ভীমে ডাকাতের বট

ভীমে ডাকাতের বট

এক

বড়োদিনের ছুটিতে আমাদের বিশেষ বন্ধু অসিতের দেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম৷

বিকালে শশা, নারিকেল, মুড়ি ও ফুলুরি প্রভৃতির থালা এবং চায়ের পেয়ালা টেবিলে সাজিয়ে নিয়ে বসে আমরা সবাই মিলে গল্প করছিলাম৷

অসিত বিনয় জানিয়ে বলল, ‘পাড়াগেঁয়ে লাইট রিফ্রেসমেন্ট হয়তো পেট ভরলেও তোমাদের মন ভরবে না৷ কিন্তু কী করব ভাই, এখানে পেলেটি কি ভীমনাগের কোনো আত্মীয় বাস করে না৷’

পরিতোষ টপ করে একখানা বড়ো কপির ফুলুরি মুখের গর্তে ফেলে দিয়ে বলল, ‘বহুত আচ্ছা! কলকাতায় যা পাওয়া যায়, পাড়াগাঁয়ে এসে আমরা তা চাই না! কিন্তু অসিত ভায়া, তুমি বোধ হয় ভুলে গিয়েছ যে, আমি দুনিয়ার আলো দেখেছি সেই পূর্ব বাংলায়, যেখানে কাঁচালঙ্কাকে মনে করা হয় মুড়ি ফুলুরির অলংকারের মতো৷ তুমি কাঁচালঙ্কাকে বয়কট করেছ কেন?’

প্রিয়নাথ বলল, ‘যেহেতু আমরা বাঙাল নই৷’

এবারে একখানা পেঁয়াজের বড়াকে চোখের নিমেষে উড়িয়ে দিয়ে পরিতোষ বলল, ‘তোমরা বাঙাল নও, কিন্তু তোমরা হচ্ছ বিখ্যাত ঘটিচোর৷ তাই লাল কাঁচালঙ্কা দেখলে লাল পাগড়ির কথা মনে করে ভয়ে তোমাদের বুক কাঁপে৷’

শ্রীপতি দুই হাত আন্দোলন করে বলল, ‘বাঙাল আর ঘটিচোর! তোমরা দুজনে ক্ষান্ত হও! অকারণে গৃহবিবাদে দরকার নেই৷ তার চেয়ে অসিতের মুখ থেকে শোনা যাক, তার দেশে দ্রষ্টব্য আছে কী কী?’

অসিত বলল, ‘এখানকার ধোঁয়া-ধুলোহীন আকাশ, মোটরের উৎপাতহীন মেঠো পথ, আর জনতার চিৎকারহীন প্রান্তরের মধ্যে তোমরা হয়তো দ্রষ্টব্য কিছুই খুঁজে পাবে না৷ তবে আমাদের খঞ্জনা নদীর ধারে গেলে তোমরা অনেক হাঁস শিকার করতে পারবে৷ ঘুঘু, স্নাইপ, আর চকাও পাওয়া যায়৷’

প্রিয়নাথ বলল, ‘আমি হচ্ছি বৈষ্ণবকুলতিলক৷ জীবহিংসা আমার পক্ষে মহাপাপ৷’

পরিতোষ বলল, ‘তুমি হচ্ছ ভণ্ড দি গ্রেট৷ আমাদের দলে তোমার চেয়ে মুরগিখোর আর কেউ নেই৷’

প্রিয়নাথ বলল, ‘হতে পারে৷ মুরগি ভক্ষণ করা আর নিধন করা এক কথা নয়৷’

শ্রীপতি বলল, ‘আহা-হা, আবার বাক্যযুদ্ধ কেন? প্রিয়নাথ কেন শিকারে যেতে চায় না, আমি তা জানি৷ বন্দুকের শব্দ শুনলে ওর পেটের অসুখ হয়৷ কিন্তু সে-কথা যাক৷ কী বলছিলে অসিত? এখানে দেখবার জায়গা কিছুই নেই?’

অসিত একটু ভেবে বলল, ‘দেখো, এখানে একটি দেখবার বিষয় আছে বটে, কিন্তু তোমরা সেটাকে হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবে৷’

আমি বললাম, ‘কেন?’

‘তোমরা হয়তো বলবে, সেটা মোটেই দ্রষ্টব্য নয়৷’

‘তবু সেটা কী শুনতে ইচ্ছা করি৷’

‘ভীমে ডাকাতের বট গাছ৷’

‘বট গাছ তো পথেঘাটে ছড়াছড়ি যায়৷ কিন্তু এ-বট গাছের নামটা ইন্টারেস্টিং বটে৷’

‘এর কাহিনিও কেবল ইন্টারেস্টিং নয়, থ্রিলিং৷’

পরিতোষ বলল, ‘আরও দু-ডজন ফুলুরির অর্ডার দিয়ে কাহিনিটা তুমি আমাদের কাছে বলতে পার৷’

‘তথাস্তু৷’

দুই

অসিত বলতে লাগল :

‘নবাবি আমলের পর বাংলাদেশে তখন ইংরেজ রাজত্ব শুরু হয়েছে৷ খালি ইংরেজ নয়, দেশ জুড়ে তখন ঠগি, ডাকাত আর বোম্বেটেরাও রাজত্ব আরম্ভ করেছে৷ দূর দেশে যেতে হলে লোকে তখন প্রাণ হাতে করে পথে বেরোয়৷

‘সেই সময়েই এ-অঞ্চলে ভীমে ডাকাতের নামে সবাই হত থরহরি কম্পমান! তোমরা সবাই নিশ্চয় বিশে ডাকাতের নাম শুনেছ? বিশে ছিল অত্যাচারী ধনীর যম, কিন্তু গরিবের মা-বাপ৷ তাকে অনায়াসেই বিলিতি ডাকাত রবিন হুডের সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ ডাকাত হলেও বিশের মধ্যে উদার মনুষ্যত্বের অভাব ছিল না৷

‘কিন্তু ভীমে ডাকাত ছিল সম্পূর্ণ উলটো ধরনের মানুষ৷ গরিব বা ধনী কারোকেই সে ছেড়ে দিত না৷ কেবল ডাকাতি নয়, নরহত্যাতেও ছিল তার উৎকট আনন্দ! শোনা যায় দু-এক আনা পয়সার জন্যেও সে অগুনতি মানুষ খুন করেছে৷ সাধারণ ডাকাতরা টাকা পেলে মিছেমিছি খুনখারাপি করে না৷ ভীমে কিন্তু আগে করত খুন, তারপর নিত টাকাকড়ি৷ যে-কালীকে পুজো করে ভীম ডাকাতি করতে বেরোত, সেই কালীমূর্তির গলায় আর কোমরে সে পরিয়ে দিয়েছিল আসল নরমুণ্ড ও কঙ্কালের মালা৷ কালীঠাকুরের হাতে সে নাকি প্রতি রাত্রেই নিত্যনতুন মানুষের রক্ত-মাখা কাঁচা মাথা ঝুলিয়ে দিত৷ বনের মধ্যে এক ভাঙা মন্দিরে সেই ডাকাতের কালী আজও বিরাজ করছেন, কিন্তু তার ভীষণ অলংকারগুলো অনেকদিন আগে খুলে নেওয়া হয়েছে৷

‘ভীমের চেহারাও ছিল নাকি ভয়াবহ৷ তার মতন লম্বা-চওড়া লোক কেউ কখনো দেখেনি, আর তার রংও ছিল মিশমিশে কালো৷ সেই মুখে তার টকটকে লাল চোখ দুটো জ্বলন্ত আগুনের ভাঁটার মতো৷ তার মূর্তি দেখলেই লোকে ভয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ত৷ ভীমে ডাকাতের অত্যাচারে এ-অঞ্চলে লোক চলাচল যখন বন্ধ হয়ে গেল, অনেকেই যখন দেশ ছেড়ে দেশান্তরে পালাতে লাগল, তখন এক সাহেব এল সিপাইদের নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করত৷

‘কয়েক মাস ধরে বহু চেষ্টার পর ভীমের দলের কয়েকজন ধরা পড়ল বটে, কিন্তু ভীমের পাত্তা পাওয়া ভার! বিপদ দেখলেই সে তার রণপায়ে চেপে হাওয়ার আগে উধাও হয়ে যেত! রণপা কী জানো? দুটো লম্বা বাঁশের লাঠি, তাতে আছে পা রাখবার জায়গা৷ এই রণপা ছিল বাংলার সেকেলে ডাকাতদের ভারি আদরের বস্তু, কারণ তার উপরে চড়ে তারা এক রাত্রেই পঞ্চাশ-ষাট মাইল পথ অনায়াসেই পার হয়ে যেতে পারত৷ রণপায়ে উঠে ভীমে যে কোথায় সরে পড়ত, তার খোঁজ আর কেউ পেত না৷

‘কিন্তু সাহেব ছিলেন মহা বুদ্ধিমান৷ একদিন ভীমে সদলবলে এক গ্রামে ডাকাতি করতে গিয়েছে, এমন সময়ে সাহেবও সেখানে এসে পড়লেন সদলবলে৷ সিপাইরা বন্দুক ছুড়লে, জনকয়েক ডাকাত মরল বা জখম হল, বেগতিক দেখে ভীমে রণপায়ে চড়ে লম্বা দিল, সাহেবও এবারে ঘোড়ায় চেপে তার পিছু নিলেন৷ কিছুদূর যেতে না যেতেই সাহেবের ঘোড়া গেল ভীমের রণপার কাছে হেরে৷ খানিক পরেই ভীমে ডাকাতের টিকিটি পর্যন্ত আর দেখা গেল না!

‘কিন্তু সাহেবের চোখ বড়ো সাফ৷ তিনি দেখলেন, ধূলিধূসরিত পথের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ভীমের রণপার দীর্ঘ রেখা! সেই চিহ্ন ধরে এগোতে লাগলেন৷ মাইল চার পরে রণপার চিহ্ন যেখানে শেষ হল সেখানে দেখা গেল যুগযুগান্তরের পুরোনো বিপুল এক বুড়ো বট গাছকে! তত বড়ো বট গাছ সহজে দেখা যায় না; তার গুঁড়ির বেড় প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ হাত৷ সেই গুঁড়ি আর শত শত ঝুরির উপরে ভর দিয়ে এই একটিমাত্র বট গাছ অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছোটোখাটো অরণ্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার মোটা মোটা প্রত্যেক ঝুরি এক-একটা আলাদা গাছের গুঁড়ির মতো শিকড় গেড়েছে মাটির ভিতরে৷

‘সাহেব আন্দাজ করলেন, ভীমে নিশ্চয় এই মস্ত গাছে চড়ে ঘন ডালপাতার আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে৷ পিঠে বন্দুক বেঁধে তিনিও গাছে উঠলেন, কিন্তু বহুক্ষণ এ-ডালে ও-ডালে তন্নতন্ন করে খুঁজেও ভীমকে পাওয়া গেল না৷

‘হতাশ হয়ে সাহেব যখন মাটিতে নেমে পড়বার জোগাড় করছেন, তখন হঠাৎ দেখা গেল, বটের গুঁড়ির উপর দিয়ে ধোঁয়ার চক্র বেরিয়ে আসছে৷

‘অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে সাহেব আরও উপরে উঠে উঁকি মেরে দেখেন, বটের প্রকাণ্ড গুঁড়িটা একেবারে ফাঁপা, আর তার ভিতরে পরম আরামে বসে ভীমে ডাকাত আপন মনে হুঁকোয় দম মারছে!

‘তামাকখোর ভীমে সে-যাত্রা আর রক্ষে পেল না৷ এক ছিলিম তামাকের লোভেই সে নিজের প্রাণটা বিলিয়ে দিল৷ সেই বট গাছেরই এক ডালে তাকে গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হল৷ কিন্তু মরবার সময়েও সে ভয় পেল না৷ দম্ভ করে বলল, ‘সাহেব, আমি আমার এ-আস্তানা ছেড়ে নড়ব না৷ ভূত হয়ে এখানেই রাজত্ব করব, এখানে যে আসবে, সে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না৷’

‘সেই ফাঁপা বট গাছই আজ ‘ভীমে ডাকাতের বট’ নামে বিখ্যাত৷ শত শত ঝুরির শিকড় দিয়ে রস টেনে কেবল বেঁচে নেই, আকারে আগেকার চেয়েও আরও বড়ো হয়ে উঠেছে৷ এ-অঞ্চলের প্রত্যেকেরই কাছে সে একটা দ্রষ্টব্য জিনিস হয়ে পড়েছে৷

