ভি সি আর
রুরু কোথায় গেছে?
সীমা বারান্দায় এলে সৌম্য জিজ্ঞেস করল।
বাঃ। জন্মদিনের পার্টিতে গেল না।
ও। কার যেন জন্মদিন?
সাঙ্গেনারিয়া।
অদ্ভুত সারনেম ত।
অদ্ভুতের কী আছে। মাড়োয়ারি! কতরকম উদ্ভট উদ্ভট সারনেমওয়ালা ছেলে আছে রুরুদের স্কুলে। কসমোপলিটান ব্যাপার!
এই স্কুলই, ছেলেটার বারোটা বাজাবে! তোমাকে বলেছিলাম।
তুমি বললে তো আর হবে না। আজকাল আবার বাংলা মিডিয়াম স্কুলে কেউ ছেলেকে দেয় নাকি? পাগলের মতো কথা। প্রথমে মিস বি হার্টলি অথবা মন্ট গ্রেস। তারপর লা মার্ট, সেন্ট। জেভিয়ার্স। নয়তো ডনবসকো। স্কুলিংই তো আসল। মানুষ না হয়ে তোমারই মতো বাঁদর হয়েই থাক, তাই ইঞ্জতো তো তুমি চাও।
এই জন্যেই তো আমার রাগ ধরে যায়। কলকাতার ক-টা বাঙালি মা-বাবা ছেলেদের এই সব স্কুলে দিতে পারেন? যাঁরা পারলেন না, তাঁদের ছেলেমেয়েরা সব বাঁদর হয়ে গেল? বাঁদর হলে, এসব স্কুলেই বেশি হবে। বেশি হয়। সেটা, স্কুলের দোষে অবশ্য নয়। মা-বাবারই দোষে। বন্ধুবান্ধবদের দোষে। যত বড়লোকের ছেলেদের আড্ডা এই সব স্কুলে।
বড়োলোক যাঁরা হন, তাঁরা সব বড়োমানুষও তো বটে! না কি, টাকা থাকাটাই অন্যায়ঞ্জ, তোমার মতে?
মনুষ্যত্ব, বিদ্যা-বুদ্ধি, সম্মান এসবের সঙ্গে রোজগারের আজকাল কোনোই সম্পর্ক নেই। বরং, যাঁদের এসব আছে তাঁদেরই পয়সা নেই। সেসব ছিল আমাদের ছেলেবেলায়। যে মানুষেরা গাড়ি চড়তেন, তাঁদের মধ্যে সামান্য কিছু যে কালোবাজারি-টাজারি ছিল না তা নয়ঞ্জ, ছিল। কিন্তু। বেশিরভাগই সম্রান্ত। প্রফেসার, ডাক্তার, জজ, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার। আর আজকাল। চোর জোচ্চোর, ফুচকাওয়ালা, পানওয়ালাও গাড়ি চড়ে। পয়সা এখন বাজে লোকদেরই হাতে। অঢেল ক্যাশ। সেইজন্যেই এই কথা বলা।
তোমার যত সব ব্যাকডেটেড আইডিয়া। আশ্চর্য সব থিওরি। শুনলেও হাসি পায়।
সীমা বলল।
তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, ওই তো গাড়ির আওয়াজ পেলাম একটা। ও শঙ্কুর গাড়িতে গেছে। শঙ্কুই নামিয়ে দিয়ে যাবে। রবিবারে তো আর গাড়ি পাওয়ার জো নেই তোমার। কী আর করব। কপাল!
বলেই, বারান্দায় গেল।
গাড়িটা তো আমার নয়। অফিসের গাড়ি। তা ছাড়া, রামখেলানও তো একটা মানুষ, না কি! সপ্তাহে একটা দিন ছুটি তো ওরও দরকার? বউ আছে, ছেলে-মেয়ে আছে।
দ্যাখো! বেশি সি-পি-এম-গিরি কোরো না। দরদে বাঁচে না। অনেক কমিউনিস্ট আমার দেখা আছে। ভণ্ডামি যত।
বারান্দায় বসে বসেই দেখল যে, গাড়িটা থামল। খুব বড়ো ঝকঝকে গাড়ি একটা। কন্টেসা বোধ হয়। গাড়ি থেকে রুরু নামল। হাত তুলে বলল, বাই-ই-ই…। তারপর খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে দৌড়ে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে।
সীমা বলল, কই? এদিকে আয়? কী হল, বল?
সীমার, তার সুন্দর সপ্রতিভ ছেলেকে নিয়ে খুবই গর্ব।
কী আবার হবে! ভিডিয়োতে ছবি দেখলাম।
বিরক্ত মুখে বলল রুরু।
ভাড়া করে এনেছিল? ভিডিয়ো ক্যাসেট রেকর্ডার?
না, না। কিনেছে সাঙ্গেরিয়া। জাপানি। গ্রেট! সৌম্য বলল, কী ছবি দেখলি?
জেমস বন্ডের। দারুণ!
গাড়িটা কী গাড়ি রে? শঙ্কুদের?
সীমা জিজ্ঞেস করল।
ইদানীং সীমা কেমন যেন হ্যাংলা হ্যাংলা হয়ে গেছে। লক্ষ করে সৌম্য। লক্ষ করে, দুঃখিত হয়।
মার্সিডিস। ডিজেল। এয়ারকন্ডিশন্ড। চড়তে যে কী আরাম না!
সৌম্য জিজ্ঞেস করল, শঙ্কুর বাবা কী করেন? কখনো গেছিস ওদের বাড়ি?
বাঃ যাব না? কত্তবার। ফ্যান্টাস্টিক বড়োলোক। বাড়িতে রুফ গার্ডেন আর সুইমিং পুল আছে। হাওড়ায় কীসব ফাউন্ড্রি-টাউন্ড্রি আছে। এক্সপোর্ট করেন। এই তো শঙ্কু ঘুরে এল ইয়োরোপ এবারের গরমের ছুটিতে। ফ্রাঙ্কফুর্ট, জুরিশ, জিনিভা, কোপেনহাগেন! ছবি দেখিয়েছে আমাদের।
বাঃ। দেশ দেখার মতো শিক্ষা আর বেশি নেই। যদি দেখার চোখ নিয়ে দেখে কেউ।
সৌম্য বলল।
যাচ্ছি মা আমি।
ছটফটে রুরু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল।
কোথায়?
বাঃ একটু টিভি দেখব না। আজ তো রবিবার। হাম কীসিসে কম নেহী দেখাবে।
ওমা! তাই-ই বুঝি। আমি আজ লেক প্লেস-এ যাব ভেবেছিলাম তাই-ই আর লক্ষ করিনি।
যা যা তুই গিয়ে খোল। আমি আসছি।
রুরু চলে গেলে সীমা বলল, চলো না, তুমিও একটু দেখবে। মনটা চাঙ্গা হয়ে যাবে। কী যে বুড়োদের মতো গোমড়ামুখ করে বসে থাকো সবসময় আর বই পড়ো। রুরুকে কিছু বলি না। যা পড়ার চাপ না বেচারিদের। ওরা যা শিখেছে এই অল্পবয়সে, এম এ পাশ করেও আমরা শিখিনি। তা। তুমি নিজেও আনন্দ করো না, অন্যে করলেও রেগে যাও।
যার হাতে আনন্দ সীমা! তুমি যাও। সুপ্রিয় একটা খুব ভালো বই দিয়েছে। র্যাগটাইম। পড়ব।
তোমার হয়ে গেলে আমাকে দিও।
দেব। কিন্তু চুপ করে বসে বই পড়ার সময় কি হবে তোমার? এ জীবনে?
হবে। হবে। বলেই সীমা উঠে গেল, হাম কীসিসে কম নেহী দেখতে। দ্ব্যর্থক কথাটা সীমার মাথার উপর দিয়েই চলে গেল। দুঃখ হল সৌম্যর। দু-কারণে।
ও বারান্দাতে বসেই রইল। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না ওর। হয় ও নিজে বদলে গেছে, ভীষণভাবেঞ্জ, নয়ত বদলে গেছে ওর চারপাশের পৃথিবী। বদলানো ভালো। না-বদলানো মানেই তো স্থবিরতা। সেকথা না মানার মতো অশিক্ষিত ও নয়। তবে, বদল বা পরিবর্তনটা কোন দিকে, কী জন্য? সেটাও ওর কাছে মস্ত বড়ো। যে পরিবর্তন ওর চোখে পড়ে, ঘরে-বাইরেঞ্জ, সেটা শুভ তো নয়ই, কিন্তু সেটা যে একেবারে অর্থহীনও একথাই বার বার মনে হয় ওর। সৌম্য, খুব সম্ভব। অকালেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। কে জানে! সবাই-ই কি তাদের ভাবনার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি? কেউই যে ভাবে না, তা অবশ্য নয়। কিন্তু সকলেরই ভাবনা, চিন্তা, বুদ্ধি, মেধা, পরিশ্রম সব কিছুই যেন আজ টাকা, আরও টাকার দিকে মুখ করে আছে। মানুষ যে মানুষইঞ্জ, সৃষ্টির অন্য সমস্ত জীবের থেকে যে তার অনেকই তফাত ছিলঞ্জ, তফাত থাকার কথা ছিল, এই কথাটাও বোধহয় মানুষ ভুলে গেছে আজকাল। পুরোপুরি। এক আশ্চর্য সময় এখন।
ভাবে, সৌম্য।
পাশের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুরুরই সমবয়সি, সেন সাহেবের ছেলে কানু তার পরের বাড়ির পুলিকে ভিডিয়ো ক্যাসেট বদলাবদলি করার কথা বলছিল। পপ-মিউজিকের ছবি। গলির শেষে। যে মাল্টি-স্টোরিড বাড়িটা হয়েছে নতুন, তার নীচে, একটি ভিডিয়ো ক্যাসেটের লাইব্রেরি হয়েছে। সারাদিন, বিশেষ করে ছুটির দিনঞ্জ, গাড়ির পর গাড়ি এসে থামে। বেশিই অবাঙালি। অল্পবয়সি, আহ্লাদি সব যুবক-যুবতীরা নামে। ভাব দেখে মনে হয়, খোকা-খুকু। এদের দেখে। বোঝাই যায় না এরাও কলকাতার বাসিন্দা। এ শহরে কোনো মানুষকে আদৌ খেটে খেতে হয় না বা কারো কোনো দুঃখকষ্ট আছে। যেন অন্য গ্রহর প্রাণী এরা। যে-গ্রহের দিকে সৌম্য এবং সৌম্যর সমাজ দ্রুত ছুটে চলেছে অনুক্ষণ। সব তারকা পরিহরি এক তারকা লক্ষ করি সকলেই বাণিজ্যেতে যাচ্ছে আজকাল। বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী!
একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল নীচে। খুকু নামল। হ্যাঁ। খুকুই তো। সঙ্গে বীরেশ। সৌম্যর মাসতুতো বোন খুকু। বীরেশ সি এম ডি-এর অফিসার। সাত বছরের মধ্যে সল্ট লেক-এ বাড়ি করেছে। গাড়ি কিনেছে, সুখের বন্যা বইয়ে দিয়েছে একেবারে। মাইনে যা পায়, তাতে
আলুপোস্ত এবং কলাই-ডাল খেয়েই থাকার কথা ছিল। বাড়ি-গাড়ি তো দূরের কথা। বীরেশকে তাও সহ্য করা যায়। চুপচাপ, ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট লোক-সবসময়ই বাঁ-চোখ আধখানা খুঁজে টাকা বানানোর চিন্তা করে যাচ্ছে। কিন্তু খুকুটাকে একেবারেই সহ্য হয় না সৌম্যর। হঠাৎ। বড়োলোকদের স্ত্রীরা প্রায়শই অসহ্য হয়ে থাকেন পরিচিতদের চোখে। খুকুও ব্যতিক্রম নয়। এত বেশি কথা বলে! বোকা বোকা। কাঁচাটাকার গন্ধ ছাড়ে, ভেঙে-যাওয়া হাঁসের ডিমের মতো। ভাবখানা এমন যেন ও বি এম বিড়লা বা জে আর ডি টাটারই বউ। নিও-রিচ বোধহয় এদেরই বলে! এক একবার ওরা আসে আর সীমার মাথায় নতুন কোনো বস্তুতন্ত্রের পোকা ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। এমনিতেই সংসার চালাতেই হিমশিম খেয়ে যায় সৌম্য। তাই এদের মতো আগন্তুককেও খুবই ভয় পায়।
সৌম্য উঠে দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল র্যাগটাইম বইটা নিয়ে। মনে মনে প্রার্থনা করল যে বীরেশ আর টুকু যাওয়ার সময় যাচ্ছি সৌম্যদা বলেই চলে যাবে। যাদের সঙ্গে কোনো বিষয়েই কথা বলা যায় না তাদের সঙ্গে কথা বলতে ভীষণই অস্বস্তি বোধ করে ও।
সত্যিই দারুণ বইটা! কী সুন্দর এবং প্রাণবন্ত ইংরিজি। বহুদিন আগে নবোকভের ললিতা পড়ে এমন মনে হয়েছিল। বিষয়বস্তুর জন্যে নয়, ভাষার জন্যে। বইয়ের মধ্যে একেবারেই ডুবে গেল সৌম্য। তার আর কোনো হুঁশ রইল না।
হঠাৎ কে যেন ধাক্কা দিয়ে ভেজানো দরজাটা খুলল এবং তারপরই হুড়মুড় করে সীমা, বীরেশ, খুকু এবং রুরুকেও সঙ্গে নিয়ে ঢুকে এল। বলল, এই যে সৌম্য! শোনো একবার! কী খবর নিয়ে এসেছে বীরেশ। হাউ সুইট অফ হিম।
আজকাল সীমা কথায় কথায় বড়ো বেশি ইংরেজি বলে। রুরুর প্রভাব পড়ছে মায়ের ওপরে। ভালো লাগে না সৌম্যর।
সৌম্য উঠে বসে বীরেশের ঈষৎ-ফোলা, গর্বিত, পানজর্দা ভরা গালের দিকে তাকাল। তারপর মুখের দিকে।
কী? ব্যাপার কী?
ভি সি আর!
ভি সি আর?
হ্যাঁ। বীরেশের এক সাপ্লায়ার ওকে হংকং থেকে এনে দিয়েছে। সোনি। একেবারে জলের দরে। বীরেশ বলছে যে, তুমি ইন্টারেস্টেড থাকলে বলে-কয়ে তোমার জন্যেও আনিয়ে দেবে একটা।
আমি কী করব? ওসব দিয়ে? বিরক্তি এবং অস্বস্তির সঙ্গে বলল সৌম্য। আমি, মানে আমরা।
বিপদের আভাষ পেল ও।
ডোন্ট বি সিলি! বাবাঃ।
রুরু বলল।
সীমা বলল, দ্যাখ খুকু। কাকে নিয়ে ঘর করি তাই-ই দ্যাখ। একটা বেরসিক, ব্যাক-ডেটেড মানুষ। আনপ্রাকটিকাল। কে বোঝাবে একে বল? চান্স ইন আ লাইফ-টাইম। মাত্র কুড়ি হাজারে হয়ে যাবে। ওয়াইড-স্ক্রিনের কালার টিভি প্লাস ভি সি আর। ভাবা যায়?
কুড়ি হাজার!
আঁতকে উঠে বলল সৌম্য।
দ্যাখ। দ্যাখ। তোর সৌম্যদাকে দ্যাখ। আসল দাম তত কম করে চল্লিশ। কী রে খুকু? তাই না?
খুকু ঘাড় নাড়ল সবজান্তার মতো।
খুকু বলল, যাই-ই হোক। তোমরা ভাবাভাবি, মারামারি করো। তোমাদের কথা মনে হওয়াতে দৌড়ে এলাম, এখন সাধা-লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে চাও তো ঠেললা। তোমাদের যা খুশি! এবার যাব আমরা। ভিডিয়ো লাইব্রেরিতে এসেছিলাম তোমাদের পাড়ায়।
রুরু, চলে গেল ঘর ছেড়ে। বোধ হয় অপদার্থ, অবুঝ বাবার ওপর রাগ করেই।
সৌম্য অন্যমনস্ক গলায় বলল, ভিডিয়ো ক্যাসেট লাইব্রেরিতে? এই আমাদের মোড়ের লাইব্রেরিতে? এত দূরে? সল্ট লেক থেকে?
শুধু রবিবারে রবিবারেই তো আসি। এদের কাছে ভালো ভালো সফট-পর্ণো থাকে। হার্ড-পর্ণোও আছে। ব্লু-ফিল্ম।
তবে, আমাদের ওসব ভালো লাগে না সৌম্যদা। বয়স তো হল!
খুকু বলল।
সীমা বিরক্তির সঙ্গে বলল, জানি না বাবা। তোমার নিশ্চয়ই হয়নি। তবে আমার বরের অবশ্যই হয়েছে।
চলি আজ আমরা। টেক ইওর ওওন টাইম। ব্যাটা একেবারে আমার হাতের কজায়। ওর জীবন কাঠি মরণ-কাঠি সবই আমি। ভেবে, বোলো। তাড়া নেই কোনো। চলি।
২.
রাতে খাবার টেবিলে রুরুকে দেখা গেল না।
কী ব্যাপার?
সৌম্য জিজ্ঞেস করল।
বলছে, খিদে নেই। সানোরিয়ারের বাড়িতে জোর খেয়েছে। একটু চুপ করে থেকে প্লেটে আচার তুলতে তুলতে বলল, আসলে রাগ।
রাগ! কার ওপর?
তোমার ওপর। আবার কার ওপর?
কেন?
আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? বীরেশের অমন অফারটা! তুমি পাত্তাই দিলে না। আরে নিজে যদি নাও রাখতে চাইতে তবু ওর কাছ থেকে সস্তায় নিয়ে তো নিতে পারতে। তারপর রুরুর কোনো বড়োলোক মাড়োয়ারি-গুজরাটি-পাঞ্জাবি বন্ধুকে বিক্রি করে দিতে। হাজার দশেক প্রফিট হয়ে যেত। আমরা কোথাও বেড়াতে যেতে পারতাম। মানে, হলিডেতে।
সৌম্য চোখ তুলে তাকাল সীমার দিকে।
মুখে কিছু বলল না।
তার সামনের হৃষ্ট-পুষ্ট সুন্দরী যুবতিটির মুখে সে গরিব কিন্তু শিক্ষিত পরিবারের ছিপছিপে, বুদ্ধিমতী, ন্যায়-অন্যায় বোধসম্পন্না বেনারসি শাড়ি-মোড়া একটি অল্পবয়সি মেয়ের মুখকে খুঁজছিল।
নিঃশ্বাস ফেলল সৌম্য। হারিয়ে গেছে। সেই মেয়ে, সেই মুখঞ্জ, সেই মানুষটি, সেই সময়, সবই হারিয়ে গেছে।
খাওয়ার পর শোবার ঘরের ইজিচেয়ারে, একা বসে সিগারেট খাচ্ছিল সৌম্য। সব কাজ চুকিয়ে সীমা এল। এসেই, বাথরুমে গেল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং-টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগল, চুলে কেয়োকার্পিন লাগিয়ে। আয়না থেকে চোখ সরিয়েই, আয়নার মধ্যের সৌম্যকে শুধোলো, চোখে মদির ভঙ্গি করেঞ্জ, কী মশায়, তুমি কতদিন আমাকে আদর করো না বলো তো?
হুঁ।
হুঁ কী?
অনেকদিন।
আজ?
নাঃ।
ঠিক আছে। আয়নায় খুশির মুখ নিবে গিয়ে অপমানের মুখ ফুঠে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আমার একজন বয়ফ্রেন্ড ঠিক করতে হবে। শরীর ব্যাপারটাও ইম্পর্টান্ট।
নিশ্চয়ই ইম্পর্টান্ট! কিন্তু আছেই তো। একাধিক।
ন্যাচারালি!
বলেই, চিৎকার করে ঘুরে বসল সীমা সৌম্যর দিকে।
সৌম্য মিনমিন করে বলল, বলেছি কি আমি, আনন্যাচারালি?
সে-এ-এ-এ দ্যাট!
অবাক হল সৌম্য। সীমা যে কবে থেকে এমন পুরোপুরি মেমসাহেব হয়ে উঠল কে জানে। ছোটোবেলা থেকেই যারা মেমসাহেব তাদের সহ্য করা অনেক সহজ। এই মাঝবয়সি হঠাৎ মেমদের সহ্য করার মতো সহনশীলতা ওর নেই।
সিগারেটটা শেষ করে নিজের জায়গায় এসে শুল সৌম্য, কোনো কথা না বলে। সীমা ঘরের আলো নিবিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দায়, খাটে। এ বছর অতিবর্ষণে শ্রাবণকেই আশ্বিন বলে মনে হচ্ছে। নরম নীল চাঁদ-ভাসা আকাশ। প্রকৃতি, রোম্যান্টিসিজম, সেন্টিমেন্টালিজম এসবই আধুনিক, বুদ্ধিমান, বুদ্ধিজীবী মানুষদের কাছে। মুখামির সামিল। তবু, সৌম্য যেহেতু বুদ্ধিজীবী নয়ঞ্জ, নির্বুদ্ধিজীবী, তার কাছে এসবের দাম তখনও অনেকই। চাঁদের আকাশের দিকে চেয়ে ওর মনে পড়ে গেল বিয়ের দু-বছর পর। হাজারিবাগে গেছিল। মণি মাসিমাদের বাড়ি উঠেছিল দোলের আগে। ক্যানারি হিল রোড ধরে রোজ বিকেলে, বেড়াতে বেরিয়ে হাত ধরাধরি করে ফিরে আসত ওরা দুজনে। নতুন শাড়ি, নতুন সুগন্ধি, নতুন যৌবনের গন্ধে ভরা নতুন বউয়ের গা ঘেঁষে হাঁটত তখন সৌম্য। সীমা গাইত ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের অন্ধকারে ধরা দিয়েছ, ধরা দিয়েছ গো তুমি। পাতায় পাতায় ডালে ডালে অথবা ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার, দুখের পারাবারে।দু পাশের শাল এবং হরজাই জঙ্গল থেকে অসভ্য অসভ্য গন্ধ বেরুত একটা। সেই সব দিনে। সীমাকে একা একটু পেলেই খুব আদর করতে ইচ্ছে করত। মনই তো সব। মন, মনে মনে, মনস্ক হলে কিছুই যে ঘটে না। মন থেকেই, আজ সীমাকে কাছে পেতে একটুও ইচ্ছে করে না। সৌম্যর। সেই সুন্দর, সুগন্ধি মানসিক ইচ্ছেটাই মৃত সাপের মতো সৌম্যর শরীরের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। অনেকই খোঁচাখুঁচি করলেঞ্জ, আজকের অনেক বুদ্ধিজীবীদের সাংস্কৃতিক প্রয়াসেরই মতো, হঠাৎ-আলোড়ন তোলে সদুদ্দেশ্যবর্জিত শরীর। যন্ত্রেরই মতো। সেটা বাইরের ব্যাপার, অগভীর, সাময়িক, লজ্জারঞ্জ, সেটা তাই বাইরেই ঝরে যায়, পড়ে থাকে। মনকে ছোঁয় না, মন ভরে না। মনই তো সব। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, রোম্যান্টিসিজম, সেন্টিমেন্টালিজম ছাড়া শুধুমাত্র রোবোট হয়, মানুষ যে হয় না! কী করবে? নিরুপায় বোধ করে ও।
সীমা হঠাৎই খাটে উঠে এসে খাটের একপাশে বসল।
বলল, কী ডিসিশান নিলে? হ্যাঁ, কি না?
কীসের?
চমকে উঠে সৌম্য বলল।
বাঃ। ভি সি আর কেনার।
না।
কেন? না, কেন? বীরেশ কিনতে পারে। পাড়ার এতলোকে কিনতে পারে। চম্পা, তোমার ছোটোবোন ছুপি পর্যন্ত কিনতে পারে, শুধু তুমিই কি গরিব?
বীরেশ তো ঘুষ পেয়েছে। কিনেছে কোথায়? এক পয়সাও দেয়নি ও। কোনো গলড জিনিস, ওর অনুগ্রহপ্রার্থী কোনো কন্ট্রাক্টর ওকে এনে দিয়েছে। এ, ঘুষ ছাড়া কী?
তুমি যদি সস্তায় পাও তাহলে তো আর ঘুষ নেওয়া হবে না। তোমার সঙ্গে তো কন্ট্রাক্টরের কোনো সম্পর্ক নেই।
তাও ঘুষ। বীরেশকেই আরও ঘুষ। বীরেশ তার শালির কাছে হিরো হবে। তাই-ই। ব্যস্ত চৌরাস্তার মোড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের অশেষ দুর্গতি ঘটিয়ে মাসের পর মাস মাত্র দুজন মজুরকে গাঁইতি মেরে মেরে কাজ করতে দেখো যে, তারাই হচ্ছে সি এম ডি-এর ঠিকাদারের লোক। এমন। বিবেকহীনতা, চক্ষুলজ্জাহীনতাঞ্জ, সরকারের, আমলার, ঠিকাদারের, এমন সহ্যশক্তি কোটি কোটি মানুষ নামের জন্তুর বোধ হয় একমাত্র এদেশেই দেখা যায়।
তুমি কি ইলেকশনে দাঁড়াবে নাকি?
কেন?
যেমন বক্তৃতা দিচ্ছ। ঘুষ! কে আজকাল ঘুষ না খাচ্ছে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, জাপানের। প্রিমিয়ার ঘুষ খাচ্ছে আর বীরেশ ঘোষ-এর বেলাই যত দোষ! কেন? ও বুঝি আমার ভগ্নীপতি, তাই? তোমার বোন ছুপির স্বামী মৃগাঙ্ক খায় না ঘুষ। ঘুষ না খেয়ে কি অত ফুটানি করা
যায়? ট্যাক্স কেটে হাতে থাকে কটা টাকা?
ওসব কথা ছাড়ো। ভি সি আর কি একটা নেসেসিটি? না থাকলে, কী এমন অসুবিধা?
অসুবিধা নয়? তোমার কী? তুমি তো আর ছবি দেখতে যাও না পরের বাড়ি!
ছুপি আর খুকু দু-জনের হাবভাবই তখন আলাদা হয়ে যায়।
এমন ভাবভঙ্গি, যেন আমি পাড়ার ঠিকে-ঝি, ওদের বাড়ি সিনেমা দেখতে গেছি।
ছিঃ।
ছিঃ আবার কী! ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
রুরুর পড়াশোনার ক্ষতি হবে না?
পড়াশোনার কনসেপ্টই বদলে গেছে আজকাল। পড়াশুনার সঙ্গে জীবনের সাকসেসের কোনো কানেকশানই নেই। রুরুকে, অ্যাট এনি রেট, প্রাগমেটিক হতে হবে, সাকসেসফুল হতে হবে। বিজ্ঞানের দৌলতে ভি সি আর সমস্ত পৃথিবীকেই এনে দিল ড্রয়িংরুমের মধ্যে, আর তুমি বলছ নেবে না! গেটিং ইট ফর আ সঙ। তবুও নেবে না? স্ট্রেঞ্জ!
সৌম্য অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।
ভি সি আর এর জন্যেই তোমার এবং রুরুর জীবনের যাবতীয় জ্ঞান এবং সুখ যে এমনভাবে আটকেছিল একথা তো আমার জানা ছিল না। এতো দেখছি, ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের মতোই ব্যাপার। পৃথিবীর যা কিছু ভালো সবই ভি সি আর নিয়ে আসবে। আচ্ছা! একটা কথা বলোতো! তোমরাদু-জন ছাড়া তো আমার আর কেউই নেই। তোমরা দুজনেই যদি সুখী হও তাহলে আমি যেরকম করে হোক কিনে কি দেব না? কী দিইনি তোমাদের আমি? যাই-ই চেয়েছ? তা বলে কুড়ি হাজার টাকা! ভেবে দ্যাখো। কিনতে হবে ফিক্সড-ডিপোজিট ভাঙিয়ে, কিন্তু তোমরা আরও ভালো করে ভেবে কাল রাতে আমাকে বোলো।
সীমা, ও-ও-ও-ও তুমি কী ভালো-ও-ও-ও-ও বলে দৌড়ে এসে সৌম্যর বুকে পড়ে চুমু খেলো। সৌম্যর গা সিরসির করে উঠল। গল্প-উপন্যাসে বেশ্যাদের যে বর্ণনা পড়েছে তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে সীমার ব্যবহার। নিজের সন্তানের জননীকে বেশ্যা ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল খুবই। তবুও, নাভেবেও পারল না।
সীমা আরও বড়ো রকম আদরের জন্যে তৈরি হচ্ছে বলে মনে হতেই ভয় পেয়ে সৌম্য বলল, আমার ঘুম পেয়েছে।
ঠিক আছে। কালকে। রুরু পড়তে যাবে। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরো। ঘুগনি করব। খাওয়া দাওয়ার পর শরীর ভ্যাদভেদে হয়ে যায়। সন্ধেবেলাতেই ভালো।
ঠিক আছে।
আচ্ছা! তুমি ফিক্সড-ডিপোজিট ভাঙবে কেন? ভি সি আর কিনতে?
না ভাঙলে, কোথা থেকে পাব কুড়ি হাজার?
তোমার চাকরিতে কোনো উপরি নেই মানে, ঘুষ? এত বড়ো চাকরি তোমার!
সৌম্য খাটে উঠে সোজা হয়ে বসে, বাজুতে বালিশ রেখে হেলান দিল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িতে আর একটা সিগারেট ধরাল।
বলল, কী বলছ কী তুমি? কী বলতে চাও? পরিষ্কার করে বলল।
গম্ভীর, ঠান্ডা গলায় সীমা বলল, ঠিকই বলছি। অপরিষ্কার করে তো কিছু বলিনি। আজকাল কে দু-নম্বরি ধান্দা না করে, বল? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। আট টাকা উচ্ছের কেজি। দুধ সাড়ে ছটাকা। আট টাকা মুগের ডাল, পার্শে মাছ চল্লিশ টাকা। তোমার মাইনে থেকে প্রতি মাসে যে দু-হাজার টাকা করে ট্যাক্স কেটে নেয় তার বদলে দেয় কী তোমাকে? তোমার পিরিতের। সরকার? ঘুষ না নিয়ে সৎ থেকে তুমি ভালোমানুষ সাজছ কার কাছে? সরকার সাহেব, সেনগুপ্ত সাহেব, সুরজিৎ সিং ঘুষ নেন না। সুরজিৎ সিং-এর ড্রয়িংরুমে যে ইরানীয়ান কার্পেটটি পাতা থাকে তারই যা দাম, সেই টাকা তার সারা জীবনের চাকরির সঞ্চয় যোগ করলেও হয় না। চোর উপরওয়ালা, চোর নীচুওয়ালা, চোর আত্মীয়স্বজন, চোর প্রতিবেশী, তাদের মধ্যে সৎ থেকে কার হাত থেকে সততার পুরস্কার নিতে চাও তুমি? তোমার কি চোখ নেই? সৌম্য! তোমাকে। ভালোবাসি বলেই বলছি না, উ্য আর লিভিং ইন ফুলস প্যারাডাইস। একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, বেড়ানো-টেড়ানো, ভি সি আর-এর জন্যে না হয় ঘুষ খেলেই তুমি! অন্য কিছু তো করছ না, চ্যাটার্জির মতো বউকে তো আর পাঠাচ্ছনা সুরজিৎ সিং আর সেনগুপ্তর জন্যে কোম্পানির গেস্ট হাউসে, চাকরির উন্নতির জন্যে! আরও টাকা রোজগারের জন্যে! তবে? এতে তোমার লাগল কেন?
আঃ। সীমা। সব কিছুরই সীমা আছে একটা।
থাকলেই ভালো হত। কিন্তু নেই। সীমা নেই বলেই আমি নিজেও হারিয়ে গেছি বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। তোমার ওসব চালাকি ছাড়ো। ভি সি আর আমাদের চাই-ই। ওরা সকলে কিনতে পারে, তুমি পার না? আমাদের স্ট্যাটাস, সম্মান কি কিছুই নেই?
৩.
সীমার নাক ডাকে। বরাবরই। এখন ঘুমোচ্ছে ও। গলির উলটোদিকের বাড়ির এবং রাস্তার আলো এসে দেওয়ালে পড়ে কাটাকুটি খেলে দরজাটা খোলা থাকলে। পথে গাড়ি গেলে হেডলাইটের আলোয় ভূতুড়ে মূর্তি নাচে। দরজাটা এখনও খোলাই আছে।
সৌম্য শুয়ে আরও একটা সিগারেট ধরালো। কুড়ি হাজারটাকা!
পরশু অফিসে ভোম্বল এসেছিল। সৌম্যদের সাপ্লায়ার, একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে বোধহয় ওর একটা দু-হাজার টাকা মাইনের চাকরি হয়ে যাবে, ভবিষ্যৎও খুব ভালো। যদি সৌম্য…ওই কোম্পানির লোক আগেই টোপ দিয়ে গেছিলেন, বলেছিলেন রায়সাহেব, আমাদের একটু সাহায্য করুন। ভোম্বল বলেছিল, সাহায্য ব্যাপারটাই হচ্ছে পারস্পরিক। বুঝলেন স্যার। আপনি এত। বুদ্ধিমান, অথচ আসল বুদ্ধি কিছু নেই। ডোম্বল সৌম্যর মৃত দাদার একমাত্র ছেলে। পড়াশোনায় ভালো। চেহারা সুন্দর। স্বভাবচরিত্র ভালো। কিন্তু চাকরি পেতে হলে এসবও এখন যথেষ্ট নয়। তাই-ইবি এসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েও ঘুরে বেড়াচ্ছে দু-বছর। ও বলেছিল যে, দু-হাজার টাকা ঢুকেই পাবে, তারপর গ্রেড অনুসারেই চার-এ পৌছে যাবে দশ বছরে। প্লাস জেনারাস পার্কস। যোগ্যতা দেখাতে পারলে তো আরও উন্নতি। টেন্ডারটা
সৌম্যর ড্রয়ারেই আছে। অন্য সাহেবরা তো সব ওই কোম্পানির মান্থলি পে-রোলেই আছেন। সৌম্যই একমাত্র কাবাব মে হাড়ি।
মেজোকাকার ছেলে রিন্টু এসেছিল গত সপ্তাহে। মেজোকাকার কাছেই মানুষ সৌম্য। বাবা মারা যান ছোটোবেলাতে। মেজোকাকার অনেকগুলো অ্যাটাক হয়ে গেছে। ডাক্তাররা বলেছেন বাই পাস সার্জারি করতে হবে। তা ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। ভেলোরে নিয়ে গেলে অনেকই খরচা। কলকাতাতেও কম খরচায়। বলেছিল, দশ হাজার টাকা, সৌম্যদা, যদি তুমি দাও। আরও কেউ কেউ দিচ্ছেন। ছোটোবেলায় বাবা তো কম করেননি তোমার জন্যে। আর তুমিই হচ্ছ বাবার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র।
সবই বুঝলাম রিন্টু, সৌম্য বলেছিল, কিন্তু রেখার বিয়ের সময়েও পাঁচ হাজার দিয়েছিলাম। কাকিমার শ্রাদ্ধতে তিন হাজার। আর মেজোকাকার জন্যে যা পারি তা তো করিই, সবসময়ই করি, বলতে হয় না। আমার কর্তব্য আমাকে শিখিও না। এখন আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, মেজোকাকার বয়স তো পঁয়ষট্টি হলই। একদিন না একদিন তো যেতে সকলকেই হয়। মানুষ কি চিরদিনই বাঁচে?
রিন্টু আহত হয়েছিল।
বলেছিল, তার মানে? তুমি বলতে চাইছ যে, এখন বাবা গেলেই ভালো।
আঃ। মিসআন্ডারস্ট্যান্ড করিস না রিন্টু। সেন্টিমেন্টাল হোস না। কথাটা বলেই চমকে উঠেছিল। ও আজকাল বুদ্ধিজীবীদের মতোই কথা বলছে! আশ্চর্য!
ঠিক আছে। আমি চললাম সৌম্যদা।
মনে মনে বিড়বিড় করে বলেছিল সৌম্য। যার পয়সা নেইঞ্জ, তার পয়সা নেই। এত ফুটানিটা কীসের? লক্ষ লোকের যা হচ্ছে, মেজোকাকারও তা-ই হবে। আত্মসম্মানজ্ঞানহীন মানুষ দু-চোখে। দেখতে পারে না সৌম্য। আত্মসম্মানজ্ঞান যার নেই, সে মানুষই নয়। ভিক্ষা করেও চিকিৎসা করতেই হবে? মেজোকাকা হ্যাড লিভড হিজ লাইফ। এখন মানে মানে, সম্মান নিয়ে চলে গেলেই তো হয়। আর কী দেবার আছে পৃথিবীকে তাঁর যে ভিক্ষাপাত্র হাতে করে ছেলেকে পাঠিয়েছেন ঘরে ঘরে? ভিক্ষুক যে, সে ভিক্ষুকই! খাওয়ার জন্যেই ভিক্ষা সে চাক আর চিকিৎসার জন্যেই চাক। মেজোকাকার মুখটা মনে পড়ল একবার। মেজোকাকার জ্বর হলেই মেজোকাকা বলতেন পা-টিপতে থাকা সৌম্যকে। বলতেন, বুঝলি সমু, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড়ো হচ্ছে চরিত্র, তারপর ন্যায়-অন্যায় বোধ, তারপর পড়াশোনা, তারপর খেলাধুলো। বুঝলি সমু। স্কুলের পড়াশুনোয় ভালো হলেই, খেলাধুলোয় ভালো হলেই, অথবা বড়ো হয়ে অনেক টাকা রোজগার করলেই মানুষ মানুষ হয় না রে। ধর্মোহি তেষাম অধিকো বিশেষোঃ ধর্মেনা হীনা পশুভিঃ। সমানাঃ। এই কথা মনে রাখবি সবসময়। মানুষ হোস। মানুষের চেহারার জন্তু হোস না বাবা। মানুষ হোস তুই!
সৌম্য ভাবল, মেজোকাকা কি জানেন যে বিন্দু তার জন্যে ভিক্ষা চাইছে দরজায় দরজায়? জানলে, তিনি কিছুতেই রাজি হতেন না। মানুষটির চরিত্রটি অন্যরকম। তবে কে জানে, বদলাতে পারেন। এখন চরিত্রভ্রষ্ট কে নয়?
সৌম্য পাশ ফিরে শুল। আবারও পাশফিরল। আবারও। প্রথম বর্ষার জল পাওয়া সিঙি
মাছের মতো পাক খেতে লাগল খাটে। সিগারেট ধরালো আর একটা উঠে বসে। মাথার কাছে পেলমেট থেকে ঝুলতে থাকা পর্দাটা হাওয়ায় খস খস শব্দ করছে।
ক-টা বাজে এখন? একটা, দুটো, তিনটে? কাল যে আফিসে অনেক কাজ।
ছোটো বোন নিপু থাকে পাটনাতে। সৌম্য ক্রমাগত পাশফিরছে। পাশ ফিরেই যাচ্ছে। আগে ছিল পাটলিপুত্র কলোনিতে। ভগ্নিপতি, রমেশ অ্যাকসিডেন্টে হঠাৎ মারা যাওয়ার পর, এক মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে একটা ভাঙা বাড়ির একতলায় থাকে নিপু। বছর তিনেক হল। ওকে প্রতিমাসেই। তিন-শো টাকা করে পাঠায় সৌম্য। আর কেউই জানে না। আজকাল তিন-শো টাকায় চারজনের। সংসার কি চলে? সবই বোঝে। জানে ও। এখানে ওদের নিয়ে এলে হত। কিন্তু তা হয় না, হবে না। দিনকাল বদলে গেছে। মাঝে, নিপুর মাথার গোলমাল হয়ে গেছিল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, গা থেকে শাড়ি খসে পড়ত। কতগুলো গুণ্ডা প্রকৃতির লোক তাকে এক সন্ধ্যেতে গাড়ি করে এসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যায় নির্জনে। টেলিগ্রাম পেয়ে গেছিল সৌম্য। ভাবলে, এখনও গা শিউরে ওঠে। পরে এ খবর পায় যে, প্রেগন্যান্ট হয়েছে নিপু। তাকে অ্যাবর্শানও করাতে হয়। সৌম্যই আবার গিয়ে সব কিছু করে।
ছিপুর কিন্তু দারুণ অবস্থা। নিপুর উপরের বোন ছিপু। তার বর একটি মালটি-ন্যাশনাল কোম্পানির নাম্বার-টু। নিপুকে ভুলে গেছে ছিপু। একমাত্র বোনকে। মনে রাখা সম্ভব নয়। দিনকাল বদলে গেছে। সৌম্যরও উচিত ছিল ভুলে যাওয়া। পারেনি। সৌম্যর পি এফ এবং পঁয়ত্রিশ হাজার এল আই সি ছাড়া আর কোনো সেভিংস নেই। রিটায়ার করার সময় অবশ্য গ্র্যাচুইটি পাবে। ফিক্সড ডিপোজিটের ওই কুড়ি হাজার টাকা নিপুর বড়ো মেয়ে দীপুর বিয়ের জন্যেই রেখেছিল ফিক্সড ডিপোজিটে।
কী করবে? সৌম্য! তুমি কী করবে? তোমার, তোমার স্ত্রী, তোমার স্কুলে-পড়া ছেলের স্ট্যাটাস সম্মান সব নির্ভর করছে একটি ভি-সি-আর এর উপর। কী করবে সৌম্য?
পর্দাটা ক্রমাগতই ভৌতিক খসস আওয়াজ করে যাচ্ছে। নাঃ। অদ্ভুত একরকম আওয়াজ করছে। পর্দাটা কি অ্যানিমেটেড? সীমারঞ্জ, পরমা সুন্দরী, বিদুষী স্ত্রী, সীমার নাক ডাকছে ভিসস–ভিসস–শব্দটা ফিরে আসছে আবার ভিসস-ভিসস–ভি-সি-আর রঞ্জ, ররভিসস–ভিসস-ভিসসি–ভিসসি–আর ররর…
দেওয়ালের আলো-ছায়ায় সার সার অনেকগুলো মুখ আঁকা হয়ে গেছে। ডোম্বল, রিন্টু, মেজোকাকা, নিপু, দীপুঞ্জ, ক্লকওয়াইজ…
মুখগুলো হাসছে, কাঁদছে, তার দিকে ড্যাবডেবে চোখে চেয়ে আছে সবকটি মুখ।
হঠাৎ ওর মনে হল, খসস খসস নয়, পর্দাটা ক্রমাগত বলে চলেছে মানুষ হোস, মানুষ হোস, মানুষ হোস। মানুষের চেহারা জন্তু নয়। বুঝলি! বুঝলি! সমু!
মাথার মধ্যে অসহ্য ব্যথা। যন্ত্রণা। বুঝি ফেটে যাবে।
নিপুর মেয়ে দীপু ডেকে উঠল মাথার মধ্যে, মেজোমামা! ইস তোমার মুখ লাল হয়ে গেছে। এখানে না, খুব গরম জানঞ্জ, পাটনাতে। লু লেগে যাবে। অভ্যেস নেই তো তোমার। আমরা সব পারি। তোমার জন্যে লেবু-নুন দিয়ে শরবত করে আনছি একটু।
একটা বেগনে-রঙা মোটা কাপড়ের ফ্রক দীপুর গায়ে। পিঠটা অনেকখানি ছেঁড়া। তাদের রক্ষক মামার জন্যে শরবত আনতে চলে গেল দীপু পোডড়া-বাড়ির ভিতরের অন্ধকার ঘরে।
মেজোকাকার দুটি হাত সৌম্যর মাথার উপর জড়ো করা। কী নরম হাতের তেলো, মেজোকাকার। আশীর্বাদ করি মানুষ হ বাবা! মানুষের মতো মানুষ হ! সমু!
অ্যাবর্শানের পরই সাইকেল-রিকশা নিয়ে নিপুকে নিয়ে ফিরে আসছিল সৌম্য। নিপু গা এলিয়ে দিয়েছে দাদার বাহুতে।
তোর গায়ে কী সুন্দর গন্ধ রে মেজদা! কী মেখেছিস?
পারফিউম! তোকেও দেব একটা।
হিঃ হিঃ। আমাকে? তুই? দিবি? ধৎ! তুই কেন দিবি রে? আমাকে খুব ভালোবাসত রে। বাজে লোক একটা। চলে গেল। তুই কি আমার বর? অ্যাই সরে বোস। সরে বোস। তুই কি আমার বর? জানিস। কত্ত বড়ো ট্রাকটা। মাথাটা ঘেঁৎলে দিয়েছিল। হ্যাঁরে! আমার বরের। রমেশের।
তারপরই হেসে বলেছিল আমি কিন্তু ভালো হয়ে গেছি রে। একটুও পাগল নই। না রে দাদা? মনে আছে? সীতাগড়া পাহাড়ের নীচের রাস্তায় তোর সঙ্গে এমনিই সাইকেল করে এসেছিলাম হাজারিবাগের বাড়িতে? আমি সাইকেলের রডে বসেছিলাম। কি মাস ছিল রে? কী সুন্দর গন্ধ ছিল চারদিকে আকাশে বাতাসে, চাঁদে। না? কি মাস ছিল রে?
আশ্বিন?
কোন বছর?
সাতষট্টি।
কোন দিন?
রবিবার।
কোন সময়?
সন্ধ্যে। গন্ধ, সেই সব সুন্দর গন্ধের দিনগুলো কোথায় গেল রে মেজদা? হারিয়ে গেছে। সব।
তারপরই বলেছিল, আমার নাম কি? অ্যাই! তুই কে রে? আমাকে নিয়ে আবার পালাচ্ছিস? তুই কে? মাগো! মেজদা! এই খবরদার! আমার মেজদা জানতে পারলে তোমাদের শেষ করে দেবে। ভারি অফসর কলকাতার। অসভ্য। পাজি। বদমাস–উঃ মা গো! মেজদা!
বলেই নিপু রিকশা থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। মাথাটা অনেকখানি কেটে গেছিল ওর।
হঠাৎই সৌম্যর মাথার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটল। প্রচণ্ড শব্দ। আর্তনাদ। কানের পর্দাবুঝি ছিঁড়ে গেল। ওসিবিসা! বাজছে! বাজছে স্টিরিয়োতে ওসিবিসার ক্যাসেট বাজছে। সীমা ভালোবাসে। ওরা সবাই ভালোবাসে। রুরু ভালোবাসে। খুউবই! উঃকী শব্দ!
বাইরে অঝোর ধারে বৃষ্টি নামল। অন্ধকার আকাশ। সব অন্ধকার। দরজাটা খোলা ছিল। জলের ছাঁট এসে ঘর ভিজিয়ে দিচ্ছে। সীমা ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুম খুবই গাঢ়।
সুখী এবং সুস্থ মানুষদের ঘুম গাঢ়ই হয়!
বৃষ্টির মধ্যেই বাইরে এল সৌম্য। চেয়ার দুটোকে ভিতরে করল। কতক্ষণ বৃষ্টি হচ্ছে কে জানে? পথে জল দাঁড়িয়ে গেছে। আবারও কি পাঁচ তারিখের মতো হবে? বন্যা? সব ভেসে যাবে? সব কিছু? ডিজ? হকি নৌকো বানাচ্ছেন আবার? তাতে কি ঠাঁই হবে সৌম্যর?
আর ভাবতে পারছে না ও। মাথার প্রচণ্ড যন্ত্রণা। দরজা বন্ধ করে, কোনোরকমে খাটে এসে পাক খেয়ে পড়ল। বৃষ্টির শব্দ ঘরেও এসে পৌঁছেছে। তারই মধ্যে পর্দার আওয়াজ। ভুতুড়ে পর্দা বলে চলেছে, মানুষ হোস, মানুষ হোস, মানুষ হোস। আর সীমার নাক ডাকছে. ভিস ভিস ভিসস…ভি সসসি…আর…র…র..র…ভিসস…ভিসস…ভিসসি…আ…র…