1 of 2

ভিজে বারুদের গল্প – আনন্দ বাগচী

ভিজে বারুদের গল্প – আনন্দ বাগচী

বি.টি, রোডের দুগালে বহুকাল পরে যেন ক্ষুর পড়েছে।

যুগ-জমাট দাড়ির জঙ্গলের মত মেটাল রোডের দু’পাশে বুকে হেঁটে এগিয়ে আসা ঝুপড়ি-মুপরি, খোলার চাল আর চাকাবিহীন রথের মত গুমটিগুলো দেখতে দেখতে নিকেশ হয়ে গেল। বড় বড় গাছপালার দশাসই লাশ পটাপট শব্দ করে উলটে পড়েছে। পথ-চলতি প্রণামীতে ফেঁপে ওঠা মন্দির আর গাছতলার দেখভালের ঠাকুর-ঠাকরুনরাও বুলডোজারের গুঁতো থেকে রেহাই পায়নি। সব গেছে।

শুধু মানুষ-প্রমাণ পাঁকজলা কাঁচা নালার এপারে সব কিছু বিলকুল অচ্ছুৎ রয়ে গেল। রয়ে গেল হরিপদ পাড়ুইয়ের চায়ের দোকানটাও। এটাকে তিন নম্বর না বলে হরিপদর তৃতীয় পক্ষও বলা যায়। দু-দুবার পাড় ভাঙার পর নদীতীরের মানুষ যেমন সজাগ-সতর্ক হয় হরিপদও তেমনি। এবার হিসেব কষে আটঘাট বেঁধেই বসেছে। অনেকটা উত্তরে সরে এসে কালভার্টের পাশে বে-ওয়ারিশ জায়গাটা খুঁজে নিয়েছে। টালির চালাটা তুলেছে বেশ বড় করেই। স্টেশন থেকে যে লম্বা রাস্তাটা অজগরের মত এঁকেবেঁকে এসে বি. টি. রোডে পড়ার সময় কনুইয়ের ভাঁজ তৈরি করেছে, সেই তেকোনায়। জায়গাটা বেশ জনজমাট। বসতির চেয়ে মানুষের চলাচল বেশি। রিকশা স্ট্যাণ্ড, বাস স্টপ আর পেট্রল পাম্পের লাগোয়া লরিগ্যারেজ তো হাতে ছোঁয়া যায়। রাস্তার ওপারে তিনতলা হায়ার সেকেণ্ডারি ইস্কুল, তার প্রাইমারি সেকশনটা আবার মর্নিং-এ।

হরিপদরও দোকান জমে উঠতে দেরি হয়নি এবার। শোনা যায় লোকটার সত্যিকারের দ্বিতীয় পক্ষের সোনাদানা গলিয়ে এই দোকানেই ঢেলেছে। সামান্য চা বিস্কুট দিয়ে শুরু করেছিল জীবন। গুমটিতে কেরসিনের স্টোভে কেটলি চাপিয়ে অনেক কসরত করে বসতে হত তখন। এখন দুটো তাগড়াই চুলো ভোর ছ’টা থেকে জ্বলে যাচ্ছে তো জ্বলেই যাচ্ছে, কামাই নেই। প্রথম সকালের ভাজাভুজি সেরে একটা ডেকচিতে ঘুগনি চাপায় পার্টটাইমের হালুইকর। অন্যটায় আলুর দম। শোকেসের ওপর পাউরুটির বাফল ওয়াল। দুটো টিঙটিঙে ছোকরা হিমসিম খায়, ধমকধামকও। পিনেবালারা উঠে যেতেই সকাল দশটা থেকে শুরু হয় খানেবালার ভিড়। চায়ের দোকান তখন আধা হোটেল। ভেতরে সার সার লম্বা টেবিলে দু’মুখো বেঞ্চি পাতা। এক এক দফায় আঠারো জনের পাত পড়তে পারে। হরিপদ তখন বাঁয়া-তবলার মত ক্যাশবাক্সো পাশে নিয়ে চায়ে বসে। মরসুমের চা-টা সে নিজে হাতেই বানায়, কখনো বে-টাইমে খাতিরের লোকজন এলেও। টেবিল চেয়ার ছেড়ে প্ল্যাটফর্মে ওঠে। তার হাতের চায়ের নাকি স্বাদই আলাদা। শুধু চায়ের গুণেই খদ্দেরলক্ষ্মীকে সে বেঁধে ফেলেছে এ কথা হয়ত পুরোপুরি ঠিক না। বিষয়বুদ্ধি ছাড়াও একটা বাড়তি গুণ লোকটার পুঁজি। হরিপদ মানুষটা রসিক, পেটেও ছিটেফোঁটা আছে। ভারতচন্দ্র-টন্দ্র পড়া আছে, লাগসই জায়গায় দু-চার পঙ্‌ক্তি চাপায়, রসের ভিয়েনে নিধুবাবুর টপ্পায় দু-এক কলি মোচড়ও দেয় কখনো-সখনো। রসিক খদ্দেররা তারিফ করে, বাহবা দেয়। এগুলোই উপরি পাওনা।

সকাল প্রায় ন’টা। হরিপদর ভাষায় লিকার পাতলা হয়ে এসেছে। তার মানে চায়ের পার্টি প্রায় সাফ। বাবু খদ্দেরদের শেষ তলানি প্রাইমারির তিন ছোকরা মাস্টার এখনও ক্রিজ ছাড়েনি। দ্বিতীয় দফা ডবলহাফের কাপে তুফান তুলেছে। সাহিত্য আর পলিটিকস এক সঙ্গে চটকাচ্ছে। হরিপদর এখন অফ-টাইম। রান্নার তদারকিতে উঠে গিয়েছিল। এক চামচ ঘুগনি ফুঁ দিতে দিতে মুখে পুরেই চেঁচালো, ‘অ ঠাকুর, ঘুগনিতে নুন হয়নি। তোমার আজ হলটা কী? আলুর দমের যা রঙ হয়েছে মনে হচ্ছে। লঙ্কাকাণ্ড করে ছেড়েছ। দমকল ডাকতে না হয়।’

বাজার-ফেরত বিশুবাবু ঢুকলেন এই সময়। থলেটা টেবিলের পায়ার সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে আয়েস করে বসলেন। রিটায়ার্ড সাব-জজ, এ-পাড়ায় এসে বাড়ি করেছেন বছর দুই হল।

‘অ হরিপদ, কই ফার্স্ট পেজটা দেখি—’

খদ্দেরের হাতখসা খবরের কাগজে হরিপদ দখল পেয়েছিল একটু আগে। ঠাকুরপ্রণাম সারার মত নমনম করে হেডলাইনে চোখ বুলোতে বুলোতে অন্যমনস্ক চোখে রাস্তা দেখছিল। বিশুবাবুকে খেয়াল করেনি, কথাটাও প্রথম দফায় শুনতে পেল না। তা কানের দোষ নেই। সামনের রাস্তায় অষ্টপ্রহর কাজ হচ্ছে, দু-দুটো স্টিম রোলার ঝকর ঝাঁই ঝকর ঝাঁই করে কানের মাথা খেয়ে ফেলছে। ওদের রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলা আর কতক্ষণ চলবে কে জানে! বাতাসে পিচ গলানো ধোঁয়া আর ঝাঁজালো গন্ধ। ফুরনের মজুররা পাথরকুচিতে যেন চিটেগুড় মাখাচ্ছে। রাস্তার বহর বেড়ে গেছে অনেকটা, শাড়ির ফলস বসানোর মত পাড় লাগানো হচ্ছে যেন। সেই পুরনো, বাপের কালের গল্পটাই আবার শোনা যাচ্ছে নতুন করে। বিটি রোডে নাকি ফুটপাথ হবে, ট্রাম লাইন বসবে। কিন্তু বিশ্বাস হয় না হরিপদর। গভরমেণ্টের কুম্ভকর্ণ জেগেছে বটে, কিন্তু আবার পাশ ফিরে শুতে কতক্ষণ। তা নইলে রাস্তায় তেঠেঙে দূরবিন দাঁড় করিয়ে ওভারসীয়ার ইঞ্জিনীয়ারদের চোখ-মারামারি আর ফিতে-টানাটানি তো প্রায় ফিবছরই দেখে আসছে।

বিশুবাবু এবার গলার ভলুম বাড়িয়ে রিপিট করলেন কথাটা।

ফিরে তাকিয়ে একগাল হাসল হরিপদ, ‘এই যে চৌধুরীমশাই, বাজার হয়ে গেল আপনার? কী আর দেখবেন স্যার, পাতাটা তো শুধু খুনজখম আর দুর্ঘটনা দিয়ে ভর্তি। মনে হয় চাপচাপ রক্ত লেগে আছে, তাকানো যায় না।’ শুধু ফাস্ট পেজ নয়, পুরো কাগজখানাই বিশুবাবুর হাতে চালান করে দিতে দিতে ফের বলল, ‘চা খাবেন তো? দাঁড়ান ফাসক্লাস করে চা বানাই দু কাপ, আপনার অনারে আমিও খাই একটু।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ বিশুবাবু ঠ্যাং-এ চেন পরানো কপালের চোখ টেনে নাকের ডগায় নামালেন, ‘যা বলেছ হরিপদ, এ এক্কেরে হাসপাতালের বুলেটিনই হয়ে গেছে। মর্গের ইস্তাহার। তবু অভ্যেস, কি করি বল, মনটা ছুঁকছুঁক করে। মনে হয়—’

কি মনে হয় আর বলা হল না বিশুবাবুর, মাঝপথে কথা বন্ধ হয়ে গেল। দোকানের পিছন দিকের আবছায়ায় খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকা লোকটা এবার উঠে দাঁড়ালো। পা টেনে টেনে হরিপদর পাশে এসে দাঁড়ালো। মনে হল ঝড়ে দুমড়ানো একটা বিপজ্জনক লাইট পোস্ট কেতরে আছে। নিজের স্পেশাল গ্লাসটায় লিকার ঢালছিল একমনে, চমকে তাকিয়ে দেখল, সেই লোকটা। ছ ফুটের বেশি হবে টান হয়ে দাঁড়ালে, কিন্তু এখন আর শরীরটা সেভাবে দাঁড়ায় না। পাপেট শোয়ের আড়ষ্ট পুতুলের মত, বেজায়গায় তারের ফাঁস আটকে যাওয়ায় কলকব্জা বুঝি ঠিকভাবে খেলছে না। তবু তাকিয়ে দেখার মত চেহারা বটে, ট্রাউজার্সের ওপরে একটা হলদে-কালো ডোরাকাটা গেঞ্জি। কঠিন ধাতুতে ঢালাই করা মুখখানা চাপদাড়িতেও চাপা পড়েনি। জ্বলজ্বলে চোখ। বাবুইয়ের বাসার মত ঘনবুনোট চুল, যেন স্কাল ক্যাপ পরেছে।

সকালে যখন প্রথম ঢুকেছিল দোকানে তখনও হরিপদ চমকে উঠেছিল। এ পাড়ায় আনকোরা নতুন মুখ বলে কি? বোধ হয় না। তারপর কাপে ডিশে ঠকঠক শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেছিল লোকটা চা খাচ্ছে। হাতটা কাঁপছে যাচ্ছেতাই ভাবে। সেই বেজুত হাতেই অনেক কসরত করে যখন সিগারেট পাকাচ্ছিল তখনও লক্ষ করেছে। হরিপদর মনের মধ্যে চাপা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছিল তামাক-পোড়ার কটু গন্ধে। বুঝে নিয়েছিল যা বোঝার। ঝামেলা না পাকিয়ে ভালোয় ভালোয় উঠে গেলেই মঙ্গল। কিন্তু লোকটা উঠছিল না, ওঠার কোন লক্ষণই ছিল না ওর মধ্যে। যেন বসতেই এসেছে, খাওয়াটা উপলক্ষ।

নামতা পড়ার সুরে ছোকরা চাকর পেছন থেকে চেঁচাল, চার টাকা পঁচাত্তর!

পাঁচ টাকার নোটটা ড্যালা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে লোকটা সিকিতক অপেক্ষা করল না। বিচিত্র কায়দায় হেঁটে চালাঘর থেকে বেরিয়ে গেল টলতে টলতে। হরিপদ মিথ্যেই ক্যাশবাক্স হাতড়ালো।

বিশুবাবুর চাপা গলা শোনা গেল, ‘কী সর্বনাশ, এটি কোথেকে এল?’

ভেতরপল্লীর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া মূর্তিটার দিকে চোখ রেখে চায়ে চিনি মেশাচ্ছিল হরিপদ, ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘কি জানি কোথাকার লোক, আজই প্রথম দেখলাম।’

‘তাই? এখনো বেঁচে আছে, আশ্চর্য!’

টিফিন-শেষের ঘণ্টা পড়ল ইস্কুলে। তিন মাস্টার কান পেতে বোধ হয় ওদের কথাবার্তা শুনছিল এতক্ষণ। একজন বলল, ‘হ্যাঁ মশাই, চেনেন নাকি লোকটাকে?’

বিশুবাবু ইতস্তত করে হরিপদর দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকালেন। হরিপদ মাথা নেড়ে টিক মার্ক দিতে নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ‘বিলক্ষণ! আপনারা রাজা মুস্তাফির নাম শুনেছেন? শোনেননি,সে কি! এক সময় সিকি কলকাতা নীলডাউন হয়ে থাকত ওর দাপটে! আপনারা ছেলেমানুষ তাই হয়ত জানেন না, কিন্তু আমরা জানি। গোটা সেন্ট্রাল ক্যালকাটার টেরর রাজা মস্তান ছিল এক বিখ্যাত নেতার মাস্‌লম্যান। তাঁর নাম করতে চাই না, তিনি আবার মিনিস্টারও হয়েছিলেন।’

মুখ দেখেই বুঝলেন ওঁরা কিছু জানেন না। অবিশ্যি এগুলো তো আর খবরের কাগজের খবর না, রাজনীতির গোপন কলকাঠি, ভেতরের কেচ্ছা।

শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়েছিল, সময় হয়ে গেছে, আবার বোধ হয় ইস্কুলে ফিরবে। যে প্রশ্ন করেছিল, সে একাই বিশুবাবুর দিকে এগিয়ে এল, একটা ঢোঁক গিলে বলল, ‘তারপর?’

‘তারপর যেমন হয়, কালের নিয়মে।’ বিশুবাবু সংক্ষেপ করলেন তাঁর কাহিনী, ‘রাজা বদল হল, লাস্ট ইলেকশনে মিনিস্টার ডিগবাজি খেলেন, সাংবাদিকদের কলম থেকেও মুছে গেলেন। রাজা মস্তানের খেলও খতম হল। শিকারীর নিয়তি শেষ পর্যন্ত শিকারের হাতেই বাঁধা থাকে। যাদের সে পাড়াছাড়া করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল তারাও তক্কে তক্কে ছিল। অসতর্ক মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি কামড়ে ধরল। শুনেছিলাম নিকেশ হয়ে গেছে। এনি হাউ হি ইজ ডেড নাউ।’

ছেলেটা আর দাঁড়াল না। হরিপদ চায়ের কাপ আর গেলাস নিয়ে তার মাচান থেকে নেমে এল, ‘নিন ধরুন। শুনে ইস্তক স্যার, আমার প্যালপিটিশন⋯আপনার চা!’

কাগজটা আলগা হাতে ধরে বিশুবাবু কি ভাবছিলেন, অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘ও, হ্যাঁ।’

মর্গ থেকে যেভাবে কাটাছেঁড়া করা লাশ ফেরত আসে, হাসপাতাল সেভাবেই ওকে বাড়ি পাঠিয়েছিল ঠিক ছ মাসের মাথায়। শরীরে তখন সাত তালি। যেন এখানে পকেট ওখানে পকেট। ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া হাড়ের অন্ধিসন্ধিতে মেটাল নেল। স্রেফ আয়ুর জোরে খুনে নেকড়েদের হামলা থেকে যদি বা বেঁচে গেছে, সার্জেনদের মেরামতি থেকে যে বাঁচেনি সেটা টের পেতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। জটিল এমার্জেন্সি অপারেশনের সামান্য ভুলচুকের ফলে স্নায়ু শিরা লিগামেন্টের কোথায় যে কী ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল তা আর বোঝা গেল না। লাঠি ধরে আর প্রতিমার কাঁধে হাত রেখে যখন এক-পা এক-পা করে হাঁটতে শিখছে তখনই রাজা মনে মনে বুঝে নিয়েছিল সে চিরদিনের মত একটা মেয়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে গেল। শুধু হাসপাতাল নয়, বাইরের জগৎ থেকেও তার যাবজ্জীবন ছুটি হয়ে গেছে। তাই ঘরে বাইরে ধ্বস্ত নষ্ট একটা মানুষের বেঁচে থাকার আর কোন অর্থই হয় না। তার মত বেপরোয়া লড়াকু পুরুষের কাছে মারের চেয়ে হারটা যে কত বেশি মারাত্মক সে কথা সে কাকে বোঝাবে?

অন্তত প্রতিমাকে বোঝানো যেত না। তার বিবর্ণ থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিমা বলত, ‘তুমি কিস্যু ভেব না। দেখো আবার আগের মত সব ঠিক হয়ে যাবে।’

রাজা আক্রোশে মাথা ঝাঁকাত আর বলত, ‘না! শেষ, আমার সব শেষ।’

প্রতিমা মুখে হাত চাপা দিয়ে বলত, ‘ওরকম বলতে নেই, ভাবতেও নেই। জীবনে কিছুই শেষ হয়ে যায় না! আমি তবে পাশে আছি কি জন্যে।’

ও কলেজে পড়া মেয়ে, ওর মুখে ভাষা আছে। রাজার মুখে অত যোগায় না। উঠোনের এক কোণে তার মোটর সাইকেল, তার যুদ্ধযান চৈতকের মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চাকা দুটো হাওয়া বেরিয়ে দুমড়ে বসে গেছে। ধুলো জমেছে। এখনও মরেনি, অথচ সাদা চাদরের মত একটা প্লাস্টিক শীট দিয়ে ওর মুখমাথা ঢেকে দেওয়া। কত দিন রাতের সঙ্গী, কত স্মৃতির বাহন ওই বাহক। ঝড় তুলে শহর তোলপাড় করেছে ওর পিঠে চেপে। সার্কাসের খেলা না, সত্যিকারের মৃত্যুঝাঁপ দিয়েছে কতবার। বুকের ভিতরটা হুহু করে উঠল রাজার। নাটকের একটি সংলাপ হঠাৎ মনে পড়ে গেল কতকাল পরে—হো নীলা ঘোড়ারা আসওয়ার।

‘আর কি ওটা চালাতে পারবো?’

‘কেন পারবে না।’

প্রতিমা সান্ত্বনা দিচ্ছে। মনে থাকবে। যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে হাসছিল রাজা।

‘হাসচো যে!’

জবাব দেয়নি সঙ্গে সঙ্গে। পরে বলেছিল, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিঃশব্দে মিশিয়ে, ‘কাঁদতে পারি না বলে।’

ক্রমে লাঠি ছাড়ল, সেই সঙ্গে শেষ আশাটুকুও। প্রতিমাকে ছেড়ে দিয়ে যখন নিজের পায়ে দাঁড়ালো, পা ঘষটে ঘষটে খানিকটা নাচের ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল, ঠিক তখনই নতুন উপসর্গগুলো দেখা দিতে আরম্ভ করেছে এক এক করে। শিরদাঁড়ার ছিলেয় টান পড়ল, কোমরটা সিমেন্টের বস্তার মত জমে শক্ত আর ভারী হয়ে উঠল। একটা পা শুকিয়ে আসতে লাগল ভেতর থেকে, একটা হাত আর বশে নেই, কাঁপে। ঝিঁ-ঝিঁ ধরা একটা যন্ত্রণা সারা শরীরে চলে বেড়ায়, জায়গা বদল করে। ডাক্তাররা বললেন, আর কিছুই করার নেই, পঙ্গুত্ব আসছে, হয়ত অন্ধত্বও। মনে মনে প্রস্তুত থাকাই ভালো।

প্রতিমা এখন আর মুখে সান্ত্বনা দেয় না, লুকিয়ে কাঁদে, কিন্তু ভেঙে পড়ে না তবু। প্রতিমার এই চেহারা রাজার চোখে কেমন অচেনা, কেমন বিস্ময়কর। দুর্বোধ্যও। রাজা যেখানে ছেড়েছিল, প্রতিমার লড়াই শুরু হয়ে গেল ঠিক সেখান থেকে। যেন যত দুর্ভাগ্য তাকে চেপে ধরছে, তার জেদ বেড়ে যাচ্ছে ততই। একদিকে সংসারের অনটন, অর্থাভাব, অন্যদিকে স্বামী আর ছেলে। বাবলুর বয়স যখন দুই কি পৌনে দুই তখন মেনিনজাইটিসের মুখ থেকে একরকম অসাধ্যসাধন করেই ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। অসুখটা তাকে প্রাণে মারতে পারল না বটে কিন্তু সেই আক্রোশ মিটিয়ে গেল অন্যভাবে। প্রতিমার ভাগ্যটাই এরকম। জীবনে এতকাল যা কিছু সে পেয়েছে, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই তা পেয়েছে। এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেই পেয়েছে।

চাকরিটা কিন্তু সেভাবে না। নিজের ইচ্ছেয়, নিজের চেষ্টায়। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেই জানতে পেরেছে প্রতিমা হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। জখম হওয়া সংসারের হালটাই শুধু কাঁধে তুলে নেয়নি, দাঁড়ও টেনে চলেছে একই সঙ্গে। এই ঘর-গেরস্থালি, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে দু-দুটো প্রাণীর পরিচর্যা, সেবা—বলতে গেলে এক অমানুষিক ব্যাপার। অথচ ঘড়ির কাঁটার মত সহজ স্বচ্ছন্দ গতিতে ঘুরে চলেছে তার দুটো হাত।

দরজা খুলে দিয়েই প্রতিমা প্রায় ধমকের সুরে বলল, ‘বাঃ বেশ লোক তো তুমি! সাতসকালে উঠেই কোথায় বেরিয়েছিলে? চা দিতে এসে দেখি বিছানা খালি। দিলে তো ফরনাথিং ইস্কুলটা কামাই করিয়ে!’

রাজা তেরচা চোখে প্রতিমাকে দেখল। দেখল শাড়ি পরা চুল বাঁধা হয়ে গেছে, মুখে বোধ হয় হালকা করে একটু প্রসাধনও। বোধ হয় কোথাও বেরতে যাচ্ছিল। সেই মুখোমুখি সে এসে পড়েছে। ওর কথার কোন জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো টাল খেতে খেতে।

‘মুখে কি কুলুপ আঁটা, কথা বলছ না যে বড়? আমি এদিকে ভেবে মরছি।’

জুতোর র‍্যাকের পাশে একটা নিচু হাইটের চেয়ার পাতা, রাজার সুবিধের জন্যে কেনা হয়েছে, রাখাও আছে সেই জন্যেই। দাঁতে দাঁত চেপে তার ওপর বসতে বসতে তেতো গলায় বলল, ‘এত ভেবে মরার কি ছিল, গেলেই পারতে! আমি কি দুধের বাচ্চা?’

প্রতিমার মেজাজটাও ভালো ছিল না, গলায় সামান্য বুঝি ঝাঁঝও ফুটলো, ‘কে বলেছে তুমি দুধের বাচ্চা!’ সদরে খিল চাপাতে চাপাতে বলল, ‘দুধের বাচ্চার কাছে কেউ কিছু আশা করে না।’

রাজা মাথা গরম করতে চায়নি, তবু কথায় কথা ঘষা খেয়ে একটু তাত উঠল, ‘তার মানে আমার কাছে কিছু আশা কর! কী আশা কর এখনো?’

জুতোর ফিতে খুলে দেবার জন্যে এগিয়ে আসছিল প্রতিমা, একটু থমকে গেল। মনে হল চোট খেয়েছে। তারপর বড় করে একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, ‘এইটুকু আশা করি যে নিজের কথাও একটু ভাববে।’

‘তাই তো ভাবছি। ভাবছি না তোমাকে কে বলল?’ পায়ের কাছে উবু হয়ে বসতেই পা টেনে নেবার চেষ্টা করল রাজা, ‘এই খবর্দার, জুতোয় হাত দেবে না। এইসব মেয়েলি আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না।’

নিষেধ শুনলো না। প্রতিমা আজকাল কেমন একগুঁয়ে আর জেদী হয়ে উঠছে। বরফের মত। ঠাণ্ডা, কিন্তু কঠিন। মুখ নিচু করে ফিতে খুলতে খুলতে বলল, ‘না লাগুক, আমার কিছুই আজকাল তোমার ভালো লাগে না তা জানি। তবু চোখের সামনে কারো কষ্ট দেখতে পারি না—’

গলাটা কেমন ধরা-ধরা, বোধ হয় চোখে জল আসবো-আসবো করছে, ঠোঁট কাঁপছে, কারণ মাথাটা আরও নিচু করে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে প্রতিমা। কেতরে পাশ ফিরে বসা রাজা ওর মুখটা দেখতে পেল না, অনুমান করে সামান্য গুটিয়ে গেল। খুব অভিমানী মেয়ে, এতদিন লক্ষ করেনি, অভিমানটা বোধ হয় তার ওপরেই তাই সে সামান্য জোরে কথা বললেই মুখের রঙ বদলে যায়। কিছু একটা নরম কথা বলা উচিত হয়ত, কিন্তু রাজা কোন কথা খুঁজে পেল না।

প্রতিমাই আবার কথা বলল, ‘তোমাকে পই পই করে বলেছি, কিছুদিন সামলে-সুমলে চলো, এরকম গোঁয়ার্তুমি করে হুটহাট বেরিয়ো না।’

রাজা বলতে গিয়েছিল, মরার ওপর আর কে খাঁড়ার ঘা দেবে, প্রতিমা। সে রকম কিছু হলে তো বেঁচে যাই। কথাটা মনের মধ্যেই চেপে রেখে বলল, ‘কিন্তু আমার চা না খেয়ে বেরনোর সঙ্গে তোমার ইস্কুলে না যাওয়ার কি সম্পর্ক তা তো বুঝলাম না। গেলেই পারতে—’

‘বেশ বুদ্ধি! খালি বাড়িতে ওই হাবলা ছেলেকে রেখে যাবো?’

‘কেন, ঝুণ্টি? ওই তো রোজ দেখে।’

‘এসেছে নাকি সে! বলা নেই কওয়া নেই ডুব মেরে বসল।’

‘ও।’

‘ভাবছি ওর ভরসায় থাকা যাবে না, একটা যদি সর্বক্ষণের লোক পেতাম—’

‘কুলোতে পারবে না,’ রাজা নরম করে বলল, ‘এই হিমসিম খাচ্ছ—’

‘তা ঠিক, তবে—’ মুখ তুলল এতক্ষণে প্রতিমা, চোখের কোণ সত্যিই চিকচিক করছে যেন। কিন্তু কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।

‘তবে?’ তারপর কি খেয়াল হতেই রাজা তাড়াতাড়ি বলল, ‘কোথাও বেরতে যাচ্ছিলে বোধ হয়?’

জুতো খুলে র‍্যাকে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘ঘরে যাও। আমি তোমার চা-টা নিয়ে এসে বলব। একটা কথা আছে।’

হাসপাতাল থেকে প্রথম বাড়িতে পা দিয়েই যেমন হাওয়াবদল টের পেয়েছিল, আজও ঠিক তেমনি করেই ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝতে পেরে গেল আজ সকালেই এ ঘরে কেউ বাইরের লোক এসেছিল। শিকারী প্রাণীর মতই এই সিক্সথ্ সেন্স তার তৈরি হয়েছিল সেই সময় যখন সে প্রতিটি মুহূর্তই বাতাসের ইশারা মেনে চলতো। দাড়ি কামাবার সময় স্নানের সময় এমনকি প্রতিমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সময়েও যন্তরটিকে নাগালের মধ্যে রাখতো। কারণ ওই লোডেড পিস্তলের চেম্বরাই ছিল তার ভ্রমর-কৌটো, ওর মধ্যে তার প্রাণভোমরা গচ্ছিত থাকতো। সেটা খুব সুখের সময়, মধুর সময় ছিল না তার পক্ষে। তখন পৃথিবীর সবচেয়ে একা মানুষ ছিল রাজা। রাজার কোন দল ছিল না, দল গড়া সে বরাবরই ভীষণ না-পছন্দ করতো। অনেক বড় বড় অপারেশন সে একাই অপারেট করতো। দলকে যারা বল ভাবে তারা ভুল করে। দল মানেই দুর্বলতা। লিকেজ। তাই ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কোনদিন শত্রুপক্ষ তার গতিবিধি টের পায়নি। বিদ্যুদ্গতিতে বিপক্ষের ঘাঁটি ছত্রাখান করে ফিরে আসতে পেরেছে বারবার।

বীরত্ব মানেই তো দুঃসাহস,প্রতি পদেমৃত্যুর ঝুঁকি নেবার কলজে। গ্যাং ফাইট আর লোক লাগিয়ে জঙ্গল বীট করিয়ে মাচায় বসে বাঘ শিকার একই কথা। ওর মধ্যে কোন পৌরুষ নেই। সাবধানতাই আসল কথা, নিরাপত্তা কোন কাজের কথা নয়। মনে আছে প্রথম দিকে প্রতিমাকেও সে এতটুকু বিশ্বাস করতো না, তার হাতের রান্না পর্যন্ত যাচাই না করে মুখে দিত না। কোণঠাসা হলে মার্জারীও বাঘ হয়ে উঠতে পারে এই বোধ তার লোপ পায়নি। ঠিক ভালোবেসে প্রতিমাকে ঘরে আনেনি রাজা, বিয়েটা গান্ধর্ব মতেও হয়নি, বিয়েটা বলতে গেলে হয়েছিল আসুরিক ভাবেই। নাগালের বাইরে একটা টাটকা গোলাপ ফুটে থাকলে কারো কারো যেমন হাত নিসপিস করে। খানিকটা লোভ, খানিকটা আক্রোশ আর অপমানের জ্বালা ক্ষমতামাতাল রাজাকে এই কাজ করতে প্ররোচনা দিয়েছিল। সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে তুলে নিয়ে এসেছিল সে। মামার আশ্রয়ে থেকে কলেজে পড়ছিল প্রতিমা। ভালোমানুষ মামা কিছুদিন দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন কিন্তু একদিকে পুলিস অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী তাঁকে শেষপর্যন্ত নিরস্ত করেছিল। মন্ত্রীর প্রোটেকশনে যে ঘুরে বেড়ায় তাকে আইন ছোঁবে সাধ্য কি!

রাজা বুঝতে পারল ঘরে যে এসেছিল সে বসেছিল তারই বিছানার কিনারায়। টি-পয়টার অঙ্গভঙ্গি বুঝিয়ে দিল সে চাও খেয়েছিল। বাতাস শুঁকে রাজা অ্যাশট্রেটার দিকে এগোলো। চাপা গন্ধটা নির্ভুল, ভালো করে নজর করতে চুরুটের ছাইটুকু আলাদা করে চিনতে পারল। যে এসেছিল তার পরিচয় আর অজানা থাকল না তার কাছে। লোকটা এখন প্রতিমার সবচেয়ে শুভানুধ্যায়ী। এই সংসারের ভালোমন্দ নিয়ে খুব ভাবিত। বোধ হয়, বোধ হয় কেন নিশ্চয়ই, তলায় তলায় প্রতিমার ওপর তার একটা টান আছে। মানুষটা খারাপ তা নয়, তবে ভিতু টাইপের, যারা এক পা এগোয় দু পা পিছোয় সেইরকম। কোনদিনই দুঃসাহসের কাজ করতে পারবে না। তবু যেটুকু এগিয়েছে তাতেই, অন্য সময় হলে লোকটার যে কি পরিণতি ঘটতো ভেবে রাজার ঠোঁটে একটুকরো নিষ্ঠুর হাসি খেলা করে গেল।

‘এ কি, এখনো দাঁড়িয়ে আছো, বসো।’ চা আর হাল্কা এক প্লেট জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল প্রতিমা। টি-পয়টি সোজা করে তাতে কাপপ্লেট নামালো। রাজা কোন কথা বলল না, গম্ভীর মুখেই বসে পড়ল খাটের কিনারে। নিজেকে যেন সেই লোকটার জায়গায় বসিয়ে তার চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকল প্রতিমার দিকে। নতুন দেখা। এই চোখ নিয়ে কখনো দেখেনি ওকে। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন রূপ খোলতাই হচ্ছে প্রতিমার। এখনো রীতিমত ফর্মে আছে বলা যায়। পরস্ত্রীর মতই আকর্ষক, পরস্ত্রীর মতই সুন্দরী। নাকি এই হতশ্রী সংসারের মধ্যে একান্ত বেমানান বলেই এমন লাগে? বুকের মধ্যে দম আটকে ও তাকিয়ে থাকল, অক্ষম আক্রোশে নিষ্ঠুর হাতে আদর করতে ইচ্ছে করল।

‘চোখ দুটো গেলে দেব কিন্তু এই অসভ্য।’ প্রতিমা বহুদিন পর হঠাৎ চটুল ভঙ্গি করে বসল।

‘তা হলে সুবিধেই হয়।’

রাজার দু’মুখো কথাটাকে গ্রাহের মধ্যে আনলো না প্রতিমা। এক লহমার ছলক ভুলে অন্য গলায় কথা বলল, ‘এই, একটা খবর আছে জানো, যে কথাটা তখন বলছিলাম।’ রাজা কোন উত্তর করল না।

‘আর একটা পার্টটা্ইম কাজ পেয়েছি। পেয়েই গেছি ধরতে পার। তুমি অমত করতে পারবে না কিন্তু। এখন টাকার সত্যি খুব দরকার। হপ্তায় চারদিন, বিকাল চারটে থেকে আটটা। ছশোর মত দেবে বলেছে। এই টাকাটা পেলে বাবলুর জন্যে আর ভাবতে হবে না। আরও বড় স্পেশালিস্ট কাউকে দেখিয়ে—’

‘কাজটা কী তা তো বললে না!’

‘একটু ইয়ে, মানে অন্য রকম তাই বলছিলুম। এক বিলেত-ফেরত লেডি ডাক্তারের চেম্বারে বসতে হবে।’

কাসির মত ছোট্ট একটু শব্দ করে রাজা হাসলো, ‘ও লেডি কম্পাউণ্ডার, নাকি নার্স?’

‘সে যাই হোক, লেডি ডাক্তার, তোমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ প্রতিমাও পালটা হাসলো ছোট্ট করে, চোখে চোখ বিঁধিয়ে কৌতুক করল, ‘তোমাদের দুজনের কল্যাণে নার্সিংয়েও আমার হাতেখড়ি হয়ে গেছে। তবে ওসব বোধ হয় না, যতদুর শুনেছি, টিকিট লেখা, রুগীর কেস লেখা, এইসব। খুব পারব, কী, পারব না?’

‘তা ঠিক, তুমি পারবে। তোমার ইচ্ছে হলে সবই পারবে।’

কথাটার তলায় হয়ত একটা খোঁচা আছে, ভেবে প্রতিমা বিষন্ন মুখে তাকালো।

বিশুবাবু জানলায় আয়না ফিট করে ক্ষুর চালাচ্ছিলেন। বারো আনা গাল কামানো হয়েছে এমন সময় চোখ পড়ল সামনে মাঠের দিকে। গাছের তলায় একটা লোক হাত-পা ছড়িয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলেন ঘুমোচ্ছ, কিন্তু মিনিট খানেক পরে আবার তাকাতেই কেমন খটকা লাগলো। এই মার্চ মাসের গরমে মুখের ওপর বেলা এগারটার রোদ্দুর নিয়ে কেউ ঘুমোয় না। তাছাড়া চার-পাঁচটা কাক কেমন সন্দেহভাজনভাবে লোকটার পাশে চক্কর দিয়ে উড়ে উড়ে বসছে। তাদের উত্তেজিত খা-খা ডাক শুনে বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠলো। তবে কি মরে পড়ে আছে লোকটা? এই কদিন আগেই তো বি, টি. রোডের নালার ধারে একটা ডেডবডি ওভাবে পড়ে ছিল। খুন-ফুন আজকাল কিছু ব্যাপার না। দাড়ি কামানো অসম্পূর্ণ রেখেই উদ্বেগে তাকিয়ে থাকলেন বিশুবাবু, কি করবেন, তাঁর এখন কি করা কর্তব্য ভেবে পেলেন না। বাড়িতে ফোন নেই, ফোন করতে গেলেও পাশের বাড়িতে ছুটতে হবে। এই বেলা এগারটায় সে-বাড়ির পুরুষরা নিশ্চয় অফিসে কলেজে বেরিয়ে গেছে। যাই হোক, তার আগে লোকটা মারা গেছে কি না সে-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া দরকার। গিন্নীকে ডাকলেন একবার কিন্তু সাড়া না পেয়ে ঐ অবস্থায়ই পায়ে চটি গলিয়ে নিচে নেমে গেলেন।

উর্ধ্বশ্বাসে ফিরে এলেন একটু পরেই। উত্তেজিত হাঁকডাক শুনে স্ত্রী কুসুমকামিনী বেরিয়ে এসে একটু পরে স্বামীর বিচিত্র মূর্তি দেখে থ হয়ে গেলেন। মুখময় থোকা থোকা সাবানের ফেনা। গেঞ্জির তলায় লুঙ্গির একটা প্যাঁচ খসে গেছে, পায়ে একপাটি রবারের চটি। উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছেন। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসার দরুনও বটে।

ভেতরে নাড়া খেলেও অভ্যেসমাফিক ঝঙ্কার দিলেন, ‘কুকুরে কামড়েছে না ডাকাত পড়েছে বাড়িতে! ওরকম বিতিকিচ্ছি চেঁচাচ্ছ কেন? তুমি না প্রেশারের রুগী!’

‘আর প্রেশার!’ হাঁপ সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘ওদিকে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে গেছে।’

‘কী হয়েছে?’ আঙুল বরাবর তাকিয়ে কুসুমকামিনী কিছু দেখতে পেলেন না। কারণ বিশুবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন সিঁড়ির মাথায়।

‘সে খুন হয়েছে, দেখবে এসো। আহা, মেয়েটার এবার সাড়ে-সর্বনাশ হল!’

ফ্যাকাশে মুখে কুসুম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন ক’পলক তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে? কার কথা বলছ?’

‘সেদিন যাকে হরিপদর দোকানে দেখেছিলুম, সে। রাজা—আমাদের জামাই!’ জামাই কথাটা উত্তেজনার মাথায় আজ এতকাল পরে ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বোধ হয় খেয়ালও করলেন না। স্ত্রীর হাত ধরে পাশের ঘরের দিকে টানলেন, ‘নিজের চোখে দেখে যাও।’

টানতে টানতে একেবারে জানালার সামনে নিয়ে এলেন, বিমূঢ় কুসুম ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু জানালা দিয়ে তাকিয়ে আর এক বিস্ময়। গাছতলা ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। রীতিমত বোকা বনে গেলেন।

‘কী আশ্চর্য, এ কি কাণ্ড!’

‘সত্যি তোমার না ভীমরতি ধরেছে।’

‘বাঃ নিজের চোখে দেখে এলাম কাছে গিয়ে।’

‘এই তো তোমার দেখা। পুজো ফেলে ধড়মড় করে উঠে এলাম।’

অহমিকায় লাগল। এমন আহাম্মক বনে যাবেন কে জানতো। বললেন, ‘পর পর দুটো দিন কেউ ভুল দেখতে পারে না। আমি ঠিকই ধরেছিলাম ওরা এ-পাড়াতেই কোথাও এসে উঠেছে।’

কুসুম বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, ‘মেয়েটাকে কতকাল দেখি না।’

মাঠের পাশের সরু গলিটা দিয়ে বাড়ির পথ শর্টকাট করতে করতে রাজার মনে হল, এই জীবনটা বড় তাড়াতাড়িই যেন শেষ হয়ে এল। এত দ্রুত তার সর্বস্ব ফুরিয়ে যাবে কেউ কি ভেবেছিল? এখন দিন কাটে না রাত কাটে না অবস্থা। প্রতিমা তাদের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই এনে দিয়ে বলে, পড়ো। পড়েই দ্যাখো না, ভালো লাগবে। আর যদি ভালো নাই লাগে ক্ষতি নেই, সময় তো কাটবে। যেমন আমাকে নিয়ে তোমার সময় কেটে যাচ্ছে হু-হু করে। হু-হু শব্দটার ওপর এমন একটা আলগা মোচড় দেয় যে, কথাটার মধ্যে অভিমান না বিদ্রুপের খোঁচা ঠিক ধরতে পারে না।

প্রথম দিকে মনে হত প্রতিমা বোধ হয় আর কাউকে ভালোবাসত। জোর করে ছিনিয়ে আনার পর এবং ভয় দেখিয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করার পর ঘৃণায় এবং নিরুপায় ক্রোধে সে ধিকিধিকি জ্বলছে। অথচ কোনদিন এমন কোন উদ্ভট কাজ করেনি, ক্ষিপ্ত আচরণ করেনি কিংবা জিভে-দাঁতে ঝগড়া করেনি যা থেকে সেই চাপা আগুনের আঁচ পাওয়া যায়। প্রতিমা নিজের মধ্যে নিজেকে এমনভাবে গুটিয়ে নিয়েছিল যে কচ্ছপের মতই তার খোলা না ভেঙে তাকে ছোঁবার উপায় ছিল না। তার উপেক্ষা, অনীহা, উদাসীনতা আর শীতল নিষ্ক্রিয়তা শুধু অনুভব করা যেত, দেখা যেত না। একটা অদৃশ্য দেওয়ালে রাজার যেন বারে বারে মাথা ঠুকে গেছে অথচ কিছুই করার থাকেনি। ছায়ার সঙ্গে কি যুদ্ধ করা যায়? নিজের অস্তিত্বকে যে হাওয়ায় মিশিয়ে দিয়েছে তাকে পীড়ন করবে কে! বন্দুকের নল। যার মাউথপিস, বোমার পর বোমা ছুঁড়ে যে একটা গোটা পাড়া জ্বালিয়ে দিতে পারে, শুধু হাতে যে মোটই নিরস্ত্র নয় বরং কখনো কখনো আরও বেশি বিপজ্জনক, ওই সূক্ষ্মকর্ম অন্তত তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এই দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত সত্যি বলতে কি তার হৃদয় ছিল না, ছিল ভগবৎ-দত্ত একজোড়া হার্ট-লাং মেশিন।

তাই যে রাতে সে মৃত্যুর বৈঠকখানায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং সেখান থেকে ফিরে আসার কোন কথাই ছিল না, তখন প্রতিমা অনায়াসেই পালিয়ে যেতে পারত। হয়ত পালাবারও দরকার হত না, যাবতীয় সঞ্চয় নিয়ে সামান্য একটু সরে দাঁড়ানোই যথেষ্ট হত, তখন প্রতিমা ঠিক উলটোটাই করেছে। অসুস্থ শিশুকেও পরের কাছে ফেলে রেখে হাসপাতালে ধরনা দিয়েছে, পাগলের মত সারা শহর চষে বেড়িয়ে রক্ত যোগাড় করেছে বোতলের পর বোতল। অমানুষিক জীবনীশক্তি আর পরমায়ুর জোরে রাজা যখন টিকে যাবে বলে মনে হয়েছে তখন নিরাপদ পাড়ায় তার জন্যে বাড়ি খুঁজে বের করেছে, নিজের একটা ভদ্রগোছের চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে অনেক ছুটোছুটি ধরা-করা করে। তারপর পায় আধখানা বছর পেরিয়ে হসপিটাল বেড থেকে যখন ঘরের বিছানায় ফিরেছিল তখন শুশ্রূষায় নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে প্রতিমা। অথচ কী স্বার্থ ছিল তার এর পেছনে, আখেরে কোন লাভ? ঘৃণা আর ক্রোধের বাষ্পই কি ফোঁটায় ফোঁটায় চোলাই হয়ে গিয়েছিল ভালোবাসায়।

নাকি এটাই প্রতিহিংসার প্রেম, বিদ্বেষের অনুরাগ? হয়ত রাজার অবধারিত পরাজয়কেই প্রকট করে তুলছে। এই মহত্ত্বের মধ্যে অপমানের শোধবোধ আছে তবে কি?

সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট হচ্ছে না। জমা-খরচের হিসেবটা একদিন রাজার কাছে খুব পরিষ্কার ছিল। হয় যোগ নয় বিয়োগ। নব্যেন্দুর ব্যাপারটা কেন যে এমন ঘোলাটে করে রেখে দিচ্ছে প্রতিমা কে জানে!

ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছিল প্রতিমা। দ্রুত হাতে। শাড়ির আঁচলটা পিছলে গেছে কাঁধ থেকে। যেন ওয়ার্নিং বেল বেজে যাচ্ছে। গ্রীনরুম, উইংস, স্টেজ, পর্দা উঠছে, জমাট স্তব্ধতা, দর্শক। চেয়ারে দুমড়ে মুচড়ে বসে আছে রাজা। পলকা, ঠুনকো প্রকাণ্ড একটা কাচের মানুষ। নিঃশব্দ।

‘আমি একটু বেরুচ্ছি।’ ঠোঁটে লিপস্টিক টানলো আবছা করে।

‘কোথায়?’

‘দূরে কোথাও না, কাছেই।’

‘জানি। দূরে আর কোথায় যাবে!’

নড়ন্ত শরীরটা হঠাৎ থেমে জমাট বেঁধে গেল বেজায়গায়। আয়নার ভেতর দিয়ে চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল প্রতিমা। ওদিকে বাইরে একটা লোক বোধ হয় ঘেমে উঠেছে। কাওয়ার্ড!

কাওয়ার্ড! দাঁতে দাঁত চেপে জিমন্যাস্ট সুধীরদা বলল, তোর হাত ছিল না?

রক্তে লাল হয়ে ওঠা তুলোর ড্যালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টিংচার আয়োডিনের শিশিটা খুললেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল। সর্বাঙ্গ জ্বলছে।

—সারা জীবন শুধু হাত পেতে নিতেই শিখলি? দে ফিরিয়ে দে। মারের ধার রাখতে নেই।

বলেই দুম করে একটা ঘুষি মারলেন মুখের ভালো দিকটায়। মাথাটা ঘুরে গেল রাজার।

জীবনটাও। সেই ষোল বছর বয়স থেকেই। তার আগে পর্যন্ত শুধু মার খেয়েই এসেছে রাজা, শুধু মার। ঘরে বাইরে। কারণে, অকারণেই বেশি। এক একটা মানুষ শুধু মার খাওয়ার জন্যেই জন্মায়। রাজাও জন্মেছিল সেই ভাবেই। রাজা তো রাজার ছেলেই ছিল। বাড়ি ভর্তি সচ্ছলতার মধ্যেই জন্মেছিল। কিন্তু বাবা হঠাৎ চলে যাবার পর কাকাদের পোয়াবারো হল। তার পর ঘোর অত্যাচারের দিন। টর্চার, কেবলই টর্চার। লুঠেরাদের রাজত্বে এক সরল অনভিজ্ঞ বিধবা আর তার অপোগণ্ড শিশুটি সেই বিশাল বাড়ির এক কোণে আবর্জনার মত শুধু পেটভাতায় পড়ে থাকল। মা-পাখিটা ডানার নিচে ঢেকেঢুকে রেখেছিল যতদিন পেরেছিল। তারপর তার দিনও শেষ হল। ততদিনে ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে রাজা। সেই সঙ্গে বাড়ির চৌকাঠও।

কিন্তু যা হতে চেয়েছিল হল না। চারপাশের মানুষ তা হতে দিল না। উলটো মুখে রাজার দৌড় শুরু হল। মানুষের প্রতি অবিশ্বাসে, আক্রোশে, ঘৃণায়। চোখের জল বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে কবে। পিছনে অতীতটা মুছে গেছে কবেই। ভবিষ্যৎটা অস্থির, ঝাপসা।

ছেলেটা দালানে বসে মুড়ি খাচ্ছিল দুলে দুলে আর আফিংখোর বুড়োর মত ঝিমোচ্ছিল। বুড়োই বটে, অকালবুড়ো। বিলকুল জড়ভরত। সারাদিন বিশেষ নড়াচড়া নেই, এক জায়গাতেই বসে থাকে আর চলাচলের অভাবটা বোধ হয় পুষিয়ে নেয় ওই দুলুনিতে। সামনে খাবার কিংবা ছবির বই ছড়ানো থাকে, একটা দুটো সস্তার খেলনা, ছুঁয়ে দেখে কি দেখে না। যেন অন্য জগতের শিশু। টকটকে ফর্সা রঙ, বুক-পেট বেশ নধর-নাদুস, কিন্তু কোমরের নিচ থেকে দুর্বল। উভঙ্গে কুরুবর, কোথায় শোনা এই কথাটাই মনে পড়ে প্রত্যেকবার। ছেলেটা দাঁড়াতে পারে না। সেটা ওর কমজোরি পায়ের জন্যেই সবটা, না মাথার জন্যে, বলা শক্ত। মাথাটা অস্বাভাবিক বড়, দেহের তুলনায় তো বটেই, বয়সের তুলনাও মনে এসে যেতে বাধ্য। অশক্ত অনিচ্ছুক ঘাড়ে কেউ বুঝি একটা বড়সড় ভারী মোট চাপিয়ে দিয়ে গেছে, পাঁচ বছরের শিশুর পঁচিশ বছরের শিরোপা। তবে বামন না, বামনদের বেলায় মুখে যে পাকা ভাবটা আসে, তা নেই। সরল ভাবুক ভাবুক মুখ, ফ্যালফেলে চাউনি। কলকাতার টেলিফোনের মত, মনে হয় বাইরের জগতের কানেকশন পেতে দেরি হচ্ছে। তারপর মগজের মধ্যে রিং হতে থাকলে ধরবে কি ধরবে না করে ধরে, কিন্তু কথা পরিষ্কার বোঝা যায় না। তবে ওর মা, প্রতিমা ঠিক বুঝতে পারে। সে বুঝি ওর দিকে একটা কান পেতেই থাকে।

ওর মা এখন বাড়ি নেই, বেরিয়েছে। কখন ফিরবে কে জানে! তবে যতক্ষণ না ফিরছে ততক্ষণ রাজাই ওর একমাত্র রক্ষক, জিম্মাদার। যার সঙ্গে ওর দূরত্ব অনেক, সে ওর ভাষাটা সঠিক বুঝতে পারে না। মনে হতে পারে এক পঙ্গু আর এক পঙ্গুকে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তাই কি? নাকি এক প্রফেশনাল কিলার বসে আছে এক চলচ্ছক্তিহীন, নিস্পাপ অবোধ শিশুর সামনে। পরস্পরের মধ্যে কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত। কথা বলেনি, ডাকেনি পর্যন্ত কেউ কাউকে কোনদিন।

চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে মনে পড়ল অনেকদিন আগে হিন্দী সিনেমায় দেখা সেই দৃশ্যটা। এক ঘুমন্ত শিশুর শিয়রে ফণা তুলে এক রাজগোখরো ওর নিঃশ্বাসের তালে তালে দুলছে। রুদ্ধশ্বাস একটা মুহূর্ত থমকে আছে অনন্তকালের মত। বোঝা যাচ্ছে না এক মুহূর্ত পরে কি হবে, মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর একটা ছোবল উদ্যত হয়ে আছে দর্শকদের পলক ফেলার অপেক্ষায়।

ঠিক দুঃস্বপ্ন নয়, তবু ঘুমটা ভেঙে যেতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সেই ছেলেবেলার চোখের জলে চোখের পালক ছপছপ করছে টের পেল। বাবার সঙ্গে এই তার শেষ ছবি, ধার জ্বলে হলদে হয়ে যাওয়া অ্যালবামের ফটোর মত। বাবার মৃত্যুটা ঘটেছিল চোখের আড়ালেই। মুখাগ্নি করার সুযোগও পায়নি সে। গঙ্গার বানের মুখে পড়ে নৌকোটা তলিয়ে যাবার পর ডেডবডির আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।

কতই বা বয়স তখন রাজার। সাত কি আট। পাখিটার জন্য খুব কষ্ট হত। উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করত, সুযোগ পেত না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। পাখিটা খাঁচার শলা ঠোকরাতো সারাদিন। বোধ হয় ভেঙে বেরুতে চাইত। পারত না।

সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরছিল, বাবার চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা। তিনতলার বারান্দার হুক থেকে পাড়তে গিয়ে রাজার হাত ফস্কে খাঁচাটা গিয়ে পড়ল সোজা নিচের ফুটপাথে। পুরনো খাঁচাটা ভেঙে তুবড়ে ছেতরে গেল। খাঁচা থেকে ছিটকে বেরিয়ে পাখিটা গিয়ে পড়ল রাস্তার মাঝখানে। মরলো না। শুধু পাখা ঝাপটে উঠে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকল ক-মুহূর্ত। রাজা ভেবেছিল এই সুযোগ, ও এইবার উড়ে পালাবে। পাখিটা কিন্তু উড়ল না, লাফাতে লাফাতে ছুটে এল সেই ভাঙা খাঁচার কাছে। গৃহহারা দিশেহারার মত। তারপর কী আশ্চর্য, বার বার সেই তালগোল পাকানো খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল।

পাখিটাকে ধরে বাবা যখন বাড়ির ভেতর ফিরিয়ে নিয়ে এল তখন রাজার সে কি হাউ হাউ কান্না! বাবা হেসে বলেছিল, দুর পাগলা ছেলে, খাঁচা ভেঙেছে তো কি হয়েছে। আবার নতুন খাঁচা কিনে আনবো এক্ষুনি।

বাবা বুঝতে পারেনি। খাঁচা নয়, রাজা সেদিন কেঁদেছিল পাখির জন্যেই।

বিছানার ওপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। বোধ হয় শেষ রাত। রাজা ধীরে ধীরে উঠে বসল, গলা বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। টি-পয় থেকে জল খেল ঢকঢক করে। খাট থেকে নেমে এগিয়ে গেল। দু’ঘরের মাঝখানের দরজাটা খোলাই থাকে। ম্লান চাঁদের আলোয় দেখতে পেল প্রতিমা ছেলের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমের অতলে তলিয়ে আছে। কেমন মনে হল ঘুমের ভেতরে নয়। জলের অতলে শুয়ে আছে প্রতিমার নিঃম্পন্দ প্রাণহীন দেহ। নিরেট পাথরের বোল্ডারের মত একটা বেঢপ মাথা বেঁধে দিয়েছে কেউ। ‘কে?’

অস্থির পায়ে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো রাজা। পেঁপেগাছের ছায়াটা হেলে আছে উঠোনের কোণে। উঠোন ফাঁকা, মৃতদেহ বিছানা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলে যেমন লাগে। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। তারপর মনে পড়ল, আজ সকালেই লোহালক্কড়ের গোডাউনের মালিক কিষণ সিং এসেছিল টেম্পো নিয়ে। গোভাগাড়ে নিয়ে যাওয়ার মত জগদ্দলটাকে তুলে নিয়ে গেল টেনে-হিঁচড়ে। তিনটুকরো হয়ে যাওয়া রাজার একটা টুকরো। গরুর মত চোখ করে হেডলাইটটা তাকিয়ে ছিল তার দিকে। তখনো বুঝি ধড় থেকে প্রাণটা বেরোয়নি।

বেলায় ইস্কুল থেকে ফিরে প্রতিমা চমকে উঠে বলেছিল, ‘এ কি! তোমার গাড়ি কোথায়?’

অবজ্ঞার ভঙ্গি করে রাজা বলেছিল, ‘ভালো দর পেয়েছিলাম তাই বেচে দিলাম।

প্রতিমা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, ‘যাঃ। কেন? এত কষ্ট করে আমি এ বাড়িতে টেনে আনলাম, আর তুমি—’

রাজা মনে মনে বলেছিল, তুমি তো কষ্ট করেই সব টেনে বেড়াচ্ছ সেই কবে থেকে। মুখে বলেছিল, ‘কি হত ওটা দিয়ে, ওটা আর কোন কম্মে লাগতো? তোমার ছেলে কোনদিন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারত স্বপ্নেও ভেবো না। শুধুমুদু আবর্জনার মত উঠোনটাকে আটকে রেখেছিল।’

প্রতিমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একটু থমকে থেকে বলল, ‘মেডেলও তো মানুষ যত্ন করে ঘরে রাখে, সেটাই বা কোন কম্মে লাগে?’

‘ওটা অক্ষমের ভ্যানিটি! তাছাড়া কী! আমার কাছে ওর কানাকড়ির দামও নেই। বগলের ক্রাচও ওর থেকে বেশি কাজের। আমি নগদমূল্য বুঝি।’

পকেট থেকে নোটের গোছা বের করে প্রতিমার হাতের মধ্যে গুঁজে দিতে গিয়েছিল রাজা, ও হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘না। তুমি কিছুই বোঝ না, তোমার কাছে কারোরই কোন দাম নেই। কিন্তু কোন আক্রোশে তুমি এ কাজ করলে! আমাকে একবার জানালে না পর্যন্ত। গাড়িটা ছিল, থাকত। ও তোমার কাছে কিছু খেতে পরতে চাইছিল না।’ বলেই আর দাঁড়াল না, ঘরের ভেতরে চলে গেল।

খাটের কিনারে বসে পড়ে গত সকালের ঘটনাই ভাবছিল রাজা। যে থাকে তাকে কোনমতে থাকলেও চলে কিন্তু যে যাবে তার কোনমতে গেলে চলে না। যাবার সময় হলে যেতেই হয়, সবাই যাবে। কিন্তু যে রাজার চালে চলেছিল এতদিন, সে রাজার মত গেল না এটাই দুঃখের। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল, হাতের ওপর এক ফোঁটা জল পড়তেই চমকে উঠল। তবে কি শরীরটা ভালো নেই? আপনা থেকেই বাঁ হাতের কজির তলায় আঙুল চলে এল। না, পালস তো ঠিক ঠিকই চলছে। আর ঠিক তক্ষুনি কিছুক্ষণ আগের স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। সেই দুমড়ানো খাঁচার চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া পাখিটাকে সে দেখতে পেয়ে গেল অন্য চেহারায়। নিজের শরীরটার দিকে তাকালো রাজা। এই ভাঙা তোবড়ানো খাঁচাটাও তো দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে তার। সব কষ্ট সব অসুবিধের সঙ্গে আপসে মানিয়ে নিতে পেরেছে। খাঁচার মত এই অর্থহীন ছকবাঁধা জীবনের সঙ্গেও। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একঘেয়ে রুটিনের চাকা ঘুরে চলেছে। কোন ভোর সকালে উঠে বারোআনা রান্না সেরে প্রতিমা স্কুলে বেরিয়ে যায়। ঝুন্টি আসে ঘরের কাজ সারতে। মাথামোটা বিকল ছেলেটা বারান্দায় রোজ একই জায়গায় বসে একই কায়দায় দুলে চলে, দুলেই চলে। নেশার ধোঁয়া আর হিজিবিজি চিন্তার মগজ নিয়ে রাজা বসে থাকে একটু তফাতে, অন্য জগতে। ঘর আগলায়।

মাছঅলা সবজিঅলা এলে ফর্দমাফিক এটা-সেটা রাখে। বেলায় ফিরে প্রতিমা আবার হেঁশেল ছোঁয়, বাবলুর খিদমত খাটে। টুকটাক কথার ফাঁকে ভাত বাড়ে। তারপর খাওয়া। একটু গড়ানো। ফের বিকেলের দৌড়। প্রতিমা ছোটে তার দু নম্বর চাকরিতে। লেডি ডাক্তারের চেম্বারে। ফিরতে রাত হয়ে যায়। ন’টা বেজে যায় প্রায়ই। ঘরে মেঝেয় পাতা কাঁথার ওপরে বাবলু ঘুমিয়ে কাদা। চারপাশে খেলনাপাতির পুরনো সংসার। গ্যাসে লাস্ট মিনিট চুকছাঁক। নাইট ওয়াচম্যানের মত রাজা ঢলচেয়ারে ঝিমোয়। ঝিমোয় না হয়ত, মাথার খুলির মধ্যে ভিডিও ক্যাসেট নাগাড়ে চলতে থাকে। তারপর ঝিঁঝিঁ ধরার মত রাতের ঘুম। দুটো ঘরের মাঝখানের দরজাটা হাঁ করে থাকে। ফের সকাল। একটা সকালের সঙ্গে আর একটা সকালের কোন তফাত থাকে না। এই তো জীবন। এভাবে মানুষ কেন যে বেঁচে থাকে কে জানে! তবু থাকে। অভ্যেস।

সেদিন দরজা খুলতেই নব্যেন্দুর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল রাজার। ওকে দেখলে নব্যেন্দু কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়, সহজ হতে পারে না। না পারারই কথা, প্রেমিকার স্বামীকে কে আর সহজে নিতে পারে? বিশেষ করে অতীতের সেই ভয়ংকর ঘটনাটা ওর পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। বিয়ের আগে প্রতিমার সঙ্গে নব্যেন্দুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। রাজা ডাকাতের মত মাঝখানে ঝাঁপিয়ে না পড়লে নব্যেন্দুর সঙ্গেই প্রতিমার বিয়ে হয়ে যেত। সে-রকমই ঠিক ছিল। সেটাই বোধ হয় ঠিক হত।

বেশ কিছুদিন থেকেই নব্যেন্দুকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে রাজা। ভাবনাটা অবশ্য প্রতিমার জন্যেই। ভূত-ভবিষ্যৎহীন দুটো বোঝাকে টানতে গিয়ে ওর সব কিছুই যেন শেষ হতে বসেছে। আজকাল ওর মেজাজে, ওর চেহারায় সেই ফুরিয়ে যাবার ছাপ পড়তে শুরু করেছে যেন।

পাপপুণ্য নিয়ে কোনদিন মাথা ঘমায়নি রাজা। কিন্তু আজ মনে হয় পুণ্য বলে কিছু না থাকলেও পাপ আছে। যে যা হতে চেয়েছিল তা হতে না দেওয়াই পাপ। একদিন চারপাশের মানুষ তাকে তার মত হয়ে বাড়তে দেয়নি। আজ সে নিজেও কি তাই করছে না? প্রতিমাকে বনসাই বানিয়ে এই খাঁচার মধ্যে ধরে রেখেছে।

কদিন আগে হঠাৎ একটা ঘটনায় রাজার চোখ খুলে গেছে। দুর্বোধ্য একটা ধাঁধার সমাধান এমন করে পেয়ে যাবে কল্পনাও করেনি। আজকের স্বপ্নটা বোধ হয় সেই কথাই মনে করিয়ে দিল আবার।

আলমারি খুলে কিছু খুঁজছিল রাজা। আজকাল প্রায়ই খোঁজে। কোন হিংসে নিয়ে নয়, আক্রোশ নিয়ে নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক যেমন মাটি খুঁড়ে অতীত ইতিহাস খোঁজে। যে দুটি হৃদয় কবে মাটিতে মাটি হয়ে গেছে তা খুঁড়ে কি পাবে রাজা? পেলেই বা কী হবে?

ব্যাগটা চোখে পড়ল রাজার। বেশ ঢাউস একটা নতুন লেডিজ ব্যাগ। দামী চামড়ার। দেখেই বোঝা যায় বিদেশী। এ ব্যাগ প্রতিমাকে কে দিল? কৌতূহলে ব্যাগটা খুলে অবাক হয়ে গেল রাজা। ব্যাগভর্তি নানা রকমের ওষুধ। সিরিঞ্জ। ব্যাণ্ডেজ। আরও টুকিটাকি কিছু। রাজা তন্ময় হয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছিল। বাবলুর জন্যে নাকি? কিন্তু ওষুধের ফাইলগুলো দেখতে দেখতে চমকে উঠল রাজা।

তিনতলার বারান্দা থেকে পাখিটাকে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। পাখিটা তোবড়ানো খাঁচার মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন কষ্ট হচ্ছিল।

তন্দ্রার ঘোরটা কেটে যেতেই টের পেল পাখি না, প্রতিমা। প্রতিমাই তার বুকে মুখ ঘষছে। ওর বাঁশির মত টিকোলো নাকে ফুরফুরে বাতাস। সুড়সুড়ি লাগছিল। ঘর অন্ধকার, শিয়রের জানলাটা বোধ হয় বন্ধ। কিন্তু এই চেনা সুগন্ধ আর পরিচিত স্পর্শ ভুল হবার নয়। কতকাল, বোধ হয় এক যুগ পরে ও-ঘর থেকে এ-ঘরে, ওর বিছানায় চলে এসেছে প্রতিমা। এই প্রথম, নিজে থেকে। বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু সত্যি। মনে পড়ল আজ কদিন ধরেই ওদের মধ্যে একটা চাপা গুমোট চলছিল, বাক্যালাপ ছিল না।

আড়ষ্ট বিমূঢ় রাজা, ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। বুকের ভেতর একটা সরীসৃপের চলাচল টের পাচ্ছিল সে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবার মুখে সামলে নিল খুব জোর। যেন অসাবধানে একটা গভীর খাদের কিনারে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়েছে। একচুল নড়ল না, জানান দিল না সে জেগেছে। নিঃস্পন্দ সজাগ শরীর দিয়ে প্রতিমাকে বুঝতে চেষ্টা করল। প্রতিমা কি কাঁদছে? একটা হাত রাজার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা, গায়ে জামা নেই, নিঃশ্বাস কেমন এলোমেলো।

দাঁতে দাঁত চাপল রাজা, চোয়াল শক্ত হল। অনেকক্ষণের নিষ্ঠুর চেষ্টায় একটা হাত রাখলো ওর পিঠে, তার পর ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘নব্যেন্দুর কথা মনে পড়ে গেছে বুঝি?’

প্রতিমা চেঁচালো না, ছিটকে সরেও গেল না, শুধু তার শরীরটা একবার কেঁপে উঠে অস্বাভাবিক রকমে স্থির হয়ে গেল। যেন এই মাত্র তার পিঠে যে ছুরিটা বসানো হয়েছে সেটা তার হৃৎপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে।

‘ছিঃ, তোমার মনটা এত ছোট হয়ে গেছে ভাবতে পারিনি।’ ঘরের আবহাওয়া বদলে গেল পলকে।

‘ছোট? তা হবে!’ রাজার গলায় শ্লেষ।

‘না, হবে না! কেন হবে? নব্যেন্দু তো তোমার কোন ক্ষতি করেনি। করবেও না কোনদিন এটা জেনে রাখো।’

‘জানি। সে সাধ্য তার নেই। এক ধরনের পুরুষ আছে যারা কিছুই পারে না, শুধু কবরে ফুল ছড়াতে পারে।’

প্রতিমা ধরা গলায় বলল, ‘সেটাই বা ক’জনে পারে।’

রাজা শব্দ করে হাসল। বলল, ‘তোমার আলমারিতে একটা নতুন ব্যাগ দেখলাম সেদিন। নব্যেন্দুর উপহার নিশ্চয়?’

প্রতিমা উঠে বসল, ‘হ্যাঁ। তুমি আমার আলমারিই শুধু ঘাঁটোনি ব্যাগও ঘেঁটেছিল আমি জানি। তোমার মাথায় ভূত চেপেছে।’

একটু চুপ করে থেকে রাজা বলল, ‘হুঁ। তোমাকে আজকাল ওষুধও সাপ্লাই দিচ্ছে নাকি তোমার ফ্রেণ্ড? ভালো, খুব ভালো!’

‘ওদের কোম্পানির ওষুধ। ফিজিশিয়ানস স্যাম্পেল।’ খাট থেকে নেমে পড়েছিল প্রতিমা। চলে যাবার মুখে ছোট্ট করে হাসলো, কেমন তেতো হাসি, ‘তোমার ভয় নেই, ওগুলো ডাক্তারখানার জন্যে।’ আবছা অন্ধকারের মধ্যে দুলতে দুলতে প্রতিমার ছায়াটা পাশের ঘরে মিলিয়ে গেল।

মাথার মধ্যে আবার সেই ঘুণপোকার শব্দটা শুনতে পেল রাজা। পোকাটা তার ব্রহ্মতালু ছ্যাঁদা করে চলেছে।

দেরাজটা খুলে বেশি খুঁজতে হল না। কদিন আগেই প্রতিমার ডক্তারখানার ব্যাগটা থেকে সরিয়ে রেখেছিল শিশিটা। লেবেলটা আর একবার পড়ে নিল নিশ্চিত হবার জন্যে। শেষ গল্পটাকে এবার শেষ করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি। হাতে আর সময় নেই। রান্নাঘরে ঢুকে দুটো গেলাসে করে দুধ নিয়ে এল।

রাজার হাতের নিশানা এক সময় ছিল নির্ভুল, কখনো ফসকায়নি। কিন্তু আজ দুটো হাতই যাচ্ছেতাই রকমে কাঁপছে। কেবলই ভয় হচ্ছে হাত থেকে একটা গ্লাস না শেষ পর্যন্ত পড়ে যায়। অনেক সময় নিয়ে সাবধানে শিশিটা খালি করল দু গেলাসে। চামচ নেড়ে নেড়ে ভালো করে মেশালো। অবোধ ছেলেটা তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখলো। কি বুঝলো কে জানে! তার মুখে আবছা হাসি। বাবু হয়ে বসে দুলে চলেছে একই ভাবে। সামনে ডালাভাঙা পুতুলের বাক্স, রঙচঙে ছবির বই। ছুঁয়েও দেখে না ছেলেটা আজকাল। এ-জীবন তার কাছে পুরনো হয়ে গেছে।

এক গ্লাস দুধ হাতে নিয়ে চেয়ার টেনে ওর সামনে গিয়ে ঝুঁকে বসল। মনে হল ছেলেটা টের পেয়ে গেছে। ভীত অথচ চতুর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে নিল। অভিমানের ভঙ্গি।

রাজা ডাকল, ‘খোকন। খোকা।’

বাবা ছেলেকে এই প্রথম ডাকল। ছেলে সাড়া দিল না। মুখ ফিরিয়েই থাকল।

‘খাও। দুধটুকু খেয়ে নাও।’ কি মনে হতে ফের বলল, ‘তুমি খেয়ে নিলে আমিও খাব। ঐ যে আমারটা। ঐ দ্যাখো।’

ছেলেটা অবাক চোখে ফিরে তাকালো। গ্লাসের দুধ দেখল। অন্যদিন ওর মা খাওয়ায়।

রাজা কাঁপা-কাঁপা হাতে গেলাসটা তুলে ধরল ওর মুখের সামনে। ছেলেটার অছেলেমানুষ মুখে ঠোঁট দুটো কাঁপছে। বোধ হয় কিছু বলছে। বুঝতে পারছে না রাজা। প্রতিমা পারে। রাজা কোনদিন বোঝার চেষ্টাও করেনি অবশ্য। গলার স্বর দুর্বোধ্য। জড়ানো। ভঙ্গিটা কেমন লজ্জা-লজ্জা। নাঃ, ছেলেটা বড় দেরি করিয়ে দিচ্ছে। বিব্রত বিরক্ত রাজা কান এগিয়ে দিল ছেলের মুখের কাছে। তরপর চমকে উঠল। দিব্যি স্পষ্ট গলায় ছেলেটা বলছে, ‘বাবা হামি। বাবা হামি।’ আঙুল তুলে গাল দেখিয়ে দিল, নিজের দুটো গাল। আড়ষ্ট মুখে ছেলের গালে চুমো খেল রাজা। এ-গালে ও-গালে।

আর ঠিক তখই টের পেল ছেলেটা তার নরম-নরম দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে ওর গলা। পরম নির্ভয়ে দুলছে ওর শরীর। মুহুর্মুহু চুমোয় আর লালায় দাড়ির জঙ্গল ভিজে গেল রাজার।

প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে ছেলের হাত দুটো ছাড়াতে পারল না।

১৩৯৪ (১৯৮৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *