ভুতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভুতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

যে কাজ যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, কিংবা যে কাজ আশ্চর্যজনক ভাবে ঘটে যায়, তাকে আমরা বলি ভূতুড়ে কাণ্ড৷

আবার ভূতেরা নিজে যে কাজ করে তাকে তো ভূতুড়ে কাণ্ড বলেই৷

আমাদের পরিবারে এমনি এক ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটেছিল৷

পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছি৷ দিদিমা আর মামাদের আদরের সঙ্গে প্রচুর আম জাম জামরুল খাচ্ছি৷ তোফা আনন্দে সময় কাটাচ্ছি৷

তিন মামা৷ বড়মামা রেল অফিসে কাজ করতেন৷ বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে শহরের বাসাবাড়িতে থাকতেন৷ মাসে একবার বাড়িতে আসতেন৷

তিনি মেজমামাকে তাঁরই অফিসে চাকরি করে দেবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু মেজমামা রাজী নন৷ ছেলেবেলা থেকে মেজমামা একটু ভিন্ন প্রকৃতির৷ সব ব্যাপারেই বেপরোয়া৷

তিনি বলেছিলেন, চাকরি-বাকরি আমার ধাতে পোষাবে না৷ আমি স্বাধীন ব্যবসা করব৷

তা মেজমামা স্বাধীন ব্যবসাই শুরু করেছিলেন৷ পাঁচ মাইল দূরের মাছের ভেড়ি থেকে মাছ কিনে গঞ্জের হাটে ব্যাপারীদের কাছে সেই মাছ বিক্রি করা৷ পরিশ্রমের কাজ কিন্তু ভালো টাকাই হাতে থাকত৷

ছোটমামা কিছু করত না৷ মামাদের চাষবাসের জমি দেখত আর অবসর সময়ে জাল দিয়ে পাখি ধরত, কাঠি দিয়ে খাঁচা তৈরি করত আর তাতে পাখিগুলোকে রাখত৷ তবে বেশিদিন নয়, হঠাৎ একদিন খাঁচার দরজা খুলে পাখিগুলোকে উড়িয়ে দিত৷ এক নম্বরের খেয়ালী লোক৷

আমাদের গল্প অবশ্য মেজমামাকে নিয়ে৷

গল্পই বা বলি কেন, একেবারে আমার চোখে দেখা ঘটনা৷

মেজমামা খুব ভোরে উঠে সাইকেলে রওনা হয়ে যেতেন৷ খুব ভোরে, তখন ভালো করে আলোও ফুটত না৷ রাস্তাটা অনেকটা পাকা নয়—মানুষের পায়ে পায়ে চলা সরু একটু রেখা৷ বেশ কিছুটা যাবার পর ইউনিয়ন বোর্ডের পাকা রাস্তা৷

একদিন ভোরেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন৷ থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের গর্জন৷ বোঝা যাচ্ছে একটু পরেই ঝড়জল শুরু হয়ে যাবে৷

মেঘের ডাকে আমিও ভোর ভোর উঠে পড়েছি৷ উঠে মেজমামার যাওয়ার তোড়জোড় দেখছি৷

দিদিমা বললেন, ওরে, এই আবহাওয়ায় আজ না হয় নাই বেরোলি৷ আকাশের অবস্থা ভালো নয়৷ এখনই জোর তুফান উঠছে৷

ঝড়কে দিদিমা তুফান বলতেন৷

মেজমামা হাসলেন, তাহলে তো বর্ষাকালে বাড়ির বাইরে যাওয়া যায় না৷ আমার কাছে বর্ষাতি আছে৷ কোনো অসুবিধা হবে না৷

মেজমামা যখন বের হলেন, তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে৷ বাতাসও বেশ জোর৷

আধ ঘণ্টার মধ্যে দারুণ ঝড় উঠল৷ চারদিক অন্ধকার৷ বাজের শব্দে কান পাতা দায়৷ সেই সঙ্গে তুমুল বর্ষণ৷ এধারে ওধারে বড় বড় গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ল কি বাড়ির চালা উড়ে গেল৷ ধসে পড়ল মাটির দেয়াল৷ দিদিমার কথাই ঠিক৷ তুফানই বটে৷

আমি জানলার ধারে চুপচাপ বসে প্রকৃতির তাণ্ডব দেখছি৷ একটু পরেই দিদিমা এসে আমার পাশে বসলেন৷

বসেই আক্ষেপ করতে লাগলেন, এই দুর্যোগে বাড়ির কুকুর বেড়াল বাইরে বের হয় না, আর এত বারণ করা সত্ত্বেও ছেলেটা রাস্তায় বের হল!

সত্যিই চিন্তার কথা৷ এই ঝড়জলে বর্ষাতি আর মেজমামাকে কতটুকু বাঁচাতে পারবে! হাওয়ার দাপটে সাইকেল চালানোই মুশকিল৷ সাইকেল থেকে নেমে যে কোনো গাছের তলায় আশ্রয় নেবেন, তাও নিরাপদ নয়৷ মাথার ওপর গাছের ডাল ভেঙে পড়লেই হল৷

সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা ঝড়বৃষ্টি চলল৷ দিদিমা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে বিছানা নিলেন৷ মেজমামার নাম করে অঝোরে কান্না৷

মেজমামা ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ৷ সাইকেল নেই, হেঁটেই এসেছেন৷ হাঁটু পর্যন্ত কাদা৷ পরনের জামা কাপড় ছিন্নভিন্ন৷ বর্ষাতির খোঁজ নেই৷

দিদিমা মেজমামাকে জাপটে ধরলেন৷ কিছুতেই ছাড়বেন না৷ শুধু কি জাপটে ধরা, ভেউভেউ করে কান্না!

মেজমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ, ছাড়! জাপটাজাপটি আমার ভালো লাগে না৷ আমি মরছি নিজের জ্বালায়!

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মেজমামা তোমার সাইকেল?

বটগাছ চাপা পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে৷

বটগাছ চাপা?

হ্যাঁ, কাঞ্চনতলার কাছে দারুণ ঝড় উঠল৷ বটগাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ল আমার ওপর৷ সাইকেল চুরমার হয়ে গেল৷ আমি ছিটকে পড়লাম মাটির ওপর৷ এই দেখ না!

মেজমামা চুল সরিয়ে দেখালেন৷ মাথার এক জায়গায় রক্ত জমে কালো হয়ে আছে৷

তারপর থেকে মেজমামা কেমন বদলে গেলেন৷

মাছের ব্যবসা বন্ধ৷ সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটাতেন৷ রাত্রে বেরিয়ে যেতেন৷ কখন ফিরতেন কে জানে!

দিদিমা অনেক বলতেন, কিন্তু মেজমামা নির্বিকার৷

শেষকালে দিদিমার নির্দেশে আমি শুতাম মেজমামার সঙ্গে৷ অবশ্য আলাদা খাটে৷

একদিন খুব ভোরে মেজমামার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল৷

এই, এক কাপ চা খাওয়াতে পারিস?

ঘরের কোণে স্টোভ ছিল৷ তাকের ওপর চা, চিনি, কাপ ডিশ৷ আগে আগে ভোরে বের হবার সময় মেজমামা নিজে চা করে খেতেন৷

ঘুমজড়ানো গলায় বললাম, তুমি নিজে করে খাও না!

মেজমামা যেন ভয় পেয়ে গেলেন, না, আমি আগুনের কাছে যেতে পারব না৷ ভয় করে৷

ভয় করে কথাটা মেজমামার মুখে নতুন শুনলাম৷ মেজমামা চিরকাল দুর্দান্ত প্রকৃতির৷ দারুণ সাহস৷

সেই দুর্ঘটনার পর থেকে মেজমামা যেন কুঁকড়ে গেছেন৷ কারো সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেন না৷ কেউ ডাকতে এলে বলে দেন, বল, আমি বাড়িতে নেই৷

আরো আশ্চর্যের কাণ্ড, মাথার একদিকের রক্ত জমে থাকাটা একই রকম রয়ে গেল৷ ওষুধপত্র মালিশ কিছুতেই কিছু হল না৷

অগত্যা উঠে চা তৈরি করে দিলাম৷ নিজেও খেলাম এক কাপ৷

আর এক রাতে এমন এক ব্যাপার ঘটল, তাতে একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম৷ ক’দিন গুমোট গরম পড়েছে৷ হাতপাখা নেড়ে নেড়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি৷ কিছুতেই ঘুম আসছে না৷ বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি৷

বহুকষ্টে যাও-বা একটু ঘুম এল, সেটা পেঁচার কর্কশ আওয়াজে ভেঙে গেল৷

ভয় পেয়ে উঠে বসলাম৷ জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে চাঁদের আলো এসে পড়েছে৷ কোথাও একটু অন্ধকার নেই৷

মেজমামার দিকে চোখ ফিরিয়েই চমকে উঠলাম৷ আমার মামার বাড়ির সবাই বেশ একটু খর্বকায়৷ মেজমামা আবার সবচেয়ে বেঁটে৷

সেই মেজমামাকে দেখলাম, বিরাট চেহারা, দেহ খাটের বাইরে গিয়ে পড়েছে৷

দুটো চোখ রগড়ে নিয়ে আবার দেখলাম একই দৃশ্য৷

খাট থেকে নেমে পালাবার চেষ্টা করতেই দৃশ্য বদলে গেল৷ মেজমামা যেন নিজের সাইজে ফিরে এলেন৷

মনকে বোঝালাম, ঘুম-চোখে নিশ্চয় ভুল দেখেছি৷ না হলে এমন ব্যাপার হতে পারে নাকি!