‘কিন্তু রাতের বেলায় কেউ তার ত্রিসীমানায় যায় না৷

‘ঠাকুরদার মুখে শুনেছি, ভীমে ডাকাতের কথা পরীক্ষা করবার জন্যে, সেকালে কোনো কোনো অতি বড়ো ডানপিটে রাত্রে ওই বট গাছের কাছে গিয়েছিল৷ কিন্তু তারা কেউ আর ফিরে আসেনি, কোনোরকম চিহ্ন না রেখেই তারা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে৷

‘আজ আর কেউ ভীমে ডাকাতের কথা পরীক্ষা করতে সাহস করে না, সেই বট গাছের চারিদিকের জমি আজ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে৷ জলাভূমির কাছে জ্যান্ত মানুষের বসবাস নেই, আছে কেবল মড়াদের রাজ্য-অর্থাৎ গোরস্থান!’

অসিতের কাহিনি শেষ হলে পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে তোমাদের বিশ্বাস, রাত্রে সেই বট গাছের কাছে গেলেও আজ ভীমে ডাকাতের সঙ্গে আমাদের দেখা হবার সম্ভাবনা আছে?’

‘লোকে তো তাই বলে৷’

‘বট গাছটা এখান থেকে কত দূরে?’

‘চার মাইল৷’

পরিতোষ বিপুল উৎসাহে বলে উঠল, ‘আজ দ্বাদশীর চাঁদ উঠবে আকাশে৷ তারই আলোতে আমরা ভীমে ডাকাতের সঙ্গে দেখা করব৷’

অসিত বলল, ‘কিন্তু-‘

শ্রীপতি বাধা দিয়ে বলল, ‘কিন্তুর নিকুচি করেছে৷ আমরা আজ হাতেনাতে প্রমাণ করতে চাই, সেকেলে গাঁজাখুরি উপকথা কোনো কালেই সত্য হয় না৷’

কেবল প্রিয়নাথ আমতা আমতা করে বলল, ‘ওই বট গাছকে আমি থোড়াই কেয়ার করি৷ কিন্তু ওই যে গোরস্থানের কথা বললে, ওটা আমার ভালো লাগছে না৷’

কিন্তু তার প্রতিবাদ আমরা কেউ আমলেও আনলাম না৷

তিন

শীতকালের কুয়াশায় আচ্ছন্ন চাঁদের আলো দেখলেই শনিগ্রস্ত বলে মনে হয়৷ একেবারে নির্জন পথ ঝিঁঝিঁর ডাকে শব্দময় ও বুনো পুষ্পপত্রে গন্ধময়৷ বহুদূর থেকে নিস্তব্ধ রাত্রির বক্ষ ভেদ করে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে চলন্ত রেলগাড়ির আওয়াজ৷ এ আওয়াজ আগেও অনেকবার শুনেছি, কিন্তু শুনে মনে হল, ওই রেলগাড়িতে চড়ে যেন ইহলোকের যাত্রীরা চলেছে পরলোকের দিকে৷

বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম৷ তাদেরও শ্বাসপ্রশ্বাস হয়েছে দ্রুত, কারো মুখেই কোনো কথা নেই৷ মুখে কেউ মানি আর না মানি, আসন্ন কোনো অলৌকিক ভাবের প্রভাবে আমাদের সকলেরই মন আজ মোহগ্রস্ত!

এখানে মানুষের শেষ আশ্রয় হচ্ছে সরকারি ডাকবাংলো৷ তাকেও পিছনে ফেলে মাইল খানেক এগিয়ে গেলাম৷

তারপর একদিকে আঙুল দেখিয়ে অসিত চুপিচুপি বলল, ‘ওটা হচ্ছে গোরস্থান৷’

মৃতের সেই মৌন জগতেও জীবন্ত ঝিঁঝিঁদের ভাঙা গলার অশ্রান্ত আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে৷ কী একটা কালো জন্তু আমাদের সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে একটা উঁচু কবরের আড়ালে পালিয়ে গেল৷ প্রিয়নাথ ছিল সব পেছনে, সে এগিয়ে সকলের মাঝখানে এসে দাঁড়াল৷ তার মুখের ভাব অস্বাভাবিক৷

শ্রীপতি বলল, ‘কিন্তু সেই বুড়ো বট গাছটা কোথায়?’

অসিত নীরবে অঙ্গুলি নির্দেশ করল৷

একটা মস্ত বড়ো জলাভূমি দৃষ্টিসীমা জুড়ে ধু-ধু করছে এবং তারই উপরে পড়ে হিংস্র দাঁতের মতো চকচক করে জ্বলছে কুয়াশায় আধমরা চাঁদের আলো! জায়গায় জায়গায় কুয়াশা এত ঘন যে, তাকে ঠেলে চোখ চলে না৷ জলারই একপাশে পাহাড়ের মতো উঁচু প্রকাণ্ড একটা ঢিপির উপরে দাঁড়িয়ে আছে, শূন্যের অনেকটা পূর্ণ করে বিপুল সেই বট গাছটা৷ কেউ বলে না দিলে আমরা তাকে অরণ্য বলেই ধরে নিতাম৷ আবছায়া মাখা রহস্যময় জ্যোৎস্নায় বৃদ্ধ বটের ডালপালা শীতার্ত হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে সজোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এবং তার তলায় জমে আছে বিরাট ও নিরেট একটানা অন্ধকার৷

প্রিয়নাথ অর্ধস্ফুট স্বরে বলল, ‘ওগুলো কী? ওগুলো? ওই যে, নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে? কী ওগুলো?’

শ্রীপতি বলল, ‘আলেয়া৷’

প্রিয়নাথ বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, যাদের দেখা যায় না তারা ওই জলার ভিতরে আগুনের ফুটবল নিয়ে ওয়াটার পোলো খেলছে৷’

মনে মনে ভাবছি, এ স্থানটা গোরস্থানের চেয়েও স্তব্ধ, কারণ এখানে ঝিঁঝিঁরাও ডাকছে না! কিন্তু ঠিক সেইসময় নানা শব্দে চতুর্দিক হঠাৎ জাগ্রত হয়ে উঠল! প্রথমে চিৎকার করে উঠল বিকট স্বরে একপাল শেয়াল, তারপরই কোথা থেকে চ্যাঁচাতে লাগল তিন-চারটে প্যাঁচা এবং তারপরই শুনতে পেলাম মাথার উপর একদল বাদুড়ের ডানার ঝটপট শব্দ-যেন কী দেখে ভয় পেয়ে তারা প্রাণপণে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে৷

প্রিয়নাথ সচকিত কন্ঠে বলল, ‘ওহে, এখানে দাঁড়িয়ে মিছেমিছি হিম লাগিয়ে আর শীতে কেঁপে কী হবে? এবার ফেরা যাক, আর নয়!’

পরিতোষ ঠাট্টা করে বলল, ‘কী হে অসিত, তোমার ভীমে ডাকাত কোথায়?’

শ্রীপতি বলল, ‘ভীমে ডাকাত আজ বোধ হয় নরকের দরজা খোলা পায়নি!’

আচম্বিতে একটা বরফের মতো ঠান্ডা কনকনে হাওয়ার ঝটকা উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে আলেয়াদের দলে যেন একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল-কাকে দেখে তারা যেন দু-ভাগে ভাগ হয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে!

প্রিয়নাথ কাঁদো কাঁদো গলায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কুয়াশার একটা মেঘ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে! ওর পিছনে কী আছে, কে জানে!’

পরিতোষ চিৎকার করে বলল, ‘কোথায় ওহে ভীমে ডাকাত! দয়া করে একবার দেখা দাও!’

সেই মুহূর্তে শুনতে পেলাম, জলার জলে ছপছপ ছপছপ করে কীসের শব্দ উঠল৷

দুই চোখ পাকিয়ে অসিত ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘মনে হচ্ছে কে যেন রণপায়ে চড়ে জলা পেরিয়ে আমাদের দিকেই আসছে!’

আড়ষ্টভাবে অবরুদ্ধ কন্ঠে শ্রীপতি বলল, ‘কোথায় রণপা? . . . কোথায় কে?’-তার স্বরে এখন কিন্তু আর কৌতুকের ভাব ছিল না৷

আমি দুর্বল স্বরে বললাম, ‘কেবল একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর একখানা ঘন কুয়াশার মেঘ হুহু করে এগিয়ে আসছে!’

প্রিয়নাথ হঠাৎ বিকট ও বিশ্রী এক চিৎকার করে পাগলের মতো দৌড় মারল! সে অমনভাবে চেঁচিয়ে না পালালে আমরা কী করতাম জানি না, কিন্তু ভয় হচ্ছে এমন সংক্রামক যে, দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমরাও ছুটতে লাগলাম প্রিয়নাথের সঙ্গে সঙ্গে!

গোরস্থান ছাড়িয়ে মিনিট পাঁচেক ছোটবার পর আমরা আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম৷

পরিতোষ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ঘটি, তুমি হঠাৎ পালিয়ে এমন ভয় দেখালে কেন?’

প্রিয়নাথ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বাঙাল, তোমাকে তো আমার পিছু নিতে বলিনি, তুমি পালালে কেন?’

পরিতোষ কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ অত্যন্ত শিউরে উঠে থেমে গিয়ে আমার দৌড় মারবার উপক্রম করল! আমরাও আড়ষ্ট হয়ে শুনতে পেলাম, আমাদের পিছনে পথের উপরে জেগে উঠেছে, ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের খটমট খটমট শব্দ!

শ্রীপতি সভয়ে বলল, ‘রণপার শব্দ কি ঘোড়ার পায়ের শব্দের মতো?’

কিন্তু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না, কারণ তখন আমরা সকলেই ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতবেগে আবার ছুটতে শুরু করেছি৷ পিছনের শব্দও যত এগিয়ে আসে, আমরাও তত বেশি পা চালাতে থাকি-এ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে ভীরু জীবনের দৌড়ের পাল্লা৷

এবারে একেবারে এসে থামলাম ডাকবাংলোর সীমানার মধ্যে৷ আমাদের দমাদ্দম পদাঘাতে বাংলোর দরজা ভেঙে পড়ে আর কী! রক্ষী দরজা খুলে দিয়ে বিস্মিত স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে বাবু, কী হয়েছে?’

আমি বললাম, ‘কিছু হয়নি৷ আজ রাত্রে আমরা এখানে থাকব৷’

একটা ঘরে ঢুকে যে যেখানে পারলাম হাত-পা এলিয়ে বসে পড়লাম৷

বাইরের স্তব্ধ পথের উপরে আবার সেই ভয়াবহ ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল৷ বেশ বুঝলাম শব্দটা বাংলোর সীমানার মধ্যে এসে থামল৷

আমার হৃৎপিণ্ড বুকের ভিতরে ছটফট করে লাফাতে লাগল!

রক্ষী আবার দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে পরিতোষ ছুটে গিয়ে তাকে চেপে ধরে উন্মত্তের মতো বলে উঠল, ‘খবরদার, দরজা খুলে দিয়ো না৷’

রক্ষী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘দরজা খুলে দেব না কী বাবু? আজ যে এখানে পুলিশসাহেবের আসবার কথা আছে৷’

চার

ঘোড়া থেকে নেমে পুলিশসাহেবই বাংলোর ভিতরে প্রবেশ করলেন৷

আমরা বোকা এবং বোবার মতো পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম৷

খানিক পরে পরিতোষ বলল, ‘ওই কাপুরুষ প্রিয়নাথই যত নষ্টের গোড়া!’

প্রিয়নাথ বলল, ‘জলায় যাবার রাস্তা খোলাই আছে৷ তুমি আবার সেখানে গেলে আমি বারণ করব না৷’

অসিত বলল, ‘হতে পারে, পথ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পুলিশসাহেবই আসছিলেন৷ কিন্তু জলার জলে যে ছপছপ করে শব্দ হচ্ছিল সেটা কীসের শব্দ?’

শ্রীপতি বলল, ‘হয়তো কোনো জন্তু সাঁতরে জলা পার হচ্ছিল৷ আমরা রজ্জুতে সর্পভ্রম করেছি, কাল আমরা আবার এই বট গাছ দেখতে আসব৷’

কিন্তু যাঁরা এই কাহিনি শুনছেন তাঁদের কানে কানে আমি জানিয়ে রাখছি যে, পরদিনের সন্ধ্যায় বট গাছ দেখতে আসবার কথা আমরা সকলেই আশ্চর্যরূপে ভুলে গিয়েছিলাম৷ আজও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সেই ছপছপ শব্দ শুনি আর গলদঘর্ম হয়ে জেগে উঠি৷ আজও মনে মনে প্রশ্ন জাগে, সে শব্দটা কীসের?

তোমরা কেউ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পার?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *