ভীমরতি
নিশুতি রাত৷ সময় দ্বিপ্রহর৷ বাড়ির প্রায় পেছন থেকে শুরু হয়ে যাওয়া দুর্ভেদ্য জঙ্গল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে৷
এই ঘরে সাবেক আমলের দামি কাঠের ভারী জানলা হলেও তাতে ছোট-ছোট ফাঁকফোকর রয়েছে, সেখান দিয়ে ঢুকে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে ঘরের পর্দাগুলো তিরতির করে কাঁপছে৷
থাকোগোপাল চৌধুরী গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, আচমকা তিনি ঘুম ভেঙে বিছানার ওপর উঠে বসলেন৷ কাঁচাঘুম ভেঙে যাওয়ায় মুখে যে বিরক্তি এসে জমা হয়, তা তাঁর অভিব্যক্তিতে নেই, বরং আলো-আঁধারিতে তাঁর মুখে খেলা করছে অদ্ভুত এক আতঙ্ক৷
কেন যে তাঁর ঘুমটা ভাঙল, থাকোগোপাল প্রথমে ঠাহর করতে পারলেন না৷ কোথাও কোনো শব্দ হয়নি, শরীরেও কোনো অস্বস্তি নেই৷ তিনি হাতড়ে হাতড়ে পালঙ্কের একপাশের টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা মুখের কাছে তুলে এনে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেলেন, তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় ডাকলেন, ‘‘অনন্ত! অনন্ত!’’
অনন্ত চৌকাঠের বাইরেই দালানে শুয়ে ছিল৷ কর্তাবাবুর রাতে কোনোকিছু দরকার হতে পারে, সেইজন্য সে ওখানেই গামছা পেতে শুয়ে থাকে৷ সে ধড়মড়িয়ে উঠে ঘরে এল, ‘‘আজ্ঞে কর্তাবাবু?’’
থাকোগোপালের কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম এসে জমা হয়েছে৷ হাতের চেটো দিয়ে সেটা মুছে তিনি বললেন, ‘‘আর তিনটে দিন অনন্ত!’’
অনন্ত বলল, ‘‘কর্তাবাবু, আপনি সেই একই কথা ভেবে যাচ্ছেন? এই এত বড় ব্যারাম থেকে উঠলেন, এসব ভাবলে তো আপনার আরো শরীর খারাপ হয়ে যাবে৷ দিদিমণি ওইজন্য আরো বেশি বেশি চিন্তা করছেন৷’’
থাকোগোপাল যেন শুনতেই পেলেন না, দূরে টিমটিম করে জ্বলা নাইটল্যাম্পটার দিকে আনমনে তাকিয়ে বললেন, ‘‘দেবযানী কিছুতেই কথা শুনল না৷ কাল সকালেই সূর্যনারায়ণ আসছে৷ শাস্ত্রীমশাই ঠিকই বলেছেন রে, এখন আমার উভয়সংকট!’’
‘‘তা আসছে এ তো ভালো কথা কর্তাবাবু! নাতিবাবু অ্যাদ্দিন বাদে দাদুর বাড়ি আসছে, এ তো বড্ড আনন্দের কথা! দিদিমণি নাতিবাবুকে পাঠাচ্ছে ঠিকই তো করছে৷ সরকারমশাইও তো সেটাই বলছিলেন…!’’ অনন্ত বলল৷
‘‘তোরা খালি একটা দিকই ভেবে চলেছিস অনন্ত৷’’ চাপা গলায় গর্জে উঠলেন থাকোগোপাল, ‘‘আমার দিকটা তো ভাবছিস না?’’
অনন্ত হাতজোড় করে বলল, ‘‘আজ্ঞে ভাবি বাবু, সবসময়েই ভাবি৷ তাই তো অ্যাত্তো বছর ধরে আপনার সব কাজে পাশে…!’’
‘‘থাম! বড্ড কথা বলছিস আজকাল! ভালো করে শুনে রাখ, যতদিন সূর্য থাকবে, তুই চোখে-চোখে রাখবি৷ শঙ্করকেও বলেছি যেন বেশি বাড়াবাড়ি না করে৷’’ একমুহূর্ত দম নিলেন থাকোগোপাল, ‘‘আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না৷’’
* * * *
বাঁ-হাতে একটা মাঝারি মাপের ট্রলি আর পিঠে রুকস্যাক নিয়ে অর্ক যখন বোলপুর স্টেশনে নামল, তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে ছুটছে৷ গোটা স্টেশনটা প্রায় নিঝুম হয়ে রয়েছে, এদিক-ওদিক গামছা পেতে শুয়ে থাকা কয়েকজন কুলি, ইলেকট্রিক তারের পোস্টে অলসভাবে ঝুলে থাকা দু-তিনটে কাক ছাড়া বলতে গেলে কেউ কোথাও নেই৷ এমনকি খাবারের বা বইয়ের স্টলগুলোর ঝাঁপও বন্ধ৷
মা প্রথমে বলে দিয়েছিলেন দাদুর পাঠানো গাড়ি স্টেশনের বাইরেই অপেক্ষা করবে৷ কিন্তু ট্রেন যখন গুসকরা স্টেশন ছাড়ছে, ঠিক সেইসময়েই মা আবার ফোন করলেন, ‘‘তুই কোথায়?’’
‘‘এইতো, ট্রেন গুসকরা ছাড়ল, ইন্টারনেটে দেখলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব৷’’ অর্ক ঝালমুড়ির ঠোঙা থেকে একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে বলেছিল৷
‘‘শোন, শঙ্করকাকা ফোন করেছিলেন৷ তোকে নিতে যে গাড়িটা আসছিল, সেটা হঠাৎ মাঝপথে বিগড়ে গিয়েছে৷ ইঞ্জিনের গণ্ডগোল, সারাতে সময় লাগবে৷ রোদ্দুরের মধ্যে তুই আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? তার চেয়ে বাসে চেপে চলে যেতে পারবি কি?’’
অর্কর মেজাজটা এমনিতেই তিরিক্ষি হয়ে ছিল, এবার বিরক্তিতে ও প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, ‘‘ধুর, কোনো মানে হয়! এইজন্য আমি আসতে চাইছিলাম না, তুমি সেই জোর করে পাঠালে! দাদুর এমনিতেই ইচ্ছে ছিল না আমি আসি, সেইজন্য ইচ্ছে করে গাড়িটাও খারাপ করে দিল৷’’
‘‘ছি অর্ক!’’ ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে মায়ের তিরস্কার শোনা গেল, ‘‘গুরুজনদের সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলতে আছে! এতবড় হয়ে গেছিস আর এইসব শিখছিস? বাবা তোর অসুবিধার কথা ভেবেই দোনোমনা করছিলেন৷ নাহলে নাতি ওঁর কাছে গিয়ে ক’টা দিন থাকবে আর উনি তা চাইবেন না, তা কখনো হয়?’’
এখন এই দুপুর রোডে স্টেশন চত্বর থেকে বেরোতে বেরোতে মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই ওর আবার বিরক্ত লাগল৷ এখানে আসার যে ওর একেবারেই ইচ্ছে ছিল না তা নয়, জ্ঞান হওয়া ইস্তক কখনোই ও দাদুর বাড়িতে আসেনি৷ আর শুধু তাই নয়, মায়ের কথা অনুযায়ী শহুরে কোলাহল ছাপিয়ে এমন নিটোল গ্রাম নাকি কখনো ও দেখেনি৷
কথাটা মিথ্যে নয়, অর্ক ছোটবেলা থেকেই খাস কলকাতার সল্টলেকে মানুষ৷ ওর বাবার তিন কূলে কেউ নেই, ছোট থেকে তিনি বড় হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের এক অনাথ আশ্রমে৷ ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাদে স্কুল, কলেজ পেরিয়ে ভালো চাকরি পেয়েছিলেন বাবা৷ সল্টলেকে বাবার কোয়ার্টারেই ওরা থাকে৷
তবে মা-র কাছে ছোট থেকেই ও গল্প শুনত মায়ের বাবা নাকি বীরভূমের এক প্রাচীন গ্রামের মস্ত জমিদার৷ আগের সেই জমিদারি না থাকলেও রাঙামাটি মাখানো সেই গ্রামে সবাই নাকি ওর দাদু থাকোগোপাল চৌধুরীকে খুব মানে৷
তবে সেই মানাটা কতটা অন্তরের ভক্তিশ্রদ্ধা থেকে আর কতটা ভয় থেকে তা অবশ্য অর্ক জানে না৷
সাবেক সেই জমিদারবাড়ির ঠাকুরদালান, নাচমহল, পায়রার খোপের মতো ঘুলঘুলি বারান্দার গল্প ছোট থেকে মার কাছে ও এত শুনেছে যে নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে সেই জমিদার বাড়ির ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল৷ ছোটবেলায় মাকে ও প্রায়ই প্রশ্ন করত, ‘‘আমার সব বন্ধুরা তো ছুটি পেলেই দাদুর বাড়ি যায় মা৷ আমরা কেন যাই না? চলো না মা, এবারের গরমের ছুটিতে যাই!’’
মা প্রথমে কোনো উত্তর দিতেন না, চুপ করে থাকতেন৷ তারপর বারংবার পীড়াপীড়িতে বলতেন, ‘‘দাদু তো এখন খুব ব্যস্ত অর্ক৷ তুমি বড় হও, তারপর তোমাকে নিয়ে যাব৷’’
বড় হয়েছে অর্ক৷ কিন্তু ছোটবেলার মতো সে আর দাদুর বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরে না৷ সে এখন বুঝেছে, থাকোগোপাল চৌধুরীর মতো আত্মম্ভরী স্বার্থপর মানুষের সংস্রবে না যাওয়াই ভালো৷
মা ফোনে বলে দিয়েছিলেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোথা থেকে বাস ধরতে হবে৷ সেইমতো ও কিছুটা হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোল৷ সেখানেও লোকজন বিশেষ নেই৷ শুধু মাঝারি মাপের লঝঝড়ে দুটো বাস দাঁড়িয়ে আছে আর পাশের গুমটিতে কাঁধে টিকিটের ব্যাগ ঝুলিয়ে বসে আছে কয়েকটা লোক৷
অর্ক পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল, ‘‘দাদা সিঙ্গি যাওয়ার বাস কোনটা?’’
একজন কন্ডাক্টর ওর দিকে তাকাল, ‘‘কোন সিঙ্গি? অজয়ের এপাশে, না ওপাশে?’’
অর্ক ঘাবড়াল না, মা ওকে আগে থেকেই সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন৷ এই তল্লাটে দুটো সিঙ্গি বলে গ্রাম আছে৷ একটা অজয় নদীর এপারে, অন্যটা ওপারে৷ নদীর ওপারের সিঙ্গি বর্ধমান জেলার এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম৷ অর্ক সদ্য বাংলায় এম এ পরীক্ষা দিয়ে এসেছে৷ ওই সিঙ্গি যে মধ্যযুগীয় কবি কাশীরাম দাসের জন্মস্থান, তা ও ভালো করেই জানে৷ কিন্তু ও ওই সিঙ্গিতে যাবে না, যাবে নদীর এপারের সিঙ্গিতে৷ সেটা বীরভূম জেলাতেই পড়ছে৷
ও বলল, ‘‘এপারের সিঙ্গি৷ রাস্তায় ইতন্ডা গ্রাম পড়বে, সেখানেই নামব৷’’
বাস ছাড়তে প্রায় একঘণ্টা পেরিয়ে গেল৷ ততক্ষণে ও জানলার ধারে বসে একদফা ঘুমিয়ে নিয়েছে৷ হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা চলতে শুরু করতেই ওর হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা সত্যিই কি দাদু ওকে দেখে খুশি হবেন? এমনিতে তো অনেকবার বারণ করেছিলেন আসতে, যেমন প্রতিবারই করেন৷ কিন্তু স্ট্রোকের খবর পেয়ে মা এবার আর কিছুতেই শুনলেন না, জোর করে অর্ককে পাঠালেন৷
সত্যি, আশ্চর্য মানুষ এই থাকোগোপাল চৌধুরী! অর্ক নিজের মনেই ভাবতে লাগল৷ সামান্য একটা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে ভদ্রলোক পঁচিশ বছর নিজের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না৷ এমনকি অর্কের জন্মের পরেও দেখতে আসেননি৷
অথচ প্রতিটা বছর পুজো আর পয়লা বৈশাখে নিয়ম করে বীরভূমের ইতন্ডা গ্রাম থেকে নতুন জামাকাপড় পৌঁছে যায় অর্কদের কোয়ার্টারে৷ ছোটবেলায় ইতন্ডার জমিদারবাবুর গাড়ি একরাশ উপহার নিয়ে কোয়ার্টারের সামনে ঢুকতে দেখলেই অর্কর মনটা আনন্দে নেচে উঠত৷ শিশুসুলভ উচ্ছলতায় ‘‘ওই তো দাদুর গাড়ি এসেছে! দেখি আমার জন্য কী কী এনেছে?’’ বলতে বলতে ও ছুটে যেত গাড়ির কাছে৷
কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর থেকে গাড়িটা দেখলেই ওর যে শুধু রাগ হত তাই নয়, ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হত উপহারগুলোকে৷ নিজে কখনো না এসে বছরে দুবার ওই টাকার গরম দেখানোটাকে অত্যন্ত খেলো মনে হত ওর৷
ও যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, তখন দাদুর গাড়ির ড্রাইভার এসে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল সদ্য দোকান থেকে কিনে আনা ঝকঝকে একটা ল্যাপটপ৷
জাগতিক মোহের ঊর্ধ্বে উঠে অর্কর আত্মাভিমান বরাবরই প্রবল৷ একেই সেইসময় ও রাগে ফুঁসছিল, মাধ্যমিক শেষে হাজার বায়না সত্ত্বেও দাদুর নিষেধে মা ওকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাননি৷ তার ওপর এই নাটক ও আর সহ্য করতে পারেনি, ল্যাপটপটা সজোরে আছড়ে ফেলেছিল মাটিতে৷ কেটে কেটে বলেছিল, ‘‘থাকোগোপাল চৌধুরীকে গিয়ে বলে দেবেন নামীদামি গিফট পাঠালেই শুধু দাদুর কর্তব্য হয় না৷ দাদু হতে গেলে স্নেহ-ভালোবাসা এগুলোরও প্রয়োজন আছে৷’’ কথাটা বলেই ও চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে৷
ওর আকস্মিক এই দুর্ব্যবহারে বাবা-মা যতটা না ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তার চেয়ে হয়েছিলেন অনেক বেশি অবাক৷ অর্ক শান্ত ছেলে, সে চট করে মাথাগরম করে না৷
সেদিন রাতেই বাবা ওকে বলেছিলেন ইতন্ডার জমিদারবাড়ির সেই আশ্চর্য অভিশাপের কথা, যা বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে৷ থাকোগোপালের মতো বংশের প্রতিটি পুরুষ নিজের অজান্তেই বংশবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জিইয়ে রাখছেন সেই অভিশাপকেও৷
কন্ডাক্টর এসে টিকিট চাওয়াতে অর্কর সংবিৎ ফেরে৷ হাতে ধরে কুড়ি টাকার নোটটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয় ও, ‘‘একটা ইতন্ডা৷ কতক্ষণ লাগবে পৌঁছোতে?’’
কন্ডাক্টর জবাব দেয়, ‘‘বোলপুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা৷ বেশিক্ষণ লাগার কথা নয়, কিন্তু রাস্তা এত খারাপ…৷’’
ইতন্ডা গ্রামের ইতিহাস অর্ক শুনেছিল বাবার কাছে৷ ওর বাবা পুরাতত্ত্ব বিভাগের অফিসার, তিনিই বলেছিলেন, ‘‘তোর দাদু যে গ্রামের জমিদার, সেই ইতন্ডা গ্রামের নামটা কোথা থেকে এসেছে বল তো?’’
অর্ক মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘‘তা তো জানি না৷ মা বলেছিলেন ইতুপুজো বলে কী একটা পুজো হয় গ্রামে৷ সেই ইতুপুজো থেকেই কি ইতন্ডা?’’
বাবা হেসে মাথা নেড়েছিলেন, ‘‘ধুর! ইতন্ডা নামটা এসেছে ইস্টইন্ডিয়া থেকে৷’’
অর্ক তো অবাক, ‘‘ইস্ট-ইন্ডিয়া? মানে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসে ব্রিটিশ শাসন শুরু করেছিল? সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে পলাশির যুদ্ধ করেছিল?’’
‘‘ইয়েস৷’’ বাবা বলেছিলেন, ‘‘এখন অজয় নদী সরে ওদিকে প্রায় সিঙ্গি গ্রামের দিকে চলে গেছে৷ কিন্তু আজ থেকে দু-আড়াইশো বছর আগে অজয় ইতন্ডা গ্রামের একদম পাশ দিয়েই বয়ে যেত৷ তখন সাহেবরা বড় বড় জাহাজে করে ইতন্ডা গ্রামে আসত বাণিজ্য করতে৷ নীলচাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল গ্রামটা৷ আঠেরো রকম পেশার আঠেরোটা পাড়া নিয়ে গমগম করত ইতন্ডা৷ কিন্তু তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অজয় নদী তার গতিপথ সরিয়ে নিয়ে আসতেই বর্ধিষ্ণু ইতন্ডা কৌলীন্য হারায়৷’’
অর্ক মন দিয়ে শুনছিল৷ বাবা থামতেই বলে উঠেছিল, ‘‘এখন কেমন গ্রামটা?’’
‘‘আমি তো ওই একবারই গেছি৷ তোর মাকে বিয়ের সময়৷ সেই জৌলুস বা ঠাটবাট কিছুই চোখে পড়েনি৷’’ বাবা বলেছিলেন৷
অর্ক যখন ইতন্ডা গ্রামে পৌঁছোল, তখন সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায়৷ গোটা গ্রামে একটাই মাত্র সরু পিচের রাস্তা৷ দু-পাশে ধানখেতের মাঝ দিয়ে সেটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর৷ সেই রাস্তা থেকে শাখাপ্রশাখার মতো আবার লালমাটির কাঁচা পথ নেমে গেছে দু-পাশে৷
মা-র কথামতো নেমেই ও শঙ্করদাদুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল৷ শঙ্করদাদুর পুরো নাম শঙ্করনাথ সরকার, ওঁরা আসলে ইতন্ডা গ্রামের জমিদারবাড়ির বংশানুক্রমিক নায়েব ছিলেন৷ কিন্তু এখন দাদুর বন্ধুস্থানীয়৷ জমিদারবাড়ির পাশেই তাঁর বাড়ি, দিনে দু-বেলা নাকি এখনো গল্প করতে আসেন থাকোগোপাল চৌধুরীর সঙ্গে৷ বেশ কয়েকবার ষাণ্মাসিক ভেট নিয়ে তিনিও গিয়েছেন অর্কদের সল্টলেকের কোয়ার্টারে৷
শঙ্করদাদু মানুষটা ভালো, বয়স সত্তরের ওপরে হলেও বেশ শক্তসমর্থ, পরিপাটি গোছের৷ অর্ককে দেখেই তিনি একগাল হাসলেন, ‘‘আরে ইয়াং ম্যান, ওয়েলকাম টু ইতন্ডা৷ দেবযানী ফোন করেছিল৷ অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি৷’’
অর্ক মৃদু হেসে প্রণাম করল, ‘‘ভালো আছেন দাদু?’’
‘‘আরে থাক থাক, এসব আবার কেন!’’ শঙ্করদাদু হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘‘তোমরা শহরের ছেলে, এসব চল এখনো আছে? বেশ বেশ!’’
শঙ্করদাদু একটা পেল্লায় রিকশা এনেছিলেন৷ সাধারণ রিকশার চেয়ে অনেকটা বড় আর আরামদায়ক, দেখলেই বোঝা যায় বিশেষ-ভাবে বানানো৷
অর্ক শঙ্করদাদুর পাশাপাশি রিকশায় উঠে বসল, ‘‘দাদু এখন কেমন আছেন?’’
‘‘এখন অনেকটা ভালো, তবে ডাক্তার পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে বলেছেন৷ রক্তে চিনিটা বেশ বেড়েছে৷’’ শঙ্করদাদু যেতে যেতে বললেন, ‘‘তোমাকে দেখবেন বলে সকাল থেকে উতলা হয়ে রয়েছেন৷’’
ওকে খুশি করার জন্য এই নির্জলা মিথ্যেটা শুনে অর্কর সাময়িক ভালো হওয়া মেজাজটা আবার খিঁচড়ে গেল৷ মা ওকে ইতন্ডায় পাঠাতে চান বলে গত কয়েকদিন ধরে ফোনে দাদুর সঙ্গে মার বাদানুবাদ চলছিল, সেটা কি শঙ্করদাদু জানেন না? নাকি জেনেও না জানার ভান করছেন!
এই তো আজ সকালেও ও যখন বাড়ি থেকে রেডি হয়ে বেরোচ্ছে, তার আগে মা ফোন করেছিলেন দাদুকে৷ ফোনের ওপ্রান্ত থেকে দাদুর গম্ভীর গমগমে গলা ও স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল, ‘‘তোমাকে এতবার বললাম, তবু তুমি শুনলে না দেবযানী৷ সেই ওকে পাঠাচ্ছ৷ যদি অঘটন কিছু ঘটে যায়, তুমি সেই দায় নেবে তো?’’
মা মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘‘আমি তো যাচ্ছি না বাবা৷ অর্ক তো তোমার একমাত্র নাতি, তোমাকে একবারও চোখের দেখা দেখবে না?’’
দাদু একটুও না নরম হয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভুলে যেও না দেবযানী, বিপ্রতীপের সঙ্গে তোমার বিয়ের শর্ত কিন্তু এটাই ছিল যে বিয়ের পর তোমাদের কারুর সঙ্গেই আমি কখনো দেখাসাক্ষাৎ করব না৷’’
মা তবু মৃদুকণ্ঠে অনুযোগ করছিলেন, ‘‘না মানে অনেকদিন তো হল…!’’
সকালের সেই কথোপকথন মনে পড়তেই মায়ের ওপর রাগটা অর্কর আবার ফিরে এল৷
এভাবে অবাঞ্ছিত অনাহূতের মতো আসার কোনো মানে হয়? আশি বছর বয়স হতে চলল লোকটার, এই বয়সেও যার বাঁচার এত তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যার এত পার্থিব লোভ, তার প্রতি কী করে শ্রদ্ধা আসবে অর্কর?
বহু বছর আগে ক্লাস ইলেভেনে ল্যাপটপ ভেঙে ফেলার সেই দিনে অনেক রাতে বাবা এসে বিছানায় ওর পাশে বসেছিলেন৷ ও তখনো ঘুমোয়নি, গোঁজ হয়ে পড়েছিল৷
বাবা ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিলেন, ‘‘অর্ক, ইতন্ডার চৌধুরী পরিবারের ওপর প্রায় দেড়শো বছরের এক অভিশাপ আছে৷ অন্তত তোর দাদু তাই বিশ্বাস করেন৷’’
মনে মনে রেগে থাকলেও ও তখন কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল, ‘‘দেড়শো বছরের অভিশাপ? মানে?’’
‘‘আমি তোর মার কাছ থেকেই পুরোটা শুনেছি৷ তোকে তো বলেইছি ইতন্ডা কত প্রাচীন গ্রাম৷ দেড়শো বছর আগে এক তান্ত্রিক সেই সময়ের চৌধুরী পরিবারের কর্তাকে খুব হেনস্থা করেছিলেন৷’’
‘‘হেনস্থা করেছিলেন বলতে?’’ অর্ক অবাক হয়েছিল৷
‘‘তখন সিপাহি বিদ্রোহের সময়৷ সারা দেশে প্রথমবারের জন্য মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে৷ সিপাহিরা যে বিদ্রোহ শুরু করেছিল, সেই আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে৷ তুই তো নিশ্চয়ই জানিস, দেশীয় জমিদাররা ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতা করত৷ ব্রিটিশ বণিকরা ইতন্ডা গ্রামকে ঘাঁটি করে তাদের বাণিজ্য চালাচ্ছে বলে ওই গ্রামের তখন ক্রমশ শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে৷ সেখানে চৌধুরীদের মতো জমিদাররা তো ব্রিটিশদেরই সমর্থন করবে৷ যিনি সেই সময় জমিদার ছিলেন, নামটা তোর মা বলতে পারবে, আমি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না, ইতন্ডা গ্রামে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন বিদ্রোহী সিপাইকে সোজা তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে৷’’
‘‘ওঁর নাম ছিল নিত্যবিনোদ চৌধুরী৷’’ মা কখন ঘরে ঢুকেছিলেন, ওরা দুজনেই খেয়াল করেনি সেদিন৷
অর্ক জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘ইতন্ডায় কি আর্মি ক্যাম্পও ছিল নাকি?’’
‘‘না না৷ ওই ক-জন সিপাই ব্যারাকপুর ছাউনি থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ইতন্ডায়৷’’ বাবা বলেছিলেন৷
‘‘তারপর?’’
এবার বাবার হয়ে মা-ই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘তখন গ্রামের বাইরের জঙ্গলে থাকতেন এক দাপুটে তান্ত্রিক, তিনি সিপাইদের সমর্থনে গ্রামের জমিদারকে বোঝাতে আসেন যে, প্রজাপালক হিসেবে জমিদারের উচিত দেশের মানুষকে সমর্থন করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো৷ বিদেশি বণিকদের এই সাম্রাজ্যবিস্তারের গ্রাসে প্রশ্রয় দিলে তা পরে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে৷ কিন্তু ওই জমিদার তখন তান্ত্রিককে গুরুত্ব তো দেনই নি, উল্টে নিজের ছেলের সামনে তাঁকে চরম অপমান করেন৷’’
শুনতে শুনতে অর্ক কখন যেন বুঁদ হয়ে গিয়েছিল, ‘‘তারপর কী হল?’’
মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘‘ওই তান্ত্রিক তখন প্রচণ্ড রেগে গিয়ে নিত্যবিনোদ চৌধুরীকে অভিশাপ দেন, ছেলের সামনে তুই আমায় এইভাবে অপমান করলি, এই ছেলেই তোকে হত্যা করবে৷ শুধু তাই নয়, তোদের এই চৌধুরী পরিবারের প্রতিটা পুরুষ মারা যাবে তার নিজের উত্তরপুরুষের হাতে৷
‘‘নিত্যবিনোদ তখন ভয় পেয়ে যান, তান্ত্রিকের পা ধরে কাকুতিমিনতি করতে থাকেন৷ কিন্তু শত অনুরোধ-উপরোধেও সেই তান্ত্রিক নরম হননি৷ শেষে বলেছিলেন, এই অভিশাপ সেদিনই শেষ হবে যেদিন কোনো অপুত্রক জমিদার এই বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন৷’’
‘‘তখন নিত্যবিনোদ কী করলেন?’’
‘‘তা জানি না অর্ক৷ নিত্যবিনোদ তার বছরখানেকের মধ্যেই মারা যান৷ তাঁর ছেলেই নাকি টাকাপয়সা নিয়ে কিছু বাদানুবাদের সময় তাঁর কপালে সোজা গুলি চালায়৷’’ মা একমুহূর্ত থেমেছিলেন, ‘‘সেই শুরু৷ তারপর থেকে এই দেড়শো বছরে চৌধুরীবাড়ির প্রত্যেকটা জমিদারের মৃত্যুর কারণ হয়েছে তার নিজের ছেলে৷’’
‘‘দাঁড়াও দাঁড়াও!’’ অর্ক উত্তেজনায় উঠে বসেছিল বিছানায়, ‘‘দেড়শো বছর মানে প্রায় ছ-টা প্রজন্ম৷ ছ-টা প্রজন্ম ধরে ইতন্ডায় ছেলের হাতে প্রতিটা বাবা খুন হয়েছে? এটা বিশ্বাসযোগ্য? থানাপুলিশ কিচ্ছু হয়নি?’’
‘‘দেখ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর৷ খুনই যে হয়েছে, তেমন নয়৷ এই যেমন তোর দাদু নাকি যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, তাঁকে আঁতুড়ে দেখতে আসার সময় দরজার চৌকাঠে পা আটকে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তাঁর বাবা৷ তাঁর সেই জ্ঞান আর কোনোদিনও ফেরেনি৷ তার মানে তোর দাদু নিজের বাবাকে হত্যা করলেন না ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর কারণ তো হয়েছিলেন!’’ বাবা বলেছিলেন৷
মা বাবার কথায় সায় দিয়েছিলেন, ‘‘তোর বাবা ঠিকই বলছেন৷’’
বাবা মা-র দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ওকে বলেছিলেন, ‘‘থাকোগোপাল চৌধুরী হলেন প্রচণ্ড স্বৈরাচারী ধরনের মানুষ৷ নিজেদের বংশের এই অভিশাপ তিনি একটু বড় হতেই জানতে পারেন৷ তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, পুত্রসন্তান তিনি কিছুতেই জন্ম দেবেন না৷’’ বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘‘গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তো এখন এ-দেশে অপরাধ হয়েছে৷ আগে তো জানা যেত না৷ তোর মায়ের আগে দুবার পুত্রসন্তান হয়েছিল ওনার৷’’
মা এবার একটু বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘এসব কথা থাক বরং!’’
কিন্তু বাবা বলেছিলেন, ‘‘না দেবযানী৷ অর্ক বড় হচ্ছে৷ সত্যিগুলো ওর জানা দরকার৷ নাহলে নিজের মনে ও অন্য কিছু কল্পনা করে নেবে, ক্ষোভ বাড়তে থাকবে৷’’ তারপর বাবা অর্কর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ওই দুটো বাচ্চাই একবছর বয়সের আগেই হঠাৎ জ্বরে মারা যায়৷’’
‘‘নিজের বাবাই ওদের মেরে ফেলেছিল?’’ অর্ক বিস্ফারিত চোখে বলেছিল৷
বাবা আমতা আমতা করছিলেন, ‘‘সেটা জানি না৷ কোনো প্রমাণ তো নেই৷ তারপর তোর মা জন্মায়৷ কিন্তু তাতেও ওঁর মৃত্যুভয় যায়নি৷ সারাক্ষণ তিনি ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন, তান্ত্রিকের সেই অভিশাপ যদি কন্যার কাছ থেকেই আসে? কিংবা যদি আসে নাতির কাছ থেকে? তাই তিনি আমাদের কারুর সাথে যোগাযোগ রাখেন না৷ বুঝলি?’’
অর্ক পুরোটা শুনে সেদিন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল৷ সামান্য একটা কাকতালীয় কুসংস্কারের শিকার হয়ে কেউ নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে? তারপর এই দীর্ঘ পঁচিশটা বছর নিজের মেয়ে, নাতিকে না দেখে থাকতে পারে! এত আত্মপ্রেম? এত স্বার্থপরতা?
শঙ্করদাদু হঠাৎ বললেন, ‘‘এসে গেছি অর্ক৷ নেমে এসো৷’’
অর্ক চমকে উঠে দেখল, ওরা কখন যেন পৌঁছে গেছে ইতন্ডার জমিদারবাড়িতে৷ শঙ্করদাদু রিকশা থেকে নেমে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে৷
ও তাড়াতাড়ি নেমে সামনে তাকাতেই যে বাড়িটা দেখতে পেল তেমন বাড়ি আজ অবধি ও শুধু ভূতের সিনেমাতেই এতদিন দেখেছে৷
একটা বিশাল বড় প্রাসাদ, কোনোকালে হয়তো সাদা বা ওই জাতীয় কোনো রং ছিল৷ এখন আর বোঝা যায় না, অন্তত তিনশো বছরের প্রাচীন শরীরে থাবা বসিয়েছে নির্মম জরা৷ জায়গায় জায়গায় ইট ফেটে মাথা তুলেছে মোটা মোটা অশ্বত্থের ঝুরি, নানারকম গাছের পাতা যেন গিলে খাচ্ছে গোটা বাড়িটাকে৷
অর্ক হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ এই তাহলে ইতন্ডার জমিদারবাড়ি! ওর মা এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী৷ অথচ সেই একমাত্র উত্তরাধিকারীরই থাকোগোপাল চৌধুরীর জীবদ্দশায় আসার কোনো অধিকার নেই৷
‘‘চলো অর্ক৷ ওই দ্যাখো, তোমার দাদু দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷’’ শঙ্করদাদু বলে উঠলেন৷
সাদা দামি পাথরের চওড়া সিঁড়ি গাড়িবারান্দার পাশ দিয়ে উঠে গেছে দালানে, সেখানে মোটা মোটা থামের মাঝে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাকে দেখেই মার অ্যালবামের পুরোনো ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে গেল অর্কর৷
ইনিই তবে সেই থাকোগোপাল চৌধুরী! যাঁর তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও শুধু মাতৃআজ্ঞা পালনে অর্ক এসেছে এ-বাড়িতে৷
কিন্তু এঁর যা মৃত্যুভয়, ইনি কি আদৌ অর্কর সাথে কোনো বাক্যালাপ করবেন?
৷৷দুই৷৷
দাদু বললেন, ‘‘তোমাকে আমি সূর্যনারায়ণ বলেই ডাকব৷’’
অর্ক একটু অবাক হল৷ সূর্যনারায়ণ!
‘‘কেন?’’
‘‘তোমার জন্মসংবাদ পেয়ে আমি ওই নামটাই পছন্দ করে আমাদের কূলজ্যোতিষী বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী মশাইয়ের অনুমোদন নিয়ে পাঠিয়েছিলাম৷’’ দাদু গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘কিন্তু নামটা বোধ হয় বড্ড সেকেলে, তাই তোমার বাবা-মা রাখার প্রয়োজন মনে করেননি৷’’
দাদুর কথা শুনতে শুনতে অর্কর মনে হল, দাদুর গলাটা কেমন যেন চেনাচেনা লাগছে৷ ও এর আগে কোনোদিনও ফোনেও কথা বলেনি দাদুর সাথে৷ মা রিসিভার চেপে ধরে কথা বলার সময় যা একটু অস্পষ্ট শুনতে পেয়েছে৷
সেইজন্যই কি চেনা লাগছে?
ও বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলল, ‘‘অর্ক মানেও তো সূর্যই!’’
দাদু সামান্য মাথা হেলিয়ে চুপ করে গেলেন৷
এখানে দাদু একাই থাকেন, সঙ্গে থাকে কদলীপিসি বলে একজন সারাক্ষণের রাঁধুনি আর অনন্তকাকা৷ অনন্তকাকা বাজার-দোকান আর দাদুর দেখভাল করে৷ এই এত বড় বাড়ি তিনটি মাত্র প্রাণীর বসবাসে খাঁ খাঁ করার কথা, কিন্তু করে না৷ কারণ, গ্রামের বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষই সকাল-বিকেল এসে ভিড় জমান দাদুর দুধসাদা দামি পাথরের লম্বা বারান্দায়৷ সেখানেই গল্পগুজব চলে৷ কেউ স্থানীয় স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, কেউ গ্রামের বৃদ্ধ চিকিৎসক, কেউ আবার প্রাক্তন পোস্টমাস্টার৷ জমিদারবাড়ির আয় এখনো ভালোই, বেশির ভাগটাই আসে ব্যাঙ্কের জমানো টাকার সুদ থেকে৷ এ ছাড়া পুকুরের মাছ, বাগানের সবজি এসবও অগাধ৷
এই বাড়ির দোতলায় রয়েছে একটা ঝোলা বারান্দা৷ সেখানেই এখন বসে রয়েছে অর্ক৷ ইতন্ডা গ্রামে ও এসেছে গতকাল বিকেলে, আর আজ সকালেই গ্রামের অনেকটা ও চষে ফেলেছে৷ সে এক কাণ্ড!
সকালে যখন রেডি হয়ে ও বেরোচ্ছিল, হন্তদন্ত হয়ে বৈঠকখানায় ঢুকছিলেন শঙ্করদাদু৷ ওকে দেখে বলেছিলেন, ‘‘কোথায় যাচ্ছ অর্ক?’’
‘‘এই একটু গ্রামটা বেড়িয়ে আসি!’’ অর্ক বলেছিল৷ দাদুর সঙ্গে তখনো ওর সেভাবে দেখা হয়নি৷ আগের দিন ওকে আসতে দেখে দালান থেকে নিম্নকণ্ঠে কাউকে কিছু নির্দেশ দিয়েই সরে গিয়েছিলেন দাদু৷ রাগে গা রি-রি করে উঠেছিল ওর৷
এই কি আতিথেয়তার ছিরি? ওর জন্য নির্দিষ্ট করা ঘরে সব পরিপাটি সাজানো ছিল, নৈশভোজেও ছিল এলাহি আয়োজন, তবু রাতে মাকে ফোন করে দু-কথা শুনিয়ে তবে রাগ পড়েছিল ওর৷
শঙ্কর সরকার লোকটা বেশ ভালো, দাদুর মতো নন৷ মার কাছে কথায় কথায় শুনেছিল, ওঁর জীবনটা নাকি বেশ দুঃখের৷ স্ত্রী অনেকদিন আগে হঠাৎ আত্মহত্যা করেছিলেন, ছেলে তখন একেবারেই ছোট৷ সেই ছেলেও নাকি বড় হয়ে বখে গেছে৷ তেমন কোনো যোগাযোগও রাখে না৷
সকালে ও গ্রাম বেড়াতে যাচ্ছে শুনে শঙ্করদাদু খুশিই হয়েছিলেন, ‘‘বেশ৷ ঘুরে এসো৷ তবে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসো৷ এমনিতেই আজ শাস্ত্রীমশাই আসবেন তোমাকে দেখতে, আর তা ছাড়া দিনকাল এখানে ভালো নয়৷ রাতের বেলা প্রায়ই ডাকাতি শুরু হয়েছে৷’’
শঙ্করদাদুর কথা শুনে ও বলেছিল, ‘‘ডাকাতি? এই গ্রামে?’’
‘‘হ্যাঁ, সামন্তবাড়ি আর বসুবাড়িতে গত দু-মাসে হয়ে গেছে৷ পুলিশ এসে তদন্তও করল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷’’ শঙ্করদাদু পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পালটে ফেলে বলেছিলেন, ‘‘ভালো কথা, দাদুর সাথে বন্ধুত্ব হল?’’
বন্ধুত্ব! হুঁ! নিজের নাতি এই প্রথম বাড়িতে এল, অথচ কাল রাতে দাদু ওর সাথে গল্প তো দূর, তেমন কোনো কথাই বললেন না৷ দূর থেকে শুধু অনন্তকাকা আর কদলীপিসিকে ওর খেয়াল রাখার নির্দেশ দিয়ে ওপরে চলে গেলেন৷ এ আবার কী?
যাই হোক, তারপর আজ সকালে ও দারুণ একটা মন্দির দেখে ফেলেছে ইতন্ডা গ্রামের বাইরের দিকে৷ আর সেই মন্দিরটা দেখতে গিয়েই ওর আলাপ হয়েছে বোধনদার সাথে৷
কদলীপিসি বলেছিল, ‘‘অর্কদাদাবাবু, আপনি প্রথমেই চলে যান কেশবাইচণ্ডীতলা মন্দিরে৷ তারপর নাহয় ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের ভেতরে ঢুকবেন৷’’
জমিদারবাড়ি-স্পেশাল সেই বিশাল রিকশাও এসে হাজির হয়েছিল অর্কর জন্য৷ অর্ক প্রথমে না না করছিল, এই লালমাটির দেশে পায়ে হেঁটে ঘুরতেই ও বেশি পছন্দ করে৷ কিন্তু অনন্তকাকার ক্রমাগত আপত্তিতে ওকে রিকশায় উঠতেই হয়েছিল৷
রিকশাচালক ফণি প্রথমেই ওকে নিয়ে চলে গিয়েছিল একদম গ্রামের সীমান্তের দিকে, যেখানে সবুজ ধানখেতের মধ্যে দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা চলে গেছে৷ সেখানে মন্দিরটা দেখে ও চমকে উঠেছিল৷
একী সাংঘাতিক মন্দির! এটা কি আদৌ মন্দির?
অর্ক কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল৷ হ্যাঁ, ভালো করে দেখলে সুপ্রাচীন পোড়ামাটির ইটের মন্দিরটা চোখে পড়ে বটে৷ কিন্তু মন্দিরের উপরের ভাগটা এমন কেন? এমনভাবে একটা গাছ আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে যেন মনে হচ্ছে মন্দিরটাই একটা গাছ হয়ে গেছে৷
‘‘এরকম কি করে হল ফণিকাকা?’’ কাউকে না পেয়ে অর্ক রিকশাওয়ালা ফণিকেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘গাছটা এরকম ভয়ংকর কেন?’’
ফণি গামছা দিয়ে ঘাম মুছে উত্তর দিয়েছিল, ‘‘এটাই তো কেশবাইচণ্ডীতলা মন্দির দাদাবাবু৷ আর ওটা পাকুড় গাছ৷ সেই যে সতীর শরীর এদিক-ওদিক পড়েছিল, এখানে পড়েছিল সতীর কেশ৷ ভয়ানক জাগ্রত৷ ফি বচ্ছর মেলা বসে তো ওই জন্য৷’’
ফণি কপালে দু-হাত তুলে প্রণাম ঠুকেছিল৷
অর্ক পায়ে পায়ে মন্দিরটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, রিকশাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মন্দিরের পাশ দিয়ে পেছনদিকটা চলে গিয়েছিল গাছের গুঁড়িটাকে ভালো করে দেখার জন্য, আর তখনই একটা অদ্ভুত কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছিল, ‘‘কী বুঝছ?’’
অর্ক চমকে তাকিয়েছিল৷ প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো মন্দির, কেউ কোথাও কাছেপিঠে নেই৷ একটু গা ছমছম তো করেই৷
লোকটা দূরে একটা আধভাঙা পাথরের ওপর এমনভাবে বসেছিল, যাতে মন্দিরের সামনে থেকে কেউ ওকে দেখতে না পায়৷ পরনে আধময়লা একটা পাজামা আর সবুজ-গেরুয়া মেশানো একটা ফতুয়া, মুখে বেশ কয়েকদিনের না-কাটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি৷
চোখগুলো কেমন যেন তীক্ষ্ণ৷
‘‘না এই দেখছিলাম আর কী!’’ অর্ক উত্তরটা দিয়ে আবার গাছের দিকে মনোনিবেশ করে৷
‘‘কম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট মন্দিরের নাম শুনেছ?’’ লোকটা ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল৷ লোকটার গলাটা পুরুষালি হলেও সরু ধরনের, কেমন যেন কানে লাগে শুনলে৷
অর্ক আবার লোকটার দিকে তাকিয়েছিল৷ প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল গ্রামের অর্ধশিক্ষিত লোক, এখন দেখছে তা নয়৷ ও ছোট্ট করে বলেছিল, ‘‘শুনেছি৷’’
‘‘আঙ্কোরভাটে একটা মন্দির আছে৷ তা প্রোহম নাম৷ তা প্রোহম মন্দিরেও এইরকম গাছ মন্দিরটাকে গিলে খেয়েছে৷ আসলে আমাদের বীরভূমের ল্যাটেরাইট মাটি হল খনিজে ভরা, জল পেলেই এই পাকুড়ের মতো গাছগুলো ইট আঁকড়ে ধরে৷’’ লোকটা বলতে বলতে কান খোঁচাচ্ছিল, ‘‘কলকাতার ছেলে নাকি, অ্যাঁ?’’
‘‘হ্যাঁ৷’’ অর্ক বলেছিল, ‘‘সল্টলেকে থাকি৷ আমার দাদুর বাড়ি এসেছি ঘুরতে৷’’
‘‘দাদুর বাড়ি? কোন পাড়ায়?’’
‘‘কোন পাড়ায় তা তো জানি না! ওই চৌধুরীবাড়ি আছে না, ওটাই৷’’ অর্ক বলেছিল৷
‘‘ওহ, থাকোগোপালের নাতি তুমি?’’ লোকটা এবার টেরিয়ে তাকিয়েছিল৷
একটু পরেই অর্কর ভালোমতো আলাপ হয়ে গিয়েছিল লোকটার সাথে৷ লোকটা একটু অপরিষ্কার কিন্তু বেশ জ্ঞানগম্যি আছে৷ হাঁটতে হাঁটতে বলছিল, ‘‘আমি পাশের গ্রামে থাকি কিন্তু ফাঁক পেলেই ইতন্ডায় চলে আসি৷ এখানে প্রতিটা ধুলোর কণায় জমে আছে অনেক না-জানা ইতিহাস, জমে আছে কালাপাহাড়ের আক্রমণের কথা…৷’’
‘‘কালাপাহাড় এই মন্দির আক্রমণ করেছিলেন?’’ অর্ক হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল৷ বাংলার ছাত্র হলেও ইতিহাসে ওর আগ্রহ দুর্নিবার৷
‘‘হ্যাঁ, কালাপাহাড় শুধু আক্রমণই করেননি, মন্দিরের প্রাচীন অষ্টধাতুর বিগ্রহটা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ আর শুধু কালাপাহাড় কেন, বর্গিরা তো পুরো ইতন্ডাকেই প্রায় শেষ করে দিয়েছিল৷ অজয় নদীর পাশের বন্দর, বাণিজ্য সব৷’’ লোকটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বলেছিল৷
এখন এই ঝোলা বারান্দায় দাদুর পাশে বসে সকালের কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল অর্ক, হুঁশ ফিরল দাদুর ডাকে, ‘‘সূর্যনারায়ণ, প্রণাম করো৷ বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী মহাশয়৷ এঁরা আমাদের পরিবারের বংশানুক্রমিক কুলজ্যোতিষী৷’’
অর্ক চমকে তাকিয়ে দেখল, দাদুর চেয়েও অনেক বেশি বয়স্ক এক ভদ্রলোক কখন যেন এসে বসেছেন পাশের চেয়ারটায়৷ দীর্ঘাঙ্গ নন একেবারেই, ছোটখাটো চেহারা, মাথায় ধবধবে সাদা চুল পাতলা হয়ে এসেছে, ফতুয়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে উপবীত৷ চোখের দৃষ্টিটা বেশ অন্তর্ভেদী ধরনের, মনে হয় যেন গিলে নিচ্ছেন অন্তরের সব কথা৷
অর্ক প্রণাম করতে শীর্ণ হাত ওর মাথায় রেখে আশীর্বাদ করলেন বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী, ‘‘সুখি হও৷ কর্মবীর হও৷’’ তারপর দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘তুমি কি ওকে সব খুলে বলেছ থাকোগোপাল?’’
অর্ক লক্ষ করলো, দাদু তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন৷ মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘না৷ কিছুই বলিনি৷’’
‘‘এটাই তো ভুল করছ তুমি!’’ বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী বললেন, ‘‘তোমাকে তো কবেই বলেছি আমি, ওর থেকে তোমার ক্ষতিসাধন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ ওর কুষ্ঠী পরিষ্কার, তাতে মহাপাতকী হওয়ার কোনো উল্লেখ নেই৷’’
দাদু যেন আরো নুয়ে পড়লেন, আস্তে আস্তে বললেন, ‘‘তবে আপনিই বলুন৷’’
বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী কিছু বলার আগেই অর্ক ফস করে বলে ফেলল, ‘‘আমি সব জানি৷’’
বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী একটু থমকে গেলেন, দাদুও দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকালেন ওর দিকে৷
শাস্ত্রীমশাই বললেন, ‘‘কী জানো তুমি?’’
অর্ক গড়গড়িয়ে বলে গেল বাবার থেকে শোনা ঘটনাটা৷ শেষে দাদু আছেন দেখে একটু শ্লেষ মাখিয়ে দিতেও ছাড়ল না, ‘‘আমার এটাই আশ্চর্য লাগে, একজন শিক্ষিত মানুষ কী করে এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে নিজের মেয়ের সাথে পর্যন্ত দেখা করেন না!’’
দাদুর চোখের পাতা যেন সামান্য কেঁপে উঠল৷ গম্ভীর রাশভারী মানুষটা কোনো কথা না বলে মুখ ফেরালেন বৈদ্যনাথ শাস্ত্রীর দিকে৷
শাস্ত্রীমশাই সেই স্মিতমুখেই বললেন, ‘‘দ্যাখো সূর্যনারায়ণ, মানুষ মাত্রই তো ভুল করে৷ তোমার দাদুও করেছেন৷ আসলে মৃত্যুভয় ওঁকে জড়সড় করে রেখেছিল৷ নাহলে তোমাদের সাথে এতবছর কোনো দেখাসাক্ষাৎ করেননি, এতে কি ওর নিজের কষ্ট হয়নি, বলো? তুমিই তো ওঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী, সেই কবে উনি নিজের উইল করে ফেলেছেন!’’
অর্ক বলল, ‘‘না কষ্ট হয়নি৷ বাবা আমাকে বলেছেন ছেলে থাকলে কিছু ঘটার তবু ওঁর আশঙ্কা থাকত, আমার মা একমাত্র মেয়ে, আমি একমাত্র নাতি, আমরা কী করলাম? আর তা ছাড়া…’’ বলতে বলতে ও ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘‘সে-সব নাহয় আগে করেছেন; আমাকে তো মা এবার ওঁর শরীর খারাপ শুনে জোর করে পাঠালেন, তখনো উনি বারণ করছিলেন যাতে আমি না আসি৷ সম্পত্তিই কি সব? দাদুর কোনো স্নেহ-ভালোবাসা কোনোদিন পেলাম না, শুধু সম্পত্তি সেই দুঃখ ভুলিয়ে দেবে?’’
‘‘আসলে তুমি এমন সময়ে এসেছ…!’’ বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী বলতে যাওয়ার আগেই দাদু থামিয়ে দিলেন, ‘‘থাক শাস্ত্রীমশাই ওসব কথা! আপনি ওর হাতটা একটু ভালো করে দেখে ভাগ্যটা নির্ধারণ করে দিন বরং৷ কুষ্ঠীতে তো সব জানা যায় না৷’’
‘‘আমার ভাগ্য আমি নিজেই নির্ধারণ করি৷’’ অর্ক এবার আর রাগ সামলাতে পারল না, ‘‘আপনি কুসংস্কারের ডিপো হলেও আমি নই দাদু৷’’
দাদু কেমন ঝিমিয়ে গিয়েছিলেন, এখন যেন একটু ধড়মড় করে উঠে বলার চেষ্টা করলেন, ‘‘কুসংস্কার নয় সূর্যনারায়ণ৷ ছেলের হাতে মারা যাওয়ার ব্যাপারটা কুসংস্কার বলতে পারো, কিন্তু শাস্ত্রীমশাই তন্ত্রসিদ্ধ মহাপুরুষ৷ ওঁর কথা ফলবেই৷ উনি আজ অবধি যাকে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, অভ্রান্তভাবে মিলেছে সব৷ উনি আরো একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন৷’’
অর্ক আরো উত্তেজিত হয়ে বলতে যাচ্ছিল, ‘‘এসব বুজরুকি আমি মানি না৷’’
কিন্তু হাত নেড়ে ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী, বললেন, ‘‘ভীমরাত্রি কাকে বলে তুমি জানো?’’
অর্ক ভ্রূ কুঁচকে চুপ করে গিয়েছিল৷ কালরাত্রি শুনেছে, কিন্তু ভীমরাত্রিটা কী বস্তু?
বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী আবার ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘‘ভীমরতি কথাটা শুনেছ কি?’’
‘‘হ্যাঁ৷ ভীমরতি তো বুড়োবয়সে কোনো বোকা বোকা বা হাস্যকর কাজ করলে বলে৷’’ অর্ক বলল৷
‘‘ভীমরতি কথাটা এসেছে ভীমরাত্রি থেকে৷ ভীম মানে ভীষণ আর রতি মানে রাত্রি৷’’ শাস্ত্রীমশাই চোখ বন্ধ করলেন, ‘‘মানুষের জীবনের সাতাত্তরতম বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম রাতকে বলে ভীমরাত্রি৷ পুরাণ অনুযায়ী, ওই রাতে মানুষের জীবনে একটা ভীষণ রকম পরিবর্তন আসে৷ কখনো সে শিশুর মতো অবোধ হয়ে যায় আবার কখনো কাণ্ডজ্ঞানহীন যুবকের মতো নির্বোধ আচরণ করতে শুরু করে৷ তাই আমরা বলি, বুড়োর ভীমরতি হয়েছে৷ বুঝেছ?’’
অর্ক মাথা নাড়ল৷
‘‘তোমার দাদু বংশানুক্রমিক ওই অভিশাপের হাত থেকে বেঁচে গেছেন, খুব আনন্দের কথা, কিন্তু তোমার দাদুর অদৃষ্টে ভীমরাত্রিতে অন্য এক মারাত্মক ফাঁড়া আছে৷ সেই ফাঁড়া পার হওয়া খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার৷’’ বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী বললেন, ‘‘আগামী পরশু তোমার দাদুর জীবনের সেই ভীমরাত্রি৷ বুঝতেই পারছ, এ-নিয়ে উনি নিজে তো বটেই, আমরাও কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছি৷ সেইজন্যই এইসময় তোমাকে উনি আসতে বারণ করেছিলেন৷ আর কোনো কারণ নেই৷’’
৷৷তিন৷৷
অর্ক বলল, ‘‘এই মন্দিরটা পুরো বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা মন্দিরের মতো৷ মাধ্যমিক দিয়ে বিষ্ণুপুর ঘুরতে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম৷’’ মোবাইলের ক্যামেরাটা বের করল ও, ‘‘দেখি একটা ছবি তুলে রাখি৷’’
বোধনদা মন্দিরের সামনেই দাঁড়িয়েছিল৷ হাতে সে একটা আখ নিয়ে এসেছিল, সেটা কিছুটা করে চিবোচ্ছিল, কিছুটা করে ছিবড়ে থু থু করে মাটিতে ফেলছিল৷ বলল, ‘‘এহে! এই অবস্থায় ছবি তুললে?’’
‘‘আরে তুমি তো গৌণ!’’ হেসে বলল অর্ক, ‘‘মন্দিরের পাহারাদার টাইপ লাগছে তোমায়৷ হা হা! এই ছবিটার ক্যাপশন হওয়া উচিত ইতন্ডায় ছোট বিষ্ণুপুর, সামনে দাঁড়িয়ে অবোধ মজদুর!’’
বোধনদা হাসতে হাসতে বলল, ‘‘এটা কিছুটা বিষ্ণুপুরের আদলে৷ পুরোটা কিন্তু নয়৷ বিষ্ণুপুরের মতো এর মধ্যিখানে কোনো চূড়া নেই দ্যাখো৷ এটা এখানকার আরেক পুরোনো মন্দির৷ হড়কা কালী মন্দির বলে এটাকে৷’’
‘‘হড়কা বান শুনেছি নদীতে৷’’ অর্ক বলল৷
অর্ক আজ গ্রামের ভেতরটা ঘুরে দেখছিল৷ এই বোধন বলে লোকটাকে ওর বেশ পছন্দ হয়ে গেছে৷ ভাবগতিক কিছুই বোঝা যায় না, সেদিন বলে রেখেছিল আজ ঘুরতে বেরোবে, কোথা থেকে ভোজবাজির মতো যেন হাজির হল৷
‘‘হড়কা এসেছে হাড়কাটা থেকে৷ দু-আড়াইশো বছর আগে এখানে সাংঘাতিক সব ডাকাত থাকত, তারা শবসাধনাও করত৷ তাদের বলত হাড়কাটা ডাকাত৷ তারাই এই মন্দিরটা তৈরি করেছিল৷ এই মন্দির নিয়ে অনেক রোমহর্ষক ঘটনাও আছে, আরেকদিন বলব’খন৷’’
শবসাধনা? অর্ক মনে মনে ভাবল, যে তান্ত্রিক দাদুর পূর্বপুরুষ ওই নিত্যবিনোদ চৌধুরীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তিনিও কি তাহলে আসলে ডাকাত ছিলেন?
বোধনদা বলল, ‘‘তারপর? দাদুর সঙ্গে ঝামেলা মিটেছে?’’
অর্ক বেজার মুখে বলল, ‘‘ধুস! আমার মেটানোর কোনো ইচ্ছেই নেই৷ এই সপ্তাহটা থাকব, তারপর ব্যাক টু কলকাতা৷ মা জোর করেছিলেন বলে এসেছিলাম, সে-পাট চুকেবুকে গেছে৷’’
‘‘যাওয়ার আগে ভালো করে ঘুরে দেখে যেও৷ তোমরা সব বড়লোকের ছেলে, কলকাতার জল-হাওয়ায় মানুষ, এই গণ্ডগ্রামে তো বারবার আসতে ইচ্ছে করবে না৷’’ বোধনদা বলল, ‘‘থাকোগোপাল চৌধুরীর ওই জমিদারবাড়িতে নাকি অনেক ব্রিটিশ আমলের সোনার পয়সা আছে৷ সে-সব দেখে যেও৷ কেন তোমাকে কিছু দেখায়নি তোমার দাদু?’’
‘‘না তো!’’
‘‘সেকী গো, সব দেখেশুনে নাও৷ তুমি হলে একমাত্র বংশধর, দাদু কী রেখে যাচ্ছে জানবে না?’’ বোধনদা একটা বিশ্রী ঢেকুর তুলে বলেছিল৷
এমনিতে অর্কর এই বোধনকে খারাপ লাগে না, কিন্তু কেন জানে না, এই বৈষয়িক কথাটা ওর শুনতে ভালো লাগল না৷ কিন্তু ও আর কথা বাড়াল না এই নিয়ে৷ হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল, আজ তো বৃহস্পতিবার৷ আজকের দিনটা পেরোলেই দাদুর সেই কী একটা ফাঁড়া আছে৷ শাস্ত্রীমশাই ওকে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছেন!
ও কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক কথা বলে বোধনদার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল৷
সেদিন শাস্ত্রীমশাইয়ের মুখে সবকিছু শুনে ওর বিরক্তি লেগেছিল৷ মনে হয়েছিল, অলৌকিকত্ব, কুসংস্কার এঁদের জীবনে এমনভাবে জাঁকিয়ে বসেছে যে কেউ চেষ্টা করলেও এঁদের তা থেকে মুক্ত করতে পারবে না৷ অলৌকিকত্ব, বুজরুকি এঁদের যুক্তিবোধকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে৷
অর্ক বাড়িতে ঢুকে বেজারমুখে বলল, ‘‘ও কদলীপিসি, কই গেলে গো, খেতে দাও৷ আমি হাত ধুয়ে খাওয়ার ঘরে বসছি৷’’
কদলীপিসি হন্তদন্ত হয়ে নীচের ভাঁড়ারঘর থেকে বেরিয়ে এল, ‘‘এই তো ছোটদাদাবাবু এসে গেছে৷ আমরা তাই তখন থেকে ভেবে ভেবে সারা হচ্ছি, দুপুর তিনটে বাজতে চলল, খাবে কখন?’’
‘‘মন্দির ঘুরতে ঘুরতে দেরি হয়ে গেল৷’’ অর্ক হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসতে যাচ্ছিল, ‘‘দাদু কোথায়?’’
‘‘উনি নিজের ঘরে৷ আজ ওঁর শরীর খারাপ, কিছু খাবেন না৷ দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন৷’’
শরীর খারাপ না ছাই, অর্ক মনে মনে ভাবল৷ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে এখন মরে যাওয়ার ভয়ে ঘরে ঢুকে রয়েছে৷ যত্তসব!
কদলীপিসি ভাত বাড়তে বাড়তে নীচুগলায় বলল, ‘‘আচ্ছা তুমি নাকি হড়কা কালীমন্দিরে শেখরের সাথে কথা বলছিলে?’’
‘‘শেখর? সেটা আবার কে?’’ অর্ক প্রথম গ্রাস মুখে পুরে বলল, ‘‘আমি তো বোধনদার সাথে গিয়েছিলাম৷’’
‘‘ওই তো, ওই বোধনেরই ভালো নাম শেখর৷’’ কদলীপিসি আরো ঝুঁকে এল, ‘‘ওর সাথে একদম মিশো না৷ শঙ্করজ্যাঠার ছেলে তো৷’’
‘‘শঙ্করজ্যাঠা মানে? কোন শঙ্করজ্যাঠা?’’ অর্ক ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘দাদুর বন্ধু শঙ্করদাদু? পাশের বাড়িতেই যিনি থাকেন?’’ ওর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল মা-ও এই শেখরদা-র গল্প করেছিলেন৷ ছেলেটা নাকি ছোটবেলায় পড়াশোনোয় ভালো ছিল৷ কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর বখে যায়৷
‘‘হ্যাঁ, তবে আর বলছি কী!’’ কদলীপিসি প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, ‘‘শেখর খুব বাজে ছেলে৷ বাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না৷ বাজে দলে মেশে, পুলিশের নজর আছে ওর ওপর৷ থাকে ইতন্ডার বাইরের একটা গ্রামে৷ কী করে তোমার সাথে আলাপ হল, এটাই তো আমরা ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি৷’’ কপালে হাতদুটো তুলে নমস্কার করল কদলীপিসি, ‘‘অমন দেবতুল্য মানুষের কী বাজে ছেলে, ছ্যা ছ্যা!’’
অর্ক খাওয়াদাওয়া সেরে নিজের ঘরে এসেও বিস্ময়ভাবটা মুছতে পারছিল না৷ বোধনদা তো ওকে একবারও বলল না যে ও-ই শঙ্করদাদুর ছেলে! অথচ বোধনদা খুব ভালো করে জানে যে অর্ক থাকোগোপাল চৌধুরীর নাতি৷
* * * *
থাকোগোপাল প্রায় তিনঘণ্টা ধরে শুয়েছিলেন, কিন্তু চোখে একফোঁটা ঘুম আসছিল না৷ থেকে থেকে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, উশখুশ করছিলেন তিনি৷
অনন্ত রোজকার মতো আজও বাইরের দালানে শুয়ে আছে৷ এরমধ্যে দুবার এসে সে কর্তামশাইকে দেখে গেছে৷ সকাল থেকে তারও চিন্তা কিছু কম হয়নি, বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন থাকোগোপাল৷
থাকোগোপাল টেবিল থেকে হাতঘড়িটা তুলে সময়টা দেখলেন৷ এগারোটা বেজে দশ মিনিট৷ তিনি আবার শাস্ত্রীমশাইয়ের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করলেন৷ আজই তাঁর সাতাত্তর বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম রাত্রি৷ কিন্তু সেই রাত্রি এখনকার মতো রাত বারোটায় শেষ নয়৷ ভীমরাত্রি মানা হত পুরোনো দেশি একক প্রহরে৷ ঘুম যখন আসছেই না, থাকোগোপাল অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে শাস্ত্রীমশাইয়ের শিখিয়ে দেওয়া অনুযায়ী হিসেব করার চেষ্টা করতে লাগলেন৷
শাস্ত্রীমশাই বলেছিলেন, অষ্টপ্রহর মানে এক দিন৷ তার মানে, এক প্রহর মানে হল গিয়ে তিনঘণ্টা৷ তুলসীদাস তো লিখেই গিয়েছেন,
‘‘প্রথম প্রহরে সবাই জাগে, দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী৷
তৃতীয় প্রহরে তস্কর জাগে, চতুর্থ প্রহরে যোগী৷’’
প্রহর ব্যবস্থায় দিন আরম্ভ হত সকাল ছ-টায়, আর রাত সন্ধে ছ-টা৷ তার মানে তাঁর জীবনের ভীমরাত্রি শুরু হয়েছে সন্ধেবেলাতেই, আর তা শেষ হবে গিয়ে ভোর ছ-টায়৷
থাকোগোপাল আবার ঘড়ি দেখলেন, রাত সাড়ে বারোটা৷ আর সাড়ে পাঁচঘণ্টা কাটলেই জীবনের এই ফাঁড়া থেকেও তিনি মুক্ত হবেন৷
‘‘সব যখন কেটেছে, এটাও কেটে যাবে৷ ঠিক কেটে যাবে৷’’ নিজের মনেই নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি৷ একটু বাথরুমে যাবেন৷
ঘর থেকে বেরিয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা অনন্তকে আর জাগালেন না থাকোগোপাল৷ থাক, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক৷
বাইরে আজ পূর্ণিমা৷ চাঁদের আলো ঝকঝক করছে চওড়া দালানে৷
থাকোগোপাল ধীরগতিতে হাঁটতে লাগলেন বাথরুমের দিকে৷ মুখে তাঁর প্রসন্ন হাসি৷ গত দেড়শো বছরে ইতন্ডার কোনো পুরুষ যা পারেননি, তিনি তা করে দেখিয়েছেন৷ নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করে জীবনটাকে এত দীর্ঘায়িত করেছেন তিনি৷ হ্যাঁ, এতে হয়তো নিজের মেয়ে, জামাই, নাতি, সর্বোপরি স্ত্রীর কাছে চরম স্বার্থপর হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন৷ সুকুমারীর চোখে মৃত্যুশয্যাতেও তিনি একরাশ ঘৃণা দেখেছিলেন৷ শেষ কয়েক বছর ভালো করে কথাই বলেনি সে৷
চাঁদের নরম আলোয় দালানে থাকা মেহগনি কাঠের আসবাবগুলো কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছে৷ প্রতিটা চেয়ার, টেবিলকে মনে হচ্ছে যেন জ্যান্ত কোনো প্রাণী৷ সেদিকে দেখতে দেখতে থাকোগোপালের হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, সুকুমারী কি কিছু আঁচ করেছিল? বিশেষত দ্বিতীয় বাচ্চাটার মৃত্যুর পর?
থাকোগোপালের এত বছর পরেও মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল৷ না, তা সম্ভব নয়, সেই বেদেটার খোঁজ অনন্ত ছাড়া কেউ জানত না৷ আর অনন্ত মরে গেলেও বিশ্বাসঘাতকতা করার লোক নয়৷
থাকোগোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ নাতির চোখেও নিজের প্রতি সেই শ্রদ্ধা তিনি এই কয়েকদিনে দেখেননি৷ কিন্তু কেউ কেন তাঁর দিকটা বোঝে না? সবার ওপরে তো তাঁর নিজের জীবন, নিজের চাহিদা! আর প্রথম দুটো অন্যায়ের অপরাধবোধের জন্যই তো সুকুমারী চলে যাওয়ার পর কন্যা দেবযানীর প্রতি তিনি অতটা কঠোর হতে পারেননি, শুধু দূরে সরিয়ে দিয়েছেন মাত্র৷ আর তা ছাড়া নিজে বাঁচতে গিয়ে এই অভিশাপটাকেও তো তিনিই শেষ করলেন! তান্ত্রিক তো বলেই গিয়েছিলেন অপুত্রক জমিদার হলে তবেই অবসান হবে এই অভিশাপের৷ এটা কি ভালো কাজ নয়?
বাঁ চোখের পাতাগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠল থাকোগোপালবাবুর৷ ঘর ছেড়ে আসার সময় পাতলা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলেই হত, কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে৷ বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে থাকোগোপাল ভাবলেন, যতদিন শক্তসমর্থ আছেন, এভাবেই নিজের শর্তে বাঁচবেন, কে কী ভাবল সেই ভয়ে নয়৷ কোনোদিনও কারুর পরোয়া করেননি, আজও করবেন না৷
বাথরুমে ঢোকার সময় থাকোগোপাল অন্যমনস্ক ছিলেন তাই, না হলে দেখতে পেতেন, বাথরুমের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় এক মানুষ লম্বা ব্রোঞ্জের স্ট্যাচুটার পেছনের জমাট অন্ধকারটা কেমন যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে৷
কী যেন প্রবলভাবে নড়াচড়া শুরু করেছে সেখানে৷
বাথরুম থেকে বেরোনোর পর থাকোগোপাল আর সময় পেলেন না৷ ঠিক রাত বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে তাঁর নিশ্বাস হঠাৎ বন্ধ হয়ে এল, প্রাণপণে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে তিনি টের পেলেন একজোড়া লোহার মতো হাত পেছন থেকে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে তাঁর গলা৷
জ্ঞান হারাতে হারাতে এক মুহূর্তের জন্য তিনি টের পেলেন চারপাশে চাপা ফিসফিসানিতে চলাফেরা করছে কয়েকজন৷
সেদিন রাতে ইতন্ডার জমিদারবাড়িতে ডাকাত পড়ল৷ নৃশংসভাবে নিজের জীবনের ভীমরাত্রিতে খুন হলেন থাকোগোপাল চৌধুরী৷
৷৷চার৷৷
অর্ক শুয়েছিল অন্যদিকের মহলে, সকাল অবধি ও কিছুই টের পায়নি৷ তার কারণ ডাকাতরা গোটা বাড়ির কোনো জায়গাই লুঠ করেনি, শুধু তছনছ করেছে ওর দাদুর ঘরটা৷ থাকোগোপাল চৌধুরীর ঘরে পালঙ্কের পাশেই যে কারুকাজ করা দেরাজটা ছিল, সেটা পুরো লন্ডভন্ড করা৷ জামাকাপড় ছাড়া তাতে আর কিছু নেই৷ এমনকি ভেতরের ভল্টটাও হাঁ মুখ করা৷
থাকোগোপালের মৃতদেহটা পড়েছিল বাথরুমের সামনে৷ তিনি বোধহয় শেষমুহূর্ত পর্যন্ত বাধা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর গলায় নির্দয়ভাবে আড়াআড়ি ছুরির পোঁচ টেনে দিয়েছে ডাকাতরা৷ সারা শরীরে লড়াইয়ের ছাপ স্পষ্ট৷
দাদুর চল্লিশ বছরের পুরোনো ভৃত্য অনন্তকে ঘরের সামনেই পাওয়া গেল৷ যদিও শক্ত দড়িতে তার হাত-পা বাঁধা, মুখের মধ্যে গোঁজা একটা নোংরা ন্যাকড়া৷
কদলীপিসি এসে হাউমাউ করে খবর দেওয়ার পর থেকে গত একঘণ্টায় অনেক কিছু হয়ে গেছে৷ অর্ক দিশেহারা অবস্থায় ছুটে গিয়ে ডেকে এনেছে শঙ্করদাদুকে৷ এসেছেন আরো কিছু প্রতিবেশী৷ সবার মুখেই বিস্ময়, অবিশ্বাস৷
অনন্তকে একটু ধাতস্থ করিয়ে বসানো হয়েছে বৈঠকখানায়, তবে তার আতঙ্ক এখনো কাটেনি, নিজের মনেই সে কিছু বিড়বিড় করে চলেছে৷ চোখ দিয়ে মাঝেমাঝেই গড়িয়ে পড়ছে জল৷
বাবা-মা অর্কর ফোন পাওয়া মাত্র কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছেন৷ দেবযানী সম্ভবত ভাবতেও পারেননি, এতগুলো বছর ধরে যে কারণে ইতন্ডায় তাঁর নিজের বাড়িতে আসাতে ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা, আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে আসতে হবে তাঁকে৷ এত বছরের নিষেধাজ্ঞা তাঁর ওপর আরোপিত ছিল যাতে থাকোগোপাল বেঁচে থাকতে পারেন৷ আর আজ সেই মানুষটাই নেই৷
বৈদ্যনাথ শাস্ত্রী যখন এলেন, তার কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ এসেছে৷ শাস্ত্রীমশাই এসে কাউকে ডাকলেন না, থাকোগোপালের দেহটা দেখতেও গেলেন না, শুধু শূন্যদৃষ্টিতে অস্ফুটে একবার বললেন, ‘‘ভবিতব্য কে খণ্ডাবে!’’ তারপর গিয়ে বসলেন বাইরের বাগানে৷
শান্তশিষ্ট পাড়াগাঁয়ে একটু কিছু ঘটলেই চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে এ তো খোদ জমিদারবাড়ি৷ গোটা ইতন্ডা গ্রাম এরমধ্যেই ভেঙে পড়েছে জমিদারবাড়িতে, তাদের শেষ জমিদারকে দেখবে বলে৷ পুলিশের কনস্টেবলরা অবশ্য তাদের কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না, অর্ক যে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে প্রথমবারের জন্য ঢুকেছিল এই অট্টালিকায়, তার নীচটায় দাঁড়িয়ে সবাই জটলা পাকাচ্ছে ইতিউতি৷
অর্ক বারান্দায় বসে বিহ্বলভাবে তাকিয়েছিল বাইরের বাগানের দিকে৷ ভেতরে ভেতরে কেমন যেন এক অপরাধবোধ এসে কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে ওকে৷
পুলিশের লোক ভেতরে ছবি তুলছে, সিজ করছে ঝপাঝপ৷
সেদিকে তাকিয়ে অর্কর মনে হল দাদুর এই মৃত্যুর জন্য কি পরোক্ষভাবে ও-ও দায়ী নয়? দাদু তো বহুবার বারণ করেছিলেন ওকে আসতে৷ মানুষটা নিজের বাঁচার জন্য যাই করে থাকুন জীবনে, অর্কদের তো কোনো ক্ষতি করেননি৷ তিনি শুধু প্রাচীন এক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চেয়েছিলেন নিজের মতো করে জীবনটা বাঁচাতে৷ অর্ক সেই ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে জোর করে এখানে এসেই কি কাণ্ডটা ঘটাল?
কিন্তু শাস্ত্রীমশাইয়ের সেই কথাটা ওর আবার মনে পড়ে গেল, ‘‘অর্কর থেকে তোমার ক্ষতিসাধন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই থাকোগোপাল!’’
শাস্ত্রীমশাই যাই বলে থাকুন, ছলছলে চোখে ও ভাবল, ও-ই দায়ী দাদুর এই অবস্থার জন্য৷ এতবছর ও আসেনি, কিচ্ছু হয়নি, এবারেও জোর করে না এলে কিছুই হত না৷
স্থানীয় থানার ওসি স্বয়ং এসেছেন, তিনি এগিয়ে এসে অর্ককে বললেন, ‘‘কাজের লোকেদের পালা চুকলে আপনাকে ক-টা কথা জিজ্ঞেস করব৷’’
‘‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই৷’’ অর্ক মাথা নাড়তে যাবে, এমন সময় দেখতে পেল একটা কনস্টেবল দাদুর ঘর থেকে একটা জামার ছেঁড়া টুকরো তুলে নিয়ে আসছে, ‘‘স্যার! এইটা ভিক্টিমের হাতে ধরা ছিল৷ খুনিকে খামচে ধরতে গিয়ে ছিঁড়েছে মনে হচ্ছে স্যার৷’’
দূর থেকে জামার টুকরোটা দেখেই অর্ক কেমন স্থবির হয়ে গেল৷ এই মেরুনের ওপর সবজেটে প্রিন্টের জামাটা যেন ওর বড্ড চেনাচেনা লাগছে!
ওসি কী বললেন সেটা ওর কানে আর ঢুকল না, কারণ ততক্ষণে ও নিজের মোবাইলে গতকাল সকালেই হড়কা কালীমন্দিরের সামনে তোলা ছবিটা খুলে ফেলেছে৷
ওর মস্তিষ্ক সম্ভবত অনেকক্ষণ ধরেই কিছু একটা বার্তা পাঠাতে চাইছিল, ও ঠিক ধরতে পারছিল না৷ এখন ও আর অপেক্ষা করল না, প্রায় উল্কার গতিতে ছূটে গেল বাড়ির ভেতরে৷ উদভ্রান্তের মতো খুঁজতে শুরু করল কদলীপিসিকে৷
পুলিশের লোকদের মাঝে ও চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ‘‘কদলীপিসি! কদলীপিসি-ই! কোথায় গেলে তুমি?’’
কয়েকবারের হাঁকডাকের পর একতলার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল কদলী, সে ভারাক্রান্ত মুখে চা বসিয়েছিল পুলিশদের জন্য৷
অর্ক ছুটে গেল ওর কাছে, ‘‘এই ছবিটা দ্যাখ তো? চিনতে পারছ একে?’’
কদলীপিসি দেখে অস্ফুটে বলল, ‘‘এই তো শেখর!’’
অর্কও চিনতে পারছিল৷ বোধনদা ওরফে শঙ্করদাদুর ছেলে শেখরকে৷ সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারছিল দাদুর সঙ্গে প্রথম কথা বলার দিন কেন দাদুর কণ্ঠস্বর ওর খুব চেনা লেগেছিল৷ সেদিন সকালেই যে ও কেশবাইচণ্ডীতলায় শুনে এসেছিল সেই এক ও অভিন্ন পুরুষালি অথচ সরু কণ্ঠস্বর৷
বোধনদার গলায়৷
দুজনের কণ্ঠস্বরে আশ্চর্য মিল, শুধু তাই নয়৷ অর্ক ব্যাক ক্যালকুলেশন করার কায়দায় হিসেব মেলাতে লাগল মনে মনে, বোধনদার উড়নচণ্ডী চেহারাটার আড়ালে যেন লুকিয়ে আছে দাদুরই কাঠামোটা! সেই তীক্ষ্ণ চোখ, সেইরকমই গড়ন!
ও আর কিছু ভাবতে পারছিল না৷ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো মাথায় ঘুরছিল দুঃস্বপ্নগুলো৷
শঙ্করদাদুর স্ত্রীর আত্মহত্যা কি এই অবৈধ সন্তান জন্ম দেওয়ার অনুতাপের কারণে? দাদু কি জানতেও পারেননি নিজে একের পর এক শিশুপুত্র হত্যা করে বাঁচার চেষ্টা করলেও বাড়ির পাশেই তাঁর পাপের চিহ্নস্বরূপ বেড়ে উঠছে প্রকৃত হত্যাকারী? নিজের এই জারজ সন্তান সম্পর্কে নিশ্চয়ই তিনি অবহিতই ছিলেন না৷ থাকলে একেও বাঁচিয়ে রাখতেন না৷ আর শঙ্করদাদুর স্ত্রীও বোধ হয় সেই ভয়েই আসল সত্যিটা কোনোদিনও প্রকাশ করেননি!
অর্ক মাথার দু-পাশের রগ টিপে ধরল, দাদু কি কল্পনাতেও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন একই রাতে অব্যর্থভাবে সত্যি হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা সেই তান্ত্রিকের অভিশাপ আর তাঁর নিজের নিয়তি?
কদলীপিসি হাঁ করে অর্কর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু ও আর কিছু বলল না৷ ক্লান্তশরীরে সরে এল রান্নাঘর থেকে৷
ইতন্ডার সুপ্রাচীন জমিদারবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী ভগ্নমনে হাঁটা দিল বাইরের দিকে৷ বিদ্যুৎচমকের মতো ওর মনে হল, নিত্যবিনোদ চৌধুরীকে দেওয়া দেড়শো বছরের অভিশাপ কি আদৌ শেষ হল? না সেটা এখনো চলবে!
ভবিষ্যৎই উত্তর দেবে!
—