ভীষণ ভিড়ের মধ্যে – তারাপদ রায়
এ জন্মের মতো কলকাতার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। আবার কবে ফিরব, ফিরলেও জোড়াতালি দেওয়া ছুটিছাটায়। অনেক বিরক্তি অনেক ভালোবাসা; সেই চৌদ্দ বছর বয়সে ফরিদপুরের থেকে, তারপর একটানা এই গত পনেরো বছর। আজই শেষ দিন, জয়ন্তী বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল।
এখনই উঠতে হবে। কত কিছু গোছানো বাকি আছে। কত টুকিটাকি, এক জায়গা থেকে সংসার বদল করে আরেক জায়গায় চলে যাওয়া। ভাঙা কড়াই থেকে, বছরের তিন মাস বাকি, দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার কি ফেলে যাওয়া যায়, অথচ সব টেনে নেওয়াও সম্ভব নয়।
সকাল সাড়ে সাতটা প্রায় বাজে। পাশে সুকোমল এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। এই মুহূর্তে সুকোমলের ওপর একটু রাগ হল জয়ন্তীর, বেশ ছিলাম, কি দরকার ছিল বৌরকেল্লায় ভাল চাকরির। কলকাতার আড়াইশো টাকাতেই যেভাবেই হোক চলে যাচ্ছিল, কি হবে অতদূরে কিছু বেশি টাকায়? জয়ন্তীর উনত্রিশ বছরের জীবনের অর্ধেক কলকাতায় কেটেছে, সেই ভিক্টোরিয়া স্কুল কলেজ, বেলগাছিয়ায় সেই এবড়ো-খেবড়ো গলির মধ্যে তার বাপের বাড়ি পাড়ার বান্ধবীরা, আর কোনওদিন কি তাদের সঙ্গে দেখা হবে? বড় বেশি মমতা বোধ হতে লাগল জয়ন্তীর।
‘এই ওঠো, তাড়াতাড়ি ওঠো, কত কাজ বাকি রয়েছে’, উঠবে না জেনেও সুকোমলকে একটা ধাক্কা দিয়ে জয়ন্তী বিছানা ছেড়ে চলে গেল। সুকোমল পাশ ফিরতে গিয়ে চোখ বুজেই একটা হাত বাড়াল কিন্তু ততক্ষণে জয়ন্তী নাগালের বাইরে।
সন্ধ্যার দিকে ট্রেন ছাড়বে। ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে হাওড়া অবশ্য খুব দূর নয়, তবু আজ শনিবার, বিকেলের দিকে ট্যাক্সি পাওয়া খুব ঝকমারি হবে। আজ কয়দিন ধরেই যথাসম্ভব গোছগাছ করা হচ্ছে। দুজনের সংসারে আছেই বা কি?
সুকোমল যতক্ষণ ইচ্ছে শুয়ে থাকুক, জয়ন্তী প্রথমে টুকিটাকি জিনিসগুলি গুছিয়ে নিতে লাগল। রান্নার বাসনকোসন সব কাল লোক দিয়ে ধুয়ে মেজে রেখেছে, আজ দুপুরে ওরা একটা হোটেলে খেয়ে নেবে ভেবেছিল, কিন্তু জয়ন্তীর বাবা কাল এসেছিলেন, আজ যাওয়ার দিন বেলগাছিয়া থেকেই দুপুরে খেয়ে নিতে হবে, একটু দৌড়োদৌড়ি হবে শেষ মুহূর্তে, তবু সুকোমল আপত্তি করতে পারেনি।
কাল একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ কিনে এনেছে সুকোমল। তাতেই ঘটি, বাটি, শিল, নোড়া খুচরো জিনিসগুলো এক এক করে তুলে ফেলল জয়ন্তী। এবার বড় ট্রাঙ্কটা গোছাতে হবে। ট্রাঙ্কটায় অনেকদিন হাত দেওয়া হয়নি। বিয়ের ট্রাঙ্ক, বিয়ের পরে একবার গুছিয়েছিল, তারপর এরকমই চলে আসছে। সব জিনিসপত্রগুলো একে একে নামিয়ে ফেলল। বিয়ের সময় পাওয়া কিছু কিছু উপহার এখনও এই বাক্সটায় রয়ে গেছে, বছর তিনেক আগেকার এক মাঘনিশীথের কিছু মধুর স্মৃতি। সেই রাত্রির হিমেল হাওয়াও যেন এই বাক্সের মধ্যে কোথায় ছিল, জয়ন্তী তার শরীরে সেই শিহরন অনুভব করল।
বাক্সটার সবচেয়ে নীচে একটা খবরের কাগজ পাতা, সেই সময়কার কাগজ, তিন বছরে একটু হলুদ হয়ে গেছে, বাক্সের রঙের সঙ্গে চটচটে হয়ে আঠার মতো কিছুটা আটকে গেছে। টেনে তুলতে গিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে বাক্সটার গায়ে লেগে রইল। এক টুকরো কাপড় জল দিয়ে ভিজিয়ে ঘষে তুলে ফেলতে হবে।
এখন সুকোমল বিছানা থেকে উঠল। চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে জয়ন্তীর সামনে এসে দাঁড়াল—
‘কি এখনও সব হল না? তুমি কোনও কাজের না।’ এই অহেতুক মন্তব্য করে সুকোমল বাথরুমের দিকে চলে গেল।
জয়ন্তীর খুব রাগ হল, কোনও কাজ করবেনা, বেলা নটায় ঘুম থেকে উঠে এই মাতব্বরি; ঠিক আছে, দেখাই যাক। দেয়ালে ঠেস দিয়ে ক্লান্তভাবে জয়ন্তী মাথা হেলিয়ে দিলে। সকাল থেকে বড় বেশি পরিশ্রম গেছে, আর এতই বা তাড়া কি আমার। যার গরজ সেই তাড়াতাড়ি করুক। জয়ন্তী একা ভাবতে লাগল।
সামনে থেকে তিন বছর আগের পুরনো ছেঁড়া খবরের কাগজের পাতাটা তুলে নিল জয়ন্তী। ৭ই ফাল্গন, রবিবার ১৩৬৭ সালের পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠার ছোটখাটো সংবাদ। তিন বছর সময়ে পৃথিবীটা একটুও পাল্টায়নি, সেই একই সব সংবাদ, ‘মসজিদ হইতে পতনের ফলে বালকের মৃত্যু’ ‘বিধবা মারাত্মকভাবে আহত—দুইজন আততায়ীর কারাদণ্ড’, ‘কারামন্ত্রী কর্তৃক শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের উদ্বোধন’ ইত্যাদি।
হঠাৎ এক জায়গায় এসে জয়ন্তীর চোখটা আটকে গেল। সামান্য সংবাদ, চোখে পড়ার মতো নয়। তিন বছর আগে চোখ পড়েনি, পড়লেও অন্তত মনে রাখেনি। কিন্তু এখন খবরটায় চোখ পড়তেই এই স্পষ্ট দিনের বেলায় তার ঘরে বসে জয়ন্তীর শরীর কেমন ছমছম করে উঠল, বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল, কয়েক বিন্দু ঘাম দেখা দিল কপালে।
ঘটনাটা তাহলে বেরিয়েছিল কাগজে, জয়ন্তীর চোখের সামনেই ঘটেছিল, সব মিলে যাচ্ছে, সেই শনিবার রাত্রি নয়টা হাতিবাগান বাজারের সামনে গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে তাহলে, তাহলে সেদিন ট্রামে এই লোকটাই চাপা পড়েছিল। সব কেমন গোলমাল বোধ হচ্ছে জয়ন্তীর, মাথাটা একটু ঘুরছে, দেয়ালগুলো গোল হয়ে যাচ্ছে, একি এতগুলো ইলেকট্রিক বালব তো তাদের ঘরে ছিল না, কটা ইলেকট্রিক বালব দুলছে—একটা দুটো..পাঁচটা, সাতটা…।
বিয়ের পর নিয়মিত প্রত্যেক শনিবার বিকেলে জয়ন্তী বেলগাছিয়ায় তার বাপের বাড়িতে গেছে। কিন্তু প্রথম-প্রথম কয়েক সপ্তাহ সুকোমলও তার সঙ্গেই গেছে। কিন্তু তার পরে আর বিশেষ কোনও ব্যাপার না হলে যায়নি। তার চেয়ে ঘরে বসে বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলাতেই বেশি আগ্রহ তার। আর কতটুকুই বা পথ, বেলগাছিয়া থেকে ওয়েলিংটন, সোজা এক ট্রামে জয়ন্তী চলে আসতে পারে।
সেই প্রথমদিকে, সে বছরই ফাঙ্গুন মাসে ওই ফাল্গুনের গোড়াতেই হবে হাতিবাগান বাজারের সামনে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, জয়ন্তী এখনও মনে করতে পারে। বেলগাছিয়া থেকে ট্রামে উঠে ওরা দুজনে মিলে সবচেয়ে সামনে ডাইনের দিকের সিটটায় বসেছিল। জয়ন্তী লেডিস সিটে বসেনি, কখন সিট ছাড়তে হয় সুকোমল এই ভয়ে কখনওই জয়ন্তীর পাশে লেডিস সিটে বসে না। মাঘ শেষ হয়ে গেলেও তখনও হিমভাবটা রয়ে গেছে। বিশেষ করে সেদিন যেন একটু বেশি ঠাণ্ডাই, উত্তরের হাওয়া দিচ্ছিল। সন্ধ্যার শো সবে ভেঙেছে, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের দুই পাশের সিনেমা হলগুলো থেকে ক্রমাগত লোক বেরিয়ে আসছে। রাস্তায় বেশ ভিড়, দোকানপাট আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাত্রির শোতেও কয়েকটা হল হাউস ফুল যাচ্ছে, জানালার পাশে বসে জয়ন্তী সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ট্রামটা ঢিমে তেতালা চলেছে, স্কার্ফের কোণাটা জয়ন্তী একটু গলার কাছে টেনে নিল, একটু শীত-শীত করছে।
এই সময় জয়ন্তী লোকটাকে দেখল, অল্প আলোয় লোকটা গ্রে স্ট্রিটের দিক থেকে হাতিবাগান বাজারের দিকে আসছে, রাস্তা পার হওয়ার জন্যে একটু থমকে দাঁড়াল। জয়ন্তীদের ট্রামটা তখন ওই স্টপে দাঁড়িয়েছে, ট্রামটা ছাড়বে কি না, সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাবে কিনা লোকটা বোধহয় একটু ভাবল। হঠাৎ জয়ন্তীর চোখে চোখ পড়ল লোকটার। যুবকই বলা উচিত, পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের বেশি হবে না, জয়ন্তীর সমবয়সীই হবে, গায়ে একটা নীল রঙের বুশসার্ট, হাতা আটকানো, ফুলপ্যান্টটা সাদা। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে জয়ন্তীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকাল, কেমন যেন চেনা চেনা, কলেজে একসঙ্গে পড়েছি, নাকি বেলগাছিয়ায় সেই গলির মোড়ের হলুদ বাড়িটার দোতলায় থাকত, নাকি সেই ফরিদপুরের আমলাপাড়ার ছোটবেলার কোনও সঙ্গী? জয়ন্তী ঠিক করতে পারল না, লোকটাও কেমন বিমূঢ়ের মতো অর্থহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।
জয়ন্তীর ট্রামটা ছেড়ে দিল। এমন সময় ‘গেলো, গেলো, এই, এই, রোককে, ট্রাম বেঁধে’ রাস্তাসুদ্ধ লোক একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। লোকটার পিছন দিক দিয়ে গ্রে স্ট্রিটের একটা ট্রাম খুব দ্রুতগতিতে বাঁক নিয়ে এসেছে—জয়ন্তী মাথা ঘুরিয়ে শুধু এইটুকু দেখতে পেল। জয়ন্তীদের ট্রামটা তখন এক স্টপ চলে এসেছে, পিছনেও হইচই আর শোনা যাচ্ছে না। সুকোমল বলল, ‘আরেকটা অ্যাকসিডেন্ট হল। দৈনিক কত লোক যে ট্রাম বাস চাপা পড়ে মরছে!’
ট্রামসুদ্ধ লোক একসঙ্গে দুর্ঘটনা, তার কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে আলোচনা করতে লাগল। একাধিক ভয়াবহ দুর্ঘটনার অত্যুৎসাহী প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণদাতাও সঙ্গে ছিলেন।
চোখের সামনে দুর্ঘটনা ঘটা, ঘটতে দেখা কলকাতা শহরে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, দেখে, ভুলে যায়। তারপর আবার ঘটে, আবার ভুলে যায়। জয়ন্তীও ভুলে যেত এবং যে কোনও কারণেই হোক, পরের দিন সাতই ফাল্গন, রবিবার এই ছোট সংবাদটা জয়ন্তীর চোখে পড়েনি। তা হলে কি হত বলা যায় না, কিন্তু পরের শনিবারদিন রাত্রিতে ফিরবার সময় ট্রামে লোকটাকে আবার দেখেছিল জয়ন্তী। সেই নীল বুশ সার্ট, সাদা প্যান্ট, সেই লোকটাই হাতিবাগানের সেই স্টপটা এসে তাদের ট্রামেই উঠল। জয়ন্তী দেখে আশ্বস্ত হয়েছিল। যাক, তাহলে লোকটা কাটা পড়েনি। লোকটা কিন্তু সেদিনও একদৃষ্টিতে জয়ন্তীর দিকে তাকিয়েছিল, জয়ন্তীর কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, সেদিনও সুকোমল সঙ্গে ছিল। লোকটা সুকোমলের পাশে এসে দাঁড়াল। জয়ন্তী বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল, একবারও মাথা ঘোরাল না। কলেজ স্ট্রিটের কাছে এসে একটু ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, লোকটা নেই, কখন নেমে গেছে।
এরপরে, প্রায় প্রত্যেক শনিবারই একই সময়ে, একই জায়গা থেকে লোকটাকে ট্রামে উঠতে দেখেছে জয়ন্তী। কখনও জয়ন্তী একা ফিরেছে, কখনও সুকোমল কিংবা আর কারও সঙ্গে। দু’ এক শনিবার হয়তো দেখতেও পায়নি, কিন্তু সেও হয়তো জয়ন্তী নিজেই লক্ষ করেনি বলে। সেই একই পোশাক, নীল শার্ট, সাদা প্যান্ট, সেই একই দৃষ্টিতে জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
কখনও জয়ন্তী বিরক্তি, খুব বিরক্তি বোধ করছে, কখনও কৌতূহল। কে লোকটা? হয়তো এখানেই কোথাও থাকে। প্রত্যেকদিন এই সময় বাড়ি ফেরে, হয়তো আগে চিনত, একদিন জয়ন্তী ঠিক করেছিল, লোকটা কি চায় প্রশ্ন করে জানতে হবে, কিন্তু করা হয়নি। কতরকমের পেশা আছে, লোকটা গোয়েন্দা বিভাগের কেউ হতে পারে, এইটুকু পথ ট্রামেই ওর ডিউটি, পকেটমার হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়। কত ভদ্র চেহারার লোক পকেট মারে, নাকি লম্পট? ধীরে ধীরে সে এসব কথা ভাবা ছেড়ে দিয়েছিল। প্রত্যেক শনিবার রাত নটার ট্রামে লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়া নৈমিত্তিক হয়ে গিয়েছিল জয়ন্তীর কাছে।
গত শনিবারেই একটা ঘটনা ঘটল। জয়ন্তীর পাশে লেডিস সিটটা খালি ছিল, ট্রামে খুব ভিড়, পুজোর বাজার, সিনেমা ফেরত অসংখ্য লোক গিজগিজ করছে। জয়ন্তী হঠাৎ দেখল তার পাশের সিটে সেই লোকটা বসে৷ জয়ন্তী জানালার কাছ ঘেঁষে একটু সরে বসল। এমন সময় কন্ডাক্টর এসে টিকিট চাইতে, জয়ন্তী নিজের টিকিট কাটল। লোকটাকে টিকিটের কথা বলতে ঘাড়টা একটু নাড়ল। কন্ডাক্টরের বোধহয় তার দিকে তাকিয়ে কি একটা সন্দেহ হল, বলল, ‘দেখি টিকিট!’
লোকটা খুব আলগোছে পকেট থেকে একটা মান্থলি বার করল।
কন্ডাক্টর এবারেও বলল, ‘দেখি।’
এই সময় আর একজন মহিলা চলে আসায় লোকটাকে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হল। ট্রামে ভিড় আরও বেড়েছে।
জয়ন্তী শুনতে পেল কন্ডাক্টর বলছে, ‘আপনার নাম অমর চক্রবর্তী?’
লোকটা কি বলল। জয়ন্তী শুনতে পেল না। কন্ডাক্টরের কর্কশ গলা শুনতে পেল, ‘একষট্টি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মান্থলি নিয়ে ঘুরছেন—দাঁড়ান, ও মশায় শুনুন, এই ধরুন, ধরুন মশায়, জোচ্চোর।’
‘কি ব্যাপার, কি ব্যাপার?’ সবাই মিলে কৌতূহলী হয়ে উঠল। ট্রামটা একটা স্টপে দাঁড়িয়েছিল, ভিড়ের মধ্যে সকলের হাত ছাড়িয়ে কি করে লোকটা যেন কোথায় উবে গেল।
জয়ন্তী চোখ খুলতে দেখল, সামনে সুকোমল দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুরনো খবরের কাগজটা তখনও হাতে ধরা, দু বছর আট মাস আগের বাসি খবরটা চোখের সামনে কাঁপছে।
‘গত শনিবার রাত্রি নয়টায় গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে অমর চক্রবর্তী নামক জনৈক ব্যক্তি ট্রামে চাপা পড়িয়া নিহত হইয়াছে। ট্রামের ড্রাইভার…’
সুকোমলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তার সংবিৎ ফিরল।
‘কি, খুব টায়ার্ড? এক কাপ চা দাও, আমি সব গোছগাছ করে দেব।’
সুকোমলকে কিছু বললে, সুকোমল শুনলে নিশ্চয় হাসবে, ভাবতে ভাবতে চা করতে গেল জয়ন্তী।
বাংলা দেশ শেষ হয়ে গিয়েছে, এখন উড়িষ্যার জমি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। চারদিকে অন্ধকার কেটে উর্ধ্বশ্বাস এক্সপ্রেস ট্রেন চলেছে, দূরে দূরে ছায়াছন্ন গ্রামসীমায় কখনও দু একটা স্তিমিত প্রদীপ শিখা। কামরায় বিদ্যুৎ বাতিটাও কেমন অনুজ্জ্বল, পাশে বসে সুকোমল একটা ইংরেজি ডিটেকটিভ বই পড়ছে। জয়ন্তী বাইরের দিকে তাকিয়ে। কলকাতার বাইরে রাত এত তাড়াতাড়ি ঘন হয়, জয়ন্তী কবজিটা উল্টিয়ে একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল, নটা প্রায় বাজে।
সহসা জয়ন্তীর কি মনে হল, কি একটা অজানা আতঙ্কে শরীর শিউরে উঠল। হাতিবাগান বাজারের সামনে ভীষণ ভিড়ের মধ্যে ট্রাম স্টপে সেই নীল বুশ শার্ট, সাদা ফুল প্যান্ট সেই লোকটা অমর চক্রবর্তী এখন কি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার অপেক্ষায় এক দৃষ্টিতে। ট্রামগুলো একের পর এক খানাতল্লাসি করছে। তারপর, জয়ন্তী ভাবতে পারে না, কে অমর চক্রবর্তী, জীবিত হোক, মৃত হোক, তার সঙ্গে কি প্রয়োজন।
সামনে বোধহয় একটা বড় স্টেশন আছে, গাড়ির গতিটা ধীর হয়ে এল। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি লোক, চেঁচামেচি, কুলি হাঁকাহাঁকি, ভেন্ডারের ব্যস্ততা। হঠাৎ জানালা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই জয়ন্তীর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। প্ল্যাটফর্মের একটা থামের পাশে অনেক লোকের সঙ্গে আবছা আলোয় একটা নীল জামা দুটো স্থির চোখের দৃষ্টি এই দিকে—
জয়ন্তী চোখ বুজে একটা অস্পষ্ট কাতর চিৎকার করে উঠল।
‘কি হল?’ সুকোমল বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
‘একটা নীল জামা পরা লোক এইদিকে—’ জয়ন্তী আঙুল দিয়ে দেখাল। সুকোমল একটু তাকাল, তারপর বলল, “তাতে কি হল, ভূত দেখলে নাকি? নীল জামা, দেখছ না, রেলের পোশাক, লোকটা রেলের কোনও ফায়ারম্যান-টায়ারম্যান হবে বোধহয়।’
৩ নভেম্বর ১৯৬৩