ভুতুড়ে ফুটবল – গোয়েন্দা ভাদুড়িমশাই – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
“এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার, মামাবাবু!” হাতের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কৌশিক বলল, “আমাদের জার্নালিস্টদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এদের কি কাণ্ডজ্ঞান বলে। কিছু থাকতে নেই?”
কথাটা ভাদুড়িমশাইয়ের উদ্দেশে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। সম্ভবত কিছু শুনতেই পাননি। না-পাওয়াই স্বাভাবিক। কেন না, নিবিষ্টচিত্তে তিনি এখন ইস্টার্ন কুরিয়ার’-এর আজকের ওয়ার্ড-জাম্বলের উত্তর খুঁজছেন।
নিজে যেহেত খবরের কাগজে কাজ করি, তাই কী খবর দেখে জার্নালিস্টদের কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কে কৌশিকের হঠাৎ সন্দেহ দেখা দিল, এই পালটা প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু মুখ খুলবার ফুরসত পেলুম না, সদানন্দবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, “ঠিক বলেচ, লাক কতার এক কর্তা বলেচ! আরে ছ্যা ছ্যাঁ, এই কি তোদের কাণ্ডজ্ঞান? দেকতে পাস না চোকের সামনে কী হচ্চে?”
অরুণ সান্যাল একটা সদ্য-আসা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। সেটা সরিয়ে রেখে বললেন, “কী হচ্ছে বোসদা?”
“বাঃ, তাও বলে দিতে হবে?” সদানন্দবাবু তার গলার পর্দা আরও এক ধাপ চড়িয়ে বললেন, “শহরটা যে চোর ছ্যাচড়ে আর গুণ্ডা-বদমাসে ভরে গেল, মশাই! আজ এখোনে ফ্ল্যাটে ঢুকে বন্দুক উঁচিয়ে ডাকাতি করছে তো কাল ওভেনে দিন-দুপুরে বোম ফাটিয়ে টাকার থলে কেড়ে নিচ্ছে! আর খবরের কাগজের লোকগুলোও হয়েছে তেমনি। এই যে ল-লেসনেস, কোতায় এর এগেস্টে রোজ একটা করে কড়া এডিটোরিয়েল লিকবি, তা নয়, তোরা আছিস শুদু পলিটিকস নিয়ে! কে কাকে নিকম্মার ধাড়ি বলেচে আর কার বউ। সরকারি বাড়িতে খাটাল বসিয়ে লাখ টাকার দুধ বিক্রি করচে! তা বলুক না, করুক না! নিকম্মাই বলুক আর অকম্মাই বলুক, দুধই বেচুক আর রাবড়িই বেচুক, তাতে তোর কী! খালি পলিটিক্স আর পলিটিকস! ঠিক বলেচ কৌশিক বাবাজি, এই পলিটিক্সই আমাদের ডুবিয়ে ছাড়ল!”
কৌশিক বলল, “যাব্বাবা! আমি মোটেই পলিটিকসের কথা ভাবছি না।”
সদানন্দবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “পলিটিক্স নয়? তা হলে?”
ভাদুড়িমশাইয়ের জাম্ব মিলে গিয়েছিল। মৃদু গলায় বললেন, “হয়েছে। একটা ‘ই’ পাচ্ছিলুম না। তা উলটে-পালটে ‘সেনল্যাক’ যদি ক্যানসেল হয় তো তার মধ্যেই তো ‘ই’ পেয়ে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে ম্যাজিক ওয়র্ডটা তা হলে দাঁড়াল ‘ক্রিকেট’। ও হ্যাঁ, তুই যেন কী বলছিলি কৌশিক?”
“আমি পলিটিক্সের কথাও ভাবছিলুম না, ক্রিকেটের কথাও ভাবছিলুম না। যেখানে মাত্তর একশো কুড়িটা রান দরকার, সেখানে একশো রান তুলতেই যাদের কালঘাম ছুটে যায়, তাদের নিয়ে আবার ভাববার কী আছে?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তা হলে?”
“আমি ভাবছিলুম ফুটবলের কথা।”
“অ্যাঁ, ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলটা কি আমরা ভাল খেলছি নাকি?”
“চুনি-পি কেবলরামের সময়ে যা খেলতুম, সেই তুলনায় অর্ধেক ভালও খেলছি না; তবে হ্যাঁ, মাঝখানে যে অধঃপতনটা ঘটেছিল, সেটা একটু সামলে নেওয়া গেছে। এবারকার ন্যাশনাল লিগ আর নেহরু কাপের খেলা দেখে অন্তত সেইরকমই মনে হল।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইল কৌশিক। তারপর বলল, “কিন্তু মুশকিলটা কী হয়েছে জানো বাবা?”
অরুণ সান্যাল ফুটবল বলে কথা নেই, কোনও খেলারই খবর বিশেষ রাখেন না। মাঠ-ময়দানের ব্যাপার-ট্যাপার নিয়ে আসলে কোনও উৎসাহই নেই তার। তবু ছেলের কথার উত্তরে কিছু একটা না বললে ভাল দেখায় না বলেই আমতা-আমতা করে বললেন, “কেন, আবার কী মুশকিল হল?”
“কী মুশকিল হল, সেটা কিরণমামাকে জিজ্ঞেস করো।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই তোমরা মানে জার্নালিস্টরাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ফুটবলে আমাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফের লাইনটা যেই না একটু উপরে উঠতে শুরু করেছে, অমনি তোমরা এমন হই-হই বাধিয়ে দিলে যে, আর দেখতে হবে না, লাইনটা আবার মুখ থুবড়ে পড়ল বলে!”
কথার ঝাঁঝ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল কৌশিক বেশ রেগে গেছে। কিন্তু রাগের কারণটা যে কী, সেটাই ঠিক ধরতে পারছিলুম না। ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু আর অরুণ সান্যালের মুখ দেখে মনে হল, তারাও কিছুই ধরতে পারেননি। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বুঝিয়ে বলবি?”
সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু বুজিয়ে বলো তো।”
“এর মধ্যে আর বোঝাবুঝির কী আছে?” কৌশিক তার হাতের ‘বিশ্ববার্তা’ কাগজখানা আমার দিকে এগিয়ে ধরে, খেলার পাতার একটা তিন-কলম-জোড়া হেডলাইনের উপরে আঙুল রেখে বলল, “পড়ে দ্যাখো, তা হলেই সব বুঝতে পারবে।”
বিশাল টাইপের বিরাট হেডলাইন, ‘যে গোল দেখলে পেলে আর মারাদোনাও তাজ্জব হয়ে যেত!
সদানন্দবাবু বললেন, “পড়ে শোনান, পড়ে শোনান, আমরাও শুনতে চাই।”
অগত্যা যেমন হেডলাইন তেমন কোচি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনও পড়ে শোনাতে হল। বিশ্ববার্তার স্পোর্টস রিপোর্টার ধনঞ্জয় চাকলাদার লিখছেন : “উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের আই, এম, বিজয়ন যে গোলটি করলেন, তাকে বিশ্বমানের গোল বললেও খুব কমই বলা হয়, কেন না ইউরো কাপ আর কোপা আমেরিকার কোনও খেলাতেই এমন অত্যাশ্চর্য গোল দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। এমন কী, গত তিন বারের বিশ্বকাপেও না। দুদিকে দুই হুমদো-জোয়ান উজবেক ডিফেন্ডার, ভাল করে ঘুরে দাঁড়াবার জায়গাটুকু না রেখে তারা বিজয়নের গায়ের সঙ্গে একেবারে আঠার মতন সেঁটে রয়েছে, অথচ তারই মধ্যে সামান্য একটু টলে গিয়ে, বলটাকে অল্প তুলে নিয়ে, মুখ না ঘুরিয়েই বিজয়ন যে বাইসিকল কিক করলেন, গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে তাতেই বল গিয়ে জালে জড়িয়ে গেল। এ একেবারে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। দর্শকরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেননি, তারপরেই তারা উল্লাসে ফেটে পড়েন। উন্নাস স্বাভাবিক, কেন না অনেক ভাগ্য করে জন্মালে তবেই এমন একটি গোল দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, পেলে আর মারাদোনাও এই গোল দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতেন। তবে আমার ধারণা, ভারতের মাঠে এই ধরনের গোল হয়তো আমরা আর দেখতে পাব না, কেন না বিদেশিরাও বিজয়নের এই খেলা টিভির পর্দায় দেখেছে নিশ্চয়, এবং এই গোলের পরে ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, স্পেনের রিয়েল মাদ্রিদ, হল্যান্ডের আয়াক্স, ইতালির এ সি মিলান ও আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স থেকে বিজয়নের ডাক পড়তে বাধ্য। আসন্ন, অনিবার্য সেই দিনটিকে আজ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এইসব বিশ্ববিখ্যাত ক্লাবের ধনকুবের কর্তারা যখন চেকবই হাতে নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনের জাম্বো জেট থেকে দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই কি চেন্নাই এয়ারপোর্টে এসে নামবেন ও নেমেই কানেকটিং ফ্লাইট ধরে যাত্রা করবেন তিরুবনন্তপুরমের দিকে, এবং…”
.
“থাক্, থাক্, কিরণমামা, আর পড়ার দরকার নেই।” পুরো সেনটেন্সটা কমপ্লিট করার আগেই কৌশিক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যেটুকু পড়েছ, তাতেই তোমাদের জার্নালিস্টদের কাণ্ডজ্ঞানের বহরটা টের পাওয়া যাচ্ছে, এর পরে তুমি নিজেই বোধহয় বিষম খেতে শুরু করবে!”
কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই আর অরুণ সান্যাল মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসির বেগ সামলাচ্ছেন। তারই মধ্যে সদানন্দবাবুকে দেখে একটু অবাক হতে হল। কেন না, একমাত্র তারই মুখে হাসি নেই। গম্ভীর গলায় বললেন, “এতে এত হাসির কী আচে?”
কৌশিক বলল, “নেই? তার মানে আপনিও মনে করেন যে, ভাল একটা গোল করেছে বলেই বিশ্ববিখ্যাত এইসব ক্লাব অমনি বিজয়নকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেবে?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডেসক্রিপশান থেকে তো মনে হচ্ছে…মানে অন্য সব কাগজও দেখলুম তো…তাতে তো বলতেই হয় যে, গোলটা সত্যিই চমৎকার দিয়েছে।”
“আহা-হা, আমি কি বলছি যে, ওটা চমৎকার গোল নয়? অফ্ কোর্স ইট ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট গোল! কিন্তু তাই বলে যদি কেউ বলে যে, পেলে আর মারাদোনাও এই গোলটা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেত, তো আমি বলব তার কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিসসু নেই!”
“দ্যাকো কৌশিক, সদানন্দবাবু বললেন, “এর মদ্যে তুমি দু-দুবার পেলে আর মারাদোনার নাম করেছ। তো একটা কতা তোমাকে জিগেস করতে পারি?”
“করুন।”
“এঁয়ারা কারা?”
“যাব্বাবা,” হতভম্ব হয়ে কৌশিক বলল, “এরা কারা, আপনি জানেন না? এঁরা হচ্ছেন সেই তারা, ফুটবলে যাদের অল-টাইম গ্রেট বলা হয়। কেন, টিভিতে আপনি মারাদোনার খেলা দেখেননি?”
সানন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হল না যে, কৌশিকের কথা শুনে তিনি বিন্দুমাত্র দমে গিয়েছেন। একই রকমের গম্ভীর গলায় বললেন, “না হে, দেকিনি। কিন্তু তাতে হলটা কী?”
কৌশিক হেসে বলল, “কী আর হবে, একজন জিনিয়াস কীভাবে ফুটবলটাকে নিয়ে যা-খুশি তা-ই করতে পারে, সেটা দেখতে পাননি, এই আর কী।”
“বটে? তা ফুটবল নিয়ে যা-খুশি তা-ই কি একা ওই লোকটাই করতে পারত?”
“আর-কেউ পারত…মানে পেলের পরে এক ওই মারাদোনা ছাড়া আর কেউ পারত বলে তো জানি না।” ঠাট্টার গলায় কৌশিক বলল, “কেন, আপনি কি জানেন নাকি?”
সদানন্দবাবু তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। চা এসে গিয়েছিল। নিজের পেয়ালায় আলতো একটা চুমুক দিয়ে পেয়ালাটাকে ধীরেসুস্থে পিরিচের উপর নামিয়ে রেখে তিনি কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “হাবল। বাঁড়ুজ্যের খেলা দেকেচ?”
এবারে কৌশিকেরই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার পালা। আমতা-আমতা করে বলল, “না
“কী করেই বা দেকবে।” ঠোঁট বেঁকিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “তোমার তো কতাই ওটে না, তোমার বাবাও তখনও জন্মাননি।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “অ্যাঁ, বলেন কী! তিনি কবেকার মানুষ?”
“ফাস্ট ওয়ার্লড ওয়ার তো ১৯১৪ সালে লাগে, তিনি তারও বারো বছর আগে, অর্থাৎ নাইনটিন হানড্রেড টু’তে জন্মেছিলেন। ছেলেবেলায় আমরা তার খেলা দেকিচি। উঃ, সে কী খেলা রে বাবা, হরিচরণ মেমোরিয়াল শিল্ডের খেলায় উঁচড়ো ইউনাইটেডকে একাই এক ডজন গোল দিয়েছিলেন।”
কৌশিক বলল, “কলকাতায় খেলতেন?”
“আমাদের ময়দানের কতা বলছ তো? মাত্তর একবারই এখেনে খেলতে নেবেছিলেন। এ হল নাইনটিন টুয়েন্টির কতা। গোরা টিমের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। সায়েবগুলোকে তাতেই এমন কঁদিয়ে ছাড়েন যে, সেই রাত্তিরেই গলির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তারা একজন মেসেঞ্জার পাটিয়ে দেয়। মেসেঞ্জার গিয়ে হাকিমকে বলে, স্টপ দিস হালা বাঁড়ুজ্যে, ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনে ওর মুভমেন্ট রেসট্রিকট করো, ওকে যদি কলকাতায় আসতে দাও, তা হলে এখেনে ল অ্যান্ড অর্ডার মেনটেন করা যাবে না, ব্রিটিশ গবরমেন্টের প্রেস্টিজ ও একেবারে পাংচার করে দেবে। ব্যস, হালা বাঁড়ুজ্যে তার পরদিন তারকেশ্বর লাইনের নসিপুরে তার বাড়িতে ফিরতেই কুম জারি হয়ে গেল যে, হুগলি জেলার চৌহদ্দি ছেড়ে তিনি কোতাও যেতে পারবেন না। তার ফল কী হল, ভাবতে পারো?”
“কী হল?”
“নাইনটিন টুয়েন্টিতেই মোহনবাগান ফর দি সেকেন্ড টাইম আই এফ এ শিল্ড জেতার যে চেষ্টা চালাচ্ছিল, আর তার জন্যে হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে টিমে ঢোকাবার ব্যবস্থা একেবারে পাকা করে ফেলেছিল, সেটা আর সাকসেসফুল হল না।”
“এ সব কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?”
“কেন, আমার বাবার কাছে।” চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “ওহে বাপধন, সারা জীবন সায়েব চরিয়ে খেয়েচি, সায়েব চিনতে আর আমার বাকি নেই। ওদের মদ্যে আমাদের কোম্পানির জেঙ্কি সায়েবের মতো ভাল মানুষ যেমন আচে, তেমনি কুচুটে বজ্জাতও কি কিছু কম আচে নাকি? তা যদি না থাকত, তো মারাদোনার নাম না কপচে তোমরা আজ হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে মাথায় তুলে নাচতে।”
ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তার চোখের মধ্যে ঈষৎ কৌতুকের ছোঁয়া লেগেছে, তবে হাসিটাকে তিনি ঠোঁট পর্যন্ত আসতে দিচ্ছেন না। বললেন, “একটু আগে বলছিলেন যে, ছেলেবেলায় আপনি তার খেলা দেখেছেন। এটা কোথায় দেখলেন?”
“সিঙুরে।” সদানন্দবাবু বললেন, “তারকেশ্বর বলতে যে জায়গাটা আপনারা বোজেন, আমরা তো ঠিক সেখেনকার লোক নই। ওর খুব কাঁচেই হচ্ছে সিঙুর। আমরা সেই সিঙুরের বাসিন্দা। সেখানকার মাঠে হাবলা বাঁড়ুজ্যের খেলা আমি ফর দি ফাস্ট টাইম দেকি। আমার বয়স তখন আব কত হবে, মেরেকেটে পাঁচ কি ছয়। সেদিনকার খেলার ডিটেলস আমার মনে নেই, তবে এটা ভুলিনি যে, হাফটাইমের আগেই একটা লোক দমাদ্দম চার-পাঁচটা গোল হাঁকড়ে দিয়েছিল। পরে শুনলুম, সে-ই হচ্চে হাবলা বাঁড়ুজ্যে।”
“দ্বিতীয়বার তাঁর খেলা কবে দেখলেন?”
“ইন দি ইয়ার নাইনটিন ফফটি টু।” সদানন্দবাবু বললেন, “জাপানিরা হাতিবাগানে বোমা ফেলেছিল বলে আমরা সেবার কলকাতার পাট তুলে দিয়ে মাস ছয়েকের জন্যে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।”
“নাইনটিন ফর্টি টু?“ ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারই হিসেবে হাবলা বাঁড়ুজ্যের বয়েস তো তখন চল্লিশ হয়ে গেছে!”
“তা তো হয়েইছে। কিন্তু এই বুড়ো হাড়েই যা ভেলকি দেকালেন না…উফ!” সদানন্দবাবু দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “অপূর্ব, অপূর্ব! সেই খেলাতেই তো চুচড়ো ইউনাইটেডকে গুনে-গুনে এক ডজন গোল দেন! কী বলব মশাই, খেলাটা যেন এখনও আমার চোকের সামনে ভাসচে! ইদিকে হাল্লা, ওদিকে হালা, সিদিকে হাল্লা…যেদিকে তাকাই, শুধু হাল্লা আর হাল্লা! গোটা মাঠে তাকে ছাড়া কাউকে দেতে পাই না! ভাবা যায়?”
একটুক্ষণের জন্য চুপ করলেন সদানন্দবাবু। তারপর একটু গলা নামিয়ে বললেন, “কিন্তু তার এক হপ্তা বাদেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা! উঃ, সেকতা ভাবলে এখনও গায়ে কঁটা দেয়।”
কৌশিক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সদানন্দবাবুর শেষ কথাটায় একটা রোমাঞ্চকর গল্পের গন্ধ পেয়ে যাওয়ায় অরুণ সান্যাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আঃ, তুই দেখছি বকরবকর করেই সক্কলের মাথা ধরিয়ে দিবি। একটু চুপ কর তো। …নিন বোদা, কী ঘটেছিল বলুন।”
আজ রবিবার, ৬ এপ্রিল। কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে ভাদুড়িমশাই গত শুক্রবার কলকাতায় এসেছেন। কৌশিক বুধবার বাঙ্গালোরে ফিরে যাবে, কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাঁর সি বি আই অর্থাৎ চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশনসের একটা আপিস যেহেতু এখানেও খুলতে চান, তাই পুরো মাসটাই তার কলকাতায় কাটাবার সম্ভবনা। কথা শুরু হয়েছিল এই আপিস ভোলার ব্যাপার নিয়েই। শুনলুম ক্যামাক স্ট্রিটে একটা আপিস বাড়ির দোতলায় বেশ খানিকটা ফ্লোর স্পেস পেয়েও গেছেন। তাতে পাটিশানের ব্যবস্থা করে দিব্যি তিনটে ঘর আর একটা অ্যাটাচড বাথ করে নেওয়া যাবে। চেনা একজন কন্ট্রাকটরের সঙ্গে তা-ই নিয়ে কথাও হয়ে গেছে তার। এখন একজন রিসেপশনিস্ট কাম টাইপিস্ট আর মোটামুটি কাজ জানা দু’জন লোক পেয়ে গেলেই হয়।
গত বছর এই সময়ে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্যে একটা তদন্তের কাজে ইউ পি-র মির্জাপুরে যেতে হয়েছিল। তার পরে আর কোথাও যাওয়া হয়নি। শিগগির যে যাওয়া হবে, এমনও মনে হয় না। একে ভাদুড়িমশাইয়ের শরীর ইদানীং বিশেষ ভাল যাচ্ছে না, তার উপরে আবার এই নতুন আপিস নিয়ে বেশ কিছুদিন তাঁকে এখন ব্যস্ত থাকতে হবে। তাতে অবশ্য আমাদের বেজার হবার কিছু নেই। বরং আপাতত যে তিনি এখান থেকে নোঙর তুলবেন না, তাতেই আমরা খুশি।
কথাবার্তা দিব্যি এগোচ্ছিল। ইতিমধ্যে একগাদা খবরের কাগজ এসে যাওয়ায় সবাই তার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভাদুড়িমশাই ইস্টার্ন কুরিয়ারের ফাস্ট পেজের হেডলাইনগুলো দেখে নিয়ে ভিতরের পাতা খুলে জাম্বলের সমাধান করতে লেগে যান। সেন্টারে যুক্তফ্রন্ট থেকে কংগ্রেসের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে দেশের রাজনীতি এবার কোন দিকে মোড় নেবে, তা-ই নিয়ে অরুণ সান্যাল, কৌশিক, সদানন্দবাবু ও আমার মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। অরুণ সান্যাল তাতে বিশেষ উৎসাহ না পেয়ে খানিক বাদে একটা মেডিক্যাল জার্নাল টেনে নেন। কৌশিক ‘ধুর, রাজনীতি আবার ভদ্দরলোক করে!’ বলে খেলার পাতায় চলে যায়। আর তার পরে-পরেই তোলে সাংবাদিকদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে সেই প্রশ্ন, যার উল্লেখ এই লেখার একেবারে গোড়াতেই করেছি।
অরুণ সান্যাল বললেন, “কী বোদা, চুপ করে আছেন কেন, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো কী হয়েছিল, বলুন, এইভাবে দগ্ধে মারবেন না তো।”
মালতী রান্নার কাজে ব্যস্ত। তাই পার্বতী, মানে কাজের মেয়েটিকে দিয়ে ইতিমধ্যে সে এক প্লেট পকোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিল। সদানন্দবাবু প্লেট থেকে আলগোছে একটি পকোড়া তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে চালান করে বললেন, “ওরে ভাই, সে এক ভয়ংকর ব্যাপার! ওই যে খেলার কথা বললুম না, তার এক হপ্তা বাদেই কামারকুণ্ডুর যজ্ঞেশ্বর শিল্ডের সেমিফাইনালে আমাদের সিঙুরের টিম নাবাতে হবে এগেস্ট গুপ্তিপাড়া বুলেটুস। তো হাবলার সেদিনকার খেলা দেখেই আমাদের সিঙুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের সেক্রেটারি রতনমণি সাঁতরা বললেন, ‘কোনো কতা নয়, এই নাও পঞ্চাশটা টাকা, এ আমি নিজের গাঁট থেকে দিচ্চি, এই টাকা নিয়ে কাল সকালেই নসিপুরে গিয়ে হালা বাঁড়ুজ্যেকে হায়ার করে ফ্যালো, নয়তো গুপ্তিপাড়ার যা মারকাটারি টিম, সেমিফাইনালে তারা আমাদের কাদিয়ে ছাড়বে। তো তা-ই হল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা-ই হল মানে গুপ্তিপাড়া আপনাদের কাঁদিয়ে ছাড়ল?”
“আরে না মশাই, তা-ই হল মানে হাবলাকে আমরা হায়ার করে ফেললুম। আর সেমিফাইনালের খেলায় কোতায় গুপ্তিপাড়া আমাদের কাঁদিয়ে ছাড়বে, তা নয়, হাফ-টাইমের আগেই সাত-সাতটা গোল খেয়ে তারাই হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। তাদের ক্যাপ্টেন এসে বলল, “মশাই, ম্যাচটা আমরা সারেন্ডার করে দিচ্চি। হালার সেভেন্থ গোলটা আটকাতে গিয়ে আমাদের গোলকিপারের পাজরার একখানা হাড় বোধহয় ভেঙে গেচে, রাইট আউট ন্যাংচাচ্চে, লেফট ব্যাকেরও কিছু একটা হয়েছে নিশ্চই, নয়তো ও ওরকম নেতিয়ে পড়ে কাতরাত না! এবারে আমাদের ভালয়-ভালয় বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিন। বাস, ড্যাংডেঙিয়ে আমরা ফাইনালে উঠে গেলুম।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তারপর ফাইনালে ক’ গোলে জিতলেন?”
সদানন্দবাবু নিমপাতা-চিবোনো মুখ করে বললেন, “জিতলুম কোতায়, হেরে ভূত হয়ে গেলুম বাঁশবেড়ের হংসেশ্বরী স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে। সেমিফাইনালে সাত গোলে জিতেছিলুম, তাও আদ্ধেক খেলা বাকি থাকতেই, আর ফাইনালে খেয়ে গেলুম আট গোল। কামারকুণ্ডুর স্পেক্টেটররা একেবারে ছ্যা ছ্যা করতে লাগল।”
“তার মানে হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে আপনারা ফাইনাল খেলার দিন মাঠে নামাতে পারেননি?”
‘না মশাই, পারিনি।” সদানন্দবাবু বললেন, “অবিশ্যি সেমিফাইনালের দিনও যে তিনিই মাঠে নেমেছিলেন, তাও বলতে পারছি না।”
“তার মানে?”
প্লেট থেকে আর-একটা পকোড়া তুলে মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বেড়ে করেছে কিন্তু। সকালে আমার সেকেন্ড কাপ খাওয়া হয়ে গেছে ঠিকই, তবে কিনা এর সঙ্গে আর-এক কাপ চা হলে মন্দ হত না।”
ভাদুড়িমাশাই হেসে বললেন, “এসে যাবে, এসে যাবে। তার আগে গপ্পোটা শেষ করুন তো। সেমিফাইনালের দিন কে তা হলে মাঠে নেমেছিল?”
“তা যদি বলতে পারতুম, তবে তো ল্যাটা চুকেই যেত। কিন্তু বলতে পারছি কোতায়?”
অরুণ সান্যাল সেই একই কথার পুনরুক্তি করলেন, “তার মানে?”
কাজের মেয়েটি দ্বিতীয় রাউন্ডের চা দিয়ে গেল। ট্রে থেকে লিকারের কাপটা তুলে নিয়ে তাতে আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বলচি, বলছি। সেমিফাইনালেই হাবলার দাপট দেখে আমাদের সাঁতরা মশাই তক্ষুনি-তক্ষুনি ঠিক করে ফেলেছিলেন যে, ফাইনালের খেলাতেও একে চাই। খেলা শেষ হয়ে যেতেই তাই গাঁট থেকে আরও পঞ্চাশ টাকা বার করে হাবলার দিকে এগিয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘ফাইনালের জন্যে এই টাকাটা দিয়ে তোমাকে বুক করে রাকলুম। জেতাতে পারো তো
আরও পাঁচশ টাকা দোব। কিন্তু তাতে কী হল জানেন?”
“কী হল?”
“হাবলা বাঁড়ুজ্যে বলল, নিজের হাতে তো আমি টাকা নিই না। কাল সকালে বরং এই টাকাটা আপনারা আমার মায়ের হাতে দিয়ে আসবেন। বাস, তারপর আর একটাও কতা না বলে হাবলা তার সাইকেলে উঠে চলে গেল।”
“পরদিন সকালে আপনারা তা হলে ফের নসিপুরে গেলেন?”
“তা গেসলম বই কী। গিয়ে দেকি হালার মা শুকনো মুকে বারান্দায় বসে আছেন। আমরা তাকে কিছু বলারও সুযোগ পেলুম না। তার আগেই তিনি তার আঁচলের গিট খুলে দশ টাকার পাঁচখানা নোট বার করে বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবারা, পরশু রাত্তির থেকেই আমার ছেলের ধুম জ্বর, তাই তোমাদের হয়ে কাল খেলতে যেতে পারেনি। যে টাকাটা দিয়ে গেলে, সেটা ফিরিয়ে নে যাও, বাবা। শুনে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! হাবলা বাঁড়ুজ্যে কাল তা হলে সেমিফাইনালের খেলায় নামেনি? একেবারে তার মতন দেকতে যে-লোকটা কাল সাত-সাতটা গোল দিল, তাও হাফটাইমের আগেই, সে তা হলে কে?”
কৌশিক তার বাপের বকুনি খেয়ে চুপ করে ছিল। কিন্তু কতক্ষণ আর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে। বলল, “যাচ্চলে, হচ্ছিল ফুটবলের গল্প, তো দুম করে সেটাকে আপনি ভূতের লাইনে ঠেলে দিলেন! এটা কী রকমের ব্যাপার হল বোস-জেই?”
সদানন্দবাবু বললেন, “এতে এত আশ্চজ্জি হবার কী আছে? ভূতেদের কি ফুটবল খেলার শখ হয় না? নরমুণ্ড দিয়ে গেণ্ডুয়া খেলার ব্যাপারটা তা হলে এল কোথথেকে? ওহে বাপধন, আমাদের ময়দানে যারা বল পেটায়, তাদের সবাই যে তোমার-আমার মতন জেনুইন মানুষ, তা কিন্তু ভেবো না। অচেন, ওই ভিড়ের মধ্যে তেনারাও দু’চারজন আচেন।”
কথাটা আর এগোল না, কেন না এই সময়েই কলিং বেল বেজে উঠল। তার মিনিট খানেক বাদেই কাজের মেয়েটি এসে জানাল, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। “বললেন যে, শক্তিগড় থেকে এয়েচেন।”
নাম বললেন না?” প্রশ্নটা অরুণ সান্যালের।
“বললেন তো। তবে সে আমি বলতে পারবনি।”
.
॥ ২॥
পার্বতী, মানে এ-বাড়ির কাজের মেয়েটি বলেছিল, ভদ্রলোক। ফলে আমি ধরে নিয়েছিলুম যে, দর্শনপ্রার্থী ব্যক্তিটি নিশ্চয় একজন বয়স্ক মানুষ হবেন। কিন্তু অরুণ সান্যাল তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে বলার একটু বাদে ডান হাতে একটা বড় সাইজের মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে যে-ছেলেটি এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকল, তার বয়স বোধহয় বছর কুড়ির বেশি হবে না। পরনে চকোলেট রঙের ট্রাউজার্স আর সাদা হাফহাতা শার্ট, পায়ে কাবুলি চপ্পল, হাইট প্রায় ছ’ ফুট, চোখ দুটি ঝকঝকে, চাউনি দেখে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। হাতের হড়িটি আলগোছে মেঝের উপরে নামিয়ে রেখে, শার্টের বুকপকেট থেকে একটা খাম বার করে আমাদের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের মধ্যে মিঃ ভাদুড়ি কার নাম?”
কোনও ব্যাপারে সন্দেহ বা ভয়ের কারণ ঘটলে সদানন্দবাবু সাধারণত যা করে থাকেন, এক্ষেত্রেও একটু আগে ঠিক তা-ই করেছিলেন। সম্ভবত তার ধারণা হয়েছিল যে, হাঁড়ির মধ্যে সাপ কিংবা কাকড়া বিছে থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ফলে, মেঝের উপরে ছেলেটি হাঁড়ি নামিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গেই সদানন্দবাবু মেঝে থেকে সড়াক করে তার পা দু’টি সোফার উপরে টেনে নিয়ে একেবারে জোড়াসন হয়ে বসে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় আঙুল তুলে ভাদুড়িমশাইকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “উনি।”
হাতের খামখানা ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, “আমার নাম ভূতনাথ দত্ত। শক্তিগড়ের ডাক্তার কৃপানাথ দত্ত আমার জ্যাঠামশাই। তিনি এই চিঠিখানা আপনাকে পাঠিয়েছেন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বোসো।” তারপর খাম থেকে চিঠি বাব করে চটপট তার উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে চিঠিখানাকে সেন্টার টেবিলের উপরে রেখে তার উপরে একটা পেপারওয়েট চাপা দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “কৃপানাথ কেমন আছে?”
“এখন ভালই আছেন।’ ছেলেটি বলল, “মাঝখানে জন্ডিস হয়ে মাস দুয়েক খুব ভুগলেন। ভীষণ দুর্বল হয়ে গেলেন। তারপর একটু থেমে থেকে বলল, “বললুম বটে এখন ভাল আছে, তবে দুর্বলতা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। নয়তো তিনি নিজেই আসতে।…আপনি যাবেন তো? আমরা কিন্তু সবাই খুব আশা করে আছি।”
যাবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৃপানাথ তো তোমার জ্যাঠামশাই। তা তুমি ওর কোন ভাইয়ের ছেলে?”
“ছোট ভাইয়ের।”
“তার মানে বিশ্বনাথের। বিশ্বনাথ যে ফুটবলটা দারুণ খেলত, তা নিশ্চয় জানো?”
“জ্যাঠামশাইদের কাছে শুনেছি। বড় জ্যাঠামশাই আর মেজো জ্যাঠামশাই দু’জনেই বলেন যে, বাবার মতন স্ট্রাইকার নাকি ও তল্লাটে খুব বেশি ছিল না।”
“শুধু ও তল্লাটে কেন, কোনও তল্লাটেই খুব বেশি ছিল না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তোমার ঠাকুর্দা তো বিশ্বনাথকে কলকাতায় আসতে দিলেন না। তা যদি দিতেন তো এখানকার বড়-বড় ক্লাবগুলোতে ওকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।”
ভূতনাথ বলল, “তার খেলা আপনি দেখেছেন?”
“দেখেছি বই কী।” একটু যেন আনমনা হয়ে গেলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে বললেন, “তোমার বয়েস এখন কত ভূতনাথবাবু?”
লজ্জিত গলায় ভূতনাথ বলল, “আমাকে বাবু’ বলবেন না, বাড়িতে সবাই আমাকে ভুতে বলে। আপনারাও তা-ই বলবেন।”
“ঠিক আছে, তা-ই বলব, তবে ‘বাবু’টাও ছাড়ব না। ধরে নাও যে, বাবুটা আমি আদর করে বলছি। তা ভুতোবাবু, তোমার বয়েস কত তা তো বললে না।”
“আজ্ঞে উনিশ চলছে। বর্ধমানে রাজ কলেজে পড়ি, এবারে বি, এ, ফাস্ট পার্টের পরীক্ষা দেব।”
“বাঃ, তা এখন তোমার যা বয়েস, তোমার বাবাকেও ঠিক সেই বয়েসেই আমি প্রথম দেখেছিলুম। সেও তখন ওই রাজ কলেজেই পড়ত। যেমন ছিল লেখাপড়ায় ভাল, তেমন খেলাধুলোয়। বল ট্র্যাপিং, ড্রিবলিং, শুটিং, কোনও ব্যাপারেই খামতি ছিল না। বডি সোয়ার্ভ করে, বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ঝটকা দিয়ে যেভাবে বেরিয়ে যেত, সে তো আমার চোখে আজও ভাসছে। তা ভুতোবাবু, ফুটবলটা তুমিও খেলল তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, খেলি।” সেই একই রকমের লজ্জিত ভঙ্গিতে ভূতনাথ বলল, “তবে বাবার কথা যা শুনি, তত ভাল খেলতে পারি না।”
মেঝেতে যে হাঁড়িটা নামিয়ে রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে সদানন্দবাবুর সন্দেহ ইতিমধ্যে কেটে গিয়ে থাকবে, নয়তো সোফা থেকে তিনি ফের মেঝেতে পা নামাতেন না। তবে সন্দেহের জায়গায় এখন যে কৌতূহল দেখা দিয়েছে, সেটা আর তিনি চেপে রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিলেন, এবারে গলা খাঁকরে বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী জিজ্ঞেস করবেন, সে তো বুঝতেই পারছি। হাঁড়ির খবর জানতে চান, এই তো? তা শক্তিগড় থেকে যে হাঁড়ি এসেছে, তার মধ্যে কী থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?”
ভূতনাথের মুখ থেকে লজ্জার ভাবটা কেটে গিয়েছিল। হেসে বলল, “শক্তিগড়ের হেম ঘোষের দোকানের ল্যাংচা। বড় জ্যাঠামশাই আপনাদের জন্যে পাঠিয়েছেন।”
“তা তো হল,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু যেতে পারব কি না, হুট করে এখুনি তা তো বলা সম্ভব নয়। তুমি কি আজকের দিনটা কলকাতায় থাকবে?”
“আজ্ঞে না, কাল আমাদের খেলা রয়েছে, আজই আমাকে শক্তিগড়ে ফিরে যেতে হবে।”
“বেশ তো, তা-ই যেয়ো। কিন্তু দুপুরের ট্রেনেই যে ফিরতে হবে, তার তো কোনও মানে নেই। খেয়ে-দেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপর বিকেলের ট্রেন ধরলেই চলবে।… ওরে কৌশিক, তোর মাকে বল যে, ভুতোবাবু দুপুরে এখানেই খাবে। আর হ্যাঁ, ল্যাংচার হাঁড়িটা ভিতরে নিয়ে যা।”
কিন্তু কৌশিককে আর উঠতে হল না, একটা ট্রের উপরে মিষ্টি আর চায়ের কাপ নিয়ে পার্বতী ইতিমধ্যে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছিল। ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে মেঝে থেকে মিষ্টির হাঁড়ি তুলে নিয়ে সে জানাল যে, একটু বাদেই আমাদের খেতে বসার ডাক পড়বে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “মা’কে বলে দে, এই দাদাবাবুটিও দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবেন।”
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে পার্বতী বলল, “মা’কে কিছু বলতে হবেনি মামাবাবু, সব দিকে তেনার নজর থাকে।”
ভূতনাথ অবশ্য দুপুরের খাওয়াটা এখান থেকে খেয়ে যেতে রাজি হল না। চা জলখাবার খেয়েই সে উঠে পড়ল। বলল, মানিকতলায় তার এক মাসির বাড়ি, তাকে বলা আছে যে, দুপুরে সে ওখানেই খাবে।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, কিন্তু আমার পক্ষে তোমাদের টুর্নামেন্টের খেলা দেখতে যাওয়া সম্ভব হবে কি না, সেটা তা হলে কী করে জানাব? এদিকে যে-সব কাজ জমে রয়েছে, তার একটা বিলিবন্দোবস্ত না করে তো যেতে পারছি না। তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?”
“আপনি কেন যোগাযোগ করবেন,” ভূতনাথ হেসে বলল, “আপনাকে কিছু করতে হবে না। যেতে আদৌ পারবেন কি না, সেটা আপনি কখন বুঝতে পারবেন?”
“বিকেলের মধ্যেই বুঝে যাব।”
“ঠিক আছে, বড়-জ্যাঠামশাই তা হলে আজ রাত্তিরে… এই ধরুন নটা-দশটা নাগাদ আপনাকে ফোন করে সব জেনে নেবেন।”
“কৃপানাথ কোত্থেকে ফোন করবে?”
“কেন, আমাদের বাড়ি থেকে। গত বছরেই আমাদের বাড়িতে ফোন এসে গেছে।”
কথা শেষ করে ভূতনাথ আর দাঁড়াল না। ভাদুড়িমশাইকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এতক্ষণ আমরা সবাই চুপ করেছিলুম। কথাবার্তা যা হবার, তা ভাদুড়িমশাই আর ভূতনাথের মধ্যেই হচ্ছিল। সদানন্দবাবুর কৌতূহলই সবচেয়ে বেশি, তাই তিনিই প্রথম মুখ খুললেন। “কৃপানাথবাবু কে মশাই?”
“বর্ধমানের বিখ্যাত ডাক্তার।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোকে বলে বর্ধমানের বিধান রায়। কৃপানাথের পৈতৃক বাড়ি অবশ্য বর্ধমান শহরে নয়, শক্তিগড়ে। সেখান থেকে রোজ দু’ বেলা বর্ধমানের খোসবাগানে ওর চেম্বারে গিয়ে বসে। দুর্দান্ত প্র্যাকটিস, দম ফেলার ফুরসত নেই। এদিকে আবার তারই মধ্যে এই ফুটবল টুর্নামেন্টের ঝক্কি সামলাতে হচ্ছে। অথচ বয়েস তো নেহাত কম হল না!”
বললুম, “আপনার বন্ধু?”
“ছেলেবেলার… মানে সেই যখন কলেজে পড়তুম তখনকার বন্ধু। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আই এসসির দুটো বছর একসঙ্গে পড়েছি। আই এসসি পাস করে ও গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু কলেজ আলাদা হলে কী হবে, কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিন আর মির্জাপুর স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিনে তখনও রোজ আড্ডা দিয়েছি। ময়দানে গিয়ে ফুটবল খেলাও দেখেছি একসঙ্গে। তারপরে যা হয় আর কি, ডাক্তারি পাস করে ও চলে গেল শক্তিগড়ে, তারপর পশার একটু জমে উঠতে বর্ধমানে গিয়ে চেম্বার খুলল। বাস্, “আমরা দুজনে দুই কাননের পাখি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “দ্যাকাসাক্ষাৎ হয়?”
“কালেভদ্রে। শেষ দেখা হয়েছিল নাইনটিন সিক্সটি সেভেনের অক্টোবরে। ওদের শক্তিগড়ের বাড়িতে সেবারে একটা উইকএন্ড কাটিয়ে আসি।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আঃ, সে-দুটো দিনের কথা এখনও ভুলিনি। পুকুরে মাছ ধরা হল, চড়ুইভাতি করা হল, গানে গল্পে ছুটির দুটো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, টেরই পেলুম না।”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। বুঝলুম, স্মৃতি রোমন্থন করছে। খানিক বাদে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কৃপানাথের ছোটভাই বিশ্বনাথের কথা হচ্ছিল না? বিশ্বনাথের খেলা সেবারেই দেখি।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “একটু আগে আপনি যা বলছিলেন, তাতে তো মনে হয় দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকার ছিলেন। সত্যি?”
“ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা সত্যি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি একটুও বাড়িয়ে বলিনি অরুণ। উনিশ বছরের ছেলেটা দেখলম চুনির মতন ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার শুটিং পাওয়ারও প্রদীপের মতো। তা ছাড়া দরকারমতো নিজের স্পিড যেভাবে বাড়িয়ে কমিয়ে খেলছিল, আসলে সেটাই চিনিয়ে দিচ্ছিল ওর জাত। বুঝতে পারছিলাম যে, ফুটবলটা ওর রক্তের মধ্যে রয়েছে।”
কৌশিক দেখলুম মুখ টিপে হাসছে। বললুম, “হাসছ যে? বড়মামার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?”
“না না, বিশ্বাস হবে না কেন?” কৌশিক বলল, “তবে কিনা আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলুম। মানে একটু আগেই বোস-জেঠুর কাছে আমরা নসিপুরের হালা বাঁড়ুজ্যের গপ্পো শুনেছি তো, তাই ভাবছিলুম যে, শক্তিগড়ের বিশ্বনাথ দত্তও কি সেই গোত্রের খেলোয়াড়।”
শুনে সদানন্দবাবু হাঁ করে ঝাড়া এক মিনিট কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “সেই গোত্রের মানে?”
“মানে হালা বাঁড়ুজ্যে তো আর নিজে খেলতেন না, ভূতেরা তাঁর হয়ে খেলে যেত। তা শক্তিগড়ের বিশ্বনাথ দত্তের হয়েও কি তেনারাই খেলতেন নাকি?”
কৌশিকের কথা শুনে ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “না রে কৌশিক, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। বুঝতে পারছি, চুনি আর প্রদীপের সঙ্গে তুলনা টেনেছি বলে তুই চটে গেছিস, কিন্তু যেমন চুনি তেমনি প্রদীপকেও তো আমি ভালই চিনি, তাই হলফ করে বলতে পারি যে, বিশ্বনাথের খেলা দেখলে ওরা কিন্তু একটুও চটত না, বরং মফসল থেকে ছেলেটাকে যাতে কলকাতার ময়দানে নিয়ে আসা যায় তার চেষ্টা করত।”
কৌশিক বলল, “সে-চেষ্টা কেউ কখনও করেনি?”
“করেছে বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৃপানাথের কাছে শুনেছি, কলকাতার অন্তত একটা বড় ক্লাব ওকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল।”
“মোহনবাগান?’
“ওই তো তোদের মুশকিল, বড় ক্লাব বলতে তোরা আজকাল শুধু মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলকেই চিনিস। কিন্তু এ হল ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখন ফুটবলের মাঠে ইস্টার্ন রেলেরও দাপট নেহাত কম ছিল না। প্রদীপ মানে পি কে বরাবর কোথায় খেলত জানিস? মোহনবাগানেও না,ইস্টবেঙ্গলেও না, ওইইস্টার্ন রেলে। তোইস্টার্ন রেলেরই এক কর্তা—যদুর মনে পড়ছে, কে দাশ-ওকে চাকরি দিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেন যে বিশ্বনাথের কলকাতায় আসা হল না, তাও তো একটু আগেই বলেছি। আসলে কৃপানাথের বাবাই তার এই ছোট ছেলেটিকে কলকাতায় আসতে দিলেন না।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “সে একপক্ষে ভালই হয়েছে। ময়দানের নানা নোংরামির খবর আজকাল কাগজে খুব বড়বড় টাইপে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে তো কোনও লাভ নেই, নোংরামিটা নেহাত গত দু-চার বছরের ব্যাপার নয়, ওটা আগেও অল্পবিস্তর ছিল। যেমন এখন রয়েছে, তেমনি সেভেন্টিজেও ছিল। বিশ্বনাথ দত্ত তখন যদি কলকাতায় খেলতে আসনে তো সেই নোংরা কাদার একটু-আধটু ছিটে কি আর তারও গায়ে লাগত না?”
আমি বললাম, “অরুণ, তুমি ভুল বলোনি। তবে কিনা নোংরামি তখনও ছিল বটে, কিন্তু আজকের মতন এতটা ছিল না। তা ছাড়া নোংরামির চরিত্রও যে ইতিমধ্যে পালটেছে, সেটাও খেয়াল করো। স্পিড আর স্ট্যামিনা বাড়াবার জন্যে খেলোয়াড়রা ওই যে কী সব গোলমেলে ট্যাবলেট খেয়ে মাঠে নামছে বলে শুনতে পাই, এরকম কথা কি আগে কখনও শোনা যেত?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “কিন্তু ও-সব যারা খায়, খানিকক্ষণের জন্যে আর্টিফিশিয়ালি ওতে করে কিছুটা সুবিধে হয় ঠিকই, কিন্তু আলটিমেটলি তো স্বাস্থ্যের একেবারে বারোটা বেজে যায়, কিরণদা। আর তা ছাড়া ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ারও তো একটা ভয় রয়েছে। বঁড়শিতে একবার আটকে গেলেই তো সর্বনাশ!”
“সে তো ঠিকই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মারাদোনার যা হয়েছিল আর কী। অত বড় খেলোয়াড়, কিন্তু ওয়ার্ড কাপে ইউরিন টেস্টে ধরা পড়ল যে, ডোপ করে মাঠে নেমেছে। তখন তো বেইজ্জতির একশেষ!”
সদানন্দবাবু বললেন, “আরে ছা ছ্যা, কৌশিক আবার এর সুখ্যাত করছিল! আরে বাবা, খেলতে নেবেছিস তো নিজের জোরে খেলে যা! সেই যেমন শিবে ভাদুড়ি আর বিজয় ভাদুড়ি খেলত, সামাদ খেলত, লক্ষ্মীনারায়ণ আর মুর্গেশ খেলত! তা নয়, তোরা কিনা নেশা করে মাঠে নাবছিস? আরে ছ্যা ছ্যা, এ-রকম নোংরামির কথা কি আগে কখনও ভাবা যেত?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “শুধু খেলোয়াড়দের দোষ দিযেই বা লাভ কী, সাপোর্টাররাও সব তেমনি হয়েছে! কী না, আমি যার সাপোর্টার, সব খেলাতেই তাকে জিততে হবে, একটা খেলাতেও তার হারা চলবে না! আরে মশাই, তা-ই কখনও হয়? এ তো খুবই সহজ কথা, কিন্তু শুনছে কে? হারলেই মারদাঙ্গা লাগিয়ে দেব, দল বেঁধে মাঠে নেমে খেলা ভণ্ডুল করে ছাড়ব, তারপর মাঠের বাইরেও দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিতে ছাড়ব না।”
“দক্ষযজ্ঞ বলতে পারো, লঙ্কাকাণ্ডও বলতে পারো,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সাপোর্টারদের যা-সব স্যা ‘দেখছি, তাতে তো মনে হয়, প্যান্টুল খুললেই অনেকের ন্যাজ বেরিয়ে পড়বে!”
কৌশিক বলল, “শুধু কলকাতার সাপোর্টারদের দোষ দিচ্ছ কেন, ইংরেজ সাপোর্টারদের তুলনায় তো এরা পারফেক্ট ভদ্দরলোক। ইংল্যান্ড যখন অন্য দেশে খেলতে যায়, এই সাপোর্টাররা তখন সেখানে গিয়ে যা-সব কাণ্ড করে, তা আর কহতব্য নয়। সেই জন্যে তো ওদের বাইরে যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হয়েছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তো ইংরেজদের নকল করার ঝোঁক ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের মধ্যে কেউ-কেউ তো দেখি ইংরেজদের চেয়েও বেশি ইংরেজ! তা এবাবে খেলার মাঠে বাঁদরামির ব্যাপারেও বোধহয় ওদের আমরা ছাড়িয়ে যাব।”
আমি বললুম, “মফসসলের খেলা কিন্তু আমাদের এই কলকাতার তুলনায় অনেক ভাল। গ্রামের পুজোয় যেমন একটা শান্ত ভদ্র চেহারা এখনও চোখে পড়ে, মফস্সলের ছোটখাটো গাঁ-গঞ্জেও তেমনি দেখবেন শহরের খেলার মাঠের এই উচ্ছল ব্যাপারটা এখনও ঢোকেনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।”
“তার মানে?”
“কৃপানাথের চিঠিখানা পড়ুন, ভাদুড়িমশাই ঠোঁট টিপে হেসে বললেন, “মানেটা তা হলেই বুঝতে পারবেন।” বলে, ভূতনাথ তার বড়-জ্যাঠামশাইয়ের যে চিঠিখানা ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেন্টার টেবিল থেকে সেটা তুলে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। চিঠিখানা এখানে তুলে দিচ্ছি :
ভাই চারু,
সেই যে বছর ত্রিশ আগে তুমি আমাদের শক্তিগড়ের গ্রামের বাড়িতে একবার এসেছিলে, তারপরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে মোটরযোগে যাতায়াতের পথে বার কয়েক বর্ধমানে আমার চেম্বারে এসে দেখা করে গিয়েছ বটে, কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আর-কখনও আসোনি। অথচ যখনই দেখা হয়, তখন তো বটেই, চিঠিতেও বহুবার তুমি জানিয়েছ যে, শক্তিগড়ের বাড়ির সেই মধুর স্মৃতি তোমার চিত্তে এখনও অম্লান, এবং আবার তুমি সেখানে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে চাও। কিন্তু কাজের চাপে কিছুতেই তোমার আসা হয় না।
কিন্তু ভাই, এবারে আর কাজের অজুহাত দিয়ো না। আজ রবিবার। আর ক’টা দিন বাদে সামনের উইকএন্ডটা এখানে এসে কাটিয়ে যাও। শনিবারের বদলে যদি শুক্রবার সকালে ট্রেনে অথবা মোটরযোগে এখানে পৌঁছে যাও তো আরও ভাল। তা হলে বিশ্বনাথের নামে আমরা এখানে যে ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করেছি, তার সেমিফাইনাল ও ফাইনালের খেলা তুমি দেখতে পাবে। ফাইনাল হচ্ছে রবিবার বিকেলে। তুমি প্রিসাইড করবে ও পুরস্কার বিতরণ করবে।
শক্তিগড় এখন আর সেই শক্তিগড় নেই, তুমি ভালই জানেনা। তবে আমাদের পুকুরটা আছে। তাতে মাছও আছে প্রচুর। শনিবারে খেলা থাকবে না, সেদিন ছিপ ফেলে মনের আনন্দে মাছ ধরতে পারবে।
এসো ভাই, নইলে আমার মুখরক্ষা হবে না। ইতি :
কৃপানাথ।
পুনশ্চ। বাঙ্গালোরে ফোন করে জানলাম যে, তুমি এখন কলকাতায়।
কাঁকুরগাছির ফ্ল্যাটের ঠিকানা তাঁরাই দিয়েছেন।–কৃপা
চিঠিখানা জোরে-জোরে পড়ে শোনাতে হল, যাতে সবাই শুনতে পান। পড়া শেষ হয়ে যাবার পরে সদানন্দবাবু বললেন, “আজ হল গে রোববার, ৬ এপ্রিল। তার মানে শুক্রবার হল ১১ এপ্রিল। তিনটে দিন… মানে এগারো, বারো আর তেরোই এপ্রিল শক্তিগড়ে কাটিয়ে চোদ্দো তারিখ সোমবার সকালে কলকাতায় ফিরে আপিস করা যাচ্চে। মন্দ কী!”
কৌশিক বলল, “আপনি তো রিটায়ার্ড ম্যান বোস-জেই, আপনার আবার আপিস কিসের?”
“আরে বাবা, আমি কি আর আমার কতা ভাবছিলুম?”
আমি বললুম, “সম্ভবত আমার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু নেমন্তন্নটা তো আপনারও নয়, আমারও নয়, ভাদুড়িমশাইয়ের। আপনার-আমার যাবার কথা অতএব উঠছেই না।”
“আরে না না, আমি একা যাব কেন?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যদি যাই তো সবাই মিলেই যাওয়া হবে। কী রে কৌশিক, যাবি?”
“অসম্ভব।” কৌশিক বলল, “টিকিট কাটা হয়ে গেছে, রিজার্ভেশন কনফার্ড, বুধবারে আমি বাঙ্গালোরে ফিরছি। আমার যাওয়ার কোনও কথাই উঠছে না।”
“কিরণবাবু, আপনি?”
“গেলে তো ভালই হয়।” আমি বললুম, “দিব্যি একটা আউটিং হয়ে যায়। ফাইভ-ডে উইকের শনি আর রবি তো ছুটি, বাকি রইল শুক্রবার। ও একটা দিন ক্যাজুয়াল নিয়ে নেব।”
“সদানন্দবাবু?”
“আমি তো যাবার জন্যে এক পা তুলে রেডি হয়েই আছি।” সদানন্দবাবু বললেন, “তা যাব কিসে? হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে, না বাড়ি থেকে টানা মোটরগাড়িতে?”
“গাড়িতেই যাব। সকাল ছ’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব, লেবেল ক্রসিংয়ে যদি আটকে না যাই তো শক্তিগড়ে পৌঁছতে দু’ঘণ্টার বেশি লাগবে না।”
পার্বতী এসে বলল, “মা বললেন, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে, আপনারা এসে বসে পড়ুন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ রে পার্বতী, যে ছেলেটা দেখা করতে এসেছিল, তোকে যখন তার নাম বলতে বললুম, তখা তুই বললি, “সে আমি বলতে পারবনি। তার মানে তোর স্বামীর নাম নিশ্চয় ভূতনাথ। তাই না?”
শুনে, মুখ নিচু করে পার্বতী যেভাবে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল, তাতে বুঝলুম, ভাদুড়িমশাই ব্যাপারটা ঠিকই আঁচ করেছেন।
টেবিলে খেতে বসে শক্তিগড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আর কোনও কথা হল না। খাওয়া শেষ হবার পরে ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে বললুম, “আচ্ছা, ফুটবল টুর্নামেন্টটা বিশ্বনাথ দত্তের নামে হচ্ছে কেন? উনি কি…”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ, বেঁচে নেই। পনরো বছর আগে মারা গেছে। ভূতনাথ তখন নেহাতই বাচ্চা। বাবার কথা ওর কিছু মনে নেই।
.
॥ ৩ ॥
রবিবার রাত দশটা নাগাদ কৃপানাথ দত্তের ফোন আসতে ভাদুড়িমশাই তাকে জানিয়ে দেন যে, আমরা মোট তিনজন তার ওখানে যাচ্ছি। শুক্রবার সকাল আটটা নাগাদই যে আমরা গাড়িতে করে শক্তিগড়ে পৌঁছচ্ছি, তাও তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাতে তিনি বলেন যে, শক্তিগড়ে ঢুকে খানিকটা এগোলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাঁ দিকে হেম ঘোষের মিষ্টির দোকানে ভূনাথ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে।
তা আজ ১১ এপ্রিল শুক্রবার সকালে শক্তিগড়ে ঢুকে দেখলুম যে, ভূতনাথ সত্যিই আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে আটটা নয়, পোঁছতে পৌঁছতে পৌনে ন’টা বেজে যায়। কৃপানাথ দত্তদের বাড়ি অবশ্য ঠিক শক্তিগড়ে নয়; মুখে তারা শক্তিগড়ের কথাই বলেন বটে, কিন্তু বাড়িটা আসলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছেড়ে খানিকটা ভিতরে ঢুকে এমন একটা এলাকায়, যেখানে পাকা বাড়ি গোটাকয় আছে ঠিকই, কিন্তু কাঁচা বাড়ির সংখ্যা সেই তুলনায় অনেক বেশি। রাস্তাটা অবশ্য কঁচা নয়, পিচের না-হলেও খোয়া-পেটানো।
দত্তদের বাড়িটা যে অনেক কালের, চেহারা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। দোতলা বাড়ি; সদর আর অন্দর দুটো মহলই মস্ত মাপের; প্রচুর ঘর, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার কোনওটাই নেহাত ছোট নয়; সেকালের বাড়ি বলে সিলিং রীতিমতো উঁচু, জানলা দরজাও বড় বড়, ফলে ঘরগুলিতে গুমোট কিংবা দম-আটকা ভাবের সৃষ্টি হয়নি। চুন সুরকির গাঁথনির মোটা দেওয়াল বলে ঘরগুলো বেশ ঠাণ্ডাও বটে। এখানে এসে পৌঁছবার সঙ্গে-সঙ্গেই যে এত সব ব্যাপার খেয়াল করেছিলুম, তা নয়। সবই আস্তে-আস্তে দেখি, আর যতই দেখি, ততই বুঝতে পারি যে, কৃপানাথ দত্ত কেন কষ্ট করে এখান থেকে রোজ বর্ধমানে যান, কেন বর্ধমান শহরেই স্থায়ীভাবে তিনি থেকে যান না। আসলে এই ধরনের বাড়ির মধ্যে এমন একটা মায়ার ভাব থাকে, মানুষ যাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যায়।
আসার পথে মগরায় খানিকক্ষণের জন্যে দাঁড়াতে হয়েছিল। রাস্তার ধারের একটা দোকানে তখন চা-বিস্কুট খেয়ে নিয়েছি। এখানে এসে হাতমুখ ধুয়ে ফের জলখাবার খেতে হল। বাড়ির পাশে মস্ত দিঘি। অনেক কাল বাদে সাঁতরে চান করা হল সবাই মিলে। তারপর মধ্যাহ্নভোজ সেরে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েও নিয়েছি। ঘুম থেকে উঠেছি তিনটে নাগাদ। তারপর খেলা দেখতে গিয়েছিলুম। সুলতানপুর স্পোটিং আর পোড়াবাজার ইলেভেনের সেমিফাইনাল খেলা। তাতে সুলতানপুরকে পাঁচ গোলে হারিয়ে পোড়াবাজার একেবারে ড্যাং ড্যাং করে ফাইনালে উঠে গেল। অন্য দিকের সেমিফাইনালে পলাশডাঙা ফুটবল ক্লাবকে একেবারে শেষ মিনিটে একটা গোল দিয়ে শক্তিগড় ব্রাদার্স ফাইনালে উঠেছে। কাল শনিবার খেলা নেই। পরশু রবিবার ফাইনাল।
মফস্বলের গ্রামে-গঞ্জে এইসব টুর্নামেন্ট নেহাত কম উন্মাদনা জাগায় না। যেখানে খেলা, সেখানকার স্থানীয় লোক তো বটেই, তার আশপাশের সব এলাকা থেকেও প্রচুর লোক খেলা দেখতে আসে। শুনলুম খেলার মাঠে নোজই বেশ ভিড় হয়। আজও যে হয়েছিল, সে তো স্বচক্ষেই দেখলুম। সুলতানপুর স্পোটিং যে খুব দুর্বল দল, তা নয়, এই নক-আউট টুর্নামেন্টের ট্রোফি গত বছর তারাই পেয়েছিল। কিন্তু এবারে যে সেমিফাইনালে তাদের গোহার হারতে হল, তার একটা কারণ যদি হয় রেফারির দু’ দুটো ভুল সিদ্ধান্ত, তত অন্য কারণ পোড়াবাজার টিমের ফরোয়ার্ড লাইনের দুর্ধর্ষ দুই খেলোয়াড়, বিপক্ষের ডিফেন্সকে যারা ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছিল।
রাত্তিরে তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। খাওয়ার পাট একটু আগে মিটেছে; সদর বাড়ির দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘরে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে; বিছানা পাতা, মশারি খাটানো, ভূতনাথের তদারকিতে সমস্ত কাজ সমাধা হয়েছে, এখন গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়। কিন্তু শুয়ে পড়ার ইচ্ছে কারও আছে বলে মনে হল না। আপাতত আমরা বারান্দার উপরে গোল হয়ে বসে গল্প করছি। দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, সামনে পুকুর, তার জলের উপরে কোত্থেকে যেন আলো এসে পড়েছে, সব মিলিয়ে এমন একটা পরিবেশ, যাতে জেগে থাকতেই ভাল লাগে।
কৃপানাথ দত্ত বললেন, “বুঝলে হে চারু, বিশ্বনাথের নামে এই টুর্নামেন্ট চালু করেছি নাইন্টিটুতে, অথচ এর মধ্যে একবারও আমরা ট্রোফিটা ঘরে তুলতে পারিনি। এদিকে
আবার এবার নিয়ে পরপর তিন বার আমরা ফাইনালিস্ট। গত দু’ বছর অল্পের জন্যে ট্রোফি ফশকে যায়। এবারে কী হবে কে জানে।”
ভাদুড়িমশাই তালুতে জিভ ঠেকিয়ে চুকচুক করে আক্ষেপ প্রকাশ করে বললেন, “এবারেও বোধহয় ফসকে যাবে।”
“একথা কেন বলছ?”
“বলছি পোড়াবাজার টিমের ফরোয়ার্ড লাইনের খেলা দেখে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বিশেষ করে ও-দুটো ছোঁড়ার তো কোনও তুলনাই হয় না। ওরে বাপ রে বাপ, ওদের দেকে তা আমার লক্ষ্মীনারায়ণ আর মুর্গেশের কম্বিনেশনের কতা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর কিকের জোর যা দেকলুম, একেবারে পাগলির মতো।”
“লক্ষ্মীনারায়ণ-মুর্গেশের খেলা আমি দেখিনি,”ভাদুড়িমশাই বললেন, “পাগলিরও না, তবে সোমানা-আপ্পারাওয়ের খেলা তো দেখেছি। না হে কৃপানাথ, আজ ওরা যা খেলল, পরশু যদি তার অর্ধেকও খেলতে পারে তো তোমার… মানে শক্তিগড়ের নো চান্স।”
কৃপানাথ দত্ত একেই মুষড়ে ছিলেন, ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে আরও নেতিয়ে পড়লেন। সেই অবস্থাতেও, সম্ভবত নিজেই নিজেকে একটু সাহস জোগাবার জন্যে, মজ্জমান ব্যক্তি যে-ভাবে হাতের সামনে যা-কিছু পায়, তা-ই আঁকড়ে ধরে, সেইভাবে বললেন, “অবিশ্যি আমাদের টিমও মোটেই ফ্যালন নয়। ভুতোর… মানে বিশ্বনাথের ছেলের খেলা তো তুমি দ্যাখোনি, দেখলে বুঝতে পারতে যে, ওই রকমের বডি-ফিটনেস আর স্টামিনা না-ই থাক, স্রেফ ট্যালেন্ট আর ফুটবল-সেন্সের কথা যদি ওঠে, তো ভুতো ওদের চেয়ে একটুও পিছিয়ে নেই, বরং দু’কদম এগিয়ে আছে। কিন্তু মুশকিল কী জানো, পাওয়ার-টেনিসের মতো এ হল পাওয়ার-ফুটবলের যুগ। যার যত মাল-পাওয়ার, খেলার মাঠে তার তত দাপট।… নাঃ, ওই মা-ম্যান দুটোই পোড়াবাজারকে জিতিয়ে দেবে, এবারেও আমরা পারলুম না!”
বললুম, “এত হতাশ হচ্ছেন কেন? আজ ভাল খেলেছে বলেই যে পরশুও ওরা ভাল খেলবে, তার তো কোনও মানে নেই। আমাদের কলকাতা ময়দানের নামজাদা সব ফুটবলারদের দেখছেন তো, পরপর দুদিন ওরা কেউ ভাল খেলে না। আজ যদি বাঘের মতো খেলল, তো কাল হয়তো খেলবে শেয়ালের মতো। না না, আপনি এত দমে যাবেন না তো।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভূতোবাবুর কথা বলছিলে। ওর খেলা তো দেখিনি। ওদের সেমিফাইনালের খেলা কবে ছিল?”
“গত সোমবার। সেদিন একসট্রা টাইম খেলানো হয়েছিল। তাও খেলাটা ড্র থেকে যায়। ফলে পরও… মানে বুধবার আবার খেলতে হয়। সেদিনও ড্র হতে যাচ্ছিল, কিন্তু একসট্রা টাইমের তিন মিনিটের মাথায় ভূতো কী বলব, অলমোস্ট আনবিলিভেবলি– একটা গোল করে বসে। সেই গোল্ডেন গোলেই আমরা জিতে যাই।”
“গোলটাকে অবিশ্বাস্য বলছ কেন?”
“এইজন্যে বলছি যে, মাঠের যে-হাফে আমরা খেলছিলুম, সেখান থেকেই একটা গ্রু পাস ধরে নিয়ে বিপক্ষের পরপর পাঁচজনকে কাটিয়ে বল নিয়ে ভূতো ওদের বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তারপর যেন ডান পায়ে শট নিতে যাচ্ছে, এইভাবে বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে সেই অবস্থাতেই বাঁ পায়ে শট নেয়। গোলকিপারের কিছু করার ছিল না, কেননা, ভুতোর ওই বাঁ দিকে ঝোকা দেখেই সে কমিটেড হয়ে গিয়েছিল।”
বললুম, “গত ওয়র্লড কাপে আফ্রিকার একজন ফুটবলারকে এগেস্ট দ্য রান অব দ্য প্লে ওইভাবে একটা গোল করতে দেখেছি। সেও একেবারে একার চেষ্টায় গোল করা।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাইট। গোলটা টিভিতে আমিও দেখেছিলুম। ইন ফ্যাক্ট দ্যাট। ওয়াজ অ্যাডজাজড টু বি দ্য বেস্ট গোল অভ দ্য টুর্নামেন্ট।… কিন্তু সে-কথা থাক। ভুতোর কথা হচ্ছিল। ওর খেলা আমি দেখিনি, তবে ওর মতো বয়েসে ওর বাপ কেমন খেলত, তা তো জানি। বিশ্বনাথের ফুটবল-ট্যালেন্টের অর্ধেকও যদি ভূতোবাবু পেয়ে থাকে, তো বলব, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তোমাদের হারতে হবে না, ইট ওন্ট বি আ ওয়ন সাইডেড অ্যাফেয়ার।”
কৃপানাথ বললেন, “আমি তো সেই ভরসাতেই রয়েছি, তবে বাইরে যে সেটা প্রকাশ করব, এমন সাহস পাচ্ছি না। তা ছাড়া এদিকে আবার আর-একটা ঝাট বেধেছে।”
“কিসের ঝঞ্ঝাট?”
“ঝঞ্ঝাট আমাদের ভুতোর মা অর্থাৎ ছোট বউমাকে নিয়ে।”
“এর মধ্যে আবার তিনি কী করে আসছেন?”
“আসছেন ভুতোর জন্যে।” কৃপানাথ একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কে যেন তার কানে তুলে দিয়েছে যে, পোড়াবাজার টিমে দুটো জল্লাদ-মার্কা ছেলে আছে, ভুতো যদি খেলতে নামে তো তার ঠ্যাং না ভেঙে তারা ছাড়বে না।”
“তাই কী হয়েছে?”
“এই হয়েছে যে, বউমা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। তার ইচ্ছে নয় যে, ফাইনাল খেলায় ভূতোকে আমরা মাঠে নামাই।”
একটুক্ষণ থেমে রইলেন কৃপানাথ। তারপর বললেন, “আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে জানো, খেলার মাঠে বিশ্বনাথ একবার মাথায় খুব চোট পেয়েছিল, মাঠ থেকে সরাসরি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। মারাত্মক ইনজুরি, কনকাশন হয়েছিল, বাঁচবার আশা ছিল না।”
“এটা কবেকার ব্যাপার?”
“বিশ্বনাথের বিয়ের পরের বছরের।” কৃপানাথ বললেন, “তারপরে আর বিশ্বনাথ মাঠে নামেনি। বউমারও সেই থেকে ফুটবলের ব্যাপারে একটা আতঙ্ক জন্মে গেছে। ছেলে ফুটবল খেলছে, এমনিতেই এটা তার পছন্দ নয়। তার উপরে যেই শুনেছেন যে, ভূতের ঠ্যাং ভাঙার জন্যে পোড়াবাজার টিম একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে, ব্যস, আর কথা নেই, সঙ্গে-সঙ্গে কান্না জুড়ে দিয়েছেন তিনি।”
সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কিন্তু এবারে আর মুখ না-খুলে পারলেন না। বললেন, “বাঙালির যে কিছু হয় না, স্রেফ এইজন্যেই হয় না। আরে বাবা, কেল্লার গোরার বুটজুতোর লাথি খেয়ে ছেলের পা ভাঙতে পারে, অভিলাষ ঘোষের মা কি তা জানতেন না? নাকি দুখিরামবাবু জানতেন না যে, কিংকং-মার্কা সায়েবের কাঁচ থেকে বল কাড়তে গিয়ে তার ভাইপো ছোনে মজুমদারের মাথা ফাটতে পারে? কিন্তু অভিলাষ ঘোষের মা কি তার জন্যে কখনও কান্নাকাটি করেছেন, নাকি দুখিরামবাবু তার আদরের ভাইপোকে ঘরের মধ্যে আটকে রেকেচেন?… না না, ভূতনাথের মা’কে সবাই গিয়ে বলতে হবে যে, এটা কোনও কাজের কতা নয়, ভূতনাথকে খেলতে দিতে হবে প্রমাণ করতে হবে যে, বাঙালি লড়তেও ভয় পায় না, মরতেও ভয় পায় না। বাঙালি যদি আজ মরার ভয়ে লড়তে না চায়, বাঙালি যদি আজ লড়ার ভয়ে…”
“আরে দূর মশাই, সদানন্দবাবুকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, “অত বাঙালি-বাঙালি করছেন কেন? পোড়াবাজার টিমের ছেলেগুলো কি বাঙালি নয়? তবে হ্যাঁ, ওদের বডি ফিটনেস যে তারিফ করার মতো, সেটা বলতেই হবে। ইন ফ্যাক্ট, আজকের খেলায় সুলতানপুর টিমের সঙ্গে ওটাই ওদের একটা মস্ত তফাত গড়ে দিয়েছিল।
“পরশুও দেবে!” কৃপানাথ বললেন, “তবে সুলতানপুরের মতো পাঁচ গোলে না হেরে যাই। ওইরকম গোহার হারলে আর মুখ দেখানো যাবে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখুনি হারের কথা উঠছে কেন? ভুতোবা খেলবে তো?”
“তা খেলবে। ছোট-বউমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমি রাজি করাতে পারব। কিন্তু একা ভুতেই বা কী করবে। ও দুটো ষণ্ডাকে একা সামলানো ওর কম নয়।”
“ও কেন সামলাবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওদের পিছনে আর-দু’জনকে লাগিয়ে রাখো, ভুতোবাবু যাতে নিজের খেলাটা খেলতে পারে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সেই সঙ্গে রেফারিকেও একটু টিপে দিন না!”
কৃপানাথ বললেন, “তার মানে?”
“মানে আর কী, সবই তো বোজেন, এই বাজারে সব জায়গাতেই যা হচ্ছে আর কী..আরে মশাই, খেলা শুরু হবার আগে রেফারিকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে…”
“আরে ছি ছি,” কৃপানাথ দাঁতে জিভ কেটে, দু হাতের বুড়ো আঙুল দুই কানের লতিতে ছুঁইয়ে বললেন, “ঘুষ দেবার কথা বলছেন তো? আরে রাম রাম, ও-সব চিন্তাকে মাথায় ঠাই দেবেন না মশাই!”
“কেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “পরশুর খেলায় কি ধর্মপুর যুধিষ্ঠির এসে রেফারি হচ্চে নাকি?”
শুনে আমরা হাসলুম বটে, কিন্তু কৃপানাথ হাসলেন না। বললেন, “সরকারি ইঞ্জিনিয়ার মাখন শিকদারকে যদি চিনতেন তো এমন কথা আপনি বলতেন না বোসমশাই।”
“তার মানে?”
“মানে আর কিছুই নয়, পরশুর খেলা নডাক্ট করছে মাখন শিকদার, যার অনেস্টি একেবারে আনকোয়েশ্চেনেবল। যুধিষ্ঠির তো তাও একবার কায়দা করে একটা ডিজনেস্ট কাজ করেছিলেন…এই হত ইতি গজর কথাটা বলছি আর কি, কিন্তু মাখন শিকদার বোধহয় তাও কখনও করেনি।”
“বটে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বিশ্বেস না হয় তো যতীন ঘোষকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
“যতীন ঘোষ আবার কে?”
“একজন ঠিকেদার।” কৃপানাথ বললেন, “ঘুষ দিয়ে একটা ব্রিজ মেরামতির টেন্ডার বাগাবার তালে ছিল। তাও যে সত্যি-সত্যি ঘুষ দিয়েছিল, তা নয়, স্রেফ হাত কচলাতে কচলাতে মাখন শিকদারকে বলেছিল যে, কাজটা যদি পায় তা হলে শিকদার-মশাইয়ের বেকার শালাটিকে সে…। বাস, আর কিছু বলার দরকার হয়নি, ওই যে ইঙ্গিতটুকু করেছিল, ওরই জন্যে যতীন ঘোষ ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যায়। গত দু বছরে লোকটা একটাও সরকারি কাজ পায়নি।… না না, ওকে কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমনিতেও ও-সব নোংরামির মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি। লোকটি পাস-করা রেফারি তো?”
“অফ কোর্স।” কৃপানাথ বললেন, “তা নইলে ওকে দায়িত্ব দেব কেন?”
“ভাল কথা। কিন্তু শুধু পাসকরা রেফারি হলেই তো হয় না, ধাঁচটা কেমন?”
“তার মানে?”
“মানে জবরদস্ত লোক কি না।” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “মানে… আরও পরিষ্কার করে বলছি… বেশ শক্ত হাতে খেলাটা কনডাক্ট করতে পারবে কি না।
“তা পারবে।” কৃপানাথ বললেন, “এর আগে কোয়ার্টার ফাইনালের একটা ম্যাচ কনডাক্ট করেছিল। একটা গোল নিয়ে হাঙ্গামা বাধার উপক্রম হয়েছিল সেদিন। গোলটা যারা খেয়েছিল, তাদের একজন স্টপার এগিয়ে এসে রেফারির ডিসিশান নিয়ে আপত্তি জানাতেই মাখন শিকদার তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে দেয়।… না না, বেশ কড়া লোক।”
“ভাল কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন একটু ঘরে চলল, তোমার সঙ্গে আর দু একটা কথা সেরে নেওয়া দরকার।”
“এঁরা?” কৃপানাথ বললেন, “এঁরা কি এখানেই থাকবেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এমন চমৎকার বাতাস এঁরা কোথায় পাবেন। বারান্দায় বসে এঁরা যেমন গল্প করছেন করুন, সেই ফাঁকে আমরাও আমাদের পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে নিই।”
কৃপানাথকে সঙ্গে নিয়ে ভাদুড়মশাই বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তবে তার উদ্দেশ্য যে শুধুই স্মৃতি রোমন্থন, তা আমার মনে হল না।
.
॥ ৪ ॥
আজ ১৩ এপ্রিল, রবিবার। বাংলা ১৩০৩ সনের আজই ছিল শেষ দিন। কাল থেকে নতুন বছর শুরু হবে। বাংলা নববর্ষে আগে ছুটি পাওয়া যেত না, আজকাল কিন্তু যাচ্ছে, তাই ফলকের দিনটাও দিব্যি এখানে কাটানো যেত, কিন্তু ভাদুড়িমশাই কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না, বলছেন, ওরে বাবা, তাই কখনও হয়? কেন হয় না, জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘মালতী একেবারে মাথার দিব্যি দিয়ে বলে দিয়েছে যে, নববর্ষের দিনটা এবারে ওদের সঙ্গে কাটাতে হবেই। কৌশিক তো বাঙ্গালোরে, এখন আমিও যদি পয়লা বৈশাখটা বাইরে কাটাই, তা হলে ও খুব দুঃখ পাবে।”
আর-একটা দিন যাতে থেকে যাই, তার জন্যে কৃপানাথ দত্ত গোড়ায়-গোড়ায় খুব ঝুলোবুলি করছিলেন ঠিকই, সেই সঙ্গে এ বাড়ির অনন্যরাও খুবই চাইছিল যে, কালকের দিনটাও এখানে থাকি, কিন্তু ভাদুড়িমশাই যখন বললেন, ছোট বোনের কাছে তা হলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে, তখন আর কেউ আপত্তি করলেন না। ভূতনাথ অবশ্য কথা আদায় করে নিল যে, অক্টোবর মাসে পুজোর কটা দিন তাদের বাড়িতে এসে কাটিয়ে যেতে হবে। ভাদুড়িমশাই বললেন যে, সেই সময়ে যদি বাঙ্গালোরের আপিসে খুব বেশি কাজ পড়ে না যায়, একমাত্র তা হলেই তাঁর কলকাতায় আসা সম্ভব হবে, আর কলকাতায় যদি আসেন তো শক্তিগড়ে এসে তিনটে দিন কাটিয়ে যাবেন ঠিকই। আর আমাদের তো না আসার কোনও কথাই ওঠে না। পুজোর কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলে তো আমরা বেঁচে যাই।
যা-ই হোক, কালকের দিনটা দুপুরে মাছ ধরে আর বিকেল থেকে রাত্তির অব্দি ব্রিজ খেলে দিব্যি কেটেছে। আর আজকের দিনটার কথা তো ভোলা যাবে না। দিনটা ছিল উত্তেজনায় ঠাসা, বিকেলে খেলার মাঠে যা কিনা একেবারে চরমে উঠে যায়। কৃপানাথ দত্ত টুর্নামেন্ট কমিটির প্রেসিডেন্ট, প্রথম থেকেই তিনি ভয়ে-ভয়ে ছিলেন যে, একটা হাঙ্গামা হয়তো বেধে যেতে পারে, আর যদি বাধে তো সেটা নেহাত খেলার মাঠে আটকে থাকবে না। পোড়াবাজার টিমের সঙ্গে যে তিনটে বাস ভর্তি করে তাদের শ’খানেক সাপোর্টারও খেলার মাঠে এসে পৌঁছেছে, এই খবর শুনে ভয়টা আরও বেড়ে যায়। তিনি অবশ্য কাল বিকেলেই নিজে থানায় গিয়ে দারোগাবাবুকে বলে এসেছেন যে, খেলার মাঠে তাকে উপস্থিত থাকতে হবেই, আর দারোগাবাবুও তাকে অভয় দিয়ে বলেছেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই, পোড়াবাজার থেকে যারা আসছে, তারা যদি কিছুমাত্র গোলমাল করে তা হলে প্রথমে তিনি মাইল্ড লাঠিচার্জ করবেন, আর তাতে যদি কোনও কাজ না হয় তো ফায়ারিংয়ের অর্ডার দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। কিন্তু কৃপানাথের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, দরকার হলে দনান গুলি চালাব মশাই,’ দাবোগাবাবুর এই কথা শুনে আশ্বস্ত বোধ করবেন কী, তিনি আরও নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
খেলা শুরু হবার কথা কাটায়-কাঁটায় ঠিক তিনটের সময়। কিন্তু শুরু হতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল। কেননা, তার আগে স্থানীয় ইস্কুলের প্রাইমারি সেকশনের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করেছে। এস. ডি. ও. সাহেব আজকের অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি; জাতি গঠনে খেলাধুলার গুরুত্ব ও খেলার মাঠে শান্তি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতখানি সেটা ব্যাখ্যা করে তিনি বেশ ওজনদার একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। স্থানীয় গ্রাম-পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্টও ভাষণ দিয়েছেন একটি। তাতে তিনি বলেছে যে, এককালে তিনিও খুব ফুটবল খেলতেন, তবে গত কয়েক বছর যাবৎ যেহেতু জনসেবার কাজেই তাকে অহোরাত্র ব্যক্ত থাকতে হচ্ছে, তাই ইদানীং আর খেলাধুলোর জন্যে সময় দিতে পারছেন না। ওলিম্পিকের আদর্শের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্থানীয় উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গেম-টিচার বললেন, হারজিতটা কোনও কথা নয়, এই যে খেলার মাঠের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে এতগুলি দল, এই যোগদানটাই হচ্ছে আসল কথা। তিনি হয়তো আরও কিছু বলতেন, কিন্তু খেলা শুরু না হওয়া পর্যন্ত এস.ডি.ও. সাহেব যেহেতু জরুরি একটা কাজ থাকা সত্ত্বেও এখান থেকে চলে যেতে পারছেন না, তাই গেম-টিচার ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির ঝুল ধরে বার দুই-তিন হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে মধ্যপথেই থামিয়ে দেওয়া হল।
এর পরে শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব। মাঠের একদিকে একটা চাঁদোয়া খাঁটিয়ে তার তলায় পর-পর গোটা কুড়ি চেয়ার পেতে তাতে অভ্যাগতদের বসানো হয়েছে। দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে এবার আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান অতিথির পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। খেলোয়াড়রা মাঠের মাঝখানে মুখোমুখি দুই সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। দুই টিমের কোচও দাঁড়িয়ে আছেন নিজের নিজের খেলোয়াড়দের পাশে। কৃপানাথবাবু এসে ভাদুড়িমশাই ও এস. ডি. ও. সাহেবকে সেখানে নিয়ে গেলেন। পরিচয়পর্ব সাঙ্গ হতে লাগল তা অন্তত মিনিট দশেক। আমরা দূর থেকে দেখলুম যে, ভাদুড়িমশাই ও এস. ডি. ও. সাহেব খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে একটি দু’টি কথা বলছেন। কোচ দু’জনকে তো ভাদুড়িমশাই জড়িয়ে ধরলেনও।
এই যে পরিচয়পর্ব আর শুভেচ্ছা বিনিময়, খেলার মাঠে এর দরকার আছে বই কী। এটা আসলে একটা প্রতাঁকের মতো। মৈত্রীর প্রতীক। যেন এই প্রতাঁকের মাধ্যমেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে, এখন আমরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকই, কিন্তু আসলে আমরা সবাই পরস্পরের বন্ধু। তাই দয়া করে কেউ যেন কোনও গণ্ডগোল কোরো না, খেলাটাকে নির্বিঘ্নে শেষ হতে দাও। যেন, ফলাফল যা-ই হোক না কেন, কারও মনে কোনও তিক্ততার রেশ থেকে না যায়।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই পর্বের সঙ্গে যেমন খেলোয়াড়দের, তেমন দু’দলের কোচকেও যে জড়িয়ে দেওয়া হল, এর পিছনে কার মাথা কাজ করেছে, জানি না। তবে যার মাথাই কাজ করে থাক, সেটা যে পাকা মাথা, তাতে সন্দেহ নেই। কথাটা এই জন্যে বলছি যে, কোচদের উশকানির জন্যেই অনেক সময় খেলার মাঠে হাঙ্গামা বেধে যায়। খেলা যখন চলছে, তখন মাঠের ধারে বসে এমনভাবে তাদের অনেকে গলা ফাটিয়ে খেলোয়াড়দের তাতাতে থাকেন যে, তাতেই বেড়ে যায় উত্তেজনা। এমন কোচও দেখেছি, একটু ধৈর্য ধরে যাঁরা বসে থাকতেও পারেন না, মাঠের ধার বরাবর দৌড়তে দৌড়তে যাঁরা চেঁচাতে থাকেন। মনে হল, খেলা শুরু হবার আগে ভাদুড়িমশাই ওই যে দুই টিমের দুই কোচকে অত আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, এতেও শান্তি রক্ষার কাজ হবে কিছুটা। আর যা-ই করুন, এর পরে আর ওঁরা নিজের নিজের টিমকে এমনভাবে উত্তেজিত করবেন না, যার ফলে একটা হাঙ্গামা লেগে যেতে পারে।
কার্যত অবশ্য দেখা গেল যে, স্থানীয় টিমের কোচটি চুপ করে বসে খেলা দেখছেন বটে, কিন্তু পোড়াবাজারের কোচটির ক্ষেত্রে ভদ্রতা করে কোনও লাভ হয়নি। সেমিফাইনাল খেলার দিনে সুলতানপুরের বিরুদ্ধে তার খেলোয়াড়দের, বিশেষ করে ফরোয়ার্ড লাইনের সেই দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় দুটিকে যেভাবে তিনি উশকে দিয়েছিলেন, আজও সেইভাবে উশকে যাচ্ছেন।
ব্যাপারটা মাঝে-মাঝে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তবু যে কোনও বড় রকমের গণ্ডগোল ঘটছিল না, তার দুটো কারণ। প্রথমত, মাখন শিকদার সত্যিই বেশ কড়া মেজাজের রেফারি। খেলা শুরু হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখলুম, পিছন থেকে বিপজ্জনকভাবে ট্যাক্স করার জন্যে দু’ দলের দু’জন খেলোয়াড়কে তিনি হলুদ কার্ড দেখিয়ে দিলেন। তা ছাড়া, পোড়াবাজারের কোচটি হঠাৎ একবার তার একজন খেলোয়াড়কে বিকট চেঁচিয়ে কিছু নির্দেশ দিতেই রেফারি সঙ্গে-সঙ্গে খেলা থামিয়ে কোচটির কাছে এসে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বললেন, “যদি আপনার কাউকে কিছু বলার থাকে তো হাফ-টাইমে বলবেন; এখন যদি এইরকম যাঁড়ের মতন চেঁচান, তো মাঠের ধার থেকে আমি আপনাকে উঠিয়ে দেব।” কোচটির গলা তারপরে আর শোনা যায়নি। বোধহয় তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছেন, চেঁচামেচি করে এখানে বিশেষ সুবিধে হবে না।
পোড়াবাজার ফরোয়ার্ড লাইনের সেই ছেলে দু’টিকে সেমিফাইনাল খেলায় খুব লাফ ঝপ করতে দেখেছিলুম। পরস্পরের সঙ্গে ভাল রকমের বোঝাঁপড়া রয়েছে, দু’জনেই চমৎকার বল-প্লেয়ার, নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়া করতে করতে এমন চমৎকারভাবে ওরা মাঝে-মাঝে আক্রমণে উঠে আসছিল যে, তাতেই চেনা যাচ্ছিল ওদের জাত। আক্রমণ আটকে যাবার পরে বল যখন আবার তাদের সীমানায় ফিরে যাচ্ছে, তখন ডিফেন্সে যাতে বড় রকমের কোনও ফঁক-ফোকর দেখা না দেয়, তার জন্য ওরা নেমেও যাচ্ছিল খুব তাড়াতাড়ি। দু’জনেরই দু’পা দেখলুম সমান চলে। সেটাও একটা মস্ত কারণ, যার জন্যে হঠাৎ-হঠাৎ জায়গা পালটে খেলতে ওদের কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু ওই যে বললুম, সেমিফাইনালের দিন ওরা যেরকম লাফ-ঝাঁপ করছিল, আর মাঝে-মাঝে একেবারে বুলডোজারের মতো ঢুকে পড়ছিল বিপক্ষের ব্যুহের মধ্যে, আজ সে রকম কিছু একবারও দেখতে পাইনি। শেষের দিকে এমনও মনে হচ্ছিল যে, ওদের দম ফুরিয়ে গেছে। দু’জনেরই দৌড়ের মধ্যে যে ভয়ংকর, প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের, গতি সে দিন দেখেছিলুম, যতই ভাল খেলুক, সেই গতির অর্ধেকও আজ দেখতে পাচ্ছিলুম না।
বরং সেই তুলনায় ভূতনাথের খেলা দেখে তাক লেগে যাচ্ছিল আমাদের। সদানন্দবাবু সে-কথা বললেনও। “আরে মশাই, এ তো দেকচি মেওয়ালালের মতো খেলচে।” আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে চেঁচিয়ে কাউকে সমর্থন করলে সেটা একটু অশোভন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সদানন্দবাবু যে তা জানেন না, তা নয়। কিন্তু ভূতনাথের খেলা দেখে তার মধ্যে যে আবেগ জমে উঠেছে, কতক্ষণ সেটাকে চাপা দিয়ে রাখবেন। তার চাপ সামলাতে না পেরে মাঝে-মাঝে, নিজের হাঁটু মনে করে, আমার হাঁটুতেই মস্ত এক-একটা চাপড় মেরে তিনি চেঁচিয়ে উঠছিলেন, “ওহোহোহো, এ কী খেলা খেলছিস রে ভূতত। চালিয়ে যা! চালিয়ে যা!”
ওদিকে, ফরওয়ার্ড লাইনের ছেলে দুটোর স্পিড কমে যাওয়ায়, আর তার ফলে পিছন থেকে যে-সব বল বাড়ানো হচ্ছে, চটপট জায়গামতো ছুটে গিয়ে সেগুলো ট্র্যাপ করতে না পারায়, পোড়াবাজারের আক্রমণ আজ ঠিক জমাট বাঁধতে পারছিল না। স্রেফ গতির অভাবেই তাদের মুভমেন্টগুলো শুরু হতে না হতেই ঝিমিয়ে যাচ্ছিল। আর তার সুযোগ নিচ্ছিল ভূতনাথের টিম। কৃপানাথ ভেবেছিলেন, পোড়াবাজারের বিরুদ্ধে তাদের টিম একেবারে দাঁড়াতেই পারবে না, সুলতানপুরের মতো তাদের কপালেও অশেষ দুর্ভোগ লেখা রয়েছে, তারাও পাঁচ-ছ গোলে হারবেন। কিন্তু আজ দেখা গেল, অত ভয় পাবার কিছু ছিল না, দক্ষতার বিচারে দুটো দলই আসলে সমান-সমান। কেউই কারও চাইতে বিশেষ এগিয়ে বা পিছিয়ে নেই।
লড়াইটাও তাই হাড্ডাহাড্ডি রকমের হচ্ছিল। দুই হাফ মিলিয়ে মোট নব্বই মিনিটের খেলা। তার অর্ধেক সময় কেটে গেছে, কিন্তু গোল হয়নি। পোড়াবাজারের মানিকজোড়ের একজন ইতিমধ্যে একটা সিটার’ নষ্ট করেছে। শক্তিগড় তেমন কোনও সহজ সুযোগ পায়নি। পাবার কথাও নয়। কেননা, আদৌ উঠে না গিয়ে যেভাবে তারা নিজেদের এলাকাতেই লোক বাড়িয়ে রেখেছে, তাতে মনে হচ্ছে আপাতত তাদের লক্ষ্য হচ্ছে গোল না খাওয়া।
হাফটাইমে দেখলুম পোড়াবাজারের কোচ হাত-পা নেড়ে বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে তার টিমের ছেলেদের কিছু বলছেন। কৃপানাথ এতক্ষণ দোয়ার তলায় আমাদের সঙ্গে বসে খেলা দেখছিলেন। এস. ডি. ও. সাহেব যেহেতু বিরতির পরে আর থাকতে রাজি হলেন না, কৃপানাথ তাই তাকে তার জিপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে, দু’পক্ষের খেলোয়াড়দের বরফ আর কোল্ড ড্রিঙ্কস ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না, তার খোঁজখবর নিয়ে ফিরেও এলেন মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। এসে বেজার মুখে বললেন, “একটা বড় বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছে।”
বললুম, “এর মধ্যে আবার কী হল? কেউ জখম-টখম হয়নি তো?”
“না না, ইনজুরির ব্যাপার নয়।”
“তা হলে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পোড়াবাজার থেকে বাস ভর্তি করে যে-সব সাপোর্টার এসেছে, তারা কোনও গণ্ডগোল বাধাবার তালে নেই তো?”
“আরে না, ওদের সাপোর্টাররা খুব ভালই জানে যে, গণ্ডগোল বাধিয়ে এখানে বিশেষ সুবিধে হবে না।”
“তা হলে?”
“আর বোলো না ভাই!” কৃপানাথ বললেন, “ওদের ওই কোচ ব্যাটাচ্ছেলে কী বলছে জানো?”
“কী বলছে?”
“বলছে যে, ওর পকেটমার হয়েছে! ভাবা যায়?”
“সে কী!” ভাদুড়িমশাই কিছু বলবার আগেই সদানন্দবাবু বললেন, “পকেটমার! সে তো কলকাতার ময়দানে বড় খেলার লাইন পড়লে হয় শুনেছি; আই. এফ. এ. ভার্সাস ইসলিংটন কোরিন্থিয়ানসের খেলার দিনে আমার মেজো মামাবাবুর যেমন হয়েছিল। টিকিট কাউন্টার অব্দি পৌচে দ্যাকেন যে, পকেট ফাঁক, ভিড়ের মদ্যে কে যেন তার মানিব্যাগ তুলে নিয়েছে, তাতে নগদ দশ আনা তিন পয়সা ছিল মশাই, সেটা হাপিস হয়ে যাওয়ায় মেজো মামাবাবুর আর টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকা হল না, মাঠ থেকে শিকদারবাগান অলি হাঁটতে-হাঁটতে ফিরতে হল। কিন্তু সে তো কলকাতার পথেঘাটে হামেশাই ওসব হচ্ছে। বাট দিস ইজ নট ক্যালকাটা, এখানে কোত্থেকে পকেটমার আসবে।”
কৃপানাথ বললেন, “সেটাই হচ্ছে কথা! ব্যাটা আসলে এখানকার লোকদের এগেনস্টে একটা দুর্নাম রটিয়ে দেবার তালে রয়েছে। কিন্তু আমাদের লোক্যাল ছেলেরা যদি এটা টের পায়…মানে..”
কথাটা শেষ করতে গিয়েও শেষ করলেন না কৃপানাথ, এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, “সবই তো বোঝেন।”
সদানন্দবাবু একটা বিপদ ঠিকই আঁচ করেছিলেন, এটাও বুঝেছিলেন যে, কথাবার্তা এখন একটু নিচু গলায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু বিপদটা যে কী হতে পারে, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কৃপানাথের দিকে একেবারে ভ্যাবলার মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তততধিক চাপা গলায় তিনি বললেন, “কী বুজব?”
ওদিকে ততক্ষণে সেকেন্ড হাফের খেলা শুরু হয়ে গেছে। সদানন্দবাবুর কথার উত্তর দিয়ে কৃপানাথ বললেন, “কাণ্ড দেখুন, আমাদের ছেলেগুলো তো একেবারেই অ্যাটাকে যাচ্ছে না। এদের হল কী! কোথায় ওদের এরিয়ার দখল নিবি, তা নয়, গুটিয়ে গিয়ে নিজেদের এরিয়ার মধ্যেই জট পাকিয়ে ঘুরছে।”
ভাদুড়িমশাই বলেলন, “এটা হয়তো ইচ্ছে করেই করছে।”
“কেন, কেন, ইচ্ছে করে করবে কেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “ওরা…আই মিন পোড়াবাজার যেমন এদের গোল-এরিয়ায় এসে হানা দিচ্ছে, তেমনি এদেরও তো ওদের এরিয়ায় গিয়ে হামলা করা উচিত।”
সদানন্দবাবুর অনেক কথাতেই আমি সায় দিই না, কিন্তু এই কথাটায় দিতেই হল। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “সদানন্দবাবু তো ভুল বলেননি। অলরেডি যে ওরা পাঁচ-পাঁচটা কর্নার পেয়েছে, সেটা খেয়াল করেছেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা করেছি বই কী।”
“ওর যে-কোনও একটা থেকে গোল হয়ে যেতে পারত।
“কিন্তু হয়নি যে, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “খেয়াল করে দেখুন, এতগুলো কর্নার পেয়েছে ওরা, সেই সঙ্গে গোল বক্সের একটু বাইরে থেকে দু দুটো ফ্রি-কিকও পেয়েছে, কিন্তু কোনওটা থেকেই কিছু ফয়দা তুলতে পারেনি। এদিকে আবার এই যে ওরা বার-বার এসে এদের গোলবক্সে হানা দিচ্ছে, এতে যে ওদের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে, দম ফুরিয়ে আসছে, ফলে আক্রমণের ঝাঁঝও ক্রমেই কমে যাচ্ছে, সেটা তো কারও না বোঝার কথা নয়।”
কথাটা ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ঠিকই, তবে কিনা বললেন আসলে আমাদের সকলের উদ্দেশেই। কৃপানাথ তাঁর কথার পিঠে কিছু একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি মুখ খুলবার আগেই বছর একুশ-বাইশের কালো, লম্বা, লোহা-পেটানো পেশল শরীরের একটি ছেলে এসে বলল, “জ্যাঠামশাই, আর তো সহ্য হচ্ছে না!”
কৃপানাথের মুখ দেখে মনে হল, তিনি ভয় পেয়ে গেছেন। শুকনো গলায় বললেন, “কেন, নতুন করে আবার কী হল?”
“ওদের কোচটা বলছে যে, যেখানে এলে পকেট মারা যায়, টিম নিয়ে সেই চোর ছ্যাচড়দের জায়গায় খেলতে আসাই উচিত হয়নি।”
“আহাহা, এতে এত রেগে যাচ্ছিস কেন?” ছেলেটিকে শান্ত করার ভঙ্গিতে কৃপানাথ বললেন, “সকলের সব কথা কি ধরতে আছে! আপন মনে তো কত জনে কত কথাই বলে, সে-সব কথা কানে না নিলেই হল!”
“আপন মনে বলেনি জ্যাঠামশাই! চেঁচিয়ে পাঁচজনকে শুনিয়ে বলছিল!”
“তুই নিজের কানে শুনেছিস?”
“আমি শুনিনি, তবে শঙ্কর আর ন্যাপাকে তো আমি ওর খুব কাছেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম, তারা শুনেছে। বলেন তো দু’ঘা লাগিয়ে দিই।”
“আরে না না,” কৃপানাথ শিউরে উঠে বললেন, “ও-সব করতে যাস না। বাইরের টিমের কোচের গায়ে আমরা হাত তুলেছি, এটা যদি রটে যায় তো কী হবে জানিস?”
“কী হবে?”
“বাইরে থেকে কোনও টিমই আর কখনও এই টুর্নামেন্টে খেলতে আসবে না। না না, যে যা-ই বলুক, তোরা বাবারা একটু শান্ত হয়ে থাক তো।”
“ঠিক আছে জ্যাঠামশাই,” ছেলেটি বলল, “আপনি যখন এত করে বলছেন, আমাদের ছেলেগুলোকে তখন সামলে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ফের যদি ও-লোকটা ওই রকমের কথা বলে, তা হলে কিন্তু আগুন জ্বলবে।”
সদানন্দবাবু যে ঘাবড়ে গেছেন, সে তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ছেলেটি চলে যেতে সেই আগের মতো চাপা গলায় কৃপানাথবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন “কী ব্যাপার মশাই? সত্যি-সত্যি আগুন জ্বলবে নাকি?”
কিন্তু কৃপানাথবাবুর কাছ থেকে এবারেও কোনও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল না। এবারেও তিনি সেই আগের মতোই নিস্তেজ, নেতিয়ে পড়া গলায় বললেন, “সবই তো ববাঝেন।”
সদানন্দবাবুর খেলা দেখার উৎসাহ চলে গিয়েছিল। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটা কতা জিগেস করচি, কিছু মনে করবেন না, খেলাটা কি শেষ পর্যন্ত দেকতেই হবে?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে কী মশাই, এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, কে হারে কে জেতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, এ-খেলা শেষ পর্যন্ত না দেখেই উঠে যাবেন?”
“না, মানে শরীরটা একটু খারাপ লাগছে কিনা, তাই ভাবছিলুম..”
“ভাববার কিছু নেই,” আমি বললাম, “নিশ্চিন্ত থাকুন, আগুন জ্বলবে না, ও-সব কথার কথা। আর তা ছাড়া খেলা তো প্রায় শেষ হয়ে এল, আর মাত্র দশ মিনিট।”
শুনে, সদানন্দবাবু কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “দুগা দুগ্ন, এই দশটা মিনিট এখন ভালয়-ভালয় কাটলে বাঁচি।”
আশ্চর্য কাণ্ড, ওই দশ মিনিটের মধ্যেই খেলাটা একেবারে দুম করে বদলে গেল। পোড়াবাজারের সেই মানিকজোড় নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়া করতে করতে একটু বেশি রকমের বিপজ্জনকভাবে এসে পড়েছিল একেবারে শক্তিগড়ের বক্সের সামনে। সেখান থেকে তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ বাঁ দিকের স্টপারকে কাটিয়ে গোলে শট নেয়। কিন্তু একে তো শক্তিগড়ের গোলকিপার আর ডান দিকের স্টপার ততক্ষণে জায়গামতো পজিশন নিয়ে গোলের মুখটাকে খুবই ছোট করে এনেছে তার উপরে আবার ফরোয়ার্ড লাইনের খেলোয়াড়টির খাটুনির চাপ ইতিমধ্যে বড্ড বেশি হয়ে যাওয়ায় তার শটে তেমন জোরও ছিল না। ভূতনাথ ওদিকে বক্সের কাছাকাছি একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল। গড়ানে শটটিকে হাত দিয়ে তুলে নিয়ে গোলকিপার সেটিকে ভূতনাথের দিকে ছুঁড়ে দিতেই বলটিকে ট্র্যাপ করে ভূতনাথ পরক্ষণেই এমনভাবে ছুটতে শুরু করে যে, বুঝতে পারা যায়, এইরকম একটা সুযোগের প্রতীক্ষাতেই ছিল সে। পোড়াবাজারের গোলকিপার আর একজন স্টপার ছাড়া বাকি ন’জন খেলোয়াড়ই তখন শক্তিগড়ের গোলের দিকে উঠে এসেছে, বলতে গেলে বাদবাকি মাঠ একদম ফাঁকা। স্টপারটি তাকে আটকাতে এসেছিল, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যে থেমে থেকে, হঠাৎই গতি বাড়িয়ে ভূতনাথ একেবারে ছিটকে বেরিয়ে যায় তার পাশ দিয়ে। গোলকিপার বিপদ বুঝে সামনে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু ভূতনাথ আর তাকে কাটাবার চেষ্টা না করে ডান পায়ের একটা ছোট্ট টোকায় বলটাকে তার মাথার উপর দিয়ে লব করে গোলে পাঠিয়ে দেয়।
শক্তিগড়ের বাসিন্দারা তো খেলা শুরু হবার ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই দলে দলে মাঠে এসে জমায়েত হয়েছিলেন। সেই জমাটি ভিড়ের ভিতর থেকে পরক্ষণেই যে চিৎকারটা ওঠে, যদি শুনি যে, বর্ধমান শহর থেকেও সেটা শোনা গিয়েছিল তো অবাক হব না। সেটাই অবশ্য শেষ জয়ধ্বনি নয়। খেলা শেষ হতে তখনও আরও মিনিট ছয় সাত বাকি, তারই মধ্যে আরও দু-দুবার জয়ধ্বনি ওঠে। তিনটে গোলই ভূতোবাবুর। তার মধ্যে শেষ গোলটা এল বাইসিল কিক থেকে। আর সেটা আসার সঙ্গে-সঙ্গেই বেজে উঠল রেকারির হুইল। একবার নয়, দু’বার। একটা বাঁশি গোলের, অন্যটা খেলা শেষের।
খেলা শেষ। কিন্তু উত্তেজনা শেষ নয়। শক্তিগড়ের বাসিন্দারা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, জনা কয়েক খেলোয়াড় ভুতোকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘুরছে, কৃপানাথের চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, আর পোড়াবাজারের কোচটি তারই মধ্যে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা যে কী, চারপাশের তুমুল হট্টগোলের মধ্যে কথাগুলো চাপা পড়ে যাওয়ায় তা আর কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
সদানন্দবাবুর ভয় কেটে গিয়েছিল। উত্তেজনায় তিনি টগবগ করে ফুটছিলেন। ভূতনাথের খেলা দেখে তিনি এতই মুগ্ধ যে, পুরস্কার বিতরণের সময় তার নামে একটা মেডেল ডিক্লেয়ার করে দিলেন। বললেন, কলকাতায় গিয়ে আমাদের স্যাকরাকে দিয়ে রুপোর মেডেল বানিয়ে তাতে ভুতোবাবুর নাম খোদাই করে সামনের হপ্তার মধ্যেই পাঠিয়ে দেব।
মারা যাবার পরে সবাই যেমন সাধনোচিত ধামে প্রয়াণ করে, পুরস্কার বিতরণী সভাতেও সভাপতিরা তেমন ‘সময়োচিত বক্তৃতা দেন। ভাদুড়িমশাই একটি সময়োচিত বক্তৃতা দিলেন। খেলাধুলোর উপকারিতা সম্পর্কে দু’চার কথা বলার পরে বিশেষ করে আজকের ফাইনাল খেলা সম্পর্কে বললেন, “পোড়াবাজার বেশ শক্তিশালী দল, কিন্তু একই সঙ্গে একটু বেহিসেবি। নয়তো খেলার প্রথমার্ধে নিজেদের শক্তির চোদ্দো আনাই তারা খরচ করে ফেলত না। এই অপচয়ের মাসুলই তাদের দ্বিতীয়ার্ধে দিতে হয়েছে। শক্তিগড় সেক্ষেত্রে প্রথমার্ধে তাদের শক্তি-সামর্থ্যের ভাড়ার অটুট রেখে পোড়াবাজারের আক্রমণগুলিকে ঠেকিয়ে গিয়েছে মাত্র। দ্বিতীয়ার্ধেরও অনেকটা সময় তারা আক্রমণে ওঠেনি। উঠেছে একেবারে শেষ সময়ে, যখন সেই আক্রমণ ঠেকাবার মতো সামর্থ্য আর পোড়াবাজারের ছিল না। খেলার সঙ্গে যুদ্ধের তুলনা টেনে বলা যায়, এও আসলে এক ধরনের ওয়ার অব অ্যাট্রিশন। নিজের পুঁজি যতটা পারা যায় অটুট রেখে শত্রর পুঁজিকে শেষ করে আনা। শক্তিগড়ের এই যে কৌশল, এটাই তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে।”
খেলার ফলাফল সম্পর্কে ভাদুড়িমশাইয়ের এই যে ব্যাখ্যা, এটা নিয়ে যে আমার মনে কোনও ধন্ধ ছিল না, তা নয়, কিন্তু তখন আর এ নিয়ে কিছু বললাম না। কথাটা তুললুম ঘণ্টা কয়েক বাদে। রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর।
রেফারির শেষ হুইল বাজার পরে মাঠের মধ্যে যে জয়োল্লাসের সূচনা হয়, তার জের তখনও পুরোপুরি মেটেনি। ভূতনাথের গলায় যে গণ্ডা-দশেক পুষ্পমাল্য পরানো হয়েছে, তাতেই তার একেবারে ঢাকা পড়ে যাবার জোগাড়। সেই অবস্থায় একটা লরির উপরে বসিয়ে ভূতনাথ সমেত গোটা টিম নিয়ে সারা তল্লাট জুড়ে ঘোরা হয়েছে। হঠাৎ যে সেই লরিতে কেন সদানন্দবাবুকে তুলে দেওয়া হয়েছিল, ঈশ্বর জানেন; তবে ছেলেছোকরাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও দেখলুম সমানে চেঁচাচ্ছেন : শিন্ড ফাইনাল জিতল কে, শক্তিগড় ইউনাইটেড আবার কে। বার কয়েক পাড়া প্রদক্ষিণ করে ছেলেছোকরার দল দত্তবাড়ির সামনে এসে জমায়েত হবার পরে তাদের মধ্যে ল্যাংচা বিতরণের পর্বও শেষ হয়েছে। এ-দিক ও-দিক থেকে তার পরেও যে জয়ধ্বনি উঠছে না, তা নয়, দু-চারটে বোমা-পটকাও ফাটছে মাঝে-মধ্যে, তবে খানিক আগের সেই মত্ত ভাবটা এখন আর নেই।
কৃপানাথের পরের ভাই শম্ভুনাথের উপরেই যেহেতু অতিথি-আপ্যায়ন ও ল্যাংচা বিতরণের দায়িত্ব ছিল, তাই এতক্ষণ তিনি দম ফেলবার ফুরসত পাচ্ছিলেন না। হই-হল্লা থেমে যাবার পরে রাত দশটা নাগাদ তিনি আমাদের কাছে এসে বললেন, “আপনারা তো কাল ভোরেই রওনা হচ্ছেন, তা হলে আর দেরি করা ঠিক হবে না, রাত্তিরের খাওয়া চুকিয়ে এবারে শুয়ে পড়াই ভাল।”
শুতে শুতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বারোটাই বাজল। তার আগে কালকের মতো আজও দোতলার বারান্দায় এসে বসেছি। হঠাৎ ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী ব্যাপার বলুন তো কিরণবাবু, মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে আপনি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন।”
হেসে বললুম, “না না, তেমন কিছু না, তবে কিনা একটা ব্যাপার নিয়ে যে একটু ভাবছি, সেটা ঠিক। তাই নিয়ে একটু অস্বস্তিও হচ্ছে।”
“কী নিয়ে ভাবছেন?”
“আপনারই একটা কথা নিয়ে। মাঠে আপনার বক্তৃতায় আপনি বললেন যে, পোড়াবাজার টিমের তাবৎ শক্তি খেলার ফাস্ট হাফেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই শেষ দিকে আর তারা কিছু করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সত্যিই কি তা-ই?”
তা ছাড়া আর কী,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেকেন্ড হাফের শেষ দিকে তো সেই জন্যেই ওরা শক্তিগড়ের ফরোয়ার্ড লাইনকে আটকাতে পারল না। ভীষণ হাপসে গেল যে!”
বললুম, “তা-ই যদি হবে তত সেমিফাইনালের দিনে দুই হাফেই পোড়াবাজার অত ভাল খেলল কী করে? নব্বই মিনিটের খেলা, তার প্রথম থেকে শেষ মিনিট পর্যন্ত ওরা একইরকম স্পিডে, একইরকম দাপটের সঙ্গে সেদিন খেলেছে। বিশেষ করে ওই মানিকজোড়। কই, ফাস্ট হাফে যে ওয়র্ক-লোড ওরা নিয়েছিল, তার জন্যে তো সেদিন সেকেন্ড হাফে ওরা একটুও হাপসে যায়নি। আজ তা হলে এমন হল কেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আহা, বাইচং আর চিমাও কি রোজই ভাল খেলে নাকি। মাঝে-মাঝে কি ওরাও ঝিমিয়ে যায় না? ধরে নিন, পোড়াবাজারের ওই মানিকজোড়ও আজ ঠিক ফর্মে ছিল না, ফাস্ট হাফে ভাল খেললেও সেকেন্ড হাফে ঝিমিয়ে গিয়েছিল।
শুনে চুপ করে গেলুম বটে, কিন্তু ব্যাখ্যাটা খুব জুতসই বলে মনে হল না, অস্বস্তির একটা কাটা কোথাও বিধেই রইল। ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বললুমও। হেসে বললুম, “যা-ই বলুন মশাই, ধাঁধাটা কিন্তু কাটল না।”
.
॥ ৫॥
আজ ১৪ এপ্রিল সোমবার। ভোর ছ’টায় শক্তিগড় থেকে রওনা হয়ে সাড়ে আটটায় বালি ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছই। ভেবেছিলুম সাড়ে ন’টার মধ্যেই শেয়ালদায় আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যাব। সেখানে আমাকে আর সদানন্দবাবুকে নামিয়ে দিয়ে ফ্লাইওভার পেরিয়ে ফের উত্তরমুখো হয়ে আপার সার্কুলার রোড ধরে ভাদুড়িমশাই কাকুরগাছিতে চলে যাবেন। কিন্তু আজ বাংলা নববর্ষ। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা নানান জায়গায় মিছিল বার করেছে। ব্যান্ড পার্টিও বেরিয়েছে এখানে-ওখানে। ফলে ইতস্তত গাড়িঘোড়া আটকে গিয়ে জ্যামও নেহাত কম হচ্ছে না। দক্ষিণেশ্বর থেকে শেয়ালদা পৌঁছতে তাই পাক্কা দু ঘণ্টা লেগে গেল। দুপুরে একটু দেরি করে আপিসে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা। তারপর গান করে, রাত্তিরের খাওয়া চুকিয়ে বসার ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে এখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। নতুন একটা বই বেরোচ্ছে। পাবলিশার তার প্রুফ দিয়ে গেছে। একটু বাদে সেই পুফ নিয়ে বসব। তার আগে বরং যে ঘটনার কথা এখানে বলতে বসেছি, তার শেযটুকু বলে নিই।
কালকের শিল্ড ফাইনালে পোড়াবাজারের অত খারাপ খেলার যে ব্যাখ্যা ভাদুড়িমশাই দিয়েছিলেন, তা যে আমার মনঃপুত হয়নি, তা তো আগে বলেইছি। এও বলেছি যে, ভাদুড়িমশাই যা-ই বলুন, অস্বস্তির একটা কাটা আমার মনের মধ্যে তার পরেও বড্ড খচখচ করছিল। রাত্তিরে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে, সদানন্দবাবুর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, অস্বস্তি একা আমার নয়, তারও। বিছানায় শুয়ে দু’চার বার এপাশ ও পাশ করে সদানন্দবাবু বললেন, “দেকুন মশাই, একটা কতা বলব?”
বললুম, “বলে ফেলুন।”
“আমরা তো এঁয়াদের গেস্ট, ঠিক কি না?”
“বিলক্ষণ।”
“এঁয়ারা আমাদের খুবই যত্ন-আত্তি করচেন, ঠিক কিনা?”
“সে আর বলতে?”
“পঞ্চব্যঞ্জনের বদলে পঞ্চান্ন ব্যঞ্জন খাওয়াচ্চেন বললেই ঠিক হয়, তাই না?”
“অবশ্য।”
“তার উপরে দেকুন, মুখ ফুটে কিছু বলবার আগেই এয়ারা স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে তিন হাঁড়ি ল্যাংচা আনিয়ে রেকেচেন। কেন জানেন?”
“কেন?”
“কাল সকালে, আমাদের গাড়িতে তুলে দেবেন।”
“বলেন কী?”
“ঠিকই বলছি।” সদানন্দবাবু বললেন, “এবারে আপনি বেশ ভেবেচিন্তে একটা কতা বলুন তো।”
“কী বলব?”
“যারা আমাদের জন্যে এত করচেন, শিল্ড ফাইনালে এই যে তারা জিতলেন, এতে তো আমাদের খুশি হওয়াই উচিত, তাই না?..না না, তাড়াহুড়ো করতে হবে না, বেশ ভেবেচিন্তে বলুন।”
“এতে এত ভাববার কী আছে,” বললুম, “নিশ্চয় খুশি হওয়া উচিত।”
ঘর অন্ধকার। তবু বুঝলুম, সদানন্দবাবু একটা দীর্ঘ নিশাস মোচন করলেন। বললুম, “কী হল, চুপ করে গেলেন কেন?”
“কী আর বলব বলুন,” খুবই বিভ্রান্ত গলায় সদানন্দবাবু বললেন, “খুশি হওয়াই যে উচিত, তা কি আর আমি জানি না? জানি। কিন্তু হতে পাবচি কোতায়?”
“তার মানে?”
“মানে আর কিচুই নয়, ব্যাপারটা একটু ফিশি লাগছে।” এক সেকেন্ড চুপ কবে থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “আপনার লাগছে না?”
“পোড়াবাজারের ওই ছেলে দুটোর কথা ভেবে এ-কথা বলছে তো?”
“এগজ্যাকটলি। পরও ওরা অত ভাল খেলেছিল। আজও ফাসঁ হাফে দাপিয়ে খেলেছে। অথচ তার পরেই কেমন যেন চুপসে গেল। কোনও মানে হয়?”
বললুম, “ভাদুড়িমশাই তো বললেন, ফার্স্ট হাফে অত দাপিয়ে খেলার জন্যেই সেকেণ্ড হাফে হাসে গেসল। তখন আর দম পায়নি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সে তো উনি ওঁর বক্তৃতাতেও বলেছেন, আবার একটু আগে বারান্দায় বসেও বললেন। কিন্তু আপনাকে ওই কতাটা যখন বলেন, তখন ওঁয়ার মুকটা দেখেছিলেন?”
“না তো।”
“দেকলে বুজতেন যে, ওটা ওঁয়ার মনের কতা নয়।”
“এটা কী করে বুঝলেন?”
“মুক দেকে বুজলুম।” সদানন্দবাবু বললেন, “উনি তখন মুক টিপে হাসছিলেন।”
অস্বস্তি তো একটা ছিলই, সদানন্দবাবুর কথা শুনে সেটা আরও বেড়ে যায়। তবে কাল রাত্তিরে এ নিয়ে আর কথা হয়নি। দিনটা ঘোর উত্তেজনার মধ্যে কেটেছে, খেলা শেষ হওয়ার পর আর-সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও নেহাত কম চেঁচাইনি, হয়তো সেই জন্যেই একটু ক্লান্ত ছিলুম, খানিক বাদেই তাই ঘুমিয়ে পড়ি।
কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি থেকে গেলে যা হয় আর কি, ঘুমটা বিশেষ সুবিধের হল না।
আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। স্রেফ চা-বিস্কুট খেয়ে কাটায় কাটায় ছটায় আমরা দত্তবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। শক্তিগড়ে আসার পথে কলকাতা থেকে মগরা পর্যন্ত আমি গাড়ি চালিয়ে এসেছিলুম, সেখান থেকে শক্তিগড় পর্যন্ত স্টিয়ারিং হুইলে ছিলেন ভাদুড়িমশাই। ফিরতি পথে আমি যে মগর পর্যন্ত গাড়ি চালাব, আর সেখান থেকে কলকাতা পর্যন্ত ভাদুড়িমশাই, এটা আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল। সেই অনুযায়ী মগরা পৌঁছে রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বলি, “নিন, আপনি এবারে স্টিয়ারিং হুইলে এসে বসুন।”
ভাদুড়িমশাই তাতে হেসে বলেন, “তা বসছি। কিন্তু তার আগে একবার চা খেয়ে নিলে হত না?”
বললুম, “বিলক্ষণ।”
চায়ের দোকানের সামনেই গাড়ি দাঁড় করিয়েছি, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভাদুড়িমশাই দোকানিকে বললেন, “তিনটে চা দিন তো। দুধ আর চিনি কম দেবেন, চা বেশ কড়া হওয়া চাই।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার ধাঁধা কেটেছে?”
হেসে বললুম, “না।”
“ঠিক আছে, সেটা কাটিয়ে দিচ্ছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নইলে মগরার বিখ্যাত চা খেয়েও আপনার শাস্তি হবে না। আরে মশাই, কালকের খেলায় প্রথম হাফে অত লম্ফঝম্প করার পরে পোড়াবাজার যে সেকেন্ড হাফের শেষের দিকে একেবারে ঝিমিয়ে গিয়েছিল, সেটাই তো স্বাভাবিক।”
সদানন্দবাবু বললেন, “এ-কতা কেন বলচেন সেমিফাইনালের দিনেও তো ওদের খেলা আমরা দেকিচি। সেদিন কিন্তু দুটো হাফেই ওরা সমান দাপটে খেলেছিল।”
আমি বললুম, “কালকের খেলাকে সেইজন্যেই আমাদের অস্বাভাবিক লেগেছে।”
“আরে মশাই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাদেব মুশকিল কী হয়েছে জানেন? যা স্বাভাবিক, তাকে আপনারা অস্বাভাবিক ভাবছেন, আর অস্বাভাবিকটাকেই ভাবছেন স্বাভাবিক।”
“তার মানে?”
“তার মানে সেমিফাইনালের দিন ওরা যা খেলেছে, সেটা মোটেই স্বাভাবিক খেলা নয়। শুরু থেকে শেষ অব্দি পুরো নব্বইটা মিনিট কেউ ওই রকমেরর সমান দাপটে খেলতে পারে না। বিশেষ করে চোত মাসের চাদি-ফাটা রোদ্দুরে। না না, ওটা সম্ভব নয়।”
“তা হলে ওরা পারল কী করে?”
“সেটাই হচ্ছে কথা।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সেদিন যে ওরা পেরেছিল, নিশ্চয় তার একটা কারণ ছিল। আবার কাল যে ওরা পারেনি, তারও নিশ্চয় একটা কারণ আছে।”
বললুম, “হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে, বড় হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে ভাদুড়িমশাই। কারণটা কী, সেটা খুলে বলুন তো! ঘুষ?”
“যাচ্চলে, কে কাকে ঘুষ দেবে? আর দেবেই বা কেন?”
“বাঃ, কে ঘুষ দেবে, আর কেন দেবে, সেটা বোঝা কি খুব কঠিন নাকি?” আমি বললুম, “কৃপানাথ তো বলেইছিলেন যে, অন্তত একবার ওঁরা শিল্ডটা পেতে চান। বলেননি?”
“হ্যাঁ, তা তো সে বলেইছিল,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাতে দোষের কী আছে?”
“চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই।” তেতো গলায় আমি বললুম, “কিন্তু যা চাইছি, ঘুষ দিয়ে পাওয়ার মধ্যে আছে।”
ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠে বললেন, “কৃপানাথকে আপনি চেনেন না। চিনলে অমন কথা বলতেন না। যা-ই হোক, কারণটা ঘুষ নয়।”
“কারণটা তা হলে কী?”
তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সরু চোখে ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে, রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর তার পাঞ্জাবির ঝুল-পকেট থেকে একটা কাঁচের শিশি বার করে আমাদের সামনে সেটা তুলে ধরে বললেন, “এই হচ্ছে কারণ। এর মধ্যে ছোট-ছোট কিছু ট্যাবলেট আছে। সেমিফাইনালের দিন হাফটাইমের সময় পোড়াবাজারের ছেলেদের প্রত্যেককে এই ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছিল বলেই সেকেন্ড হাফেও তাদের তেজ আর দাপট কিছু কমেনি, আর ফাইনালের দিন হাফ-টাইমের সময় এটা খায়নি বলেই সেকেন্ড হাফে তারা ঝিমিয়ে যায়।
শুনে আমি স্তম্ভিত। বললুম, “এ তো ড্রাগ!”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মারাত্মক ড্রাগ! আপনাকে যদি এই ট্যাবলেট খাইয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়, তো এই বয়সেও আপনি বোধহয় মিলখা সিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়তে চাইবেন।”
সদানন্দবাবুর চোখ দুটো প্রায় কপালে উঠে গিয়েছিল। বাকশক্তিও লোপ পেয়ে থাকবে। সেটা ফিরে পাবার পরে বললেন, “এই শিশিটা আপনি পেলেন কোতায়?”
“পোড়াবাজারের কোচের পকেটে। ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “খেলা শুরু হবার আগে ওই যে আমাদের সঙ্গে দুই দলের খেলোয়াড়দের খুব কোলাকুলি হল না?”
“তা তো হল।”
“সেই সময় কোচ দু’জনের সঙ্গেও কোলাকুলি করেছিলাম যে! সেই তখনই পোড়াবাজারের কোচের পকেট থেকে এটা আমি তুলে নিই।”
শুনে, আমার অবস্থাও সদানন্দবাবুর মতো। কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলুম । তারপর বললুম, “তার মানে…”
“তার মানে আর কিছুই নয়,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেমিফাইনালের দিন ওদের খেলা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, এটা ভোপিংয়ের ব্যাপার, ড্রাগের ভূতের সাহায্য ছাড়া ওই অস্বাভাবিক স্ট্যামিনা আর স্পিড কিছুতেই শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা সম্ভব নয়।..নিন, এবারে শান্তিতে চা খান।”