ভিখারি বিষয়ে
কার্তিক সবে শেষ হতে চলেছে। কলকাতায় শীত আসতে এখনও ঢের দেরি। তবে সকালে সন্ধ্যায় বাতাসে একটু হিম হিম ভাব। রাতে গায়ে একটা চাদর দিলে আরাম লাগে। ভোরবেলায় গাছের পাতা, মাঠের ঘাস শিশিরে ভিজে থাকে। সন্ধ্যার দিকে একটা নীল কুয়াশার হালকা পরদা ল্যাম্পপোস্টের নীচে নেমে আসে কোনও কোনও দিন।
মাসের দ্বিতীয় শনিবার দুপুরে খেয়ে উঠে শারদীয় সংখ্যার একটা উপন্যাসের পাতা ওলটাতে ওলটাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে মাসকাবার বাজার করেছি। তারপর বিক্রিওয়ালা ডেকে পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করেছি। অবশেষে স্নানের সময় পোষা কুকুরটাকে সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়েছি। ঠান্ডা পড়ে যাচ্ছে, এর পরে আর অনেকদিন স্নান করানো যাবে না। একটা বুড়ো এবং বেয়াদপ কুকুরকে স্নান করানো খুব কষ্টসাধ্য কাজ। বাজার করা, কাগজ বেচাও খুব সোজা কাজ নয়।
ফলে যথেষ্টই শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি এবং যখন ঘুম ভাঙল তখন রীতিমতো অন্ধকার। শেষবারের মতো দিন ফুরানোর মুখে কয়েকটা কাক ডাকাডাকি সেরে নিচ্ছে শ্রান্ত কণ্ঠে।
অবেলায় ঘুম থেকে উঠে মন খারাপ হয়ে গেল। কত কী করার ছিল, কত কী করার আছে, কিছুই হল না।
ছুটির দিনের বিকেল। বাড়ির সবাই বাইরে বেরিয়েছে। বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বেলে মুখ ধুয়ে খাওয়ার টেবিলের ওপরে চায়ের ফ্লাস্ক থেকে পেয়ালায় চা ঢেলে খেলাম।
শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। বার বার হাই উঠছে। জামাকাপড় পরে বাইরে বেরুলাম। সদর দরজার ডুপ্লিকেট চাবির বন্দোবস্ত আছে। খালি বাড়ি বন্ধ করে যেতে কোনও অসুবিধে নেই। তা ছাড়া কুকুরটা আছে। আমরা এখনও যেখানটায় থাকি সেখান থেকে ময়দানের দক্ষিণ প্রান্ত বেশ কাছে। হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত গেলাম।
শনিবারের সন্ধ্যা বলেই গেটের কাছে খুব ভিড়, রীতিমতো মেলা জমে গেছে। বেলুনওলা, পুলিশের ভয়ে ত্রস্ত ফুচকা ও আলুকাবলিওয়ালা এবং সেই সঙ্গে এক দঙ্গল ভিখারি। ভ্রমণকারী বায়ুসেবীরা অধিকাংশই অবাঙালি, কালোয়ার বা গুজরাটি। আজকাল আবার কিছু চিনেও জুটেছে। হংকং হস্তান্তর হয়ে যাবে কয়েক বছরের মধ্যে, সেখানকার চিনেরা নাকি কলকাতার দিকে আসছে। কথাটা হয়তো সত্যি; থিয়েটার রোডে, ময়দানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আজ বছর দুয়েক হল চিনেদের সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। আগে এসব অঞ্চলে চিনে দর্শন অকল্পনীয় ছিল।
তা যা হোক, কালোয়ার, গুজরাটি আর চিনে এই তিন সম্প্রদায়েরই ভিক্ষে দেওয়ার দিকে ঝোঁক। হয় এদের হাতে কাঁচা পয়সা খুব বেশি অথবা অন্য কোনও পাপপুণ্যজনিত গর্হিত কারণ। আছে কিংবা দুটোই। এরা ভিখারি খুঁজে, ভিখারি ডেকে ভিক্ষা দেয়।
ভিক্টোরিয়ার প্রধান গেটের উলটো দিকে একটা অশ্বথ গাছের নীচে একটা ইট বাঁধানো বেদি আছে। ময়দানে এলে অনেক সময় এই বেদিটার ওপর বসি। জায়গাটা এমনিতে সুন্দর। সামনে বিশাল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, তার ওপারে আলোঝলমল এসপ্ল্যানেড। ডাইনে চৌরঙ্গির উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। কাঁচের জানলা দিয়ে সেই আলোর রেশ শহরকে মোহময়ী করে তুলেছে।
বেদিটার ওপর বসতে গিয়ে দেখি একপাশে একটা লোক আগাগোড়া র্যাপার মুড়ি দিয়ে বসে রয়েছে। সে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সদর গেটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। লোকটার বসার ভঙ্গি, ঘাড় বাঁকানোর ভঙ্গি কেমন যেন খুব চেনা চেনা মনে হল।
বুঝলাম লোকটাও আমাকে চিনতে পেরেছে। হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বসে বলল, কীরে, সন্ধ্যাবেলা ময়দানে কী করছিস?
গলার স্বর শুনে স্পষ্টই চিনতে পারলাম। আমার পুরনো বন্ধু সিদ্ধেশ্বর। সে আমাকে যে প্রশ্ন করেছে সেই একই প্রশ্ন আমিও তাকে করতে পারতাম, তা না করে র্যাপার-আবৃত অবয়বের দিকে তাকিয়ে বললাম, খুব শীত পড়েছে।
সিদ্ধেশ্বর উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, যা, ইয়ার্কি করিস না। জানিস না ঠান্ডায় আমি কষ্ট পাই। আর এই নতুন ঠান্ডাতেই সবচেয়ে বেশি বেকায়দা হয়।
আমি বললাম, তা হলে ঠান্ডায় ময়দানে বসে আছিস কেন? সিদ্ধেশ্বর জবাব দিল, উপায় নেই। পেটের দায়ে এই কাজ করতে হচ্ছে। র্যাপারটা সেজন্যেও দরকার।
পেটের দায়ে ময়দানে গাছের নীচে চাদরমুড়ি দিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে শুনে আমি একটু চিন্তিত হলাম। এ আবার কী ধরনের পেটের দায়? সিদ্ধেশ্বর কি গোয়েন্দাগিরি কিংবা স্পাইং শুরু করেছে। নাকি? কাউকে অনুসরণ করছে, কারও দিকে নজর রাখছে? সিদ্ধেশ্বরের পেটের দায়ের আগের ধান্দাগুলো কিছু কিছু জানি। সেজন্যে আরও চিন্তায় পড়লাম।
এবারে সে কুকুরের বাচ্চার ব্যবসা করেছিল। এমন যে আমি ওর এত পুরনো বন্ধু আমার কাছেও ও একটা বাচ্চা বিক্রি করেছিল। আমাদের বাড়িতে এখন যে বুড়ো পাজি কুকুরটা রয়েছে, যেটাকে স্নান করাতে গিয়ে আজই গলদঘর্ম হয়েছি, সেটাই সিদ্ধেশ্বর আমাকে গছিয়ে দিয়েছিল।
কুকুর বেচে লাভ করার একটা সহজ এবং চমৎকার পন্থা আবিষ্কার করেছিল সিদ্ধেশ্বর। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, ফোর্টের সামনে গঙ্গার ধারে শীতের মরশুমে বেদেরা আসে পাহাড়ি কুকুর নিয়ে। সেই সব কুকুরের ছানা তারা যার কাছে যেরকম পারে সেইরকম দামে বিক্রি করে।
সিদ্ধেশ্বর করেছিল কী, সেখান থেকে সস্তায় কুকুরছানা নিয়ে এসে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে উচ্চবংশের কুকুর বলে চড়া দামে বেচত।
শেষরক্ষা করতে পারেনি। কারণ তার লোভ বেড়ে যায়। রাস্তা থেকে নেড়ি কুকুরের ছানা কুড়িয়ে বা চুরি করে এনে বেশি দামে বেচতে থাকে। খুব ছোট কুকুরছানার জাতগোত্র বিচার করা। কঠিন। সব ছানারই কান ঝোলা, ঝকমকে লোম। এক পুলিশ সাহেবের মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের কাছে। এরকম একটা কুকুরছানা বিক্রি করে গুরুতর বিপদে পড়েছিল সিদ্ধেশ্বর। তারপর ও লাইন ছেড়ে দেয়।
সিদ্ধেশ্বরের পরের লাইন ছিল আরও গোলমেলে। সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে যেসব দলিল। রেজিস্ট্রি করা হয় তার মধ্যে গোলমেলে দলিল থাকে কিছু। সেসব দলিলের সাক্ষী কেউ হতে চায় না। বেশ কিছুকাল সিদ্ধেশ্বর ওইরকম সব দলিলের পেশাদার সাক্ষী হয়ে রুজিরোজগার করেছে। তারপর বহুদিন কোথায় বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। জেলে-টেলেও গিয়ে থাকতে পারে, কিছুই আশ্চর্য নয়।
আজ আবার অনেকদিন পরে সিদ্ধেশ্বরের সঙ্গে ময়দানে এইখানে দেখা হয়ে গেল। তবে। আজকে সিদ্ধেশ্বরের সমস্যাটা কী সেটা ভাল বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য বেশিক্ষণ মৌন থাকার পাত্র সিদ্ধেশ্বর নয়। সে নিজে থেকেই মুখ খুলল। সহসা খেদোক্তি করল, ভিখারিরা যে এত জোচ্চোর হয় একথা কি আগে কোনওদিন বুঝতে পেরেছিলাম।
তার কথা শুনে একটু বিচলিত হলাম। ভিখারিরা জোচ্চুরি করবে তার সুযোগ কোথায়? তারা তো কিছু দেয়া-নেয়া, কেনা-বেচা করে না। তাদের সঙ্গে আমাদের শুধু প্রদানের সম্পর্ক, আদানপ্রদানের নয়। এক্ষেত্রে প্রতারণা বা জোচ্চুরির সুযোগ কোথায়?
আমার বিমূঢ় এবং চিন্তাশীল ভাব দেখে সিদ্ধেশ্বর বলল, তুই বিশ্বাস করছিস না? কী করে বিশ্বাস করবি বল? তোর তো আর নিজের অভিজ্ঞতা নেই?
এরপর একটু থেমে থেকে, একটু দম নিয়ে, একটু দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে সিদ্ধেশ্বর বলল, আমার কথা শোন। এই দেড় মাসে আমার ঢের অভিজ্ঞতা হয়েছে। জানিস আমার এখন এগারোটা ভিখারি।
দেড় মাস এবং এগারোটা ভিখারি এই দুটো জিনিস আমার মোটেই হৃদয়ঙ্গম হল না। আমি আরও হতবাক হয়ে গেলাম।
সিদ্ধেশ্বর নিজের মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আমার এগারোটা ভিখারি, এগারোটাই ডিসঅনেস্ট। সবকয়টা পুরো জোচ্চোর। চাবকিয়ে সিধে করে দিলে মনে শান্তি হয়।
অসাধু ভিখারিদের শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধেশ্বরের খুব উত্তেজনা ও আগ্রহ দেখে আমি আরও চিন্তিত হলাম, কী জানি ব্যাপারটা কী। সিদ্ধেশ্বর বোকা নয়, কখনওই বোকা ছিল না। সে আমার বোঝবার অসুবিধেটা বোধহয় আন্দাজ করেছিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, আয়, আমার সঙ্গে আয়। আমি কিছুটা কৌতূহলবশত এবং বাকিটা কোনও কিছু এই মুহূর্তে করার না থাকায় বিনা বাক্যব্যয়ে সিদ্ধেশ্বরকে অনুসরণ করলাম। রাস্তা পার হয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেটের ভেতরে ঢুকে গিয়ে পাঁচিলের ওপারে আড়াল থেকে আঙুল দিয়ে দুজন ভিখারিকে দেখিয়ে সিদ্ধেশ্বর আমাকে বলল, এ দুটো আমার ভিখারি।
আমি কিছুই না বুঝে সিদ্ধেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নির্বিকার সিদ্ধেশ্বর বলে চলল, আমার আর দুটো ভিখারি আছে ওই দিকে উত্তরের গেটে আর ওপাশে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনের গেটে দুজন। এই হল মোট ছজন।
সিদ্ধেশ্বর আমার দিকে গর্বিত ভাবে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল। এ অবস্থায় বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা মানায় না। আমি আর কী বলব, গম্ভীর হয়ে বললাম, হিসেব ঠিক আছে?
সিদ্ধেশ্বরও গম্ভীর হল, বলল, ইয়ার্কি নয়। পুরো হিসেবটা এখনও হয়নি। এগারোটার মধ্যে গেল ছয়টা। আরও হাতে রইল পাঁচটা। এই পাঁচটার মধ্যে দুটোকে রেখেছি রবীন্দ্রসদনের সামনে। আরও তিনটে কালীঘাটে।
কথার পিঠে কথা জোগানোর জন্যেই আমি বললাম, কালীঘাটে?
সিদ্ধেশ্বর বলল, আরে সেটাই তো হয়েছে সমস্যা। শনিবার বিকেলে কালীঘাটে ভিক্ষের মার্কেট যেরকম, ভিক্টোরিয়ার এদিকটাতেও তাই। দুদিক সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়।
এতক্ষণে আমি অল্প অল্প বুঝতে পারছিলাম সিদ্ধেশ্বরের সমস্যাটা। তখনও সিদ্ধেশ্বর আমাকে বোঝাচ্ছে, অথচ শুক্রবারের দুপুরে কোনও ঝামেলা নেই। দুপুরবেলা বড় নামাজের সময় দুটো। ট্যাক্সি করে সবকটাকে নাখোদা মসজিদের সামনে নামিয়ে দিই। রোববারের সকালেও তাই, চারটে গির্জা আর দুটো কবরখানায় একজন করে যায়। বাকি পাঁচজনের ছুটি। প্রত্যেককে সপ্তাহে দেড় দিন ছুটি দিতে হয়।
আমি গোঁ ধরে বললাম, সপ্তাহে দেড় দিন ছুটি?
গর্জন করে উঠল সিদ্ধেশ্বর, শুধু দেড় দিন ছুটি নয়। দৈনিক দশ ঘণ্টা ডিউটি। মিনিমাম ওয়েজ আইন মেনে প্রত্যেককে আঠারো টাকা সত্তর পয়সা করে দিতে হবে। এ ছাড়া স্পেশাল মজুরি।
এতক্ষণে আমি একটা আসল প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ওদের তুই টাকা দিতে যাবি কেন? ওরা তো যে যার মতো ভিক্ষেই পাচ্ছে।
সিদ্ধেশ্বর অনেকদিন পরে আমার মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, তোর কবে বুদ্ধি হবে? ওই ভিক্ষের পয়সাগুলো তো আমার। ওদের তো আমি মাইনে করে রেখেছি। এগারোটা লোকের দৈনিক দুশো টাকার ওপর মাইনে দিতে হয়। তার ওপরে গাড়িভাড়া, বাস হোক, ট্যাক্সি হোক।
সাতটা বাজতে খুব বেশি বাকি নেই। আর একটু পরেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাইরের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। সিদ্ধেশ্বর আমাকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে দক্ষিণ দিকের গেটের অভিমুখে নিয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে সিদ্ধেশ্বর আমাকে বোঝাচ্ছে, সবচেয়ে শয়তান হল ওই খোঁড়া ভিখারিগুলো। খোঁড়া কি খোঁড়া নয় কে জানে, বলে ট্যাক্সি ছাড়া চলব না।
এরপর কিছু একটা ভেবে সিদ্ধেশ্বর আমাকে বলল, তুই খোঁড়া ভিখারিদের নিয়ে কী যেন লিখেছিলি? আমার লেখা নিয়ে উৎসাহ দেখানোর লোক বিরল। সুতরাং ভিখারির প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন উঠতেই আমি সায় দিলাম। সিদ্ধেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, কী যেন গল্পটা?
আমি গল্পটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, আসলে ব্যাপারটা কিছু নয়। একটা খোঁড়া ভিখারি অন্ধ সেজেছে আর অন্ধ ভিখারি গেছে সিনেমা দেখতে। কথা হল খোঁড়াও প্রকৃত খোঁড়া নয়, অন্ধও অন্ধ নয়।
আমার কথা শুনে খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল সিদ্ধেশ্বর, পিঠ চাপড়িয়ে বলল, তুই প্রবলেমটা ঠিক ধরেছিলি। জানিস কানা খোঁড়া এদের রেট ডেইলি পঁচিশ টাকা। কিন্তু টাকাটা দিতে হয়, কারণ রিটার্ন বেশি আসে।
আমার কিছু বলার নেই। আমি নিঃশব্দে তার কথা শুনে যেতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধেশ্বর কথা বলে যাচ্ছে, জানিস, ভাল একটা মেয়েছেলে ভিখারির রেট তিরিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা!
আমি বললাম, তা জানি না। তবে মেয়েছেলে ভিখারির একটা গল্প জানি। মেয়েছেলে ভিখারি বিষয়ে সিদ্ধেশ্বরের খুব উৎসাহ দেখা গেল। আমি গল্পটা ছোট করে বললাম।
গৃহস্থের বাড়িতে ভিখারি ভিক্ষা চাইতে গেছে। গৃহস্থ বলছে, এখন ভিক্ষা হবে না। এখন বাড়িতে মেয়েছেলে নেই। ভিখারি বলল, কর্তা আমি তো মেয়েছেলে চাইছি না। দু পয়সা ভিক্ষা চাইছি।
এত ভাল গল্পটা শুনে কিন্তু সিদ্ধেশ্বর মোটেই খুশি হল না। ততক্ষণে দক্ষিণ দিকের গেটে পৌঁছে গেছি। হঠাৎ র্যাপারে আগাগোড়া মাথাসুদ্ধ শরীর ঢেকে সিদ্ধেশ্বর এগিয়ে গিয়ে একটু আড়াল থেকে তার নিয়োজিত ভিখারিদের পর্যবেক্ষণ করল। তারপর ফিসফিস করে আমাকে বলল, এ দুটোই একদম আলসে। একটু চেঁচাতে হবে, বাটিতে পয়সা বাজাতে হবে। নাকিসুরে কাঁদতে হবে, তবে না লোক পয়সা দেবে। দুটোকেই কাল ছাড়িয়ে দেব। একটু থেমে পরামর্শ চাওয়ার ভঙ্গিতে সিদ্ধেশ্বর আমাকে বলল, ভাবছি এবার একটা লেপার ব্যান্ড করব!
আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবু ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞাসা করলাম, লেপার ব্যান্ড আবার কী?
লেপার ব্যান্ড জানিস না? খুবই অবাক হয়ে গেল সিদ্ধেশ্বর। ওই যে চৌরঙ্গি পাড়ায় ব্যান্ড বাজিয়ে টুপি মাথায়, পায়ে কেডস জুতো, নাক থ্যাবড়া কালো কুষ্ঠ রোগীরা নেচে পয়সা তোলে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, সেই লেপার ব্যান্ড তুই কী করে করবি?
আমার অজ্ঞতা ব্যথিত করল সিদ্ধেশ্বরকে। সে বলল, ও তো সোজা ব্যাপার। যাত্রা পার্টির মতো। আমাদের লাইনে ওর নাম হল কুষ্ঠ অপেরা।
আমি বিস্ময়োক্তি করতে বাধ্য হলাম, কুষ্ঠ অপেরা।
সিদ্ধেশ্বর বলল, কিন্তু খুব খরচ। লাভ আছে বটে তবে ওরকম একটা দল বানাতে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা লেগে যায়। তারপরে থানা পুলিশ আছে।
আমার এবার বাড়ি ফেরার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া জ্ঞানলাভও যথেষ্ট হয়েছে। সিদ্ধেশ্বরকে বললাম, আমি এখন যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুই আর কতক্ষণ?
সিদ্ধেশ্বর বলল, আমার যেতে রাত দশটা। আজ শনিবার, অনেক মাতাল আসবে এদিকে। মাতালেরা খুব ভাল ভিক্ষে দেয়। দশ টাকা, একশো টাকার নোট পর্যন্ত দেয়। এই ভিখারিগুলো যা। চোর–চোখের আড়াল হলেই লুকিয়ে রাখবে। ইটের নীচে চাপা দেবে, গাছের ফোঁকরে গুঁজে রাখবে। ওদের শরীরের মধ্যেও অনেক লুকোনোর জায়গা। কী আর বলব, হাজার সার্চ করেও বার করা যাবে না!
এত দুঃখ ও সমস্যার কথা শুনে লাভ নেই। আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। আমার সঙ্গে সিদ্ধেশ্বর রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত এল। এখানে ওর আরও দুটো ভিখারি আছে। তারা শো ভাঙা পর্যন্ত ডিউটি দেবে। সিদ্ধেশ্বর দুঃখ করে জানাল, আটটার পর ঘণ্টা ধরে ওভারটাইম দিতে হয়।
একেবারে শেষ মুহূর্তে একটা প্রশ্ন করল সিদ্ধেশ্বর, তুই এখন কী করছিস?
সত্যি কথা বললাম, তেমন কিছু নয়।
এইবার আসল প্রস্তাবটা দিল সিদ্ধেশ্বর, আয় দুজনে মিলে একটা লেপার ব্যান্ড করি। ফিফটি ফিফটি শেয়ার। দুজনেই নামব। আট-দশটা লোক। গায়ে একটু মবিল আর আলকাতরা, দু-একটা। কালো ব্যান্ডেজ। আমি আর তুই ড্রাম বাজাব, বাকিরা নাচবে। দুপুরে সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিট চৌরঙ্গিতে। ভাল লাগবে। লাভও খুব।
প্রস্তাবটা লোভনীয়। সিদ্ধেশ্বকে সরাসরি না করতে পারলাম না। বললাম, বিবেচনা করে দেখব। বাড়ি ফেরার পথে বুঝলাম ঠান্ডা শুরু হয়েছে। সিদ্ধেশ্বরের মতো ব্যাপার না হোক, আমার অন্তত একটা মাফলার দরকার।