একথা কাউকে কোনোদিন বলি নি, জানি কেউ বিশ্বাস করবে না৷

কিন্তু পরে যা ব্যাপার ঘটল, তাতে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম৷

এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, মেজমামা বিছানায় নেই৷ ভাবলাম প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গেছেন, এখনই ফিরবেন৷ কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেল, মেজমামা ফিরলেন না৷

উঠে পড়লাম৷ জানলা দিয়ে বাইরে চোখ ফিরিয়েই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল৷ মেজমামা রোয়াকে বসে আছেন, জানলার দিকে পিছন ফিরে৷

একটু দূরে গোটাকয়েক গাছ পার হয়ে একটা জাম গাছে ছোটমামা জাল পেতে রেখেছে পাখি ধরবার জন্যে৷ জালের এক জায়গায় ফুটো ছিল, ছোটমামা বোধ হয় লক্ষ্য করেনি৷ সেই ফুটো দিয়ে আটকে থাকা পাখিগুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাচ্ছে৷

মেজমামা বসে বসেই হাত বাড়ালেন৷ কি বিরাট হাত! রোয়াক থেকে জাম গাছটার দূরত্ব কমপক্ষে ত্রিশ গজ তো হবেই!

হাতটা সোজা গাছের ওপর চলে গেল৷ যেখানে জালের ফুটো সেখানে৷ মেজমামা আঙুল দিয়ে জালে গিট বেঁধে দিলেন৷ পাখিদের পালানো বন্ধ হল৷

আমি বুকের ওপর হাত চেপেও দুপদুপ শব্দ বন্ধ করতে পারলাম না৷ মনে হল এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব৷ কোনোরকমে কাঁপতে কাঁপতে খাটের ওপর শুয়ে পড়লাম৷

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না৷ ভোরে উঠে দেখি মেজমামা খাটে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন৷ আশ্চর্য কাণ্ড, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ! কাল রাতে মেজমামা যখন রোয়াকে বসে তখন লক্ষ করেছি দরজায় ছিটকানি!

তাহলে মেজমামা বাইরে গেলেন কি করে? বন্ধ দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যেই বা কি করে ঢুকলেন?

ঠিক করে ফেললাম, আর মামার বাড়ি নয়৷ কোনো একটা অছিলায় বাড়ি পালাব৷

এটাও কি চোখের ভুল? দু’দুবার এরকম চোখের ভুল হতে পারে কখনো?

দুপুরবেলা কিন্তু মত বদলে গেল৷ ছোটমামা জালে আটকানো পাখিগুলো নিয়ে খাঁচায় পুরছিল, আমি বসে বসে দেখছিলাম৷ মেজমামাও বসেছিলেন৷

বেশির ভাগই মনুয়া আর টুনটুনি পাখি৷ একটা শুধু বড় আকারের টিয়া৷ গাঢ় সবুজ রং৷ লাল চোখ৷ কিছুতেই ধরা দেবে না, ছোটমামার হাতে ঠুকরে রক্ত বের করে দিল৷

আমি তো তখন দেখছিলামই, আরো একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম৷ আড়চোখে দেখছিলাম উঠোনে মেজমামার ছায়া পড়েছে কিনা, আর তাঁর পায়ের আঙুলগুলো উল্টোদিকে কিনা৷

দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম৷ উঠোনের ওপর মেজমামার রীতিমতো ছায়া পড়েছে আর তাঁর পায়ের আঙুলগুলো একেবারে স্বাভাবিক৷

তার মানে রাত্রে নিশ্চয় আমি বিদঘুটে স্বপ্ন দেখেছি৷ পেটগরম হলে যা হয়৷ পেট ঠাণ্ডা করার জন্য রোজ সকালে একটা করে ডাব খেতে হবে৷

আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিপদও আছে৷ এখানে দিব্যি হেসে খেলে বেড়াচ্ছি, আর ওখানে বাবা রোজ পাঁচপাতা হাতের লেখা আর দশটা অঙ্ক কষাবে!

বেশ কিছুদিন অলৌকিক কিছু চোখে পড়ল না৷ বুঝতে পারলাম নিজের ভয়ের বিকৃত রূপটাই দেখেছি৷

মেজমামা যে মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, তাতে দিদিমা খুব খুশি৷ তাঁর দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে৷

কিন্তু আমি ভাবি, মেজমামার চলবে কি করে?

একদিন জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম৷

হ্যাঁ মেজমামা, তুমি যে মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিলে? কি হবে?

মেজমামা চুল আঁচড়াচ্ছিলেন, ফিরে বললেন, কেন, তোর অসুবিধাটা কি হচ্ছে?

মুশকিলে পড়ে গেলাম৷ সামনে গিয়ে বললাম, না, অসুবিধা আর কি! আগে তুমি মাঝে মাঝে বড় বড় মাছ আনতে—

আমাকে থামিয়ে দিয়ে মেজমামা বললেন, ও, এই কথা! তোকে আজই বড় মাছ খাওয়াচ্ছি৷

মেজমামা বেরিয়ে গেলেন৷ ফিরলেন হাতে একটা প্রকাণ্ড রুই মাছ নিয়ে৷

আমি তো অবাক৷

হ্যাঁ মেজমামা, এর মধ্যে এত বড় মাছ পেলে কোথায়?

মেজমামা হাসলেন, একজন জেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ মাছের ঝুড়ি নিয়ে হাটে যাচ্ছিল৷ আমার তো সবাই চেনা, বলতেই দিয়ে দিল৷

দিদিমার আনন্দ আর ধরে না৷ বঁটি নিয়ে এসেই মাছ কুটতে বসলেন৷ আমি কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম৷

রোজ ছাইরঙা একটা উটকো বেড়াল এ বাড়িতে আসত, আহারের সন্ধানে৷ সেদিনও সে এসে হাজির৷

বঁটির পাশে আঁশের স্তূপ৷ বেড়ালটা এগিয়ে এসে আঁশে মুখ দিয়েই বিকট স্বরে ম্যাও করে উঠল৷ অস্বাভাবিক স্বর৷ কেউ যেন তার গলা টিপে ধরেছে৷

তারপর ল্যাজটা খাড়া করে সোজা পাঁচিলের ওপর গিয়ে উঠল৷ দিদিমাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন৷

তিনি বললেন, বেড়ালটার কি হল বল তো? ওভাবে চেঁচিয়ে উঠল, গলায় কাঁটা ফুটল নাকি?

কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছি, বেড়ালটা একটা আঁশও মুখে তোলে নি৷ খাওয়া তো দূরের কথা, কেবল শুঁকেই ওই রকম চিৎকার করে উঠল৷ সব ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়েছিল৷

এমন কি দিদিমা যখন একটা কলাপাতায় বড় মাছের টুকরো ভেঙে আমাকে খেতে ডাকলেন, তখন একটু ইতস্তত করেছিলাম৷

তারপর মনে সাহস এনে মাছের টুকরা মুখে দিয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলাম৷ না, কোনো গোলমেলে ব্যাপার নেই৷ দিব্যি সুস্বাদু মাছ৷

কত অল্পেতে আমরা ভয় পেয়ে যাই! বেড়ালটার ওভাবে চিৎকার করে ওঠার হাজার কারণ থাকতে পারে৷

তবে সেদিন থেকে বেড়ালটাকে আর ধারেকাছে দেখতে পাই না৷ বোধ হয় অন্য কোনো বাড়িতে আস্তনা গেড়েছে৷

এতদিন কথাটা দিদিমা কিংবা ছোটমামাকে বলি নি৷ কারণ প্রথমত, সব ব্যাপারটা নিজেই ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি৷ হয়তো আমারই চোখের ভুল কিংবা ভয়ের ছায়াটা রূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল৷

দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন হলে এই অলৌকিক কাণ্ড যে কাউকে দেখাতে পারব, এমন সম্ভাবনা কম৷

তাছাড়া দিদিমাকে নিজের ছেলের সম্বন্ধে কি করে এসব কথা বলি?

তবে আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, আর একবার এরকম বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়লেই মামার বাড়ি থেকে পালাব৷ এখানে আদরযত্নের লোভে তো আর বেঘোরে প্রাণ দিতে পারি না৷

বেশ কিছুদিন সব স্বাভাবিক৷ কোথাও কোনো গোলমাল হল না৷ মেজমামা অবশ্য মাছের ব্যবসায় আর গেলেন না৷ বাড়িতেও বিশেষ থাকতেন না, কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতেন কে জানে!

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, একটা কিছু করবার চেষ্টায় আছি৷ কতদিন আর চুপচাপ বসে থাকব?

তারপরই অঘটন ঘটল৷

মাঝরাতে বাথরুমে যাবার প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে দেখি, ছোটমামা রোয়াকের এককোণে দাঁড়িয়ে৷ একেবারে পাথরের মূর্তির মতন নিস্পন্দ, নিশ্চল৷

আমি কাছে যেতেই আঙুল দিয়ে বাগানের দিকে দেখাল৷ যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল৷

একটা গাছের ডালে মেজমামা পা ঝুলিয়ে বসে৷ মেজমামা মানে মুখটা মেজমামার, কিন্তু দেহটা বিরাট৷ মাথাটা প্রায় গাছের মগডালে ঠেকেছে৷ পা দুটো মাটির অল্প ওপরে৷

কি খেয়ে খেয়ে বাগানের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলছেন৷ একটা ছিটকে এসে রোয়াকের ওপর পড়তে নিচু হয়ে দেখেই চমকে উঠলাম, রক্তমাখা হাড়ের টুকরো!

সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল৷ মনে হল এখনিই বুঝি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ব৷

ছোটমামা আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছিল৷

তারপর দিন পনের কি হয়েছে আমি জানি না৷ দারুণ জ্বরে আমি প্রায় বেহুঁশ৷

দিদিমা চেয়েছিলেন আমার বাবাকে খবর দিতে, কিন্তু ছোটমামা অনেক বুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করেছিল৷ ছোটমামা বলেছিল, শুধু ভয় পেয়ে আমার এই জ্বর৷ ডাক্তারেরও তাই মত৷ এর মধ্যে বাবাকে টেনে নিয়ে এলে আসল ব্যাপারটা তাঁকে জানাতে হবে৷ স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বাবা বিশ্বাস করবেন, এটা আশা করা যায় না৷

অথচ তার পরের দিন সকালে দিদিমার পোষা ছাগলটা নিখোঁজ৷ খুঁজতে খুঁজতে বাগানের মধ্যে তার ছিন্নমুণ্ডটা পাওয়া গিয়েছিল৷ চারদিকে রক্তমাখা যেসব হাড়ের টুকরো পাওয়া গেল, সেগুলো যে ছাগলেরই হাড় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷

কিন্তু এমন কথা কে বিশ্বাস করবে? বিশেষ করে শহরের লোক!

মেজমামা নাকি আশ্চর্যভাবে শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন৷ হাঁটুর ওপর মাথাটা রেখে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘরের মধ্যে৷ হাজার ডাকে সাড়া দিতেন না৷ খেতে ডাকলে রুক্ষকণ্ঠে উত্তর দিতেন, খিদে নেই! শরীর খারাপ!

দিদিমা যে মেজমামাকে এত ভালোবাসতেন, সেই দিদিমা ছোটমামার কাছে সব শুনে মেজমামার ধারেকাছে ঘেঁষতে চাইলেন না৷

আমি যখন সেরে উঠলাম, তখন ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়েছে৷

শোবার ব্যবস্থা পালটে গেছে৷ একঘরে আমরা তিনজন শুতাম৷ একপাশে দিদিমা, অন্যপাশে ছোটমামা, মাঝখানে আমি৷ সারারাত ঘরে আলো জ্বলত৷

ছোটমামা দরজায় ভিতর থেকে ডবল তালা লাগিয়ে দিত৷ আমরা সবাই জানতাম, অলৌকিক শক্তির পক্ষে এ তালা কোনো বাধাই নয়, কিন্তু তবু বারণ করতে পারিনি৷

ছোটমামা আর আমি ওই দৃশ্য দেখার পর, আমি আগে যা দেখেছি সব দিদিমা আর ছোটমামাকে বলেছি৷

ছোটমামা বলল, কথাটা আগেই তোমার বলা উচিত ছিল, তাহলে আরো আগে ব্যবস্থা নিতে পারতাম!

কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও ছোটমামা বলল৷

বদনপুর এখান থেকে আড়াই মাইল৷ সেখানকার ভৈরব রোজা খুবই বিখ্যাত৷ তার খড়মের আওয়াজে ভূতপ্রেত থরথর করে কাঁপে৷

তাকে পাওয়া একটু মুশকিল৷ লোকের ডাকে প্রায়ই ভিনগাঁয়ে চলে যায়, আর দক্ষিণাও একমুঠো টাকা৷

দিদিমাকে ছোটমামা অনেক কষ্টে রাজী করাল৷ দিদিমা সব বুঝেও একটু ইতস্তত করলেন৷ হাজার হোক ছেলে তো!

ছোটমামা বোঝাল, বেশ তো, ভৈরব রোজা এলেই সব বোঝা যাবে৷

খুব ভোরে ছোটমামা বেরিয়ে পড়ল৷ বদনপুরে ভৈরবকে যদি না পাওয়া যায়, তাহলে অন্য গাঁ থেকে তাকে ধরে আনতে হবে৷

ছোটমামা যখন বের হয় তখন মেজমামা বাড়ি ছিলেন না৷ আধঘণ্টা পরে কোথা থেকে ফিরে এলেন৷

চেহারা দেখে মনে হল, অনেক দূর থেকে যেন ছুটতে ছুটতে আসছেন, হাঁটু পর্যন্ত কাদা৷ সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে৷ তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে ফতুয়াটা গাছের ডালে লেগে ছিঁড়ে গেছে৷

দিদিমা রোয়াকে বসে তরকারি কুটছিলেন, আমি পাশে বসেছিলাম৷

মেজমামা সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ ঠোঁটের দু’পাশে ফেনা৷ লাল চোখ পাকিয়ে দিদিমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছোনে কোথায় গেছে?

ছোনে ছোটমামার ডাকনাম৷

আমার বুকের দুপদাপ শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম৷ ভয় হল, অবশ হয়ে বঁটির ওপর না পড়ে যাই!

দিদিমা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, নিজের কি একটা দরকারে গেছে৷

নিজের দরকার না ছাই! মেজমামা দাঁত কিড়মিড়ি করে উত্তর দিলেন, ভাই তো নয়, শত্তুর—শত্তুর! আচ্ছা, ঠিক আছে!

কথাগুলো বলেই মেজমামা জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির চারপাশে ঘুরতে লাগলেন, দুটো হাত পিছনে, কেবল মাথা নাড়ছেন, থুতু ফেলছেন আর ঘুরছেন৷

ব্যাপার দেখে দিদিমা আর সাহস পেলেন না, আমার হাত ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিলেন৷

দিদিমার দিকে চেয়ে দেখি তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে৷ তাঁর মনের কষ্টটা বুঝতে পারলাম৷

যতক্ষণ মেজমামা বাড়ির চারদিকে ঘুরতে লাগলেন, ততক্ষণ আমি আর দিদিমা ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে রইলাম৷

কিছুক্ষণ পরে মেজমামাকে আর দেখা গেল না৷ দিদিমা উঠে জানলা দিয়ে দেখে যখন নিঃসন্দেহ হলেন যে মেজমামা ধারেকাছে কোথাও নেই, তখন আমাকে খেতে দিলেন৷

নিজে কিছু খেলেন না৷ ছোটমামা এলে একসঙ্গে খাবেন৷

আমি খাব কি, তখনো শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ মনে হচ্ছে কিছু খেলেই বমি হয়ে যাবে৷

মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, কোনোরকমে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল সকালেই বাড়ি রওনা হব৷ এখানে এভাবে ভয়ে কুঁকড়ে থাকলে শীঘ্রই শক্ত অসুখে পড়ে যাব৷

ছোটমামা ফিরল বেলা আড়াইটে নাগাদ, সাইকেল রিকশায়৷ সঙ্গে ভৈরব রোজা৷

আমি জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম৷

ভৈরবের পরনে লাল টুকটুকে কাপড়৷ গায়ে কোনো জামা নেই৷ গলায় অনেকগুলো রুদ্রাক্ষের মালা৷ দু’হাতে রুদ্রাক্ষের তাগা৷

লাল দুটি চোখ৷ কপালে সিঁদুরের ফোঁটা৷ ঝাঁকড়া পাকাচুল কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়েছে৷

ভৈরব নেমে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ বাতাসে কি যেন শুঁকল, তারপর ছোটমামার দিকে ফিরে বলল, কেউ গৃহবন্ধন করেছে!

ছোটমামা অবাক৷

গৃহবন্ধন কি?

কেউ মন্ত্র পড়ে গৃহবন্ধন করে দেয়, তাতে এই গৃহের মধ্যে কোনো কাজকর্ম করলে তা ফল দেয় না৷

কে এ কাজ করবে?

যাকে তাড়াতে চাও সেই করবে৷

কিন্তু তার পক্ষে তো কিছু জানা সম্ভব নয়৷

ছোটমামার কথায় ভৈরব খুব জোরে হেসে উঠল৷

প্রেতাত্মার পক্ষে সব কিছু জানতে পারাই সম্ভব৷ মানুষের চেয়ে তারা অনেক বেশি শক্তির অধিকারী হয়৷

তাহলে উপায়?

উপায় আছে বইকি৷ তুমি আগে সাইকেল-রিকশাকে বিদায় কর৷

ছোটমামা সাইকেল-রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিল৷

ভৈরব পাশে রাখা ঝোলা থেকে একটা মাটির সরা বের করল৷ তার ওপর চারটে পাকা লঙ্কা, একমুঠো সর্ষে, কতকগুলো কুশের ডগা রাখল৷ তারপর রাস্তার ওপরই বসে পড়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল৷

মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই লঙ্কা, সর্ষে আর কুশের ডগা আমাদের বাড়ির দিকে ছুঁড়তে লাগল৷

পিছনে নিশ্বাসের শব্দ হতে ফিরে দেখলাম দিদিমা এসে দাঁড়িয়েছেন৷ তাঁর চোখে তখনো জল৷

আধ ঘণ্টা পরে ভৈরব উঠে দাঁড়াল৷

ঠিক আছে, এবার বাড়ির মধ্যে চল৷

ভৈরবের কাণ্ডকারখানা দেখে ইতিমধ্যেই রাস্তার ওপর গাঁয়ের কিছু লোক জড়ো হয়েছিল৷ ভৈরবের পিছন পিছন তারা বাড়ির মধ্যে এসে ঢুকল৷

উঠানে মাটি দিয়ে বেদি করা হল৷ তাতে কাঠ, শুকনা ডালপালা দিয়ে আগুন জ্বালানো হল৷ ভৈরব সেই অগ্নিকুণ্ড প্রদক্ষিণ করতে করতে মাঝে মাঝে কাঠি করে ঘি ছিটিয়ে দিতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে লাগল৷

ততক্ষণে সাহস পেয়ে আমি রোয়াকে গিয়ে বসেছি৷ দিদিমা আমার পাশে৷ ছোটমামা ভৈরবের কাছে তার ফাইফরমাশ খাটছে৷

আধ ঘণ্টা কিছু হল না৷ সব নিস্তব্ধ৷ শুধু ভৈরবের রুক্ষ গলায় মন্ত্রপাঠের শব্দ শোনা গেল৷ হিং টিং ছট করে অদ্ভুত ভাষা!

আমি যখন ভাবতে শুরু করেছি যে সবটাই বুজরুকি, তখন হঠাৎ শোঁ শোঁ আওয়াজ৷ ঠিক অনেক দূর থেকে ঝড় এলে যেমন হয়৷

পশ্চিম দিকের গাছপালাগুলো ভীষণভাবে দুলতে লাগল৷ গাছের ডালে বসা কাকের দল চিৎকার করে আকাশে পাক খেতে লাগল৷

একটু পরেই গাছপালার পিছন থেকে মেজমামা এসে হাজির৷ দুটি চোখ বনবন করে ঘুরছে৷ ফুলে উঠেছে নাকের পাটা৷ মুখে একটা মুরগি—বেচারি মরণযন্ত্রণায় পাখা ঝটপট করছে৷ মেজমামার দু’কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷

মেজমামার সেই মূর্তি দেখে আমি ভয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলাম৷ দেখলাম, উত্তেজনায় দিদিমাও ঠকঠক করে কাঁপছেন৷

মেজমামা এসে দাঁড়াতে ভৈরবেরও চেহারা বদলে গেল৷ সে আরো জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে লাগল৷ আগুনে মুঠো মুঠো কি ফেলল, তাতে আগুন আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল৷

মেজমামা এগোতে পারলেন না৷ গাবগাছের তলা পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ বিশ্রীভাবে ভৈরবকে গালাগাল দিতে লাগলেন৷ আধখাওয়া মুরগিটা ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে, মুরগিটা এসে পড়ল আগুনের মধ্যে৷

কে তুই? ভৈরব চেঁচিয়ে উঠল৷

আমি দয়াল বাঁড়ুজ্জে৷ মেজমামা আরো জোরে চিৎকার করে বললেন৷

না, তুই দয়াল ন’স৷ ঠিক করে বল, কে তুই?

দয়াল বাঁড়ুজ্জে মেজমামার নাম৷ ডাকনাম টোনা৷

বলব না৷

মেজমামার সে কি গর্জন৷ ঠোঁটের দু’পাশে ফেনা এসে জমল৷

বলবি না? আচ্ছা দেখি বলিস কিনা?

ভৈরব পাশে পড়ে থাকা ঝাঁটাটা তুলে নিয়ে ঘটের ওপর মারতে লাগল৷ সঙ্গে সঙ্গে মেজমামা আর্তনাদ করে উঠলেন৷ মনে হল ঝাঁটার প্রত্যেকটি ঘা যেন তাঁর দেহেই পড়ছে৷

বলছি, বলছি, আর মারিস নি!

মেজমামা গাছতলায় বসে পড়লেন৷

বল! ভৈরব ঝাঁটা আছড়ানো শব্দ করল৷

আমি মহিন্দর ডোম৷

ভৈরব দিদিমার দিকে চোখ ফেরাল, চেনেন মহিন্দর ডোমকে?

দিদিমা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আমি কখনো দেখিনি৷ বাবার কাছে শুনেছি, মহিন্দর পুজোর সময় ঢাক বাজাত৷ বিষয়সম্পত্তি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে গণ্ডগোল হওয়াতে তারা পিছন দিক থেকে মাথায় লাঠি মেরে লোকটাকে শেষ করে দিয়েছে৷

মেজমামা আর বলব না, মহিন্দরই বলি৷

মহিন্দর সব চুপচাপ শুনল৷ দিদিমার কথা শেষ হতে বলল, মা-ঠাকরুণ ঠিক বলেছেন৷ শিবে আমার মাথায় লাঠি মেরেছিল৷ আমিও শোধ নিয়েছি, শিবের গুষ্টির ঘাড় মটকে পগারে ফেলে দিয়েছি৷ ওর বংশে বাতি দিতে আর কেউ নেই৷

তুই দয়ালের দেহে এলি কি করে?

সেদিন খুব ঝড়জলের সময় দয়াল সাইকেলে চেপে বটগাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল৷ ওটাই আমার আস্তানা৷ হঠাৎ মোটা একটা ডাল ভেঙে পড়ল দয়ালের মাথার ওপর—দয়াল খতম, তার সাইকেল চিঁড়েচ্যাপ্টা৷ আমি দেখলাম এমন সুযোগ আর পাব না৷ অমাবস্যায় বামুনের মড়া—অনেক বছর দেহহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সুড়সুড় করে ঢুকে পড়লাম৷

এ দেহ তোকে ছাড়তে হবে! ভৈরব বলল৷

মাথা খারাপ! আমি ছাড়ব না!

তবে রে!

আবার ঘটের ওপর ঝাঁটার আছড়ানি৷

মাটির ওপর গড়াগড়ি দিয়ে মহিন্দর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল৷

একটু পরে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব৷

কি করে বুঝব তুই গেছিস?

কি করতে হবে বল?

ভৈরব এদিক ওদিক দেখল, উঠোনের একপাশে মরচে ধরা একটা বরগা পড়েছিল৷ সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে ভৈরব বলল, ওটা দাঁতে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে৷ আর একটা কথা…

বল?

গাঁ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে চলে যেতে হবে৷

ঠিক আছে৷ কাসুন্দিপুরের শ্মশানে আস্তানা বাঁধব, এদিকে আর আসব না৷

যা তবে৷

লোহার ভারী বরগা, যেটা তুলতে অন্তত জনচারেক লোকের দরকার, সেটা মহিন্দর অবলীলাক্রমে দাঁতে করে তুলে নিল৷

আবার সেই ঝোড়ো হাওয়া! গাছপালার মধ্য দিয়ে বরগা নক্ষত্রবেগে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল!

এদিকে নজর পড়তে দেখলাম মেজমামার প্রাণহীন দেহটা গাবগাছতলায় পড়ে আছে৷ দেহ থেকে বিশ্রী পচা গন্ধ বের হচ্ছে৷

ভৈরব বলল, এখনই দেহটা সৎকারের ব্যবস্থা কর৷ অনেকদিনের বাসি মড়া!

দুম করে একটা শব্দ৷ দিদিমা অজ্ঞান হয়ে রোয়াকের ওপর ঢলে পড়লেন৷

এসব অনেকদিনের কথা৷

দিদিমা কবে মারা গেছেন৷ মামারাও কেউ বেঁচে নেই৷ মামাতো ভাইবোনেরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, খবর রাখি না৷

আমারও বেশ বয়স হয়েছে৷

খুব ঝড়জল শুরু হলে সব ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে৷

মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই কি এসব অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছিল?

কিন্তু চোখের সামনে দেখা সব কিছু অস্বীকারই বা করি কি করে!

তৃষ্ণা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

প্যাট মেনডোনসা! এই ঘরে তুমি এসেছ আমি বুঝতে পারছি৷ আমি আর বুঝব না, বাধা দেব না, আমার ক্ষমতা ফুরিয়েছে—তুমি যা চাও তাই হবে৷ কিন্তু তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, তাই ভয় হচ্ছে৷ তুমি সামনে এসে দাঁড়াও, তোমার কাকে ভয়?

ঘরে যে ক’টি প্রাণী ছিল সকলে চমকে উঠেছিল৷ এমন কি অমন নামজাদা ডাক্তারও৷ রোগের ঘোরে অনেকে অনেকরকম প্রলাপ বকে, সেটা অসংলগ্ন হয়৷ জড়তা থাকে৷ কিন্তু এ যেন কেউ সর্বরকমভাবে হার মেনে ক্লান্ত বিষণ্ণ থমথমে গলায় স্পষ্ট করে শেষ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল৷ অনেকের কানে সেটা নিজের মৃত্যুঘোষণার মতো লাগল৷

অসুখের ঘোরে রোগী আগেও অনেকবার ভুল বকেছে, বিকারগ্রস্ত দুই চোখ টান করে অনেকবার ঘরের চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে৷ কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর এমন স্পষ্ট হয়ে কানে লেগে থাকেনি কারো, সেই চাউনি এত স্পষ্ট, স্বচ্ছ মনে হয়নি৷ তাতে নিজেকে আগলে রাখার ব্যাকুলতা ছিল, সেই দৃষ্টিতে অব্যক্ত দুর্বোধ্য যাতনা ছিল৷ অভিজ্ঞ চিকিৎসক ইনজেকশন আর ঘুমের ওষুধ দিয়ে তখন রোগীকে ঘুম পাড়িয়েছেন৷ আজ ছ’দিন ধরেই তাই করছেন৷ দেহগত লক্ষণ তিনি সুবিধের দেখছেন না৷ অথচ আরো দুজন সতীর্থ চিকিৎসকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেও সঠিক রোগের হদিস পেয়েছেন বলে মনে হয় না৷ এক একবার ভেবেছেন হাসপাতালে এনে ফেলা দরকার৷ আবার মনে হয়েছে এই অবনতির লক্ষণ গোটাগুটি স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ার দরুন৷ ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে কোনো রোগ যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন তেমন ভয়ের কিছু নেই বোধ হয়৷ স্নায়ু সে-রকম বিকল হলে দেহের অন্যান্য লক্ষণও তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে৷

তিনি শুনেছেন রোগীর প্রকৃতি ভাবপ্রবণ৷ এর ওপর বড় রকমের মানসিক বিপর্যয়ের যে কারণ ঘটেছে তাও শুনেছেন৷ তিনি বিশ্বাস করেননি, সম্ভব-অসম্ভবের চিন্তাও তাঁর মাথায় আসেনি৷ সুপ্ত বাসনার একটা বিকৃত প্রকাশ ছাড়া আর কিছু ভাবেননি তিনি৷ যে রাতের কথা শুনেছেন সেই রাতে ছোকরা যে প্রকৃতিস্থ ছিল না তাতেও ডাক্তারের কিছুমাত্র সন্দেহ নেই৷ আজকালকার রোমান্সসর্বস্ব দুর্বলচিত্ত অতি আধুনিক ছেলেছোকরাদের জানতে বাকি নেই তাঁর৷ যে কারণেই হোক বড় রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছে, সেটা সামলে ভালো কোনো মানসিক চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে দিতে পারলেই দায়িত্ব শেষ হতে পারে ভাবছেন তিনি৷

কিন্তু লক্ষণ দেখে ভিতরে ভিতরে তিনিও শঙ্কা বোধ করছেন এখন৷

রোগীর এই শেষ কথা শুনে আর তার এই চাউনি দেখে সব থেকে বেশি চমকে উঠেছিল খবরের কাগজের চ্যাটার্জি৷ বন্ধুদের মধ্যে আরো দুই একজন অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে৷ চ্যাটার্জির কাছ থেকেই তারাও ঘটনার কিছু কিছু আভাস জেনেছিল৷ আর সাতদিন আগে উৎসবের সেই রাত্রি শেষে একটা মজার প্রহসন তারা স্ব-চক্ষেই প্রত্যক্ষ করেছিল৷ কেউ কেউ অসংযত ঠাট্টাবিদ্রূপে জর্জরিত করেছে নরিসকে, হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলি? সঙ্গে ঢুকলি না! তোর মতো হাঁদা প্রেমিককে কলা দেখাবে না তো কি, কোটের শোক করতে করতে এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমোগে যা—৷

ঠাট্টা যারা করেছিল, ফিলিপ নরিসের অন্তরঙ্গ বন্ধু খবরের কাগজের চ্যাটার্জিও তাদের একজন৷

ফিলিপ নরিসের এই কণ্ঠস্বর শুনে আর এই চাউনি দেখে ঘরের অনেকেই নিজেদের অজ্ঞাতে দরজার দিকে তাকালো৷ মনে হল, এই কথার পর, এই আত্মসমর্পণের পর দ্বারপ্রান্তে বুঝি সত্যই কোনো রমণীর নাটকীয় আবির্ভাব ঘটবে৷ তা ঘটল না৷ রোগীর দৃষ্টি ধরে চ্যাটার্জির চোখ যে দিকে ফিরল ঘরের সেখানটায় আলনা৷ আলনার হ্যাঙারে গরম কোট ঝুলছে একটা৷ ফিলিপ নরিস সেদিকেই চেয়ে আছে, বিকারের চাউনি জানে, কিন্তু বড় অস্বাভাবিক উজ্জ্বল৷ যেন সেদিকে চেয়ে সত্যিই কাউকে দেখছে সে৷ ঠোঁট দুটো নড়ছে৷ বিড়বিড় করে বলছে কিছু৷ শোনা যায় না৷ কিন্তু চ্যাটার্জির মনে হল সে বলছে, প্যাট মেনডোনসা…প্যাট মেনডোনসা…!

ঘরের মধ্যে সব থেকে বেশি অস্বস্তি বোধ করছে চ্যাটার্জি৷ এ ছ’দিনে অনেকবার যে কথা মনে হয়েছে, কোটটার দিকে চেয়েও আবার সেই কথাই মনে হল৷ দিয়ে যখন দিয়েই ছিল, এই কোটটা নরিস আর ফিরিয়ে না আনলেই পারত৷ এই আনাটাই যেন—ভুল হয়েছে৷ কি ভুল, কেন ভুল চ্যাটার্জিও জানে না৷ অথচ তার সামনেই তো ওটা ফিরিয়ে এনেছে নরিস, চ্যাটার্জি নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল—অস্বস্তি বোধ করেছিল, কিন্তু বাধা দেবার কথা মনে হয়নি৷

ডাক্তার আবার ওষুধ খাওয়ালেন, ইনজেকশন দিলেন৷

বাইরে এসে এক বন্ধু ভেবেচিন্তে চ্যাটার্জিকে বলল, দেখো, এক কাজ করো, উৎসবের পরদিন পর্যন্ত তোমারও মাথা খুব সাফ ছিল না বুঝতে পারছি, তোমাদের কাগজে প্যাট মেনডোনসার নামে একটা বিজ্ঞাপন দাও—ফিলিপ নরিসের এই অবস্থা জানিয়ে অতি অবশ্য তার সঙ্গে এসে দেখা করতে লেখো—এই বোম্বাই শহরে প্যাট মেনডোনসা হয়তো ডজন দুই বেরুবে, কোথায় কার সঙ্গে লটঘট বাধিয়ে রেখেছে কে জানে—বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে যে আসবার ঠিক এসে হাজির হবে’খন দেখে নিয়ো৷ তোমরা যে ঠিকানায় গেছলে সেটা একটা যোগাযোগ হতে পারে আর তার আগের রাত থেকে ফিলিপেরও মাথার গোলযোগ ঘটে থাকতে পারে—সে-তো বে-সামাল কথাবার্তাই বলছিল তখন, কেউ কি এক বর্ণও বিশ্বাস করেছে!

করেনি সত্যি৷ চ্যাটার্জি নিজেই করেনি৷ কিন্তু তারপরে যা সে দেখেছে অবিশ্বাস করবে কি করে! তবু নিজেরই তার বার বার ধাঁধা লাগছে, ধোঁকা লাগছে৷ ফিলিপের না হয় মাথার গণ্ডগোল হয়েছিল, কিন্তু তারও কি হয়েছিল? বন্ধুর কথামতো কাগজে বিজ্ঞাপন একটা দিয়ে দেখবে? পর মুহূর্তে কি আবার মনে পড়েছে৷ না ভুল কিছু হয়নি, যারা জানে না তাদের এ-রকম ভাবাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু চ্যাটার্জি ভাববে কি করে, এ যদি ভুল হয় তা হলে তার এই মুহূর্তের অস্তিত্বও ঠিক কিনা সন্দেহ৷

যাক, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশও আর কিছু থাকল না৷ ডাক্তারের ওষুধ আর ইনজেকশনে ফিলিপ নরিস চোখ বুজেছে৷ সেই চোখ মেলে সে আর তাকায়নি৷ তার সেই রাতের ঘুম আর ভাঙেনি৷ কখন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে নার্সও টের পায়নি৷ বন্ধুরাও পরদিন এসে তাকে মৃত দেখেছে৷

এবারে আগের ঘটনাটুকু যোগ করলেও কাহিনী সম্পূর্ণ হবে কিনা বলা শক্ত৷

ঘটনাস্থল বোম্বাইয়ের এক মস্ত নামজাদা ইঙ্গ-ভারতীয় ধাঁচের ক্লাব৷ নামজাদা ক্লাব না বলে নামজাদা সংস্থা বললেই বোধ করি ঠিক হবে৷ অনিবার্য কারণে নাম অনুক্ত থাক৷ এই ক্লাব বা ক্লাবের নিজস্ব প্রাসাদ-সৌধ সেখানকার সকলেই চেনেন৷ মেম্বাররা সর্বভারতীয় এবং কিছুটা সর্বদেশীয়৷ তবে একক সংখ্যার বিচারে গোয়ান মেয়ে পুরুষের সংখ্যাই বোধ করি বেশি৷ এই গোয়ানদের মধ্যে আবার জাতের রেষারিষি আছে৷ গোড়া ব্রাহ্মিন- ক্রিশ্চিয়ান গোয়ানদের মাথা উঁচু—সামাজিক ব্যাপারে অধস্তন গোয়ানদের সঙ্গে সচরাচর তারা আপস করে না৷ কিন্তু এই ক্লাব অনেকটা শ্রীক্ষেত্রের মতো৷ এখানে জাত বর্ণের খোঁজ বড় পড়ে না৷

এখানে প্রবেশের প্রধান ছাড়পত্র আর্থিক সঙ্গতি৷ যার টাকা আছে আর তারুণ্যের পিপাসা আছে, তার কাছে ক্লাবের দ্বার অবারিত৷ বহু লক্ষপতি বা ক্রোড়পতি প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ এই সংস্থার পৃষ্ঠপোষক৷ নবীন সভ্য-সভ্যাদের টাকার জোরের থেকে দিল-এর জোর বেশি৷ টাকার থেকেও তাদের বড় মূলধন আনন্দ আহরণের উৎসাহ আর উদ্দীপনা৷ এই উৎসাহ আর উদ্দীপনার ফলেই সাধারণত সংস্থার মুরুব্বিদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায়৷ এখানে ইচ্ছার বেগই প্রধান৷ এখানে এসে হিসেবের খাতার পাতা খোলে না৷

চ্যাটার্জি এখানে ভিড়তে পেরেছে টাকার জোরে নয়, তার কাগজের জোরে৷ আর কিছুটা তার সুপটু যোগাযোগের ফলে৷ সুমার্জিত কৌশলে সবজান্তার আসরে যে নামতে পারে, দুনিয়া উলটে-পালটে গেলেও খুব একটা কিছু যায় আসে না এমনি নির্লিপ্ত মাধুর্যে যে অবকাশ যাপন করতে পারে—এখানে তারই কদর বেশি৷ সেই হিসেবে চ্যাটার্জি প্রিয়পাত্র এখানকার৷ ফিলিপ নরিসের বিশেষ গুণ হল সে টাকা যা রোজগার করে তার থেকে বেশি খরচ করতে জানে৷ নিজের গতি-বিধি আচার-আচরণ সরল, সংযত—অথচ বন্ধুবান্ধবরা তার বেশির ভাগই বেপরোয়া, সদা মুখর৷ কারো টাকার দরকার হলে অসঙ্কোচে হাত পাতো ফিলিপি নরিসের কাছে, হাতে থাকলে সে তক্ষুনি দিয়ে দেবে৷ না থাকলে, আর টাকার প্রয়োজন যার সে প্রিয়পাত্র হলে, ধার করে এনে দেবে৷ দিয়ে অনুগ্রহ করবে না, নিজেই অনুগৃহীত হবে৷ ব্যাঙ্কে মোটামুটি ভালো চাকরিই করে, ব্যাচিলর, তাই ভালো হোটেলে আলাদা একখানা ঘর নিয়ে থাকার সঙ্গতি আছে৷

তাহলেও ফিলিপ নরিস ক্লাবের প্রথম সারির কেউ নয়৷ অর্থাৎ চ্যাটার্জির মতো নিজের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত নয়৷ সকল সভ্য বা সভ্যারা ভালো করে চেনেও না তাকে৷ তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির দরুন সভার আলো উজ্জ্বল বা স্তিমিত হয় না৷ তার মতো সাদামাটা সভ্যসংখ্যা শতকের ওপর৷ দু’ দশজনের কাছে যেটুকু খাতির সে পায় তাও চ্যাটার্জির সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার দরুন৷ এইজন্যই চ্যাটার্জির প্রতি সদা কৃতজ্ঞ সে৷ কৃতজ্ঞতার আরো কারণ আছে, চ্যাটার্জির সক্রিয় সহযোগিতায় তার কাগজে নরিসের দুই একটা আবেগমুখর প্রবন্ধও ছাপা হয়েছে৷ তিরিশ টাকা দক্ষিণা পেলে আনন্দাতিশয্যে ষাট টাকা খরচ করে বসেছে সে, তবু চ্যাটার্জির ঋণ শোধ হয়েছে ভাবেনি৷

গুণমুগ্ধ দুই একটি ভক্ত সকলেই পছন্দ করে৷ চ্যাটার্জিরও ভালো লাগে ফিলিপ নরিসকে৷

ক্লাবের বার্ষিক উৎসবের রাত সেটা৷ গোটা প্রাসাদ আলোয় আলোয় একাকার৷ ছ’মাস আগে থেকেই এই একটা রাতের প্রতীক্ষা করে থাকে সকলে৷ এক রাতের উৎসবে কত হাজার টাকা খরচ হয় সে-প্রসঙ্গ অবান্তর৷ সভ্য এবং অতিথি অভ্যাগতদের গাড়ির ভিড়ে প্রাসাদসৌধের সামনের দুটো বড় বড় রাস্তার অনেকটাই আটকে থাকে৷

সমস্ত রাতের উৎসব—খাওয়া দাওয়া নাচ গানের ঢালা ব্যবস্থা৷ যে সময়ের ঘটনা, বোম্বাই শহর তখন ‘ড্রাই’ নয়, অতএব বহুরকম রঙিন পানীয়ের ব্যবস্থারও ত্রুটি ছিল না কিছু৷ রাত বারোটার পরে ডান্স হলএ যখন নাচের ডাক পড়ল, নিজের নিজের দুটো পায়ের ওপর তখন অনেকেরই খুব আস্থা নেই৷

…সেই মেয়েটির দিকে আবার চোখ পড়ল ফিলিপ নরিসের৷ এই নিয়ে বারকয়েক চোখ গেল তার দিকে৷ খুব রূপসী না হলেও সুশ্রী৷ বছর পঁচিশ ছাব্বিশ হবে বয়স৷ এই উৎসবে এই বয়সের সঙ্গীহীন মেয়ে বড় দেখা যায় না৷ ডান্স হলের দরজার ওধারের দেয়াল ঘেঁষে কেমন যেন বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে৷ একা৷ সকলেই যে নাচছে তা নয়, কিন্তু ওই মেয়েটির মতো একা কাউকে মনে হল না নরিসের৷ মুখখানা মিষ্টি কিন্তু বড় শুকনো—এক ধরনের বিষণ্ণ ঘুম-জড়ানো চোখ-মুখ-চাউনি৷ এই পরিবেশ মেয়েটির যেন পরিচিত নয় খুব—মনে হল সেই থেকে সে যেন কাউকে খুঁজছে৷ অন্যমনস্কের মতো নাচ দেখছে এক-একবার, আবার শ্রান্ত দৃষ্টিটা এদিক-ওদিক ফিরিয়ে আগন্তুকদের মুখ দেখে নিচ্ছে৷

এখানে, বিশেষ করে এই সময়ে কারো দিকে চোখ নেই৷ সকলেই যে যার সঙ্গী-সঙ্গিনী বা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত৷ এই রাতের মতো রাতে সঙ্গী বা সঙ্গিনী থাকার কথা নয় ফিলিপ নরিসেরও৷ সে নাচতে একটু-আধটু জানে বটে, কিন্তু গিয়ে এসে কাউকে ডেকে নিতে জানে না৷ সে মদও সচরাচর খায়ই না, তবে আজ সামান্য খেয়েছে, আর তাইতেই বেশ একটু আমেজের মতো লাগছে৷ ভালো লাগছে৷ একটু আনন্দ করার ইচ্ছে তার মধ্যেও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে৷ কিন্তু সহজাত সঙ্কোচে কারো দিকে এগোতেও পারছে না৷ আর এগোবেই বা কার দিকে, সকলেই ব্যস্ত, আনন্দমগ্ন৷

মেয়েটির বিষণ্ণ ঠাণ্ডা দৃষ্টিটা ফিলিপ নরিসের মুখের ওপরেও আটকালো দুই একবার৷ লোকটিও তাকে দেখছে মনে হতেই দৃষ্টিটা চট করে সরে গেল না মুখ থেকে৷

ফিলিপ নরিস উঠে মেয়েটির কাছে এল একসময়৷ সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারো অতিথি এখানে?

সামনে এসে মেয়েটির চোখ-মুখ আরো নিষ্প্রভ বিষণ্ণ মনে হল নরিসের৷ কেমন এক ধরনের আত্মবিস্মৃত জড়তার ভাব৷ মুখ তুলে তার দিকে তাকাল মেয়েটি৷ কয়েক মুহূর্ত চেয়েই রইল৷ তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল৷ অস্ফুট শ্রান্ত স্বরে বলল, না…আমি কেমন করে যেন এসে পড়েছি৷

সঙ্গে সঙ্গে ফিলিপ নরিস উদার হয়ে উঠল, বলল, বেশ করেছেন, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মাদাম, দয়া করে নিজেকে আপনি আমার অতিথি ভাবুন! আগে কি খাবেন বলুন?

মেয়েটি নিঃশব্দে চেয়েই আছে তেমনি৷ অথচ নরিসের মনে হল সে যেন কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করছে৷ বলল, না কিছু খাব না৷ একটু থেমে আবার বলল, দেখো, আমি সেই থেকে একজনকে খুঁজছি, পাচ্ছি না…ভাবলাম এখানে থাকতেও পারে৷ তুমি কি বলতে পারবে…

হঠাৎ ‘তুমি’ শুনে নরিস রীতিমতো অবাক৷ অথচ মেয়েটি যে খেয়াল না করেই বলেছে তাতেও ভুল নেই৷ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখানকার মেম্বার? কি নাম?

নরিস বিস্মিত৷ কি নাম তাও চট করে মনে করতে পারছে না৷ স্মরণের চেষ্টা৷ বেশি মাত্রায় মদটদ খেয়েছে কিনা নরিসের সেই সন্দেহ হল একবার৷ না, তাহলে টের পেত৷ মনে পড়েছে৷ মনে পড়ার দরুনই যেন মেয়েটির শ্রান্ত মুখখানা উজ্জ্বল দেখালো একটু৷ অস্ফুটস্বরে বলল, ডিসুজা…মার্টিন ডিসুজা…চেনো?

নরিস মাথা নাড়ল, চেনে না৷

মেয়েটির বিষণ্ণ মুখখানা বড় অদ্ভুত লাগছে নরিসের৷ রাজ্যের অন্যমনস্কতার দরুন সে যেন খুব কাছে নেই৷ একটা লোকের সন্ধানে এখানে এসে পড়েছে তাও কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয়৷ কোথায় থাকে ডিসুজা, কি করে তাও স্মরণ করতে পারল না৷ নরিসের কেমন মনে হল, মেয়েটি যে কারণেই হোক বড় অসুখী, তাই খুব প্রকৃতিস্থ নয়৷ কিছু মানসিক রোগ থাকাও বিচিত্র নয়৷ যার নাম করছে, তার কাছ থেকেই হয়তো বা বড় রকমের কোনো আঘাত পেয়েছে৷

নরিস বলল, দেখো এটা আনন্দের হাট, এই আনন্দের টানেই তুমি এসে পড়েছ—বি চিয়ারফুল অ্যান্ড হ্যাপি, আমাকে তোমার বন্ধু ভেবে নাও, নাচবে একটু?

ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আভাস ফুটল একটু৷ ঘুম জড়ানো ভাবটা কাটিয়ে উঠছে যেন৷ দেখছেই তাকে৷ এত কি দেখছে নরিস ভেবে পেল না৷ তার মুখের দিকে চেয়ে যেন বিস্মরণের ধাপগুলো উত্তীর্ণ হতে চেষ্টা করছে৷

মাথা নাড়ল৷ নাচবে৷

ডান্স হল৷ তারা আস্তে আস্তে নাচছে৷ বাহু স্পর্শ করে নরিসের মনে হয়েছে মেয়েটি বড় দুর্বল, হয়তো অনেকটা পথ পার হয়ে নিজের অগোচরে এখানে চলে এসেছে৷ সহৃদয় সুরে বলল, আগে কিছু খেয়ে নাও না, এই উৎসব সমস্ত রাত ধরে চলবে৷

তার চোখের আত্মবিস্মৃত দৃষ্টি এখন আরো একটু বদলেছে৷ নাচের ফাঁকে নরিসের মুখখানাই দেখছে ঘুরে ফিরে, এই চোখ ঈষৎ প্রসন্ন৷ মেয়েটির তাকে পছন্দ হয়েছে বোঝা যায়৷ মাথা নেড়ে জানালো খাবার ইচ্ছে নেই৷ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?

নরিস…ফিলিপ নরিস৷ তোমার?

প্যাট মেনডোনসা৷…তুমি খুব ভালো…ডিসুজার মতোই দরদী, তুমি কি ব্রাহ্মিন ক্রিশ্চিয়ান?

নরিস হঠাৎ এ প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝল না৷—না, কেন বলো তো?

নয় শুয়ে প্যাট মেনডোনসার চোখে মুখে খুশির আভাস৷ জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল৷ একটু বাদে বলল, আমার কেমন শীত শীত করছে৷

নরিস কি করতে পারে! আধঘণ্টার আলাপে মেয়েটির প্রতি মায়া অনুভব করছে কেন জানে না৷ আর কোনো মেয়ের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কখনো আসেনি বলেও হতে পারে৷ এ যেন এরই মধ্যে তার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে৷ আর একটু কাছে টেনে আনল, নাচের গতি বাড়িয়ে দিল৷ সঙ্গী এত সদয় বলেই যেন প্যাট মেনডোনসা কৃতজ্ঞ, সে কাছ ঘেঁষে এসেছে, মন্থর পায়ে নাচছে, আর প্রসন্ন চোখে দেখছে তাকে৷

বিশ্রামের জন্য দুজনে একটা নিরিবিলি কোণে গিয়ে বসল একটু৷ আর তখনি প্যাট মেনডোনসা অস্ফুট ক্লান্ত সুরে বলল, আমার ভয়ানক শীত করছে৷ আমি আর থাকতে পারছি না…

জামার ওপর তার কাঁধে হাত রেখে নরিস বিচলিত হল একটু৷ গা’টা সত্যি বড় বেশি ঠাণ্ডা৷ আবার আগের মতোই শ্রান্ত আর ক্লান্ত মনে হল তাকে৷ তাড়াতাড়ি উঠে নরিস নিজের দামি গরম কোটটা নিয়ে এসে তার গায়ে পরিয়ে দিল৷ বলল, তোমাকে খুব সুস্থ লাগছে না, আর রাত না করে তুমি একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাও, বাড়ি কোথায়?

বান্দ্রা…৷

বেশি দূরে নয় তা হলে৷ প্যাট মেনডোনসার গায়ে তার নিজের কোটের পকেট হাতড়ে এক টুকরো কাগজ আর কলম বার করল৷ পলকে কি ভেবে সে দুটো তার দিকেই বাড়িয়ে দিল৷—তোমার বাড়ির ঠিকানা লিখে দাও, কাল সকালে গিয়ে আমি কোটটা নিয়ে আসব’খন৷

এ-রকম বিদায়টা যেন খুব পছন্দ নয় মেয়েটির, মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে নাম, বাড়ির নম্বর আর ঠিকানা লিখে দিল৷ কাগজটা নিজের পকেটে রেখে নরিস বলল, চলো তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে আসি৷

দোতলার সিঁড়ির কাছে আসার আগেই সামনের লম্বা প্যাসেজের দিকে চোখ পড়তে মেনডোনসা দাঁড়াল৷—ও-দিকটা কি?

বাথ…

অস্ফুট স্বরে বলল, আমি যাব, দেখিয়ে দাও—

প্যাসেজ ধরে পায়ে পায়ে খানিকটা এগিয়ে নরিস দাঁড়াল৷ প্যাট মেনডোনসা হালফ্যাশানের মস্ত বাথরুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল৷ গম্ভীর ক্লান্ত দুটো চোখ আবার নরিসের মুখে এসে আটকালো৷ মাথা নেড়ে ডাকল তাকে৷

ঈষৎ বিস্মিত মুখে সে কাছে আসতে বলল, তুমিও এসো৷

হঠাৎ হতভম্ব বিমূঢ় নরিস৷ বলে কি! এ কার পাল্লায় পড়ল সে! তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠল, না না, কিছু ভয় নেই, তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি৷

রমণীর নিষ্পলক দুই চোখ তার মুখের থেকে নড়ছে না৷ এই মুখে আর চোখে একটা কঠিন ছায়া পড়েছে৷ শান্ত ঠাণ্ডা গলায় আবার বলল, তুমিও এসো৷

প্রায় আদেশের মতো শোনালো৷ নরিস ঘাবড়েই গেল৷ কপালে ঘাম দেখা দিল৷ এ কি সাঙ্ঘাতিক মেয়ে! ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই—নাকি এও মানসিক রোগ কিছু! বিস্ময় সংবরণ করে এবারে জোর করেই মাথা ঝাঁকালো নরিস, বলল, আঃ! কেউ এসে পড়লে কি ভাববে! বলছি তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি—

প্যাট মেনডোনসা চেয়েই আছে৷ চেয়েই আছে৷ তারপর আস্তে আস্তে বাথরুমের দরজা খুলল সে৷ ভিতরে ঢুকল৷ দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল৷ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল নরিসের৷…ভালোয় ভালোয় এখন ট্যাক্সিতে উঠলে হয়৷

জানালায় ঠেস দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে৷ অদ্ভুত মেয়েটার কথাই ভাবছে৷

হঠাৎ সচকিত৷ একটা আস্ত সিগারেট শেষ হয়ে গেল, আর একটা কখন ধরিয়েছে এবং আধাআধি শেষ করেছে খেয়াল নেই—অথচ প্যাট মেনডোনসা এখনো বেরোয়নি৷ বাথরুমের দরজা বন্ধ৷

দ্বিতীয় সিগারেট শেষ হল৷ নরিস পায়চারি করছে৷ কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই৷

তারপর আরো আধঘণ্টা কেটে গেল৷ নরিস বিলক্ষণ ঘাবড়েছে৷ দরজা ঠেলেছে, দরজায় মৃদু আঘাত করেছে, ডেকেছে—কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই৷ তারপর একটা করে মিনিট গেছে আর নরিসের ভয় বেড়েছে৷ গোড়া থেকেই কেমন লাগছিল মেয়েটাকে—ভিতরে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেল, না কি কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসল!

ঘড়ি দেখল! সাড়ে তিনটে বেজে গেছে রাত্রি৷ তার মানে একঘণ্টার ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে প্যাসেজে! বিমূঢ় নরিস কি করবে দিশা পেল না৷ জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিল কয়েকবার৷ মজবুত দরজা একটু কাঁপল শুধু৷

নরিস দৌড়লো হঠাৎ৷ আধ ভাঙা আসর থেকে চ্যাটার্জিকে খুঁজে বার করল৷ চ্যাটার্জি প্রকৃতিস্থই আছে বটে, কিন্তু নিজের হাত পায়ের ওপর দখল খুব নেই৷ তাকে একরকম টানতে টানতেই নিয়ে এল নরিস৷ চ্যাটার্জির পিছু পিছু আর দুই একজন উৎসুক বন্ধুও এল৷ খুব সংক্ষেপে ব্যাপারটা শুনে তারাও অবাক৷ খানিকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করল তারাও৷

শেষে কেয়ারটেকারের তলব পড়ল৷ বেগতিক দেখে কেয়ারটেকার পুলিশে ফোন করল৷ পুলিশ এসে দরজা ভাঙল যখন, তখন প্রায় সকাল৷

ভিতরে কেউ নেই৷

এক সঙ্গে বহু জোড়া বিস্মিত দৃষ্টির ঘায়ে নরিস বিভ্রান্ত, বিমূঢ়৷ বাহ্যচেতনা লোপ পাবার উপক্রম তার৷

সুরার ঝোঁকে দুই একজন ঠাট্টা করল, নরিসের প্রেয়সী বাথরুমের জানালা দিয়ে নিশ্চয় পাখি হয়ে উড়ে পালিয়ে গেছে৷ নইলে ভিতর থেকে উধাও হবার আর কোনো পথ নেই৷

কেয়ারটেকার বা পুলিশের লোকেরও ধারণা হল, নরিস বেসামাল হয়েছিল, হয়তো ভিতরে যে ঢুকেছিল সে কখন বেরিয়ে চলে গেছে খেয়াল করেনি—আর বাইরে থেকে দরজার হ্যান্ডেল টানা-হেঁচড়ার ফলে হোক বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক কারণে হোক ভিতরের ল্যাচ আটকে গেছে৷ বাইরে থেকে টানা হেঁচড়া করে বা কোনোরকম অস্বাভাবিক কারণে এই দরজার ল্যাচ আটকে যেতে পারে কিনা—এই দিনের এই সময়ে তা নিয়ে— গবেষণা করার মতো ধৈর্য কারো নেই৷

চ্যাটার্জি হতভম্ব নরিসকে একদিকে টেনে এনে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, রাত্তিরে কতটা খেয়েছিলে?

নরিস সত্যি কথাই বলল, কিন্তু চ্যাটার্জির সংশয় গেল না৷ বলল, অভ্যেস নেই—ওটুকুতেই গণ্ডগোল হয়েছে৷

তাকে বিশ্বাস করানোর ঝোঁকে পকেট থেকে চিরকুট বার করল নরিস, এই দ্যাখো, আমার কোট গায়ে দিয়ে গেছে, নিজের হাতে নাম বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছে—

চ্যাটার্জি দেখল৷ রাতের ধকলে তার মাথাও খুব পরিষ্কার নয়৷ তবু একমাত্র সঙ্গত মন্তব্যই করল সে৷ বলল, তাহলে তুমি যখন জানালার দিকে ফিরে সিগারেট খাচ্ছিলে তখনি বেরিয়ে চলে গেছে সে, তুমি টের পাওনি৷ নিশ্চয় তোমার মতলব ভালো মনে হয়নি তার, তাই—

নরিস তখন আদ্যোপান্ত ব্যাপারটাই বলল তাকে৷ মতলব যে তার ভালো ছিল না তাও গোপন করল না৷ শুনে চ্যাটার্জি হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে—বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পেল না৷

এদিকে চ্যাটার্জীর ওই শেষের যুক্তিই সম্ভবপর মনে হয়েছে নরিসের৷ সে যখন জানালার দিকে ফিরে সিগারেট টানতে টানতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা তার অলক্ষ্যে তখনি চলে গিয়ে থাকবে৷ এ ছাড়া কি আর হতে পারে! তার অনভ্যস্ত জঠরে ওই সামান্য সুরাই হয়তো কিছুটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তাকে৷ আর, মেয়েটা যে রুষ্ট হয়েছিল সে তো বোঝাই গেছে—তাই কোনোরকম বিদায়সম্ভাষণ না জানিয়েই চলে গেছে৷

ঘণ্টা তিনেক নরিসের ঘরেই ঘুমালো চ্যাটার্জি, তারপর নরিস ঠেলে তুলল তাকে৷ তাকে নিয়ে সে প্যাট মেনডোনসার বাড়ি যাবে কোট আনতে৷ ঘুম তাড়িয়ে নরিসের সঙ্গ নিল চ্যাটার্জি৷ যে মেয়ে ওভাবে নিজেকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাকে একবার দেখার কৌতূহলও ছিল৷ চিরকুটের নম্বর মিলিয়ে বান্দ্রার বাড়ির ঠিকানায় এসে দাঁড়াল তারা৷ কড়া নাড়তে এক বৃদ্ধ দরজা খুলে দিলেন৷

নরিস প্যাট মেনডোনসার খোঁজ করতে বৃদ্ধটি খানিক চেয়ে রইলেন মুখের দিকে৷ তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কে?

নরিস জানালো তারা কে এবং কেন এসেছে৷ গত রাতের ফাংশানে শীত করছিল বলে প্যাট মেনডোনসা তার কোট গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে, সেই কোটটা ফেরত নিতে এসেছে তারা৷ নাম ঠিকানা লেখা চিরকুটটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল নরিস৷

বৃদ্ধ দেখলেন৷ গম্ভীর৷ বললেন, আচ্ছা, আপনারা বসুন একটু—

ভিতরে চলে গেলেন তিনি৷ একটু বাদে বাঁধানো একটা ফোটো হাতে ফিরলেন৷ সেটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দেখুন তো এর মধ্যে কেউ কাল আপনার কোট নিয়ে এসেছিল কি না৷

বৃদ্ধের ব্যবহারে এরা দুজনেই মনে মনে বিস্মিত৷ সামনে আট দশটি নারী পুরুষের বড় গ্র&প ফোটো একটা৷ সেটার দিকে এক নজর তাকিয়ে আঙুল দিয়ে প্যাট মেনডোনসাকে দেখিয়ে দিল নরিস৷ বলল, ইনি—

দু’ চোখ টান করে বৃদ্ধ নরিসের দিকে চেয়ে রইলেন খানিক৷ নরিস জিজ্ঞাসা করল, ইনি কি এ বাড়িতে থাকেন না?

থাকত৷ এখন থাকে না৷ আমার এই মেয়ে দুবছর আগে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে৷

নরিস আর তার সঙ্গে চ্যাটার্জিও কি সত্যি শুনছে, নাকি এখনো রাতের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে! সত্যিই কোথায় তারা?

চেতনারহিতের মতো আরো একটু খবর শুনল৷ বৃদ্ধ জানালেন, বাড়ির সব থেকে সেরা মেয়ে ছিল এই প্যাট মেনডোনসা—মার্টিন ডিসুজা নামে এক ছেলেকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল৷ সকলে ধরেও নিয়েছিল বিয়ে হবে৷ কিন্তু ডিসুজার বাপ মা’র বড় গর্ব তারা ব্রাহ্মিন ক্রিশ্চিয়ান—বিয়ে হতে দিলে না৷ বিয়ে হবে না শুনে মেয়েটার মাথাই হয়তো বিগড়ে গিয়েছিল, নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল ডিসুজার বাড়ি থেকে—দাদারে সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট হল—তক্ষুনি শেষ৷ অ্যাকসিডেন্টের খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল৷

অনেকক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাটাল নরিস৷ চ্যাটার্জি ঠেলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল না৷ মুখে কথা নেই৷ কেমন যেন হয়ে গেছে৷ খানিক বাদে ফুল কিনল এক গোছা, চ্যাটার্জিকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠল৷

সমাধি-ক্ষেত্র৷ নিঃশব্দে খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছে দুজনে৷ বেশি খুঁজতে হল না৷ হঠাৎ একদিকে চোখ পড়তে নিস্পন্দ কাঠ দুজনেই৷ ওই ছোট সমাধি একটা৷ সমাধির ওপর ক্রস৷ ক্রস-এ ঝুলছে নরিসের সেই কোট৷ সমাধির গায়ে নামের হরফ—প্যাট মেনডোনসা৷

নির্বাক স্তব্ধ দুজনেই৷ অভিভূতের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সমাধির সামনে হুঁশ নেই৷

নরিস ফুল দিল৷ ক্রস-এর ওপর থেকে কোটটা হাতে তুলে নিল৷ বলল, চলো—

ফিলিপ নরিসের হাতে কোটটা দেখে কি এক অজ্ঞাত অস্বস্তি বোধ করছিল চ্যাটার্জি৷ কিন্তু বলা হয়নি, ওটা থাক৷

* আখ্যানের বক্তা খবরের কাগজের চ্যাটার্জি আমার বন্ধু৷ মূল ঘটনাটি সত্যি বলে তাঁর দাবি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *