ভুতো

ভুতো

ভুতোর ক্রিয়াকাণ্ড সব লিখতে হলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। ওর ভাল নাম ছিল ভূতনাথ সরকার। ও আমাদের চেয়ে বয়সে বছর দশেকের ছোট ছিল কিন্তু ক্ষণজন্মা ছিল। স্কুলে ও ক্লাসে ফারস্ট হত নাকি। কোন স্কুলে পড়ত তা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে ও যেমন বুদ্ধিমান ছিল যে ওকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ ঘটেনি। কী কারণে ওর বাবা ওকে খুব মারধর করে দোতলার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নাকি একতলাতে ফেলে দেন। তারপর থেকেই ও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে। সবরকম নেশা করতে থাকে—রেসের মাঠে যাওয়া শুরু করে। কিন্তু মেকানিক ও ছিল খুব বড় মাপের। এক কথায় ব্রিলিয়ান্ট।

নাজিম সাহেব আমাদের দু বেলা দাবড়াতেন। ছঁওড়াপুত্তান বলে ডাকতেন। তিনি যেহেতু বয়সে অনেকই বড় এবং আমাদের হাজারিবাগি লোকাল গার্জেন ছিলেন ওঁকে আমরা ঘাঁটাতাম না। গোপাল তখন কলেজের ছাত্র, একবার চাতরার জঙ্গলে প্রখর গ্রীষ্মে শিকারে গিয়ে প্রায় মারাই যেতে বসেছিল। নাজিম সাহেবের সেবা—যত্নে সে প্রাণ ফিরে পায়। নাজিম সাহেবই গোপালের বাবাকে কলকাতাতে ট্রাঙ্ককল করে খবর দেওয়াতে মাসিমা ওদের ব্যুইক এইট গাড়ি ও ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে এসে গোপালকে গাড়ি করেই নিয়ে যান কলকাতাতে। গোপালের মা—বাবা গোপালকে খুব পুতু পুতু করে রাখতেন। এটা কোরো না, ওটা কোরো না করতেন সব সময়েই অধিকাংশ বাঙালি বাবা—মায়ের মতন। আমার বাবা এসব ব্যাপারে মহাদেব ছিলেন। আমি কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, যা করছি তাতে বিপদ হতে পারে কি না এসব নিয়ে ভাববার অবকাশই তাঁর ছিল না, উল্টে সমস্তরকম বিপজ্জনক কাজে উৎসাহ দিতেন। এ জন্যে গোপাল আমার বাবাকে খুবই শ্রদ্ধা করত। বলত মেসোমশাই—এর মতো বাবা পেয়েছ, তুমি ভাগ্যবান। বাঙালিদের মধ্যে এমন বাবা সত্যিই দেখা যায় না।

সেই নাজিম সাহেবকেই ভুতো প্রথম আলাপেই একেবারে ল্যাজে—গোবরে করে দিয়েছিল। ভুতো সবসময়েই ওর মামাবাড়ির আমবাগানের গল্প করত। সেই আমবাগানের বড় বড় গাছে কী অসামান্য পারদর্শিতাতে সে উঠত এবং গাছে বসেই আম খেত তার গল্প করত আমাদের সবিস্তারে। আমরা শুনতাম, নাজিম সাহেবও শুনতেন।

একবার গরমের দিনে আমরা হাজারিবাগে গেছি। শুক্লপক্ষ। সন্ধের পরেই চাঁদ উঠেছে। সকলে মিলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ‘পূর্বাচল’—এ ফিরে আসছি। নাজিম সাহেব ভুতোকে গোপালদের বাড়ির ইউক্যালিপটাস গাছগুলো দেখিয়ে বললেন, আরে এ ভুচু! তুমহারা মামাবাড়িকি আমগাছমে চড়নেকা বহত গপ তো শুনায়া—ইউক্যালিপটাস গাছমে চড়নে শেকোগে? তুমহারা গাঁড় টুট যায়েগা হাঃ।

ভুতোকে নাজিম সাহেব ভুচু বলে ডাকতেন এবং প্রথম থেকে ওর ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে ওর উপরে রাগ ছিল নাজিম সাহেবের। ভুতো নাজিম সাহেবের পেছনে লেগেও থাকত সবসময়ে। নাজিম সাহেবের কথার কোনও উত্তর দিল না ভুতো। বাড়ির হাতাতে ঢোকার পরে ভুতো বিনা বাক্যব্যয়ে চটি জোড়া ছেড়ে, যেমন করে খেজুর রসের হাঁড়ি পাড়তে লোকে পায়ে দড়ি বেঁধে খেজুর গাছে চড়ে তেমন করে দড়ি ছাড়াই সট সট করে মসৃণ ইউক্যালিপটাস গাছে উঠে যেতে লাগল—উঠে প্রায় মগডালে পৌঁছে একটা সরু ডালে দু পায় লটকে সার্কাস করতে লাগল আর বলতে লাগল, এ বুড়ুয়া। হাম হিয়াসে গিড় যানেসে হামারা মামালোগ আকর আপকি খাল খিঁচ লেগা। নাজিম সাহেব দু হাত জড়ো করে বলতে লাগলেন, আরে ও বাবা ভুচু নিচুমে উতর আ যা বাবা—তু সাচমুচ গিড় পড়েগা হুঁইয়েসে। ভুতো সার্কাস করতে করতে বলল, ম্যায় নেহি উতরেগা, আপ বোলিয়ে আপকি গাঁড় টুটা হ্যায়, তবহি ম্যায় উতারকে আওবেগা।

উতর আ বাবা। উতর আ……।

ভুতো বলল, নেহি উতরেগা। বোলিয়ে আপ কো গাঁড় টুটা হ্যায়।

অমন বিপদে মহম্মদ নাজিম জীবনে পড়েননি। বলতে লাগলেন, উতর আ বাবা। ভুতো নাছোড়বান্দা। অবশেষে নাজিম সাহেবকে হার মানতেই হল। নাজিম সাহেব বললেন, হাঁ। হাঁ। হামারা টুট গ্যায়া। ভুতো বলল, বলিয়ে গাঁড় টুটা। নাজিম সাহেব বললেন, মান লিয়া রে—টুটা, টুটা, হামারা গাঁড় টুটা।

