ভুতুড়ে সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরের বেশ কিছু ভৌতিক ঘটনা সত্য হরর কাহিনী সিরিজের আগের বইগুলোতে ছাপা বইগুলোতে ছাপা হয়েছে। ধারাবাহিকতায় ওখানকার বাছাই করা কয়েকটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি এই বইটিতেও।
ওমরের গল্প
এবারের কাহিনীটি বলেন একজন বিমান স্টুয়ার্ড। তাঁর নাম কামাল বিন মুস্তফা। আমরা বরং এটা তাঁর জবানীতেই শুনি।
এর নায়ক বা খলনায়ক যা-ই বলি না কেন আমার ভাই ওমর। আমাদের ছোটবেলার কথা। নিউটন সার্কাস এলাকায় বেড়ে উঠেছি। বাড়ির উল্টোপাশে মনক’স স্কুলের ফুটবল মাঠ। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে প্রতিদিন বিকালে সেখানে হাজির হতাম আমরা।
একদিন সন্ধ্যার আগে, ওমর বলটা লাথি মেরে পাঠায় মাঠের কিনারে একটা কুৎসিত দর্শন, অশুভ গাছের দিকে। ওটা আনতে গিয়ে দেখলাম, গাছে বাস করা অশুভ আত্মাদের শান্ত রাখতে যেসব লাল চীনা ফলক ব্যবহার করা হয় এর একটাকে উপড়ে ফেলেছে বলটা।
ওমরকে অবশ্য এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না। বেশ সাহসী ছেলে সে। কিন্তু আমরা বাকি ছেলেরা বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ওই ফলকটা ভেঙে লাল টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গাছের নিচে।
ওখানে যখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি তখনই হঠাৎ ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। গাছটার ডালপালাগুলো সে হাওয়ায় অদ্ভুত শব্দ তৈরি করল। আকাশ ঢেকে গেছে ঘন কালো মেঘে। যেন বৃষ্টি নামবে। আমরা তাড়াহুড়ো করে যার যার বাড়ির দিকে দৌড়লাম।
রাতে আমাদের সবার ঘুম ভেঙে গেল ওমরের চিৎকারে। ওর পাজোড়া ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল অনেক কষ্ট হচ্ছে তার।
চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো সকালে। কিন্তু কেন এমনটা হয়েছে বলতে পারলেন না তিনি। উপায়ান্তর না দেখে ইপোহর একজন বোমা বা ওঝার শরণাপন্ন হলাম আমরা।
সাদা চুলের বুড়ো এক মানুষ তিনি। বেশিরভাগ আঙুলে নানা ধরনের পাথর শোভা পাচ্ছে তাঁর। সব কিছু খুলে বলার পর অদ্ভুত গন্ধের একটা মলম লাগানো কলা পাতা দিয়ে ওমরের পাদুটো মুড়ে দিলেন। তারপর দুর্বোধ্য কোন ভাষায় মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে ধূপ পোড়াতে লাগলেন।
আমাদের নিয়ে যে গাছটার নিচে ওই লাল ফলক ছিল সেখানে চলে এলেন ওঝা। বেশ কিছু ফল রেখে দিলেন জায়গাটিতে। এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই ওঝার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম আমরা। ওমরের কান্না থেমে গেছে। বলল ওর পা আর যন্ত্রণা করছে না।
কয়েকদিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল ওমর। আবার প্রতিবেশী বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু করলাম আমরা। তবে তখন খেলার সময় খেয়াল রাখতাম অশুভ ওই গাছটার কাছ থেকে যেন বল দূরে থাকে।
পুরানো স্কুল
এবারের অভিজ্ঞতাটি বেলিন্দা ওয়ং নামের এক মডেলের।
মাউন্ট ফেবার ধরে আমার প্রেমিকের সঙ্গে গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তার সঙ্গে একটা বিষয়ে তুমুল তর্ক শুরু হয়। মেজাজটা এতটাই খিঁচড়ে যায় যে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে বললাম। তখন বেশ রাত। রাস্তাও ফাঁকা কিন্তু সে এতটাই অমানুষ যে আমাকে নেমে যেতে দিল
কিছুক্ষণ হাঁটতেই শীতল বাতাসে গরম মাথাটা আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হলো। বুঝতে পারলাম এখানে এই রাতে নেমে পড়ে বোকামি করেছি। আকাশ চিরে ফালা ফালা করে দিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে। কেমপং সিলাট ধরে হাঁটছি এমন সময় বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল সত্যি সত্যি। আশপাশে কোন গাড়ি-ঘোড়া নেই। অতএব পুরানো এক স্কুলভবনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম।
পুরানো রাডিন মাস স্কুল ওটা। বহু বছর ধরেই এখানে লোকজনের ততটা আনাগোনা নেই। বিশেষ করে স্কুলভবনটা পরিত্যক্ত হবার পর থেকে। তাই এখানে কোন বাতি বা প্রহরী নেই। স্কুলের চারপাশের ছিন্ন বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারলাম।
গোটা দালানটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে ঝড়ের জন্য এটা মোটামুটি ভাল আশ্রয়। তাছাড়া আমি বেশ সাহসী, মেয়ে। অন্ধকার করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলাম। ভাঙা জানালা গলে যখনই ঝড়ো বাতাস ভেতরে ঢুকছে প্রতিটি আনাচে-কানাচে নানা ধরনের ছায়া খেলা করছে। অব্যবহৃত ক্লাসরুমগুলোর দিকে তাকালাম। ওগুলোর অবস্থা দেখে করুণা হলো। সব টেবিল আর টুল উল্টানো, ভাঙা। দেয়ালে আশ্চর্য সব চিত্র আঁকা। বাস্তব দুনিয়ার কিছুর সঙ্গে এই চিত্রগুলোর মিল আছে কমই। অন্ধকারে আমার পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনে বুঝতে পারলাম একাই আছি এখানে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। এসময়ই ফিক ফিক হাসির শব্দ শুনলাম। ওপরের সিঁড়িগুলোতে ছোট ছেলে-মেয়েদের দৌড়াদৌড়ির আওয়াজও পেলাম। প্রথমে বেশ স্বস্তি পেলাম। মনে হলো, যাক, কিছু বাচ্চাও মনে হয় কীভাবে যেন এই বৃষ্টিতে এখানেই আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সিঁড়ি ধরে যেখান থেকে আওয়াজটা আসছে মনে হচ্ছে, সেদিকে এগুতেই আমার মাথায় এল এই আবহাওয়ায় কয়েকটা শিশু কোনভাবেই ঘরের বাইরে আসার কথা নয়।
শব্দ এখন আরও চড়েছে। তবে কেমন বিকৃত শোনাচ্ছে। হাসির শব্দটা একটা অশুভ আওয়াজে পরিণত হয়েছে। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে নিচের দিকের সিঁড়ি থেকে। আমার খোঁজে আসছে ওরা!
প্রথমবারের মত ভয় পেলাম। ওটা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল কয়েক সেকেণ্ডে। দৌড়লাম। বেড়ার তারে লেগে জামা ছিঁড়ল, একটা হিলের জুতোও হারালাম। তবে কেয়ার করলাম না। বৃষ্টির মধ্যে ছিন্ন কাপড় এবং এক পায়ে জুতো পায়ে ছুটতে লাগলাম।
সৌভাগ্যক্রমে টহল পুলিসের একটা গাড়ি আমাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিল। শুরুতে ওরা ভাবল, কেউ আমাকে তাড়া করেছে। তবে যখন কী ঘটেছে খুলে বললাম, দয়ালু মালয়ী পুলিস কর্পোরালটি সমঝদারের মত মাথা নাড়লেন। অবাক হননি, জানালেন। প্রাচীন এই স্কুলটা যে ভুতুড়ে এটা নাকি এখানকার অনেকেরই জানা। এ কারণে আশপাশের লোকেরা এই জায়গাটি এড়িয়ে চলে। দালানটা এত বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে কেন, বুঝতে পারলাম এবার।
শেষ বাস
এবারের অভিজ্ঞতাটি শেইলা কো নামের এক স্কুল ছাত্রীর।
এক ছুটির দিনে মেরিন প্যারেডের আয়োজিত এক বারবিকিউ পার্টিতে গিয়েছিলাম স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে। আমি ছাড়া সবাই রাতে সেখানেই থেকে গেল। আমার বাবা- মা খুব কড়া ধাঁচের। যেখানে ছেলেরাও আছে সেখানে কোনভাবেই রাত কাটাতে দেবেন না আমাকে।
রাত মোটামুটি পৌনে বারোটার দিকে মন খারাপ করে বাস ডিপোতে দাঁড়িয়ে শেষ বাসের অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্ধকার, জনহীন ডিপোতে একাকী দাঁড়িয়ে আছি। তারপর ঠিক মধ্যরাতে শেষ বাসটি এল। তবে এটাকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে।
পুরানো একটা এসবিএস বাস। এত পুরানো এসবিএস বাস আগে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। শুধু পুরানো যে তা নয়, ময়লাও। দাঁড়িয়ে পড়ল ওটা। আমাকে ভেতরে ঢুকতে বলল গাড়ির চালক। গাড়ির ধোঁয়াটে জানালা দিয়ে দেখলাম ড্রাইভার প্রায় কঙ্কালের মতই শীর্ণকায়। চোখদুটো কোটরে ঢুকে আছে। ভেতরে কোন বাতি নেই গাড়িটার, তাই ঢোকার সাহস পেলাম না।
তখনই কণ্ডাক্টর হাজির হলো। বলল, ‘বোন, তাড়াতাড়ি ওঠো, সময় নেই আর।’
চালকের চেয়ে তার অবস্থা আরও খারাপ। কেবল যে শরীরে রক্ত-মাংসের বালাই নেই তা নয়, চামড়াটাও কেমন ফ্যাকাসে। মাথার জায়গায় জায়গায় চুল নেই। যখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আঁতকে উঠলাম। দাঁতগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, কালো। বিহ্বলের মত মাথা নাড়লাম। চালককে গাড়ি ছাড়ার ইশারা করল সে। গাড়িটা চলে গেল।
তখনই আমার মনে পড়ল, এসবিএস বাসে কোন কণ্ডাক্টর থাকে না এখন আর। বড় ধরনের কোন ঝামেলা আছে ওই বাসটায়।
তারপরই নতুন, চকচকে একটা বাস এসে দাঁড়াল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রান্স আইল্যাণ্ড বাস আমি ঠিক যে স্টেশনে যেতে চাই সেখানেই যাবে। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বাসে উঠে কণ্ডাক্টরের কাছে জানতে চাইলাম আগের বাসটার বিষয়ে।
‘কোন্ শেষ বাস? এটাই তো শেষ বাস।’ অবাক হয়ে বলল সে।
ওই অশুভ বাসটায় সে রাতে উঠলে কী হত ভেবে আজও কেঁপে ওঠে আমার শরীর।
গায়ে কীসের দাগ?
ভিনসেন্ট ননিস নামের এক বুড়োর কাহিনী এটা। এ ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাও বছর বিশেক হয়ে গেল।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে সিঙ্গাপুর টার্ফ ক্লাবে কাজ করতাম। সিঙ্গাপুরের তখন একটা সময়ই গিয়েছে। যুদ্ধের পর পর। যুদ্ধের ফলাফল হিসাবে অনেক সিঙ্গাপুরী আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছে। আমি প্রায়ই ভাবতাম যুদ্ধের কারণে কীভাবে কিছু লোক বড়লোক হয়ে যায়! আমার কাছে একেবারে অসম্ভব মনে হত। তবে ওই লোকদের ধারণা অবশ্যই ভিন্ন ছিল।
যারা লাভবান হয় তাদের মধ্যে আমার পরিচিতদের একজন ছিল ওয়ং কিম সেং। সে পরিণত হয় সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার ধনী লোকদের একজনে।
টার্ফ ক্লাবে বিশাল এক আস্তাবল ছিল কিমের। সেখানে দামি সব রেসের ঘোড়া থাকত। খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিল সে। বিন্দুমাত্র মায়া-দয়ার বালাই ছিল না মনে। কোন ঘোড়ার রেসে দৌড়নোর মেয়াদ ফুরিয়ে এলে কুকুরের খাবার বানানোর জন্য বেচে দিত, অন্য মালিকেরা যেখানে এমন পরিত্যক্ত ঘোড়াগুলোকে চারণভূমিতে ছেড়ে দিত। তাই তাকে ঘৃণা করতাম রীতিমত। যে কারণে তার এত ধন- সম্পত্তি সেই ঘোড়াগুলোর সঙ্গে কীভাবে এটা করে!
যা হোক, ওয়ং কিম সেং তখন রীতিমত উড়ছে। রুপোলী একটা রোলস রয়েসে চেপে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে ক্লাবে আসতে দেখি তাকে। এক কথায় রাজার মতই তার চালচলন।
তবে পঞ্চাশের দশকের শেষ এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ভাগ্যদেবী মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগল তার দিক থেকে। একের পর এক ব্যবসায় মার খেতে লাগল।
ওই সময়ই তার চেহারায় হতাশ, হতবিহ্বল একটা ভাব লক্ষ করি প্রথমবারের মত। তাকে ঘিরে থাকা বিশাল চাটুকারের দল কমতে কমতে এসে ঠেকেছে কয়েকজনে। এরা তার পোষা দুর্বৃত্ত।
এদিকে আরেকটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। দ্রুতই দেনা পরিশোধ করতে না পারলে তার বেশিরভাগ সহায়- সম্পত্তি নিলামে তুলে দেবে ব্যাঙ্ক। বলা চলে পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে সে।
তারপরই আমার চোখের সামনে ঘটল ভয়াবহ সেই ঘটনাটি। সারাদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর সেদিন রাতে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ক্লাব থেকে। এসময়ই দেখলাম কিমের রোলস রয়েস ঢুকছে ভেতরে। এত রাতে গাড়িটাকে দেখে আশঙ্কায় কেঁপে উঠল আমার শরীর। কিম দু’জন সঙ্গীসহ নামল গাড়ি থেকে। চুপিসারে এগিয়ে গেল তারা আস্তাবলের দিকে। পরমুহূর্তেই ঘোড়াগুলোর আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পেলাম। কী হয়েছে দেখতে ঘুরলাম। হায়, খোদা! আগুন লেগেছে আস্তাবলে। দৌড়ে একটা অগ্নি-নির্বাপক তুলে নিলাম। কিন্তু ওটাসহ আস্তাবলের দিকে দৌড়াতেই কিমের লোকেরা পথ আটকে দাঁড়াল।
‘ওখান থেকে দূরে থাকো, বুদ্ধ!’ সতর্ক করে দিল কিম সেং। তাকে পাত্তা না দিয়ে দশাসই গুণ্ডাদুটোকে পাশ কাটিয়ে আগুনের শিখা লক্ষ্য করে অগ্নিনির্বাপকের মুখ তাক করলাম। এসময়ই ঘাড়ে প্রচণ্ড একটা রদ্দা অনুভব করলাম। মাটিতে আছড়ে পড়লাম। কিমের পোষা গুণ্ডাদের একজন পা তুলে দিল আমার ওপর।
‘তোমাকে আমি এসব থেকে দূরে থাকতে বলেছি।’ গর্জে উঠল কিম।
জ্বলতে থাকা আস্তাবলের ধোঁয়ায় নাকি ঘোড়াগুলোর জন্য আমার চোখে পানি চলে এসেছিল, বলতে পারব না। হতভাগা ঘোড়াগুলোর চিৎকার শুনতে পেলাম, আগুনের লেলিহান শিখা ঘিরে ফেলেছে তাদের। তার আস্তাবলটা জ্বলে-পুড়ে একেবারে ছারখার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল বদমাশ লোকটা। তারপর উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করল, এখন জানে বীমার টাকায় অনেকটাই আর্থিক সমস্যা সামলে উঠতে পারবে।
ওই সময়ের সিঙ্গাপুরে আইনের তেমন একটা বালাই ছিল না। প্রতিটি জায়গা ছিল দুর্নীতির আখড়া। তাই ঘটনাটা সামাল দিতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না কিমকে।
তারপরই অদ্ভুতভাবে যবনিকাপাত হলো কিম অধ্যায়ের। কেউ বলতে পারে না ঠিক কেমন করে ঘটনাটা ঘটল। তবে লোকের মুখে মুখে গল্পটা ছড়িয়ে পড়ল। ওয়ং কিম সেংকে তার বিশাল ভিলার মাঠে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোন একটা জন্তুর পাল তার ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, তার শরীর বা পোশাকের যে টুকরোগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয় তাতে পাওয়া যায় আগুনে পোড়া খুরের ছাপ।
রেলস্টেশনের মেয়েটি
এবারের অভিজ্ঞতাটি জেনিসি লিম নামের এক তরুণীর।
নভেনা মেট্রো রেলস্টেশনে আসা-যাওয়া করা ট্রেনগুলোতে চড়ে সন্ন্যাসিনীর পোশাক গায়ে চাপানো রহস্যময় এক নারীকে চলাফেরা করতে দেখেছেন কেউ কেউ। তবে মেট্রোরেলে দিনে-রাতে নিয়মিত চলাফেরা করলেও তাকে কখনও দেখিনি। হয়তো একদিন ওই অশরীরীর দেখা পেয়েও যেতে পারি।
তবে রহস্যময় একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে এক সকালে তোয়া পেয়োহ স্টেশনে এক ট্রেনে দেখেছি। সে কাহিনীটাই বলব।
সিটি হলে যাচ্ছিলাম। আমার সামনে বসেছিল মেয়েটা। তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি আমার। আর পাঁচ-দশটা স্কুল ছাত্রীর মতই মনে হচ্ছিল। তবে চুল অনেক লম্বা, কোমর পর্যন্ত। সাদা একটা ইউনিফর্ম পরনে ছিল তার। তবে খুব ভালভাবে লক্ষ্য করতে পারিনি, কারণ মাথা নিচু করে একটা বই পড়ছিল। লম্বা চুলগুলো মুখের বেশিরভাগটাই ঢেকে রেখেছে।
যখন সিটি হলে পৌঁছল ট্রেন, আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটাকেও উঠতে দেখলাম। তখনই চেহারাটা দেখলাম। মুখের চামড়া তামাটে। তবে অবাক হলাম চোখজোড়া দেখে। ওগুলো প্রায় বর্ণহীন।
তারপরই বিস্ময়কর কাণ্ডটা হলো। এস্কিলেটরে যখন উঠলাম তখন সে ছিল আমার সামনে। কিন্তু যখন ওপরে উঠলাম মেয়েটা সেখানে নেই। চারপাশে তাকালাম তার খোঁজে। কাঁধের পাশ দিয়ে তাকাতেই শিউরে উঠলাম, আমার ঠিক পেছনে মেয়েটা। হাসছে। এটা অসম্ভব। পুরোপুরি ঘুরে আমার পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া কীভাবে এটা করল সে?
যখন টিকেট চেকারের সামনে পৌছলাম ততক্ষণে সে হাওয়া। একটু পরে আবার দেখলাম তাকে, আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে নর্থ ব্রিজ রোডের দিকে যাচ্ছে। অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তার ওপর চোখ রেখে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। কেবল মেয়েটার থেকে দুই মিটার দূরে, এসময় বাতাসে মিলিয়ে গেল। কীভাবে সে এটা পারল?
এক হপ্তা পরের ঘটনা। আমার মা আর খালার সঙ্গে তোয়া পেয়োহ মেট্রো রেলস্টেশনে এসেছি। তখনই আবার মেয়েটাকে দেখলাম। আরও কিছু যাত্রীর সঙ্গে একটা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। কী ঘটেছে আগেই মাকে বলেছিলাম। এবার ইশারায় দেখালাম। মা ও খালা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে ঠিক করল। মেয়েটার দিকে আস্তে-ধীরে হাঁটতে লাগল তারা।
কিন্তু যখনই মেয়েটার কাছাকাছি হলো, তাদের দিকে রংহীন চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর আগের মতই বাতাসে উবে গেল।
সু নামের ছেলেটি
লি থাই হোং নামের এক যুবকের গল্প।
একসময় আর্মিতে চাকরি করতাম। এক শনিবার বিকালে আমার পুরানো অফিসার লেফটেনেন্ট লও কুইয়ি ইয়ং, আমি এখন যে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে কাজ করি সেখানে এলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে। আমরা গল্প করছিলাম, এদিকে তাঁর স্ত্রী আর ছেলে বিভিন্ন রাইডে চড়ছিল। স্ত্রী আর ছেলেটার সঙ্গে তখন আমার পরিচয় করিয়ে দেন। ভদ্রমহিলার নামটা ভুলে গেছি। তবে ছেলেটার নাম মনে আছে স্পষ্ট। সু নামের একটা ছেলের নাম কী করে ভুলি?
‘কী অদ্ভুত!’ বলে ফেললাম, ‘এটা তো মেয়ের নাম!’ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুইয়ি ইয়ং ব্যাখ্যা করলেন। অন্য এক নারীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাঁর। কিন্তু ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। শুরুতে খুব ভেঙে পড়লেও বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। সাবেক প্রেমিকার কথাও ভুলে যান। বিয়ের কথাও পাকা হয়।
ঠিক ওই সময় হঠাৎ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন কুইয়ি ইয়ং। বেশ কয়েকজন চিকিৎসক দেখিয়েও লাভ হলো না। একপর্যায়ে এক ওঝার শরণাপন্ন হলো পরিবারটি।
তিনিই জানালেন পুরানো প্রেমিকার প্রেতাত্মা সওয়ার . হয়েছে তাঁর ওপর। অন্য একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার প্রেমিক এটাই তাকে অশান্ত করে তুলেছে। এর একমাত্র সমাধান ভূত বিয়ে।
অসুস্থ কুইয়ি খুব একটা বাধা দিতে পারেননি। তাঁর কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারের সদস্যরা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। একটা প্রথাগত ছোটখাট চীনা বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে মেয়েটার প্রতিনিধিত্ব করে তার পরিবারের কালপঞ্জি লেখা একটা ফলক।
আশ্চর্য ব্যাপার! বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষের অল্প সময়ের মধ্যে কুইয়ি ইয়ং সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না এই বর্ণনায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই সামান্য ব্যাপারটা কি ওই প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মাটাকে ঠাণ্ডা করে দিল, যেখানে পরে তোমার পছন্দের পাত্রীকে ঠিকই বিয়ে করে সংসার করতে লাগলে?’
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়ং বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। ব্যাপারটা এতটা সহজ নয়। আমাকে ওঝার কথামত প্রতিজ্ঞা করতে হয় প্রথম বাচ্চাটার নাম আমার প্রাক্তন প্রেমিকার নামে রাখব। তাই ওর নাম সু।’
ওই সময়ই সু নামের ছেলেটা আমার কাছে এসে বলল, ‘হ্যালো, আঙ্কেল!’
যেভাবে সে কথা বলল, হাঁটল, চোখের পলক ফেলল, বুক কেঁপে উঠল আমার। সব কিছু অবিকল একটা মেয়ের মত। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম, আমার আশঙ্কা যেন সত্যি না হয়।
শিস বাজায় কে?
স্টিভেন গোহ নামের এক তরুণের কাছ থেকে এবারের কাহিনীটি সংগ্রহ করা।
আমাকে গুরুজনরা বলেছিল, অন্ধকারে গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শিস বাজানো উচিত নয়। কারণ এটা মৃতদের আকর্ষণ করে। তবে এসব গালগপ্পে মোটেই বিশ্বাস নেই আমার। উল্টো ঠিক করলাম মওকা বুঝে একদিন এটা পরীক্ষা করে দেখব।
জালান বাহার গোরস্থানের কাছেই আমার বাসা। এক নিরানন্দ শনিবার। হাতে কোন কাজ নেই। হঠাৎ দুষ্টবুদ্ধিটা মাথায় চাপল। মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর বাইসাইকেল চালিয়ে রওয়ানা হলাম গোরস্থানের দিকে। কাছাকাছি এসে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। এবার সারি সারি সমাধির মাঝখান দিয়ে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এগুলাম। রাস্তাটা প্রচণ্ড অন্ধকার। তবে একটুও ভয় করছে না আমার।
একসময় শিস বাজাতে শুরু করলাম।
চারপাশ একেবারে সুনসান। আমার পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসছিল না। এখন যোগ হয়েছে আমার শিসের আওয়াজ। তারপরই ওটা শুনলাম। আমার পেছন থেকে চাপা একটা শ্বাস নেয়ার শব্দ। ওটা কিছু না ধরে নিয়ে, শিস দিতে শুরু করলাম আবারও।
তারপরই গা-টা শিরশির করে উঠল, আমার পেছনে মৃদু একটা শিসের শব্দ। বেশ অদ্ভুত, তবে সুখ ছড়ানো একটা সুর। কেমন ভেজা ভেজা। এবার ভয় পেলাম। শিস বাজানো বন্ধ করে দিলাম। তবে এখন আরও কাছাকাছি চলে এসেছে শিসের শব্দ। আর একজন-দু’জন নয় গোটা একটা দল যেন যোগ দিয়েছে এতে। চারপাশের সমাধিগুলো থেকেও আসছে একই সুরে শিসের আওয়াজ। তখনই সাইকেলে চেপে এক টানে বেরিয়ে এলাম গোরস্থান থেকে। ভূতবিষয়ক প্রাচীন লোককিচ্ছাগুলো এরপর থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করি।