তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৪ – ভুতুড়ে বিমান – কাহিনি রচনা : কাজী শাহনূর হোসে – তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর : শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০
১
আরিব্বাবা, কিশোর, কী আসছে দেখ! রাশেদ চাচা চেঁচিয়ে উঠল। আমাদের সরাসরি সামনে, বিশালদেহী এক জেট প্লেন রকি বীচে এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করার জন্য আসছে।
গাড়ির পিছনের দিকে বসে আমি। চাচা গাড়ি চালাচ্ছে, মেরি চাচী পাশে বসা। জেটটাকে নেমে এসে কাছের এক রানওয়েতে ল্যাণ্ড করতে দেখলাম।
মার্ক এরকম জেটে করেই আসবে, বলে আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল চাচী।
মার্ক আমাদের পরিচিত কেউ না। আমার বয়সী এক ছেলে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে আসছে। প্রতি বছর রকি বীচ থেকে একজন ছাত্র বিদেশে যায় আর বিদেশ থেকে একজন ছাত্র এখানে আসে; সারা। বছর কোন একটি পরিবারের সঙ্গে থাকে, স্কুলে ভর্তি হয়। এবার স্বেচ্ছায় এ ধরনের ছাত্রের মেজবান হতে চেয়েছে আমাদের পরিবার।
মার্ক ট্রেনে করে এলে ভাল হত, বাইরের কালিগোলা আঁধারের দিকে চেয়ে মন্তব্য করলাম।
কিশোর, এয়ারপোর্টে তোর কী অসুবিধা? হেসে বলল চাচা।
সব এয়ারপোর্টে তো না, বললাম। শুধু রকি বীচ এয়ারপোর্ট।
আসলে ওই আজগুবী গল্পটা শুনে শুনে তোর মাথাটা বিগড়েছে, বলল চাচা।
আমি আসলে মাথা থেকে হারানো বিমানটার কথা তাড়াতে পারছি না।
গল্পটা আরেকবার বলো না শুনি, বলল চাচা। এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে পড়েছে গাড়ি।
এখন কোন ভূতের গল্প নয়, শাসনের সুরে বলল চাচী। আমরা নতুন ছেলেটাকে নিতে এসেছি। আমি চাই সবাই স্বাভাবিক থাকুক।
চাচী যা-ই বলুক, আমি মাথা থেকে দূর করতে পারলাম না ভুতুড়ে গল্পটা। বহু বছর আগের কথা। রকি বীচে এয়ারপোর্ট বানানোর সিদ্ধান্ত হয়। এক বছর লেগে যায় কাজ শেষ করতে। অবশেষে জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেখান থেকেই গোলমালের শুরু।
এখানে তখন ক্যাপ্টেন স্টার নামে এক লোক থাকতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউএস আর্মি পাইলট ছিলেন ভদ্রলোক। তিনি ঘোষণা দেন, রকি বীচ এয়ারপোর্টে তিনিই প্রথম বিমান ল্যাণ্ড করাবেন।
কর্তৃপক্ষ তাকে বারণ করে। কেননা ক্যাপ্টেন স্টারের বয়স হয়েছে, কাজটা বিপজ্জনক এবং তাঁর বৈধ কাগজপত্রও নেই।
প্রথম যেদিন এয়ারপোর্ট চালু হয় সেদিন আবহাওয়া ছিল ভারী আর কুয়াশাচ্ছন্ন। এয়ারপোর্টের প্রতিটা ফ্লাইটই বিলম্বিত হয়।
হঠাই টাওয়ারের ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা একটা শব্দ শোনেন। আর তাঁদের রাডারে ধরা পড়ে একটা ব্লিপ। ল্যাণ্ডিঙের জন্য একটা প্লেন আসছে!
মুহূর্তের জন্য মেঘমুক্ত হয় আকাশ। ক্যাপ্টেন স্টার তার প্রথম। বিশ্বযুদ্ধের পুরানো বিমান নিয়ে উড়ে আসছেন।
ঠিক এ সময় আরেক গুচ্ছ কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘের মধ্যে ঢুকে যায় বিমান। ক্যাপ্টেন স্টারকে এরপর আর কেউ দেখেনি। রাডার থেকে উধাও হয়ে যায় তাঁর বিমান। তাঁকে কিংবা বিমানটাকে আর কেউ কোনদিন দেখতে পায়নি।
আবহাওয়া পরিষ্কার হলে গোটা এলাকা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। বিমান দুর্ঘটনার কোন চিহ্ন নেই। স্রেফ কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে যেন ওটা।
তার পর থেকে গুজব রটে গেছে, ভুতুড়ে বিমান নিয়ে এখনও উড়ে বেড়াচ্ছেন ক্যাপ্টেন স্টার। এখনও ল্যাণ্ড করার এবং তাঁর কথা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অ্যাটেনশন প্লিজ! ফ্লাইট নম্বর ৩৪৫। দুমিনিটের মধ্যে ল্যাণ্ড করবে, ঘোষণা শোনা গেল পিএ সিস্টেম থেকে। সচকিত হয়ে উঠলাম আমি। মার্ক এই ফ্লাইটেই আসছে।
আমরা এখন লাউঞ্জ-টার্মিনাল এরিয়াতে দাঁড়িয়ে। চাচা-চাচী ফ্লাইট কাউন্টারে গেছে শিডিউল বোর্ড দেখতে।
হঠাৎই আকাশে বাতি জ্বলতে দেখলাম, এয়ারপোর্টের উদ্দেশে আসছে। নিশ্চয়ই মার্কের বিমানে! ·
লাউঞ্জের শেষ প্রান্তে সরে গেলাম, বিমানটাকে যাতে ভাল মত রানওয়েতে নামতে দেখতে পারি। আমিই শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছি ওখানে। আর সবাই টার্মিনালের মাঝখানে।
অন্ধকার আকাশে মেঘ নেই দেখে স্বস্তি পেলাম। মার্কের বিমান মেঘের কিংবা কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।
এসময় সহসা বিশাল এক কুয়াশা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল, ঠিক আগুয়ান বিমানটার পথের উপরে। বিমানটা উড়ে এসে ঢুকে পড়ল কুয়াশার মধ্যে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল!
২
ঘুরেই এক দৌড়ে টার্মিনালের মাঝখানে চলে গেলাম। চাচা-চাচীকে খুঁজছি।
চাচা! চাচী! চেঁচালাম। প্যাসেঞ্জার এন্ট্রি ডোরের পাশে দ তারা।
কীরে, কী হয়েছে? চাচা জানতে চাইল।
প্লেন! মার্কের প্লেনটা উধাও হয়ে গেছে! কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেছে!
পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল চাচা-চাচী।
তোর কল্পনার ঘোড়াকে লাগাম পরা, বলল চাচী। কাছের এক জানালার দিকে আঙুল তাক করল। দেখ। হেসে বলল।
জানালা দিয়ে চাইলাম। ওই তো, বিশালদেহী জেট প্লেনটা। ল্যাণ্ড করেছে, এখন ট্যাক্সিইং করে কাছের এক গেটের সামনে থেমে দাঁড়াচ্ছে।
কিন্তু আমি কুয়াশা দেখেছি! বললাম। ভাগ্য ভাল ক্র্যাশ করেনি! জানালার সামনে এসে দাঁড়াল চাচা। চেয়ে রইল আকাশের দিকে।
কোথায়? কোন মেঘ বা কুয়াশা তো দেখতে পাচ্ছি না। পরিষ্কার, চাঁদ-তারার রাত।
প্যাসেঞ্জাররা নেমে আসছে বিমান থেকে। টার্মিনাল সরগরম হয়ে উঠছে। আমাদের কুয়াশা সংক্রান্ত আলোচনার ওখানেই ইতি। চাচা-চাচী একটা সাইন তুলে ধরল। ওতে লেখা: স্বাগতম, মার্ক! পাশা পরিবার। থেকে।
চাচা-চাচী মার্ককে খুঁজছে, এসময় ওদের বিমানের পাইলটকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। দৌড়ে গেলাম তার কাছে।
প্লেনটা ল্যাণ্ড করার সময় লক্ষ করছিলাম আমি। শেষ দিকে কুয়াশা দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আপনি? প্রশ্ন করলাম।
হাসি মুছে গেল ক্যাপ্টেনের। আমার দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মাথা নাড়লেন।
গোটা ট্রিপের কোথাও কোনও কুয়াশা ছিল না।
চোখ পিটপিট করলাম আমি।
কিন্তু আমি তো দেখেছি, বলে জানালা দিয়ে আঙুল নির্দেশ করলাম। আপনি ল্যাণ্ড করার ঠিক আগে কুয়াশার মেঘে ঢুকে পড়েছিল প্লেন।
ক্যাপ্টেন আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
মানুষ এয়ারপোর্টে অনেক উল্টোপাল্টা দেখে। আমি বলছি কোন কুয়াশা ছিল না। হেঁটে চলে গেলেন তিনি।
তাঁর গমনপথের দিকে চেয়ে রইলাম। আমি দেখেছি, আর কন্ট্রোলে বসে উনি দেখবেন না, এটা হয়? মিথ্যে বলে গেলেন কেন ক্যাপ্টেন?
এসময় আমার নাম ধরে ডাকা হলো।
কিশোর! কিশোর! এদিকে!
ঘুরে দাঁড়ালাম। প্যাসেঞ্জার এরিয়াটায় দাঁড়িয়ে চাচা-চাচী। তাদের পাশে আমার বয়সী এক কিশোর। মার্ক।
এগিয়ে গেলাম। চাচী মার্কের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল।
কেমন আছ, মেট? বন্ধুভাবাপন্ন হাসি হাসল মার্ক। মেট বলতে অস্ট্রেলিয়ানরা বন্ধু বোঝায়।
ভাল। তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম, বললাম। হাত মিলালাম। মার্ক আমার চাইতে খানিকটা খাটো। মাথার চুল হালকা বাদামী, চোখজোড়া ম্লান নীল। একটু যেন উদাসীনও।
প্লেনে বসে থাকতে থাকতে হাতে-পায়ে খিল ধরে গেছে। লম্বা। জার্নি, বলল ও।
বাসায় যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না, চাচী বলল। রাতে ভাল একটা ঘুম দিলে কাল সকাল থেকেই বছর শুরু করে দিতে পারবে।
তবে তো খুব ভাল হয়, বলে হাই চাপল মার্ক। তোমার স্কুলের বন্ধুদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে তর সইছে না আমার। শেষের কথাগুলো আমার উদ্দেশে বলল। গাড়িতে গিয়ে বসেছি আমরা।
ওদেরকে তোমার ভাল লাগবে। মার্ক, একটা প্রশ্ন করতে পারি?
নিশ্চয়ই, হাই তুলে বলল ও।
প্লেনটা ল্যাণ্ড করার ঠিক আগ মুহূর্তে কী করছিলে তুমি?
আমার দিকে চাইল মার্ক।
কী আর করব? সিট বেল্ট বেঁধে সিটে বসে ছিলাম। কেন?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলে?
হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য।
প্লেনটা কুয়াশার মেঘে ঢুকে পড়েছিল টের পেয়েছিলে?
আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে মার্ক। ওর চোখজোড়া যেন নীলচে দ্যুতি ছড়াল। গাড়ির পিছনের সিট থেকে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে, গা ছমছম করে উঠল আমার।
এবার শান্ত স্বরে বলল ও, না, মেট, কোন কুয়াশা-টুয়াশা চোখে পড়েনি।
মাথা ঝাঁকালাম। বোঝা যাচ্ছে আমি ছাড়া আর কেউ কুয়াশার মেঘটাকে দেখেনি। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?
তবে একটা ব্যাপার ঘটেছিল, মার্ক বলল।
ঝট করে ঘুরে চাইলাম।
কী?
ল্যাণ্ড করার আগের মুহূর্তে প্লেনের বাতিগুলো নিভে যায়। গোটা কেবিন আঁধার হয়ে গিয়েছিল। পরমুহূর্তে আবার আলো ফিরে আসে।
ওহ, হতাশ কণ্ঠে বললাম। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। নাহ, কুয়াশা-রহস্য ভেদ করা গেল না।
ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকল। চাচা গাড়ি পার্ক করলে সবাই নেমে পড়লাম। চাচা-চাচী মার্ককে যখন তার রূম দেখাতে নিয়ে গেল, কিচেনে থমকে দাঁড়ালাম আমি।
কিচেন টেবিলে কিছু কাগজ ফেলে গেছিল চাচা। তার মধ্যে মার্কের পাঠানো একটা চিঠি রয়েছে। ওর একটা রঙিন ছবিও আছে চিঠির সঙ্গে।
ছবিটা তুলে নিয়ে দুমুহূর্ত জরিপ করলাম। ছবির সঙ্গে ওর সব কিছুরই মিল খুঁজে পেলাম। শুধু একটা বাদে। সেজন্যেই গাড়িতে অমন ভয় পেয়েছিলাম আমি, মার্ক যখন তার স্লান নীল চোখ মেলে আমার দিকে চেয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওর চোখজোড়া গাঢ় বাদামি।
৩
পরদিন স্কুল। ঘুমিয়ে উঠে তরতাজা বোধ করছে মার্ক। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল নাস্তার টেবিলে।
কমলার রস আর কর্ন ফ্লেকসে আপত্তি নেই তো? আমরা বেশির ভাগ। দিন সকালে ওগুলো দিয়েই শুরু করি, বলল চাচী।
আমরাও অস্ট্রেলিয়াতে তা-ই করি, বলে সিরিয়ালে চামচ ডোবাল মার্ক।
দুদেশের মিল-অমিল আস্তে আস্তে জানা যাবে, চায়ে দুধ ঢেলে বলল চাচা।
বোধহয় অমিল কম, মিলই বেশি, জানাল মার্ক। অবশ্য আপনাদের এখানে ক্যাঙারু দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
হেসে ফেললাম আমরা। মার্ক নীল চোখজোড়া মেলে আমার দিকে চাইল। চোখ দুটো যেন ঝলসাচ্ছে। হঠাই পানির তেষ্টা পেয়ে গেল। আমার।
যাই, পানি খেয়ে আসি, বলে সিঙ্কের দিকে এগোলাম।
পানি? নাস্তার সাথে? বলিস কী? চাচী বলে উঠল। কোনদিন তো খাস না।
তেষ্টা পেয়েছে কী করব, শ্রাগ করে বললাম। চাচী ঠিকই বলেছে। নাস্তায় সব সময় কমলার রস আর দুধ খাই আমি। কিন্তু এখন আমার পানির খুবই দরকার।
ঠাণ্ডা পানির ফসেট অন করে গ্লাস ভরে নিলাম।
ওউ, পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠে মুখের পানি ফেলে দিলাম সিঙ্কে।
কী হয়েছে! চাচা-চাচী উঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল।
পানিটা, কোনমতে আওড়ালাম, ভয়ানক গরম।
ঠাণ্ডা পানি খাবি তো গরম পানি অন করলি কেন? চাচা জিজ্ঞেস করল।
করিনি, বললাম। নীচের ঠোঁটটা অসাড় হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে। ফুলে যাবে। কোল্ড ফসেট অন করেছি। এই দেখো।
ফসেটটা আবারও চালু করলাম। সাবধানে আঙুল ছোঁয়ালাম পানির ঝর্নায়। গরম!
এ কী করে হয়? চাচী প্রশ্ন করল। কোল্ড ফসেট থেকে গরম পানি বেরোয় কীভাবে!
দেখি তো, বলে গরম পানির ফসেট চালু করলাম। আঙুল বাড়ালাম। বরফ শীতল পানি! উল্টে গেছে, বললাম। ঠাণ্ডার জায়গায়
গরম আর গরমের জায়গায় ঠাণ্ডা।
ঠাণ্ডা পানিতে একটা ন্যাপকিন ভিজিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরলাম।
বাড়ির নীচে পানির পাইপে মনে হয় কোন গণ্ডগোল হয়েছে। মিস্ত্রি ডাকতে হবে, বলল চাচা।
পুরোটা সময় মার্ক কোন কথা বলেনি। আমার দিকে ম্লান নীল চোখজোড়া মেলে চেয়ে ছিল শুধু। ভঙ্গিটা এমন যেন সম্মোহিত অবস্থায় রয়েছে।
আমাদের দেশেও এসব ছোটখাট মিক্স-আপ ঘটে, বলল ও।
চাচা-চাচী হেসে উঠল। আমি হাসলাম না। মুখের ভিতরটা এখনও ফুলে আছে।
একটু পরে মার্ককে নিয়ে স্কুলের পথ ধরলাম।
হাঁটার ফাঁকে ওর দিকে এক ঝলক চাইলাম। মনে পড়ে গেল কাল রাতে কোন ব্যাপারটা আমাকে অবাক করেছিল।
মার্ক, আমি একটা কথা ভাবছিলাম, বললাম। তুমি অস্ট্রেলিয়া। থেকে আমাদের কাছে যে ফটোটা পাঠিয়েছ, সেটায় তোমার চোখের মণি গাঢ় বাদামি ছিল। কিন্তু আসলে তোমার চোখ হালকা নীল। ব্যাপারটা কী?
মার্ক নিশ্চপ। শেষমেশ আমার দিকে চাইল।
ও, এই কথা? আমি তখন ডার্ক কনট্যাক্ট লেন্স পড়তাম। তারপরে চোখের সমস্যা সেরে গেল, ফলে আর পরার দরকার পড়েনি।
ও, কী হয়েছিল চোখে? আলো সহ্য হত না, বলল মার্ক। লাইট সেনসিটিভিটি।
ব্যাপারটা ভাল বুঝলাম না। তবে, ও নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। স্কুলের কাছাকাছি এসে গেছি।
ওই দেখো, গাড়ি থেকে নামছে রবিন মিলফোর্ড। ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন।
রবিন গাড়ি থেকে নেমে মাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। আন্টি পাল্টা হেসে হাত নাড়লেন। রবিন সাইডওয়কে পা রাখলে, মিসেস মিলফোর্ড রাস্তায় ট্রাফিক আছে কিনা দেখে নিলেন! ফাঁকা। আমি মিসেস মিলফোর্ডের গাড়ির পিছন দিয়ে সাইডওয়কের উদ্দেশে এগোলাম। গাড়িটা তখন সামনের দিকে চুলতে শুরু করেছে।
অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিলেন মিসেস মিলফোর্ড।
কিশোর, সাবধান! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। মুখ তুলে চাইলাম। শেষ মুহূর্তে দেখতে পেলাম গাড়িটা ব্যাক করে সোজা আমার দিকে ধেয়ে আসছে!
৪
এক লাফে সরে গেলাম সাইডওয়কের দিকে। সিমেন্টে পড়ে এক গড়ান। দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ঝটপট। পতনের ফলে সামান্য ব্যথা পেলেও, গাড়ির ধাক্কা থেকে তো বেঁচেছি।
মিসেস মিলফোর্ড ব্রেক চেপে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলেন।
কী হলো কিছুই বুঝলাম না, বিস্মিত কণ্ঠে বললেন তিনি। ফরওয়ার্ড গিয়ার দিয়ে অ্যাক্সিলারেটর চাপলাম, কিন্তু কী কারণে কে জানে গাড়ি গেল পিছন দিকে।
পিছনে আনার চেষ্টা করে দেখুন কী হয়, বাতলে দিলাম।
ঠিক আছে, বলে এঞ্জিন চালু করলেন আবার, ব্যাকগিয়ার দিলেন, গাড়ি এগোল সামনের দিকে! অদ্ভুত কাণ্ড! গিয়ার উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে!
আগে তো কখনোই এরকম হয়নি, মন্তব্য করল রবিন।
আজকে সব কিছুই উল্টে গেছে, বললাম।
তোমার জন্যে আজকের দিনটা অপয়া, কিশোর, বলে হেসে উঠল মার্ক।
রবিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর। এরপর বেল বাজলে। আমরা ক্লাসে গিয়ে ঢুকলাম।
রোল কলের পর মিসেস রবার্টস মার্ককে ডেকে নিলেন। জানালেন, মার্ক বদলি ছাত্র হিসেবে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে, আমাদের পরিবারের সঙ্গে থাকছে।
হাই ইয়া, মেটস! মার্ক চেঁচিয়ে বলল।
হাই, মার্ক! পাল্টা সম্ভাষণ জানানো হলো ওকে।
রকি বীচ সত্যিই চমৎকার জায়গা। তোমরা অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে যা জানতে চাও আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।
তুমি কি কাছ থেকে ক্যাঙারু দেখেছ? জুলি প্রশ্ন করল।
নিশ্চয়ই। তবে ওদের সাথে লাফানোর কম্পিটিশন দিতে যেয়ো না, পারবে না।
মুসা হাত তুলল।
মার্ক, কোয়ালা ভালুক কি সত্যিকারের ভালুক? খুদে, লোমশ, মিষ্টি প্রাণীগুলোর কথা জানতে চেয়েছে ও।
দুমুহূর্ত ভেবে নিল মার্ক।
আমি জানি না। তবে অস্ট্রেলিয়াতে ফিরে প্রথম যে কোয়ালা ভালুকের সাথে দেখা হবে তাকে জিজ্ঞেস করব।
ছেলে-মেয়েরা হেসে উঠে হাততালি দিল। মার্ককে সবাই পছন্দ করতে শুরু করেছে।
লাঞ্চের সময় ক্যাফেটেরিয়াতে মার্ক, মুসা, রবিন আর আমি জড় হলাম। মুসার সঙ্গে ইতোমধ্যেই পরিচয় হয়ে গেছে মার্কের। রবিন আর মুসা অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলল মার্ককে। বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে সাধ্যমত জবাব দিয়ে গেল ও। শেষমেশ মার্ককে রেহাই দেওয়ার জন্য প্রসঙ্গ পাল্টালাম আমি।
আজকে আমাদের বিগ ম্যাচ ভুলে যেয়ো না।
ওরা আমার দিকে ঘুরে চাইল। রকি বীচ সকার টিমের সঙ্গে আজ স্কুল ছুটির পর হোয়াইট লায়ন্স ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ। হোয়াইট লায়ন্স আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ।
মনে আছে। আমরা মাঠে যাব, জানাল রবিন। তারপর মার্কের উদ্দেশে বলল, মার্ক, তুমি আসছ তো ফুটবল মাঠে?
আমার দিকে অন্তর্ভেদী নীল চোখ মেলে চাইল মার্ক।
তুমি কী বলো, মেট?
নিশ্চয়ই যাবে!
তুমি কোন্ পজিশনে খেলো? মার্ক প্রশ্ন করল।
ডিফেন্স। আজকে যদি ওদেরকে হারাতে পারি তা হলে ভাল ভাবে। শুরু হবে আমাদের সিজন।
আমি যাব, কিশোর। খেলাটা মিস করতে চাই না, জানাল মার্ক।
বিকেলটা কেটে গেল চোখের পলকে। এক সময় তিনটে বাজল। স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আর আধ ঘণ্টা পর বড় ম্যাচ। হলওয়ের বাইরে জড় হলাম আমরা।
মার্ককে মাঠে নিয়ে যাব আমরা, বলল রবিন। আমাদের সাথে স্ট্যাণ্ডে বসবে ও।
সামনের দিকে বসা যাবে না? জিজ্ঞেস করল মার্ক।
নিশ্চয়ই যাবে, জানাল মুসা। পায়ে ব্যথা, তাই চলে গেল ও।
ভাল খেলা চাই কিন্তু, মেট, আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল মার্ক। সবার শুভ কামনা নিয়ে জার্সি পরতে গেলাম আমি।
একটু পরে, সহ খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঠে নামলাম। দর্শক সারির সামনের দিকে বসেছে আমার ক্লাসমেটরা। রবিন আর মুসার মাঝখানে মার্ক বসা। সবাই হাত নাড়ছে, চিৎকার করে উৎসাহ যোগাচ্ছে–শুধু মার্ক বাদে। হয়তো এটা ওর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা, ভাবলাম, তাই ও জানে না কী করতে হবে।
দুদল তৈরি। এখুনি খেলা শুরু হবে। রেফারি বাঁশি বাজালেন।
সেন্টার করেছে লায়নরা। দ্রুতগতিতে বল দেওয়া-নেওয়া করে। আমাদের গোলের দিকে এগিয়ে আসছে ওরা। আমি এগিয়ে গেলাম বাধা দিতে। প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগতেই পড়ে গেল সে। রেফারির বাঁশি বেজে উঠল। ফাউল। পেনাল্টি। খেলা শুরু হতে না হতেই পিছিয়ে পড়লাম আমরা ০-১ গোলে। দুই মিনিট পর আমাকে তুলে নেওয়া হলো মাঠ থেকে। অবাক কাণ্ড! সাইডলাইনে দেখি জার্সি পরে মার্ক দাঁড়িয়ে। আমার বদলে মাঠে ঢুকল ও।
তোমাকে আজকে নামানোই উচিত হয়নি, বললেন কোচ। মার্ক ছেলেটা কেমন খেলে দেখি। অস্ট্রেলিয়াতে ও নাকি ডিফেন্সে খেলে। লাঞ্চের সময় আমাকে গিয়ে বলেছে দরকার পড়লে ওকে যাতে নামাই।
বোকা হয়ে গেলাম আমি! বেঞ্চে বসে মার্ককে আমার জায়গা নিতে দেখলাম। বসে বসে ভাবতে লাগলাম। পেনাল্টি বক্সের ভিতরে কোন কুক্ষণে ওভাবে ফাউল করতে গেলাম। অথচ আমি দলের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ডিফেণ্ডার। না, মার্ক ছেলেটা আসার পর থেকে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রথমে ঠাণ্ডা-গরম পানির ব্যাপারটা ঘটল, তারপর গাড়ি চাপা পড়তে যাচ্ছিলাম। আর এখন খেলার শুরুতেই পেনাল্টি দিয়ে বসলাম। এসব হচ্ছেটা কী?
৫
খেলা শেষ। ০-১ গোলে হেরেছে রকি-বীচ। সব দোষ আমার। মার্ক আমার বদলি হিসেবে নামার পর আর গোল হয়নি। দুর্দান্ত খেলেছে ও।
লকার রূমে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। কারও সঙ্গে কথা বলতে চাই না। সবাই ঘিরে ধরেছে মার্ককে, বাহবা দিচ্ছে। হঠাৎ করেই দলের সবচাইতে জনপ্রিয় খেলোয়াড় হয়ে গেছে ও!
বাইরে বেরিয়ে এলাম। মুসা আর রবিন অপেক্ষা করছিল আমার জন্য।
ব্যাড লাক, কিশোর। ফাউলটা না করলেও পারতে, বলল মুসা।
আমিও ফাউল করতে চাইনি। কী থেকে কী হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাই।
খেলা তো আরও আছে, অত চিন্তা করছ কেন, আমার পিঠ চাপড়ে দিল রবিন।
কিন্তু মার্ক কী খেলাটাই না খেলল। একাই সব আক্রমণ রুখে দিল, ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন চীনের প্রাচীর, বলল মুসা।
ধন্যবাদ, মুসা, বলল মার্ক, এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে লকার রূম থেকে। মুখে চওড়া হাসি, নীল চোখ ঝলকাচ্ছে।
পরের ম্যাচে কোচ হয়তো তোমাকেই প্রথম এগারোয় নামাবেন, বলল রবিন।
আমার তা মনে হয় না। কিশোরই খেলবে। আমি তো বদলি হিসেবে খেলছিলাম, জানাল মার্ক।
চলো, বাড়ি ফিরি, মার্কের উদ্দেশে বললাম।
চলো, মেট, জবাব দিল মার্ক। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম আমরা। তোমার বন্ধুগুলো খুব ভাল, একটু পরে বলল মার্ক।
হ্যাঁ, তোমাকে ওদের ভাল লেগেছে, একটু কি ধারাল শোনাল। আমার কণ্ঠ? ঝট করে আমার দিকে চাইল ও।
দেখো, কিশোর, আমি কিন্তু নিজের ইচ্ছায় মাঠে নামিনি। কোচ চেয়েছেন বলেই, বলল ও।
বাসার কাছের মোড়ের উদ্দেশে এগোচ্ছি আমরা।
আমি এর আগে কোনদিন পেনাল্টি দিইনি। তা ছাড়া ওটা এমন। কোন বিপজ্জনক আক্রমণ ছিল না যে গোল হতে পারত, বললাম।
সবুজ বাতি জ্বলে উঠল, কার্ব থেকে নেমে রাস্তা পেরোতে লাগলাম। আমি।
পঞ্চাশটার উপরে ম্যাচ খেলেছি। এরকম ভুল আগে কখনও করিনি।
হঠাৎই এক গাড়ির হর্ন যেন কানের পর্দা ফাটিয়ে দিল। ঘুরে চাইলাম। একটা গাড়ি ছুটে আসছে। রাস্তা থেকে সরার উপায় নেই। চাপা দেবে আমাকে!
৬
গাড়িটা এক পাশে কেটে তীক্ষ্ণ শব্দে থেমে দাঁড়াল। মাত্র ফুটখানেকের জন্য ধাক্কা লাগেনি।
অ্যাই, তুমি বাতি না দেখে রাস্তা পেরোচ্ছিলে কেন? বলল ড্রাইভার। ভাগ্যিস তোমাকে দেখতে পেয়েছিলাম!
কী বলছেন আপনি? আমি বিস্মিত। সবুজ আলো দেখেই তো রাস্তা। পেরোচ্ছিলাম। দূরে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক লাইটটা দেখলাম।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না! লাল! একটু আগেই তো সবুজ দেখলাম। ঘুরে চাইলাম মার্কের দিকে। তখনও কার্বে দাঁড়িয়ে ও। এবার দৌড়ে এল আমার কাছে।
কিশোর, তুমি ঠিক আছ তো?
হ্যাঁ, বললাম। যদিও ভিতরে ভিতরে রীতিমত কাঁপছি। একই দিনে দুবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি কপাল গুণে।
এখন থেকে ট্রাফিক আইন মেনে চোলো, বলে গাড়ি স্টার্ট করল ড্রাইভার।
মার্ক আর আমি হেঁটে চললাম বাড়ির উদ্দেশে।
তোমাকে অনেকবার ডেকেছি, তুমি শুনতে পাওনি।
আমি কিন্তু বাতি সবুজ দেখেই কার্ব থেকে নেমেছিলাম।
তুমি ভেবেছ সবুজ।
তার মানে?