তারপর ভুতো কাঁড়িয়ে পিরেতের মতো সড়াৎ সড়াৎ করে নীচে নেমে এল।

আমরা সকলে দোর্দণ্ড প্রতাপ নাজিম সাহেবের ওই দুর্দশা দেখে হাসি চাপতে না পেরে একসঙ্গে হেসে উঠলাম। জংলি ঘোড়া যে ভাবে বশ করে সে ভাবেই ভুতো নাজিম সাহেবকে বশ করল। তারপর থেকে নাজিম সাহেব ভুতোকে আর কখনও ঘাঁটাননি।

আরেকবার প্রচণ্ড শীতে হাজারিবাগে গেছি। গোপাল বলল, একটা জিপ জোগাড় করতে পারো লালা! সুব্রত তখন গুমিয়াতে। মুকুলও চাকরি পেয়ে চলে গেছে কলকাতার কাছে এক সাহেবি কোম্পানিতে। আমি ডালটনগঞ্জে মোহন বিশ্বাসকে ফোন করে বললাম, মোহন একটা জিপ পাঠাও কালকে। পরশুই ফেরত পাঠিয়ে দেব। ডালটনগঞ্জ থেকে লাতেহার চান্দোয়া টোড়ি বাঘড়া মোড় সীমারিয়া হয়ে জিপ এসে পৌঁছল। গোপালের এক জান—চিন স্যাঙাৎ ছিল হান্টারগঞ্জে। আমরা বিকেল বিকেল রওনা হলাম। ভীষণই ঠান্ডা। গোপাল বলল, এক বোতল রাম সঙ্গে নেওয়া ভাল। তখনও আমরা মদ্যপান করি না। ওষুধ হিসেবেই রাম নেওয়া হল। নাজিম সাহেব বললেন, রাম ঔর আন্ডা বহতই মানহুস হোতি হ্যায়। ওসব লেকর শিকারমে যানা নেহি চাইয়ে। আমরা কথা শুনলাম না। গোপাল চমনলালকে বলল, মশলা বেটে রাখতে। আমরা হান্টারগঞ্জ থেকে হরিণ মেরে ফিরে এলেই ফটাফট রান্না করতে হবে।

বড়হি থেকে আরও আগে গ্রান্ড—ট্রাঙ্ক রোডে ডোভির পথে গিয়ে সে রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের পাহাড়ে হান্টারগঞ্জে যাওয়ার রাস্তা।

প্রচণ্ড ঠান্ডা। সত্যিই প্রচণ্ড ঠান্ডা ছিল। হাজারিবাগ আর বহরমপুরের মশা ছিল কুখ্যাত আর আলমোড়ার মাছি, কিন্তু হাজারিবাগ আর বহরমপুরের শীত—গ্রীষ্মের কুখ্যাতিও কম ছিল না। মিলিটারি জিপে গরম জামাকাপড়, মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস পরে তো রওয়ানা হওয়া গেল। গোপালের ভাষাতে ড্রাইভারের চেহারাটা জিপের শক অ্যাবজর্বারের মতো। ঠান্ডায় সেই ধুতি—পাঞ্জাবি পরিহিত গলায় চাদর জড়ানো ড্রাইভারের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। সে স্টিয়ারিং শক্ত করে দুহাতে ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ি তো সে চালাচ্ছে না, মনে হচ্ছে গাড়িই তাকে চালাচ্ছে। ঠান্ডাতে হাত কুঁকড়ে যাওয়াতে স্টিয়ারিং ডাইনে বাঁয়ে কাটাচ্ছেই না। খানা—খন্দ যাই থাকুক পথে। জিপ সোজা চলেছে এবং ঘটাং ঘটাং করে গাড্ডায় পড়ছে প্রতি সেকেন্ডে।

নাজিম সাহেব সেই ড্রাইভারের ড্রাইভিং—এর রকম দেখে বললেন, ক্যা ড্রাইভার সাব, নিমন গীতিয়া না গাওয়েব, সরকারনে না পাকড়ায়েব?

হ্যায় না?

আমরা, কেউই কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না।

সমস্বরে বললাম, মতলব?

ড্রাইভার কোনও কথাই বলছিল না। একেবারেই নীরব।

নাজিম সাহেব বললেন উও কিসসা বাতায়গা! পহিলে ভুচু যাও, স্টিয়ারিং—পর বৈঠো, বাদমে বাত করেগা।

ড্রাইভার খুশি মনেই স্টিয়ারিং ভুতোকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে গিয়ে নাজিম সাহেবের পাশে বসল। আমি আর গোপাল সামনে বসেছিলাম।

ভুতোর পরনে একটি ফেডেড জিনস, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি ডোরাকাটা স্পোর্টস গেঞ্জি, পায়ে একজোড়া হাওয়াই—চপ্পল। ওই শীতে ওই পোশাক পরে ও কী ভাবে বেঁচেছিল তা ওই জানে। কিন্তু উঃ আঃও করছে না। একেবারে নির্বিকার মহাদেব।

ভুতো, জিপ গিয়ারে ফেলে নাজিম সাহেবকে বলল, হাঁ মিঞা, অব বোলিয়ে। যেন ইয়ার! আমরা যখন সম্ভ্রমের সঙ্গে নাজিম সাহেবকে ‘নাজিম সাহেব’ বলে সম্বোধন করি তখন ভুতো সেই ইউক্যালিপটাস কাণ্ডের পর থেকেই তার ঠাকুর্দার বয়সি নাজিম সাহেবকে নাম ধরে ডাকত ‘নাজিম’ বলে। কখনও কখনও বলত মিঞা।

নাজিম সাহেব বললেন, এক রাজার এক মন্ত্রী ছিল। রাজা গান—বাজনা শুনতে খুব ভালবাসতেন। নানা বড় বড় গাইয়ে বাজিয়েকে আমন্ত্রণ করে এনে গান শুনতেন। তাঁদের জবরদস্ত তোফা দিতেন। এদিকে সেই মন্ত্রীর এক সুন্দরী তরুণী সুগায়িকা বাইজি রক্ষিতা ছিল। মন্ত্রীর খুবই ইচ্ছে যে সে একদিন রাজাকে তার রক্ষিতার গান শোনাবে। অনেকদিন ধরে বলতে বলতে রাজা বললেন, ঠিক আছে মন্ত্রী নিয়ে এসো কাল তোমার গাইয়েকে।

মন্ত্রী তো বেজায় খুশি। নিয়ে গেলেন তাঁর রক্ষিতাকে। রাজা যখন গান গাইতে বললেন তখন সেই বাইজি কাঁকাঁ কিঁকিঁ কুঁকুঁ শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠল। মিনিট দু তিন শুনেই রাজা বললেন, ঈ, ক্যা হো রহা হ্যায়? নিকালিয়ে মন্ত্রীজি, নিকালিয়ে উনকি।

বাইরে চার ঘোড়ায় টানা ব্রুহাম গাড়ি তৈরিই ছিল। মন্ত্রী তো তাঁর রক্ষিতাকে তাতে তুলে দিয়ে বললেন, রাতমে মিলেঙ্গে।

রাতে যখন মন্ত্রী গেলেন রক্ষিতার কাছে রাজকার্য সমাপন করে, গিয়ে খুব রাগ করলেন রক্ষিতার উপরে। বললেন, কত সোনা দানা ধন রত্ন পেতে পারতে রাজার কাছ থেকে, তুমি তো সত্যিই ভাল গাও। ওটা কী করলে তুমি? ছিঃ ছিঃ। এমন অসম্মান করলে আমাকে!

বাইজি হেসে বলল, আপ মন্ত্রী হোনে শকতা মগর অকল থোড়া কম হ্যায় আপকি।

মতলব?

মতলব, ম্যায় আচ্ছি গাতিথি তবতো রাজা মুঝকো হারেমমেহি ভর দেতে থে। আপ আতা থা কিসকি পাশ? ”নিমন গীতিয়া না গায়েব, সরকারমে না পাকড়ায়েব।” মানে হল, ভাল গান গাইব না, গাইলে রাজার হারেমে…..

ভুতো বলল, তা তো বুঝলাম কিন্তু মোহনদার পাঠানো জিপের ড্রাইভারকে একথা বললেন কেন আপনি? মানে বুঝলাম না।

বুঝলে না? ড্রাইভার যদি ভাল করে গাড়ি চালাতেন তবে তো এই ঠান্ডাতে সারা রাত খোলা জিপ চালাতে হত। চালাক বলে উনি এমন করেই চালালেন যে তাঁর হাত থেকে স্টিয়ারিং তোমাকেই দিতে হল।

বলেই, বললেন, ক্যা ড্রাইভারসাব, ঠিক্কেই না বোলিন।

ড্রাইভার সাহেব, এন্ডির চাদরে কান মাথা গলা ঢেকে তখন গভীর নিদ্রাতে। কোনওরকম উচ্চচবাচ্যই করলেন না।

হান্টারগঞ্জে আমরা শীতের রাতের সাতটাতেই পৌঁছলাম। বেশ উঁচু পাহাড়ের উপরে একটি মালভূমি। হান্টার নামের কোনও সাহেব বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হয়তো পত্তন করেছিলেন জায়গাটার, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, হ্যামিলটনগঞ্জ, ফোর্বস গঞ্জেরই মতো কিন্তু এখন দেহাতি বস্তি প্রায়। খুব ভাল বাজরা হয়েছে। আর বাজরা খেতেই গোপালের ওখানকার চেনা শনিচরোয়া আমাদের জিপ ঢুকিয়ে দিল। একটা বিরাট দল স্পটেড ডিয়ারের, বাজরা খেতে বাজরা খাচ্ছিল। হড়বড়িয়া—খড়বড়িয়া গোপাল নিশানা না নিয়েই গুলি করে দিল। আমি আর নাজিম সাহেবও করলাম—নিশানা কেউই নিলাম না—গুলি হল অ্যাট দ্যা জেনারাল ডিরেকশান—শীতে আঙুল কুঁকড়ে ছিল—আমার আঙুল গ্লাভস পরা থাকাতে পিছলে গেল। সে রাতে ভাগ্য হরিণদের সদয় ছিল আর আমাদের নির্দয়। গুলি ফসকে যাওয়াতে গোপাল নির্দেশ দিল ভুতোকে—আরও আগে করো জিপ। অন্ধকারে অন্ধর মতো জিপের অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল ভুতো আর জিপ গিয়ে পড়ল একটি নালার মধ্যে। অনেকক্ষণ এবং গ্রামের অনেক মানুষের সম্মিলিত চেষ্টাতে গাড্ডা থেকে জিপ উদ্ধার করে খালি হাতে আমরা হাজারিবাগমুখো হলাম। অনেকখানি পথ। পূর্বাচল—এ ফিরতে ফিরতে রাত দশটা হয়ে যাবে। আর ওদিকে চমনলাল মাংসের মশলা বেটে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে।

আমাদের কষ্টের তো সেই সবে শুরু। তখন কি আর জানি কপালে আরও কত দুর্ভোগ আছে।

শিকার তো হলই না, যখন অকুস্থল থেকে ফিরে আসছি হান্টারগঞ্জের পাহাড়ি ঘাটের ঘনবনাবৃত পথ দিয়ে, হঠাৎই কোঁ—কোঁ—কোঁ—কোঁ আওয়াজ করে জিপটা থেমে গেল। থেমে গেল না বলে বলা উচিত কোনও অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলল। জিপটাকে, তার প্রাণ থাকতে থাকতে ভুতো বুদ্ধি করে বনপথের বাঁদিকের উঁচু জঙ্গলময় ডাঙার গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যাতে অন্য যানবাহনের যাতায়াতের অসুবিধা না হয়। তবে সে পথে যানবাহন ছিলই না। আসার সময়েও একটিও যান চোখে পড়েনি। পরে জেনেছিলাম সূর্যাস্তের আগে একটি বাস নামে হান্টারগঞ্জ পাহাড় থেকে—নেমে, পাকা রাস্তাতে পড়ে বাঁদিকে গিয়ে দোভিতে পৌঁছায়। নবাব শের শাহর পত্তন করা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এর উপরে। তারপরে সেখানে প্যাসেঞ্জারদের চা—পানি খাইয়ে রোদ ওঠার পরে গয়ামুখো যায়। সেই বাসই আবার ফিরে আসে হান্টারগঞ্জে বিকেল বিকেল—হান্টারগঞ্জ পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নেমে আসে।

কী ব্যাপার? জিপ থেমে গেল কেন আর্তনাদ করে? কোঁ—কোঁ—কোঁ—কোঁ শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুতো পার্টি হো হো করে হেসে উঠল রাতের শীতার্ত বনপথকে সচকিত করে। আমরা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। তখন ড্যাশবোর্ডের আলোও জ্বলছিল না। তাই দেখাও কিছু যাচ্ছিল না। গোপাল আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে।

আমি ভুতোকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?

ভুতো বলল, তেল শেষ।

গোপাল বলল, তেল শেষ মানে?

আমি বললাম, মোহনের তো ট্যাঙ্ক ফুল করেই পাঠানোর কথা।

নাজিম সাহেবও তো জিপ নিয়ে কাছারির কাছের পেট্রোল পাম্প থেকে ট্যাঙ্ক ফুল করে এনেছিলেন আমরা পূর্বাচল থেকে বেরোবার আগে।

—তব ক্যাইসে অ্যাইসা হুয়া?

ভুতো হাসতে হাসতে বলল, আরে মিঞা তেল ভূতনে পী লিয়া হোগা। ইস পাহাড়ো জঙ্গলমে বহত ওর বহত কিসিমকি ভূত হ্যায়।

নাজিম সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মজাক মত করো আভভি। আভভি করনা ক্যা ওহি শোচো।

তারপর নিজেই বললেন, করনা ক্যা? যো বাস সুব্বে চার বাজি উৎরোগে পাহাড়সে, ওহি বাসমে বৈঠকর দোভি যা কর পিট্রোল লাতা হ্যায়। হাজারিবাগ কব লওটনে শেকোগে উও খুদা মালুম।

খবরের কাগজের ভাষাতে যাকে বলে ”কিংকর্তব্যবিমূঢ়” তাই হয়ে জিপের মধ্যে বসে থাকলাম আমরা। তিনদিকে খোলা অ্যামেরিকান আর্মির ডিজপোজাল থেকে কেনা জিপ। ১৯৫৯—তে পাটনাতে জীবনের প্রথম পেশার কাজ, পাটনার ইনকামট্যাক্স অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনালে সওয়াল করে কেস জিতে আসতে আমার বাবা পানাগড়ের ডিসপোজাল থেকে ৪৮০০ টাকা দিয়ে একটা চলন্ত জিপ আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। ওই টাকাতে আজকাল মোটরাইজড সাইকেলও পাওয়া যাবে না। হান্টারগঞ্জের এই ঘটনা ঘটে ১৯৫৮ সনের শীতকালে।

রাত যত বাড়ে শীত তত বাড়ে। আমি ভুতোর দিকে চেয়ে দেখি গায়ে ডোরাকাটা সুতির একটি পাতলা গেঞ্জি, নিম্নাঙ্গে ফেডেড জিনস আর পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরে পরমানন্দে বসে বেসুরে, হিন্দি ফিল্মের গান গাইছে। ড্রাইভারের তাও চাদর ছিল, পায়ে মোষের চামড়ার নাগরাও ছিল। নাজিম সাহেবের গায়ে অ্যামেরিকান ডিসপোজালের জার্কিন। ডিবে থেকে বের করে পান খাচ্ছেন মাঝে মধ্যে কালি—পিলি জর্দা দিয়ে আর মাঝে মাঝে কাঁচি সিগারেট। আমাদের পায়ে মোজা, গরম কাপড়ের ট্রাউজার, কোট, ওভারকোট, মাথায় টুপি—তাতেও ঠান্ডাতে জমে যাচ্ছি। জিপ থেমে থাকাতে জিপের ইঞ্জিনের গরমও আর নেই। কুমেরু সুমেরু দুইই এক ঠাঁই হয়েছে।

আমি বললাম, ভাগ্যিস রামটা আনা হয়েছিল। এই ঠান্ডার থেকে আজ রাতে ওই রামই বাঁচাবে।

নাজিম সাহেব বললেন, এতবার মানা করলাম তা ছঁওড়াপুত্তানরা শুনলেন কেউ? ওই সব আনাতেই তো এই মুসিব্বত।

ভুতো পার্টি বলল, ক্যা মুসিব্বত? মিঞা, আপ জানসে বাঁচ গ্যায়া যো ভূতনে জিপকি পেট্রোলহি পীয়া, আপকি খুন নেহি পী গ্যয়া।

নাজিম সাহেব বেজায় চটে গিয়ে ভুতোকে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ রহো বদতমিজ।

অনভ্যস্ত গোপাল আর আমি রাম—এর বোতল—এর ছিপিতে রাম ঢেলে দু—তিন ছিপি খেলাম। নাজিম সাহেব মুখে রাগ করলেও প্রাণ বাঁচাতে খেলেন একটু। আমি গোপালকে বললাম, ভুতো ছেলেটা আজ মরেই যাবে। ওর মামাবাড়িতে ওর ডেডবডি পৌঁছতে হবে তোমাকেই। ওকেও ছিপিতে ভরে রাম দাও একটু—নইলে সত্যিই ও প্রাণে বাঁচবে না।

তারপর বললাম, ভুতো এসব কড়া জিনিস—আমরা একেবারেই খাই না। ঠান্ডার ভয়েই এনেছিলাম। এক ছিপি খেয়ে নাও, গা গরম হবে।

ভুতো পার্টি বলল, বোতলটা দিন, আমিই ঢেলে নিচ্ছি—অন্ধকারে এদিক—ওদিক পড়ে যাবে। সেই কথাতে গোপাল হাত পেছনে করে রাম—এর সাড়ে সাতশো মিলিলিটারের বোতলটা ভুতোর দিকে এগিয়ে দিল। এমন সময়ে শিশিরভেজা লাল মাটির পথ বেয়ে কী একটা বস্তুকে আসতে দেখা গেল। কী জিনিস দেখবার জন্যে আমরা ব্যগ্র হয়ে উঠলাম। ড্রাইভার পেছন থেকে ভয়ার্ত গলাতে বলল, বা—বা—বা বাঘ।

বাঘ?

হতেও পারে। চাঁদ যতটুকুও বা আছে—গাছপালার চন্দ্রাতপের ফাঁক—ফোকর দিয়ে তার আলো পথে পড়ছেই না বলা চলে। একটু পরই সবিস্ময়ে আমরা সবাই দেখলাম, বাঘ নয়, বাঘের প্রিয় খাদ্য, বড় বড় কানওয়ালা একটা গাধা হেঁটে আসছে, রাতের বনের সব ভয়কে ডোন্ট কেয়ার করে।

গাধাটা আমাদের জিপকে অতিক্রম করে চলে গেল হান্টারগঞ্জের দিকে। মনে হল সেটা কোনও অলৌকিক গাধা নইলে এই জঙ্গলে একাধিক বাঘ থাকা সত্ত্বেও কোনও গাধা পরম গাধামি করে বনপথে বেরোত না এবং এমন বীরদর্পে হেঁটেও যেত না।

গোপাল ফিসফিস করে বলল, অলৌকিক গাধা। এর মালিক হয়তো ছিল হান্টারসাহেবের ধোপা—যারা সকলেই বহুযুগ আগে গত হয়েছেন।

ভুতো বলল, হান্টারগঞ্জে এমন হতেই পারে। আমি বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি যে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে কাব্রাল সাহেবকে রাতের বেলাতে প্রায়ই দেখা যায় ম্যাকলাস্কিগঞ্জের স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম—এ নিজের মুন্ডুটি বগলতলিতে চেপে হেঁটে বেড়াচ্ছেন ছমছমে জ্যোৎস্না রাতে।

গোপাল বলল, বুলশিট।

নাজিম সাহেব বললেন, উয়ো গাধা নেহি থা।

—তব ক্যা থা?

ভুতো বলল।

—উয়ো ইন্টেলিজেন্ট থা।

—ইন্টেলিজেন্টকি দুম হোতা হ্যায়, না ঐসা বড়কা বড়কা কান? না চার পায়ের?

জাদাই হোতা দো—পায়েরকা, তুম যেইসা, মগর চার পায়েরওয়ালা ইন্টেলিজেন্ট ভি হোতা হ্যায়।

গাধা দেখে নিজেরা গাধা বনে গেছি যখন, তখন আমাদের রাম—এর বোতলটার খেয়াল হল। শুনতে পেলাম, পেছন থেকে ঢক—ঢক—ঢক—ঢক করে আওয়াজ হচ্ছে। চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি ভুতো রাম—এর বোতলটা থেকে জল খাওয়ার মতো ঢকঢকিয়ে রাম খাচ্ছে। আমরা ”মরে যাবে। মরে যাবে”, ”এটা ওষুধ, অমন করে খায় না” ইত্যাদি বলতে বলতেই ভুতো পার্টি বোতলটাকে নিঃশেষ করে গোপালের হাতে ফেরত দিল। দিয়ে বলল, এতজন দাবিদার, কিনলেনই যখন তখন মোটে একটা কিনলেন!

ভুতোর বয়স তখন বেশি হলে ষোলো—সতেরো হবে। বেশি তো নয়ই, কমও হতে পারে।

তারপর নাজিম সাহেব নেমে ভুতোর সাহায্যে কাঠ—কুটো জোগাড় করে, জড়ো করে, নিজের রুমালটা জিপেই রাখা একটি বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে পেট্রল ট্যাঙ্কে ঢুকিয়ে একটু ভেজা ভেজা ভাব করে সেই কাঠ—কুটোর নীচে রেখে দেশলাই ঠুকে আগুন জ্বাললেন। আগুনটা জোর হতে আমাদের ডাকলেন। আমরা গিয়ে আগুনের পাশের ভেজা পাথরে বসলাম।

ভুতো বলল, লালাদা, রাতে হরিণের মাংসর কাবাব আর চাঁপ খাব বলে দুপুরে খুবই কম খেয়েছিলাম। রাত এগারোটা বাজতে চলল। বড় খিদে পেয়েছে।

ভুতো খিদে শব্দটা উচ্চচারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও সকলের খিদে যেন চাগিয়ে উঠল। কিন্তু খাদ্য—দ্রব্য বলতে তো কিছুই ছিল না সঙ্গে। আধ—ভর্তি দু বোতল জল ছিল। তাও অচিরে শেষ হয়ে যাবে। তবে ওই প্রচণ্ড ঠান্ডাতে জল পিপাসা তখনও পাচ্ছিল না কারোই।

কীভাবে যে সেই রাত গড়িয়ে গড়িয়ে ভোরের দিকে পৌঁছল বোঝা গেল না। আগুনে জুতোসুদ্ধ পা ঢুকিয়ে দিয়েও পায়ের ঠান্ডা কাটছিল না। প্রায়—নগ্ন ভুতোর দিকে তাকিয়ে আমাদের শীত আরও বেড়ে গেল। বাইরে আগুনের সামনেও আর বসা যাচ্ছিল না। মাঝ রাতে সকলে জিপের ভিতরে গিয়ে বসেছিলাম। একে অন্যের শরীরের ওম—এ কতটুকু উষ্ণতা পাওয়া যায়। দু চোখ ঘুমে ভরে এসেছিল এমন সময়ে ভ্যাঁকো ভ্যাঁকো ভ্যাঁকো করে একটা লজঝড়ে বাস হেডলাইট জ্বালিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে বালব হর্ন বাজাতে লাগল। তার ইলেকট্রিক হর্ন ছিল না।

নাজিম সাহেব আমাকে আর গোপালকে বললেন যে সেই বাসে চড়ে গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোড—এ ডোভিতে গিয়ে পেট্রল নিয়ে আসতে। নইলে এইখানে অশোকবনে সীতার মতো কতদিন পড়ে থাকতে হবে কে জানে।

আগে জিপ থেকে নেমে সকলে মিলে ঠেলে তাকে পথের আরও বাঁদিকে করা হল যাতে বাস যেতে পারে। তারপর আমি আর গোপাল সেই বাসে দুগগা বলে চড়ে বসলাম। যাত্রী চার পাঁচ—জনই ছিল তবু মাথাতে কাঠের ফ্রেমের উপরে টিনের ছাদ এবং চালু ইঞ্জিনের গরম ছিল তাই ঠান্ডাটা তিনদিক খোলা উপরে ত্রিপলের চাঁদোয়া দেওয়া জিপের চেয়ে বাসের মধ্যেটা তুলনাতে অনেকই গরম ছিল।

ডোভিতে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন সবে ভোর হয়েছে। বাস তো আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। প্রথমেই অভুক্ত আমরা একটা ধাবাতে গিয়ে ডিমের কারি আর গরম রুটি দিয়ে তিন চার কাপ করে গরম চা খেলাম। একটু ধাতস্থ হয়ে পেট্রোল পাম্পে গিয়ে পেট্রল পাওয়া যায় কি না তারই চেষ্টা করলাম। পেট্রোল নাকি এমনিতে বিক্রি বারণ। বেশি টাকা দিয়ে রাজি করিয়ে একটি বড় জেরিক্যান কিনে সেই জেরিক্যানও অ্যামেরিকার আর্মির ডিসপোজালের, তাতে যতখানি পেট্রল আঁটে তা ভরে যে বাসই ডাল্টনগঞ্জের দিকে যাবে সে বাসের ড্রাইভার—কনডাকটারকে হাতে পায়ে ধরলাম। কিন্তু বাসে পেট্রল নেওয়া বে—আইনি বলে কেউই আমাদের বামাল নিতে রাজি হল না। এসব বাস তো হান্টারগঞ্জে যাবে না। যে বন—পথ পাহাড়ের উপরের মালভূমি হান্টারগঞ্জে চলে গেছে সেই পথ আর পিচ রাস্তার সংযোগস্থলেই আমাদের নামিয়ে দেবে তারপরে কী করা যায় না যায়, ভেবে দেখা যাবে। হান্টারগঞ্জ থেকে পথটা যেখানে সমতলে নেমেছে সেখানে পথের উপরে ইলাজান নদীর ধারে একটি বড় ধাবা ছিল। রাতে লক্ষ করিনি, সকালে করেছিলাম। ঠিক করলাম জিপে যে তিনজন সহযাত্রী ছিলেন এবং যাঁরা অর্ধমৃত অবস্থাতে পরিত্যক্ত জিপে পড়ে আছেন তাঁদের জন্যে গরম গরম কিছু খাবার নিয়ে যাব। তাড়াতাড়িতে জলের শূন্য বোতলগুলি জিপ থেকে নিয়ে আসা হয়নি, ভুতোর শেষ করে—দেওয়া রাম—এর বোতলটিও না—তাই জলের কী ব্যবস্থা হবে ভেবে পেলাম না।

অনেকক্ষণ পথে দাঁড়িয়ে থেকে দুটি সাইকেল রিকশা নিয়ে আমরা এগোলাম সেই ধাবার দিকে। এক রিকশাতে পেট্রলের জেরিক্যান অন্য রিকশাতে আমি আর গোপাল। কোনও এক অজানা জায়গাতে পথের উপরেই নানা আনাজ ও শাকসবজি নিয়ে গ্রামের মানুষরা বসেছিল। সাপ্তাহিক হাট নয়। হাট বসতে বসতে দুপুর গড়িয়ে যায় এবং ভাঙে সন্ধের পরে। সেটি একটি প্রভাতী বাজার। প্রচুর পাকা টোম্যাটো ডাঁই করে রাখা ছিল। আমরা দু’সের টোম্যাটো কিনে কাঁচা টোম্যাটো খেতে খেতে ক্যাঁচোর—কোঁচোর শব্দ করা রিকশা চড়ে এগোলাম। ততক্ষণে ভাল রোদ উঠে গেছিল কিন্তু তবুও ঠান্ডা ছিল খুবই।

বেলা প্রায় দশটা নাগাদ সেই ধাবাতে পৌঁছে ওঁদের তিনজনের জন্যে এক ডজন ডিম—এর কারি আর কুড়িটা রুটি বানিয়ে নিয়ে মাটির হাঁড়িতে ডিমের কারি আর শালপাতার প্যাকেটে রুটি প্যাক করে নিয়ে পথে দাঁড়িয়ে যখনই কোনও ট্রাক বা বাস যায়, খুব কমই যেত সেই সময়, তাদের থামিয়ে হাত জোড় করে বলি যে আমাদের একটু পৌঁছে দিতে কিন্তু কেউই রাজি হয় না। অসহায় আমাদের দেখে ধাবাওয়ালা বলল যে, যে বাস হান্টারগঞ্জ থেকে আপনাদের নিয়ে এসেছিল শেষ রাতে তার দয়া নিশ্চয়ই হবে।

গোপাল বলল, কিন্তু সেই বাস তো ভূ—প্রদক্ষিণ করে সন্ধেবেলাতে কি প্রথম রাতে এসে পৌঁছবে।

তার আর কী করা যাবে।

ধাবাওয়ালা বলল।

তারপর বলল, ভাল করে রোদ উঠলে, কাড়ুয়া তেল দেব, তেল মেখে ইলাজান—এ চান করে, প্রাতঃকৃত্য সেরে নাওয়া খাওয়া করুন। শীত লাগবে না তখন। গোপাল বলল, কী দিয়ে খাব?

ঘি আর হিং দেওয়া অড়হড়ের ডাল, ভাত, আলুর চোকা, স্যালাড আর ডিমের ঠেসে লংকা দেওয়া ঝাল—ঝোল।

স্যালাডে কী থাকবে?

খাওয়া—দাওয়ার ব্যাপারে ভীষণই খুঁতখুঁতে গোপাল বলল।

—পেঁয়াজ, মুলো, শসা, টোম্যাটো আর কাঁচালঙ্কা।

ফাসটক্লাস। গোপাল বলল।

আমি ভাবছিলাম, চান টান না হয় করা যাবে তেল মেখে বেলা বাড়লে কিন্তু ভুতো, নাজিম সাহেব আর ড্রাইভারের মুখগুলির কথা মনে করে খাব কোন লজ্জায়।

গোপাল বলল, দেয়ার ইজ নো পয়েন্ট ইন ট্রাইং টু ড্যু সামথিং হোয়েন দেয়ার ইজ নাথিং টু বি ডান।

সেই উদ্ধারকারী বাস এল সন্ধে লাগার পরে। দয়া হল ড্রাইভারের। সে তো দেখেইছে যে আমাদের সঙ্গীরা পথেই পড়ে আছে কাল রাত থেকে। তেলের জেরিক্যানসুদ্ধ সে তুলে নিল আমাদের। পাহাড়ের মাথাতে উঠে দূর থেকে দেখতে পেলাম পথের পাশে আগুন করে নাজিম সাহেব শবাসনে বসে আছেন আর ভুতো জিপের সামনের সিটে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। তখন রাত সাড়ে—সাতটা বাজে। অনেকক্ষণ অন্ধকার নেমে এসেছে, মাঘ মাসের রাত। ড্রাইভার নাজিম সাহেবের পাশে আগুনের সামনে বসে বিড়বিড় করে বিলাপ করছে নিচুগ্রামে।

বাস থেকে নেমেই আমরা বললাম, আগে খেয়ে নাও তোমরা। ডিমের কারি আর রুটি এনেছি। আমরাও তাই খেয়ে এসেছি।

নাজিম সাহেব এবং রহমান সাহেব হাঁড়ির উপরে হামলে পড়ল। এদিকে নতুন মাটির হাঁড়ি ডিমের ঝোল সব শুষে নিয়েছিল। হাঁড়ির নীচে কয়েকটি তৈলাক্ত ডিম গড়াগড়ি খাচ্ছিল। প্রচণ্ড খিদেতে তাই রুটি মুড়িয়ে মুখে দিতেই গলাতে ডিম—রুটি আটকে গেল। গোঁ—গোঁ—গোঁ করে আওয়াজ করতে লাগলেন দুজনেই আর একটা গোঙানি উঠতে লাগল টাগরা থেকে পানি, পানি, পানি করে। কিন্তু পানি কোথায় পাব আমরা?

ভুতো জিপের গ্লাভস চেম্বার খুলে এক বোতল জল বের করে আনল মন্ত্রবলে। সেই জল ঢকঢকিয়ে খেয়ে নাজিম সাহেব আর রহমান ড্রাইভারের প্রাণ বাঁচল সে যাত্রায়।

পানি কাঁহাসে মিলা রে ভুচু?

খাওয়া সেরে জল খেয়ে প্রশ্ন করলেন নাজিম সাহেব।

কাহে? নদ্দীসেহি লায়া। এক বুতলতো পী লিহিন আপ—দোনো। ওর ইক বুতল ম্যায় রাখ দিয়া থা।

ড্রাইভার আর ভুতো মিলে তেল ঢালল ট্যাঙ্কে। তার আগে পথচলতি একজন দেহাতির কাছ থেকে এক টুকরো কাপড়কাচার সাবান পয়সা দিয়ে কিনে রেখেছিলেন নাজিম সাহেব। তাই দিয়ে তেল ঢালার আগে পেট্রল ট্যাঙ্কের সম্ভাব্য অসম্ভাব্য জায়গার ফুটোফাটা আটকে দেওয়ার কাজ তাঁরা সম্পূর্ণ করে রেখেছিলেন। পেট্রল ঢালা হতেই আমরা জিপে উঠে বসলাম। পাশের জমিনে লুকিয়ে রাখা বন্দুক তিনটেকে ভুতো তুলে এনে যার যার জিম্মাতে দিল। তারপর স্টিয়ারিং—এ বসে জিপ স্টার্ট করল।

আঃ। কী আরাম, কী স্বস্তি!

গোপাল বলল বেচারা চমনলাল হয়তো এতক্ষণে কলকাতাতে ট্রাঙ্ককল করে মা—বাবাকে বলে দিয়েছে যে দাদাবাবুরা নিখোঁজ হয়ে গেছে।

জিপ হান্টারগঞ্জের পাহাড়ি শীতের ধূলিমলিন কাঁচা পথ বেয়ে নীচের পিচের পথে নামতেই আমার মনে এল ব্যাপারটা। বললাম, ভুতো তুমি কি নিখান্তি বাবা?

গোপাল বলল, ও যে সিদ্ধ বাবা তা ওই শুয়োর—মরা শীতার্ত রাতে ওর পোশাক দেখেও তুমি বুঝলে না?

পোশাক দেখে তো হতবাক হয়েই ছিলাম কিন্তু খিদে—তৃষ্ণাও যে জয় করেছে সেটা তো জানতাম না।

ভুতো বলল, আজ দুপুরে যা ভোজ খেলাম না। তা বলার নয়।

ভোজ? এই জঙ্গলে ভোজ খেলেটা কোথায়?

ভুতো পার্টি ফিলসফারের মতো বলল, মীর সাহেবের শায়রি জানেন না?

গোপাল বলল, না।

ভুতো বলল, ”মুদ্দয়ী লাখ বুঢ়া চাহেতো ক্যা হোতা হ্যায়,

 ওবহি হোতা হ্যায়, যো মঞ্জুরে খোদা হোতা হ্যায়”।

অর্থাৎ লক্ষ লোকে আমার খারাপ চাইলে কী হবে? খোদা আমার জন্যে যা মঞ্জুর করে গেছেন তাই হবে, তাই হবে।

আমি বললাম, একটু খোলসা করে বলোই না বাবা। ভুতো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আড় চোখে নাজিম সাহেবের দিকে চেয়ে বলল, সকাল হতেই নাজিম সাহেবের যে কী অবস্থা তা যদি দেখতেন। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। নাজিম সাহেব ‘খুটবা’ চাইবার মতো করে পথের দিকে চেয়ে আছেন, যদি আল্লার দোয়া জোটে। পথ দিয়ে মাঝে মাঝেই দেহাতি হিন্দু মুসলমান উপর থেকে নামছে অথবা উঠছে কাঁধে পুঁটলি নিয়ে। কারও কারও বা পুঁটলি নেই, হাতে টাঙ্গি—ক্যুপ কাটতে যাচ্ছে বাঁশ বা গাছের জঙ্গলে। নাজিম সাহেব তাদের প্রত্যেককে দাঁড় করিয়ে বলছে এরে এ বাবুয়া, তেরা ঝোলিমে ক্যা হ্যায় রে? খানেকা কুছ হ্যায়?

নেই খে।

বলে, তারা চলে যাচ্ছে।

একজনের পুঁটলি জোর করে খুলিয়ে দেখা গেল তার মধ্যে এক জোড়া ধূলিধূসরিত ফেটে—যাওয়া মোষের চামড়ার নাগরা জুতো। মেরামত করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে নীচে।

ইতিমধ্যে দেখা গেল মাদল ধামসা এবং বেসুরো সানাই বাজাতে বাজাতে রংচঙে পোশাক পরে একদল মেয়ে মদ্দ পাহাড়তলির ইলাজান নদীর বুক বেয়ে চলেছে উত্তরমুখো। কারও বিয়ে আছে সম্ভবত।

ভুতো নাজিম সাহেবকে বলল, ম্যায় দাওয়াত খা কর আতা হ্যায়। বহত ভুখ লাগা নাজিম মিঞা। আপভি চলিয়ে না। রহমানকে লিয়ে খানা লেতে আয়গা যব লওটেঙ্গে।

নাজিম সাহেব সাবধান করে দিয়ে বলল, মত যা ভুচু। নদ্দীমে ভাল নোচ লেগা।

অর্থাৎ যাস না ভুচু, নদীতে ভাল্লুকে খাবলে নেবে।

ওই ইলাজান আর জাঁম ফল্গু নদীর শাখা নদী। গয়ার ফল্গু অন্তঃসলিলা, বছরের অধিকাংশ সময়েই কিন্তু ইলাজান আর জাঁম অন্তঃসলিলা নয়, জল থাকে বছরের অধিকাংশ সময়েই। এই জাঁম নদী পেরিয়ে এক প্রচণ্ড শীতের রাতে শুক্লপক্ষের চতুর্থী কি পঞ্চমীতে মধ্যরাতে গোরুর গাড়ি চড়ে একবার আমি গোপাল আর নাজিম সাহেব জৌরী থেকে সিজুয়াহারার পাহাড়ে রঘুশাহর ভাণ্ডার থেকে যখন ফিরে আসছিলাম, পেছন পেছন কাড়ুয়া তার মুঙ্গেরি একনলা গাদা বন্দুক পিঠের উপরে শুইয়ে খালি পায়ে গান গাইতে গাইতে আসছিল তখন নাজিম সাহেব বলেছিলেন জাঁম কি মতলব জানতে হেঁ।

আমি কী—ই বা জানতাম। মাথা নাড়লাম।

নাজিম সাহেব বললেন, জাঁম মানে, পানপাত্র। তারপরই শায়রি আওড়ালেন,

”অ্যাইসা ডুবাহু তেরি আঁখোকি গেহরাইমে

হাত মে জাঁম হ্যায়, মগর পীনেকি হোঁস নেহি।’

মানে, তোমার চোখের গভীরে এমনই ডুবে আছি যে হাতে আমার, পান—পাত্র ধরা কিন্তু চুমুক দিতেই ভুলে গেছি।

কাড়ুয়ার গানটাও মনে আছে আজ পঞ্চান্ন বছর পরেও

”তু কেহরো কচমচ ছাতি

তুহুর সুরত দেখি মোরা

বসল নজরিয়া হো, বসল নজারিয়া

হো তন বৈবসানা দিনা দেখব নজারিয়া

হো দেখব নজারিয়া।”

যাই হোক নাজিম সাহেবের বারণ না শুনে ভুতো তো তড়তড়িয়ে পাহাড় বেয়ে ইলাজানের বুকে নেমে গেল।

নাজিম সাহেব বললেন, কোঈ হাজামৎকি শাদী হোগা—

হাজামৎ কওন চিজ?

হাজামৎ নেহি জানতা? মহাবীর যেইসী। তুমলোগো কি নাপিত। তারপর বললেন খানা তো নেহি মিলেগী মগর পিটাই মিলেগী। ঔর ইস বিচসে উনলোগ পিট্রোল লেকর আ পঁহুছা তো হামলোগ চল দেগা, তুমহারে লিয়ে রোকেংগা নেহি। সমঝা না?

ভুতো বলল, হাঁ হাঁ সমঝা। পহিলে তো জান বাঁচায়গা তব হি না হাজারিবাগকি বারেমে শোচেগা।

আমি বললাম, তারপর?

ভুতো উত্তেজিত হয়ে বলল, কী যে আদর—আপ্যায়ন করল তারা কী বলব। বরযাত্রীর দলে ভিড়ে গেলাম। আধমাইল দূরেই মেয়েদের বাড়ি। জব্বর খাওয়া হল। এখনও চোঁয়া ঢেকুর উঠছে। নাজিম সাহেব আর রহমানের জন্যে কটা লাড্ডুও নিয়ে এসেছিলাম আর বোতলে করে নদীর জল।

তারপর বলল, নাজিম মিঞার যত্ত ভয়, ভাল্লুক খাবলে নেবে, বাঘে কামড়ে দেবে। সাহস না থাকলে কিছুই হয় না। তাইতো বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *