পাণ্ডু ও কুন্তির দ্বিতীয় পুত্র। দ্রুপদ-রাজের কন্যা কৃষ্ণা বা দ্রৌপদী (যিনি পঞ্চপাণ্ডবের সবারই ভার্যা ছিলেন) ছাড়াও ভীমের আরও দুই ভার্যা ছিলেন – কাশীরাজদুহিতা বলন্ধরা ও শল্যের ভগিনী কালী। ওঁর চার পুত্র – সুতসোম (দ্রৌপদীর গর্ভজাত) সর্বগ (বলন্ধরার গর্ভজাত) সর্বগত (কালীর গর্ভজাত) ও ঘটোৎকচ। ঘটোৎকচ রাক্ষসী হিড়িম্বার পুত্র। পুত্রের জন্মের পরেই হিড়িম্বাকে ভীম ত্যাগ করেন। কিন্দম মুনির অভিশাপ ছিল যে, মৈথুনকালে পাণ্ডুর মৃত্যু হবে – সেইজন্য পাণ্ডু স্ত্রীদের মিলিত হতেন না। পুত্র কামনায় তিনি বার বার কুন্তিকে অনুরোধ করেন ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্য। দুর্বাসা মুনির বরে কুন্তি যে-কোনও দেবতাকে আহবান করে তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারতেন। সেই বরের বিষয়ে পাণ্ডুকে জানাতে তিনি প্রথমে ধর্মকে, পরে বায়ু ও ইন্দ্রকে আহবান করতে অনুরোধ করলেন। বায়ুদেবের সেই পুত্রই হলেন ভীম। অসীম বলশালী ভীমকে কৌরবরা সবাই ভয় পেতেন। শৈশবকালে দুর্যোধন ভীমের খাদ্যে কালকূট বিষ মিশ্রিত করে তাঁকে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন। নাগালোকে গিয়ে বিষধর সর্পের দংশনে কালকূট ক্ষয়প্রাপ্ত হল। নাগরাজ বাসুকি ভীম তাঁর দৌহিত্রের (কুন্তিভোজ) দৌহিত্র জেনে – তাঁকে রসায়ন পান করতে দিয়ে আরও বলশালী করে দেন। ভীম দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। বলরামের কাছে শিক্ষা করেন অসিযুদ্ধ ও গদাযুদ্ধ। ভীমের বাহুবলের ওপর কুন্তি ও অন্যান্য পাণ্ডবরা নির্ভর করতেন। হিড়িম্ব, বক-রাক্ষস ও জটাসুর ভীমের হাতেই নিহত হন। পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে বিবাহ হলেও বিপদে আপদে দ্রৌপদী ভীমকেই স্মরণ করতেন। দ্যূতক্রীড়ায় পরজিত হবার পর দুর্যোধন দুঃশাসন ইত্যাদিরা যখন দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করছেন, তখন ভীম প্রতিজ্ঞা করেন দুঃশাসনের বুকের রক্ত পান করবেন এবং দুর্যোধনের উরু ভঙ্গ করবেন। ভীমের এই প্রতিজ্ঞা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বিশেষ ভয় পেয়েছিলেন। পাণ্ডবদের বনবাসের সময়ে জয়দ্রথ যখন দ্রৌপদীকে হরণ করতে যান, তখন ভীম তাঁকে চুল ধরে মাটিতে ফেলে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। বিরাটরাজের প্রাসাদে যখন পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী সহ অজ্ঞাতবাস করছেন, তখন বিরাট-মহিষী সুদেষ্ণার ভ্রাতা কীচক সৈরিন্ধ্রীর (দ্রৌপদীর ছদ্মনাম) প্রতি আকৃষ্ট হন। সৈরিন্ধ্রী তাঁর কুপ্রস্তাবে বাধা দিলে, কীচক চুল ধরে তাঁকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করেন। দ্রৌপদী ভীমকে ওঁর দুঃখের কথা জানাতেই, ভীম কীচককে বধ করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে একে একে দুর্যোধনের প্রতিটি সহোদর ভ্রাতাকে উনি বধ করেন। যুদ্ধের শেষে পুত্র, ভ্রাতা ও সুহৃদদের হারিয়ে পরাজিত দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে যখন আত্মগোপন করেছিলেন, তখন খবর পেয়ে ভ্রাতাদের সঙ্গে ভীম সেখানে এসে উপস্থিত হন। পাণ্ডবদের বাক্যবান সহ্য করতে না পেরে দুর্যোধন গদা হাতে বেরিয়ে এসে একে একে সবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন ভীম এগিয়ে আসায় দুজনের গদাযুদ্ধ শুরু হল। দুজনেই বলরামের সুযোগ্য শিষ্য ভীমের বাহুবল দুর্যোধনের থেকে বেশি, কিন্তু যুদ্ধ-কৌশলে দুর্যোধন ভীমের চেয়ে অভিজ্ঞ। ধর্মসঙ্গত যুদ্ধে ভীমের জয় অসম্ভব। গদাযুদ্ধে নাভির নিচে আক্রমণ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু দ্রৌপদীকে জন-সমক্ষে লাঞ্ছনা করার সময় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে নিজের বাম উরু প্রদর্শন করেছিলেন, আর সেই দেখে ভীম শপথ করেছিলেন যে তিনি ঐ উরু ভঙ্গ করে এর প্রতিশোধ নেবেন। সুযোগ পাওয়া মাত্র ভীম গদাঘাতে দুর্যোধনের দুই উরুই একসঙ্গে ভঙ্গ করে তাঁর সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। দুর্যোধনের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের আর সবাইকে ক্ষমা করলেও ভীমকে সহজে ক্ষমা করবেন না। তাই তিনি যখন ভীমকে আলিঙ্গন করতে চাইলেন, কৃষ্ণ তাঁকে লৌহনির্মিত ভীমের মূর্তি দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র সেই ভীমকে এত জোরে আলিঙ্গন করলেন যে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হল। গান্ধারীও দুঃখ করে ভীমকে বলেছিলেন যে, অল্প অপরাধী একটি পুত্রকেও কি ভীম জীবিত রাখতে পারতেন না। নিয়তির বিধানে সত্যপ্রিয় ন্যায়নিষ্ঠ বিকর্ণের মত গান্ধারী-পুত্রকেও ভীম বধ করেছিলেন। মহাপ্রস্থানের পথে মেরুপর্বতের নিকটে একে একে দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল ও অর্জুনের পতনের পর ভীম নিপাতিত হলেন। ভীমের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন যে, নিজের শক্তিমত্তা নিয়ে অহঙ্কার ও বহুভুকত্বের জন্য ভীমের পতন ঘটেছে।