ভিন্ন ভূগোল

ভিন্ন ভূগোল

বড় মামা ড. ফৈয়াজ হোসেন খান তখন ঢাকায় ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের কর্মকর্তা। আমার বেড়ে ওঠায় যে দুজন মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি তাঁদের মধ্যে একজন আব্বা, অন্যজন বড় মামা। বড় মামা ছিলেন আব্বার মতোই নৈতিক ও পুরোপুরি আত্মোৎসর্গিত মানুষ। তিনি ছিলেন গভীরভাবে দেশপ্রেমিক। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে হাতেগোনা যে গুটিকয় ছাত্র সর্বভারতীয় ভিত্তিতে স্কলারশিপ পেয়ে বিলেত থেকে ডক্টরেট করে আসার সৌভাগ্য পেয়েছিলেন তিনি তাঁদের একজন। সে-সময় আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলোর কাছে ভূতত্ত্বের ছাত্রদের চাহিদা ছিল বিপুল। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মামার সঙ্গে যাঁরা সেবার ভূতত্ত্বে পিএইচডি করেছিলেন তাঁদের সবাইকে ঐ কোম্পানিগুলো কয়েক হাজার ডলার করে বেতন দিয়ে নিয়ে যায়। জীবনের শেষে তাঁরা সবাই বিস্তর ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এঁদের অধিকাংশেরই ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার পর্যন্ত ছিল। কিন্তু মামা সে চাকরি নেননি। তিনি দেশের খনিজ সম্পদ খুঁজে বের করে দেশকে সম্পদশালী করার স্বপ্ন নিয়ে মাত্র তিনশো টাকা বেতনে পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভেতে এসে যোগ দেন এবং একপর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসে ধীরে ধীরে আজকের জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ বাংলাদেশ গড়ে তোলেন। এর পরে শুরু হয় তাঁর পরিপূর্ণ আত্মোৎসর্গের জীবন। সারাজীবন আত্মবিস্মৃতের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-সমতলে ও নির্জন এলাকায় ঘুরে ঘুরে এখানকার মাটির নিচের যাবতীয় খনিজ সম্পদ খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের অধিকাংশই তাঁর নেতৃত্বে আবিষ্কৃত। মৃত্যুর আগে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় বই “জিওলজি অফ বাংলাদেশ’ আজ অব্দি বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই।

ভাগনেদের মধ্যে আমি ছিলাম মামার সবচেয়ে আদরের। হয়ত প্রথম ভাগনে ছিলাম বলে অন্য ভাগীদাররা এসে পড়ার আগেই তাঁর স্নেহের একটা বড় অংশ হাতিয়ে নেবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাছাড়া ‘নরনং মাতুলাক্রম’ বলে যে কথাটা আছে তা আমার বেলায় ছিল খুবই প্রযোজ্য। ছেলেবেলায় মামার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার ছিল আশ্চর্য মিল। হয়ত এ কারণেও আমার ব্যাপারে তাঁর কিছুটা বাড়তি দুর্বলতা ছিল। এটা খুব অদ্ভুত যে জীবনের দুই পর্বে আমার প্রিয় দুজন মানুষের সঙ্গে আমার চেহারার মিল দেখা গেছে। পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত মামার চেহারার সঙ্গে, পঁয়তাল্লিশ বছরের পরে আব্বার চেহারার সঙ্গে। মামা ছিলেন কিছুটা একরৈখিক ধরনের মানুষ। কোনোকিছু একবার তাঁর মাথায় ঢুকলে সহজে সেখান থেকে তা বের হতে চাইত না। আমার জন্যে তাঁর স্নেহও ছিল সেরকম। এই স্নেহের কোনোদিন হেরফের হয়নি। পরবর্তী সময়ে মামার সঙ্গে কিছু কিছু ব্যাপারে আমার তীব্র মনান্তরের পরেও না। আজ এসব লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে কেবল মামা নন, মা, আব্বা, মামা–আমার জীবনের এই সবচেয়ে কাছের তিনজন মানুষের প্রত্যেকেরই আমি ছিলাম সবচেয়ে স্নেহের। এটা কম ভাগ্যের কথা নয়। মা ভালোবাসতেন বড় ছেলে বলে, মামা বড় ভাগনে বলে, আব্বা ভালোবাসতেন চেহারায় আর প্রকৃতিতে মার সঙ্গে আমার মিল ছিল বলে। আমার মতোই মামা হাঁটতেন কিছুটা হেলেদুলে। মনে পড়ে খুব ছেলেবেলায় মামা আমাকে ঘাড়ে নিয়ে ফুটপাথ ধরে বন্ধুদের সঙ্গে পার্ক সার্কাস ময়দানের দিকে যাওয়ার সময় সুর করে আবৃত্তি করতেন :

রোজ সুবাহ কো উঠতা লালু
মাখখন রোটি খাতা লালু।

মামার সেই স্নেহমাখা বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর সুদূর ছেলেবেলা থেকে আজও যেন আমার কানে ভেসে আসে। মা মারা যাবার পর আমার জন্যে মামার আদর স্নেহ খুবই বেড়ে গিয়েছিল। করটিয়ায় মাখখন-রোটি পাওয়া যেত না, এটা পেতাম কেবল কলকাতা গেলে। আমার কাছে কলকাতা তাই ছিল সকালবেলায় পুরু মাখন আর চিনি মাখানো রুটির স্বাদে ভরা এক স্বপ্নের শহর। মামার ছড়া শুনে রোজ সকালে লাল্লুর মাখখন-রোটি খাবার ছবিটা মনে মনে ভেবে নিতে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান লাগত।

মনে আছে মামা জাহাজে করে মুম্বাই হয়ে বিলেত থেকে ফেরার সময় হাওড়া স্টেশনে আমাদের গোটা পরিবার তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গেলে তাঁর প্রিয় ভাগনে হিশেবে তাঁকে মালা দিয়ে বরণ করার ভার পড়েছিল আমার ওপরেই। নিজেকে এত বড় একজন বিলেত ফের্তা মামার সবচেয়ে আদরের ভাগনে ভেবে মনে মনে খুবই গর্ব হয়েছিল।

আগেই বলেছি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৩-৫৪ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীন, বৈরী ও অনিশ্চিত পরিবেশ থেকে হিন্দুরা বিপুলসংখ্যায় দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। সাধারণ হিন্দুরা তখন যত না গিয়েছিল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও সংস্কৃতিবান হিন্দুরা দেশত্যাগ করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। আমার ধারণা এদের ষাট-সত্তর ভাগই তখন ভারতে চলে গিয়েছিল। পুরুষানুক্রমিক উচ্চ সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার ভিত্তি থেকে বিচ্যুত হওয়ায় এই দেশত্যাগীরা ভারতে গিয়ে যেমন তাদের আত্মপরিচিতি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে তেমনি সেখানকার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও অর্থনৈতিক সংকটের নির্মম চাপে বাঙালি রেনেসাঁর এই উত্তরাধিকারীরা একটা বেদনাদায়ক অবস্থার ভেতর পিষ্ট হয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়।

এরা দেশত্যাগ করেছিল ধীরে ধীরে ও নিঃশব্দে। নিজেদের জমিজমা সহায়- সম্পদ পানির দরে বিক্রি করে অজানা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছিল। কিন্তু সবাই যে একইরকম নিঃস্ব অবস্থায় বিদায় নিয়েছিল তা-ও নয়। দুয়েকজনের বিদায় হয়েছিল বেশ লাভজনকভাবেই। এদেরই একজন পাবনা কলেজের ক্যাশিয়ার ফণীবাবু। ফণীবাবু নামে ‘ফণী’ হলেও ব্যবহারে ছিলেন খুবই ভদ্র। একেবারেই মাটির মানুষ। তাঁর কথাবার্তাও ছিল মধুভরা। আব্বা তাঁকে খুবই বিশ্বাস করতেন। আমাদের ভাইবোনদের সবাইকে তিনি সবসময় মা বাবা বলে ডাকতেন। হঠাৎ একদিন শোনা গেল ফণীবাবুকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁর বাসায় তালা ঝুলছে। ব্যাপক খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল। না, তিনি কোথাও নেই। যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল চার-পাঁচদিন পর সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল। তিনি ভারতে পালিয়েছেন। যাবার সময় কলেজের ক্যাশ থেকে আঠারো হাজার টাকাও নিয়ে গেছেন—গত কয়েকমাস ধরে তিনি একটু একটু করে এই টাকা নিঃশব্দে সরিয়েছিলেন। ভারত পাকিস্তানের তখন পুরোপুরি বৈরিতার যুগ। কেউ তখন একবার ভারতে চলে যেতে পারলে তার ব্যাপারে কারো কিছু করার থাকত না। আজও যে খুব একটা কিছু করা যায়, তা-ও নয়।

ফণীবাবুর মতো মানুষ যে এমন কাজ করতে পারেন এ ছিল স্বপ্নেরও অতীত। আঠারো হাজার টাকা সেকালে অনেক টাকা। আমাদের গোটা পরিবারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমাদের জীবনের ভারসাম্যটাকে পুরো ওলট-পালট করে দিল ঘটনাটা। কলেজের অধ্যক্ষ হিশেবে সরাসরি বিপদে পড়লেন আব্বা। আব্বা অঙ্কে তুখোড় হলেও টাকা-পয়সার নিয়মিত হিশাব দেখে রাখার বেলায় ছিলেন কিছুটা অর্ধমনস্ক—এই ধরনের শিল্পমনা বা পড়াশোনা নিয়ে থাকা লোকেরা সাধারণত যেমন হয়। ফণীবাবু এই সুযোগটাই নিয়েছিলেন। সে-সময়কার পাবনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গেও পুলিশ আর কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের ব্যাপার নিয়ে আব্বার বেশ মন কষাকষি চলছিল। তাঁর খেসারতও আব্বাকে দিতে হল কড়ারকমেই। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের প্রস্তাব মোতাবেক তদন্তের স্বার্থে আব্বাকে অধ্যক্ষের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হল। কলেজ গভর্নিং বডির সভায় সিদ্ধান্ত হল মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আব্বাকে তাঁর মাসিক বেতনের চারভাগের একভাগ করে দেওয়া হবে। তখন পাবনায় আমের শ’ এক টাকা হলেও বেতনের চারভাগের একভাগ হিশেবে মাসে যা পাওয়া যেতে লাগল তা দিয়ে এত বড় পরিবারের পক্ষে ঐ দামের আম খেয়েও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কাজেই মার সঙ্গে বাড়ির অধিকাংশ সদস্যকে বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ছোট আপা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থাকার পর স্কলারশিপের টাকা আর আব্বার পাঠানো সামান্য টাকা দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। আমাকে আর মামুনকে পাঠিয়ে দেওয়া হল ঢাকায় বড় মামার কাছে।

পাবনা কলেজে আব্বার চাকরি নিয়ে এই ঝামেলার কারণে আমাকে তাই কিছুদিনের জন্যে ঢাকায় মামার বাসায় গিয়ে থাকতে হয়। ঢাকায় মামার বাসায় আসতেই মামা আমাকে সদরঘাটের কাছে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানোর চেষ্টা করলেন। পরীক্ষায় ফলাফলের দিক থেকে একালের গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটারি স্কুলের মতো সেকালে কলেজিয়েট স্কুল ছিল ঢাকা শহরের সেরা স্কুল। একসময়কার স্টেটব্যাংক ভবনটি তখন ব্যবহৃত হচ্ছে কলেজিয়েট স্কুল হিশেবে। ভবনের সামনের দিকটায় বিশাল আয়তনের বড় বড় গোল থাম। জাফরিওয়ালা বড় বড় জানালা। সবকিছুর মধ্যে একটা রাজকীয়তার ছোঁয়া। স্কুলটা দেখেই মন ভরে গেল। তাছাড়া স্কুলের নামের সঙ্গে কলেজ কথাটা থাকায় এর পদমর্যাদাকেও একটু উঁচু বলে মনে হল। মনে হল, ‘এখানে বাঁধিব মোর তরণী।’

মামার অফিস ছিল বাহাদুর শাহ পার্কের দক্ষিণ দিকে, জনসন রোডের ওপর, স্কুলের কাছেই। মামা একদিন তাঁর অফিসের একজন কর্মচারীকে দিয়ে স্কুল থেকে একটা ভর্তি-ফর্ম আনিয়ে সেটা আমাকে দিয়ে পূরণ করিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। ভর্তি-পরীক্ষার দিন দুরুদুরু বুকে পরীক্ষা দিতে বসলাম। আশা ছিল আমরা ক্লাস নাইনে যা পড়েছি, সেসব থেকেই প্রশ্ন আসবে। কিন্তু দেখলাম প্রশ্নের অধিকাংশ এসেছে তার বাইরে থেকে। অধিকাংশ বিষয় আমার অজানা। আমি পুরো বোকা হয়ে গেলাম। মাথার শিরা দপদপ করতে লাগল। শীতের দিনেও ঘেমে উঠলাম। উল্টোপাল্টা কী লিখলাম প্রায় বুঝতেই পারলাম না। ঘণ্টা পড়লে আমার সেই বিভ্রান্ত অবস্থাতেই স্যার হাত থেকে খাতা ছিনিয়ে নিলেন। তিন দিন পর স্কুলের নোটিশ বোর্ডে ফলাফলের তালিকা ঝুলিয়ে দেওয়া হল। বারবার খুঁজেও সেখানে আমার নাম পেলাম না। আমি চৌকশ ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু ফেলও আমার চিন্তার বাইরে। অপমানে লজ্জায় আমি মাটির সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাম। নিজেকে একটা মূল্যহীন অর্থহীন নিকৃষ্ট জীবের মতো মনে হতে লাগল। মনে হল সারা পৃথিবী আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। আত্মগ্লানিতে ক্লেদে নিজেকে নিজের কাছে একটা গলিত লাশের মতো লাগল। আমি নাকে আমার নিজের পচে যাওয়া শবের উৎকট তীব্র দুর্গন্ধ টের পেতে লাগলাম। কেবলি মনে হল, কেন ভালো স্কুলে পরীক্ষা দিতে গিয়ে জীবনের জন্যে এই অপমান কিনলাম। সাধারণ কোনো স্কুলে ভর্তি হলে তো নিজেকে এভাবে উপহাসের পাত্র করতে হত না। কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেলাম অসহ্য অসম্মানের অনুভূতিটা আমার ভেতর একটু একটু করে এক ধরনের বেদনার অনুভূতিতে পরিণত হচ্ছে। আমি আকাশ-পৃথিবীজুড়ে যেন একধরনের অঝোর কান্নার মতো শব্দ শুনতে পেলাম। কলেজিয়েট স্কুল থেকে পুরানা পল্টনের মামার বাসায় ফেরার পথে নবাবপুর রোডে দুটো রেস্টুরেন্ট থেকে মাইকে জোর গলায় গানের শব্দ উঠছিল। গানের মিষ্টি শব্দ বহুদূরজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। গানগুলোকেও আমার কাছে সারা পৃথিবীর বুকের ভেতরকার কান্নার শব্দ বলে মনে হতে লাগল। অসম্মানের এমন কষ্ট জীবনে আমি আর কখনও পাইনি।

এটিই আমার জীবনের প্রথম পরাজয়। হয়ত একমাত্র পরাজয়। আমি পরাজয় সহ্য করতে পারি না। যে কাজে পরাজয় আসতে পারে সে কাজ থেকে আমি সরে যাই। তুচ্ছ কাজেও চিরকাল আমি জয়ের পক্ষেই থাকার চেষ্টা করি। কোন বইয়ে যেন পড়েছিলাম দীনেশচন্দ্র সেন যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র তখন নিজের নোটবুকে লিখেছিলেন : ‘প্রতিভা থাকিলে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হইব। না থাকিলে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক হইব।’ প্রতিভা ছিল না বলে প্রথমটি তিনি হতে পারেননি, কিন্তু অমানুষিক পরিশ্রম দিয়ে যা হওয়া যায় তা তিনি হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক তিনি।

ক্লাসের পড়াশোনাকে কোনোদিন আমি গুরুত্ব দিইনি। পরীক্ষায় কী রেজাল্ট হল তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কিন্তু তাই বলে ফেল? আমার অস্তিত্বটাই যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এই দুঃসহ অপমান আমি কোনোদিন ভুলতে পারিনি। আজও কথাটা মনে হলে আমি যেন ধুলোর সঙ্গে মিশে যাই।

ভর্তি পরীক্ষার এই ব্যর্থতা আমার মানসিক শক্তিকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছিল। ঐ কলেজিয়েট স্কুল হয়ে উঠেছিল আমার কাছে ব্যর্থতা আর পরাজয়ের পতাকা। স্কুলটার দিকে তাকালেই একটা হীনতার অনুভূতি আমাকে চেপে ধরত। মনে হত, এই সেই স্কুল যার দরোজা একদিন অযোগ্য বলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল; এর ক্লাসে বসার অধিকার সে আমাকে দেয়নি। যখনি ঐ স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটেছি তখন স্কুলের প্রতিটি ছাত্রের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আমার ছোট মনে হয়েছে। ভেবেছি কী ভাগ্যবান আর আনন্দিত ওরা। যেখানে আমার পড়ার সুযোগ হয়নি সেখানে কী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রতিদিন ওরা আসছে যাচ্ছে, ক্লাস করছে, হইচই করে খেলছে। জীবন কী বিচিত্র! যে স্কুল একদিন তার দোরগোড়া থেকে আমাকে বিদায় দিয়েছিল বছর কয়েক আগে সেই স্কুলের ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেবার জন্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন। ছাত্রদের কাছে কথা বলতে গিয়ে এই স্কুলের দরোজা থেকে একদিন আমার অশ্রুসিক্ত বিদায়ের গল্প তাদেরকে আমি সবিস্তারে শুনিয়েছিলাম।

কলেজিয়েট স্কুলে ব্যর্থ হবার পর উপায় না দেখে আমি সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হলাম। সিদ্ধেশ্বরী স্কুল পুরানা পল্টন থেকে কাছে, স্কুলে যাতায়াতের সুবিধা— এসব ভেবেই সেখানে আমাকে ভর্তি করানো হল। যে আমি কলেজিয়েট স্কুলে ফেল করেছিলাম, সেই আমাকেই, ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার নম্বর দেখে সিদ্ধেশ্বরী স্কুল লুফে নিল। কেবল লুফে নয়, মাস দুয়েক যেতে না যেতেই আমার যোগ্যতা ও আচার-ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নির্বাচন করা হল স্কুল ক্যাপ্টেন হিশেবে। সে-সময় সিদ্ধেশ্বরী স্কুল সবে গড়ে উঠছে, স্কুলের হেডমাস্টার আমিনুল হক। স্কুলটাকে গড়ে তুলছিলেন তিনিই। তিনি ছিলেন ইংরেজির এম.এ.। যেমন চমৎকার মানুষ, তেমনি ভালো হেডমাস্টার। তাঁর ভেতর ছিল শিক্ষকসুলভ উন্নত মূল্যবোধ। ব্যবহারও ছিল মিষ্টি। আত্মাভিমানী নব্য তরুণকে শিক্ষা দেবার জন্যে বিদ্যাসাগরের কুলিগিরি করার বিখ্যাত গল্পটা বলতে গিয়ে একদিন ক্লাসে বলেছিলেন : ‘দ্যাখো, যার সম্মান এত্তটুকুন সে-ই সবসময় সেটুকু হারিয়ে ফেলার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। মনে করে যেটুকু আছে সেটুকুও বুঝি চলে গেল। তাই সে সামান্য আর ছোট কাজ করতে ভয় পায়। কিন্তু যার সম্মান অনেক তার এ ভয় নেই। তার বিরাট সম্মান থেকে ছিটেফোঁটা গেলে তো কিছু হয়ই না, উল্টো তা আরও বেড়ে যায়। বিদ্যাসাগর কুলিগিরি করায় তার সম্মান কমেনি, বরং বেড়েছিল।’ কথাটা আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

আমি যখন সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হই তখন ঢাকা শহরের উত্তরের সীমা সবেমাত্র পুরানা পল্টন ছেড়ে শান্তিনগরের সবুজ গাছপালা-ভরা জগতের দিকে এগিয়ে চলেছে। শান্তিনগরের ওপারেই ঘন সবুজ গ্রামবাংলা। শান্তিনগর থেকে রাজারবাগ পর্যন্ত রাস্তাটা তখন সবে তৈরি হচ্ছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বিরাট শব্দে হলুদ বুলডোজার সগর্জনে রাস্তা তৈরি করে এগিয়ে চলেছে—দৃশ্যটা আজও আমি চোখের সামনে দেখতে পাই।

সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের আর একজন তরুণ শিক্ষকের চেহারা চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর পৌত্র আসফউদ্দৌলা রেজা। পরবর্তীকালে তিনি ইত্তেফাকের সাংবাদিকতা এবং রেডিওতে একটি গ্রামভিত্তিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করে দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছিলেন। সম্ভবত অল্প কিছুদিনের জন্যেই তিনি সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ছিলেন; রেডিওর কাজের ফাঁকে ফাঁকে এখানে পড়াতেন। তাঁর গলার স্বর ছিল আশ্চর্যরকম সুখদ। কথা ছিল অনবদ্য। সেকালের সেই প্রথম প্রজন্মের অকর্ষিত মানুষদের জগতে তাঁকে পুরোপুরি আলাদা মনে হত। তাঁর পড়ানো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলত। তাঁর গলার স্বর আমার কাছে এমনই অপূর্ব লাগত যে আমি মাথা নিচু করে, চোখ বুজে তাঁর প্রতিটা শব্দের অনবদ্য মাধুর্যকে মনের ভেতর শুষে নেবার চেষ্টা করতাম। কেবলি মনে হত এমন সুন্দরভাবে যদি কোনোদিন কথা বলতে পারতাম!

জীবনে স্যারের মতো সুন্দর কথা বলতে পেরেছিলাম কি না জানি না, কিন্তু স্যারের কথাগুলোকে যে সে-সময় অমন অবিশ্বাস্যরকমে ভালো লেগেছিল তা থেকে মনে হয় সুন্দর করে কথা বলার ব্যাপারে আমার নিজের ভেতরেও হয়ত একটা সহজাত আকুতি ছিল। এই সময় থেকে আমি আমার বাচনভঙ্গিকে সুন্দর আর শ্রুতিমধুর করে তোলার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করতে শুরু করি। এর ফল ফলে। আমার কথা সবার প্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। তার একটা বড় প্রমাণ পাওয়া যায় সত্তরের দশকে এসেই। ঐ দশকের মাঝামাঝিতে আমার টেলিভিশন অনুষ্ঠান যে জনসাধারণের কাছে অতটা জনপ্রিয় হয়েছিল তার একটা বড় কারণ হয়ত ছিল আমার কথা।

উনিশ শো তেরাশি-চুরাশির দিকে ঢাকা বেতারের ট্র্যান্সক্রিপশন বিভাগ দেশের সব জ্ঞানীগুণী ও খ্যাতনামা ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ধারণ করে তা সংরক্ষণ করার একটা বড় কর্মসূচি হাতে নেয়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সাক্ষাৎকারগুলো ঐ সব ব্যক্তির মৃত্যুর পর বিভিন্ন উপলক্ষে প্রচার করা হবে। ঐ কর্মসূচির আওতায় অন্তত পাঁচজন বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেবার জন্যে আমাকে অনুরোধ করা হয়। আমি বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের তালিকা থেকে স্যারের নামসহ পাঁচজনের নাম বেছে নিয়ে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিই। আমি জানতাম এ সাক্ষাৎকার বড় নিষ্ঠুর। রেডিওতে যদি কোনোদিন এই পাঁচজনের কোনো একজনের সাক্ষাৎকার শুনতে পাই তবে বুঝতে হবে তিনি আর ইহলোকে নেই। বছর দশেক পরের কথা। একদিন দুপুরে গাড়িতে যাবার সময় গাড়ির ড্যাশ বোর্ডের রেডিওতে ঢাকা স্টেশন ঘোরাতেই হঠাৎ আমার নিজের গলা শুনতে পেলাম। শুনে কিছুটা অবাক হলাম। রেডিওতে আমার গলা? আমি তো রেডিওতে অনুষ্ঠান করি না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব স্পষ্ট হল। দেখলাম অনুষ্ঠানে আমি কথা বলছি আসফউদ্দৌলা রেজা স্যারের সঙ্গে। আমার শরীর অসাড় হয়ে এল। বুঝলাম, ঘটে গেছে সেই বেদনাময় ঘটনাটি। তিনি বিদায় নিয়েছেন। যাঁর সোনালি কণ্ঠস্বর আর সুমার্জিত বাচনভঙ্গি শুনে একদিন সুন্দর কথা বলার আকুতিতে প্রাণিত হয়েছিলাম আমার শৈশবের সেই অনন্য নায়ক আর পৃথিবীতে নেই।

আমি পাবনা থেকে ঢাকা যাবার মাস তিনেক আগে বড় মামার শ্বশুর আবুল হাসেম খান জেলা সেটলমেন্ট অফিসার হিশেবে পাবনায় বদলি হয়ে আসেন। আমি তখন ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকারি বাসা বরাদ্দ পেতে তাঁর সময় লাগছিল। আমাদের বাসায় তখন আমি মামুন আর আব্বা ছাড়া কেউ ছিলাম না বলে আব্বার আমন্ত্রণে তিনি মাস কয়েকের জন্যে সপরিবারে আমাদের বাসায় এসে ওঠেন। মাস তিন-চার পর তাঁর বাসার সুরাহা হয়। শহরের মাঝামাঝি জায়গায় বড় রাস্তার ওপরে শাদা রঙের তারাশের বিশাল জমিদার বাড়িতে তিনি বাসা বরাদ্দ পান। বাড়িটা তখন সরকারের এক্তিয়ারে। তার নিচের তলা বরাদ্দ হয় তাঁর অফিস হিশেবে, ওপরের তলা বাসা হিশেবে। তিনি সেখানে উঠে গেলে আব্বাকেও তাঁর বাসায় থাকার জন্যে তিনি নিয়ে যান। আব্বা সে বাড়ির সামনের দিকের ডান প্রান্তের বড় ঘরটায়, সম্ভবত জমিদার স্বয়ং যে ঘরটায় থাকতেন, সাময়িক থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

আমি এই ক’মাসের মধ্যে ঢাকায় কলেজিয়েট স্কুলের ব্যর্থতার পর সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের স্কুল ক্যাপ্টেন হিশেবে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছি। স্কুলটার শিক্ষক- ছাত্রেরা আমাকে প্রীতির চোখে দেখলেও এবং স্কুলে হেডমাস্টার বা আসফউদ্দৌলা স্যারের মতো দুয়েকজন ভালো শিক্ষক থাকলেও স্কুলের সাধারণ পরিবেশ ছিল বেশ স্থূল আর রুচিহীন। স্থূল হবারই কথা। কারণ সিদ্ধেশ্বরী এলাকাটা আসলেই তখনও শহরের লাগোয়া একটা গ্রামমাত্র। শহরের ক্লেদগুলো তখন সেখানে পৌঁছে গেছে কিন্তু রুচিগুলো আসেনি। অধিকাংশ ছাত্রের আচার-আচরণ যেমন অকর্ষিত, কথাবার্তা তেমনি অমার্জিত ও নোংরা। একটা স্কুলের পরিবেশ যে এতটা নিম্নমানের হতে পারে এ ছিল আমার চিন্তার বাইরে। দুর্ভাগ্যের কারণে আমাকে যে এমন একটা স্কুলের ছাত্র হতে হয়েছে একথা ভেবে আমার কান্না পেত। পাবনা জিলা স্কুলের ছবির মতো ছিমছাম পরিবেশ, সেখানকার পরিশীলিত বন্ধুবান্ধবদের স্মৃতি মনের ভেতর আরও প্রিয় ও রমণীয় হয়ে উঠত। আমি সারাক্ষণ সেসব স্মৃতি নিয়ে বিমর্ষ ও স্মৃতিভারাতুর হয়ে থাকতাম। আমার দিনরাত্রির স্বপ্নে আর ভাবনায় আমি তাদের দেখতে পেতাম। মনে মনে তাদের সঙ্গে কথা বলতাম। তাদের সঙ্গে আর কোনোদিন কোনোভাবেই দেখা হবে না ভেবে আমার দু’চোখ পানিতে ভিজে উঠত।

তারাশ হাউসে গুছিয়ে বসেই আব্বা তাঁর কাছে আমাকে ফেরত পাঠানোর জন্যে মামাকে চিঠি লিখলেন। পাবনা জিলা স্কুল, স্কুলের বন্ধুবান্ধব আমার সামনে তখন চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলা একটা সোনালি স্বপ্ন মাত্র। পাবনা ফিরে যাবার কথা শুনে সেই অবিশ্বাস্য স্বর্গ ফিরে পাবার সম্ভাবনায় চাঙ্গা হয়ে উঠলাম।

তারাশ হাউসের গোটা অবয়বে একটা রাজকীয়তা ও আভিজাত্য ছিল। একটা সুন্দর জবরজং গেট দিয়ে ঢুকলেই সামনে বিরাট মাঠ, সে মাঠ পেরিয়ে তবে বাড়ি। রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ তখন আমি নতুন পড়েছি। সেই গল্পের চন্দ্রালোকিত রহস্যময় চকিত পৃথিবী তখনও মনটাকে আচ্ছন্ন করে আছে। তারাশ হাউসের সুবিশাল অট্টালিকার ভেতরে আমি যেন সেই রহস্যময় জগৎটাকে চোখের সামনে জীবন্ত দেখতে পেতাম। দোতলার বিশাল হলঘরটায় তখনও তিনটা বড় আকারের ঝাড় লণ্ঠন ছাদ থেকে ঝোলানো ছিল, অল্প বাতাসেই সেগুলো টুং টাং শব্দ করত আর সামান্য আলোর প্রতিফলনে সেগুলো থেকে বৰ্ণিল রশ্মিচ্ছটা ঠিকরে পড়ত। সারাটা বাড়িজুড়ে আমি অদ্ভুত একটা গা-ছমছম-করা অনুভূতি টের পেতাম। যেন অতীত দিনের অনেক হারানো স্মৃতিরা কথা বলছে বাড়িটার ঘরদোরের আড়ালে-আবডালে। অনেকদিনের অনেক গোপন ইতিহাস যেন চোখের পানি ফেলছে। একবার নানা (আবুল হাসেম খান) কিছুদিনের জন্যে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। বিশাল শূন্য বাড়িটার একপ্রান্তে ছিলাম কেবল আব্বা আর আমি। সেই ক’টা দিনে আমার চোখের সামনে বাড়ির রাতগুলো অতীতের সমস্ত ইতিহাস নিয়ে যেন উঠে দাঁড়িয়েছিল। একা একা বিশাল বাড়িটার ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমি যেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর সেই অলীক পৃথিবীতে চলে যেতাম। বাতাসের শুকনো ঝাপটায় বাড়িটার দরোজা- জানালাগুলো ঝনঝনিয়ে বেজে চললে এক অশরীরী জগতের ভৌতিক পরিবেশ জন্ম নিত গোটা বাড়িটার ভেতরে। মনে হত কারা যেন পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, কাদের পায়ের শব্দ যেন ঝাড় লণ্ঠনের স্নিগ্ধ অস্ফুট শব্দের সঙ্গে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটাকে নিয়ে সেই রহস্যের সজীব অনুভূতির ব্যাপারটা খুব সম্ভব ছিল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ পড়ারই ফল।

আমাদের পাবনা কলেজের বাসায় আব্বার দোতলার ঘরের নিচে ছিল একটা ছোট্ট ঘর। এই সেই ঘর যা ছোট আপা একসময় পড়াশোনার জন্যে দখল করে নিয়েছিলেন। একসময় মাস কয়েকের জন্যে ঐ ঘরটাতে আমাকে থাকতে হয়েছিল। স্থানীয় লোকজন বলত অনেক বছর আগে কলেজ বন্ধ থাকার সময় খালি বাড়ির সুযোগ নিয়ে একদিন এক কাজের ঝি নাকি গয়নার লোভে তার মনিবের ছোট্ট মেয়েকে ঐ ঘরে এনে গলাটিপে খুন করেছিল। কাউকে বলতে পারতাম না, কিন্তু ঐ ঘরে রাতে একা থাকতে আমার ভীষণ ভয় করত। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হত গলা টিপে ধরা মেয়েটার চোখদুটো যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসত। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার আলোয় বসে রাত কাটিয়ে খুব ভোরে বিছানায় ফিরে যেতাম। একদিন শীতের রাতে লেপের ভেতর উপুর হয়ে শুয়ে একটা ভূতের গল্প পড়ছিলাম। গল্পটা এত ভয়ের যে দেখলাম গল্পটা যত পড়ছি তত আমার শরীর পুরো অসাড় হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হল পেছনের বন্ধ জানালা দিয়ে নিঃশব্দে দুটো লম্বা হাত এগিয়ে এসে আমাকে যেন আস্তে আস্তে ধরে ফেলতে চেষ্টা করছে। আমি সেই নিঃসঙ্গ ঘরের ভেতর পেছন দিকে না তাকিয়েও ভয়ঙ্কর হাতদুটোকে আমার পিঠের পেছনে নড়াচড়া করতে অনুভব করলাম। ঘাড়ের ওপর তার আঙুলের রোমশ স্পর্শ যেন টের পেলাম। মনে হল সেই অপলকভাবে তাকিয়ে-থাকা ঠাণ্ডা, মৃত ছোট্ট মেয়েটা ঘরের প্রতিটা জায়গা জুড়ে বসে আছে।

তারাশ হাউসের দিনগুলো আব্বার জন্যে ছিল নরক যন্ত্রণার কাল। শিক্ষক হিশেবে আব্বা ছিলেন উঁচু শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত। অধ্যক্ষ হিশেবেও সবাই তাঁকে সম্মান করতেন। শিক্ষকরা একটা জায়গায় খুব দুর্বল। অর্থ-বিত্ত কিছুই তাদের থাকে না। থাকে কেবল একটা জিনিশ : সম্মান। প্রতিদিন ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সমাজের ঠাঁটবাটওয়ালা অসংখ্য লোককে তাঁরা তাঁদের সামনে শ্রদ্ধায় অবনত হতে দেখে। দেখতে দেখতে সম্মানের জায়গাটাতে তারা খুবই নাজুক আর স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। কোনো কারণে সেই সম্মানের ওপর আঘাত পড়লে তারা একেবারে ভেঙে যায়। ঝড়ে উপড়ে পড়া বিশাল বটগাছের মতো অসহায়ভাবে এলিয়ে থাকে। আব্বারও তাই হল। একদিকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, তার ওপর মামলা। এই দুই সামাজিক অসম্মান তাঁকে গুঁড়িয়ে দিল। শুনেছি ঘটনাটার প্রথমদিকে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে আব্বা বিছানায় বসে একা একা কাঁদতেন। কিন্তু এ খুব বেশিদিন চলেনি। আব্বা ছিলেন সৎ আর নৈতিক মানুষ। তিনি জানতেন এই মামলায় তাঁর কিছুই হবে না। অপরাধ না থাকলে অপরাধের চিহ্ন প্রমাণ করা সহজ নয়। মন শক্ত করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি জানতেন যেহেতু তাঁর কোনো অপরাধ নেই সেহেতু তাঁর উকিলেরও দরকার নেই। সত্য নিজেই নিজের কথা বলবে। তাছাড়া উকিল নিয়োগ করার টাকাও তখন তাঁর ছিল না। তিনি ঠিক করলেন নিজেই তিনি নিজের উকিল হয়ে লড়বেন। তাঁর এক পরিচিত উকিল বন্ধুর কাছ থেকে মোটা মোটা আইনের বই এনে তিনি পড়তে শুরু করলেন। ছাত্র হিশেবে আব্বা ছিলেন খুবই মেধাবী। পড়াশোনার ব্যাপারে অদম্য স্পৃহা ছিল তাঁর। প্রতিদিন আট-দশ ঘণ্টা করে আইনের বই পড়ে চললেন তিনি। তারাশ হাউসের তাঁর নিঃসঙ্গ দিনগুলো কাটতে লাগল আইনের পড়াশোনা আর লেখালেখি নিয়ে। অধ্যক্ষ হবার পর বহুদিন পর্যন্ত এমন অফুরন্ত অবকাশ তিনি পাননি। তপস্যার মতো করে তিনি এই সময়টাকে ব্যবহার করতে লাগলেন। এই দুটো চেষ্টার কোনোটাই বৃথা হল না। দুটো নাটক লিখে শেষ করলেন তিনি এক বছরের মধ্যে। এই সময় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পি.ই.এন. (পেন)-এর পক্ষ থেকে নাট্য প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হলে আব্বা তাঁর সদ্য সমাপ্ত ‘মা’ নাটকটি তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নাটকটির বিষয়বস্তুও আব্বার জীবনের সেই সময়কার ঘটনা : টাকা চুরি করে ক্যাশিয়ারের পালিয়ে যাওয়া একটা কলেজের অধ্যক্ষের সামাজিক ও পারিবারিক সংকট। আমি তখন আব্বার সবচেয়ে কাছের মানুষ। একই ঘরে থাকি। নাটকটা ঢাকায় পোস্ট করে বাসায় ফিরে আব্বা আমাকে বললেন,

‘এই নাটক যদি পুরস্কার না পায় তবে বুঝব ‘ধান কাটিমু কচাকচ’রা-ই এদেশে থাকবে।’ মানে সাহিত্যে গ্রাম্যতার যুগই চলতে থাকবে। নাটক নিয়ে আব্বার প্রত্যাশা সফল হল। নাটকটি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেল। এদিকে মামলা থেকেও আব্বা অব্যাহতি পেয়ে গেলেন। আদালতে নিজেই আব্বা নিজের নির্দোষিতার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেন। শুনানির দিনই অভিযুক্তের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়ে গেল। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় কলেজের অধ্যক্ষের পদ ফিরে পেতে তাঁর বাধা ছিল না। কিন্তু কলেজ এবং সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর সম্মানের অবস্থানটি নেমে গেছে বিবেচনা করে তিনি ঐ পদে আর ফিরলেন না। এরই মধ্যে বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ (আব্বার নিজের কলেজ) থেকে তাঁকে অধ্যক্ষ পদের জন্যে আহ্বান জানানো হয়েছিল। পাবনার ঝুট-ঝামেলা শেষ করে যেতে তাঁর কিছুদিন লাগার কথা। তাই বাগেরহাট কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঠিক করা হল মাস তিনেক পরে শিক্ষা বছরের শুরু থেকে তিনি সেখানে যোগদান করবেন। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা এর মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক হল ফল বেরোনোর আগের তিন মাস বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আমি পরিবারের অন্যদের সঙ্গে থাকব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *