ভুতুড়ে গল্প

ভুতুড়ে গল্প

বাড়িটাতে পা দিয়েই আমার মেজো পিসেমশাই টের পেলেন কাজটা ভালো করেননি। বাড়িটার বাইরে থেকেই গা ছম্‌ছম্‌ করে। কবেকার পুরোনো বাড়ি, দরজা-জানলা ঝুলে পড়েছে, শ্যাওলা জন্মে গেছে, ফোকরে ফাটলে বড়-বড় অশ্বত্থগাছ গজিয়েছে, ফটক থেকে সামনের সিঁড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা আগাছায় ভর্তি আর তার দু পাশের শিরীষ গাছগুলো ঝোপড়া হয়ে মাথার উপর আকাশটাকে অন্ধকার করে রেখেছে। সন্ধেও হয়ে এসেছে, চারিদিকে সাড়াশব্দ নেই, কেমন একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে।

মেজো পিসেমশাই হাতের লণ্ঠনটা জ্বেলে ফেললেন। বার বার দোতলার ভাঙা জানলার উপর চোখ পড়তে লাগল, বার বার মনে হতে লাগল এক্ষুনি জানলার সামনে থেকে কে বুঝি সরে গেল। মেজো পিসেমশাইয়ের তো অবস্থা কাহিল। অথচ উনি ভূত বিশ্বাস করেন না। সেইজন্য তাল ঠুকে ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভিতরে।

গঙ্গার উপর বাড়ি। ঢুকেই একটা বড় খালি হলঘর, আবছায়াতে হাঁ করে রয়েছে, লণ্ঠনের আলোতে দেয়ালে পিসেমশাইয়ের প্রকাণ্ড ছায়াটা নড়ে বেড়াচ্ছে। পিসেমশাই তাড়াতাড়ি হল্‌ পেরিয়ে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালেন। প্রকাণ্ড একটা বারান্দা, তার রেলিং ভাঙা, তার পর একফালি শান-বাঁধানো চাতাল, তার চারিদিকে সাদা সাদা পাথরের মূর্তি সাজানো। তারপরেই ঘাটের ভাঙা সিঁড়ি জল অবধি নেমে গেছে, তার অসংখ্য ইঁট জলে ধুয়ে গেছে। সিঁড়ির পাশেই একটা বুড়ো বাতাবিলেবুর গাছ, তার নীচে কবেকার পুরোনো ইঁটের গাদা, রোদে পুড়ে জলে ভিজে কালো হয়ে গেছে। গঙ্গার ওপারে জুট মিলের সাহেবদের বাড়িতে আলো জ্বলছে দেখে পিসেমশাই ফোঁস্ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

একতলায় বসে থাকলে চলবে না। উপরে যেতে হবে, রাত কাটাতে হবে। নইলে বাজি হেরে যাবেন; ক্লাবে মুখ দেখাতে তো পারবেনই না, উপরন্তু জগুর বাবা সোনালী ছাগলটাকে নিয়ে যাবেন।

হলের দুপাশে সারি সারি ঘর, তাদের দরজাগুলো আধখোলা। দু-একটা বিশাল বিশাল কারিকুরি-করা ভাঙা তক্তপোষ, দু-চারটে প্রকাণ্ড খালি সিন্দুক, এক-আধটা বৃহৎ রঙচটা আয়না ছাড়া কোথাও কিছু নেই। মেজো পিসেমশাই তাড়াতাড়ি একবার সবটা দেখে নিয়ে এক দৌড়ে উপরে উঠে গেলেন।

দোতলাটাও ঠিক একতলার মতো। সেখানেও মাঝখানে প্রকাণ্ড একখানি হল্‌। তার মধ্যে আসবাব কিছু নেই, খালি মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড বড় ঘোর নীল রঙের গালচে পাতা, তাতে বহুদিনের ধুলো জমে পুরু হয়ে রয়েছে। আর ঘরের কোণে দেয়ালে একটা সেতার ঝুলছে, তাতে তারের কোনো চিহ্ন নেই।

মেজো পিসেমশাই খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দেয়ালের দিকে পিঠ করে, যাতে পিছন দিক থেকে হঠাৎ কিছুতে এসে না পড়ে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলেও চলবে না। প্রত্যেকটা ঘরের বর্ণনা দিতে হবে, তাই প্রত্যেকটা ঘর একবার দেখা দরকার! ভয় আবার কীসের? ভূত তো আর হয় না। ঘরগুলি প্রায় সব কটাই দরজা খোলা। একেবারে খালি, ধুলোয় ধূসর। দু-একটাতে ভাঙা ভাঙা আলমারি, প্রকাণ্ড জলচৌকি দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখেন আলো ঝোলাবার বড়-বড় হুক আছে, তার আশেপাশের ছাদটাতে ঝুলকালির দাগ রয়েছে। মেজো পিসেমশাই দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তা ছাড়া রাতই যখন কাটাতে হবে একটা বসবার জায়গা তো চাই।

হলের ওপাশে, গঙ্গার উপরে চওড়া বারান্দা। গঙ্গায় একটা স্টিমার যাচ্ছে, তাতে মানুষ আছে, আলো জ্বলছে। ওপারে শত শত আলো জ্বলছে। মেজো পিসেমশাই রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ালেন, ভর দিতে ভয় করে। যদি ভেঙে পড়ে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন—ঐ তো জাহাজে কত লোক দেখা যাচ্ছে, আঃ।

“এনেছিস? কই দেখি।”

চমকে মেজো পিসেমশাই ফিরে দেখেন গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন সাদা জাব্বাজোব্বাপরা একজন বুড়োমতো লোক। কী ভালো দেখতে, হাতির দাঁতের মতো গায়ের রঙ, দাড়ি নেই, লম্বা গোঁফটা পাকিয়ে পাকিয়ে কানের উপর তুলে রেখেছেন, টানা টানা চোখ। আশ্চর্য ফরসা একখানি হাত বাড়িয়ে বললেন, “দে, দে, দেরি করিস নে। কখন এসে পড়বে।”

মেজো পিসেমশাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন লোকটার গলায় মুক্তোর মালা জড়ানো, কানে মুক্তো পরা, হাতের ভুল আঙুলে হীরের আংটি। এ্যাঁ! এ আবার কে!

লোকটি এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুই কি বোবা হলি নাকি রে? আজকাল সব যা-তা চাকর রাখতে আরম্ভ করেছে দেখছি। আছে, না নেই?”

মেজো পিসেমশাইয়ের গলা-টলা শুকিয়ে একাকার, নীরবে মাথা নাড়লেন।

লোকটি হতাশভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, “একটা বসবার জায়গাও কি এগিয়ে দিতে পারিস না? মাইনে খেতে লজ্জা করে না তোর? আমি আর কে, তা বটে তা বটে, আমি এখন আর কে যে আমার কথা শুনবি?”

হঠাৎ কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বললেন, “অত যে নিলি তখন মনে ছিল না হতভাগা? এর জন্য তোকে কষ্ট পেতে হবে বলে রাখলাম, কী ভীষণ কষ্ট পেতে হবে জানিস না। তিলে তিলে তোকে—ঐ রে, এল বুঝি।”

বিদ্যুতের মতো বুড়ো লোকটি হলের পাশের ঘরটাতে ঢুকে পড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

মেজো পিসেমশাইয়েরও যেন কানে এল স্পষ্ট পায়ের শব্দ। দেয়ালের মতো সাদা মুখ করে লণ্ঠনটাকে উঁচু করে ধরে, চারি দিক ভালো করে দেখে নিলেন, কেউ কোথাও নেই। লোকটা নিশ্চয় পাগল-টাগল হবে। অত গয়নাগাটিই-বা পেল কোত্থেকে? কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল।

লণ্ঠন হাতে বারান্দা থেকে হলে ঢুকলেন। নীচের তলাটা বরং ভালো, একটা তক্তপোষে বসে বসেই রাত কাটানো যাবে। পকেট চাপড়ে দেখলেন ‘অশরীরী-খুনে’ লোমহর্ষণ ১০ নং খানা দিয়ে দিতে জগুর বাবা ভোলেননি। রাত জেগে ঐটি পড়ে শেষ করে কাল সকালে আগাগোড়া গল্পখানি বলতে হবে। তবে বাজি জেতা।

পা টিপে টিপে হল্‌ পার হয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সদর দরজার ডান পাশের ঘরখানিতে ঢুকে, ভাঙা সিন্দুকের উপর লণ্ঠন নামিয়ে, তক্তপোষের কোণটা ধুতির খোঁট দিয়ে ঝেড়ে, ধপ করে পিসেমশাই বসে পড়লেন। ময়লা খোঁটটা দিয়েই গলার, কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। আঃ, বাঁচা গেল। ভাগ্যিস ভূতে বিশ্বাস করেন না! নইলে তো আজ ভয়েই আধমরা হয়ে যেতে হত।

সামনের রঙচটা আয়নাতে একখানি সাদা ছায়া পড়ল। বুড়ো লোকটি ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে, অনুনয়ের স্বরে বললেন “দিয়েই দে না বাবা। তোর আর কী কাজে লাগবে বল? যারা দেয় তারা প্রাণ হাতে করে এনে দেয়। না পেলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যায়। কেন দিচ্ছিস না, বাপ? একে একে সবই তো প্রায় নিয়েছিস, আরো চাস বুঝি? তোর প্রাণে কি মায়া-দয়াও নেই? প্রথম যখন এলি, কী ভালো মানুষটিই ছিলি? আমি উপরের ঐ নীল গালচেটাতে বসে সেতার বাজাতাম, আর তুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে শুনতিস। তোকে কত-না ভালো বাসতাম, এটা-ওটা রোজই দিতাম, কত-না ভালোমানুষ সেজে থাকতিস৷ ভেতরে ভেতরে তুই যে এত বড় একটা বিশ্বাসঘাতক কেউটে সাপ তা কি আর জানি।”

মেজো পিসেমশাই লাফিয়ে উঠে এক হাত সরে দাঁড়ালেন। বুড়ো লোকটিও খানিকটা এগিয়ে এলেন, রাগে তাঁর দু চোখ লাল হয়ে গেল, ফরসা দুটো মুঠো পাকিয়ে মেজো পিসেমশাইয়ের নাকের কাছে ঘুষি তুলে বললেন, “একদিন এই ঘুষিকে দেশসুদ্ধ লোকে ভয় করত, কোম্পানির সাহেবরা এসে এর ভয়ে পা চাটত। এখন বুড়ো হয়ে গেছি, দুর্বল হয়ে গেছি, তাই আমার বাড়িতে আমার মাইনে-খাওয়া চাকর হয়ে তোর এত বড় আস্পর্ধা। তবে এখনো মরিনি, এখনো তোকে এক মুঠো ভস্মে—না রে না, কী বাজে কথা বলছি। দিয়ে দে বাবা, দেখ তোকে তার বদলে কী দেব।”

এই বলে বুড়ো লোকটি আঙুল থেকে হীরের আংটিখানি খুলে মেজো পিসেমশাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মরিয়া হয়ে পিসেমশাই ইদিক-উদিক তাকালেন। কী যে দেবেন ভেবে না পেয়ে, পকেটে হাত দিতেই গোলাপী বিড়ির প্যাকেট দুটোর উপরে হাত পড়ল। তাই বের করে বুড়োর হাতে দিয়ে দিলেন।

“সত্যি দিলি? আঃ, বাঁচালি বাবা। এই নে, আমি আশীর্বাদ করছি তোর একশো বছর পরমায়ু হবে।”

এই বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, মেজো পিসেমশাইয়ের বুকপকেটে আংটি ফেলে দিয়ে হলের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ির দিকে দে ছুট। পিসেমশাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। সিঁড়ির প্রথম ধাপটা অবধি তাঁকে লণ্ঠনের ক্ষীণালোকে দেখতে পেলেন, তার পর তিনি যেন বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। আর পিসেমশাইও তক্ষুনি “আরে বাপ” বলে মূর্ছা গেলেন।

পরদিন সকালে জগুর বাবা, পটলের মামা, আমার বাবা, আরো পাঁচ-সাতজন গিয়ে ঠ্যাঙ ধরে টেনে পিসেমশাইয়ের ঘুম ভাঙালেন। উঠে দেখেন ঘরদোর রোদে ভরে গেছে। তাঁরা বললেন, “উপরে গেছিলি? তবে দে, উপরের বর্ণনা দে।”

ঠিক বলছেন কি না পরখ করবার জন্য সবাই মিলে উপরে গেলেন। পিসেমশাইও গেলেন। সব ঘরদোর শূন্য হাঁ হাঁ করছে। জগুর বাবা তো রেগে টং। ইস্‌, অত ভালো ছাগলছানা হাতছাড়া হয়ে গেল। ইস্, ক্লাবের রাক্ষসগুলোকে তার উপরে বাজির খাওয়া খাওয়াতে হবে।

মাটিতে ‘অশরীরী-খুনে’ পড়ে ছিল।

“এ্যাঁ! ঠিক হয়েছে। বড় যে ঘুমুচ্ছিলি, বইটা পড়েছিলি? বল তবে, আগাগোড়া গল্পটা বল।” মেজো পিসেমশাই-এর মুখে আর কথাটি নেই। মনে মনে দেখতে পেলেন জগুর বাবা সোনালী ছাগলটাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। সারারাত ঘুম লাগিয়েছেন, স্বপ্ন দেখেছেন, তার উপযুক্ত সাজা তো হবেই।

লজ্জায়, দুঃখে, মাথা নিচু করতেই চোখে পড়ল বুক পকেটের ভিতর হীরের আংটি জ্বল্‌জ্বল্‌ করছে। মেজো পিসেমশাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বললেন, “নিয়ে যা তোর ছাগল। ইস ভারী তো ছাগল।” বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোজা বাড়িমুখো রওনা দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *