ভীরু

ম্যাট্রিকুলেশনে পড়ে
               ব্যঙ্গসুচতুর
           বটেকৃষ্ট, ভীরু ছেলেদের বিভীষিকা।
               একদিন কী কারণে
সুনীতকে দিয়েছিল উপাধি “পরমহংস’ ব’লে।
        ক্রমে সেটা হল “পাতিহাঁস’।
               শেষকালে হল “হাঁসখালি’–
        কোনো তার অর্থ নেই, সেই তার খোঁচা।
 
আঘাতকে ডেকে আনে
    যে নিরীহ আঘাতকে করে ভয়।
        নিষ্ঠুরের দল বাড়ে,
           ছোঁয়াচ লাগায় অট্টহাসে।
        ব্যঙ্গরসিকের যত অংশ-অবতার
           নিষ্কাম বিদ্রূপসূচি বিঁধে
        অহৈতুক বিদ্বেষেতে সুনীতকে করে জরজর।
 
        একদিন মুক্তি পেল সে বেচারা,
           বেরোল ইস্কুল থেকে।
        তার পরে গেল বহুদিন–
    তবু যেন নাড়ীতে জড়িয়ে ছিল
           সেদিনের সশঙ্ক সংকোচ।
    জীবনে অন্যায় যত, হাস্যবক্র যত নির্দয়তা,
           তারি কেন্দ্রস্থলে
    বটেকৃষ্ট রেখে গেছে কালো স্থূল বিগ্রহ আপন।
 
সে কথা জানত বটু,
    সুনীতের এই অন্ধ ভয়টাকে
        মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে পেত সুখ
           হিংস্র ক্ষমতার অহংকারে;
        ডেকে যেত সেই পুরাতন নামে,
           হেসে যেত খলখল হাসি।
 
বি. এল. পরীক্ষা দিয়ে
        সুনীত ধরেছে ওকালতি,
           ওকালতি ধরল না তাকে।
        কাজের অভাব ছিল, সময়ের অভাব ছিল না–
           গান গেয়ে সেতার বাজিয়ে
               ছুটি ভরে যেত।
           নিয়ামৎ ওস্তাদের কাছে
               হ’ত তার সুরের সাধনা।
 
ছোটো বোন সুধা,
        ডায়োসিসনের বি. এ.
গণিতে সে এম. এ. দিবে এই তার পণ।
               দেহ তার ছিপ্‌ছিপে,
                   চলা তার চটুল চকিত,
                       চশমার নীচে
               চোখে তার ঝলমল কৌতুকের ছটা–
                       দেহমন
           কূলে কূলে ভরা তার হাসিতে খুশিতে।
তারি এক ভক্ত সখী নাম উমারানী–
           শান্ত কণ্ঠস্বর,
        চোখে স্নিগ্ধ কালো ছায়া,
দুটি দুটি সরু চুড়ি সুকুমার দুটি তার হাতে।
           পাঠ্য ছিল ফিলজফি,
        সে কথা জানাতে তার বিষম সংকোচ।
 
    দাদার গোপন কথাখানা
        সুধার ছিল না অগোচর।
           চেপে রেখেছিল হাসি,
        পাছে হাসি তীব্র হয়ে বাজে তার মনে।
                   রবিবার
           চা খেতে বন্ধুকে ডেকেছিল।
               সেদিন বিষম বৃষ্টি,
                   রাস্তা গলি ভেসে যায় জলে,
           একা জানালার পাশে সুনীত সেতারে
    আলাপ করেছে শুরু সুরট-মল্লার।
               মন জানে
        উমা আছে পাশের ঘরেই।
               সেই-যে নিবিড় জানাটুকু
বুকের স্পন্দনে মিলে সেতারের তারে তারে কাঁপে।
 
হঠাৎ দাদার ঘরে ঢুকে
সেতারটা কেড়ে নিয়ে বলে সুধা,
    “উমার বিশেষ অনুরোধ
        গান শোনাতেই হবে,
           নইলে সে ছাড়ে না কিছুতে।’
    লজ্জায় সখীর মুখ রাঙা,
           এ মিথ্যা কথার
        কী করে যে প্রতিবাদ করা যায়
               ভেবে সে পেল না।
 
সন্ধ্যার আগেই
    অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে;
        থেকে থেকে বাদল বাতাসে
           দরজাটা ব্যস্ত হয়ে ওঠে,
    বৃষ্টির ঝাপ্‌টা লাগে কাঁচের সাশিতে;
        বারান্দার টব থেকে মৃদুগন্ধ দেয় জুঁইফুল;
           হাঁটুজল জমেছে রাস্তায়,
               তারি ‘পর দিয়ে
        মাঝে মাঝে ছলো ছলো শব্দে চলে গাড়ি।
    দীপালোকহীন ঘরে
সেতারের ঝংকারের সাথে
        সুনীত ধরেছে গান
           নটমল্লারের সুরে–
          আওয়ে পিয়রওয়া,
               রিমিঝিমি বরখন লাগে!
           সুরের সুরেন্দ্রলোকে মন গেছে চলে,
    নিখিলের সব ভাষা মিলে গেছে অখণ্ড সংগীতে।
               অন্তহীন কালসরোবরে
                   মাধুরীর শতদল–
        তার ‘পরে যে রয়েছে একা বসে
           চেনা যেন তবু সে অচেনা।
 
    সন্ধ্যা হল
        বৃষ্টি থেমে গেছে;
           জ্বলেছে পথের বাতি।
    পাশের বাড়িতে
           কোন্‌ ছেলে দুলে দুলে
    চেঁচিয়ে ধরেছে তার পরীক্ষার পড়া।
 
           এমন সময় সিঁড়ি থেকে
        অট্টহাস্যে এল হাঁক,
“কোথা ওরে, কোথা গেল হাঁসখালি!’
মাংসলপৃথুলদেহ বটেকৃষ্ট স্ফীতরক্তচোখ
    ঘরে এসে দেখে
সুনীত দাঁড়িয়ে দ্বারে নিঃসংকোচ স্তব্ধ ঘৃণা নিয়ে
    স্থূল বিদ্রূপের ঊর্ধ্বে
           ইন্দ্রের উদ্যত বজ্র যেন।
জোর করে হেসে উঠে
    কী কথা বলতে গেল বটু,
        সুনীত হাঁকল “চুপ’–
অকস্মাৎ বিদলিত ভেকের ডাকের মতো
           হাসি গেল থেমে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *