ভুবনজোড়া আসনখানি

ভুবনজোড়া আসনখানি

আগের পরিচ্ছেদটি শেষ হয়েছে একটি জরুরি প্রশ্নে— আমরা কি এই জগৎকে মিথ্যে বলার মারাত্মক ভুল আজও করে চলব? ভুলটা করে চলছি, আজও আমাদের মধ্যে বহু শিক্ষিত নারী-পুরুষের মনে ‘জগৎ মিথ্যা’ এই ধারণা বাসা বেঁধে আছে। তার কারণ কি উপনিষদে এমন একটি সংকেত আছে যা আমরা ভুল বুঝেছি, ভুল ব্যাখ্যা করেছি?

সংকেতটি হল, ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। মাত্র দুটি শব্দ, যা গত হাজার বছরে ভারতের মানসিকতা ও সারা দেশের কর্মসংস্কৃতিটাই বদলে দিয়েছে। আমি বলব, ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’-র ভুল ব্যাখ্যা আমাদের সভ্যতাকেই পিছিয়ে দিয়েছে। এবং আমাদের ফেলে দিয়েছে এমন একটি দ্বন্দ্বের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের কোনও সমাধান হল না আজও!

‘ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’-র ভুল ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, উপনিষদ বলছে ত্যাগ করতে—এই বিশ্বজগৎকে মায়া বলে মিথ্যা বলে ত্যাগ করতে। উপনিষদের এই ভুল ব্যাখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শংকরাচার্যের মায়াবাদের সারাৎসার— ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। অতএব গত হাজার বছর ধরে উপনিষদের বাণী এবং শংকরাচার্যের মায়াবাদী প্রচারকে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত এই পেরেকের মাথায় হাতুড়ি মারা হল যে জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ না করলে জগতের মায়া আমাদের ব্রহ্ম থেকে, সত্য থেকে দূরে ভুল পথে নিয়ে যাবে। সেই পথে অনন্ত নরক সুনিশ্চিত— এমন একটি ভয়ও দেখানো হল ভারতবাসীকে।

কিন্তু ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’-র মধ্যে যে শুধু ত্যাগ নয়, ত্যাগের মধ্যে ভোগের সংকেতও লুকিয়ে আছে, সেটি উপনিষদের শংকরাচার্য-প্রভাবিত প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকাররা চেপে গেলেন। চেপে যাওয়ার বা ভুল ব্যাখ্যার কারণ, তাঁরা চাননি জগতের আনন্দে মানুষ যুক্ত হোক। তাঁরা চেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে গড়ে উঠুক ধর্মভয়, মৃত্যুভয়, পাপবোধ, বিষণ্ণতা। মানুষ ভুলে যাক সে অমৃতের সন্তান।

বারেবারেই বলছি, নবযুগের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথই প্রথম যিনি সহজ ও সাহসী ব্যাখ্যায় হাজার বছরের এই ভ্রান্তিকে শুধরে দিয়েছেন! তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ না হয়ে আমাদের উপায় নেই। একটি ধাক্কায় তিনি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন ভারতের ত্যাগপ্রবণ, কর্মবিমুখ, অলস, জগৎ থেকে মুখ ফেরানো মানসিকতার। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, উপনিষদ বলছে—

‘এই-যে সমস্তকে পাওয়া, সমস্তকে অনুভব করা, এর একটি মূল্য দিতে হয়। কিছু না দিয়ে পাওয়া যায় না। এই সকলের চেয়ে বড় পাওয়ার মূল্য কী? আপনাকে দেওয়া। আপনাকে দিলে তবে সমস্তকে পাওয়া যায়। আপনার গৌরবই তাই— আপনাকে ত্যাগ করলে সমস্তকে লাভ করা যায় এইটেই তার মূল্য, এইজন্যই সে আছে।’

যাঁরা শংকরাচার্যের মায়াবাদে বিশ্বাসী তাঁরা উপনিষদের এই বাণীর অপব্যাখ্যা করে বললেন, জগৎকে ত্যাগ করো, সব মিথ্যা। উপনিষদের মূল বক্তব্য কিন্তু ত্যাগ না করলে ভোগ করা যায় না। ভোগের মূল্য হচ্ছে ত্যাগ। উপনিষদের এই সার কথাটি তাঁরা বুঝে বা না-বুঝে এড়িয়ে গেলেন।

এড়িয়ে গেলেন না রবীন্দ্রনাথ। তিনিই বৈপ্লবিক সাহসে একেবারে এ-যুগের ভাষায় সাধারণ মানুষের প্রাণের মধ্যে ঢেলে দিলেন উপনিষদের সারমর্ম তাঁর ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে—

‘…উপনিষদে একটি সংকেত আছে: ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। ত্যাগের দ্বারাই লাভ করো, ভোগ করো। মা গৃধঃ। লোভ কোরো না।’

রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের সঠিক ব্যাখ্যা করে শুধুমাত্র ত্যাগের কথাই বললেন না কিন্তু— বললেন, ত্যাগের মধ্যে দিয়ে ভোগ করার কথা! ‘ত্যক্তেন’ মানে ত্যাগের দ্বারা। ‘ভুঞ্জীথাঃ’ মানে ভোগ করো।

ত্যাগের দ্বারা ভোগ? সে আবার কেমন কথা? একদিকে ত্যাগ। অন্যদিকে ভোগ। এই বিপরীত স্রোতকে উপনিষদ মেশাতে বলছে? কী করে সম্ভব?

যাঁরা উপনিষদের ভুল ব্যাখ্যা করলেন তাঁরা ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’-র পরের দু’টি শব্দও আড়ালে রেখে দিয়েছিলেন। শব্দ দুটি হল ‘মা গৃধঃ’। ছোট্ট এক সংকেত, কিন্তু ব্যঞ্জনায় গভীরপ্রসারী। উপনিষদ বলছে, ভোগ করো। কিন্তু লোভ কোরো না। এই লোভ-না-করাই হল ত্যাগ। লোভ না করা মানে যা ভোগ করবে— অর্থাৎ এই জগতের রূপ-রস-ধর্ম-গন্ধ-আনন্দ, এই জীবনের বিচিত্র সম্ভার ও অবদান— সেই সবের সঙ্গে জড়িয়ে যেয়ো না। অর্থাৎ মনে কোরো না সব তোমার। ভোগের বস্তুর সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যেয়ো না। ভোগ করো। কিন্তু সংসক্ত, সম্পৃক্ত হোয়ো না। ভোগের বস্তুর সঙ্গে, জগতের সঙ্গে এই অলগ্নতা, এই জড়িয়ে-না-পড়াই ত্যাগ। জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। কারণ জগৎ সত্য। শুধু ভোগের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যাওয়া চলবে না। উপনিষদ ত্যাগ বলতে এই নির্বেদকেই বোঝাচ্ছে।

তবু আমাদের শেখানো হল জগৎকে ‘মিথ্যা’ বলতে। এই ভুলের উৎসটি খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছেন সে-কথা দুর্বার সাহসের সঙ্গে—

‘বুদ্ধদেবের যে শিক্ষা সেও বাসনাবর্জনের শিক্ষা। গীতাতেও বলছে, ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে নিরাসক্ত হয়ে কাজ করবে। এই সকল উপদেশ হতেই অনেকে মনে করেন, ভারতবর্ষ জগৎকে মিথ্যা বলে কল্পনা করে বলেই এইপ্রকার উদাসীনতার প্রচার করেছে। কিন্তু কথাটা ঠিক এর উল্টো।’

(বিশ্ববোধ)

‘কিন্তু কথাটা ঠিক এর উল্টো’— এ-কথা আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মায়াবাদের বিরুদ্ধে এমন প্রবল প্রতিবাদের কথা লিখতে কতটা সাহসের প্রয়োজন আজ তার হয়তো আমরা আন্দাজই করতে পারব না।

কিন্তু এখানেই থামলেন না তিনি। মায়াবাদকে বিদ্রূপ করলেন এইভাবে—

‘যে লোক আপনাকেই বড়ো করে চায় সে আর-সমস্তকেই খাটো করে। যার মনে বাসনা আছে সে কেবল সেই বাসনার বিষয়েই বদ্ধ, বাকি সমস্তের প্রতিই উদাসীন। উদাসীন শুধু নয়, হয়তো নিষ্ঠুর। এর কারণ এই, প্রভুত্বে কেবল তারই রুচি যে ব্যক্তি সমগ্রের চেয়ে আপনাকেই সত্যতম বলে জানে; বাসনার বিষয়ে তারই রুচি যার কাছে সেই বিষয়টি সত্য, আর সমস্তই মায়া। এই সকল লোকেরা হচ্ছে যথার্থ মায়াবাদী।’

রবীন্দ্রনাথ যা বললেন তার সারমর্ম হল এই— তারাই জগৎকে মিথ্যা বলে যারা বিশ্বজগতের চেয়ে নিজেদের বড় বলে মনে করে, সত্য বলে মনে করে। মায়াবাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে মিথ্যা অহংকার— সেই কথাটি সাহস আর বিদ্রূপের সঙ্গে ধরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও আমাদের মধ্যে অনেকেই শুধু ব্রহ্মকেই সত্য বলে মানেন, তাঁর সৃষ্ট জগৎকে মিথ্যা বলেই তাঁরা ভাবতে শিখেছেন বাল্যকাল থেকে— গুরুজনদের কাছে এই একই কথা শুনে শুনে। তাঁরা জগৎকে ভোগ করার মধ্যে যে কোনও অন্যায় নেই, তা মানতে পারছেন না ভিতর থেকে। তাঁরা আজও মায়াবাদের শিকার। মনে করেন জগৎ মায়া, মিথ্যা।

রবীন্দ্রনাথ শুধু মায়াবাদকে বিদ্রূপ করেননি, পথ দেখিয়েছেন মায়াবাদ থেকে বেরোবার। মায়াবাদের ‘মিথ্যা’ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল, নিজেকে ব্যাপ্ত করা, ছড়িয়ে দেওয়া, অহংকার ও বাসনার বন্ধন কাটিয়ে এই জগৎকে ভোগ করা, এই জগৎকে ব্রহ্মেরই মতো সত্য বলে গ্রহণ করা। রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বলেছেন এবার পড়া যাক—

‘মানুষ নিজেকে যতই ব্যাপ্ত করতে থাকে ততই তার অহংকার এবং বাসনার বন্ধন কেটে যায়।…

…ততই তাকে বৃহৎ ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হতে হয়। একেই তো বলে বীতরাগ হওয়া। এইজন্যেই মহত্ত্বের সাধনামাত্রই মানুষকে বলে: ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। বলে: মা গৃধঃ।…

এই যে বাধাহীন চৈতন্যময় বিশ্ববোধটি ভারতবর্ষে অত্যন্ত সত্য হয়ে উঠেছিল এই কথাটি আজ আমরা যেন সম্পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করি। এই কথাটি স্মরণ করে আমাদের বক্ষ যেন প্রশস্ত হয়, আমাদের চিত্ত যেন আশ্বান্বিত হয়ে ওঠে। যে বোধ সকলের চেয়ে বড়ো সেই বিশ্ববোধ, যে লাভ সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ লাভ সেই ব্রহ্মলাভ— কাল্পনিকতা নয়;…’

প্রাণের মধ্যে বিশ্ববোধ না গড়ে উঠলে, বিশ্বজগৎকে সত্য বলে ভাল না বাসলে সত্যকে জানা যায় না— উপনিষদের এই প্রাণবার্তাটুকু তুলে ধরলেন রবীন্দ্রনাথ। উনি নিজেই পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন,

‘আসক্তি আমাদের চিত্তকে বিষয়ে আবদ্ধ করে। চিত্ত যখন সেই বিষয়ের ভিতরে বিষয়াতীত সত্যকে লাভ করে, তখন প্রজাপতি যেমন গুটি কেটে বের হয় তেমনি সে বৈরাগ্য-দ্বারা আসক্তি বন্ধন ছিন্ন করে ফেলে। আসক্তি ছিন্ন হয়ে গেলেই পূর্ণ সুন্দর প্রেম আনন্দ রূপে সর্বত্রই প্রকাশ পায়। তখন, আনন্দরূপমৃতং যদবিভাতি— এই মন্ত্রের অর্থ বুঝতে পারি। যা-কিছু প্রকাশ পাচ্ছে সমস্তই সেই আনন্দরূপ, সেই অমৃতরূপ। কোনো বস্তুই তখন আমি প্রকাশ হচ্ছি বলে আর অহংকার করে না, প্রকাশ হচ্ছেন কেবল আনন্দ, কেবল আনন্দ। সেই প্রকাশের মৃত্যু নেই।’

কোথা থেকে মায়াবাদের বিরুদ্ধে এমন তীব্র প্রতিবাদে এ-কথা বলার সাহস পেলেন রবীন্দ্রনাথ? পেলেন উপনিষদ থেকেই।

উপনিষদের মতে, বিশ্বজগতের মধ্যে ব্রহ্ম বা আদিসত্তা বা উৎসকে জানার মধ্যেই সত্যকে জানা যায়। ব্রহ্মকে জানবার চেষ্টা না করলে সে-পথ ধ্বংসের পথ। কিন্তু ব্রহ্মকে জানার চেষ্টা করা মানে জগৎকে ত্যাগ করা নয়। আবার জগৎকে ত্যাগ না করা মানে ভোগে জড়িয়ে পড়া নয়, সে-পথও সর্বনাশের।

তা হলে শংকরাচার্যের মতো একজন সর্বশাস্ত্রবিদ, প্রখর যুক্তিবাদী, ধীময় মানুষ কেন বললেন, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা? জগৎকেও সত্য বলে কেন তিনি মেনে নিতে পারেননি?

আমার মনে হয়, সত্যের মূর্ত ও বিমূর্ত উপস্থিতির মধ্যে যে বিরোধাভাস আছে তা তিনি তাঁর নিজস্ব যুক্তি দিয়ে সমাধান করতে পারেননি। কারণ হাজার বছর আগে বিজ্ঞানের যুক্তি এই বিরোধভাসের সমাধানের পর্যায়ে পৌঁছোয়নি। কিন্তু আজ পৌঁছেছে। আবার উপনিষদের উপলব্ধ সত্যকেও মেনে নিতে পারেননি তিনি। সত্যের প্রকাশ মহাবিশ্বে দুইভাবে। এক বিমূর্ত সত্য। যার কোনও পরিবর্তন নেই। কোনও বিনাশ নেই। সত্যের আর এক প্রকাশ মূর্ত। সত্যের এই মূর্ত প্রকাশই হল জগৎ। মূর্ত সত্য কিন্তু পরিবর্তনশীল। শংকরাচার্য এই পরিবর্তনশীল সত্যকেই ‘সত্য’ বলে গ্রহণ করতে পারলেন না। তিনি এই পরিবর্তনশীল সত্য অর্থাৎ জগৎকে ত্যাগ করার বাণী প্রচার করলেন।

আজকের কোয়ান্টাম বিজ্ঞান বলছে, জগতের এই পরিবর্তনশীল সত্য আর বিশ্বজগতের প্রতি কণায় বিরাজমান ‘উৎস’ যা শাশ্বত সত্য, তাদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, দুই-ই সমান সত্য। বিজ্ঞানের এ-কথা একেবারেই প্রমাণিত সত্য। হাজার হাজার বছর আগে ভারতের প্রাচীন ঋষি, বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই ধ্যানের মাধ্যমে উপনীত হয়েছিলেন এই সত্যে যে, সৃষ্টির উৎস মিশে আছে এই বিশ্বজগতের বুননের সঙ্গে— তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর যেহেতু সেই আদিউৎস বিশ্বের সর্বত্র ওতপ্রোত জড়িয়ে, সেই বিশ্বজগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করারও কোনও উপায় নেই।

এবার রবীন্দ্রনাথে ফিরে যাওয়া যাক। তিনি যেভাবে যত সহজে বুঝিয়ে বলতে পারেন, সে তো আর কেউ পারেন না। এই বিশ্ব সম্পর্কে উপনিষদের অন্তরবার্তাটি ব্যাখ্যা করলেন রবীন্দ্রনাথ—

‘…য একঃ, যিনি এক; অবর্ণঃ, যাঁর বর্ণ নেই; বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ, যিনি সমস্তের আরম্ভে এবং সমস্তের শেষে…।’

এই সহজ ব্যাখ্যার পরে নিজের অনুভবের কথা, উপলব্ধির কথা অতুলনীয়ভাবে প্রকাশ করলেন রবীন্দ্রনাথ—

‘হে সর্বানুভূ, তোমার যে অমৃতময় অনন্ত অনুভূতির দ্বারা বিশ্বচরাচরের যা-কিছু সমস্তকেই তুমি নিবিড় করে বেষ্টন করে ধরেছ, সেই তোমার অনুভূতিকে এই ভারতবর্ষের উজ্জ্বল আকাশের তলে দাঁড়িয়ে একদিন এখানকার ঋষি তাঁর নিজের নির্মল চেতনার মধ্যে যে কী আশ্চর্য গভীররূপে উপলব্ধি করেছেন তা মনে করলে আমার হৃদয় পুলকিত হয়। মনে হয়, যেন তাঁদের সেই উপলব্ধি এ দেশের এই বাধাহীন নীলাকাশে, এই কুহেলিকাহীন উদার আলোকে আজও সঞ্চারিত হচ্ছে। মনে হয়, যেন এই আকাশের মধ্যে আজও হৃদয়কে উদ্ঘাটিত করে নিস্তব্ধ করে ধরলে তাঁদের সেই বৈদ্যুতময় চেতনার অভিঘাত আমাদের চিত্তকে বিশ্বস্পন্দনের সমান ছন্দে তরঙ্গিত করে তুলবে।’

বিশ্বজগৎকে এইভাবে অন্তরে গ্রহণ করার কথা বললেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন প্রাচীন ঋষিবাণীর কথা— যে-বাণীর উৎস মহাবিশ্বের সঙ্গে চেতনার বিশুদ্ধ বন্ধন। জগতের মূর্ত সত্য আর সৃষ্টি-উৎসের অমূর্ত সত্য— দুই-ই এক, উপলব্ধ হয়েছিল ভারতের প্রাচীন ঋষির ধ্যানে। এইভাবেই সেই ধ্যানের মধ্যে ধরা দিয়েছিল জগতের এক পরিপূর্ণ মূর্তি। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের এই সারাৎসারকে ব্যাখ্যা করলেন নিজের ভাষায়, বোঝালেন কীভাবে ভোগের মধ্যে ত্যাগ সম্ভব, কেন ভোগ না করলে ত্যাগের মহিমায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় না—

‘কী আশ্চর্য পরিপূর্ণতার মূর্তিতে তুমি তাঁদের কাছে দেখা দিয়েছিলে— এমন পূর্ণতা যে কিছুতে তাঁদের লোভ ছিল না। যতই তাঁরা ত্যাগ করেছেন ততই তুমি পূর্ণ করেছ, এইজন্যে ত্যাগকেই তাঁরা ভোগ বলেছেন।’

উপনিষদের এই সহজ কথাটাই তলিয়ে গিয়েছিল গত হাজার বছর ধরে মায়াবাদের অতলে। সাহসী ডুবুরির মতো সেই সারমর্মটিকে অতল থেকে উদ্ধার করে আনলেন রবীন্দ্রনাথ:

‘তাঁদের দৃষ্টি এমন চৈতন্যময় হয়ে উঠেছিল যে, লেশমাত্র শূন্যকে কোথাও তাঁরা দেখতে পান নি, মৃত্যুকেও বিচ্ছেদরূপে তাঁরা স্বীকার করেন নি।’

মহাবিশ্বের মধ্যে আপাত স্ববিরোধকে বুঝতে পারেননি শংকরাচার্য। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর চেয়ে অনেক প্রাচীন ঋষিরা। বুঝতে পেরেছে এ যুগের বিজ্ঞান। এই স্ববিরোধের এক অপূর্ব ব্যাখ্যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ—

‘এইজন্যে অমৃতকে যেমন তাঁরা তোমার ছায়া বলেছেন তেমনি মৃত্যুকেও তাঁরা তোমার ছায়া বলেছেন: যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ। এইজন্যে তাঁরা বলেছেন: প্রাণো মৃত্যুঃ প্রাণস্তক্মা। প্রাণই মৃত্যু, প্রাণই বেদনা। এইজন্যেই তাঁরা… বলেছেন: নমস্তে অস্তু আয়তে। নমো অস্তু পরায়তে। যে প্রাণ আসছ তোমাকে নমস্কার। যে প্রাণ চলে যাচ্ছ তোমাকে নমস্কার। প্রাণে হ ভূতং ভব্যং চ। যা চলে গেছে তা প্রাণেই আছে, যা ভবিষ্যতে আসবে তাও প্রাণের মধ্যেই রয়েছে।’

ভারতের প্রাচীন ঋষি তাঁর ধ্যানের অন্তরে, জগতের পরিবর্তনশীল রূপের মধ্যে বিস্ময়করভাবে চিরন্তন অপরিবর্তনীয় সত্যের উদ্ভাস খুঁজে পেয়েছিলেন। কোথাও তাঁরা অপরিবর্তনীয় ব্রহ্ম আর পরিবর্তনশীল জগতের মধ্যে বিরোধ দেখতে পাননি, বরং উপলব্ধি করেছিলেন সত্যের এই ‘রূপ’ একই সূত্রে গাঁথা। লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ—

‘তাঁরা অতি সহজেই এই কথাটি বুঝেছিলেন যে, যোগের বিচ্ছেদ কোনোখানেই নেই। প্রাণের যোগ যদি জগতের কোনো এক জায়গাতেও বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে জগতে কোথাও একটি প্রাণীও বাঁচতে পারে না। সেই বিরাট প্রাণসমুদ্রই তুমি। যদিদং কিঞ্চ প্রাণ এজতি নিঃসৃতং। এই যা-কিছু সমস্তই সেই প্রাণ হতে নিঃসৃত হচ্ছে এবং প্রাণের মধ্যেই কম্পিত হচ্ছে। নিজের প্রাণকে তাঁরা অনন্তের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন নি, সেইজন্যেই প্রাণকে তাঁরা সমস্ত আকাশে ব্যাপ্ত দেখে বলেছেন: প্রাণো বিরাট্।’

বিশ্বজগতের সঙ্গে, যে-কারণেই হোক, হয়তো প্রাণের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেননি শংকরাচার্য। তিনি উপলব্ধি করেননি এই সত্য যে, তাঁর প্রাণ সারা জগতে পরিব্যাপ্ত অনন্ত প্রাণের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। রবীন্দ্রনাথের প্রাণের কথা, ‘প্রাণ, প্রাণ, প্রাণ, সমস্ত প্রাণময়,— কোথাও তার রন্ধ্র নেই, অন্ত নেই।’ উপনিষদও জগতের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই অখণ্ড অনবচ্ছিন্ন প্রাণকে উপলব্ধি করেছে, সত্য বলে জানিয়েছে। এ-কথা উপলব্ধি করেননি শংকরাচার্য। তাই তিনি ব্রহ্ম আর জগৎকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেছেন। দেখেননি অখণ্ডভাবে। যদি তা দেখতেন তা হলে বলতে বাধ্য হতেন, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য।

একমেবাদ্বিতীয়ম্ যিনি, সেই অদ্বৈত এক যে বহু হয়ে জগতে প্রকাশমান, এবং সেই অপরিবর্তনীয় চিরন্তন ‘এক’ এবং পরিবর্তনীয় ‘বহু’ যে সমান সত্য, একই সত্যের দুটি প্রকাশ মাত্র, তাদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, উপনিষদের এই গূঢ় বার্তাটি শংকরাচার্য বুঝতে পারেননি বা হয়তো বুঝতে চাননি। এই বিরোধ শুধুমাত্র আপাত— এ-কথা বুঝেছিলেন হাজার হাজার বছর আগে ভারতের ঋষি। এ-কথা বলছে আধুনিক বিজ্ঞান। এ-কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ এইভাবে— ব্রহ্ম আর জগৎকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে,

‘…আমরা হারাচ্ছি তাঁকে যিনি সকলকে নিয়েই এক হয়ে আছেন— যিনি তাঁর প্রকাশকে বিচিত্র করেছেন কিন্তু বিরুদ্ধ করেন নি।’

জগৎকে এই যে আমরা মিথ্যা ভাবতে, মায়া বলতে শিখেছি অন্তত গত হাজার বছর ধরে, এই যে আমরা ক্রমশ দূরে সরে গেছি উপনিষদের বিশ্ববোধ থেকে, তাতে ভারতবাসীর কী বিপুল ক্ষতি হয়েছে তা আমরা ভেবে দেখি না। ভাবলে পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন আমাদের এই সমষ্টিগত গভীর ক্ষতির। তাঁর মতো করে এত সংক্ষেপে, এমন ব্যঞ্জনাময় করে আমরা কেউই বলতে পারব না। তাই তাঁর উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করছি এই পরিচ্ছেদ—

‘…আজ আমাদের মধ্যে দুর্গতির সীমা পরিসীমা নেই; যা ভালো তা কেবলই বাধা পায়, পদে পদেই খণ্ডিত হতে থাকে, তার ক্রিয়া সর্বত্র ছড়াতে পায় না।… এমনি করেই ভূমাকে আমরা হারালুম, মনুষ্যত্বকে তার বৃহৎ ক্ষেত্রে দাঁড় করাতে আর পারলুম না, নিরর্থক কতকগুলি আচার মেনে চলাই আমাদের কর্ম হয়ে দাঁড়াল, শক্তিকে বিচিত্র পথে উদারভাবে প্রসারিত করা হল না, চিত্তের গতিবিধির পথ সংকীর্ণ হয়ে এল, আমাদের আশা ছোটো হয়ে গেল, ভরসা রইল না, পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়াবার কোনো টান নেই, কেবলই তফাতে তফাতে সরে যাবার দিকেই তাড়না, কেবলই টুকরো টুকরো করে দেওয়া, কেবলই ভেঙে ভেঙে পড়া— শ্রদ্ধা নেই, সাধনা নেই, শক্তি নেই, আনন্দ নেই। যে মাছ সমুদ্রের সে যদি অন্ধকার গুহার ক্ষুদ্র বদ্ধ জলের মধ্যে গিয়ে পড়ে তবে সে যেমন ক্রমে অন্ধ হয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে, তেমনি আমাদের যে আত্মার স্বাভাবিক বিহারক্ষেত্র হচ্ছে বিশ্ব, আনন্দলোক হচ্ছেন ভূমা, তাকে এই সমস্ত শতখণ্ডিত খাওয়া-ছোঁওয়ার ছোটো ছোটো গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে প্রতিদিন তার বুদ্ধিকে অন্ধ, হৃদয়কে বন্দী এবং শক্তিকে পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে।’

এই ক্ষতি থেকে আমাদের উদ্ধার পেতেই হবে। এই বিনষ্টি থেকে, সর্বনাশ থেকে বেরোবার পথ আমাদের পেতেই হবে। কে আমাদের আলো দেখাবে? রবীন্দ্রনাথ বললেন,

‘এর যে যথার্থ উত্তর সে আমাদের দেশেই আছে। ইহ চেৎ অবেদীৎ অথ সত্যমস্তি, ন চেৎ ইহ অবেদীৎ মহতী বিনষ্টিঃ। ইঁহাকে যদি জানা গেল তবেই সত্য হওয়া গেল, ইঁহাকে যদি না জানা গেল তবেই মহাবিনাশ। এঁকে কেমন করে জানতে হবে? না, ভূতেষু ভূতেষু বিচিন্ত্য। প্রত্যেকের মধ্যে, সকলেরই মধ্যে, তাঁকে চিন্তা করে, তাঁকে দর্শন করে।… সেই একই অমৃত, সেই একের থেকে বিচ্ছিন্নতাই মৃত্যু।’

শুধু ব্রহ্মকে সত্য বললে, আর জগৎকে মিথ্যা, মায়া বলে ত্যাগ করলে আমরা নিজেরাই সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হব। এবং সেই বিচ্ছিন্নতাই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশের পথে। এই সর্বনাশ থেকে আমাদের বাঁচতেই হবে। জাগ্রত হতে হবে নতুন চেতনার উদ্ভাসে। উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও যেন বলতে পারি—

ভুবনজোড়া আসনখানি

আমার হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি॥

রাতের তারা, দিনের রবি, আঁধার-আলোর সকল ছবি,

তোমার আকাশ ভরা সকল বাণী—

আমার হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *