ভুতুড়ে আংটি
মিস্টার জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ, এফ.আর.এস, থাকেন ১৪৭ গাউয়ার স্ট্রিটে। তিনি এমন একজন মানুষ যাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা আর কর্মশক্তি তাঁকে প্রথম সারির বৈজ্ঞানিকদের দলে স্থান করে দিতে পারত। কিন্তু তিনি বিশ্বজনীন উচ্চাকাঙ্খর শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে কোনো এক বিষয়ে সেরা হওয়ার চাইতে নানা বিষয়ে বৈশিষ্ট্য অর্জন করার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল।
প্রথম দিকে প্রাণিবিদ্যা আর উদ্ভিদ বিদ্যার দিকে তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। এই দুই বিষয়ে তিনি এমন ভাবে কাজ করেছিলেন যে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে দ্বিতীয় ডারউইন ভাবতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু যখন একটি অধ্যাপকের পদ প্রায় তার নাগালের মধ্যে এসে গিয়েছে, তখনই তিনি এসব বিষয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে রসায়ন শাস্ত্রের ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন। এখানে তিনি ধাতুর বর্ণালীর ওপর গবেষণা করে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ অর্জন করেন।
কিন্তু এবারও তিনি একই কাজ করলেন। ল্যাবরেটরিতে এক বছর অনুপস্থিত থাকার পর মি. স্মিথ ওরিয়েন্টাল সোসাইটিতে যোগ দেন। এলকাব-এর হায়ারোগ্লিফিক এবং ডিমোটিক লিপি সম্পর্কে একটি মূল্যবান গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। আর এভাবেই মি. স্মিথ একদিকে যেমন বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিলেন, অন্যদিকে তেমনি দেখালেন তাঁর প্রতিভার অস্থিরতা।
এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এক সময় না এক সময় কিছু একটায় থিতু হয়। মি. স্মিথও তার ব্যতিক্রম নন। প্রাচীন মিশরতত্ত্ব মানে ঈজিপ্টোলজির যত গভীরে তিনি প্রবেশ করতে লাগলেন ততই তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁর কাছে জ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। মানব সভ্যতার সূচনা যেখানে হয়েছিল তার ওপর গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কারের কী বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তা তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।
মিশরতত্ত্ব স্মিথকে এমনভাবে আকৃষ্ট করেছিল যে তিনি এক তরুণী মিশরতাত্ত্বিককে বিয়ে করে ফেললেন। এই তরুণী প্রাচীন মিশরের ষষ্ঠ রাজ বংশের ওপর মূল্যবান গবেষণা করেছিল।
গবেষণার ভিত্তি শক্ত তৈরি করে, মিস্টার স্মিথ গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য প্রাচীন মিশর নিয়ে এমন কাজ করবেন যার মধ্যে সংযুক্ত হবে Lepious-এর গবেষণা আর Champolion-এর উদ্ভাবনী দক্ষতা। আর এই বিরাট ঐতিহাসিক কাজের জন্য স্মিথকে প্রায়ই ফ্রান্সে যেতে হতো। সেখানকার স্যুভর জাদুঘরের প্রাচীন মিশরীয় সংগ্রহ খুবই সমৃদ্ধ। গত অক্টোবরের মাঝামাঝিতে তিনি শেষবার ভরে গিয়েছিলেন। সে সময় অদ্ভুত এক রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
ট্রেনটা অনেক আস্তে চলছিল। আর ইংলিশ চ্যানেলের অবস্থাও ছিল খারাপ। তাই মি. স্মিথ প্যারিসে পৌঁছালেন কিছুটা বিভ্রান্ত এবং উত্তেজিত অবস্থায়। প্যারিসে পৌঁছে তিনি উঠলেন Rue Laffitte রাস্তার হোটেল দ্য ফ্রান্স-এ। হোটেল রুমে ঢুকে তিনি ক্লান্ত দেহটাকে সোফায় এলিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক শুয়ে থেকেও ঘুম এল না। তাই স্মিথ সিদ্ধান্ত নিলেন এখনই ল্যুভর মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বেন। যে কারণে তিনি মিউজিয়ামে যাবেন তাতে বেশি সময় লাগবে না। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হলে, সন্ধ্যার ট্রেনেই তিনি দিয়েঞ্জীতে (Dieppe) ফিরে যাবেন।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সোফা ছেড়ে উঠে ওভারকোট গায়ে দিলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। Boulevard des Italiens এবং Avenue de POPera পার হয়ে তিনি ভরে পৌঁছালেন।
ভর তাঁর খুব পরিচিত জায়গা। মিউজিয়ামে পৌঁছেই তিনি যে ঘরে প্যাপিরাসের সংগ্রহ রয়েছে সেদিকে পা চালালেন।
জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথকে খুব একটা সুদর্শন বলা যাবে না। তবে তাঁর টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো নাক আর দৃঢ় চিবুক তাকে আর দশজন মানুষ থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। দেহের ওপর মাথাটাকে তিনি পাখির কায়দায় ধরে রেখেছেন। আলাপ আলোচনা করার সময় তিনি পাখির ঠোকরানোর মতো ভঙ্গি করেন। আর এভাবেই কোনো বিষয়ে আপত্তি জানান, কারও কথার জবাব দেন।
প্যাপিরাসের সংগ্রহশালায় স্মিথ ঢুকলেন। তাঁর ওভারকোটের কলার উঁচু করে কান পর্যন্ত তোলা। সামনের ডিসপ্লে কেসের কাছে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ভাবলেন, সত্যিই তিনি অন্যরকম। কিন্তু পেছন থেকে ইংরেজি ভাষায় পরিষ্কার করে বলা কথাগুলো শুনে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। পেছন থেকে তীক্ষ্ণ গলায় কেউ বলল, লোকটা দেখতে কী অদ্ভুত!
স্মিথের একটু বেশি পরিমাণেই অহমিকা বোধ আছে। পেছন থেকে মন্তব্য শুনে তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল। তিনি কঠিন দৃষ্টিতে প্যাপিরাসের বান্ডিলগুলোর দিকে তাকালেন। সমস্ত ব্রিটিশ ভ্রমণকারীদের প্রতি বিতৃষ্ণায় তাঁর মনটা তিক্ত হয়ে গেল।
হ্যাঁ, আরেকটা কণ্ঠ বলল, লোকটা সত্যিই অসাধারণ।
তুমি জানো, প্রথম বক্তা বলল, যে কেউই বিশ্বাস করবে মমির ব্যাপারে ক্রমাগত চিন্তা করতে থাকলে কোনো লোক নিজেই অর্ধেক মমি হয়ে যায়?
লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে মিশরীয়, দ্বিতীয় বক্তা বলল।
জন স্মিথ ঘুরে দাঁড়ালেন। উদ্দেশ্য, তার দেশের লোক দুটিকে কড়া কথা বলবেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে গেলেন। পাশাপাশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। দেখলেন লোকদুটো তাকে নিয়ে মন্তব্য করছে না। বরং তারা তার দিকে পেছন ফিরে লুভর মিউজিয়ামের এক বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকিয়ে আছে। অ্যাটেনডেন্ট রুমের অপর প্রান্তে বসে পিতলের তৈরি একটা জিনিস পালিশ করছিল।
কার্টার আমাদের জন্য প্যালেস রয়েল-এ অপেক্ষা করবে, একজন অপরজনকে বলল, ঘড়ির দিকে তাকাল। তারা চলে গেল। রুমের মধ্যে শুধু মাত্র মি. জন স্মিথ আর অপর প্রান্তে সেই অ্যাটেনডেন্ট।
বুঝলাম না ওরা কেননা বলল লোকটা দেখতে মিশরীয়দের মতে, স্মিথ ভাবতে লাগলেন। যে জায়গায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাই স্মিথ একটু সরে দাঁড়ালেন। অ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। মিশর নিয়ে গবেষণা করার সময় এধরনের চেহারার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে।
লোকটার আকৃতি পাথুরে মূর্তির মতো, কপাল চওড়া, গায়ের রং ঈষৎ কালচে। এরকম চেহারার অসংখ্য পাথরের মূর্তি, মমি কেস আর ছবি এই বিশাল রুমের দেয়ালগুলোতে সাজানো রয়েছে।
ঘটনাটা কাকতালীয় বলা যায় না। লোকটা অবশ্যই মিশরীয়। তার কাঁধের কৌণিক গড়ন এবং সরু নিতম্ব তাকে মিশরীয় হিসেবে পরিচিত করে।
অ্যাটেনডেন্টের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন স্মিথ। উদ্দেশ্য লোকটার সাথে কথা বলা। মানুষের সাথে কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধা বোধ করেন না। কিন্তু এবারে একটু অপ্রস্তুত বোধ করছেন। কাছে এসে তিনি অ্যাটেনডেন্টের মুখের এক পাশ দেখতে পেলেন। কারণ এখনও সে একমনে পালিশ করে যাচ্ছে। স্মিথ স্থির দৃষ্টিতে লোকটার গায়ের চামড়ার রং দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো ওই চামড়ার মাঝে কেমন যেন এক অমানবীয় এবং অতিপ্রাকৃত ভাব রয়েছে। কপাল আর দুচোয়ালের চামড়া এমন চকচকে যেন বার্নিশ করা পার্চমেন্ট। কোনো লোমকূপের চিহ্নও নেই। এই শুষ্ক চামড়ায় একবিন্দু ঘামের কল্পনাও কেউ করতে পারবে না। কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত মুখের বাকি অংশ অসংখ্য সূক্ষ্ম বলি রেখায় ভরা। দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন মাউরি (Maori-নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী) মেজাজে ওই মুখের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছে যে কত জটিল নকশা সৃষ্টি করতে পারে সে।
মেমফিসের সংগ্রহগুলো কোথায়? স্মিথ জিজ্ঞাসা করলেন। আলাপ শুরু করার জন্যই প্রশ্নটা করেছেন।
ওইখানে, লোকটা রূঢ়ভাবে জবাব দিল, মাথা নেড়ে ঘরের অপর প্রান্ত দেখাল।
তুমি কি মিশরীয়? স্মিথ আবার প্রশ্ন করলেন। অ্যাটেনডেন্ট এবার তার অদ্ভুত কালো চোখ তুলে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটো কাঁচের মতো চকচকে। তাতে রয়েছে এক কুয়াশাচ্ছন্ন শুকনো ঔজ্জ্বল্য। কোনো মানুষের এরকম চোখ স্মিথ কখনও দেখেননি। অ্যাটেনডেন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখলেন, লোকটার চোখের গভীরে যেন আবেগ জমে উঠছে। যেটা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ঘৃণা আর আতঙ্কে রূপ নিল।
না, মশিয়ে, আমি ফরাসি। একথা বলে লোকটা হঠাৎ ঘুরে বসে আবার পালিশে মন দিল।
স্মিথ অবাক হয়ে লোকটার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর হলের এক কোণে চেয়ারে বসলেন। জায়গাটা একটা দরজার পেছনে। চেয়ারে বসে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্যাপিরাসের পাতা থেকে নোট করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাজে মন বসাতে পারলেন না। বারবার স্ফিংসের মতো বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের চেহারা আর পার্চমেন্টের মতো তার চামড়ার কথা মনে পড়তে লাগল।
ওরকম চোখ কোথায় দেখেছি? স্মিথ নিজেকে প্রশ্ন করলেন। চোখের দৃষ্টি অনেকটা সরীসৃপের মতো। সাপের চোখে যে ঝিল্লি আছে, হয়তো বুড়োর চোখেও তাই আছে। স্মিথ হাসলেন। প্রাণিবিদ্যার কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে। ঝিল্লি আছে বলেই হয়তো তার চোখে চকচকে ভাব রয়েছে। কিন্তু ওখানে আরও কিছু রয়েছে। আমি পরিষ্কার দেখেছি শক্তি আর জ্ঞানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ওই দুই চোখে ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া আরও আছে চরম ক্লান্তি আর প্রচণ্ড হতাশা। হয়তো এসব আমার কল্পনা। কিন্তু প্রথম দর্শনে কেউ আমার মনে এরকম ছাপ ফেলেনি। ঈশ্বর, লোকটাকে আরেকবার দেখতেই হবে। স্মিথ চেয়ার থেকে উঠে মিশরিয় সংগ্রহশালায় ঢুকলেন। কিন্তু যে লোক তাঁর কৌতূহল জাগিয়েছে, তাকে দেখতে পেলেন না।
স্মিথ আবারও সেই নির্জন কোনায় বসে নোট করতে লাগলেন। যে সমস্ত তথ্য তার দরকার সবগুলোই তিনি প্যাপিরাসে পেয়েছেন। মনে থাকতে থাকতে সেগুলো লিখে ফেলা দরকার। কিছুক্ষণ তার পেন্সিল কাগজের ওপর দ্রুত চলতে লাগল। কিন্তু একটু পরেই লাইনগুলো আর এক রেখায় রইল না। শব্দগুলো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। অবশেষে পেন্সিলটা মেঝেতে পড়ে গেল। স্মিথের মাথা বুকের ওপর ঝুলে পড়ল। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির ফলে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। নির্জন কোণে দরজার পেছনে তাঁর ঘুম এতটাই গম্ভীর হলো যে সিভিল গার্ডের চলাচলের শব্দ, দর্শকদের পদধ্বনি এমনকী মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার তীক্ষ্ণ, কর্কশ ঘণ্টা ধ্বনিও তার ঘুম ভাঙাতে পারল না।
সন্ধ্যার তরল অন্ধকার গাঢ় হতে হতে রাতের ঘন অন্ধকারে পরিণত হলো।
Rue de Rivoli-র কর্মব্যস্ততার শব্দ বেড়ে উঠে একসময় তাও থেমে গেল। দূরে নটরডেম গীর্জায় মাঝরাতের ঘণ্টা বাজল। এখনও হলঘরের অন্ধকার কোণে স্মিথের ঘুমন্ত দেহটা এক নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তির মতো নিঃশব্দে বসে রইল।
.
রাত একটার দিকে মি. স্মিথের ঘুম ভাঙল। জেগে উঠে তিনি বড়ো করে শ্বাস নিলেন। এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন বাসায় স্টাডি রুমের চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পর্দাবিহীন জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পরিপূর্ণভাবে ঘরে ঢুকছে। সেই আলোয় সারি সারি মমি আর পালিশ করা বাক্স দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তিনি কোথায় আছেন। কীভাবে এখানে রয়ে গেলেন তা বুঝতেও দেরি হলো না।
তবে মি. স্মিথ আতঙ্কিত হলেন না। নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে সে পরিবেশকে ভালোবাসা তার বংশের বৈশিষ্ট্য। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। হাত পায়ের খিল ভাঙাবার জন্য ছড়িয়ে বসে ঘড়ির দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোয় সময় দেখে মুচকি হাসলেন। ভাবলেন, এই ঘটনা তার পরবর্তী গবেষণা বইয়ের জন্য একটি ছোটো অথচ চমৎকার কাহিনি হবে। কাটখোট্টা বিষয় পড়তে পড়তে পাঠক কিছুটা স্বস্তি পাবে।
একটু ঠান্ডা লাগছে। তবে স্মিথ পুরোপুরি জেগে আছেন। এখন বুঝতে পারছেন গার্ডরা কেন তাঁকে দেখতে পায়নি। যে দরজার আড়ালে তিনি ছিলেন সেটার কালো ছায়ায় তিনি পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন।
চারদিকে এই সুনসান নিস্তব্ধতা ভারি চমৎকার। বাইরে বা ভেতরে কোথাও একটু শব্দ, এমনকী একটু মর্মর ধ্বনি পর্যন্ত নেই। এক মৃত সভ্যতার মৃত মানুষদের সাথে তিনি একা রয়েছেন। এই ঘরের বাইরে রয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর ভাপসা আবহাওয়া, কিন্তু তাতে কী! এ হলঘরে যে সব প্রাচীন বস্তু রয়েছে–গমের শুকনো মঞ্জুরী থেকে চিত্রশিল্পীর রঙের বাক্স পর্যন্ত-সবগুলো সুদীর্ঘ চার হাজার বছর ধরে মহাকালের সাথে লড়াই করে আজও টিকে রয়েছে। সুদূর অতীতের সাম্রাজ্য থেকে সময়ের স্রোতে ভেসে আসা কত জিনিস এখানে আছে। থিবিস, লুক্সর (Luxor) এমনকী হেলিও পোলিশের বিশাল মন্দিরগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে বিভিন্ন নিদর্শন এখানে এসেছে। তা ছাড়া কয়েকশো সমাধি খনন করে সংগ্রহ করা বিপুল প্রাচীন দ্রব্য এখানে আনা হয়েছে।
স্মিথ নিস্তব্ধ মূর্তিগুলোর দিকে তাকালেন। আলো আঁধারিতে দেখে মনে হচ্ছে মূর্তিগুলো কাঁপছে। একদা ব্যস্ত, কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো এখন চির বিশ্রামে শায়িত আছে। এসব ভাবতে ভাবতে স্মিথের মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। নিজের যৌবন আর তুচ্ছতা সম্পর্কে এক ভিন্ন ধারণা যেন পেয়ে বসল তাঁকে। চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে স্বপ্নীল দৃষ্টিতে সংগ্রহশালার দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোতে সব কিছু যেন রুপালি হয়ে উঠেছে। সংগ্রহগুলোর মাঝখানে দর্শক চলাচলের সরু পথটা বিরাট হলের শেষ প্রান্তে চলে গেছে।
হঠাৎ তিনি সেই পথে একটা আলো দেখতে পেলেন। আলোটা ক্রমশ কাছিয়ে আসছে।
স্মিথ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। উত্তেজনায় তার স্নায়ু টান টান। আলোটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে থেমে এগুচ্ছে। আলো বহনকারী নিঃশব্দে এগোচ্ছে। তারপরও তার পায়ের টিপটিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
স্মিথ ভাবলেন মিউজিয়ামে হয়তো চোর ঢুকেছে। তাই তিনি আরও অন্ধকার কোণে সরে গেলেন। আলোটা এখনও দুই রুম দূরে। এবার পাশের রুমে আসল। এখনও কোনো শব্দ নেই।
হঠাৎ করেই বাতির আলোটার পেছনে একখানা মুখ দেখা গেল। মুখের অধিকারীর দেহটা ছায়ায় মোড়ানো। আলোটা মুখের ওপর এমনভাবে পড়েছে, মনে হচ্ছে মুখটা যেন বাতাসে ভাসছে। এই মুখের ওপর চকচকে চোখ দুটো আর কর্কশ চামড়া দেখে ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই। গভীর রাতের রহস্যময় আগন্তুক আর কেউ নয়, সেই অ্যাটেনডেন্ট–যাকেমি. স্মিথ কথা বলার জন্য খুঁজেছিলেন।
লোকটাকে দেখে স্মিথ প্রথমে ভাবলেন কথা বলবেন। বলবেন, কী ভাবে এখানে আটকা পড়েছেন আর বেরুবার রাস্তার কথাও জানতে চাইবেন। কিন্তু লোকটা রুমে ঢুকার পর স্মিথ লক্ষ্য করলেন ওর চলাফেরার মধ্যে কেমন যেন গোপনীয়তার ভাব ফুটে উঠেছে। ওর চোরের মতো ভাব দেখে স্মিথ নিজের ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হলেন। বুঝতে পারলেন লোকটা অফিশিয়াল ডিউটি দিতে বের হয়নি। তার পায়ে ফেল্ট সোল স্লিপার। উত্তেজনায় ঘন ঘন শ্বাস নেয়ায় তার বুক দ্রুত ওঠানামা করেছে। মাঝে মাঝে দ্রুত ডানে আর বামে তাকাচ্ছে। দ্রুত নিঃশ্বাসের ফলে আলোর শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্মিথ অন্ধকার কোণ থেকে তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন, লোকটা গোপনে এখানে এসেছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে।
বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের চলাফেরার মধ্যে কোনো ইতস্তত ভাব নেই। সে হালকা কিন্তু দ্রুত পদক্ষেপে একটা বড়ো বাক্সের কাছে গেল। পকেট থেকে চাবি বের করে বাক্সের তালা খুলল। স্মিথ দেখলেন বাক্সটার মধ্যে অনেকগুলো তাক। সবচেয়ে ওপরের তাক থেকে লোকটা একটা মমি বের করল। তারপর যথেষ্ট সতর্কতার সাথে সেটা মাটিতে নামাল। বাতিটা মমির পাশে রাখল। সে মমির পাশে প্রাচ্যদেশীয় ভঙ্গিতে বসল। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে মমিটাকে ঢেকে রাখা দামি লিনেনের কাপড় খুলতে শুরু করল। কাপড়ের ভাঁজগুলো খুলতেই ঘরটা এক তীব্র সুগন্ধে ভরে গেল। প্রতিটা ভাঁজ খোলার সাথে সাথে সুগন্ধি কাঠের টুকরো এবং মশলার গুঁড়ো মেঝেতে পড়ছে।
জন স্মিথ পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এই মমিটি আগে কখনও খোলা হয়নি। ঘটনাটা তাকে প্রচণ্ড কৌতূহলী করে তুলেছে। প্রচণ্ড কৌতূহল তার সমস্ত দেহকে শিহরিত করে তুলল। তাঁর পাখির মতো মাথাটা দরজার পেছন থেকে ক্রমশই বেরিয়ে আসতে লাগল। যখন চার হাজার বছর পুরোনো দেহটার মাথা থেকে শেষ ভাঁজটা সরানো হলো তখন বিস্ময়ে তার গলা থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল।
প্রথমেই বুড়ো লোকটার হাতে একরাশ ঘন কালো চুল ঝরে পড়ল। দ্বিতীয় ভাঁজ খুলতেই দেখা গেল ফর্সা কপাল। সেখানে ধনুকের মতো বাঁকানো সুন্দর দুটি ভ্র। তৃতীয় ভাঁজ খুলতে দেখা গেল দুটি চোখ আর উন্নত নাক। চতুর্থ এবং শেষ ভাঁজ খোলার পর দেখা গেল মিষ্টি একটা মুখ। চিবুকের গড়নটা অপূর্ব। আসলে সমস্ত মুখটা অদ্ভুত সুন্দর। তবে একটুখানি খুঁত রয়েছে।
কপালের মাঝখানে কফি রঙের একটা ক্ষত। মেয়েটার চেহারা দেখে প্রাচীন মিশরীয়দের মৃতদেহ সংরক্ষণের অপূর্ব কলাকৌশল সম্পর্কে চমৎকার ধারণা পাওয়া যায়। মুখখানা দেখতে দেখতে স্মিথের চোখ দুটো ক্রমশ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তাঁর গলা দিয়ে সন্তুষ্টির শব্দ বেরিয়ে এলো।
মেয়েটার চেহারা স্মিথের ওপর যতখানি প্রভাব বিস্তার করল বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের ওপর প্রভাবের কাছে তা কিছুই নয়। সে উত্তেজিত ভাবে শূন্যে হাত ছুঁড়ে কর্কশ কন্ঠে কী যেন বলল। তারপর মমির পাশে শুয়ে পড়ল। মমিকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁট আর কপালে বারবার চুমু খেতে লাগল। Ma petite! সে ফরাসী ভাষায় গুঙিয়ে বলল। Ma pauvrepetite! প্রচণ্ড আবেগে তার কণ্ঠস্বর বুজে গেল। তার মুখের অসংখ্য বলিরেখা তির তির করে কাঁপছে। কিন্তু স্মিথ প্রদীপের আলোয় দেখলেন, বুড়োর চকচকে চোখ দুটো শুকনো। সেগুলোতে এক ফোঁটা পানি নেই।
কয়েক মিনিট মমিটাকে জড়িয়ে ধরে সে শুয়ে রইল। সুন্দর চেহারাটার কাছে নিজের মুখ নিয়ে বিলাপ করছে। হঠাৎ সে হেসে উঠল। অজানা ভাষায় কী যেন বলল। তারপর একলাফে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে নতুন কোনও কাজ করার জন্য প্রচণ্ড শক্তি পেয়েছে।
ঘরের মাঝখানে একটা বিরাট গোল বাক্স। স্মিথ জানেন, এতে প্রাচীন মিশরের নানারকম আংটি আর মূল্যবান পাথরের এক চমৎকার সংগ্রহ আছে। বুড়ো অ্যাটেনডেন্ট বাক্সটার কাছে গেল।
বাক্সের তালা খুলে ঢাকনা উঁচু করল। পাশের সরু তাকের ওপর বাতিটা রাখল। পকেট থেকে একটা ছোটো মাটির পাত্র বের করে বাতির পাশে রাখল। তারপর গোল বাক্সটা থেকে এক মুঠো আংটি বের করল। তারপর গম্ভীর এবং চিন্তিতভাবে এক এক করে প্রতিটি আংটিতে পাত্র থেকে একরকমের তরল পদার্থ লাগাতে লাগল। লাগানোর পর প্রতিটি আংটি আলোর সামনে তুলে ধরে দেখতে লাগল। প্রথম দফার আংটিগুলো সম্পর্কে সে আশাহত হয়েছে এটা পরিষ্কার বোঝা গেল। ফলে আংটিগুলোকে অধৈর্যের সঙ্গে গোল বাক্সের ভেতর ছুঁড়ে ফেলল। এরপর আরও এক মুঠো আংটি তুলল।
এগুলোর মধ্যে একটা প্রকান্ড আংটি, যাতে একটা বড়ো ক্রিস্টালের পাথর বসানো, তার মনোযোগ কাড়ল। প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে পাত্রের তরল পদার্থ দিয়ে সে এটা পরীক্ষা করল। অচিরেই তার গলা দিয়ে আনন্দের চিৎকার বেরিয়ে এলো। আনন্দে সে শূন্যে হাত ছুঁড়ল। হাতের ধাক্কায় তাকের ওপরে রাখা মাটির পাত্র উলটে গেল। তরল পদার্থটুকু মেঝের ওপর পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তার একটা ধারা স্মিথের পায়ের কাছে গড়িয়ে আসল।
বুড়ো অ্যাটেনডেন্ট তাড়াতাড়ি বুকের কাছ থেকে একটা লাল রঙের রুমাল বের করল। মেঝের ধারাটা মুছতে মুছতে ঘরের অন্ধকার কোণে বসে পড়ল। মুছতে গিয়ে এক পর্যায়ে স্মিথের মুখোমুখি হয়ে পড়ল।
এক্সকিউজ মি, স্মিথ বিনয়ের সাথে বললেন। দুর্ভাগ্যবশত আমি এই দরজার পেছনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আর আমাকে লক্ষ্য করেছিলেন? বুড়ো পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল। তার মৃত-পান্ডুর মুখে তীব্র ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠেছে।
সত্যবাদী হিসেবে স্মিথের খ্যাতি আছে। হ্যাঁ, তিনি বললেন। আমি তোমার কাজ দেখেছি। তুমি যা করেছ তা দেখে আমার মনে প্রচণ্ড কৌতূহল জেগেছিল।
লোকটা তার পোশাকের ভেতর থেকে একটি বিরাট ছুরি বের করল।আপনি অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন, সে বলল। দশ মিনিট আগেও যদি আপনাকে দেখতে পেতাম তবে এই ছুরি দিয়ে আপনার হৃৎপিন্ড ফুটো করে দিতাম। এখনও যদি আপনি আমাকে স্পর্শ করেন কিংবা আমার কাজে বাধা দেন তা হলে মরা মানুষে পরিণত হবেন।
তোমাকে বাধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, স্মিথ জবাব দিলেন। এখানে আমার উপস্থিতি নিছকই দুর্ঘটনা। এখন তুমি যদি আমাকে বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দাও তবে তোমার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ থাকব। অত্যন্ত ভদ্র এবং নরম গলায় স্মিথ কথাগুলো বললেন। কারণ লোকটা তার নিজের বাম হাতের তালুতে ছুরির ধারাল ডগাটা দিয়ে মৃদু চাপ দিচ্ছিল। বোধহয় ছুরিটার তীক্ষ্ণতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে চাইছে। তার চেহারায় এখনও ঘৃণার ভাব স্পষ্ট।
যদি বুঝতে পারতাম… সে বলল। কিন্তু না, হয়তো ভালোই হয়েছে। আপনার নাম কী?
স্মিথ নিজের নাম বললেন।
জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ, লোকটা পুনরাবৃত্তি করল। আপনি কি সেই লোক যিনি লন্ডনে এলকাবের ওপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন? রিপোর্টটা আমি পড়েছি। কিন্তু এ বিষয়ে আপনার জ্ঞান অতি নগণ্য।
স্যার! দারুণ বিস্ময়ে মিশরতাত্ত্বিক ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ চিৎকার করে উঠলেন।
তবে অনেকের চেয়ে আপনার গবেষণাপত্রটা অনেক উন্নত মানের। আমাদের প্রাচীন মিশরীয় জীবনের মূল নীতির কথা আপনারা কোনো লিপি অথবা স্মৃতিস্তম্ভে খুঁজে পাবেন না। অথচ আপনারা এগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেন।
আমাদের প্রাচীন মিশরীয় জীবন! স্মিথ বিস্ফারিত চোখে কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, ঈশ্বর, মমির মুখের দিকে তাকান!
অদ্ভুত লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে মমির মুখের ওপর আলো ফেলল। তার গলা থেকে বেদনামাখা বিলাপ ধ্বনি বেরিয়ে এল। বাইরের বাতাস মৃতদেহ সংরক্ষণের কলা-কৌশলকে এটুকু সময়ের মধ্যে অনেকখানি নষ্ট করে ফেলেছে। মমির মুখের চামড়া বিবর্ণ হয়ে গেছে, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, বিবর্ণ ঠোঁট দুটো কুঁচকে যাওয়ায় হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কেবল মাত্র কপালের ওপরকার বাদামী চিহ্নটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ হলো সেই মুখ যেটায় কিছুক্ষণ আগেও ছিল যৌবন আর সৌন্দর্য।
দুঃখে আর আতঙ্কে সে হাত ঘষল। তারপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে স্মিথের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল।
এটা কোনো ব্যাপার নয়, লোকটা কাঁপা কণ্ঠে বলল। সত্যিই এটা কোন ব্যাপার না। আজ রাতে একটা কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে আমি এখানে এসেছি। কাজটা হয়ে গেছে। আর সব কিছু আমার কাছে মূল্যহীন। আমি যা খুঁজছিলাম তা পেয়েছি। পুরোনো অভিশাপ দূর হয়েছে। এখন ওর সাথে। আমি মিলতে পারব। ওর দেহের কী হলো তা কোনও বিষয় নয়। ওর আত্মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এগুলো পাগলের প্রলাপ, স্মিথ বললেন। তাঁর মনে এই বিশ্বাস ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছিল যে তিনি এক পাগলের পাল্লায় পড়েছেন।
সময় নেই, আমাকে যেতে হবে, অ্যাটেনডেন্ট বলল। সুদীর্ঘ কাল ধরে যে সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই মুহূর্ত এসে গেছে। কিন্তু প্রথমে আপনাকে বাইরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেব। আমার সাথে আসুন।
বাতি হাতে নিয়ে অ্যাটেনডেন্ট অগোছাল ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। স্মিথ তাকে অনুসরণ করলেন। তারা দ্রুত ঈজিপশিয়ান, অসিরিয়ান আর পারসিয়ান সংগ্রহের ঘরগুলো অতিক্রম করলেন। শেষে বুড়ো দেয়ালের গায়ে একটা ছোটো দরজার পাল্লা মৃদু ধাক্কা মেরে খুলল। দেখা গেল একটা ঘোরানো পাথরের সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। স্মিথ কপালে রাতের ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পেলেন। এবার উলটো পাশে একটা দরজা দেখলেন, যেটা দিয়ে রাস্তায় বেরুনো যায়। তার ডান পাশে আরেকটা দরজা খোলা, যেটা থেকে বাতির হলুদ আলো প্যাসেজের ওপর পড়েছে। এ ঘরের ভেতরে আসুন, অ্যাটেনডেন্ট সংক্ষেপে বলল।
স্মিথ ইতস্তত করতে লাগলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে এই অভিযানের সমাপ্তি বুঝি এখানেই ঘটবে। যদিও কৌতূহল অমীমাংসিত রেখে যেতে পারছেন না তিনি। তাই অদ্ভুত লোকটার সাথে আলোকিত ঘরটায় ঢুকলেন।
ঘরটা ছোটো। সাধারণত দারোয়ানদের এরকম ঘর দেওয়া হয়। ভেতরে আগুন রাখার তাওয়ায় আগুন জ্বলছে। এক পাশে একটা চাকাওয়ালা চৌকির ওপর বিছানা পাতা। আরেক পাশে একখানা অমসৃণ কাঠের চেয়ার। মাঝখানে একটা গোল টেবিল রয়েছে। টেবিলের ওপর একটা প্লেটে রাতের খাবারের অবশিষ্ট পড়ে আছে।
স্মিথ লক্ষ্য করলেন ঘরের আসবাবগুলো তৈরির মধ্যে প্রাচীন কারিগরি দক্ষতার ছাপ বিদ্যমান। মোমবাতি, মোমদানি, চুলো খোঁচাবার শিক, দেয়ালে ঝোলানো নকশা–সবগুলোর মধ্যে সুদূর অতীতের ছাপ রয়েছে।
বুড়ো অ্যাটেনডেন্ট বিছানার কিনারায় বসে অতিথিকে চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করল। হয়তো আমার ভাগ্যে এই ছিল, বুড়ো চমৎকার ইংরেজিতে বলল। ভাগ্য হয়তো আগেই ঠিক করে রেখেছে যে যাওয়ার আগে আমি একটা বিবরণ রেখে যাব। এ বিবরণ হচ্ছে সেই লোকদের জন্য যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজেদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে চায়। আমি আপনাকে সেই কথা বলতে চাই। চাই আপনার মাধ্যমে সবাই এই কথা জানতে পারুক। পরজগতের দোরগোড়ায় পা রেখে আমি আপনাকে আমার জীবনের গল্প বলছি।
.
আপনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন আমি মিশরীয়। প্রাচীন মিশরে জন্মেছিলাম আমি। কী, অবাক হচ্ছেন? বিশ্বাস করছেন না? আগে আমার বিচিত্র কাহিনি পুরোটা শুনুন। বুড়ো একটু থেমে আবার বলল, তো যা বলছিলাম, আমি জন্মেছিলাম প্রাচীন মিশরে। আজ যে পদদলিত দাসজাতি নীলনদের তীরে বাস করছে আমি সে গোত্রের কেউ নই। প্রাচীন মিশরে যে বীর্যবান আর পরিশ্রমী জাতি বাস করত, যারা ইহুদিদের বশ করেছিল আর দুর্ধর্ষ ইথিওপিয়ানদের দক্ষিণের মরুভূমিতে তাড়িয়ে দিয়েছিল, যারা বিশাল বিশাল পিরামিড তৈরি করেছিল, সেই জাতিতে আমার জন্ম।
যীশুর জন্মের মোলোশো বছর আগে ফারাও Tuthmosis-এর রাজত্বকালে আমি পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলাম। আপনি আমার কাছ থেকে দূরে সরে বসছেন। ভয় পাচ্ছেন? কিন্তু একটু ধৈর্য ধরে আমার কাহিনি শুনুন। তা হলে বুঝতে পারবেন, আমি যতটা না ভয়ের তার চেয়ে অনেক বেশি করুণার পাত্র।
আমার নাম সোসরা। আমার বাবা ছিলেন আবরিস এর ওসাইরিস দেবতার মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। মন্দিরটা ছিল নীলনদের বুবাস্তিক শাখার তীরে। এই মন্দিরেই আমি পালিত হয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলাম। আমাকে সব রকমের অতীন্দ্রিয় বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলা হয়। এই বিদ্যা সম্পর্কে আপনাদের বাইবেলেও লেখা আছে। আমি মেধাবী ছাত্র ছিলাম। দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরোহিত আমাকে যা শেখাতে পারতেন না, ষোলো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই আমি তা শিখে ফেললাম। ওই সময় থেকে আমি নিজেই প্রকৃতির গোপন তত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলাম। আমার এই জ্ঞানের কথা আমি কাউকে জানাইনি।
সমস্ত প্রশ্নের থেকে একটা প্রশ্ন আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল। প্রশ্নটা হলো জীবনের প্রকৃতি কী? এই বিষয়ে আমি অনেক গবেষণা করতে শুরু করলাম। এর মূলনীতির গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলাম। ওষুধের লক্ষ্য হলো রোগ হলে দেহ থেকে রোগকে তাড়িয়ে দেয়া। আমার মনে হলো এমন একটা পদ্ধতি কি আবিষ্কার করা যায় যাতে দেহে কোন দিন দুর্বলতা কিংবা মৃত্যু বাসা বাঁধতে না পারে? আমার গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা অর্থহীন। করলেও আপনি বুঝতে পারবেন না। এ গবেষণার জন্য আমাকে দীর্ঘকাল অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়েছে। এ পরীক্ষার কিছু অংশ পশুর ওপর, কিছু অংশ ক্রীতদাসদের ওপর আর কিছু অংশ আমার নিজের ওপর চালিয়েছিলাম। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকুই বলি, দীর্ঘ গবেষণার ফলে আমি এমন একটা তরল পদার্থ আবিষ্কার করেছিলাম যেটা ইনজেকশন দিয়ে রক্তের মধ্যে প্রবেশ করালে মানবদেহ সময়, হিংস্রতা অথবা রোগের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। এর ফলে মানুষ অমর হবে না কিন্তু ওষুধের কার্যকারিতা থাকবে হাজার বছর ধরে। ফলে সে বেঁচে থাকবে সহস্র বছর।
প্রথমে একটা বিড়ালের ওপর এই ওষুধ প্রয়োগ করলাম। তারপর তার শরীরে মারাত্মক বিষ ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু তীব্র বিষেও বিড়ালটি মরল না। আজও লোয়ার ঈজিপ্টে ওটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে কোনও রহস্য বা জাদু নেই। এটা নিছকই এক রাসায়নিক আবিষ্কার। যেটা আবারও তৈরি করা যেতে পারে।
যৌবনে যে কেউ জীবনকে ভালোবাসে। আমার মনে হলো জীবনের সমস্ত দুশ্চিন্তার বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছি আমি। কারণ মৃত্যুকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারব বহু দূরে। অত্যন্ত হালকা মনে আমি আমার আবিষ্কৃত সেই অভিশপ্ত জিনিসটি আমার শিরায় ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর এমন একজনকে খোঁজ করতে লাগলাম যাকে আমি আমার দীর্ঘ জীবনের সঙ্গী করতে পারি।
মহান দেবতা থোথ-এর মন্দিরে এক তরুণ পুরোহিত ছিল। তার নাম পারমেস। সে প্রকৃতি আর পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ছিল। এ জন্য ওকে আমি খুব পছন্দ করতাম। আমার এই গোপন আবিষ্কারের ব্যাপারে ওকে সব খুলে বললাম। ও উৎসাহিত হয়ে আমাকে অনুরোধ করায় ওর শরীরে ওই ওষুধ ঢুকিয়ে দিলাম। ভাবলাম, এই সুদীর্ঘ জীবনে একজন সাথি পেলাম।
এই বিরাট আবিষ্কারের পর আমার গবেষণায় কিছুটা ঢিল পড়ল। কিন্তু পারমেস দ্বিগুণ উদ্যমে গবেষণা শুরু করল। প্রতিদিন তাকে থোথের মন্দিরে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে দেখেছি। কিন্তু ওর কাজ সম্পর্কে খুব কম কথাই আমাকে বলতো। আমি শহরের পথে পথে অলসভাবে ঘুরে বেড়াতাম। আনন্দের দৃষ্টিতে চার পাশে তাকিয়ে ভাবতাম এ সবই চলে যাবে শুধু আমি টিকে থাকব। পথচারীরা মাথা নুইয়ে আমাকে সম্মান জানাতো। কারণ পন্ডিত হিসেবে বিদেশেও আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।
এ সময় দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। হেক্সোমদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মহান ফারাও পূর্ব সীমান্তে একদল সৈন্য পাঠালেন। আবরিসে একজন গভর্নর পাঠালেন যাতে ফারাওদের শাসন কায়েম করতে পারেন। শুনেছিলাম গভর্নরের মেয়ে নাকি খুব সুন্দরী। একদিন পারমেসকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে তার সঙ্গে দেখা হলো। চারজন ক্রীতদাস একটা পালকিতে করে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম দেখাতেই আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম।
আমি আর আমার মাঝে রইলাম না। ভাবলাম, এই-ই আমার জীবনের কাঙ্খিত নারী। ওকে ছাড়া আমার জীবন ধারণ অসম্ভব। মহান দেবতা হোরাস-এর নামে শপথ করলাম, ওকে নিজের করে পেতেই হবে। আমার মনের কথা পারমেসকে জানালাম, কিন্তু ও আমার কাছ থেকে চলে গেল। দেখলাম ওর মুখটা মাঝরাতের অন্ধকারের মতো কালো হয়ে গেছে।
সেই মেয়ের সাথে আমার ভালোবাসার কাহিনি আপনাকে বলার প্রয়োজন নেই। শুধু এতটুকুই বলব, আমি যেমন তাকে ভালোবাসতাম, সেও আমাকে তেমনি গভীরভাবে ভালোবাসত। শুনেছিলাম, আমার সাথে দেখা। হওয়ার আগেই নাকি পারমেসের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। পারমেস তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম। কারণ আমি জানতাম ওর হৃদয় আমার।
এ সময় এক দুর্যোগ দেখা দিল। আমাদের শহরে হোয়াইট প্লেগের আক্রমণ হলো। অনেকেই মারা যেতে লাগল। কিন্তু আমি অসুস্থ লোকদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কারণ আমার কোনো ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না। আমার সাহস দেখে গভর্নরের মেয়ে মানে আমার প্রেমিকা বিস্মিত হলো। আমি তাকে আমার গোপন আবিষ্কারের কথা বললাম। অনুরোধ করলাম আমার এই চমৎকার আবিষ্কার ব্যবহারের জন্য।
আমার ওষুধ তোমার ওপর প্রয়োগ করতে দাও, আতমা (Atma), আমি বললাম। তা হলে ফুলের মতো তোমার এই সুন্দর শরীর কখনও শুকিয়ে যাবে না। হাজার হাজার বছর চলে যাবে কিন্তু আমরা এবং আমাদের ভালোবাসা চিরকাল রয়ে যাবে। ফারাও শেফুর বিরাট পিরামিড ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরও আমরা রয়ে যাব।
কিন্তু ওর মনে সংশয় ছিল। এটা কি ঠিক হবে? আমাকে ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল। এর ফলে কি দেবতার ইচ্ছাকে বাধা দেয়া হবে না? মহান দেবতা ওসাইরিস যদি আমাদের দীর্ঘ জীবন চাইতেন, তবে তিনি নিজেই কি ব্যবস্থা করতেন না?
ভালোবাসার কথা বলে আমি ওর সন্দেহ দূর করলাম। যদিও ও ইতস্তত করছিল। বলেছিল, এটা একটু বড়ো প্রশ্ন। ভেবে দেখার জন্য আমার কাছে এক রাত সময় চাইল। বলল যে আগামীকাল সকালে ওর জবাব জানতে পারব। যদিও এক রাত বেশি সময় নয়। আমাকে বলেছিল, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আইসিসের কাছে সাহায্য চাইবার জন্য প্রার্থনা করবে।
এক বুক সংশয় আর মনের মধ্যে অমঙ্গলের চিন্তা নিয়ে ওর কাছ থেকে বাড়ি ফিরে আসলাম। পরদিন সকালে মন্দিরের প্রথম বলিদান শেষ হওয়ার পরেই আমি আমাদের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলাম। প্রাসাদে পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় এক ক্রীতদাসীর সাথে দেখা হলো। সে বলল, তার মনিব কন্যা খুব অসুস্থ। একথা শুনে পাগলের মতো ছুটে ওর ঘরে চলে গেলাম। দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছে ও। মাথাটা বালিশের ওপর। মুখটা বিবর্ণ, চোখ দুটো চকচক করছে। ওর কপালের মাঝ বরাবর একটা বেগুনি রঙের ক্ষত জ্বলজ্বল করছে। ক্ষতটা দেখেই বুঝতে পারলাম কী হয়েছে। এ হলো হোয়াইট প্লেগের চিহ্ন। একে অনিবার্য মৃত্যুর চিহ্নও বলা যায়।
আতমা বাঁচল না।
সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা কী বলব! মাসের পর মাস আমি পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলাম। জ্বরে আক্রান্ত শরীরে ভুল বকতে লাগলাম। কিন্তু আমি মরতে পারলাম না। মৃত্যুকে আমি যেমন করে কামনা করেছিলাম, মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত কোনও আরবও বুঝি তেমনভাবে পানির খোঁজ করে না। যদি বিষ অথবা অস্ত্রের আঘাতে মরতে পারতাম তবে পরজগতে আমার ভালোবাসার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য একটুও দেরি করতাম না। আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোন ফল হয়নি। সেই অভিশপ্ত ওষুধ আমার দেহে শক্ত প্রভাব বিস্তার করে বসেছে।
এক রাতে দুর্বল শরীরে আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ পারমেস আমার ঘরে প্রবেশ করল। ও বাতির আলোর বৃত্তের মাঝে দাঁড়াল। ও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখলাম ওর চোখে বিজয়ের দৃষ্টি।
তুমি আমাকে মরতে দিলে কেন? পারমেস আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমাকে যেমন দীর্ঘায়ু করেছ, ওকে কেন করলে না?
দেরি করে ফেলেছিলাম, আমি জবাব দিলাম। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম তুমিও তো ওকে ভালোবাসতে। তুমি আমার দুর্ভাগ্যের সঙ্গী। একদিন পরজগতে ওকে আমরা ঠিকই দেখতে পাব। কিন্তু এর জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে। চিন্তাটা কত ভয়ঙ্কর, তাই না? মূর্খ, আমরা মূর্খ। মৃত্যুকে আমরা শত্রু বলে গণ্য করেছিলাম।
একথা তুমি বলতে পার, উন্মাদের মতো হেসে পারমেস বলল। তোমার মুখ থেকে এ ধরনের কথা বেরুতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এসব অর্থহীন।
কী বলতে চাও তুমি? আমি চিৎকার করে বললাম, কনুই-এর ওপর ভর দিয়ে উঠে বসলাম। শোকে নিশ্চয়ই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
পারমেসের চেহারায় আনন্দের ছাপ। ওর সারা শরীর এমন ভাবে কাঁপছে যেন শয়তান ভর করেছে।
জান, আমি কোথায় যাচ্ছি? ও জিজ্ঞাসা করল।
না, আমি জবাব দিলাম। বলতে পারব না।
আমি আমার কাছে যাচ্ছি, পারমেস বলল। শহরের প্রাচীরের বাইরে জোড়া খেজুর গাছের পাশের সমাধিতে শুয়ে আছে ও।
ওখানে কেন যাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মরতে! পারমেস চিৎকার করে বলল। মরতে যাচ্ছি! পৃথিবীর আর কোনো কিছু আমাকে আটকাতে পারবে না।
কিন্তু তুমি মরতে পারবে না, আমি চিৎকার করে বললাম। তোমার রক্তে এখনও ওই অভিশপ্ত ওষুধের প্রভাব রয়েছে।
আমি ওটাকে অগ্রাহ্য করতে পারব, পারমেস বলল। এমন একটা শক্তিশালী ওষুধ আমি আবিষ্কার করেছি যেটা তোমার ওষুধের প্রভাব নষ্ট করে ফেলতে পারবে। আমার শরীরে এখন ওটা কাজ করছে। এক ঘণ্টার মধ্যে আমি মারা যাচ্ছি। আমি আমার সাথে মিলিত হব। কিন্তু তুমি এই জীবনের বোঝা বইবার জন্য পড়ে থাকবে।
পারমেসের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ও সত্যি কথাই বলছে। ওর চোখের আলো সেই কথাই বলছে।
তুমি আমাকে শেখাও! আমি বললাম।
কখনও না! পারমেস জবাব দিল।
মহান দেবতা থোথ আর আনুবিসের নামে তোমার কাছে অনুরোধ করছি!
কোনো লাভ হবে না, পারমেস শীতল কণ্ঠে বলল।
তা হলে আমি নিজেই খুঁজে নেব, আমি চিৎকার করে বললাম।
পারবে না, পারমেস বলল। আমি দৈবক্রমে এটা আবিষ্কার করেছি। ওষুধের মধ্যে এমন একটা উপাদান আছে, যা তুমি কখনও সংগ্রহ করতে পারবে না। থোথ-এর আংটির মধ্যে যেটুকু ওষুধ আমি রেখেছি, তার বাইরে এক ফোঁটা ওষুধও কেউ কোনোদিন তৈরি করতে পারবে না।
থোথের আংটির মধ্যে? আমি পুনরাবৃত্তি করলাম। আংটিটা কোথায়?
তুমি একথা কখনও জানতে পারবে না, পারমেস বলল। তুমি আমার ভালোবাসা পেয়েছিলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কে জিতল? তোমাকে আমি এই নোংরা পৃথিবীতে রেখে আমার কাছে চলে যাব। পারমেস পাগলের মতো ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে খবর পেলাম থোথের তরুণ পুরোহিত মারা গেছে।
এরপর আমার দিনগুলো গবেষণার মধ্যে কাটতে লাগল। সেই বিষের সন্ধান আমাকে অবশ্যই পেতে হবে। যেটা আমার ওষুধের প্রভাব নষ্ট করে আমাকে মৃত্যু দান করবে। ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত আমি টেস্টটিউব আর ফার্নেস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। থোথের মন্দির থেকে পারমেসের ব্যবহৃত প্যাপিরাস আর ফ্লাস্কগুলো সংগ্রহ করলাম। কিন্তু হায়! ওগুলো থেকে কিছুই জানতে পারলাম না। প্যাপিরাসগুলোতে লেখা কিছু ইঙ্গিত আমার মনে আশা জাগিয়ে তুলল। কিন্তু কোনও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলাম না। মাসের পর মাস আমি কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে যখনই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন জোড়া খেজুর গাছের পাশে আমার সমাধিতে হাজির হতাম। সেখানে আতমার উপস্থিতি অনুভব করতাম। ওর উদ্দেশ্য ফিসফিস করে বলতাম, ওর কাছে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
পারমেস বলেছিল ওর আবিষ্কারের সাথে থোথের আংটির সম্পর্ক রয়েছে। আংটিটার কথা আমার মনে আছে। ওটা একটা বিরাট আর ভারী আংটি। আংটিটা সোনা দিয়ে তৈরি নয়। এক ধরনের ভারী দুর্লভ ধাতু দিয়ে তৈরি, যেটা হারবাল পর্বত থেকে আনা হয়েছিল। মনে পড়ল, বিরাট ওই আংটিটায় একখন্ড ফাঁপা স্ফটিক বসানো রয়েছে। হয়তো ওটার মধ্যেই পারমেসের আবিষ্কৃত ওষুধের কয়েক ফোঁটা থাকতে পারে। পারমেসের গোপন আবিষ্কার ধাতুর সাথে সম্পর্কিত নয়। কারণ প্রাটিনামের তৈরি অনেকগুলো আংটি থোথের মন্দিরে আছে। তা হলে কি পারমেস তার আবিষ্কৃত ওষুধ ফাঁপা স্ফটিকের মধ্যে জমা রেখেছে? এ সিদ্ধান্তে আসার পর আমি তন্নতন্ন করে পারমেসের কাগজ পত্র পরীক্ষা করতে লাগলাম। একখানা কাগজ থেকে জানলাম আমার ধারণাই ঠিক। স্ফটিক খন্ডের মধ্যেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেই বিষ। সেই বিষের কয়েক ফোঁটা তখনও ব্যবহার করা। হয়নি।
কিন্তু আংটিটা খুঁজে পাব কীভাবে? আংটিটা পারমেসের সাথে ছিল না। ওর মৃতদেহটা মমিতে পরিণত করার সময় তা পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাঝেও আংটিটা পাওয়া যায়নি। যে সব জায়গায় ও যেত সেখানেও খুঁজে দেখেছি। কিন্তু পাইনি। এ সময় নতুন এক দুর্ভাগ্য না এলে হয়তো শেষ পর্যন্ত আমার পরিশ্রম সার্থক হতো।
হিসোসদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। ফারাও-এর সেনাবাহিনী সেই যুদ্ধে পরাজিত হলো। এই মেষ পালক জাতি আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা আমাদের সবকিছু লুটপাট করতে লাগল। এই এলাকায় দিনের বেলায় বইতে লাগল রক্ত স্রোত আর রাতের বেলায় জ্বলতে লাগল আগুন। আমাদের আবারিস ছিল মিশরের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু ওই বর্বরদের আমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। নগরীর পতন হলো। গভর্নর এবং সৈন্যদের হত্যা করা হলো। আর অন্যদের সাথে আমি বন্দি হলাম।
বছরের পর বছর ধরে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে আমি পশু চরাতে লাগলাম। আমার প্রভু মারা গেল। তার ছেলেও বুড়ো হলো। কিন্তু মৃত্যু থেকে তখনও আমি বহু দূরে। অবশেষে একদিন একটা দ্রুতগামী উটের পিঠে চড়ে আমি পালালাম। এগিয়ে চললাম মিশরের দিকে। হিকসোসরা মিশরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। তাদের রাজা দেশটা শাসন করছে। আবারিস নগরী বিধ্বস্ত হয়েছে।
শহরটাকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিরাট বিরাট মন্দিরগুলোর জায়গায় এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। প্রতিটা কবর লুট করা হয়েছে। প্রত্যেকটা স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার আমার সমাধির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মরুভূমির বালির তলায় হারিয়ে গেছে সেই সমাধি। যে পোড়া খেজুর গাছ। সমাধিটাকে চিহ্নিত করতো তার কোনও চিহ্ন নেই।
পারমেসের কাগজপত্র এবং থোথের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হয় ধ্বংস হয়েছে, নয়ত ছড়িয়ে পড়েছে সিরিয়া মরুভূমির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অনেক খুঁজলাম। কিন্তু সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হলো।
তখন থেকেই থোথের আংটি এবং তার মধ্যে লুকানো পারমেসের ওষুধ খুঁজে পাবার আশা আমি ত্যাগ করেছি। মনস্থির করলাম যতদিন ওষুধের প্রভাব কেটে না যায় ততদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। সময় যে কী ভয়ঙ্কর জিনিস তা আপনি কীভাবে বুঝবেন? কালস্রোত অসীম, অনন্ত। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত কালের এই সীমিত গন্ডির মাঝেই আপনাদের অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমি জানি। যুগ-যুগ ধরে কালের অসীম স্রোতে ভেসে চলছি আমি। ইতিহাসের উত্থান পতন আমি নিজের চোখে দেখেছি। ট্রয় নগরীর . পতন যখন হয় তখন আমি বৃদ্ধ। হেরোগেটাস যখন মেমফিস নগরীতে আসে, আমি তখন অতি বৃদ্ধ। যীশু খ্রিস্ট যখন পৃথিবীতে তাঁর নতুন বাণী প্রচার করলেন, আমি তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি।
কিন্তু আজও আপনি আমাকে জীবিত মানুষ হিসেবেই দেখছেন। কারণ আমার রক্তে ওই অভিশপ্ত পদার্থ এখনও ক্রিয়াশীল। তবে এবার আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি।
এই সুদীর্ঘ জীবনে আমি সব দেশে ঘুরেছি, সব জাতির সাথে বসবাস করেছি। পৃথিবীর সব ভাষাই আমার কাছে একই রকম। ক্লান্তিকর সময় কাটানোর জন্য আমি সব ভাষা শিখেছি। সময় যে কীভাবে ধীরে চলে তা আপনাকে কীভাবে বোঝাব? বর্বরতার মধ্যযুগ আর আধুনিক সভ্যতার উন্মেষ আমার নিজের চোখে দেখা। এসবই আমি পেছনে ফেলে এসেছি। অন্য কোনো নারীর দিকে কখনও আমি প্রেমের দৃষ্টিতে তাকাইনি। আতমা জানে আমি তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি।
প্রাচীন মিশর সম্পর্কে গবেষকরা যা লিখতেন তা পড়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এই দীর্ঘ জীবনে অনেক কাজ করেছি। কখনো প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেছি, কখনওবা দারিদ্র্যের মধ্যে। কিন্তু যে অবস্থায়ই থাকি না কেন প্রাচীন মিশর সংক্রান্ত পত্র-পত্রিকা সব সময় কিনেছি। নয় মাস আগে আমি সানফ্রান্সিসকোতে ছিলাম। সেখানে এক পত্রিকায় পড়লাম, প্রাচীন আবারিস নগরীর কাছাকাছি এলাকার বালির তলা থেকে কিছু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। খবরটা পড়ে আমার বুক ধক করে উঠল। ওখানে আরও লেখা ছিল, যিনি খননের দায়িত্বে আছেন, বর্তমানে তিনি সদ্য আবিষ্কৃত গেছে। মমিটির কফিন এখনও ভোলা হয়নি। কফিনের ওপর একটা চিত্রলিপি আছে তাতে লেখা-ফারাও টুথমোসিসের আমলের গভর্নরের কন্যা এখানে শুয়ে আছেন।
পত্রিকায় আরও লেখা আছে, কফিনের ঢাকনা সরাবার পর মমিটার বুকে একটা প্লাটিনামের বড়ো আংটি পাওয়া গেছে। তাতে বিরাট একখন্ড স্ফটিক বসানো। বুঝতে পারলাম, পারমেস এখানেই থোথের আংটি লুকিয়ে রেখেছিল। আর এজন্য ও বলেছিল, অতি নিরাপদ জায়গায় আংটিটা লুকিয়ে রেখেছে। কারণ কোনো মিশরীয়ই মমির অভিশাপ নেওয়ার জন্য কফিনের ঢাকনা খুলবে না।
ওই রাতেই আমি সানফ্রান্সিসকো ত্যাগ করলাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরবিসে পৌঁছে গেলাম। অতীতের সেই সমৃদ্ধ নগরীর জায়গায় বর্তমানে কয়েকটা বালুর স্তূপ আর ভাঙাচোরা কয়েকটা প্রাচীর ছাড়া আর কিছুই নেই। কয়েকজন ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক এখানে খনন করছিল। তাদের কাছে গিয়ে আংটিটার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বলল যে আংটি আর মমিটা কায়রোর বুলাক জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি বুলাক জাদুঘরে গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, ম্যারিয়েট বে নামে এক লোক আংটি আর মমির মালিকানা দাবি করেছে। তাই ওগুলো তাকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে শুনলাম তিনি দুটি জিনিসই লুভর মিউজিয়ামের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। ওগুলোকে অনুসরণ করে অবশেষে আমি ভরে হাজির হলাম। সুদীর্ঘ চার হাজার বছর পর আমার আমার দেহাবশেষ খুঁজে পেলাম আমি। খুঁজে পেলাম সেই আংটি, যেটাকে এতকাল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
কিন্তু ওগুলো হাতে পাবো কীভাবে? কেমন করে ওই মূল্যবান বস্তু দুটি আমি একান্ত করে পাবো? এবার ভাগ্য আমার প্রতি প্রসন্ন হলো। মিউজিয়ামের মিশরীয় সংগ্রহশালার অ্যাটেনডেন্টের পদ খালি হলো। আমি সোজা ডিরেক্টরের কাছে চলে গেলাম। তাকে বোঝাতে পারলাম যে প্রাচীন মিশর সম্পর্কে অনেক কিছু জানি আমি।
অতি আগ্রহে হয়তো একটু বেশিই বলে ফেললাম। আমার কথা শুনে ডিরেক্টর মন্তব্য করলেন, তোমাকে তো দেখছি সামান্য অ্যাটেনডেন্টের পদের চেয়ে অধ্যাপকের পদেই বেশি মানায়। তারপরও তিনি আমাকে চাকরি দিলেন। আর এভাবেই আমি এই চাকরিটা পেলাম। এখানে আজকেই আমার প্রথম এবং শেষ রাত।
মি. ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ, এই হলো আমার কাহিনি। আপনার মতো বিদ্বান ব্যক্তির কাছে এর বেশি কিছু আমার বলার নেই। আজ রাতে দৈবক্রমে আপনি সেই নারীর মুখ দেখলেন যাকে সুদূর অতীতে আমি ভালোবেসেছিলাম। বাক্সের মধ্যে স্ফটিক বসানো অনেকগুলো আংটি রয়েছে। কিন্তু আমার সেই প্রাটিনামের আংটিটি খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাকে পরীক্ষা করতে হয়েছিল।
আংটিটার স্ফটিক খণ্ডের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি ওটার ভেতরে পারমেসের আবিষ্কৃত ওষুধের কয়েক ফোঁটা রয়ে গেছে। অবশেষে আমার এই সুদীর্ঘ অভিশপ্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।
মি. স্মিথ, আপনার কাছে আমার আর কিছু বলার নেই। এ কাহিনি এতকাল আমার মনের মধ্যে ছিল। আজকে আপনার কাছে বলে মুক্তি পেলাম। ইচ্ছে করলে আমার জীবনের ইতিহাস আপনি অন্য লোকদের কাছে বলতে পারেন আবার নাও বলতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা রইল।
আজ রাতে আপনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন। আমি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য সাধনের পথে কোনো বাধাই আমি সহ্য করতাম না। আমার কাজ শেষ হওয়ার আগে যদি আপনাকে দেখতে পেতাম তা হলে আমাকে বাধা দেওয়ার বা কোনো রকম বিপদ সংকেত জানানোর সুযোগটুকু পর্যন্ত আপনাকে দিতাম না। এবার আপনাকে বাইরে বেরুবার রাস্তা দেখিয়ে দিই। এই দরজা দিয়ে বেরুলে আপনি Rue de Rivoli রাস্তায় যেতে পারবেন। শুভ রাত্রি, মি. স্মিথ।
মি. জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকালেন। মুহূর্তের জন্য সোসরার কৃশ দেহটা সরু দরজা পথে দেখতে পেলেন। পরমুহূর্তে দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। খিল আটকানোর গুরুগম্ভীর শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল।
.
লন্ডনে ফিরে আসার দুদিন পরে মি. জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ দি টাইমস পত্রিকায় একটি খবর পড়লেন। খবরটি পাঠিয়েছে সংবাদপত্রের প্যারিস সংবাদদাতা। সংবাদটি হচ্ছে :
স্যুভর মিউজিয়ামে অস্বাভাবিক ঘটনা
গতকাল সকালে মিউজিয়ামের বড়ো ঈজিপশিয়ান চেম্বারে এক অদ্ভুত আবিষ্কার হয়েছে। সকালে ঝাড়ুদারেরা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে ঈজিপশিয়ান চেম্বারের নবনিযুক্ত বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মৃত ব্যক্তি দুহাত দিয়ে সদ্য সংগৃহীত মমি জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। মৃত ব্যক্তি এত দৃঢ় ভাবে মমিটাকে আলিঙ্গন করে রেখেছিল যে অনেক কষ্টে তাদেরকে আলাদা করা গেছে। একটা বড়ো বাক্সে অনেকগুলো মূল্যবান আংটি ছিল। বাক্সটা খুলে সেগুলো এলোমলো করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ধারণা লোকটা মমি চুরি করে ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মমি নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। লোকটার বয়স কত বা দেশ কোথায় কিছুই জানা যায়নি। তার এই অস্বাভাবিক ও নাটকীয় মৃত্যুতে শোক করার জন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রাখলেন স্মিথ। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল লুভর মিউজিয়াম। মনে পড়ল সেই রাতের কথা…সেই রহস্যময় মানুষটির কথা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : তারক রায়