে কিনা তার প্রাক্তন প্রেমিক। মুখ উঁচু করে সে শোনে গান, খানিকক্ষণ। তারপর প্যাডেল মেরে সাইকেল ঠেলে মিশে যায় ভিড়ে। স্বর্গভ্রষ্ট সেই সুর ভোরের প্রথম আলোর মতো হালকা ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র…ঘুমের দরজা ঠেলে আজও আমি সেই সুর ও সাইকেলের চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই…
কী আশ্চর্য! লেখা শেষ করতে গিয়ে মনে পড়ল আজ ৭ অক্টোবর। আখতারী বাঈ ফৈজাবাদীর ১০৪তম জন্মতিথি। পরোক্ষে আমি যে তাঁরই কথা লিখছি! এ কী অদ্ভুত, অলৌকিক সমাপতন!
শুধু বেগম আখতার নয়, এই অত্যাধুনিক মেকি, রংচড়ানো ও মুখোশ-মানুষদের দুনিয়ায় ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসা কলের গান ও লং প্লেয়িং রেকর্ডের বিস্মৃত, অবহেলিত শাস্ত্রীয় সংগীতের সেইসব অখ্যাতনামা সরদারী বেগমদের সশ্রদ্ধ প্রনাম জানাই এই লেখার মাধ্যমে…
।। অনল হক! অনল হক!।।
উঠেগা অনল হক কা নারা
যো ম্যায় ভি হুঁ, তুম ভি হো—
ঔউর রাজ করেগি খলক-এ-খুদা
যো ম্যায় ভি হুঁ, ঔউর তুম ভি হো…
আমি দেখতে পাচ্ছি তাকে… ঘুমের নিকষ কালো দরজা ঠেলে আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি কুয়াশার সাদা ব্যারিকেড ঠেলে উপড়ে এসেছে ‘সরহদ’…মর্চে, জং ধরা কাঁটাতার।
ঘুমের মধ্যে একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে লাহোর। সাল ১৯৮৫। ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। হাজার হাজার মানুষের ‘জমাবরা’। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ—কে নেই সেখানে। কত হবে? ৩০…৪০…৫০ হাজার! মনে হয় তারও বেশি।
শত সহস্র কালো কালো মাথাগুলো দুলছে একটু একটু! ঠোঁট কাঁপছে তাদের। চোখ নিবিষ্ট সামনের দিকে। সেখানে মঞ্চ। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে এক নারী। দূর থেকে যাকে ‘জোয়ান অফ আর্ক’ বলে বারবার ভুল হচ্ছে আমার। আহা! তার খোলা চুলে ঠিকরে পড়ছে আলো সর্বাঙ্গে জড়ানো মূলতানী জরির কাজ করা কালো রঙের শাড়িতে উঠেছে যেন আরব সাগরের ঢেউ। দৃঢ় একটা হাত ধরে আছে মাইক, অন্য হাত মেপে নিচ্ছে আকাশের ‘ওম’! চোখ কখনও বন্ধ, কখনও খোলা। যেন নিভন্ত কোনও আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে। তিনি গাইছেন—
হাম দেখেঙ্গে!
লাজিম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে!
উও দিন কা জিসকা ওয়াদা থা…
আমি চিনি তাকে। তিনি ইকবাল বানু।
পাকিস্তানের কিংবদন্তি গজল ও ঠুমরি গায়িকা। কিন্তু এখানে তিনি কোনও মজলিশের ‘শান ও শৌকত’ হয়ে আসেননি। এসেছেন প্রতিবাদের লৌহ-সমান কন্ঠস্বর হয়ে। আমাদের ঘুমন্ত বিবেক জাগাতে।
এসেছেন বর্তমান শাসক দলীয় সরকারের তুঘলকি ফরমানের বিরুদ্ধে সরব হতে। সেই সরকার যা অত্যাচারী সেনানায়ক জেনারেল জিয়া উল হক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
সেই সরকার যা ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দখল করেছে ‘তখত-ই-পাকিস্তান’। বিতর্কিতভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো-কে। জারি হয়েছে মার্শাল ল’ জেনারেল জিয়া-র নির্দেশে। এতেই অবশ্য খুশি নন তিনি। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ঘোষণা হচ্ছে, ‘আজীব-ও-গরীব’ ফরমান। সরকারি মদতে ‘দহশদ-গর্দরা’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। নিত্যনৈমিত্তিক আইনি বদল, কট্টরপন্থীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জায়গা নিচ্ছে ‘শরিয়তি’ সিদ্ধান্ত। ইসলামকে হাতিয়ার করে মুক্তমনা, উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে শানানো হচ্ছে সাঁড়াশি আক্রমণ। সাধারণ মানুষের অধিকার নয়, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ তার ‘না-মুরাদ’ আশ্রয়। ধর্মের নামে যত্রতত্র আক্রান্ত হচ্ছেন সাহিত্য-সংস্কৃতিমনস্ক, শিক্ষিত মানুষ। মহিলাদের প্রতিমুহূর্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কঠোর নিয়মের অন্ধকূপে। সেখানে প্রশ্ন তোলা বা প্রতিবাদ করা আর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়ানো সমার্থক। এমনই এক অস্থির, টালমাটাল, অগ্নিগর্ভ পরিবেশে, জিয়া-উল-হক সরকার ঘোষণা করল ‘শাড়ি’ পড়তে পারবেন না মহিলারা। পড়তে হবে সালোয়ার-কামিজ ও হতে হবে বোরখা-আবৃত। শাড়ি নাকি ইসলাম ও পাক-সংস্কৃতিবিরুদ্ধ।
সঙ্গে সঙ্গেই যেন বারুদে হল অগ্নিসংযোগ। প্রতিবাদ, বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। শুরু হল এক অলিখিত ‘জেহাদ’, স্বৈরতান্ত্রিক ‘না-পাক’ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে! এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে লাহোরের জনতাকে আহ্বান করলেন বানু। তার কাছেই রয়েছে সবচেয়ে বড়ো ‘হাতিয়ার’। সেই অস্ত্রের নাম—ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।
ফয়েজ পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিতর্কিত বামপন্থী কবি ও বুদ্ধিজীবী। ঠিক এক বছর আগেই যার ‘ইন্তেকাল’ হয়েছে। অথচ তিনি তখনও সমান আদৃত। ফয়েজের ‘নজম’কে অস্ত্র বানিয়েই সেদিন লাহোর স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষের সামনে এই গান গেয়েছিলেন বানু। তার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়েছিলেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। যার অধিকাংশই মহিলা। গানের শেষে লাহোর স্টেডিয়ামে উঠেছিল এক জোড়া শ্লোগান—’ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ আর ‘অনল হক’।
‘অন-অল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই সত্য!’ ফয়েজ বলেছিলেন, ”মন্ত্র যেদিন ধ্বনিত হবে ‘আমিই সত্য’, যা আমিও, তুমিও জেনো তা”। কী অদ্ভুত সেই কথা। সত্যিই তো! শাশ্বত সত্যের কাছে সবাই সমান। তার কোনও মাপ-পরিমাপ নেই। কোথাও না কোথাও অলক্ষ্যে ধ্বনিত হয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের পাতা থেকে উঠে আসা মহাবাক্য—’অহম ব্রহ্মাস্মি’ (আমিই ব্রহ্ম আমিই সত্য)-র কথা। বাইবেলের ‘রিভিলেশন’ (1:18. KJV) থেকে উঠে আসে “I am he that liveth, and was dead; the truth and the lie and, behold, I am alive for evermore, Amen; and have the keys of hell and of death, I am He.” শতসমুদ্র, সহস্র নদী যেন এক লহমায় এখানে এসে লীন হয়ে যায়। আমার ‘আমি’কে চেনার তাগিদে।
তাই যতবার ইকবাল বানু-র এই গান শুনেছি, যতবার পড়েছি ফয়েজ আহমেদ-এর এই কালজয়ী ‘নজম’ ঠিক ততবারই বিস্মিত হয়েছি, দর্শনের অন্ত্যমিল দেখে। অথচ ‘লাহোর অভিযান’-এর প্রায় ছ’বছর আগে ১৯৭৯ সালে ফয়েজ এই রচনাটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। সুরও দিয়েছিলেন নিজেই। পরবর্তীকালে যা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের রণহুঙ্কারে পরিণত হয়। বানু-র উপর এরপরে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। দিল্লিতে জন্মেছিলেন বলে তাকে ‘ভারতের গুপ্তচর’ বলে দাগিয়েও দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় তার গানের অনুষ্ঠান, রেডিওতে তার গান নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু তাতে থামেননি ইকবাল বানু। গেয়ে গেছেন এই গান সারাবিশ্ব জুড়ে। থামানো যায়নি সাধারণ মানুষকেও। সেই গান রেকর্ড করে লুকিয়ে চুরিয়ে, এমনকি তা ব্ল্যাকেও বিক্রি হয়েছে সারাদেশ জুড়ে। পরের ঘটনা ক্রমেই কালজয়ী ইতিহাস।
‘অনল হক’-এর ইতিহাস হাতড়াতে গিয়ে প্রথমেই যাকে দেখতে পাই, তিনি মালায়লি লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশির। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হওয়া তার গল্প-গ্রন্থ ‘অনর্ঘ নিমিশাম’-এ বর্ণিত একটি ছোটোগল্প ছিল ‘অনল হক’। অবশ্য সে ইতিহাস সংগৃহীত আরও একজনের অনবদ্য জীবনী থেকে। তিনি পারস্যের বিখ্যাত সুফি-সাধক আবু হুইসেন বিন মনসুর আল হালাজ। ৮৫৮ অব্দে পারস্যের ফারসা প্রদেশে তার জন্ম। ছিলেন চন্দ্রাহত, দিব্যোন্মাদ পুরুষ। বর্ণময় তার জীবন। ১২ বছর বয়সে কন্ঠস্থ করেছিলেন কোরান। করেছেন অতীন্দ্রিয় চর্চা। পাঠ নিয়েছেন সেই সময়কার বাগদাদের বিখ্যাত সুফি সাধক ও শিক্ষক জুনেইদ বাগদাদি-র কাছে। সাধনার তাগিদে দু’দুবার ছুটে গেছেন পবিত্র শহর মক্কায়। প্রথমবার, মক্কায় ‘ম্যভলভী’ সুফিদের সংস্পর্শে এসে করেছেন কঠোর সাধনা। ‘অনাদিঅন্ত’-কে জানার চেষ্টায় করেছেন কৃচ্ছসাধন। নিয়েছেন মৌনতা। উপবাস করেছেন টানা একবছর। হয়েছেন গিরিগুহাবাসী। ফিরে এসে প্রচার করেছেন ঐশ্বরিক জ্ঞানের বাণী। দ্বিতীয়বার, ৪০০ শাগরেদ নিয়ে পুনরায় ছুটে গেছেন ‘কাবা’ দর্শনে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ওঠে কালা জাদু, অতীন্দ্রিয়বাদ ও অতিমানবিক কর্মকাণ্ড পৃষ্ঠপোষকতার মিথ্যা অভিযোগ। নানাবিধ কালোবিদ্যায় তিনি নাকি পারদর্শীতা লাভ করেছিলেন। আসলে ঈশ্বরের দর্শন পেতে তিনি তখন ‘ভাবোন্মাদ’। তার জন্য নিজেকে ‘ফনাহ’ করতেও দ্বিধা নেই। ইরান, ইরাক, দামাস্কাস, সিরিয়া জুড়ে সেই কথা প্রচার করেন তিনি। পান প্রবল জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সান্নিধ্য। তার দিব্যোন্মাদতা তাকে ঈশ্বরীয় ক্ষমতার কাছে আনে। হয়েছিল মনোবিকারও। অদ্ভুত সেই ঘোর। একদিন যখন ‘শাগরিদ’-দের কাছে ঈশ্বরিক মাহাত্ম্যকথা বলছিলেন, তখনই তার ‘ভর’ হয়। বিকারগ্রস্তের মতো ”অনল হক! অনল হক” বলে চিৎকার করে উঠে ছোটাছুটি করতে থাকেন। কখনও কাঁদতে থাকেন, কখনও হাসতে থাকেন। আর মুখে তার একটাই কথা—”অনল হক!”
আল হালাজ-এর মুখে ”অনল হক” শুনে খেপে ওঠে সমাজের মাতব্বরেরা, যাদের অধিকাংশই কট্টরপন্থী মল্লাহ। তাদের দাবি, আল হালাজ এখন নিজেকেই ‘ঈশ্বর’ ভাবতে শুরু করেছে। এ তো ভয়াবহ অপরাধ! তাকে শাস্তি দিয়ে সমাজের কাছে কঠোর দৃষ্টান্ত রাখতে হবে, যাতে ‘আল্লাহ’র সমকক্ষ হওয়ার ধৃষ্টতা কেউ না করতে পারে। দুর্ভাগ্য, তাদের বোঝার ক্ষমতা নেই সাধনমার্গের কোন উচ্চাতিউচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আল হালাজ নিজেকে সেই ‘অখন্ড সত্যে’র অংশ বলে মনে করেছেন। তাই রাতারাতি বসল সালিসি সভা। আটক করা হল আল হালাজ-কে। নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। বহাল হল সর্বসমক্ষে মৃত্যুদণ্ডের বিধান। ইংরিজির ২৫ মার্চ ৯২২ অব্দে ঢ্যারা পিটিয়ে ঘোষণা করা হল তার ফাঁসির সাজা। পরদিন বাগদাদে টাইগ্রিস নদীর ধারে আল হালাজ-এর মৃত্যুদণ্ড দেখতে উপচে পড়ল হাজার হাজার মানুষ। নিয়ে আসা হল হালাজ-কে বধ্যভূমিতে। তার হাতে পায়ে শিকলের বেড়াজাল। প্রিয় সাধকের এই অবস্থা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তার ঘনিষ্ঠজন, শাগরেদ, গুণগ্রাহীরা। অথচ কোনও দুঃখ-শোক-ভয়-মনস্তাপের লেশ নেই হালাজ-এর মুখে। অপার্থিব এক হাসির রেখা ছুঁয়ে আছে তার ঠোঁট। এল সেই সময়। মাতব্বরেরা এগিয়ে এসে শোনায় তার ‘অধার্মিক’ কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ অভিযোগের কিসসা। অথচ মুখে কোনও বিকার নেই আল হালাজ-এর। ভাষণের মাঝেই তিনি বলেন, ”তাড়াতাড়ি করো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি অপেক্ষায়।” এই কথা শুনে এগিয়ে আসে ঘাতক। ঘুষি মারে তার মুখে। উন্মাদের মতো চালাতে থাকে চাবুক, যতক্ষণ না অজ্ঞান হয়ে যান হালাজ। তারপর তাকে ঝোলানো হয় ফাঁসিকাঠে। এতেও রাগ মেটেনি তাদের। মৃত হালাজ-এর দেহে মাটির তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে তার ছাই ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ট্রাইগ্রিসে। কথিত আছে, টাইগ্রিসের ধারে সে দিন হালাজ-এর ‘শাগরিদ’রা ধ্বনি তুলেছিলেন ”অনল হক! অনল হক!” হতভম্ব হয়ে সেই উন্মাদনা দেখেছিলেন মোল্লা সমাজের প্রতিনিধিরা। পরে বাগদাদ ছেড়ে হালাজ-এর বাণী প্রচারে তারা ছড়িয়ে পড়েন তুর্কিস্তান, ইরান, আফগান হয়ে ভারতে।
ঘুমের ঘন কুয়াশা আবারও ঢুকে পড়ছে ঘরে, মাথার ভিতর, মস্তিষ্কের কোষে কোষে। সেই অপার সমুদ্রে তলিয়ে যেতে যেতে দেখি মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন আল হালাজ। তার গলায় ফাঁসির দাগ, পোড়া শরীর, অথচ মুখে সেই স্মিত হাসি যা দেখেছি গতজন্মে টাইগ্রিসের ধারে। ক্রমেই সেই মুখ ধোঁয়ায় মিলিয়ে গিয়ে একে একে উঠে আসেন ভৈকম মুহম্মদ বশির, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ইকবাল বানু। একবার তারা শূন্যে মেলান, পরক্ষণেই ফিরে আসেন।
ক্রমেই দেখতে পাচ্ছি সবার অলক্ষ্যে একে একে উঠে এসেছেন কালবুর্গী, পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ। সারি বেধে উঠে দাঁড়িয়েছেন তারা আমার ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী অঞ্চলের শূন্যতায়।
ঘুমের আরব্য সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে…শেষবারের মতো…আমি দেখতে পেলাম, তাদের প্রত্যেকের ঠোঁটের ভাঁজে রাখা সেই অমোঘ বীজমন্ত্র—
”অনল হক! অনল হক!”
।। কেসরিয়া বালমা।।
সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক যে ছিল দেশ। থর মরুভূমির পাশে, রাজপুতানা। দেশের মধ্যে ছিল দেশ। সে দেশের নাম নারওয়ার। সেই দেশে বৃষ্টি হত না একদম। সারাদেশ এক্কেবারে শুকিয়ে চ্যালাকাঠ, ফুটিফাটা। চারদিকে ছিল শুধু ধু ধু মরুভূমি আর কাঁটাঝোপের জঙ্গল। খুব কষ্টে ছিল সেই দেশের লোকেরা। তবুও তারা হাসত, গাইত, রুখা-শুখা মরুভূমির বুকে চাষবাস করে দিন কাটতো। তারা ছিল বীর যোদ্ধাদের বংশজ। যতই কষ্টে থাকুক না কেন, হাতে তরবারি থাকলে তারা ভগবানের বিরুদ্ধে লড়তেও ভয় পায় না।
সেই দেশে ছিল এক রাজা। রাজার নাম নল। তার রানি দয়মন্তী। তাদের ছিল এক ছেলে, নাম ঢোলা। ভোলা নয়, ঢোলা। ঢোলক থেকে রাখা হয়েছিল কিনা কে জানে! রাজা-রানির চোখের মণি ছোট্ট রাজপুত্তুর ঢোলা। রাজার বন্ধু পুগলরাজ। তা সেই পুগলরাজের ছিল এক সুন্দরী রাজকন্যে, নাম মারু। ঢোলা আর মারু দু-জন হরিহর আত্মা। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারত না। দু-জনেই দুজনকে ছোটোবেলা থেকে ভীষণ ভালোবাসতো। যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। তা ঢোলা-মারুর বাবা’রা, মানে দুই দেশের দুই রাজা ঠিক করলে, তাদের বিয়ে দেবে। ব্যাস! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ওটুকুনি বয়সেই বিয়ে হল ঢোলা আর মারুর। তারা তো বেজায় খুশি। এবার থেকে সারাদিন পড়াশোনা শিকেয় তুলে একসঙ্গে খেলা করতে পারবে, উট ছোটাতে পারবে, মরুভূমির বুকে খুঁজতে যাবে পুরোনো কেল্লা। কিন্তু বাধ সাধলো মারুর বাবা পুগলের মহারাজা। বিয়ে না হয় হল, কিন্তু পড়াশোনা করে মানুষ হতে হবে তো, দেশের হাল সামলাতে হবে যে রাজা বুড়ো হলে। তাই মেয়েকে নিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তিনি ফিরে এলেন নিজের রাজ্যে। ওদিকে প্রিয়বন্ধুকে হারিয়ে ঢোলার মনখারাপ। মারু তো কেঁদেকেটে ফুলিয়ে বসল চোখ। ঢোলাকে ছেড়ে আসার আগে বন্ধুত্বের, ভালোবাসার চিহ্ন রূপে মারু তাকে দিয়ে গেল গেরুয়া রংয়ের একটা কাপড়, ওদেশে তাকে বলা হয় ‘কেশরিয়া রং’। চোখের জল মুছে উটের পিঠে চড়ে বাবার কোলে বসে মারু ফিরে গেল নিজ রাজ্য পুগলে। দূর থেকে কেল্লার মাথায় চড়ে মারুর সেই চলে যাওয়া দেখল ঢোলা। কষ্ট হয়েছিল খুব, কিন্তু সে কাঁদেনি। রাজপুতদের চোখে কেউ জল দেখেনি কখনও।
এদিকে দিন যায় রাত যায়। সময় গড়ায়। ঢোলা-মারু দুজনই এখন যুবক যুবতী। মারু আজও ভুলতে পারেনি ঢোলাকে। কিন্তু ঢোলা ভুলে গেছিল মারুকে। ইতি মধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন রাজা নল। দেশ চালানোর ভার এখন কুঁওর ঢোলা সিং-এর কাঁধে। সে অনেক ঝক্কি। রাজা মারা যেতেই ঘন ঘন বিদ্রোহ, অন্য রাজাদের আক্রমণ ঠেকানো, রাজপাট চালানো সব নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই রাজকুমার ঢোলার। এর মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার ছোটোবেলার ভালোবাসা—মারু। সে ভুলেই গেল তাকে। একদিন মায়ের নির্দেশে পাশের রাজ্যের রাজকন্যা মালওয়ানীকে বিয়েও করল ঢোলা। সেই খবর শুনে খুব কষ্ট পেল মারু। সেও তো তার স্ত্রী! আর সে বেঁচে থাকতে কীভাবে এই বিয়ে সম্ভব? ঢোলাকে সব পুরোনো কথা জানিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করল মারু। কিন্তু সেই চিঠি কোনদিনও পৌঁছায়নি ঢোলার কাছে। রানি মালওয়ানী ঢোলা-মারুর এই প্রেমকাহিনি জানতেন। ঢোলা যাতে মারুকে ফিরে না পায় সেই জন্য সব চিঠি তিনি লুকিয়ে ফেলেন। অন্য দিকে, পুগলের সেনাপতির লম্পট ছেলে উমর সুমার মারুর প্রেমে পাগল। মারু তাকে পছন্দ করে না। তার জীবনে ঢোলা ছাড়া অন্য কেউ নেই। উমার সুমার সে সব বোঝে না। সে জোর করে মারুকে বিয়ে করতে চায়। মারু রেগে গিয়ে তাকে পুগল থেকে নির্বাসিত করে। মারুর উপর রাগে-দুঃখে ও অপমানের বদলা নিতে উমার সুমার হাত মেলায় রানি মালওয়ানীর সঙ্গে। দুজনের একটাই উদ্দেশ্য, ঢোলা আর মারুকে যেভাবেই হোক আলাদা করে রাখা।
এভাবেই কাটছিল দিন। কাটছিল মাস, বছর। ঢোলাকে না পেয়ে তখন মারু উন্মাদিনী। কিন্তু ঢোলাও তো মনে রাখেনি তাকে। তবু মারু আশা ছাড়েনি। সে বিশ্বাস করে একদিন ঢোলা ফিরে আসবে তার কাছে। একদিন মারু কেল্লার উপর ঘুরে ঘুরে ঢোলার কথা ভেবে মনের দুঃখে গান গাইছিল। ভারি করুণ তার সুর। সেই সুরের রেশ ছড়িয়ে পড়ল সারা পুগলে। এক সময় বানজারাদের একটা দল এল নারওয়ারে। রাজা ঢোলা সিংয়ের দরবারে গাইল তারা সেই গান। যে গানে মিশে আছে, ঢোলা-মারুর আখ্যান। সে গান শুনে মারু-র কথা মনে পড়ে যায় ঢোলার। এতদিন পর মারুর কথা মনে পড়ায় সে পাগল হয়ে ওঠে। ছুটে বেরিয়ে পড়ে পুগলের উদ্দেশ্যে। যেভাবেই হোক তাকে যে তার মারু-র কাছে পৌঁছাতে হবে। রানি মালওয়ানী তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হয়। তার ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেয় বানজারারা। ঢোলা রানি মালওয়ানীকে তাড়িয়ে দেয়। এমনকি উমর সুমার দস্যু দিয়ে ঢোলা সিংকে প্রাণে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু ঢোলা সিংয়ের বিক্রমের কাছে তারা হার মানে। অবশেষে অসংখ্য বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ঢোলা পৌঁছায় পুগলে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মিলন হয় ঢোলা-মারুর।
গল্প এখানেই শেষ নয়। মারুকে নিয়ে নিজের রাজ্য নারওয়ারে ফিরে চলে ঢোলা। দুজনেই খুব খুশি। কিন্তু বাধ সাধে বিশ্বাসঘাতক উমর সুমার। পথযাত্রায় ক্লান্ত ঢোলা-মারু যখন রাতে ঘুমিয়ে, সেখানে বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেয় সে। সেই সাপ কামড়ায় মারুকে। বিষের প্রভাবে ছটফট করতে করতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে মারু। ঘুম ভেঙে উঠে মৃত মারুকে দেখে শোকে দুঃখে পাগল হয়ে যায় ঢোলা। সে ঠিক করে মারুর সঙ্গে সেও সহমরণে যাব। হবে প্রথম ‘পুরুষ সতী’। চিতাকাঠ সাজিয়ে মৃত মারুর দেহ কোলে নিয়ে যেই মুহূর্তে আগুন ধরাতে যাবে ঢোলা, সেই মুহূর্তে উদয় হয় এক সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী। তারা ঢোলাকে ‘সতী’ হতে নিষেধ করে ও বলে তারা মৃতের শরীরে প্রাণ ঢালার কৌশল জানে। তবে তার জন্য ঢোলাকে তার অর্ধেক প্রাণ মারুকে দিতে হবে। এককথায় রাজি হয়ে যায় ঢোলা। একথা শুনে তারা মৃত মারুর মাথার কাছে বসে একটি তারের যন্ত্র (রাবনহত্তা) বাজিয়ে গান ধরে। অদ্ভুত তার সুর। এ সেই সুর যা ঢোলার বিরহে কেল্লায় ঘুরে ঘুরে গাইত মারু। এ সেই সুর যা দরবারে গেয়ে ঢোলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে বানজারারা। সে সুরের এমন জাদু, চোখ মেলে মারু। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে জীবনে। অবশেষে ফিরে আসে তার চিরকালের ভালোবাসার মানুষ ঢোলার কাছে। তাদের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী তাদের এক পক্ষীরাজ উট উপহার দেয়। তারা আশীর্বাদ করে বলে, আজ থেকে সারা দেশে ঢোলা-মারুর এই প্রেমাখ্যান অমর হয়ে থাকবে। এই উট তাদের সবসময় রক্ষা করবে বিপদ আপদ থেকে। আর সেই গান সেই সুর গোটা থর মরুভূমির বুকে নিয়ে আসবে ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের ধারাজল। যুগ যুগ ধরে সেই সুর বহন করবে রাজপুতদের শৌর্য, বীর্য, বলিদানের পাশাপাশি ভালোবাসা ও ত্যাগের অমর নিদর্শন। এই বলে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী অন্তর্হিত হন। ‘উড়ন্ত’ সেই উটের পিঠে চেপে ঢোলা ও মারু উড়ে যায় তাদের চিরকালীন ভালোবাসার দেশে।
ছোটোবেলা থেকে দাদুর কাছে ঢোলা-মারুর এই কিংবদন্তি আখ্যান শুনে বড়ো হয়েছিল জিলাই। পুরো নাম আল্লাহ জিলাই বাঈ (১৯০২-১৯৯২)। শিখেছিলেন সেই অসাধারণ গান। তালিম নেন প্রখ্যাত খেয়াল গায়ক উস্তাদ হুসেইন বকশখ খান ও অচ্ছন মহারাজ-এর কাছে। মাত্র দশ বছর বয়সে বিকানীরের দরবারে তার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রাজা গঙ্গা সিংজি মহারাজ। আর পিছনে ঘুরে দেখেননি জিলাই। সেই ‘কেসরিয়া বালাম’ গেয়েই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবিখ্যাত। ১৯৭২ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হওয়ার পরেও অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে এই গানই পরিবেশন করেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই গান, যা দেশ-কাল-সীমানার যাবতীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে রাজপুতানার রক্তের টান, বেঁচে থাকার আবেগ ও ভালোবাসার শাশ্বত সংলাপ। আজও যা অক্ষত, অজর, অমর!
।। বিলাসখানি টোড়ি।।
পিঠালা সো মজলিশ গয়ি, তানসেন সো রাগ
হাসিবো, রামিবো, বলিবো—গয়ো বীরবরা সাথ।
সাল ১৫৮৬। এপ্রিল ২৩। প্রয়াত হলেন মিঁয়া তানসেন। শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। তাঁর প্রয়াণ-তিথির আজও সঠিক হদিস পাওয়া যায় না। যেমন জানা যায় না তাঁর সঠিক জন্মতিথিও। এমনকি, তানসেন কীভাবে প্রয়াত হলেন সে নিয়েও রয়েছে বহু মতভেদ।
কেউ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গাইতে গাইতে গলায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষত বিষিয়ে গিয়েই। অনেকে বলেন, রাগ বাচস্পতি গাইতে গিয়ে শ্বাস আটকে মারা যান তিনি। আবার অনেকের মতে, তার মৃত্যুর কারণ স্বয়ং বাদশা আকবর। শেষোক্ত কারণটিই বহুল চর্চিত।
রাগ দীপক শোনার জন্য ছেলেমানুষি বায়না ধরে ছিলেন বাদশা। বড়ো ভয়ানক সে রাগ। সে রাগের সঠিক প্রয়োগে শুধু প্রদীপের জ্বলে ওঠা নয়, খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পুরোমাত্রায়। তাই প্রথমে অরাজি হলেও, পরে নিজের অন্নদাতা জালালুদ্দিনের আবদার রাখতে গিয়ে দীপক রাগের প্রভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তানসেন। মেয়ে সরস্বতী (মতান্তরে সংগীতাচার্য স্বামী হরিদাসজীর ছাত্রী রূপা) বাপের নির্দেশে মেঘ মলহার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল! আজ সে সব কিংবদন্তি।
কারণ যাই হোক, প্রায় আশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন আকবরের নবরত্নসভার অন্যতম রত্ন মিঁয়া তানসেন। সেই শোকে পাথর হয়ে গেলেন আকবর। একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হল তামাম মুঘল রিসায়তে। তানসেনের ‘জনাযা’য় গোটা আগ্রার পাশাপাশি সামিল হলেন শাহেনশাহও। কিন্তু এরপরেই শুরু হল সেই বিতর্কিত অধ্যায়।
তানসেনের শেষকৃত্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হল ব্যাপক বিক্ষোভ। বেঁকে বসলেন হিন্দু সমাজের একশ্রেণির মাতব্বরেরা। তারা ঘোষণা করলেন, তানসেন হিঁদুর ঘরের ছেলে। নাম রামতনু মিশ্র, পিতা মুকুন্দ মিশ্র (মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও সুগায়ক। জনৈকা মুসলিম রমণী (তানসেনের স্ত্রী হুসেইনি বেগম)-র চক্করে পড়ে ধর্ম পরিবর্তন করলেও, তার শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। তাই তাঁর শেষকৃত্য হিন্দুশাস্ত্র মতেই হওয়া উচিত।
কিন্তু এ তত্ত্ব মানতে নারাজ ইমাম-মৌলবীরা। তারা বললেন, আগে কী ছিলেন তা বড়ো কথা নয়, ধর্ম বদল করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন। ছিলেন পাঁচ রোজের ‘নামাজি’। তাই ইসলাম মতেই পালন করা হোক সুরসম্রাটের শেষ যাত্রা। তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে রীতিমতো শুরু হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ, প্রবল তর্কাতর্কি।
বলাবাহুল্য, বেকায়দায় পড়লেন আকবর। কোনও পক্ষকেই চটাতে চান না তিনি। একেই দীর্ঘদিনের সুহৃদ তানসেনের মৃত্যুতে তিনি শোকাহত, তার উপরে এমন জটিল পরিস্থিতি, এহেন অবস্থায় খোদ আকবরও বিপর্যস্ত। তানসেন-এর শেষকৃত্য নিয়ে দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম। এমন সময়ে আসরে নামলেন তানসেন-এর মেয়ে সরস্বতী। বলে রাখা ভালো, তানসেনের ছিল পাঁচ সন্তান—হামীরসেন, সুরটসেন, তানরস খান, সরস্বতী দেবী ও বিলাস খান। এরা প্রত্যেকেই উচ্চমানের গায়ক ও বীণাবাদক। পাঁচ সন্তানের মধ্যে মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন তানসেন। সেই সরস্বতী বললেন, তার মৃত্যুর পর যে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা ঠিকই আঁচ করেছিলেন তানসেন। তাই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা নিয়ে দিয়ে গেছেন বিস্ময়কর নির্দেশ। আর সেই নির্দেশ হল—গান। যে গায়ক তার গানের প্রভাবে তানসেন-এর মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন, তার ধর্মানুসারেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে আকবরের নবরত্নের অন্যতম এই রত্নটির। অর্থাৎ কিনা জীবনের শেষ অধ্যায়টির বিচার হবে সংগীত দিয়ে। একেই বলে ‘পোয়েটিক’ থুড়ি ‘মিউজিকাল জাস্টিস’।
অবাক হলেন আকবর। এ কী অসম্ভব কাজ! গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণের সঞ্চার কখনও সম্ভব নাকি? আশ্বস্ত করলেন তানসেন দুহিতা—হ্যাঁ সম্ভব! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে রয়েছে সে গুণ। দরকার আধ্যাত্মিক সাধনা, সুরজ্ঞান ও আন্তরিক পরিবেশনের। বলাবাহুল্য, প্রস্তাবের সার্থকতা নিয়ে সন্দিহান হলেও অসম্ভব এই প্রস্তাবটি শেষপর্যন্ত মনে ধরে আকবরের। অবাক কাণ্ড, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মাতব্বরেরাও একমত হলেন এই প্রস্তাবে। সংরক্ষণ করা হল তানসেন-এর মরদেহ। তারপর শুরু হল সেই রুদ্ধশ্বাস গানের লড়াই। মৃতসঞ্জীবনী সুরসুধার সন্ধানে, যা এক কথায় ছিল অসাধ্যসাধন। কারণ, তানসেনের পরবর্তী এমন কোনও গায়ক সে সময় ছিল না তামাম হিন্দুস্থানে যে কিনা এমনই ঐশ্বরিক ক্ষমতাধারী যার সুরের জাদুতে মৃতের শরীরেও প্রাণের সঞ্চার ঘটতে পারে। তবু সে সময় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই শুরু হল গান।
তিনদিন, তিনরাত দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত। সম্রাটের আমন্ত্রণে সারাদেশ থেকে আগত সেরা গায়করা ভিড় জমিয়েছেন আগ্রার দরবারে। দিনরাত ধরে পালা করে চলছে ওস্তাদি গান। ওদিকে ফুল, আতর, বরফ আর ঔষধি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তানসেন-এর মরদেহ। মনে হচ্ছে যেন পরম নিশ্চিন্তে তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন, এক্ষুনি জেগে উঠে তানপুরার তার বেঁধে রেওয়াজে বসবেন তার গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্ট ‘বৃন্দাবনী সারঙ্গ’ রাগে। ওদিকে গান গেয়ে গেয়ে জেরবার দেশের তাবড় তাবড় গওয়াইয়ারা। তিনদিন ধরে সুরের বন্যা বয়ে গেল রাজ দরবারে, অথচ নিস্পন্দ তানসেন। তার মৃত শরীরে স্পন্দনের কোনও লক্ষণ নেই। এত কিছু করেও কি তবে সব আয়োজন ব্যর্থ হতে চলেছে? এমনকি কোনও গায়ক সত্যিই নেই ভূ-ভারতে, যে কিনা তানসেনের সমান ওজস্বী? নেই কি তানসেনের সমকক্ষ কোনও সুরসাধক যে কিনা এই অসাধ্যসাধন করতে পারে? বলাবাহুল্য হতাশ হয়ে পড়লেন আকবর।
এপ্রিল ২৬। সাল ১৮৫৬। ভোরের আলো ফুটতে তখনও দেরি। একটু একটু করে সরছে রাতের পরদা। ধীর পায়ে রাজদরবারে এসে দাঁড়ালেন এক দীন ফকির। বললেন, তিনি একবারটি চেষ্টা করতে চান। চালচুলোহীন সেই ফকিরের কথা শুনে তো হেসে কুটিপাটি সভাসদরা। তামাম হিন্দুস্তানের নামজাদা ওস্তাদেরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন এই ফকির সেখানে কী চমৎকার দেখাবেন? ফকির কিন্তু অনড়। শেষ চেষ্টা করে দেখতে তিনি যেন মরিয়া। তাঁর উজ্জ্বল দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সায় দিলেন আকবর। তানসেন-এর পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন গান। আর কী আশ্চর্য! মুহূর্তে যেন পালটে গেল গোটা পরিবেশ। অজানা সেই রাগের অপার্থিব সুরের অদ্ভুত মায়াজালে আচ্ছন্ন হলেন সকলে। ভোরবেলায় সেই রাগের এমনই মাধুর্য, যেন সকাল এর জন্যেই অপেক্ষা করে বসেছিল। সেই রাগ কেউ কখনও শোনেনি। কেউ কখনও ভাবেনি এমনও গান হয়। কী গায়কি, কী তালিম, কী সুর—প্রতিটি চলনে সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত এমনকি যেন হারিয়ে ফেলেছেন মুখের ভাষা। এমন সময় দেখা গেল সেই অদ্ভুত দৃশ্য। অজ্ঞাত সেই ফকিরের গানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে রাজসভায় শায়িত মিঁয়া তানসেন-এর নিস্পন্দ শরীরে। ফকির ভাবলেশহীন, তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছেন। যেন পরম করুণাময় ঈশ্বরের সাধনায় লীন হয়ে গেছে তাঁর সকল সত্ত্বা, বোধ, জাগরণ। এরপর অবলীলাক্রমে যখন একটি অসাধারণ গমক নিলেন সেই ফকির, সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন মৃত তানসেন-এর ডান হাতটি কাঁপছে। দেখা গেল সেই অজ্ঞাত গায়কের দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে তানসেন-এর ডানহাত। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থমকে গেল। তারপর সব শেষ।
ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায়। সবাই আপ্লুত চোখে তখন সেই ফকিরের দিকে তাকিয়ে। গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির। অদ্ভুত প্রশান্তি তার মুখে। সকলের মুখে তখন একটাই প্রশ্ন—কে এই ফকির? ইনি তো কোনও সাধারণ মানুষ নন! খোদ বাদশাহ আকবর পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু নিজের পরিচয় প্রথমে দিতে চাননি সেই ফকির। পরে উপস্থিত সকলের একান্ত অনুরোধে নিজের পরিচয় দেন তিনি।
তিনি বিলাস খান। তানসেনের কনিষ্ঠতম সন্তান। অল্প বয়সে সুফিসাধনায় মজে ঘর ছেড়ে ছিলেন তিনি। সেদিন গাওয়া সেই রাগ তাঁর নিজস্ব রচনা। নাম ‘বিলাসখানি টোড়ি’।
দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেই ফকিরকে নজরানা দিতে চেয়েছিলেন ‘দীন-ই-ইলাহী’। বিলাস খান জানিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকেও তাঁর পিতার পাশে স্থান দেওয়া হয়। কথা রেখেছিলেন আকবর। আজও গোয়ালিয়রে পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা-পুত্র।
শাগরেদ’দের কাছে প্রায়ই এই গল্প শোনাতেন বড়ে গোলাম। শ্রীকৃষ্ণ রতনঝনকার জানিয়েছেন, এই গল্প শোনাতে শোনাতে নাকি আপ্লুত হয়ে পড়তেন বড়ো খান সাহেব। চোখে জল এনে কপাল চাপড়ে বলতেন, ”হায়! হায়! কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব মানুষগুলো।” বলতেন, আর কি কখনও এমন গান হবে! আর কে স্পর্শ করবে সেই সাধনমার্গ? খুব আক্ষেপ করে বলতেন ”এমন মৃত্যুই বা নসিব হয় কতজনের।”
অদ্ভুত ব্যাপার, মিঁয়া তানসেনের মৃত্যুর ৩৮২ বছর পর ২৩ এপ্রিল ১৯৬৮ সালে হায়দরাবাদে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পাতিয়ালা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান।
শেষ করার আগে যেটা না বললেই নয়, গত ২৩ এপ্রিল বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণদিবসের পাশাপাশি ছিল বড়ো খাঁ সাহেবের ৫১তম প্রয়াণতিথি।
আর আজকের দিনেই নিঃশব্দে, সকলের অগোচরে ৪৩৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী পেরিয়ে এলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের যুগপুরুষ, সংগীতসম্রাট মিঁয়া তানসেন।