ভিন্ন ভাষার শব্দ
কোনো ভাষারই চলে না শুধু নিজের শব্দে। দরকার পড়ে অন্য ভাষার শব্দ। কখনো ঋণ করতে হয় অন্য ভাষার শব্দ। কখনো অন্য ভাষার শব্দ জোর ক’রে ঢুকে পড়ে ভাষায়। জোর যার তারই তো সাম্রাজ্য। শুধু নিজের শব্দে চলে নি বাঙলা ভাষার। ঋণ করতে হয়েছে তাকে বিভাষি, অন্য ভাষার, শব্দ। আবার অনেক সময় প্রচণ্ড কোনো ভাষার শব্দ জোর ক’রে ঢুকেছে বাঙলা ভাষায়, যেমন ঢোকে বিদেশি সেনাবাহিনী। বাঙলায় প্রবেশ করেছে ফারসি শব্দ, ঢুকেছে আরবি শব্দ, ঢুকেছে পর্তুগিজ, ফরাশি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার শব্দ। অনেক শব্দ বাঙলা ভাষা নিয়েছে আপন দরকারে, অনেক শব্দ নিয়েছে নিরুপায় হয়ে; প্রতাপশালী ওই সমস্ত শব্দকে প্রতিরোধ করতে পারে নি অসহায় বাঙলা ভাষা। অন্য ভাষার বহু শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বাঙলা শব্দের সাথে। পণ্ডিত ছাড়া অন্যরা জানেও যে ওই শব্দগুলো বাঙলা নয়। আমিও ক-বছর আগে জানতাম না ‘সবুজ’ বাঙলা নয়। ‘ফসল’ বাঙলা নয়। ‘জমি’ বাঙলা নয়। ‘ফিতা’ বাঙলা নয়। বাঙলা নয় ‘মাস্তুল’, ‘তামাক’, ‘পেয়ারা’, ‘আলকাতরা’, ‘পাঁজা’,’কাগজ’,’জাহাজ’, ‘কাঁচি’, ‘শবরি’ আর ‘তুফান’। এবং আরো বহু শব্দ।
বাঙলা ভাষায় প্রবেশ করেছে প্রধানত ফারসি ও ইংরেজি শব্দ। ফারসি ভাষার মধ্য দিয়ে ঢুকেছে কিছু তুর্কি ও বেশ কিছু আরবি শব্দ। ঢুকেছে কিছু পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ফরাশি শব্দ। অন্যান্য ভাষার শব্দও পাওয়া যায় গুটিকয়। তবে সবচেয়ে বেশি ঢুকেছে ফারসি ও ইংরেজি। ইংরেজি এখনো প্রবলভাবে ঢুকছে বাঙলায়।
বাঙলা ভাষায় ফারসি শব্দ প্রবেশের কারণ বাঙলাদেশে মুসলমান শাসন। তেরো শতক থেকে আঠারো শতকের শেষভাগ পর্যন্ত মুসলমানেরা শাসন করে বাঙলাদেশ। রাজভাষা ছিলো ফারসি। তাই প্রচুর ফারসি শব্দ, ও ফারসি শব্দকে আশ্রয় করে আরবি ও তুর্কি শব্দ অনুপ্রবেশ করে বাঙলা ভাষায়। বাঙলা ভাষায় আছে আড়াই হাজারের মতো ফারসি-আরবি-তুর্কি শব্দ। পুরোনো বাঙলায় কোনো ফারসি-আরবি শব্দ ছিলো না। কিন্তু মধ্যযুগের শুরুতেই বাঙলায় প্রবেশ করে ফারসি শব্দ। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” – কয়েকটি ফারসি শব্দ—কামান, মজুরি, মজুরিআ, খরমুজা—পাওয়া যায়। ষোলো শতক থেকে বাড়তে থাকে বাঙলা ভাষায় ফারসি শব্দের প্রতাপ; এবং আঠারো শতকে তা চরমরূপ লাভ করে। উনিশ শতকের প্রথমভাগেও বেশ প্রভাবশালী ছিলো ফারসি শব্দ। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “কলিকাতা কমলালয়”(১২৩০) গ্রন্থে খুব দুঃখ করেছিলেন বাঙলা ভাষায় ফারসি শব্দের আধিপত্যে। তিনি একটি তালিকা ক’রে দেখিয়েছিলেন যে ফারসি (ও আরবি) শব্দ কীভাবে সরিয়ে দিয়েছে তৎসম ও তদ্ভব বাঙলা শব্দকে। তাঁর তালিকায় দেখা যায় ‘কল’, ‘কলম’,’কম’,’খরচ’, ‘খারাব’, ‘খুব’-এর মতো বহু শব্দ (এগুলোর বাঙলা ‘যন্ত্র’, ‘লেখনী’, ‘অল্প’, ‘ব্যয়’,’মন্দ’, ‘উত্তম’) অধিকার করেছে বাঙলা শব্দের স্থান।
‘কিনারা’ ‘গ্রেফতার’, ‘দেয়াল’, ‘আয়না’, ‘মামলা’ এসেছে ফারসি থেকে। ‘কিনারা’, ফারসিতে ছিলো ‘কিনারাহ’, ‘গ্রেফতার’ ফারসিতে ছিলো ‘গিরিফতার’,’দেয়াল’ ফারসিতে ছিল ‘দিওয়াল’, ‘আয়না’ ফারসিতে ছিলো ‘আইনাহ্’, ‘মামলা’ ফারসিতে ছিলো ‘মুআমলাহ্’। আরো কতো ফারসি শব্দ একটুকু রূপ বদলে বাঙলা হয়ে গেছে।
‘কবুল’, ‘কলম’, ‘জৌলুস’, ‘তুফান’, ‘মরসিয়া’ এসেছে আরবি থেকে। বাঙলায় এদের উচ্চারণ বদলে গেছে। বাঙলা অক্ষরে শব্দগুলোর মূল আরবি রূপ দেখানো একটু কঠিন। ‘কবুল’ এসেছে আরবি ‘ককূল’ থেকে। ‘কলম’ এসেছে আরবি ‘কলম’ থেকে। আরবি ‘জুলুস’ থেকে এসেছে ‘জৌলুস’, আরবি ‘টুফুন’ থেকে এসেছে ‘তুফান’। ‘মরসিয়া’ শব্দটি আরবি থেকে ফারসি হয়ে বাঙলায় এসেছে। আরবিতে শব্দটি ছিলো ‘মরথিয়া’, ফারসিতে ও বাঙলায় ‘মরসিয়া’। ‘কলম’ শব্দটি মূলে ছিলো গ্রিক। তখন তার রূপ ছিলো ‘কলমোস’। আরবিতে হয় ‘কলম’। বাঙলায় ‘কলম’। ‘টুফুন’ আসলে চীনা শব্দ। চীনা ‘তাইফাং’ জাপানিতে হয় ‘তাইফুন’; আরবিতে হয় ‘টুফুন’, ফারসিতে হয় ‘তুফান’। বাঙলায় ‘তুফান’।
সুনীতিকুমার বলেছেন বাঙলায় তুর্কি শব্দ চল্লিশটির বেশি হবে না। ‘আলখাল্লা’, ‘কুলী’, ‘কোর্মা’, ‘খাতুন’, ‘বেগম’, ‘লাশ’ তুর্কি শব্দ। ‘আলখাল্লা’ তুর্কিতে ছিলো ‘আল খালিক’। ‘কুলী’ ছিলো ‘কুলি’, তখন তার অর্থ ছিলো ‘ক্রীতদাস’। ‘কোর্মা’ তুর্কিতে ছিলো ‘কওউর্মা’। ‘খাতুন’ ছিলো ‘খতুন’,’বেগম’ ছিলো ‘বেগুম’। ‘লাশ’ ছিলো ‘লাস’। কেমন আপন হয়ে গেছে এগুলো।
বাঙলা ভাষায় একশো থেকে একশো দশটির মতো আছে পর্তুগিজ শব্দ। আছে গুটিকয় ওলন্দাজ ও ফরাশি শব্দ। ইংরেজি শব্দের কোনো হিশেব-নিকেশ নেই। দিন দিন ইংরেজি শব্দ অনুপ্রবেশ করছে বাঙলায়। শুধু ঢুকছেই না; ইংরেজি শব্দ আমাদের বাধ্য করছে নতুন বাঙলা শব্দ তৈরি করতে, যাতে আরো ইংরেজি ভাব প্রকাশ করতে পারি বাঙলা শব্দে। বাঙলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ কতো আছে, তা কেউ জানে না।
‘আনারস’, পিস্তল’,’ছায়া’, ‘কামরা’, ‘বালতি’, ‘পেঁপে’ পর্তুগিজ শব্দ। ‘আনারস’ পর্তুগিজে ছিলো ‘অননস’। ‘পিস্তল’ ছিলো ‘পিস্তোল’। ‘সায়া’ (মেয়েদের পোশাক) পর্তুগিজে ছিলো ‘সইঅ’। ‘কামরা’ ছিলো ‘কমর’। ‘বালতি’ পর্তুগীজে ছিলো ‘বলদে’। ‘পেঁপে’ ছিলো ‘পপইঅ’।
ইংরেজি শব্দের কোনো হিশেব নেই। গুটিকয় ইংরেজি শব্দ তুলে দিচ্ছি। অফিস পালিশ কলেজ গবর্নমেন্ট হারিকেন ডজন শার্ট রোড ফটো কোর্ট চেয়ার আস্তাবল ইস্টিমার কেটলি লাট। বহু শব্দ বাঙলা ভাষায় গঠিত হয়েছে ইংরেজি শব্দের অনুসরণে। এমন কয়েকটি শব্দ : ‘মন্ত্রীসভা’ (কেবিনেট),’সভাপতি (চেয়ারম্যান),’পরমাণু’ (অ্যাটম), ‘ভূগোল’ (জিওগ্রাফি), ‘অণুবীক্ষণ’ (মাইক্রোস্কোপ), ‘দূরবীক্ষণ’ (টেলিস্কোপ), ‘ছায়াপথ’ (মিল্কিওয়ে), বিশ্ববিদ্যালয় (ইউনিভার্সিটি) ‘ সিন্ধুঘোটক’ (হিপোপটমাস), ‘লোহিতসাগর’ (রেডসি), ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’ (কেপ অফ গুড হোফ), ‘বাতিঘর’ (লাইটহাউস), ‘পাদপ্রদীপ’ (ফুটলাইট), ‘সংবাদপত্র’ (নিউজপেপার)। এখন নিত্য নতুন শব্দ তৈরি হচ্ছে ইংরেজি শব্দের অনুসরণে। তাই বাঙলা ভাষা এখন ইংরেজির আত্মা খানিকটা বহন করে নিজের শরীরে।