ভিটেমাটি

ভিটেমাটি

আজ কখন ফিরবে গো?

অফিস বেরোনোর আগে লাস্ট মিনিট ব্যাগ চেক করছিলাম। পর্ণার প্রশ্নে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কাল বিকেল থেকে চেপে রাখা সুসংবাদটা। চট করে সামলে নিয়ে বললাম, কেন, কোথাও বেরোবে?

না। ভালমামা আসবেন। পরপর ক’দিন এসে ফিরে গেলেন। তোমার সঙ্গে কী যেন দরকার। আমার সঙ্গে কী এমন কথা, যা পর্ণাকে বলা যায় না। বললাম, কী দরকার তুমি শুনে নিয়ো। আমার ফেরার কোনও ঠিক নেই।

আমাকে বলার হলে বলেই দিতেন, রোজ ঘুরে যেতেন না। তুমি আজ অন্তত তাড়াতাড়ি ফিরো। এমন সময় আসেন, চা জলখাবার দিতেই হয়। বাবানটার হোমওয়ার্ক করাতে পারি না। টুকটাক দোকান বাজার করার থাকে।

আচ্ছা দেখি। বলে, বেরোতে যাচ্ছিলাম। পর্ণা একটু যেন ঝাঁঝিয়ে উঠল, দেখি নয়। তাড়াতাড়ি ফিরবে। রোজ রোজ তোমার মামাকে আপ্যায়ন করার সময় আমার নেই। তাও আবার লতাপাতায় সম্পর্ক। শ্বশুরমশাই থাকতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারতেন, সে ঠিক আছে। সময়মতো চা-টা জুগিয়েছি। এখন আমাদের সঙ্গে কী দরকার বাবা।

বুঝতে পারছি, ভালমামার অসময়ে উপস্থিতি পর্ণাকে বেশ বিরক্ত করেছে। তার ওপর আমার সঙ্গে কী প্রয়োজন, পর্ণাকে বলছেন না। অপমানিতও হয়েছে নিশ্চয়ই পৰ্ণা। ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বলি, দেখো বোধহয় তোমার চা জলখাবারের আকর্ষণে চলে আসেন। এটাকে কমপ্লিমেন্ট হিসেবে ধরতে পারো না!

দরকার নেই আমার এরকম অসহ্য কমপ্লিমেন্টের। একটু আশ্চর্য হলাম। জানতে চাইলাম, অসহ্য কেন?— কেন আবার। বাবানকে পড়াচ্ছি হাতে চা নিয়ে এসে সেই যে বসলেন, শুরু হল পুরনো দিনের কথা। তোমার বাবা ওঁর কেমন বন্ধু ছিলেন। কী কী করতেন ওঁরা, এই এলাকাটা কেমন ছিল তখন… নানান কথা। কাল আবার বলেন কিনা, জানো বউমা, তোমাদের বাড়ি এলে, এখনও তোমার শ্বশুরের গন্ধ পাই। মনে হয় ও যেন এ বাড়িতেই আছে। মিশে আছে বাতাসে। তোমরাও হয়েছ যোগ্য সন্তান, ওর সাজানো বাড়ি যেমনকার তেমনই রেখেছ, একটা আসবাবও এদিক ওদিক করোনি… যতসব অলুক্ষুনে, তেল মারা কথাবার্তা। তার ওপর আছে ঘনঘন নস্যি নেওয়া। নোংরা রুমাল বার করে নাক মোছা। বাবানটাও ঘেন্না পায়। কে বলবে, ওঁর ছেলে অতবড় চাকরি করে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন খানদানি বাড়িতে…

কথা ঘুরে গেছে অনেক দূরে। নির্ঘাত লেট হয়ে যাবে অফিসে। পর্ণার বকর বকরের একটা সুবিধে আছে, কাজ করতে করতে কথা বলে। ফাঁকতালে বেরিয়ে এলাম। বেচারা হয়তো বকেই যাচ্ছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সরু এবড়ো খেবড়ো গলি। রিকশা ঢোকারও জায়গা নেই। দেড় মিনিট হেঁটে বড় রাস্তা। স্টেশনে যাওয়ার জন্য অটো অথবা রিকশা ধরতে হবে।… নস্যি আমার বাবাও নিত। তখন পর্ণাকে এত বিরক্ত হতে দেখিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর সত্যিই দূর সম্পর্কের হয়ে গেছেন ভালমামা। পর্ণা ততটা উদার হতে পারছে না। ভালমামার নেশা, রুমাল নিয়ে আমি তেমন ভাবছি না। তার থেকেও বড় একটা অস্বস্তি পর্ণা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। খুব ভুল সময় ভালমামা এ বাড়ির ইতিবৃত্ত বলতে শুরু করছেন। তার মানে এখনও একজন অভিভাবক আছেন আমাদের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির ভালমন্দ দেখার। অথচ আমি ভালমামার অস্তিত্বটা খেয়ালই করিনি। আসলে হয়েছে কী, এঁদোগলির শেষ প্রান্তে আমাদের পুরনো বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার ইচ্ছে আমার বহুদিনের।

বাবা বেঁচে থাকতে রাজি করাতে পারিনি। এখন আর কোনও বাধা নেই। খুবই অল্প টাকায় হলেও, বাড়ি কেনার একটা পার্টি পেয়েছি। পাচ্ছিলাম না আমার পুঁজি অনুযায়ী ভদ্র জায়গায় ফ্ল্যাট। কাল অফিস পাড়ায় দেখা হয়ে গেল হাসিরের সঙ্গে। ওরা আগে আমাদের পাড়ায় ভাড়া থাকত। একসঙ্গে স্কুল কলেজে পড়েছি, এখন চলে গেছে স্টেশনের ওপারে।… এ কথা সে কথার পর আজকাল সবার সঙ্গে যা করছি, ফ্ল্যাটের কথা বললাম। আমার বাজেট শুনে হাসির কিন্তু হোঁচট খেল না। বলল, আছে। ওই দু’লাখেই তুই ফ্ল্যাট পেয়ে যাবি। সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিট।

কোথায়?

আমার ফ্ল্যাটের পেছনের ফ্ল্যাটটা এখনও খালি পড়ে আছে। বলছে আড়াই। চাপাচাপি করে ধরলে দু’য়ে রাজি হয়ে যাবে।

আমার চোখে ঘোর অবিশ্বাস। হাসিরদের নতুন ফ্ল্যাটে না যাওয়া হলেও জানি, এলাকাটার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। মুসলমান পাড়ায় এখন প্রচুর ফ্ল্যাটবাড়ি, চওড়া রাস্তা। ঘ্যামা ঘ্যামা লোক ফ্ল্যাট কিনছে ওখানে।

আমার অভিব্যক্তি পড়ে নিয়ে হাসির বলে, বিশ্বাস না হয় কালই অফিসের পর আমাদের ওখানে চল, দেখে আসবি। আমি বলি, কিন্তু দাম এত কম কেন? নিশ্চয় কোনও গন্ডগোল আছে।

সে কিচ্ছু নয়। প্রমোটার নিজেদের বাস্তুজমির ওপর ফ্ল্যাট তুলছে। জমির এক কোণে কবর আছে। সেটুকু ছেড়েই উঠেছে কমপ্লেক্স। তুই তো জানিস আমাদের ধর্মে রেওয়াজটা আছে। ব্যক্তির ইচ্ছে অনুযায়ী তারই ভিটেতে তাকে গোর দেওয়া হয়। তা এখন সেই কবর পড়েছে ওই ফ্ল্যাটের সামনে। ঝোপঝাড়ে তেমন কিছুই বোঝা যায় না। বরং সামনেটা কোনওদিন বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

ধর্মের ব্যাপার যখন চলে আসছে, হাসিরকে শুধরে দিয়ে বলি, হিন্দুদের মধ্যেও ব্যাপারটা ছিল। তখনকার দিনে অনেক ফাঁকা জায়গা। উঠোনেই চিতা সাজানো হত। তবে সবটাই মৃত গৃহকর্তা অথবা কর্ত্রীর ইচ্ছে অনুসারে। কিন্তু ছাই, আগুন, গন্ধ মিলিয়ে সে এক ক্যাডাভারাস

কাণ্ড। তারপর তো জনস্ফীতি। জায়গা কমে গেল। তবে এখনও অনেক গ্রামের বাড়িতে চিতাভস্ম দিয়ে তুলসীমঞ্চ করা হয়। প্রতি সন্ধেতে দীপ জ্বালানো হয় সেখানে।

রিকশা, অটো, সাইকেলের বিশৃঙ্খল হইচইয়ে খেয়াল হল বড়রাস্তায় এসে পড়েছি। আমাদের এলাকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের আওতায়। স্টেশনের ওপারটা মিউনিসিপ্যালিটির। স্বাভাবিকভাবেই ওপারের নাগরিক পরিষেবা বেশ পরিচ্ছন্ন। সেই অভিমানেই কি না জানি না, আমাদের এলাকায় সবসময় এক অরাজক পরিস্থিতি। যেন গ্রাম পঞ্চায়েত তকমা ছেড়ে এলাকাটাকে শহর হতেই হবে।

ড্রাইভারের পাশে চিলতে জায়গা নিয়ে অটো এসে দাঁড়াল। উঠে পড়লাম। ট্রেন ধরার তাড়ায় স্টেশনের পথটুকু রোজই আমার অর্জুনের মাছের চোখ দেখার মতো কাটে। আজ কিন্তু আশপাশটা খুঁটিয়ে দেখছি। যদি সবকিছু ঠিকঠাক ঘটে যায়, কিছুদিন পরেই চলে যাব স্টেশনের ওপারে। ওখানে নিশ্চয়ই আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে আসতে বলতে কুণ্ঠা হবে না। বাবানটাও বড় হওয়ার জন্য পরিশীলিত পরিবেশ পাবে। বাবা যে কেন এই এলাকাটা ছেড়ে যেতে চাইত না, কে জানে। মা মারা যায় বাবা রিটায়ার করার দু’বছর আগে। বাবা যেন বাড়িটাকে নিয়ে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ে। একচিলতে বাগান নিয়ে দু’কাঠার ওপর কড়ি বরগার বসতবাড়ি। একাই ঘুরঘুর করত বাবা। জানলা দরজা রিপেয়ার করছে, অল্পবিস্তর প্লাস্টার, ঘর রং করা সব নিজের হাতেই। বাড়ি ছিল বাবার কাছে মোহঘোরের মতো। অনর্থক পরিশ্রমের জন্য যখনই কিছু বলতে গেছি, বলেছে, বাপ ঠাকুরদার বাড়ি, আকারে বাড়াতে না পারলেও আদরে বাঁচিয়ে রাখি। তা হলে ওঁদেরই সেবা করা হবে। বাবার আবেগটা সেভাবে অনুভব করতে না পারলেও, চোখের সামনে দেখতে পেতাম

আমাদের বুড়ো বাড়ির শরীরে তোয়াজের ছাপ স্পষ্ট।

গত পাঁচ-ছ’ বছরে হঠাৎই যেন আমাদের পাড়ার ভূগোল দ্রুত পালটাতে শুরু করল। দেখতে দেখতে বাড়ি ঘিরে উঠল ফ্ল্যাট। আমাদের জমি এত কম, এন্ট্রান্স এঁদোগলি, প্রমোটার ঘুরেও দেখল না। স্থায়ী ছায়া, স্যাঁতস্যাঁতে ভাব গ্রাস করল এ বাড়িকে। বাগানে রোদ না আসার দরুন গাছপালা নিস্তেজ। বাবার আচরণে অসহায়, অপ্রস্তুত ভাব। পাশের উঁচু বাড়িগুলোর ফাঁক গলে যখনই চিলতে রোদ আমাদের ভিটের ওপর পড়ত, টবের গাছগুলো নিয়ে রোদে সার দিয়ে বসিয়ে দিত বাবা। ওখানেই আবার কাপড়জামা শুকোতে দিত পর্ণা। রোদের অধিকার নিয়ে প্রায়ই দু’জনের মধ্যে খটাখটি লেগে যেত। ওইসময় বাবাকে কতবার বলেছি, চলো, বাড়িটা বিক্রি করে, কোনও ফ্ল্যাটে চলে যাই। এখনও দাম কম আছে, কিছুদিন পর ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।

ফ্ল্যাটে যেতে বাবার প্রবল আপত্তি। বলত, এই বিশাল পৃথিবীর বুকে একটুকরো জমি আমার। এটা কম গর্বের ব্যাপার। ফ্ল্যাটবাড়ি মানে তো নিজস্ব জমি নয়, জায়গা, জমি ছাড়া জায়গা মানে শূন্য কেনা।

অর্থহীন হলেও অকাট্য যুক্তি৷ উত্তরে কিছুই বলতে পারতাম না। বাবান জন্মাল। ছোট থেকেই সর্দিজ্বরে ভুগত খুব। সরাসরি না হলেও, আমাকে বলে পর্ণা শ্বশুরকে শোনাত, এই স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির জন্যই বাবানটা ভুগছে।

অপরাধবোধের ছায়া নামত বাবার মুখে। যে ছায়া পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির ছায়ার থেকেও গাঢ়। শেষ ক’বছর একটু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল বাবা। তবে বাবার এই বিষণ্নতা কেটে যেত ভালমামা এলেই। আত্মীয়তা সূত্র যাই থাকুক, দু’জনে বন্ধুর মতো পুরনো দিনের গল্প করে যেত বাইরের ঘরে বসে। বাবাদের ছোটবেলায় আমাদের অঞ্চল কত ফাঁকা ছিল। মাত্র দশবারো ঘর স্থায়ী বাসিন্দা। বাকি সব ইটভাটার অস্থায়ী মজুর। খালপাড়ে পরপর ইটভাটা। মাইলখানেক দূরে রঘুনাথপুর গ্রাম। গ্রামের মানুষ আমাদের অঞ্চলটাকেই শহর সাব্যস্ত করত। গোরুর গাড়িতে রোগী শুইয়ে আমাদের এলাকা দিয়েই যেত রেললাইনের ওপারে সরকারি হাসপাতালে। ভালমামা ছিলেন এই এলাকারই জমিদার বংশের ছেলে। বাবার মুখে শুনেছি, ছোটবেলায় ভালমামা চাকরের কাঁধে চেপে স্কুলে যেতেন। একদম রাজপুত্রের মতো চেহারা ছিল নাকি ভালমামার। পড়তি জমিদারি, ভাগাভাগি হতে হতে ভালমামারা হয়ে গেলেন আর পাঁচজন সাধারণ লোকের মতো। একটা জুটমিলের অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন ভালমামা। ওই সামান্য চাকরিতেও ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন। দীপুদা এখন ওয়েল এস্টাব্লিশড। তুলনায় আমি তেমন কিছুই করে উঠতে পারিনি। বাবারা অবশ্য সন্তানদের নিয়ে আক্ষেপ বা উদ্বেগ কোনওটাই করত না। পুরনোদিনের গল্পেই মশগুল থাকত দুই বন্ধু। যার সঙ্গে এখনকার দিনের কোনও মিল নেই। তাই বাবাদের গল্পগুলোকে বানানো মনে হত। আবার এটাও ঠিক ওই কথাগুলোর মধ্যে এমন কিছু ছিল, ভূমিপুত্রের প্রচ্ছন্ন অহংকার ভর করত আমার মনে।

বাবা মারা যেতেই একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাড়িটা। ভালমামা আসা কমিয়ে দিলেন। তবে আশপাশের উঁচু বাড়ির ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এখনও আসে। গাছের টবগুলো আর সেখানে রাখা হয়ে ওঠে না। এক রাতে কড়ি বরগাতে ঘুন ধরা কড়কড়ে আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছিল বাবা যেন ঘুটুর ঘুটুর করে বাড়ির কোনও কাজ করছে। ঘুম ভেঙে ছিল পর্ণারও। বলল, আর না। বাড়িটা বিক্রি করে, একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট কেনো।

ফ্ল্যাট যদি কিনতেই হয়, মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় কেনা উচিত। কিন্তু আমাদের বাড়ি বিক্রি করে যে ক’টা টাকা হবে, ভদ্রপাড়ায় কোনও ফ্ল্যাটের গ্যারেজ কেনা যেতে পারে। আমার মতো সাধারণ একটা প্রাইভেট কোম্পানির ক্লার্কের পুঁজি শুনে, সেই যে দালালরা একবার মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়, আর খোঁজ নেয় না। পর্ণার তাগাদায় একাই খোঁজ শুরু করি। ফ্ল্যাটের খোঁজ করছি শুনেই কি ভালমামা এসেছিলেন? হয়তো জ্ঞান দেবেন, বাড়ি বিক্রি করিস না সুজন। ওপারে বসে তোর বাবা কষ্ট পাবে— চিন্তাটাকে আর আশকারা দিলাম না। মিছিমিছি নিজের ভাবনাটাকে ভালমামার মুখে বসিয়ে দিচ্ছি কেন! নিজের এক্তিয়ার সম্বন্ধে ভালমামা নিশ্চয় ওয়াকিবহাল। তা হলে কেন এসেছিলেন আমার কাছে? একান্তভাবে আমাকেই বা ওঁর কী দরকার! বিচ্ছিরি একটা খটকা নিয়ে অফিসে ঢুকলাম। আশাকরি কাজের চাপে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ভুলে যাব ভালমামার কথা। হাসির বিকেল পাঁচটায় আমার অফিসে আসবে। ওর সঙ্গেই যাব নতুন ফ্ল্যাট দেখতে।

