ভিতরের চোখ
অফিসের কাজে বোম্বে গিয়েছিলাম, ভাবলাম, চট করে একবার গোয়া থেকে ঘুরে আসা যাক। হাতে তিনদিন সময় আছে। পাঞ্জিমে একদিন কাটাবার পর চলে গেলাম কালাংগুটের সমুদ্রতীর দেখতে।
তখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে চতুর্দিকে অপরূপ নরম আলো। দূরে সমুদ্রে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দৃশ্যের সৌন্দর্য এখানে একটা বিশাল মহিমা বিস্তার করেছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এখানে বেশ ভিড়। হিপিদের বড়ো একটা দল তো রয়েছেই, তা ছাড়া এখন ভ্রমণকারীদের মাস এবং ভ্রমণকারীদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা যথেষ্ট।
প্রায় বিচের ওপরেই একটা ছোট রেস্তোরাঁ। সেখানে বসবার জায়গা নেই। বালির ওপরে হুটোপুটি করছে অনেকে। কেউ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে জলের দিকে। জল বেশ খানিকটা দূরে।
একটি পুরুষ ও একটি রমণীকে আমি পাশাপাশি জলের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি তাদের পিঠের দিক। সূর্যাস্তের দিকে এগোচ্ছে বলে, বিপরীত দিক থেকে আসা আলোয় তাদের শরীর দুটি কালো রেখায় আঁকা। হাওয়ায় উড়ছে মেয়েটির আঁচল, ছেলেটির হাতে সিগারেট। মন্থর তাদের চলার ভঙ্গি।
হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগল। মনে হল ওই মেয়েটির হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি আমার পরিচিত।
আর একবার তাকিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। রূপাকে আমি এতদিন ধরে এতভাবে দেখেছি যে, আমার ভুল হবার কথা নয়। শুধুমাত্র পেছন দিকটা দেখে, তাও প্রায় একশো গজ দূর থেকে এবং গোধূলিকালীন ম্লান আলোয় কোনো মেয়েকে চিনতে পারার কথা নয়, কিন্তু আমার মনে কোনো দ্বিধা রইলো না।
আমি অপেক্ষা করলাম না। পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম। রূপা জলের ধার থেকে এক্ষুনি ফিরে আসবে, আজ যেন আমাকে দেখতে না পায়। আমার অভিমান বড়ো তীব্র।
তা ছাড়া, রূপা হয়তো ভেবে বসতে পারে, ও ওখানে ওর স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে আসবে জেনেই আমি এখানে এসেছি। মেয়েদের মন বড়ো বিচিত্র। আমি এখনো রূপার জন্য কাতর হয়ে আছি কিংবা ওদের সুখে বিঘ্ন ঘটাতে এসেছি—এরকম ভেবে বসাও বিচিত্র নয়।
আমার ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল। ফিরে এসে বললাম, চলো।
ট্যাক্সিওয়ালা অবাক। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য কেউ এতটাকা খরচ করে ট্যাক্সিভাড়া নিয়ে কালাংগুটের বেলাভূমি দেখতে আসে না। কিন্তু প্রকৃতি আমার জন্য বিস্বাদ হয়ে গেছে।
পাঞ্জিমে ফিরে ঠিক করলাম, তার পরের দিন ভোরেই বাস ধরে ফিরে যাবো বোম্বে। রূপাও নিশ্চয়ই পাঞ্জিমে আসবে, তখন আমার সঙ্গে দেখা হোক, আমি চাই না।
একবার শুধু মনে হয়েছিল, যদি রূপা না হয়! আমার দিকে পিছন ফিরে থাকা একটি নারীমূর্তি, উড়ন্ত শাড়ির আঁচল—শুধু এইটুকু দেখেছি। পরক্ষণেই মনে হল, ওই মেয়েটা রূপা ছাড়া আর কেউ নয়। আমি নিজের সঙ্গেই নিজে একটা বাজি ধরে ফেললাম। এবং ফিরে গেলাম পরদিন ভোরে।
রূপার সঙ্গে দ্বিতীয়বার আমার দেখা কলকাতা রবীন্দ্রসদনে। দেখা মানে, এবারও এক পক্ষের ব্যাপার, অর্থাৎ আমিই শুধু দেখেছি, রূপা দেখেনি।
একটা বিখ্যাত নাটক দেখতে এসেছিলাম। টিকিট হাতে নিয়ে রবীন্দ্রসদনের কাচের দরজাগুলোর সামনে এসে সবেমাত্র দাঁড়িয়েছি, দেখলাম, ভেতরের লবিতে আরও দু-তিনজন নারী-পুরুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। এবারও আমার দিকে পেছন ফেরা। নতুন ডিজাইনের খোঁপা, একটা ময়ূরকণ্ঠি রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে, হাতে একটা অনুষ্ঠান-পত্র, খুব গল্পে মত্ত।
দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। আজ চিনতে ভুল হবার কোনো প্রশ্নই নেই। বিয়ের পর সামান্য একটু শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে, আগের মতন ছিপছিপে ভাবটা আর নেই। তবু ওর হাতের একটা আঙুল শুধু দেখলেও বোধহয় আমি চিনতে পারবো।
এখন ভিতরে ঢুকলে রূপার চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই। ঠিক করলাম, একটু পরে ঢোকা যাবে। এখন গিয়ে দরকার নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে চলে গেলাম ময়দানে। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। খানিকটা বাদে ঘড়ি দেখে বুঝলাম, এতক্ষণে নাটক আরম্ভ হয়ে গেছে, এখন সকলেই ভিতরে ঢুকে গেছে। এখন যাওয়া যেতে পারে।
তবু আমার যেতে ইচ্ছে করলো না। মনে মনে একটা যুক্তি খাড়া করলাম, নাটক শুরু হবার পরে ভিতরে ঢোকা অভদ্রতা। অন্য দর্শকদের ব্যাঘাত হয়। আসলে, একই হলঘরের মধ্যে, এক ছাদের নীচে, যেখানকার হাওয়ায় রূপার নিশ্বাসের সঙ্গে আমার নিশ্বাস মিলবে—আমি থাকতে চাইছিলাম না। আমার জীবনে রূপা নামে কেউ নেই।
অনেকক্ষণ একলা একলা ঘুরলাম ময়দানের অন্ধকারে। তারপর হঠাৎ একসময় আমি ভাবলাম আমার কি মন খারাপ? আমি একা অন্ধকারে ঘুরছি কেন?
কথাটা ভেবেই আমার হাসি পেল। আড়াই বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে রূপার। এখনও সেইজন্য মন খারাপ করে করে ঘুরে বেড়াবার মতন নরম প্রেমিক তো আমি নই। এমনকি এই জন্য একটা থিয়েটারে টিকিট নষ্ট করারও কোনো মানে হয় না। অথচ রূপাকে দেখলেই আমার মনে একটা দুরন্ত অভিমানবোধ জেগে ওঠে। যুক্তিহীন এই অভিমান। রূপার বিয়ের আগে আমি তো জোর করে কিছু বলিনি। রূপাকে শুধু বলেছিলাম, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে। রূপা আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি। আমি তো নিজেই জানি, ওর অনেক অসুবিধা ছিল। যাই হোক সেসব এখন চুকে-বুকে গেছে।
কিন্তু কলকাতা শহরটা আসলে খুব ছোটো। কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকেই। আমাকে অবশ্য চাকরির জন্য প্রায়ই কলকাতার বাইরে থাকতে হয়। রূপার স্বামীও বদলির চাকরি করে শুনেছি।
কিছুদিন পরেই রূপাকে আর একবার দেখলাম। এইবার রূপাও হয়তো আমাকে দেখেছে, তাও দু-এক পলকের জন্য মাত্র।
আমার এক বন্ধুকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়েছিলাম হাওড়া স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ভিড়, কিন্তু ব্যস্ততার কিছু ছিল না আমাদের। সিট রিজার্ভ করাই ছিল। আমি আর অসিত পাশাপাশি হাঁটছিলাম। অসিতের সঙ্গে ছোটো সুটকেস, কুলি নেওয়ারও দরকার ছিল না।
হঠাৎ একটি কামরার জানলার দিকে চোখ পড়ল। রূপা বসে আছে জানালার ঠিক পাশটিতেই। একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল।
চোখের পলক পড়তে বোধহয় একটু দেরি হয়েছিল। কিন্তু আমি থামিনি। এগিয়ে গেলাম। রূপা কি আমাকে চিনতে পেরেছে? যদি অন্যমনস্ক থাকে তা হলে লক্ষ না করতেও পারে।
হঠাৎ রূপার দিকে আমার চোখ গেল কেন? অসিতের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলাম, কোনোদিকে তো আগে তাকাইনি। অবশ্য, মেয়েদের দিকে চোখ আপনি চলে যায়। কিন্তু রেলের এতগুলো কামরায় আর কোনো জানালার পাশে আর কোনো মেয়ে কি বসে নেই।
অসিত জিজ্ঞেস করল মেয়েটিকে চেনা চেনা মনে হল না?
আমি কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, কে? ওই সামনে যিনি যাচ্ছেন লম্বা মতন?
অসিত বলল, না, ওই যে জানলায় যাকে দেখলাম।
কারুর চোখের দিকে ঠিক তাকিয়ে আমি মিথ্যে কথা বলতে পারি না। তাই সিগারেট ধরাবার ছলে মুখ নীচু করে বললাম, আমি ঠিক লক্ষ করিনি।
অসিতের সংরক্ষিত আসন সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। আমরা দু-জনে কামরায় উঠে বসলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনো মিনিট পনেরো দেরি আছে।
কিছুক্ষণ গল্প করার পর আমি লক্ষ করলাম, প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে রূপা। হাতে একটি জলের ফ্লাস্ক। চোখে কিছু একটা খোঁজার দৃষ্টি। কি আর খুঁজবে, জলের কল নিশ্চয়ই।
একটু পরে যখন ট্রেন ছাড়ল আমি প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়ালাম। ট্রেনটা চলতে লাগল আমার সামনে দিয়ে। অসিতের উদ্দেশে আমি রুমাল ওড়াতে লাগলাম। আর একবার রূপার দিকে চোখ তো পড়বেই। কিন্তু সঠিক সময়ে আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে পেরেছি, এবং রুমালটা পুরে নিয়েছি পকেটে। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাবার পর আমার মনে হল, আমি এবার সত্যিই রূপাকে আমার জীবন থেকে বিদায় দিলাম।
এরপর সত্যিই আর বছর তিনেকের মধ্যে রূপার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। সময়ে অনেক কিছু ম্লান হয়ে যায়। কত গাছের পাতা ঝরে পড়ে। এই চোখে পুরোনো হয়ে যায় পৃথিবী। অনেক গুরুতর মান-অভিমানও হয় অতি সামান্য।
অফিসের কাজেই গিয়েছিলাম দিল্লিতে। উঠেছি হোটেলে। সারাদিন বহু অকিঞ্চিৎকর লোকের সঙ্গে দেখা করার কাজ। অকারণ ভদ্রতার হাসি দিতে দিতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যায়।
পরদিন খুব ভোরে উঠে হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, কী যেন একটা পুজোর প্যান্ডেল সেখানে। এর মধ্যেই পরিচ্ছন্ন পোশাকের অনেক নারী-পুরুষের ভিড়। দুম করে মনে পড়ে গেল আজ সরস্বতী পুজো। আমার খেয়ালই ছিল না।
খুব ছেলেবেলা থেকেই আমি সরস্বতী পুজোর দিন অঞ্জলি দিয়ে থাকি। সেই ছেলেবেলায় যখন নিজেরাই পুজো করতাম, তখন তো আমরা এটা মেনে চলতাম খুব। ছেলেবেলার অনেক কিছুই আর নেই, শুধু এই অভ্যেসটা রয়ে গেছে। চা খেলাম না। ভাবলাম, এত কাছেই যখন পুজো তখন অঞ্জলিটা দিলেই তো হয়। সরস্বতীর সঙ্গে এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই। খবরের কাগজ আর ইংরেজি গোয়েন্দা কাহিনি ছাড়া কিছু পড়ি না—তবু পুরোনো অভ্যেসটা খোঁচা মারতে লাগলো।
ধুতিটুতি নেই। প্যান্ট-শার্ট পরেই চলে গেলাম পুজো প্যান্ডেলে। এখানে কারুকেই চিনি না। তবু বাঙালিদের ব্যাপার, নিজেকে খুব একটা বহিরাগত মনে হয় না।
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিচ্ছিলাম। পাশ থেকে একটা সুগন্ধ পেলাম। ফুলের নয়, কারুর চুলের অনেক কালের চেনা গন্ধ। লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। হাতের ফুলগুলি ছুঁড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছ?
পুরোনো অভিমান-টভিমান সব মরে গেছে। আমি হাসিমুখে বললাম, ভালো।
তুমি কেমন?
রূপা বলল, চা খাওনি নিশ্চয়ই? তুমি তো অঞ্জলি দেবার আগে কিছু খেতে না।
মনে আছে!
সব মনে আছে। আমার বাড়ি কাছেই। আসবে?
এর আগে রূপাকে দেখলেই এড়িয়ে চলে গেছি। আজ এই সকালবেলার প্রসন্ন আলোয় আমার বাল্যকালের বান্ধবীকে দেখে মনের মধ্যে আর কোনো রাগ দুঃখ অনুভব করলাম না। মনে হল, এই রোদ হাওয়া ও শিশুদের কলরবের মতন সবকিছু স্বাভাবিক।
পুজো-প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এলাম দুজনে। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার স্বামী আসেননি?
না, এখনো ঘুম ভাঙেনি।
কয়েক পা নিঃশব্দে চলার পর কিছু একটা বলার জন্যই আমি বললাম, কতদিন পর দেখা। প্রায় ছ-বছর তো হবেই। কি বলো?
রূপা বলল, কেন?
এর আগে তো আরও দেখা হয়েছে।
রূপার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, কোথায়?
রূপা হাসল। বলল, কেন?
আমার বিয়ের কয়েক মাস পরেই, গোয়ার কালাংগুট বিচে তুমি ছিলে না?
চমকে উঠলাম। শুধু মাত্র পেছন দিক থেকে দেখে আমি সেই মেয়েটিই রূপা কিনা এ সম্পর্কে একটু দ্বিধা করেছিলাম। আর রূপা আমাকে কখন দেখল?
রূপা বলল, আমি ফিরে এসে তোমাকে আর খুঁজে পেলাম না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম তোমার জন্য।
আমার হাতে বেশি সময় ছিল না। ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল।
আমি ভেবেছিলাম। পাঞ্জিমে ফিরে এসে অন্তত দেখা হবেই। ছোটো জায়গা তো। তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল।
আমি পরদিন ভোরেই…
তারপর রবীন্দ্রসদনে—তুমি গেট দিয়ে ঢুকছিলে।
সেদিন তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে?
কেন পাবো না?
তুমি অন্যদিকে ফিরে ছিলে।
মেয়েদের ভিতরে একটা আলাদা চোখ থাকে জানো না? সেই চোখ দিয়ে দেখেছিলাম। তুমি গেট ঠেলে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলে না। আমি ভাবলাম, কিছু একটা বোধহয় ফেলে এসেছো। আমি তোমার জন্য বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ। নাটক শুরু হয়ে গেল, তবু আমি ভিতরে ঢুকিনি, কিন্তু তুমি এলে না আর। কোনো মিথ্যে অজুহাত দিতে ইচ্ছে করল না আর। তাই চুপ করে রইলাম।
রূপা আবার বলল, তারপর একদিন হাওড়া স্টেশনে, আমি জানলার ধারে বসে।
সেদিন বোধহয় তুমি আমাকে দেখতে পাওনি, না?
মৃদু গলায় বললাম, পেয়েছিলাম।
তবু তুমি আমার সঙ্গে কোনো কথা বললে না কেন? চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হলে বুঝি চোখ ফিরিয়ে চলে যেতে হয়?
না, ঠিক তা নয়।
তারপর আমি প্ল্যাটফর্মে নেমে তোমাকে খুঁজলাম। গাড়ি ছাড়ার আগে পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিলাম।
কেন দাঁড়িয়েছিলে রূপা? আমি ভেবেছিলাম। ওইসব সময়ে তুমি কোনোবারই আমাকে দেখতে পাওনি। তাই আমি—
রূপা খুব নরমভাবে বলল, কেন এরকম ভাবলে? আমি তোমায় না দেখে পারি?
আমি রূপার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম। সত্যিই আজ কোনো রাগ আর অভিমান নেই। রূপা আজ এই সকালবেলাটার মতনই সুন্দর। আজকের সকাল শুধু আজকেরই সকাল।
রূপা আবার বলল, তুমি এক-সময় আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলে। আমি তখন পারিনি। তারপর, তোমাকে যখনই দেখেছি, গোয়ার সমুদ্রের ধারে, রবীন্দ্রসদনে, হাওড়া স্টেশনে—আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি—তোমাকে একটা কথা বলার ছিল, কিন্তু তুমি আসনি।
আমি বললাম, আজ আর সে কথা বলার দরকার নেই। আমি সব বুঝতে পেরে গেছি।
সত্যি বুঝতে পেরেছো?
না হলে মনটা এমন পরিষ্কার লাগছে কেন?
জনবিরল রাস্তার বিরাট আকাশের নীচে, নরম রৌদ্রে রূপার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমার মনে হল, এই নারী আর আমার নয়, কিন্তু আমি কিছুই হারাইনি। সবই থেকে গেছে। অভিমান আমাকে রিক্ত করে দিয়েছিল, কিন্তু এখন আমি অনুভব করতে পারি—আবার কখনও সমুদ্রবেলায় সূর্যাস্তের মুখোমুখি এই নারীকে হেঁটে যেতে না দেখলেও, সেই দৃশ্য শাশ্বত হয়ে থাকবে।