ভুঁইয়া শ্রেষ্ঠ কেদার রায় – প্রসিত রায়চৌধুরী
মেঘনার মোহনায় থইথই নীল জলে ভাসছে সবুজ সুন্দর এক দ্বীপ-নাম সন্দ্বীপ৷ ভোরের আলো ফুটতে দেখা গেল পঞ্চাশটা পালতোলা যুদ্ধজাহাজ কোষা ঘিরে ফেলেছে দ্বীপটাকে৷ কামান থেকে মুহুমÍñহু গোলা বর্ষণ শুরু হয়ে গেল৷ ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় চার-শো বছর আগে৷ পাঠান সুলতান দায়ুদের পতন হয়েছে৷ গৌড় থেকে রাজধানী চলে গেছে রাজমহলে৷ মোগল শাসন মেনে নিতে রাজি নয় বাংলাদেশ৷ পাঠানদের সঙ্গে মোগলদের লড়াই লেগেই আছে৷ বাংলার বীর ভুঁইয়ারা মাথা তুলছে পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গে৷ পর্তুগিজ বোম্বেটে আর আরাকানি মগরা ছারখার করছে দক্ষিণ বাংলা৷ নদীনালাগুলো নিরাপদ নয় পুতুÍগিজ ‘হার্মাদের’ অত্যাচারে৷ গ্রামের মধ্যে ঢুকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়-মানুষজনকে বেঁধে নিয়ে যায়-বিক্রি করে দেয়, গোরু ছাগলের মতো৷ সোনার গাঁয়ের ঈশা খাঁ, যশোরের প্রতাপাদিত্য আর শ্রীপুরের ভুঁইয়া চাঁদ রায়, কেদার রায় ঠিক করলেন এ অত্যাচার তাঁরা সহ্য করবেন না৷ মাতলা, বিদ্যাধরী, কালীগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা নদীতে টহল &&দিয়ে ফিরতে থাকে চাঁদ প্রতাপের যুদ্ধ জাহাজ কোষা, ঘুরাব৷ পর্তুগিজ বোম্বেটেদের রণতরি দেখলেই গোলার ঘায়ে ডুবিয়ে দেয়৷ জব্দ হয়ে গেল বোম্বেটেরা৷ পর্তুগিজ জলদস্যু বড়া প্রতাপের হাতে বন্দি হল৷ প্রতাপ তাকে তাঁর সৈন্যদলে ভরতি করলেন৷ মেঘনা নদীর বোম্বেটে কার্ভালো কেদার রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে৷ কেদার রায় তাঁকে তাঁর নৌসেনাবাহিনীতে চাকরি দেন৷ উদ্দেশ্য ছিল সন্দ্বীপ দখল করা৷ সন্দ্বীপ দখল করতে পারলে আরাকানি মগদস্যুদের শায়েস্তা করা যাবে সহজে৷ কিন্তু সন্দ্বীপের দাবিদার কম নয়৷ পাঠানদের পরাজয়ের পর মোগলরা চাইছিল এমন চমৎকার দ্বীপটা তাদের কব্জায় থাকুক৷ কিন্তু আরাকানরাজ মনতাজগিরি সন্দ্বীপ দখলের ব্যবস্থা করলেন৷ সমুদ্রের বুকে এমন দ্বীপটা দখলে থাকলে বঙ্গদেশ লুঠপাটের বেশ সুবিধা হয়৷ কিন্তু তার আগেই কেদার রায় পঞ্চাশটি রণতরি পাঠালেন সন্দ্বীপ জয় করতে৷ নৌবাহিনীর অধ্যক্ষ কার্ভালো৷
এদিকে মগরাজ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন৷ প্রচণ্ড নৌযুদ্ধের পর আরাকানরাজের নৌবাহিনী বিধ্বস্ত হল৷ কার্ভালো সন্দ্বীপ দখল করে নিলেন৷ কেদার রায় সন্দ্বীপের ভার কার্ভালোকেই দিলেন৷ কেদার চেয়েছিলেন কাঁটা দিয়ে দিয়ে কাঁটা তুলতে৷ তাঁর কৌশল ছিল-সন্দ্বীপের দুর্গ থেকে পর্তুগিজ বোম্বেটেদের দিয়ে মগ জলদস্যুদের জব্দ করবেন৷ সন্দ্বীপ পর্তুগিজ দখলে যাওয়ায় আরাকানরাজের বাড়াভাতে ছাই পড়ে৷ এর জন্য কেদার রায়কেই তিনি দায়ি করেন৷
এদিকে সন্দ্বীপ কেদার রায়ের আয়ত্তে আসায় মোগল সেনাপতি মানসিংহ ক্রুদ্ধ হন৷ মগরাজ গিরির দূত রাজমহলে উপস্থিত হয়৷ মগ-মোগলের গোপন সন্ধি হয় ভুঁইয়া কেদার রায়কে ধ্বংস করতে৷ মোগল আর মগরাজের নৌবাহিনী সন্দ্বীপ আক্রমণ করে৷ ভারী কামান-বসানো রণতরি নিয়ে মগ নৌসেনাপতি সিনাবাদি কার্ভালোর যুদ্ধ জাহাজ আক্রমণ করেন৷ প্রচণ্ড যুদ্ধে পর্তুগিজ রণপোত হটে আসছে, এমনি সময় কেদার রায়ের এক-শো কোষা জাহাজ কার্ভালোর সাহায্যে উপস্থিত হয়৷ ‘জয় মা কালী’ রবে মেঘনার মোহনা কেঁপে ওঠে৷ হঠাৎ গাদাবন্দুকের একটা গুলি মগ সেনাপতি সিনাবাদির মাথায় লাগে৷ বীর সেনানী সিনাবাদি রণপোত ঘুরাব থেকে বঙ্গোপসাগরের জলে পড়ে যান৷ সেনাপতির মৃত্যুতে মগসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে৷ তারা পালাতে চায়৷ কিন্তু বাঙালি সেনাদের ছোড়া তিরের ঘায়ে পাকা ফলের মতো জলে পড়ে যায়৷ ইতিমধ্যে পর্তুগিজ জলদস্যু মাটুস চার-শো বোম্বেটে নিয়ে কার্ভালোকে সাহায্য করতে আসে৷ কার্ভালো জয়ী হন বটে কিন্তু তাঁর প্রায় সব যুদ্ধ জাহাজ গোলার ঘায়ে চূর্ণ হয়ে যায়৷ মাত্র ত্রিশটা কোষা নিয়ে কার্ভালো শ্রীপুরে কেদার রায়ের রাজধানীতে আশ্রয় নেন৷ বিচিত্র ব্যাপার বাঙালির নিজের দেশ, বাংলাদেশ৷ তা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে বিদেশি পাঠান মোগল৷ লুঠপাট চালাচ্ছে পর্তুগিজ বোম্বেটে আর হিংস্র মগদস্যুরা৷ সেদিন বাংলাদেশে যাঁরা রুখে দাঁড়ালেন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের মধ্যে প্রধান তিনজন ছিলেন ইশা খাঁ, প্রতাপাদিত্য ও কেদার রায়-তিন বীর ভুঁইয়া৷ এরা যদি একসঙ্গে লড়তে পারতেন তবে মোগলকে হটে যেতে হত৷ তা হল না৷
শ্রীপুরে এসেছিলেন ঈশা খাঁ৷ উদ্দেশ্য কেমনভাবে মোগলকে বাংলাদেশ থেকে তাড়ানো যায় তারই পরিকল্পনা করা৷ সেদিন ভোর রাতে ত্রিশ দাঁড়ের ছিপ একটা কালীগঙ্গা হয়ে পদ্মায় পড়ল৷ গাদাবন্দুক হাতে সারারাত ছিপের উপর পাহারায় রইলেন ঈশা খাঁ৷ চোখ জ্বলছিল তাঁর সুন্দরবনের হিংস্র বাঘের মতো৷
পরদিন কেদার রায়ের শ্রীপুর দুর্গে শোকের ছায়া নেমে এল৷ কেদার রায়ের দাদা চাঁদ রায়ের বিধবা কন্যা সোনামণি দুর্গে নেই৷ অপূর্ব রূপবতী এই কন্যাকে ঈশা খাঁ চুরি করে নিয়ে গেছে৷ ব্যক্তিগত লোভের কাছে বাঙালির একতা চুরমার হয়ে গেল৷ জানা গেল শ্রীমন্ত নামে কেদার রায়ের এক কর্মচারী সোনামণিকে মিথ্যা কথায় ভুলিয়ে ঈশা খাঁর ছিপে তুলে দিয়েছে৷ অবশ্য তার জন্য প্রচুর পুরস্কারও পেয়েছে৷ লজ্জায় অপমানে চাঁদ রায় শয্যা নিলেন৷ মারাও গেলেন৷ কেদার রায় তরবারি ছুঁয়ে শপথ নিলেন, এর শোধ নেবেন৷ আর তার আগে দরকার শ্রীমন্তের মাথা৷ কিন্তু কোথায় শ্রীমন্ত? সে তখন রাজমহলের পথে৷ লক্ষ্য মানসিংহের শিবির৷
কেদার রায় রণতরি সাজালেন৷ খিজিরপুরের ঈশা খাঁকে সপরিবারে ধ্বংস করতে বললেন৷ দুই বীর ভুঁইয়ার আত্মঘাতী কলহে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে গেল৷ কেদার রায়ের বছরের পর বছর আক্রমণে ঈশা খাঁর সৈন্যক্ষয় হল প্রচুর৷ মোগল সেনাপতি মানসিংহ এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন৷ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঈশা খাঁর উপর৷ ঈশা খাঁ চূর্ণ হল৷ তাঁর মৃত্যুর পর মগদস্যুরা আক্রমণ করল সোনারগাঁ৷ প্রতিরোধ করবার মানুষ নেই৷ বেগম সোনামণি আগুনে পুড়ে মরে ইজ্জত রক্ষা করলেন৷ কেদার রায়ের কাছে পৌঁছোল সে খবর৷ ক্রোধের সঙ্গে শোক মিলল৷ মগস্যুদের শায়েস্তা করতে সন্দ্বীপ দখলের জন্য কার্ভালোকে পাঠালেন৷ কার্ভালো জয়ী হলেন৷ রাজমহল থেকে মানসিংহ এ খবর পেলেন৷ দেখলেন কেদার রায়কে আর শক্তি বৃদ্ধি করতে দেওয়া ঠিক হবে না৷ নৌসেনাপতি মন্দা রায়ের নেতৃত্বে এক বিশাল নৌবহর পদ্মানদীর পথে বিক্রমপুরের দিকে যাত্রা করল৷ শ্রীপুর দুর্গে এ খবর পৌঁছোল৷ কেদার রায় গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন মোগল সেনা আসছে দেশ দখল করতে৷ যারা দেশকে ভালোবাসে- দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, তারা যেন তার সৈন্য দলে যোগ দেয়৷ এ আহ্বান মিথ্যা হয়নি৷ দলে দলে বাঙালি তরুণেরা কেদার রায়ের সেনাদলে যোগ দেয়৷ বিশাল এক নৌবহর তৈরি হয় মোগল নৌবহরের সঙ্গে লড়তে৷ নৌসেনাধ্যক্ষ হন মধু রায় আর তাঁর অধীনে কার্ভালো নৌবহর পরিচালনার ভার পান৷
শ্রীপুরের পথে কালীগঙ্গার বুকে মোগল নৌবহর আর বাঙালি নৌবহর মুখোমুখি হয়৷ আকাশে তখন ঝড়ের কালো মেঘ, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ এমনি সময় কার্ভালোর কামান গর্জন করে উঠল-গুড়ুম গুম৷ মোগল কোষা থেকে চিৎকার ওঠে আল্লাহো আকবর৷ আগুনের গোলা ছিটকে এসে পড়ে মধু রায়ের ঘুরাবে৷ ‘জয় মা কালী’ বলে বাঙালি গোলন্দাজ কামানোর পলতেতে আগুন লাগায়৷ গোলার শব্দে কেঁপে ওঠে কালীগঙ্গার জল৷ কার্ভালোর ভয়ংকর আক্রমণে মোগল কোষাগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়৷ হঠাৎ একটা গোলা এসে লাগে মোগল সেনাপতি মন্দা রায়ের বুকে৷ জাহাজ থেকে ঠিকরে পড়েন তিনি-কালীগঙ্গার স্রোতে৷ তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷ ভয় পেয়ে মোগল নৌবাহিনী পালিয়ে যায়৷ হঠাৎ একটা তির এসে লাগে কার্ভালোর হাতে৷ রক্তে ভিজে যায় জামা৷ আহত স্থানে কাপড়ের পটি বেঁধে গাদা বন্দুক তুলে গুলি মেরে মোগল সেনা নিপাত করতে থাকেন৷ কেদার রায় জয়ী হন৷ বাংলার ইতিহাস এতবড়ো নৌযুদ্ধের কাহিনি বেঁচে আছে৷
রাজমহলে খবর পৌঁছোল মোগল সৈন্যের হার হয়েছে ভয়ানকভাবে৷ ক্রুদ্ধ মানসিংহ মোগলের নিমকের মর্যাদা রাখতে স্বাধীনতা সংগ্রামী স্বদেশবাসীদের বিরুদ্ধে লড়তে বিশাল বাহিনী নিয়ে যাত্রা করলেন৷ শ্রীপুর দুর্গের কাছে তাঁবু ফেলে দূত পাঠিয়ে কেদার রায়ের কাছে জানালেন, কেদার রায় মোগলের বশ্যতা স্বীকার করলে সন্ধি করে ফিরে যাবেন৷ চিঠিতে দম্ভ ভরে জানালেন তিনি ‘সিংহ’, আত্মসমর্পন করলে ক্ষমা করতে তিনি জানেন৷ কেদার রায় ঘৃণাভরে সে পত্র ছিঁড়ে ফেলে জানালেন-সিংহ পাহাড়ের চূড়ায় গুহায় থাকলেও পশুমাত্র, জঙ্গলের জন্তু-মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী৷ শুনে মানসিংহ রেগে আগুন হলেন৷ আক্রমণ করলেন শ্রীপুর দুর্গ৷ নয় দিন একটানা যুদ্ধ চলল৷ বাঙালি সৈন্যদের বর্শা আর তিরের ঘায় মোগল সৈন্য কত যে মারা পড়ল তার হিসাব নেই৷ মানসিংহের চোখের ঘুম আর আহারে রুচি ঘুচে গেল৷ মাঝরাতে ডেকে পাঠালেন শ্রীমন্তকে-কেদার রায়ের বিশ্বাসঘাতক কর্মচারী৷ রাজমহল থেকে মানসিংহের সঙ্গেই এসেছে সেই ঘৃণ্যজীব৷ নকশা এঁকে বাতলে দিয়েছে-শ্রীপুর আসার সহজ পথ৷ মানসিংহকে শ্রীমন্ত জানাল-হাতে অস্ত্র থাকতে কেদার রায়কে বন্দি করা অসম্ভব৷ তাই একটা কৌশল প্রয়োজন৷ তিনি যখন দেবী ভগবতীর মন্দিরে পূজা করেন তখন অস্ত্র থাকে না তাঁর হাতে-সেই সুযোগ৷ মানসিংহ বুঝলেন-ইঙ্গিত৷ অর্থ দিয়ে গুপ্তঘাতক নিযুক্ত করলেন৷
খুব ভোরে ইষ্ট দেবীর মন্দিরে পূজা করছিলেন কেদার রায়৷ সুড়ঙ্গ পথে মন্দিরে ঢুকে লুকিয়ে ছিল গুপ্তঘাতক৷ সুযোগ বুঝে ধারালো খাঁড়ার আঘাতে কেদার রায়ের মাথা কেটে ফেলে৷
অনেকে বলেন এ গল্প সত্য নয়-যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁর প্রাণ যায়৷ মানসিংহ শ্রীপুর ধ্বংস করে-কেদার রায়ের ইষ্ট দেবীর কষ্টি পাথরের সুন্দর বিগ্রহটি অম্বরে নিয়ে যান৷