হাসির এল না। চারটে নাগাদ ফোন করে জানাল, কী একটা কাজে আটকে গেছে। বলল, কাল পর্ণাকে নিয়ে চলে আয়। স্পট ডিসিশান নিতে পারবি। প্রমোটারকেও বলেছি থাকতে।

তা ছাড়া পর্ণা তো এখনও আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে আসেনি। রুমানা বলেছে, তোরা রাত্তিরে খেয়ে যাবি।

একটু হতোদ্যম হলেও, একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি, হাসির দামটা ভুল বলেনি। পর্ণাকে ডাকছে, প্রমোটারও থাকবে। এখন শুধু ফ্ল্যাটটা পছন্দ করার ব্যাপার। তবে খবরটা আরও একরাত চেপে যেতে হবে। না হলে পর্ণা বলবে, এক্ষুনি চলো ফ্ল্যাটটা দেখে আসি। ও জানে না, অতি আগ্রহ দেখালেই স্কোয়ার ফিটের দাম দুশো টাকা বেড়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়িয়েছি। বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। দোরগোড়ায় হাওয়াই চটি। মনে পড়ল, ভালমামার আসার কথা।

নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আছেন ভালমামা। হাতে চায়ের কাপ। কোলে সকালের বাসি কাগজ। উলটোদিকের বেতের চেয়ারে বাবা নেই। আমার ঘরে ঢোকা টের পেয়ে তাকালেন, আয় সুজন। ক’দিন ধরেই তোর খোঁজে এসে ফিরে যাচ্ছি। বউমা বলেছে নিশ্চয়ই। আসলে কথাটা বউমাকে বলতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল।

কী কথা মামা? বলে, বাবার চেয়ারে বসলাম।

আমি চলে যাচ্ছি।

অবাক হয়ে জানতে চাই, কোথায়?

দীপু বদলি হয়ে যাচ্ছে দিল্লিতে। বলল, বাবা তুমিও চলো। এখানে কে দেখবে তোমাকে। আমি রাজি হইনি। শেষ বয়সে আর নিজের জায়গা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি জানি, তোর বাবা হলে এসময় বলত, ভালদা তুমি এ বাড়িতেই থেকে যাও। এরকমই সম্পর্ক ছিল তোর বাবার সঙ্গে… বলে, একটু দম নিলেন ভালমামা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাবার কথাটা আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতে চাইছেন ভালমামা। কিন্তু খামোকা এই উদারতা আমি দেখাতে যাব কেন! আমার সেই সামর্থ্য কোথায়। তা ছাড়া দীপুদা যথেষ্ট সচ্ছল, ভালমামার একটা সুবন্দোবস্ত সে অনায়াসে করতে পারবে। ভালমামার এই চুপ করে থাকাটা বড্ড দীর্ঘ মনে হচ্ছে আমার। আমাকে আশ্বস্ত করে ভালমামা বলে ওঠেন, ভবানীপুরের কাছে একটা ওল্ডএজ হোমে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। শেষ বয়সে পুনর্বাসন বলতে পারিস।… আবার চুপ করে গেলেন। আমি প্রমাদ গুনি, এখনও বুঝতে পারছি না, ঠিক কী বলতে এসেছেন উনি। ফের শুরু করলেন, তোর বাবা শেষ রোগশয্যায় আমাকে একটা কথা বলে গিয়েছিল, ভালদা, আমি বোধহয় চললুম। তুমি আমার ছেলেবউমাদের দেখো।… নেহাতই কথার কথা। মানুষ মারা যাওয়ার সময় এরকম কথা বলেই থাকে। এসব না ধরলেও চলে! কিন্তু যাকে বলে, তাকে সারাজীবন ধরে বিশ্বাস করে বলেই বলে। আমায় ক্ষমা করিস। সে বিশ্বাস আমি রাখতে পারলাম না।

ভালমামার গলা ধরে এসেছে। নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, আমি নিশ্চয়ই দেখা করে আসব। আর যখনই আপনার কোনও প্রয়োজন হবে, ফোন করে ডেকে নেবেন আমাকে।

ও, হ্যাঁ ঠিকানাটা তোর জন্যই নিয়ে এসেছিলাম। বলে, পকেট থেকে একটা চিরকুট আমার হাতে দিলেন।

ভালমামা চলে যাচ্ছেন। এই অঞ্চলের জমিদারির বৈভব-লালিত শেষ প্রতিনিধি। যিনি কাজের লোকের কাঁধে চেপে স্কুলে যেতেন। আজ চলে যাচ্ছেন বানপ্রস্থে। দৃশ্যটা যতই করুণ হোক, এক ধরনের নিশ্চিন্ততাকেও অগ্রাহ্য করতে পারছি না। যাক, বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে আমাকে আর কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না।

পরের দিন বিকেল। কথামতো আমি, পর্ণা চলে এসেছি হাসিরদের ফ্ল্যাটে। বাবানও এসেছে। হাসিরের ছেলের সঙ্গে হুটোপাটি করছে খুব। আমরাও আড্ডায় মশগুল। চোরা গুঁতো দিল পর্ণা। অর্থাৎ ফ্ল্যাটটা দেখতে চায়। কথাটা তুললাম। হাসির সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠল, হ্যাঁ, চল চল। আসল কাজটা আগে সেরে নিই।

হাসিরদের ফ্ল্যাটের ঠিক পেছনেই দেখতে আসা ফ্ল্যাটটা। কেয়ার টেকারের কাছে চাবি নিয়ে গ্রিলের দরজা খোলা হল। প্রথমে এক চিলতে বারান্দা। সামনে ফাঁকা জায়গা। বেশ খোলামেলা ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ভাল লেগে গেল। গ্রাউন্ড ফ্লোর বলেই বোধহয় বাড়ি বাড়ি মনে হচ্ছে। পড়ন্ত বিকেল হলেও, ঘর ভরতি আলো। হাসির বলল, আমার ফ্ল্যাটের থেকেও পঞ্চাশ স্কোয়ার ফিটের মতো বড়। প্ল্যানের মার প্যাঁচে বেড়ে গেছে।— তা হলেও কেন এত কম দাম! বলল পর্ণা।

কেন, সুজন তোমায় বলেনি! দক্ষিণের বারান্দার সামনের জমিটা…

হাসিরের কথার মাঝে প্রমোটার আমিনুল ঢুকলেন, আর বলবেন না, আমার চাচা আর আব্বাজানের ইরাদা ছিল তাঁদের গোর যেন এই ভিটেতেই দেওয়া হয়। হয়েছে তাই। সেইটুকু জায়গা ছেড়ে আমি ফ্ল্যাটটা তুলি। সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেল। এই ফ্ল্যাটটার সামনে যেহেতু কবর, কেউ আর নিতে চায় না। হিন্দু, মুসলিম কেউ না। গ্রিলের গেট খোলার পর বারান্দাটা দেখেছি। সামনে আগাছার জঙ্গল। কোনও কবর চোখে পড়েনি। আমিনুল সাহেবকে বললাম, চলুন তো আবার দেখি জায়গাটা।

বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। শেষ বিকেলের হলুদ আলোয় ঝোপঝাড়টাও অসাধারণ লাগছে। তারপরই বড় রাস্তা। ওপারে খেলার মাঠ। আমিনুল বলে যাচ্ছেন, হাসির বলছিল, আপনার কোনও প্রেজুডিস নেই। আজকালকার দিনে এসব থাকার কথাও নয়। বিশেষ করে যারা পড়াশোনা জানা শিক্ষিত…

কথার মাঝেই ঝোপঝাড়ের ফাঁকে দেখতে পেয়েছি আমিনুল সাহাবের বাবা, কাকার সিমেন্ট বাঁধানো পাশাপাশি দুটি কবর। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল, বাবা আর ভালমামা। এখানেও পাশাপাশি বসে আছে।

তা হলে আপনাদের কোনও আপত্তি নেই তো?

আমিনুল সাহেবের প্রশ্নে চুপ করে থাকি। আমার এই মুহূর্তের অনুভূতি ওঁকে কী করে বোঝাব, মৃত্যুর পর বোধহয় অভিভাবকদের কোনও ধর্ম থাকে না। এই ফ্ল্যাটে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। এটা যদি আমার সংস্কার হয়, তাই সই।

সাহিত্য সেতু, ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *