ভিত রহস্য – অমিত কুমার সাহা
পড়াশোনা শেষ করার অনেকবছর পর রনি একটা চাকরি পেলো, সরকারি চাকরি। সারা
পরিবারে খুশীর হাওয়া।পরিবার বলতে তিনজন,মা বাবা আর রনি নিজে। এতদিনের কষ্টের যেন সার্থকতা।
প্রতিদিন সকালে উঠে রনি চাকরিতে যায়, সন্ধ্যে হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। ওদের একটা বাড়ি আছে, কাঁচা বাড়ি। বৃষ্টি হলে চাল দিয়ে জল পড়ে, ঘরের ভেতর ভিজে যায়।এ ছবি বহুদিনের পুরনো।দু’বেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করে, রনির পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়েই গোটা সংসারের হিমশিম অবস্থা!ঘর ঠিক করার দরকার হলেও তার আর সামর্থ্যে কুলায় নি। ভাঙ্গাচোরা ঘরবাড়ি,তা নিয়ে কম কথা শুনতে হয়না ওদের। এমনকি ওদের আত্মীয় স্বজনরাও তেমন আসে না ওদের বাড়িতে!
তাই রনির ইচ্ছে ছিল বরাবর এই পরিচিত ছবিটা বদলানোর। রনি নতুন চাকরি পেয়ে পায়ের তলায় যেন একটু মাটি পেলো! মনে মনে ভাবে কিভাবে একটা পাকা বাড়ি তৈরি করা যায়?
একদিন কাজের জায়গায় আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ করে কথাপ্রসঙ্গে রনি ওর এক কলিগকে
ওর পাকা বাড়ি তৈরির স্বপ্নের কথা বললো।ঐ কলিগ রনিকে একটা বুদ্ধি দেয়।
রনিদের বাড়ির জায়গাটা বেশ কম। তাই রনি লোন নিয়ে একটা নতুন জায়গা কেনে ঐ কলিগের বুদ্ধি মতো। তবে জায়গাটা মূল শহর থেকে অনেকটাই দূরে।আর সেজন্য দামটাও অনেকটা কমেই পেয়ে গেলো! এরপর হোম লোন নিয়ে আগের লোনের টাকাটা শোধ করে দেয়। বাড়ি তৈরির স্বপ্ন সফল হবার দোরগোড়ায় রনিরা।
ঠিক হয় ভিত করেই বাড়ি করবে।ভিতপুজো হবার পর যথারীতি ভিতের মাটি কাটা শুরু হয়। তিন দিন মাটি কাটার পর,ভিতের মাটি কাটার সময় মাটির নীচে কিছু একটা শক্ত জিনিস কোদালে ঠেকে! ভালো করে সন্তর্পণে মাটিটা কাটার পর একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে আসে!
রনি অফিসে। রনির মা ওদের পুরোনো বাড়িতে।
একজন লোক ভিতের মাটি কাটছে, রনির বাবা
দাঁড়িয়ে দেখছেন।এমন সময় কোদালের মাটির তালের সঙ্গে কি একটা শক্ত সাদা জিনিস উঠে এলো। ঐ লোকটা রনির বাবাকে বললো,
“দেখুন তো কাকা, সাদা মতো মাটিমাখা এই জিনিসটা কি?”
রনির বাবা ঐ মাটির তাল থেকে জিনিসটা বের করে জল দিয়ে ধুলেন। তারপর তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ!
“এ যে,এ যে মানুষের হাতের হাড়!”
কি করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না রনির বাবা।ঐ লোকটা তখন বলে,
“কাকা,এটার কথা কাউকে বলতে হবে না, লোকজন জানাজানি হয়ে গেলে নানান ঝামেলা!”
“তাহলে এটা নিয়ে এখন কি করি বলো তো?”, রনির বাবা জিগ্গেস করেন।
তারপর ঐ লোকটার কথামতো রনির বাবা ঐ জিনিসটা কোনো একটা আলাদা জায়গায় রেখে
দেন।এই ঘটনার কথা আর কেউ জানতে পারে না। পরের দিন রনির বাবা ঐ জিনিসটা নিয়ে একটা লোকের কাছে যায়।
এরপর কয়েকদিন কেটে যায়। বাড়ির ভিত কাটা কমপ্লিট। গাঁথুনি শুরু হয়েছে। বেশ কিছুটা গাঁথুনিও হয়ে গেছে। হঠাৎ রনির বাবা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেদিন রবিবার, রনি তাই বাড়িতেই। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় রনি ওর বাবাকে। ওষুধ দেন ডাক্তারবাবু।বলেন,
“ভয়ের কিছু নেই।”
রনি ওর বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কদিন ধরেই নতুন বাড়ির কাজ বন্ধ! রনির বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু চেহারায় ভাঙ্গন ধরে। দিন দিন শীর্ণকায় হতে থাকে ওনার শরীর! একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রনি বাবাকে অনেক ডেকেও কোনো সাড়া পায় না।ওর বাবার সারা শরীর ঠাণ্ডা! হৃদস্পন্দনও পাওয়া যাচ্ছে না!আর এক মুহুর্ত দেরী না করে রনি ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনে। ডাক্তারবাবু আসেন, জানান,
“সব কালরাতে ঘুমের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে রনি!”
রনির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে!কি করবে, কিভাবে মা’কে সামলাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
যাই হোক, বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বাড়ি ফিরে আসে রনি।কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না রনি! দেখতে দেখতে দিন এগিয়ে চলে। নতুন বাড়ির স্বপ্ন বন্ধ।বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
আজ একমাস হয়ে গেল, বাবা চলে গেছেন। রনির সবসময় বাবার কথা মনে পড়ে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে চোখের সামনে ভাসে সব!একসময় চোখ লেগে আসে।
রাতে রনির বাবা স্বপ্নে আসেন। রনিকে সেদিনের গোটা ঘটনাটি বলেন। এমনকি উনি কোথায় গিয়েছিলেন,তাও জানান রনিকে।
রনি পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মা’কে আর কিছু বলে নি। অফিস যাবার সময়ে বেরিয়ে পড়ে, বাড়ি থেকে।
ঠিক রনির বাবা যেমন বলেছিলেন, সেই অনুযায়ী
রনি সেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছায়। জায়গাটার এক অদ্ভুত পরিবেশ, দিনেরবেলায়; তাও গা ছমছমে!এক তান্ত্রিক বসে আছেন এক বিশাল
বটগাছের নিচে। রনি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে যায়।
“কি ব্যাপার? বল বাবা!”, উনি জিগ্গেস করলেন রনিকে।
রনি তখন ওর বাবার চেহারা এবং ঘটনাটির কিছু বর্ণনা দিতে ঐ তান্ত্রিক বুঝতে পারেন। রনিকে কাছে ডেকে নিয়ে বসান। উনি বলেন,
“দেখ বাবা! তোর বাবা যে জিনিসটি নিয়ে এসেছিলেন,সেটি কোনো এক মৃত মানুষের হাতের হাড়। তোরা যে জায়গায় বাড়ি করছিস,সেটা মোটেই ভালো জায়গা নয়।ওর পাশে যে শুকনো জলা জায়গাটা আছে ওটা আগে একটা খাল ছিল।”
রনি জানতে চায়,
“জায়গাটা ভালো নয় কেন?”
উনি বলেন,
“ঐ খালটা আর তোদের কেনা জায়গাটার
আশেপাশে ছিল কবরখানা।ঐ হাড়টা কোনোভাবে মাটির নীচে চাপা পড়ে যাওয়া কোনো অপঘাতে মৃত্যু হওয়া শরীরের। তোর বাবা যখন ঐ হাড়টা নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন, তখনই আমি গোটা ব্যাপারটা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম। শুধু তাই নয়, উনি যে বেশিদিন আর বাঁচবেন না,তাও আমি জানতাম, কিন্তু ওনাকে কিছু বলিনি।”
রনি সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ওনাকে বলে,
“এখন তাহলে আমি ঠিক কি করবো?ব্যাঙ্কের এতগুলো টাকা লোন, এদিকে বাড়িও প্রায় অনেকটাই তৈরি হয়ে গেছে, এখন তো আর আমার পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়!”
ঐ তান্ত্রিক রনিকে আশ্বস্ত করে বলেন,
“তোর বাবা নিজের হাতে ঐ হাড় স্পর্শ করেছিলেন,তাই আমিও পারিনি ওনাকে বিপদ
থেকে বাঁচাতে। তুই চিন্তা করিস না। আগামী শনিবার অমাবস্যা; ঐদিন আমি ছদ্মবেশে তোর ঐ জায়গায় গিয়ে কিছু ক্রিয়াকলাপ করে দিয়ে আসবো। কিন্তু ঐ জায়গায় তুই ছাড়া আর কেউ যেনো না থাকে।”
রনি সম্মত হয়।
শুক্রবার দিন কিছু মিস্ত্রি আসে,কবে থেকে বাড়ির কাজ শুরু হবে জানতে। রনি জানায়, কয়েকদিন পর রনি ওদের ফোন করে জানাবে।
শনিবার দিন,রনি ঠিক বেলা বারোটায় ওর কেনা
জায়গাটায় পৌঁছে যায়। তারপরই ঐ তান্ত্রিক আসেন, কাঁধে ঝোলা,পুরোপুরি ভিখারির ছদ্মবেশ।
উনি এসে কিছু মন্ত্রপূত জিনিস রনিদের নির্মিয়মান বাড়ির চারপাশে ছিটিয়ে দেন। বাড়িটার মাঝে বসে কিছু ক্রিয়াকলাপও করেন। এমন সময় রনি দেখতে পায়, রনিদের নির্মিয়মান বাড়ির পেছনে থাকা তেঁতুল গাছটার বড় একটা কাঁচা ডাল আচমকাই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ছে।রনি খুব ভালো করে দেখে, না আশেপাশে কেউ রয়েছে, না গাছের ওপরে। এদিকে ঐ তান্ত্রিকের মন্ত্রোচ্চারণ চলছে।
একসময় ডালটি পুরোটাই মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে!
তান্ত্রিক চিৎকার করে বলে ওঠেন,
“যা! এবার মুক্তি।”