তুমি আপসেট আছ, মেট। সেজন্যে উল্টোপাল্টা ভাবছ। এটা অস্বাভাবিক না। সবারই কখনও না কখনও এমন হয়।
ওর সঙ্গে তর্ক করলাম না। কিন্তু আমি জানি বাতিটা তখন সবুজই ছিল। হঠাৎ করে ব্যাখ্যাতীত ভাবে লাল হয়ে গেছে।
ডিনারে বসে চাচা-চাচীকে এসব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ব্যাখ্যা করতে হবে বলে উদ্বেগ বোধ করলাম। বৃথা চিন্তা। আমাকে মাঠ থেকে তুলে নেওয়ার কথা শুনে দুঃখ পেল তারা। কিন্তু মার্ক বদলী হিসেবে নেমে দুর্দান্ত খেলাতে যারপর নাই খুশি হলো। মার্ককে নিয়ে রীতিমত মেতে উঠল চাচা-চাচী!
মনে হচ্ছে বাড়িতে নতুন একজন ফুটবল স্টার পাওয়া গেল, বলল। চাচী। খাওয়া শেষে ডেজার্ট নিয়ে এল।
আমার আর সহ্য হলো না।
আমি যাই, অনেক হোমওয়র্ক আছে, বলে উঠে পড়লাম।
তাই? মিসেস রবার্টস তো বললেন ফুটবল ম্যাচের জন্যে আজকে হোমওয়র্ক দেবেন না, বলল মার্ক।
আমার আসলে বাড়তি কাজ আছে। বুক রিপোর্ট করার কথা ছিল গত সপ্তাহে, করিনি। আগামীকাল জমা দেওয়ার তারিখ।
ঠিক আছে, তুই হোমওয়র্ক কর। মার্ক দেখুক আমেরিকান টিভির প্রোগ্রাম ভাল লাগে কিনা, চাচী বলল।
উপরে, নিজের রূমে চলে এলাম। বাতি জ্বেলে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
ঘরের ভিতরটা গুমোট লাগছে। খুদে এয়ারকণ্ডিশনারটা চালু করে দিলাম।
বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। এটা আমেরিকার বিপ্লবের উপরে লেখা এক ইতিহাস বই। বেশ মজে গেছি। হঠাই অনুভব করলাম দরদর করে ঘামছি আমি। এয়ারকণ্ডিশনারটার দিকে চাইলাম। কাজ করছে তো? শব্দ তো ঠিকই শুনতে পাচ্ছি।
উঠে গেলাম জানালার কাছে। যন্ত্রটায় হাত দিয়ে দেখলাম গরম বাতাস বেরোচ্ছে।
হচ্ছেটা কী এখানে? চেঁচিয়ে উঠে লকটা বন্ধ করে দিলাম। এবার আরও বেশি গরম হাওয়া ছাড়তে লাগল যন্ত্রটা।
দম আটকে আসছে! ঘামে জবজব করছে শরীর। এবার মাথায় ঘাই মারল চিন্তাটা, আজকে সব কিছুই উল্টো হচ্ছে। অফ দিলে যদি আরও গরম হয়ে ওঠে, তবে হাই করে দিলে নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যাবে।
নবটা ডানে মোচড় দিলাম। নড়ল না! অফ-এ আটকে আছে। তপ্ত বাতাসের হলকা পুড়িয়ে দিচ্ছে আমাকে।
আমার সাহায্য দরকার। চাচাকে ডাকব ঠিক করলাম। ভারি; গরম বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, টলতে টলতে দরজার দিকে এগোলাম। ডোরনবে হাত রেখে, ডান দিকে মুচড়ে ঠেলা দিলাম।
কিছুই ঘটল না! আরও জোরে ধাক্কা দিলাম। খুলল না। অসম্ভব কাণ্ড! আমার বেডরূমের দরজায় লক নেই। তা হলে খুলছে না। কেন?
এদিকে, গরম বাতাস ক্রমেই দুর্বল করে ফেলছে আমাকে
বাঁচাও! চেঁচিয়ে উঠলাম। দুমাদুম কিল মারলাম দরজায়। আমাকে এখান থেকে বের করো! চাচা-চাচী, বাঁচাও! তারস্বরে চেঁচাচ্ছি, তপ্ত বাতাসে ভরে উঠছে ঘরটা।
৭
জ্ঞান হারিয়ে ফেলার দশা আমার। হঠাৎই দরজার বাইরে চাচার কণ্ঠ শুনলাম।
কিশোর! কিশোর! নবটা ছেড়ে দে! চেঁচিয়ে বলল।
আমি তো ধরে রাখিনি, দুর্বল কণ্ঠে জবাব দিলাম।
দরজাটা খোলার জন্যে টানছি, কিন্তু খুলছে না! চাচা চেঁচাল।
আমার ঘরের দরজা বাইরে থেকে টানলে কিংবা ভিতর থেকে ঠেললে খোলে।
চোখ মেলোম, কপাল থেকে ঝরে পড়ল ঘাম। পেয়েছি! চাচা, দরজার কাছ থেকে সরে যাও! চেঁচালাম।
ডোরনব ধরে টানলাম। খুলে গেল দরজা। টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম হলওয়েতে। চাচা-চাচী চেপে ধরল আমাকে।
কিশোর, কী হয়েছিল? প্রশ্ন করল চাচী। চোখজোড়া আতঙ্কে বিস্ফারিত।
হাঁফানোর ফাঁকে আমার কামরার দিকে তর্জনী নির্দেশ করলাম। খুলে বললাম সব কথা। এয়ারকণ্ডিশনার থেকে কীভাবে গরম বাতাস বেরোচ্ছিল, দরজা কীভাবে আটকে যায়।
কিচেনে চল। তোর একটা ঠাণ্ডা ড্রিঙ্ক দরকার, বলল চাচী।
বেসমেন্টে গিয়ে এয়ারকণ্ডিশনিং ইউনিটটাকে বন্ধ করে দিচ্ছি, চাচা বলল। কালকে পানির ফসেটের সঙ্গে এটাও চেক করিয়ে নেব। সব কটার মধ্যে হয়তো সম্পর্ক আছে। কোথাও নিশ্চয়ই তার ওলট পালট হয়ে গেছে।
কিন্তু দরজার অ্যাকশন উল্টে গেল কীভাবে? ওর সাথে তো তারের কোন সম্পর্ক নেই, বললাম সন্দেহের সুরে।
চাচা দরজাটা এক পলক দেখে নিয়ে কাধ ঝাঁকাল।
বাড়িটা পুরানো। কজাগুলোয় হয়তো জং ধরে গেছে।
একটু পরে, কিচেনে বসে চাচীর বানানো ঠাণ্ডা লেমোনেড়ে চুমুক দিতে লাগলাম।
এখন কেমন লাগছে, বাপ? চাচীর প্রশ্ন।
অনেকটাই ভাল। চাচী, গত চব্বিশ ঘণ্টায় অনেক উল্টোপাল্টা কাণ্ড ঘটেছে, যার কোন ব্যাখ্যা নেই, বললাম।
নিশ্চয়ই আছে। একটু অপেক্ষা করলেই জানা যাবে।
চাচা বেসমেন্ট থেকে ফিরে কিচেনে এসে ঢুকল।
কিশোরের রূমের কানেকশন অফ করে দিলাম। কালকে মিস্ত্রি ডাকব।
মাথা ঝাঁকালাম। লেমোনেড শেষ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। হঠাৎ করেই ভাল লাগতে লাগল, সব যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মার্ক আসার পর থেকে এই বোধটারই অভাব অনুভব করছিলাম।
মার্ক!
চেয়ারে সিধে হয়ে বসে চারধারে নজর বুলালাম।
মার্ক কোথায়?
ও বাইরে গেছে, বলে আরও খানিকটা লেমোনেড ঢেলে দিল চাচী।
বাইরে? কোথায়?
রবিন এসেছিল তোদেরকে ডাকতে। ওর বাবা নতুন এক নেচার ভিডিও এনেছেন সেটা দেখাতে। তুই তখন হোমওয়র্ক করছিলি, তাই মার্ক একাই গেছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরবে।
কিশোর, কোথায় যাচ্ছিস? চাচা আমাকে দরজার দিকে পা বাড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করল।
ভিডিওটা দেখতে চাই আমি, বলে বেরিয়ে এলাম।
দ্রুত হাঁটছি।
একটু পরে, রবিনের বাসার সামনে চলে এলাম। পড়ন্ত বিকেল, রবিনের বাবা-মা সামনের লনে গার্ডেনিং করছিলেন।
হাই, আঙ্কল, আন্টি, চেঁচিয়ে বললাম।
আরে, কিশোর যে, বললেন মিসেস মিলফোর্ড। তোমার বন্ধুরা পিছনে আছে, মার্কের আনা কী একটা খেলা খেলছে।
খেলা? মার্কের আনা? সেটা আবার কী? বললাম মনে মনে।
মার্ক ছেলেটা সত্যিই ভাল, বললেন মি. মিলফোর্ড। আর নাকি খুব ভাল ফুটবল খেলে।
মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালাম। এবার বাড়ির পিছনের উদ্দেশে পা বাড়ালাম।
আমার পালা! আমার পালা। একটি মেয়ে কণ্ঠ শুনতে পেলাম। পিছনে এসে দেখি রবিন, মুসা, জুলি আর শিনা। সঙ্গে মার্কও রয়েছে।
জুলি চেঁচিয়ে উঠেছিল। মার্ক ওর হাতে একটা বাঁকা জিনিস তুলে দিচ্ছে। বুমেরাং। ছুঁড়ে দিলে আবার ফিরে আসে নিক্ষেপকারীর কাছে।
জুলি ছুঁড়ে দিল ওটা। একটু পরে, হাত বাড়িয়ে লুফে নিল।
সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।
আগে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। এখন এটা স্রেফ একটা খেলা। এইমিং আর দূরত্ব বিচার করতে কাজে দেয় জিনিসটা, জানাল মার্ক।
সবাই ট্রাই করেছে, শুধু কিশোর বাদে, বলল শিনা। বুমেরাংটা কিশোরকে দাও।
জুলি আমার হাতে দিল জিনিসটা।
বাড়ির বাঁ দিকের এক কোনায় সরে এলাম। এখান থেকে বুমেরাংটা ছুঁড়ে দিলে সোজা আমার কাছেই ফিরে আসবে।
আমার হাত থেকে উড়ে গেল ওটা।
ফিরে আসবে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না, বলল মুসা।
আমরা সবাই চেয়ে রয়েছি যেদিকে ছুঁড়েছিলাম। কেউ টু শব্দটি করছে না।
কী হলো? প্রশ্ন করল রবিন। আমার দিকে চাইল।
হঠাৎই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ওর।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল ও। পরমুহূর্তে ডাইভ দিয়ে আমাকে পেড়ে ফেলল। দুজনে ছিটকে পড়লাম মাটিতে।
৮
চিতিয়ে পড়েছি আমি।
কী, ব্যাপারটা কী? চেঁচিয়ে উঠলাম।
ওই দেখো, তোমার পিছনে! তর্জনী তাক করে বলল রবিন। পিছু ফিরে চাইলাম। বুমেরাংটা উড়ে এসে আমার পিছনে মাটিতে পড়েছে। মাত্র কফিট দূরে।
যেদিকে ছুঁড়েছিলাম তার উল্টো দিক থেকে এসেছে ওটা!
উঠে দাঁড়ালাম। ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলাম জিনিসটা।
খাইছে, এটা কী হলো? ছুঁড়লে একদিকে, এল আরেক দিক থেকে! বলে উঠল মুসা।
রবিন আমাকে সময় মত পেড়ে না ফেললে সোজা আমার মাথার পিছনে এসে লাগত, বললাম।
সরি, মেট, বলে বুমেরাংটা আমার হাত থেকে নিল মার্ক, প্যান্টে মুছল। এটার এভাবে কাজ করার কথা নয়। তোমার দিনটাই খারাপ।
আজকের দিনটা আমার শেষ দিন হতে পারত। আমি মারা যেতে পারতাম।
তা হলে আজকের দিনটা তোমার জন্যে শুভ। এতগুলো খারাপ ঘটনা ঘটল, অথচ তোমার কিছুই হলো না, মৃদু হেসে বলল মার্ক।
এরপর আর খেলা চলে না। আমরা ভিতরে গেলাম ভিডিও দেখতে। আলাস্কার বনভূমি রক্ষার উপর এক ডকুমেন্টারি। কোডিয়াক ভালুক, ঈগল, পর্বতমালা এসব নিয়ে তোলা ছবি, আমার যেগুলো ভাল লাগে।
আমার মাথার মধ্যে অবশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে দুর্ঘটনাগুলোর কথা। ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ঘটনাগুলো। আমি নিজেকে মোটেই ভাগ্যবান ভাবতে পারছি না।
ভিডিও দেখা হয়ে গেলে আমি আর মার্ক বাড়ির পথ ধরলাম।
মার্ক, ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে, ওর দিকে চেয়ে বললাম, কিন্তু যতবারই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে তুমি আশপাশে ছিলে, প্রতিবারই।
মার্ক শ্রাগ করে মুচকি হাসল।
এভাবে ভাববো না কেন, মেট, আমাদের সবার জীবনেই দুর্ঘটনা ঘটে, তোমার বেলায় সবগুলো হয়তো একদিনেই ঘটে শেষ হয়ে গেছে।
হতে পারে। বললাম বটে, তবে আত্মবিশ্বাসী হতে পারলাম না।
বাড়ি ফিরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে চলে এলাম। মার্ক চাচা-চাচীর সঙ্গে টিভি দেখতে বসল। দরজাটা স্বাভাবিকভাবেই খুলল এবং এয়ার কণ্ডিশনারটাকে নীরবে জানালায় বসে থাকতে দেখে স্বস্তি বোধ করলাম।
দরজা বন্ধ করে ডেস্কে বসলাম। বইটা খুলে পড়তে লাগলাম। মাঝে মধ্যে নোট নিচ্ছি।
প্রায় দুঘণ্টা পর কাজটা শেষ হলো। হাই উঠছে। ঘুমানোর সময় হলো। পায়জামা পরে হলওয়েতে বেরিয়ে এলাম।
অন্ধকার। চাচা-চাচীর বেডরুমের পাশ কাটালাম। দরজা বন্ধ। কোন সাড়া-শব্দ নেই। তারমানে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাথরূমে গিয়ে বাতি জ্বালোম। তারপর পানির দুটো ফসেটই অন করলাম। এবার সতর্ক আমি। পরখ করে দেখলাম। ঠিকমতই কাজ করছে।
একটু পরে, দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করলাম। আয়নায় চোখ পড়তেই বুঝলাম মুখের চেহারায় সারাদিনের দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে।
ব্রাশ করা হয়ে গেলে বাথরূমের বাতি অফ করে দিলাম। হাঁটা দিলাম আমার কামরার উদ্দেশে। হঠাই থমকে দাঁড়ালাম। মনে হলো একটা শব্দ শুনেছি। নীচে থেকে আসছে। নিচু, চাপা এক শব্দ। এবাড়িতে এরকম আওয়াজ আগে কখনও পাইনি।
সাবধানে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে চাইলাম। চাচা-চাচীর ঘর আবারও পার হয়ে এলাম। এখনও নিস্তব্ধ।
সিঁড়ি ভেঙে ধীরেসুস্থে নামতে লাগলাম। মেইন ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়েছি। শব্দটা জোরাল হয়েছে, নীচ থেকে আসছে। মার্ক যে তলায় থাকে সেখান থেকে!
ওর ঘরের উদ্দেশে নেমে যাচ্ছি। ডানদিকে, সিঁড়ির গোড়ায় বন্ধ দরজাটা দেখতে পাচ্ছি। তলা দিয়ে আলো চুঁইয়ে বেরোচ্ছে। মার্ক জেগে আছে এখনও। কথা বলছে কারও সঙ্গে। কেননা দুজনের গলা শুনতে পাচ্ছি!
পা টিপে টিপে নেমে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দরজায় কান পাতলাম।
তুমি ঠিকমতই কাজ করছ, চাপা এক কণ্ঠস্বর বলল। কিন্তু আজকে মাত্র প্রথম দিন। আমার আরও অনেক বড় প্ল্যান আছে।
না! মার্ক জবাবে বলল। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই না!
আমি যা বলব তুমি তাই করবে, হিসিয়ে উঠল অপর কণ্ঠটা। আমি তোমার বস, তুমি আমার বশ।
না, আমাকে আমার মত থাকতে দিন, প্লিজ!
সময় আসুক তোমাকে ছেড়ে দেব। শীঘি। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তোমার দেহ, তোমার আত্মা সব আমার। হেসে উঠল অচেনা কণ্ঠটা।
না, আমি আপনাকে চান্স দেব না!
তুমি নিরুপায়, বলল কণ্ঠটা।
না! চেঁচিয়ে উঠল মার্ক। মনে হলো সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। ও। ডোরনবে হাত রেখে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লাম।
৯
মার্ক বিছানায় শুয়ে ছিল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো ধোঁয়ার এক কুণ্ডলী দেখলাম, ওর ঠিক মাথার কাছে। কিন্তু চোখের পলকে মিলিয়ে গেল ওটা। মনে হলো মিশে গেল মার্কের শরীরের ভিতরে!
আমি কোন কথা বললাম না। বদলী ছাত্রটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। আমি ঘরে ঢুকেছি টের পায়নি ও। চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে।
মার্ক, ফিসফিস করে ডাকলাম। তুমি ঠিক আছ?
জবাব নেই। আরেকটু কাছিয়ে গেলাম। একচুল নড়েনি মার্ক। আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে যেন জানেই না ও। চোখজোড়া বিস্ফারিত!
মার্ক, তুমি ঠিক আছ? পুনরাবৃত্তি করে, হাত নামিয়ে ওর বাহু স্পর্শ করলাম।
কী ব্যাপার! বলে তড়াক করে সিধে হয়ে বসল ও। এতটাই চমকে গেছি, কয়েক পা পিছু হটে গেলাম।
মার্ক, আমি কিশোর। এই রূম থেকে কথাবার্তার শব্দ পেলাম। মনে। হলো কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে।
চোখ পিটপিট করল মার্ক। উপলব্ধি করলাম আমাকে দেখার পর এই প্রথম চোখের পাতা ফেলল ও। হঠাই ঢিল হয়ে এল শরীর। আবারও স্বাভাবিক দেখাতে লাগল ওকে।
না, কোন গণ্ডগোল হয়নি, মেট, মুচকি হেসে বলল, বিছানা থেকে দোল খাইয়ে নামিয়ে আনল পা জোড়া। মনে হয় কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মার্ক, এঘরে তর্কাতর্কি চলছিল।
ত্বরিত হেসে উঠল ও।
মনে হয় আবারও ঘুমের মধ্যে কথা বলছিলাম। বাবা-মা বলে মাঝেমাঝেই নাকি বলি।
ঘুমের মধ্যে কথা? দুঃস্বপ্ন দেখেছ নাকি?
মনে পড়ছে না। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল মার্ক। আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। হাই তুলল। ঘুমানো দরকার, বলল।
আর কথা বাড়ানোর সুযোগ নেই, তাই ওর কামরা ছাড়লাম। তবে এখনও আতঙ্কিত আমি। ওরকম গলা আগে কখনও শুনিনি। মানুষের গলা বলে মনে হয়নি।
কুয়াশার এক কুণ্ডলীকেও মার্কের মুখের চারপাশে ঘুরপাক খেতে দেখেছি। মার্কের বিমান ল্যাণ্ড করার সময়ও আমিই একমাত্র কুয়াশা দেখতে পেয়েছিলাম। হয়তো এসবই আমার কল্পনা!
কিন্তু মার্ক আসার পর থেকে যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে সেগুলো তো কাল্পনিক নয়। এখনকার ঘটনাটাও যোগ হলো সেগুলোর সঙ্গে।
মার্ক কথা বলছিল। ঘুমের মধ্যে নয় বলেই আমার বিশ্বাস। আরও কেউ একজন কিংবা কিছু একটা ওর সঙ্গে কামরায় ছিল। কে কিংবা কী। সেটা না জানা অবধি সাবধান থাকতে হবে আমাকে। নিজের স্বার্থেই।
পরদিন নাস্তার টেবিলে সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক মনে হলো। অন্তত উপর-উপর।
আজকে শুক্রবার, চাচী বলল। মার্ক, এই উইকএণ্ডে তুমি কি বিশেষ কিছু করতে বা দেখতে চাও?
হ্যাঁ, দেশে আমি অনেক হাইকিং করি। রকি বীচের আশপাশে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং জায়গা আছে। বেড়াতে গেলে মন্দ হত না, জানাল মার্ক।
ভাল তো। কিশোর, এই উইকএণ্ডে মার্ককে নিয়ে হাইকিং করে আয়, চাচী বলল।
গ্রেট আইডিয়া, চাচা যোগ করল। আমাদের কাছে তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক সবই আছে।
চাচা, তুমি যাবে না? প্রশ্ন করলাম।
না, কাজ আছে। প্লাম্বার আর ইলেকট্রিশিয়ান আসবে পাইপ আর তার পরীক্ষা করতে।
ক্যাম্পিঙে গেলে মার্কের ভাল লাগবে। আশপাশে দেখার অনেক জায়গা আছে। তা ছাড়া কিশোর আর তুমি একে অন্যকে আরও ভালভাবে চিনতেও পারবে, উৎসাহ জুগিয়ে বলল চাচী।
মার্কের সঙ্গে ক্যাম্পিঙে যেতে মন সায় দিচ্ছে না আমার। কিন্তু যেতে চাই না বলি কী করে? কী বলব? মার্ক ছেলেটা অদ্ভুত? এই দুর্ঘটনাগুলো ওই ঘটাচ্ছে? আমাকে লক্ষ্য করে এগুলো ঘটানো হচ্ছে? নাহ, কেউ বিশ্বাস করবে না।
কিশোর, তুই কিছু বলছিস না যে? চাচী জিজ্ঞেস করল। সবাই আমার দিকে চেয়ে।
কথা দিলাম উইকএণ্ডে মার্ককে নিয়ে ক্যাম্পিঙে যাব। খুব মজা হবে। সিরিয়ালের বাইরের দিকে চোখ নামিয়ে মিথ্যে কথাটা বলতে হলো আমাকে।
ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা।
আমরা স্কুলে ঢুকতেই, কয়েকটা ছেলে-মেয়ে আমাদের দিকে ঘুরে চাইল।
অ্যাই, মার্ক, কেমন আছ? মুসা চেঁচিয়ে উঠল।
শার্টটা দারুণ, মার্ক, মৃদু হেসে বলল রবিন।
মার্ক, কাল রাতে বুমেরাং নিয়ে হেভি মজা হয়েছে, বলল শিনা।
মার্ক সবার মনোযোগ পাচ্ছে। নতুনরা পেয়েই থাকে। এতে আমার মন খারাপের কিছু নেই। আমি যদি অস্ট্রেলিয়া যাই, আমাকে নিয়েও মার্কের বন্ধুদের মধ্যে মাতামাতি হবে।
বেল বাজলে যে যার সিটে বসলাম। মিসেস রবার্টস রোলকল করে। সোজা আমার দিকে চাইলেন।
কিশোর, তোমার বুক রিপোর্ট হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন।
জি, মিসেস রবার্টস, জবাব দিলাম।
যার যেদিন বুক রিপোর্ট, তাকে সেদিন ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত বই সম্পর্কে বলে যেতে হয়।
ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবার দৃষ্টিনিবদ্ধ আমার দিকে।
মিসেস রবার্ট ডেস্কে বসে টেপ রেকর্ডার অন করলেন। উনি সব সময় আমাদের রিপোর্ট রেকর্ড করেন, পরে যাতে আমরা স্টাডি করতে পারি।
কিশোর আমাদেরকে আমেরিকান বিপ্লবের ওপর পড়া বইটা সম্পর্কে রিপোর্ট করবে, বললেন মিসেস রবার্টস।
গলা খাঁকরে নিলাম। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে উঠল বোঁ করে। ঘরটা বনবন করে ঘুরছে। টলতে লাগলাম।
কিশোর, কিশোর, তুমি ঠিক আছ তো? বলে এগিয়ে এলেন মিসেস রবার্ট। গোটা ঘরটা নাচছে আমার চোখের সামনে। মার্কের নীল চোখে চোখ পড়ল আমার। একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। পরমুহূর্তে চারদিক আঁধার হয়ে গেল।
১০
চোখ খুললাম। সব কিছু অস্পষ্ট লাগছে। চোখ পিটপিট করলাম।
কিশোর, এখন কেমন লাগছে? মহিলা কন্ঠে প্রশ্ন এল।
কাউচে শুয়ে আমি। কামরার চারদিকে নজর বুলালাম। স্কুল নার্স, মিসেস ডনেলি আমার উদ্দেশে স্মিত হাসলেন। তাঁর পাশে বসে ডক্টর রিচার্ডসন, চোখের ডাক্তার।
উঠে বসলাম। আমি এখানে এলাম কীভাবে? ক্লাসে কথা বলতে যাচ্ছিলাম এটুকু মনে আছে।
কিশোর, এখন কেমন আছ বলো। আমার সাথে কথা বলো, বললেন মিসেস ডনেলি।
চোখ ঘষে ওঁর দিকে চাইলাম।
ভাল আছি।
পরস্পরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসি বিনিময় করলেন ওঁরা।
গুড। তুমি এখন ঠিক হয়ে গেছ। ডক্টর রিচার্ডসন তোমাকে একটু পরীক্ষা করে দেখবেন।
কেন?
তেমন কিছু না। তোমার চোখ দুটোকে খানিকটা আউট অভ ফোকাস মনে হলো, তাই। বললেন ডাক্তার।
পেন্সিল লাইট দিয়ে আমার চোখ পরীক্ষা করলেন তিনি। তারপর মাথা নাড়লেন।
কোন সমস্যা নেই, বলে লাইট নিভালেন। একদম ঠিক আছ তুমি। দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিয়ে।
ঠিক আছে, ডক্টর রিচার্ডসন। একটা প্রশ্ন করতে পারি? জবাব চাইলাম।
নিশ্চয়ই।
লাইট সেনসিটিভিটি নামে কোন চোখের অসুখ আছে? যেজন্যে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরতে হয়?
আমার দিকে চাইলেন ডক্টর রিচার্ডসন।
খুবই বিরল এই রোগ। এসব ক্ষেত্রে আমরা স্পেশাল আই-ড্রপ দিই। কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। এতে চোখের কষ্ট আরও বাড়বে। কেন জিজ্ঞেস করলে কথাটা?
একজনের কাছে শুনেছিলাম কিনা তাই, আসল কথা চেপে গেলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।
তারমানে মার্ক তার চোখের রং পরিবর্তন বিষয়ে মিথ্যে কথা বলেছে। ওর বাদামী চোখ হালকা নীল হলো কীভাবে?
ড. রিচার্ডসন চলে গেলে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
আমি বরং ক্লাসে ফিরে যাই, বললাম মিসেস ডনেলিকে।
কিশোর, ক্লাসে তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে, তার আগে অদ্ভুত এক, ঘটনা ঘটে, বললেন মিসেস ডনেলি।
অদ্ভুত? মনে করার চেষ্টা করলাম। মিসেস রবার্টস এটা টেপ করেছেন শোনো।
টেপ রেকর্ডারের বাটন টিপলেন তিনি। নিজের গলা শুনতে পেলাম। উদ্ভট সব কথা বলে চলেছি।
টেপ রেকর্ডার বন্ধ করলেন মিসেস ডনেলি।
কিশোর, তুমি ক্লাসে কথা বলছিলে।
মনে পড়েছে।
তোমার কী হয়েছিল বলো তো? অপ্রাসঙ্গিক কথা-বার্তা বলছিলে কেন? আমরা তো ভেবেছিলাম হাসপাতালে নিতে হবে তোমাকে।
তার দরকার নেই। আমি এখন ভাল আছি। কী হয়েছিল? আমার ধারণা এর সঙ্গে মার্ক জড়িত। আমি মরিয়ার মত আমার সন্দেহের কথা কাউকে বলতে চাইছি, কিন্তু কাকে বলব? কেউ তো বিশ্বাস করবে না।
কাজেই মিসেস ডনেলিকে বললাম, কাল অনেক রাত অবধি কাজ করেছি বলে ক্লাসে অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি, আবোল তাবোল বকতে থাকি।
ক্লাসরূমে ফিরে এলাম আমি। মুসা আর রবিন দৌড়ে এল আমার কাছে।
এখন কেমন লাগছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল রবিন।
খাইছে! যে ভয় পেয়েছিলাম! বলল মুসা।
আমি ভাল আছি, আশ্বস্ত করলাম ওদেরকে।
মিসেস রবার্টস আমাকে তার ডেস্কে ডেকে নিলেন।
তোমার রিপোর্ট আগামী সপ্তায় দিলেও চলবে। এখন চুপচাপ বসে থাকো। কোন টেনশন কোরো না।
টেনশন করব না! না করে উপায় আছে? মার্ক, কিংবা তাকে যে নিয়ন্ত্রণ করছে সে ক্রমেই পেয়ে বসছে আমাকে। আমার জীবনটা নরক বানিয়ে ছাড়ছে। ভাগ্যগুণে কিংবা মনের জোরে এখন পর্যন্ত অশুভ শক্তির হাত এড়াতে পেরেছি আমি। কিন্তু এভাবে কতদিন?
বাকি সময়টুকুতে অস্বাভাবিক আর কিছু ঘটল না। স্কুলের ঘণ্টা বাজলে বেরিয়ে এলাম আমরা। আজকের আবহাওয়াটা চমৎকার।
ক্যাম্পিঙের জন্যে আদর্শ ওয়েদার, বলল মার্ক।
আমি চুপ করে রইলাম। মুষলধারে বৃষ্টি নামলে খুশি হতাম। ওর সঙ্গে ক্যাম্পিঙে যেতে মোটেই ইচ্ছে করছে না আমার।
সোমবার দেখা হবে! বলল মুসা। ও আর ভুগি যার যার বাইসাইকেলে চাপল।
মুসা, তোমার সাইকেলটা একটু দেবে? দেশে আমি অনেক সাইকেল চালাই, সোৎসাহে বলে উঠল মার্ক।
নিশ্চয়ই, বলে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে ওটা টেনে এগিয়ে দিল মুসা। মার্ক এক লাফে চড়ে বসল সিটে।
দারুণ, বলে ছোট চক্র কেটে ঘুরতে লাগল। হঠাৎই চোখ পড়ল আমার দিকে। ঝিকিয়ে উঠল ওর নীল চোখজোড়া। কিশোর, ডুগিরটায় তুমি চাপো। চলো, এক পাক ঘুরে আসি। ঢিবি পর্যন্ত রেস দিয়ে যাব। আবার ফিরে আসব।
স্কুলের মাঠে রেস দেয়া ঠিক হবে না, বললাম।
সেফ টিবি পর্যন্ত। আজকে শুক্রবার, কেউ কিছু মনে করবে না।
করতেও পারে।
কী, কিশোর, মার্কের সঙ্গে রেস দিতে ডরাচ্ছ নাকি? ডুগি বলল।
এসময় রবিন, ডুগি আর কয়েকটা ছেলে-মেয়ে ওখানে এসে হাজির হলো।
কী হয়েছে? রবিন প্রশ্ন করল।
মার্কের চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পাচ্ছে কিশোর, ডুগি জানাল।
মোটেই না, দৃঢ় গলায় জানালাম। ডুগি, তোমার সাইকেলটা দাও। সাইকেলে চেপে ছোট করে দুচারপাক দিলাম। অভ্যস্ত হয়ে নিয়ে মাথা কঁকালাম মার্কের উদ্দেশে। আমি তৈরি। কেউ একজন কাউন্ট ডাউন করো।
আমি করছি, বলল মুসা। বাইকাররা, যার যার জায়গা নাও।
পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে দাঁড়ালাম মার্ক আর আমি। আমাদের ঠিক সামনে, একশো গজ দূরে ঢিবি। আমরা সাইকেল রেস দিয়ে ওখানে যাব,
ঘুরব এবং ফিরে আসব শুরুর জায়গায়। যে আগে আসবে সে বিজয়ী।
অন ইয়োর মার্ক। গেট-সেট, বলল মুসা। বিরতি নিল। সবাই নীরব। মার্ক আমার দিকে চকিত চাউনি হানল। মনে হলো ওর চোখে মুহূর্তের জন্য কুয়াশা দেখলাম। যাও!
সবাই হৈ-হৈ করে উঠল। ছিটকে বেরিয়ে গেলাম মার্ক আর আমি। পাশাপাশি ছুটে চলেছে দুটো সাইকেল। প্রথমে সামান্য এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর মার্ক, তারপর আবার আমি। এবার মার্ক নাগাল ধরে ফেলল।
ঢিবির দিকে উড়ে চলেছি যেন আমরা। রেসের জয়-পরাজয় এখুনি নির্ধারিত হয়ে যাবে। যথাসময়ে ব্রেক করে, ঘুরে যে ফিনিশ লাইনে আগে ফিরে আসতে পারবে তারই জিত হবে।
প্রতিযোগিতা নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলাম, অন্য কিছুই মাথাতে ঠাই পায়নি। একটু পরেই অনুভব করলাম সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই ঘটছে। বাইকটা মসৃণ গতিতে চলেছে, উল্টোপাল্টা কোন ব্যাপার নেই।
ঢিবিটা আর মাত্র পনেরো গজ দূরে। মার্ক ঠিক আমার পাশে টার্নিং পয়েন্টে। একসঙ্গে পৌঁছলাম আমরা, মার্ক ঘুরে চাইল আমার দিকে, দীপ্তি ছড়াল ওর চোখজোড়া।
চোখ সরিয়ে নিলাম আমি, ঘোরার জন্য ব্রেক চাপলাম। কিন্তু যতবারই ব্রেক চাপছি, বাইক ততই আরও জোরে ছুটছে! ঢিবিটা ঠিক আমার সামনে। থামতে পারছি না আমি। প্রচণ্ড গতিতে খাড়া ঢিবি থেকে তালগোল পাকিয়ে পড়ে যেতে চলেছি আমি!
১১
আগে কখনও এই ঢিবির ঢাল বেয়ে নামিনি। কেউ নামেনি। কাজটা অবৈধ, যেহেতু বিপজ্জনক। ঢিবির চূড়া থেকে যখন উড়ে গেল বাইকটা, আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। ঘাবড়ালে চলবে না।
ব্রেক আর কষলাম না। বাইকটা ঊর্ধ্ব গতিতে ছুটে চলেছে এখনও। আর ধরে থাকতে পারছি না। মনটাও বাইকের গতিতে রেস দিচ্ছে। তলপেট ফাঁকা। বাতাসের ঝাপ্টা এসে লাগছে মুখে। ঢিবির পাদদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে! এবার মাথায় একটা চিন্তা ঘাই মারল। ব্রেক চাপলে যদি বাইক আরও জোরে ছোটে, তা হলে হয়তো উল্টোটাও সত্যি।
পেড়ালে দুপা রেখে বনবন করে ঘুরাতে লাগলাম।
হ্যাঁ, সহসাই ধীর হয়ে এল বাইকের গতি!
ঢাল বেয়ে তখনও নেমে চলেছে বাইকটা, কাজেই নীচে নামা না পর্যন্ত পুরোপুরি থামবে না। তবে গতিটা আমি কমাতে পেরেছি। মিনিট খানেকের মধ্যে ঢিবির নীচে নেমে এসে নিরাপদে থেমে দাঁড়াতে পারলাম।
ঢিবির চূড়ার দিকে চোখ তুলে চাইলাম। ঢোক গিলোম। সবাই দাঁড়িয়ে ঢিবির মাথায়। আমার দিকে চেয়ে তলার উদ্দেশে আঙুল নির্দেশ করছে। হয়তো আমার দুঃসাহসের কথা বলাবলি করছে।
বাইকটাকে হটিয়ে নিয়ে ঢিবি বেয়ে উঠতে লাগলাম।
কিশোর, কী হয়েছিল? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আমরা তো ভেবেছিলাম মারাই যাবে বুঝি। নীচে নামতে গেলে কেন?
কোথায় থামতে হবে বুঝতে পারিনি, বলে মার্কের দিকে চাইলাম। তুমি জিতে গেছ, মার্ক।
তুমি বিপদকে জয় করেছ। তুমিই বিজয়ী, মেট, বলল মার্ক। পরীক্ষায় উতরে গেছ তুমি।
কীসের পরীক্ষা? কার কাছে পরীক্ষা? যে বা যা কাল রাতে মার্কের সঙ্গে কথা বলছিল তার কাছে? এই পরীক্ষার পিছনে কি কোন ধরনের পরিকল্পনা ছিল? এর শেষ কখন, কোথায়? মার্ক কি জানত? জানলেও বলবে না। জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ নেই। আমাকে স্রেফ সতর্ক থাকতে হবে পরের পরীক্ষাটার জন্য।
আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে এই উইকএণ্ডে। মার্ক আর আমি যখন ক্যাম্পিঙে যাব।
শনিবার সকালে ক্যাম্পিঙের জিনিসপত্র গোছগাছ করলাম। পাপ টেণ্ট পরিষ্কার করলাম, স্লিপিং ব্যাগ টান-টান করে নিলাম, গ্যাস ল্যাম্প আর ফ্ল্যাশলাইট পরখ করলাম, চাচীর দেওয়া খাবার আর বেভারেজ প্যাক করলাম।
দুজনের পরনেই জিন্স, সোয়েটশার্ট আর ব্যাকপ্যাক, শনিবার বিকেল নাগাদ তৈরি হয়ে গেলাম আমরা ক্যাম্পিঙের জন্য।
কিশোর, তুই যেহেতু এলাকাটা চিনিস, কাজেই তুই-ই লিডার। এটা নিরাপদ এলাকা। রাতে যখন ক্যাম্প করবি নিরাপদ, শুকনো দেখে একটা জায়গা বেছে নিবি। আর মনে রাখবি ডাকলেই যেন একজন আরেকজনের গলা শুনতে পাস, চাচা পরামর্শ দিল।
মনে থাকবে, চাচা, বললাম।
তোদের ভাল সময় কাটুক, চাচী বলল। দুজনকেই জড়িয়ে ধরল। কালকে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবি কিন্তু, মনে থাকে যেন।
সায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। প্রথম কয়েক ঘণ্টা শহরের পিছনের বনভূমি ভেদ করে এগোলাম।
আমাদের দেশে এরকম বন নেই, বলল মার্ক। শেষ বিকেল। বিশ্রাম নিতে থেমেছি আমরা। জঙ্গলের ভিতরে, এক টুকরো ফাঁকা জায়গায় বসেছি দুজনে, লেমোনেড পান করছি।
জানতাম তোমার ভাল লাগবে, বললাম।
আমি আসলে খানিকটা হোমসিক হয়ে পড়েছি, বলল মার্ক। যেদিন এলাম সেদিন জলাভূমির উপর দিয়ে এসেছিলাম। ঠিক আমার অস্ট্রেলিয়ার মত লেগেছিল। ওখানে হাইকিং করলে কেমন হয়, মেট? রাতে আমরা যদি ওখানে ক্যাম্প করি?
জলাভূমি! মার্ক সবচাইতে ভুতুড়ে জায়গাটা বেছে নিয়েছে রাত কাটানোর জন্য।
জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, বললাম।
তাতে সমস্যা নেই। তবু আর ব্যাগগুলো ওয়াটারপ্রুফ। জায়গাটা একনজর দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
ও নীল চোখ মেলে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার দিকে। ভয় পেয়েছি বোঝানো যাবে না। জানি পালিয়ে লাভ হবে না। শোডাউন যদি জলাভূমিতে হয় তো হোক।
কাজেই রাজি হয়ে গেলাম আমি। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে। হৃৎপিণ্ড।
অনেকটা পথ হাইক করে জলাভূমিতে পৌঁছতে হলো। দূর থেকে এয়ারপোর্ট চোখে পড়ছে।
তুমি ওখানে ল্যাণ্ড করেছিলে, বললাম।
হ্যাঁ। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও। আঁধার হয়ে আসছে। এটা রাত কাটানোর জন্যে চমৎকার জায়গা।
দুটো লম্বা উইলো গাছের মাঝে শুকনো এক স্পট খুঁজে নিলাম আমরা। দূরাগত ব্যাঙের ডাক কানে আসছে। কয়েকটা জোনাকি পোকা উড়ে গেল। এখন গোধূলি, অতটা গা ছমছম করছে না। তবে শীঘ্রিই করবে।
পরের বিশটা মিনিট তাঁবু খাটাতে আর ব্যাগ বিছাতে কেটে গেল। এবার ডিনারের ব্যবস্থা করলাম। ফ্র্যাঙ্কস আর বিনস।
মাটিতে বিছানো এক কম্বলের উপর বসেছি দুজনে, নিঃশব্দে ডিনার সারছি। ইতোমধ্যে আঁধার ঘনিয়েছে। প্রদীপ জ্বেলেছি আমি।
মার্ক খাওয়ার সময় একদৃষ্টে প্রদীপের আলোর দিকে চেয়ে রইল। অগ্নিশিখায় স্থির ওর দুচোখ।
আচমকা আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল ও।
ঘুমিয়ে পড়িগে যাই, বলে উঠে দাঁড়াল। তুমি এখন ঘুমাবে নাকি আরও খানিকক্ষণ জেগে থাকবে?
আরেকটু জাগি, বললাম। আসলে প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করছি, কিন্তু মার্ক গভীর ঘুমে তলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ঘুমাতে চাই না।
মার্ক তাঁবুতে গিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকল। ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরে।
আমি বাইরে প্রদীপের আলোর নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকলাম। শান্ত, আরামদায়ক পরিবেশ। এখানে কোন বিপদ হবে না, ভাবলাম। ভুল ভেবেছিলাম। এজায়গাটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরঞ্চ উল্টো-চমৎকার জায়গা। চোখজোড়া ভারী হয়ে আসছে। শিথিল হয়ে আসছে শরীর।
কিশোর, চাপা এক কণ্ঠস্বর কানে এল। অ্যাই, কিশোর, চোখ খোলো।
চোখের পাতা তিরতির করে কেঁপে উঠল। তন্দ্রা কেটে গেছে। কেউ কি ডাকল আমার নাম ধরে?
মার্ক? বলে উঠে বললাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম প্রদীপের পাশে বসে।
মার্ক এখন সচেতন নয়, কিশোর। ও তোমার কথা শুনতে পাবে না। আমি পাব। এবং সেটাই তোমার দরকার।
চোখ পিটপিট করলাম। কণ্ঠটা পরিচিত। মার্ক ওর কামরায় এর সঙ্গেই তর্কাতর্কি করছিল। চোখ তুলে চাইতেই কুয়াশাচ্ছন্ন, ধোঁয়াটে এক অবয়ব দেখতে পেলাম। সারা শরীর ধূসর, শুধু একটা জিনিস বাদে। একজোড়া অন্তর্ভেদী, ঝিকিমিকি নীল চোখ!
১২
পরীক্ষা শেষ, কিশোর। তুমি ভাল করেছ, প্রতিবারই পাস করেছ তুমি। তুমি হবে আমার পারফেক্ট হোস্ট।
তারমানে? কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। কে আপনি? কী আপনি?
কিশোর, তুমি জান আমি কে। আমি ক্যাপ্টেন স্টার। ওরা আমাকে ল্যাণ্ড করতে দেয়নি, কিশোর। আমার আত্মা এতদিন ধরে সুন্দর একটা ল্যাণ্ডিঙের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সেই সুযোগ পেয়ে গেছি আমি। তুমি আমার আত্মাকে তোমার দেহে ধারণ করবে। তুমি হবে আমার হোস্ট, আবারও বলল ছায়ামূর্তিটা।
তাঁবুর দিকে পিছিয়ে গেলাম। কুয়াশাময় জিনিসটার দিকে চোখ সেঁটে আছে আমার। কিন্তু ক্রমেই সরে যাচ্ছি আমি ইঞ্চি-ইঞ্চি করে।
আপনি মার্কের শরীরের ভিতরে ছিলেন, তাই না? প্রশ্ন করলাম। ছায়াময়কে কথা বলিয়ে সময় পেতে চাইছি।
হ্যাঁ, সেদিন ওর প্লেন যখন কুয়াশার মধ্যে ঢুকল তখন ওর দেহে প্রবেশ করি আমি। ওকে ব্যবহার করে আমি তোমার কাছে আসি। তোমাকে পরীক্ষা করে দেখি, তুমি আমার উপযুক্ত মেজবান হতে পারবে কিনা। তুমি প্রতিটা পরীক্ষায় পাস করেছ, কিশোর। খলখল করে হাসল, ওটা। তোমাকে দিয়ে উল্টোপাল্টা কাজ করিয়েছি। তোমার সাথে উল্টোপাল্টা ব্যবহার করা হয়েছে। ঠাণ্ডা পানির বদলে গরম পানি, এয়ারকণ্ডিশনার থেকে গরম বাতাস বেরনো-এসবের কথা বলছি। তুমি প্রতিটা পরীক্ষায় উতরে গেছ। শেষমেশ পেডাল মেরে বাইক পর্যন্ত থামিয়ে ফেলেছ। হবে, কিশোর, তোমাকে দিয়ে হবে!
আপনি আমাকে আপনার আত্মার হোস্ট বানাতে চান কেন? জিজ্ঞেস করলাম। আমি থমকে দাঁড়িয়েছি ব্যাকপ্যাকের কাছে। ওটা আমার পিছনে। ডান পায়ের পিছনের অংশ ছুঁয়ে আছে ব্যাকপ্যাকটাকে।
কারণ আমি শেষ পর্যন্ত ল্যাণ্ড করতে চাই, কিশোর। তোমার শরীরে প্রবেশ করে, তোমার মন আর আত্মাকে দখল করে আমি সুযোগটা পেতে চাই! আমি কিশোর পাশা বনে যাব। সবাই যাকে ভালবাসে। আমরা দুজনে মিলে সবার উপরে প্রতিশোধ নেব। এই শহর বহু বছর আগে আমার সাথে যা করেছে তার প্রতিশোধ!
ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকাচ্ছি আমি।
ওরা বহু বছর আগে আপনার সাথে কী করেছিল, ক্যাপ্টেন স্টার? জবাব চাইলাম। আমার কণ্ঠস্বর জোরাল শোনালেও শব্দগুলো মুখ থেকে বের করতে কষ্ট হলো-দাতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে।
ওরা আমাকে ল্যাণ্ড করতে দেয়নি! আর এই কুয়াশা আমার শরীর দখল করে নেয়। আমাকে বন্দি করে, আকারহীন, অবয়বহীন এক অস্তিত্বে পরিণত করে। নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছ! চেঁচিয়ে উঠল ওটা।
মায়াই লাগল ওটার প্রতি। কিন্তু তাই বলে ছায়ামূর্তিটার ধারক হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই আমার। এখন, রক্ষা পাওয়ার একটাই মাত্র উপায়। সরাসরি ওটার চোখের দিকে চাইলাম।
ঠিক আছে, আমি রাজি, বললাম।
ধন্যবাদ, কিশোর। দখলের জন্যে প্রস্তুত হও। আমাদের দীর্ঘ প্রতিশোধপরায়ণ জীবন শুরু হোক!
নীল চোখজোড়া ধকধক করে জ্বলছে। কুয়াশা পাকিয়ে উঠে সোজা, সরু এক স্তম্ভে রূপ নিয়েছে। আমার দিকে পাক খেয়ে নেমে আসছে এ
কোন ভুল-চুক করা চলবে না।
আমার হাতে এক কি দুই সেকেণ্ড মাত্র সময়।
কুয়াশা চেপে আসছে আমার উপরে। আর মাত্র কফুট বাকি, এখুনি মাথা ছুঁয়ে ফেলবে!
ব্যাকপ্যাক থেকে এক টানে ফ্ল্যাশলাইটটা বের করলাম। পরমুহূর্তে সুইচ টিপে সোজা তাক করে ধরলাম আগুয়ান কুয়াশার কুণ্ডলীটার উদ্দেশে।
না! করুণ চিৎকার উঠল। আলোয় ধরা পড়েছে কুয়াশা। আলোর রশ্মি ধরে রেখেছি, ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে লাগল ওটা। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। শেষ অবধি রইল শুধু অল্প একটুখানি ধোঁয়া আর একজোড়া তীক্ষ্ণ, নীল চোখ। চোখজোড়া আমার দিকে শেষবারের মত অগ্নিদৃষ্টি হেনে আবছা কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।
১৩
কী ভেবে ফ্ল্যাশলাইট অন করলে, মেট? মার্ক জানতে চাইল।
পরদিন সকাল।
জলাভূমি ভেদ করে বাড়ির পথে চলেছি।
তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পরপরই তুমি একটা কথা বলেছিলে, জবাব দিলাম। বলেছিলে প্লেন ল্যাণ্ড করার ঠিক আগ মুহূর্তে কেবিনের বাতিগুলো নিভু নিভু হয়ে আসে। আমার ধারণা সে সময়ই ক্যাপ্টেনের আত্মা তোমার শরীরে প্রবেশ করে। ওটা হয়তো আলো সইতে পারে না, তাই কাজটা আঁধারেই সেরেছে।
মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক, স্বস্তির হাসি হেসে বলল মার্ক। ওর দিকে চেয়ে মুচকি হাসলাম। কুয়াশা উবে যাওয়ার পরপরই ঘুম ভাঙে মার্কের। ওর চোখের দিকে চেয়ে দেখেছি আগের স্বাভাবিক বাদামি রং ফিরে পেয়েছে।
বুড়োর আত্মা আমার শরীরে ঢোকার পর থেকে ভয়ঙ্কর সময় কেটেছে। তোমাকে বলতেও পারি না, সইতেও পারি না-সে এক বিশ্রী অবস্থা, বলল মার্ক।
তোমার তো কোন দোষ নেই। তুমি ওর নিরীহ এক শিকার। আর তুমি যদি কেবিনের বাতি নেভার কথা না বলতে, ফ্ল্যাশলাইট জ্বালার কথা মাথায় আসত না আমার। কাজেই, আমরা দুজনে একসাথে দুষ্ট আত্মাকে হারিয়েছি। আমরা একটা দল হিসেবে কাজ করেছি।
পরস্পরের হাত ঝাঁকিয়ে দিলাম আমরা।
বাসায় ফিরতে কতক্ষণ লাগবে বলতে পারো? মার্কের প্রশ্ন।
দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাব।
এখন কটা বাজে? রিস্টওয়াচ দেখলাম।
এগারোটা প্রায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে রয়েছি। হঠাই হাঁটার গতি ধীর হয়ে এল।
কী হলো?
জবাব দিলাম না। দিতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে। বড় কাঁটাটা বারোটার ঘরের উদ্দেশে এগোচ্ছে। ছোট কাটাটা এগারোর ঘরে।
আমার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে সেকেন্দ্রে কাটা। পিছন দিকে চলেছে ওটা।
ঠিক সে মুহূর্তে, মনে হলো আকাশে পুরানো এক বিমানের এঞ্জিনের শব্দ শুনলাম। মুখ তুলে চাইলাম। কিছু নেই। স্রেফ স্বচ্ছ নীল আকাশ।